Class 10 Social Science Chapter 3 অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ

Class 10 Social Science Chapter 3 অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 10 Social Science Chapter 3 অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ and select needs one.

Class 10 Social Science Chapter 3 অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ

Join Telegram channel

Also, you can read SCERT book online in these sections Class 10 Social Science Chapter 3 অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 10 Social Science Chapter 3 অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 10 Social Science Chapter 3 অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ for All Subject, You can practice these here..

অসমে ব্রিটিশ বিরোধী জাগরণ এবং কৃষক বিদ্রোহ

               Chapter – 3

প্রথম খণ্ড – ইতিহাস

অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর

● অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও

প্রশ্ন ১। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অসমের রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতির কী পরিবর্তন হয়েছিল ? 

উত্তরঃ মুদ্রার ব্যবহারে অসমের রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছিল । ইংরেজের প্রবর্তিত টাকার মাধ্যমে মাটির খাজনা এবং অন্যান্য কর সংগ্রহ ব্যবস্থাই অসমীয়া প্রজার শোচনীয় অবস্থা করে তুলেছিল । 

প্রশ্ন ২। কোন সালে মোফট মিলস অসমে এসেছিলেন ? 

উত্তরঃ ১৮৫৩ সালে । 

প্রশ্ন ৩। কেঞা কারা ছিল ? 

উত্তরঃ কেঞাগণ ছিল সুদখোর মহাজন । অসমীয়া জনসাধারণ এই সুদখোর মহাজন থেকে অধিক সুদে টাকা ধার করে হলেও ভূমি রাজস্ব সরকারকে দিতে বাধ্য হয়েছিল । এই মহাজন শ্রেণি ছিল বহিরাগত ব্যবসায়ী , মারোয়ারি ( কেঞা ) এবং বাঙালি মহাজন । 

প্রশ্ন ৪। অসমে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে কে নেতৃত্ব দিয়েছিল ? 

উত্তরঃ মণিরাম দেওয়ান । 

প্রশ্ন ৫। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অসমের বিদ্রোহীরা কোন আহোম রাজকোঅরকে পুনরায় সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিল ? 

উত্তরঃ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অসমের বিদ্রোহীগণ কন্দপেশ্বর সিংহকে পুনরায় সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিল ।

প্রশ্ন ৬। মণিরাম দেওয়ানকে কোন বাঙালি মোক্তার সাহায্য করেছিল ? 

উত্তরঃ মণিরাম দেওয়ানকে মধু মল্লিক নামক একজন বাঙালি মোক্তার সাহায্য করেছিল । 

প্রশ্ন ৭। মণিরাম দেওয়ানের সঙ্গে আর কাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়েছিল ? 

উত্তরঃ মণিরাম দেওয়ানের সঙ্গে পিয়লি বরুয়াকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়েছিল । 

প্রশ্ন ৮। মণিরাম দেওয়ানের বিচার করেছিল কে ? 

উত্তরঃ ক্যাপ্টেইন হলরয়ড সাহেব মণিরাম দেওয়ানের বিচার করেছিল । 

প্রশ্ন ৯। অসমের ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের বিফলতার দুটো কারণ উল্লেখ করো । 

উত্তরঃ অসমের ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের বিফলতার দুটো কারণ হল ―

( ১ ) মণিরাম দেওয়ানের সমর্থকগণ শুধু যোরহাট ও শিবসাগরে সীমাবদ্ধ ছিল । নগাঁও , কামরূপ ও গুয়াহাটিতে বিশেষ সমর্থন লাভ করেনি । 

( ২ ) বিদ্রোহের নেতাদের সময় জ্ঞান ছিল না , কেন না তাঁরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সময়মত কার্য সম্পন্ন করেনি । যার ফলে ইংরাজ সরকার প্রতিরক্ষার প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল । 

প্রশ্ন ১০। কোন কোন সালে টিকিট কর আর আয়কর প্রবর্তন করা হয়েছিল ? 

উত্তরঃ ১৮৫৮ সালে টিকিট কর ও ১৮৬০ সালে আয়কর প্রবর্তন করা হয়েছিল । 

প্রশ্ন ১১। ব্রিটিশের শাসনকালে অসমের কৃষকের দুরবস্থার দুটো কারণ লেখো । 

উত্তরঃ ব্রিটিশের শাসনকালে অসমের কৃষকের দুরবস্থার দুটো কারণ হল ― 

( ১ ) কৃষির উপরে ব্রিটিশগণ বিভিন্ন ধরনের কর প্রবর্তন করেছিল । ফলে কৃষক বিদ্রোহ কৃষকগণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । 

( ২ ) ব্রিটিশ সরকারে চরাঞ্চল বা চরভূমিতে গ্রেজিং কর , আবকারী কর ইত্যাদি প্রবর্তন কর ছাড়াও নদীতে সোনা সন্ধান, মাছ ধরা ইত্যাদির জন্য নদীর ‘ ডাক ’ এ ( ইজারা ) দেওয়ার ফলে কৃষকদের অবস্থা অতি শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার কৃষি তথা কৃষকদের উন্নতিকল্পে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি । 

প্রশ্ন ১২। লেফটেনান্ট সিঙ্গার কে ছিলেন ? 

উত্তরঃ লেফটেনান্ট সিঙ্গার ছিলেন নগাঁওয়ের সহকারী উপায়ুক্ত । 

প্রশ্ন ১৩। ফুলগুরির ধাওয়া কখন সংঘটিত হয়েছিল ? 

উত্তরঃ ১৮৬১ সালে । 

প্রশ্ন ১৪। রঙিয়ার কৃষক বিদ্রোহ কখন সংঘটিত হয়েছিল ? 

উত্তরঃ রঙিয়ার কৃষক বিদ্রোহ ১৮৯৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সংঘটিত হয়েছিল । 

প্রশ্ন ১৫। লচিমা কোথায় অবস্থিত ? 

উত্তরঃ বরপেটা জেলার সরুক্ষেত্রী মৌজায় লচিমা অবস্থিত । 

প্রশ্ন ১৬। লচিমার কৃষক বিদ্রোহ কখন সংঘটিত হয়েছিল ? 

উত্তরঃ ১৮৯৪ সালে । 

প্রশ্ন ১৭। পথরুঘাটের কৃষক বিদ্রোহ কখন হয়েছিল ? 

উত্তরঃ ১৮৯৪ সালের জানুয়ারী মাসে পথরুঘাটের কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল । 

প্রশ্ন ১৮। ১৮৬১ সালে জয়ন্তীয়া বিদ্রোহের নেতৃত্ব কে দিয়েছিল ? 

উত্তরঃ ওকিয়াং নংবাহ । 

প্রশ্ন ১৯। ১৮৮১ সালে উত্তর কাছাড়ের জনজাতীয় বিদ্রোহের নেতৃত্ব কে দিয়েছিল ? 

উত্তরঃ ১৮৮১ সালে উত্তর কাছাড়ের জনজাতীয় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সম্বোধন কছারি ।

প্রশ্ন ২০। টিকেন্দ্রজিতকে কে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল ? 

উত্তরঃ বি . ডব্লিউ . মর্টনে টিকেন্দ্রজিতকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল । 

প্রশ্ন ২১। জে . ডব্লিউ . কুইন্টনকে কোন সালে হত্যা করা হয়েছিল ? 

উত্তরঃ ১৮৯০ সালে । 

দীর্ঘ উত্তর লেখো

প্রশ্ন ১। ১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো । 

উত্তরঃ ১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহের কারণগুলি নীচে উল্লেখ করা হল— 

( ১ ) রাজনৈতিক কারণ :- আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ১৮৫৭ সাল উল্লেখযোগ্য বছর । ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি যেমন — লর্ডওয়েলেসলির বশ্যতামূলক মিত্রতা নীতি , লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতি ইত্যাদি বিভিন্ন ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল । এই রাজ্যগুলোর বঞ্চিত শাসকদের সঙ্গে তাদের সমর্থ করা ও ভারতীয় সৈন্যরা যখন তাদের বিভিন্ন দুর্দশার প্রতিবাদে ১৮৫৭ সালের ১০ মে তারিখে মিরাটে বিদ্রোহ ঘোষণা করে , তখন অসমের সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বিদ্রোহ অধিক শক্তিশালী করে তুলেছিল । কারণ ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে অসমীয়া জনসাধারণ জাগরিত হয়ে উঠেছিল । 

( ২ ) ভূমি রাজস্ব ও মুদ্রা অর্থনীতি :- ব্রিটিশ সরকারের নতুন ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধির নীতি এবং মুদ্রা অর্থনীতি অসমীয়া আমজনতার মনে তীব্র অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছিল । ১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহের একটি কারণ । এই মুদ্রা অর্থনীতি অসমে সুদখোর মহাজন শ্রেণির সৃষ্টি করেছিল এবং অসমীয়া প্রজা এই সুদখোর মহাজন শ্রেণির কাছ থেকে টাকা ধার করে হলেও ভূমি রাজস্ব ইংরাজ সরকারকে দিতে বাধ্য হয়েছিল । এই মহাজন শ্রেণি ছিল বহিরাগত ব্যবসায়ী , মারোয়ারী ( কেঞা ) এবং বাঙালি মহাজন । ভূমির খাজনাই যে অসমীয়া মানুষের অর্থিক অবস্থা শোচনীয় করেছিল সেই কথা আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকনও উল্লেখ করেছিলেন ।

( ৩ ) অভিজাত শ্রেণির বিদ্রোহ :- সাধারণ শ্রেণির মানুষের দুর্বল অবস্থার বিপরীতে অভিজাত শ্রেণির লোকদের অবস্থাও ভাল ছিল না । নতুন প্রশাসন ব্যবস্থায় আহোম সামস্তরীয় শ্রেণির একাংশ আরম্ভ থেকে জড়িত হয়ে পড়েছিল যদিও সেই শ্রেণির অনেক লোক কর্মসংস্থান হীন হয়ে পড়েছিল । অন্যদিকে ইংরাজ শাসকও প্রশাসন কার্য চালনার জন্য আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি লোককে প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য নিয়োগ করে । ফলে অসমের পূর্বের আহোম সামস্তরীয় লোকগণ দ্রুত হারে কর্মসংস্থান হীন হয়ে পড়ে এবং তারা বিদ্রোহী হয়েছিল । 

( ৪ ) দাস প্রথার নিষিদ্ধকরণ :- ১৮৪৩ সালে অসমে ইংরাজরা দাসপ্রথার বিলোপ সাধন করে । পরিণামে ব্রাহ্মণ , পুরোহিত বা অন্যান্য অভিজাত শ্রেণির লোকগণ সাধারণ মানুষে পরিণত হয় । সুতরাং এই শ্রেণির লোকেরাও ইংরেজ শাসনের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে পড়েছিল । 

( ৫ ) সামাজিক সংস্কার :- সতীদাহ প্রথার বিলোপ , বিধবা বিবাহের প্রবর্তন প্রভৃতি সমাজ সংস্কারের ফলে অসম তথা ভারতবর্ষের মানুষের মনে ভয় ও সন্দেহ দেখা দেয় । স্বাভাবিক কারণেই অসমীয়া জনগণ মনে করে যে ব্রিটিশ সরকার তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি ধ্বংস করছে । ফলে অসমের জনগণের মনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। 

এইভাবে দেখা যায় যে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পূর্বে ইংরেজ কোম্পানীর শাসন অসমের জনগণের কোনো অংশটিকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি এবং এর ফলে ১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল । 

প্রশ্ন ২। অসমে ১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহে মণিরাম দেওয়ানের ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো । 

উত্তরঃ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় অসমে বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন পূর্বতন দিনের রাজা বরবরুয়া মণিরাম দেওয়ান । তিনি প্রথমে তহশীলদার এবং পরে সেরেস্তাদার হয়েছিলেন । মণিরাম ইস্ট – ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একজন কর্মঠ বিষয়া ছিলেন । ১৮৩৯ সালে তিনি অসম চা কোম্পানীর বিষয়া নিযুক্ত হয়েছিলেন । পরে ওই কাজ ত্যাগ করে যোরহাটের চেনিমরাতে নিজে একটি চা বাগান শুরু করেন । শিবসাগরের ব্রিটিশ অধিকর্তা টোডী মণিরামকে অন্যান্য ইউরোপীয়দের ন্যায় চা – বাগানের জমির ক্ষেত্রে সুযোগ – সুবিধা দিতে অস্বীকার করে এবং প্রাচীনকালের ভোগ করা অন্যান্য সুযোগ – সুবিধা বাতিল করে । ফলে মণিরামের পরিবার ভীষণ অসুবিধায় পড়ে । আর্থিক সংকট দূর করতে মণিরাম ইংরেজদের স্মরণাপন্ন হন এবং কন্দর্পেশ্বর সিংহকে আবার আহোম রাজা করবার আবেদন জানান । 

মণিরামের আবেদন অসমে নাকচ হলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের উচ্চমহলে আর্জি পেশ করার জন্য কলকাতায় গমন করে গভর্নর জেনারেলের নিকট আবেদন করেন । এরই মধ্যে ১৮৫৭ সালের ১০ ই মে মিরাটে সিপাহী বিদ্রোহ আরম্ভ হলে মণিরাম অসমকে স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করার চিন্তা করতে থাকলেন । দূত মারফত অসমে তাঁর অনুচরদেরকে খবর প্রেরণ করেন । তাঁর পরিকল্পনা ছিল সিপাহীদের সহযোগে অসমে মুষ্টিমেয় ইংরেজ শাসককে শেষ করে তিনি কন্দর্পের্শ্বর সিংহকেই অসমের রাজা করবেন । এই মর্মে তিনি কন্দর্পেশ্বর সিংহ ও পিয়লি বরুয়াকে পত্র লেখেন । এর পরই অসমের গুয়াহাটি , যোরহাট , ডিব্রুগড় , গোয়ালপাড়ায় সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব জেগে উঠে । সর্বপ্রথম গোলাঘাটের সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে কলকাতা থেকে ইংরেজ সামরিক অফিসারগণ এসে বিদ্রোহ দমন করেন । 

এদিকে পিয়লি বরুয়া এবং কন্দর্পেশ্বর সিংহকে লিখিত মণিরামের চিঠি উদ্ধার করে হরনাথ পর্বতীয়া এটি শিবসাগরের উপায়ুক্ত ক্যাপ্টেন হলরইদকে প্রদান করলে ১৮৫৭ সালের ৭ ই সেপ্টেম্বর মধ্যরাত্রিতে কন্দর্পেশ্বর সিংহকে বন্দী করে বর্ধমানে নির্বাসন দেওয়া হয় । মণিরাম দেওয়ানকেও কলকাতায় বন্দী করা হয় । সঙ্গে সঙ্গে পিয়লি বরুয়া , মায়ারাম নাজির , পতিরাম বরুয়া , মধু মল্লিক , বাহাদুর গাঁওবুড়া , মরঙ্গীঘোরা গোঁহাই , করমুদ আলী প্রমুখকে বন্দী করা হয় । বিদ্রোহী সিপাহীদের বরখাস্ত করা হয় এবং কয়েকজনকে নির্বাসনও দেওয়া হয় । ১৮৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বিদ্রোহীদের বিচারকার্য সম্পন্ন হয় । শিবসাগরের উপায়ুক্ত ক্যাপ্টেন চার্লস হলরইদ মণিরাম দেওয়ান এবং পিয়লি বরুয়াকে ফাসির আদেশ দেন । ১৮৫৮ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে যোরহাটে মণিরাম দেওয়ান ও পিয়লি বরুয়াকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয় । 

প্রশ্ন ৩। কি কি কারণে অসমে ১৮৫৭-৫৮ সালের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল আলোচনা করো । 

উত্তরঃ অসমে ১৮৫৭-৫৮ সনের বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো নীচে আলোচনা করা হল— 

( ১ ) অসমে বিদ্রোহীদের সংখ্যা খুবই কম ছিল । মণিরাম দেওয়ানের সমর্থ করা যোরহাট ও শিবসাগরে সীমাবদ্ধ ছিল । নগাঁও , কামরূপ ও গুয়াহাটিতে বিশেষ সমর্থন লাভ করেনি । 

( ২ ) বিদ্রোহের নেতাদের সময় জ্ঞান ছিল না , কেন না তাঁরা প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেও সময়মত কার্য সম্পন্ন করেনি । যার ফলে ইংরাজ সরকার প্রতিরক্ষার প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল । 

( ৩ ) বিদ্রোহের মুখ্য সংগঠক মণিরাম দেওয়ান বিদ্রোহস্থল থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থান করেছিলেন । সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা অসম থেকে বহু দূরে অবস্থিত ছিল এবং সেখান থেকে চিঠি – পত্রের মাধ্যমে বা নির্দেশ পাঠিয়েই বিদ্রোহ পরিচালিত করাটা বাস্তবসম্মত ছিল না । মণিরাম দেওয়ান যতটা শীঘ্র পারেন কলকাতা থেকে ফিরে আসা উচিত ছিল । প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকলেও বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয় দক্ষতা দেওয়ানের ছিল না । বিদ্রোহের নেতৃত্ব যিনি দেন তিনি প্রতিপক্ষকে দুর্বল বলে অবজ্ঞা করা বা ক্ষমতা তথা বুদ্ধিমত্তাকে হেয় জ্ঞান করলে কী পরিণাম হয় মণিরাম দেওয়ান তার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন । 

( ৪ ) সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষকে বিদ্রোহে জড়িত করতে মণিরাম দেওয়ান তথা তাঁর সহযোগীগণ কোনো প্রচেষ্টা হাতে নেয়নি । নগাঁও ও গুয়াহাটিতে অসমের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকগণের বিদ্রোহের প্রতি সামান্যও সহানুভূতি ছিল না । সেই সময় নতুন করে বিকশিত মধ্যবিত্ত অসমীয়া বুদ্ধিজীবী শ্রেণির লোকেরা বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনধারার প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিল । পুরানো আহোম রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে পুনরায় ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তাঁদের ছিল না । তাই ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অসমের এই শ্রেণির লোক কোনো সমর্থন বা সহানুভূতি প্রদর্শন করেনি । ফলে অসমে বিদ্রোহের উন্মেষ ঘটেছে , বিস্ফোরণ ঘটতে পারে নি । 

( ৫ ) অসমের বিদ্রোহীরা তাঁদের কার্যপস্থার গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিলেন । ফলে সমগ্র পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকার অবগত হয়েছিল এবং বিদ্রোহ নির্মূল করতে সরকার সফল হয়েছিল । 

( ৬ ) অসমের বিদ্রোহীরা প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্র – শস্ত্রের যোগান পায়নি । মণিরাম দেওয়ান যদিও অস্ত্রের যোগান দেওয়ার কথা বলেছিলেন , কিন্তু তাঁর আগেই তিনি ধরা পড়ে যান । 

( ৭ ) ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তের মতো অসমে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত ভারতীয় সৈন্যই মূল চালিকাশক্তি হিসাবে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে নি । অসমের বিদ্রোহীরা মিরাট , দিল্লি , লক্ষ্ণৌ ইত্যাদির মতো সিপাহীদের সমর্থন আদায় করতে পারে নি । এই সকল কারণে অসমে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে নি । যাও একটুখানি হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণরূপে তা নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল । 

প্রশ্ন ৪। অসমে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো । 

উত্তরঃ অসমে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম । এর গুরুত্বগুলো নীচে আলোচনা করা হল— 

( ১ ) ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ যদিও ব্রিটিশ সরকার কঠোর হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছিল। অসমের ইতিহাসে প্রথম বারের জন্যে একটি সর্বভারতীয় ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে অসম জড়িত হয়েছিল । 

( ২ ) ১৮৬১ সাল থেকে অসমে আরম্ভ হওয়া সমূহ কৃষক বিদ্রোহ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহেরই প্রতিক্রিয়া । 

( ৩ ) অসমেও হিন্দু এবং মুসলমান এই দুই প্রধান সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে জাতীয়তা বোধের বিকাশে প্রেরণা সঞ্চার করেছিল । 

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ থেকে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যান্য সংগ্রামীর মতো অসমীয়া সংগ্রামীরাও মণিরাম দেওয়ান তথা সহযোগীদের কর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল । 

প্রশ্ন ৫। ফুলগুরি ধাওয়ার ওপর একটি টীকা লেখো । 

উত্তরঃ ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত কৃষক জনতা যে বিদ্রোহ করেছিল , অসমে প্রথম বিদ্রোহ হচ্ছে সেই ফুলগুরির ধাওয়া । নগাঁও থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত ফুলগুরি তিওয়া ( জনজাতি ) জনবসতিপূর্ণ একটি গ্রাম , যেখানে জনসাধারণ বৃহৎ পরিমাণে‘ আফু খেতি ‘ ( আফিম চাষ ) করত এবং তার দ্বারাই তারা জীবিকা নির্বাহ করত । ব্রিটিশ সরকার নিজের সুবিধামতো করে কানি ( আফিম , মাদক ) বিক্রী করতে গেলে ( আফু গুটি থেকে কানি , মাদক দ্রব্য প্রস্তুত করা হয় ) আফু চাষ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেছিল সেই ফুলগুরি অঞ্চলের কৃষকরা বিক্ষুব্ধ হয়েছিল । ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার আফু চাষ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় । তাতে সমগ্র তিওয়া জনজাতির লোকেরা অতিশয় অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে , কারণ সরকারী কানির প্রচলন কিন্তু বন্ধ করা হয়নি । ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত এই সমস্ত লোকদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছিল । তদুপরি পান – সুপারির উপরও সরকার কর আরোপ করবে বলে 83 খবরে প্রকাশ পেয়েছিল । 

সরকার আফু চাষ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ১৮৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রায় ১৫০০ কৃষক তার প্রতিবাদ করার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ফুলগুরিতে রাইজমেল অনুষ্ঠিত করে । সেই সভায় কৃষকরা আফু চাষ বন্ধের যে নির্দেশ দিয়েছিল তা বাতিল করার জন্য এবং পান – সুপারির ওপর যাতে কোনো কর আরোপ না করা হয় সেই কথা উপায়ুক্তকে জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । সেই সময় নগাঁওয়ের উপায়ুক্ত ছিলেন লেফটেনান্ট হাবটি স্কন্স।তিনি জনতার আবেদনের প্রতি সমর্থন জানানো তো দূরের কথা , কৃষকদের প্রতি দুর্ব্যবহার করলেন । ক্ষুব্ধ জনতা এই অপমানের প্রতিবাদ করার জন্য ১৫ অক্টোবর থেকে পাঁচদিন ধরে ফুলগুরিতে রাইজমেল অনুষ্ঠিত করে । 

প্রথম দিন সমবেত প্রায় এক হাজার কৃষকের প্রায় অর্ধাংশই লাঠিসোঁটা নিয়ে সজ্জিত ছিল । এর পরবর্তী দিনগুলোতে প্রতিবাদীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করে । ১৮ অক্টোবর তারিখে সভায় প্রায় চার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিল । উপায়ুক্ত হার্বার্ট স্কন্স সহকারি উপায়ুক্ত লেফটেনান্ট সিঙ্গারকে সভাস্থলীতে পাঠিয়েছেন । সিঙ্গার সভার উদ্দেশ্য জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে জনতার মাঝখান থেকে জাতি কলিতা নামে একটি লোক সাহেবকে জানাল যে কর্তৃপক্ষ কৃষক জনতার দাবিগুলোর প্রতি ( আফু চাষ বন্ধ প্রত্যাহার , পান – সুপুরির ওপর থেকে কর প্রত্যাহার ইত্যাদি ) সাড়া না দেওয়ায় তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করবে । 

এই কথায় সিঙ্গার যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে জনতাকে সেই স্থান ত্যাগ করে যাবার নির্দেশ দেন । অধিকন্তু তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসা বাহিনীকে জনতার হাত থেকে লাঠিগুলো কেড়ে নেবার নির্দেশ দেন । লাঠির জন্য টানাটানি করলে জনতার মধ্য থেকে কাঁহিঘর মৌজার বাবু কৈবর্ত নামে একজন মাছুয়া সিঙ্গারের মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে মাটিতে ফেলে দেয় । অন্য কৃষকরাও সিঙ্গ রিকে আক্রমণ করলে সেখানে তার মৃত্যু হয় । সিঙ্গারের মৃতদেহ নদীতে ছুঁড়ে ফেলা হয় । সিঙ্গারের সঙ্গে যে পুলিশ বাহিনী গিয়েছিল তারা ভয়ে পালিয়ে যায় । এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় ফুলগুরি ধাওয়া নামে খ্যাত । 

প্রশ্ন ৬। ১৮৯৪ সালে উত্তর কামরূপে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো । 

উত্তরঃ ১৮৯৪ সালে উত্তর কামরূপের রঙ্গিয়া , লচিমা এবং দরং জেলার পথরুঘাট নামক তিনটি স্থানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল । 

রঙ্গিয়া বিদ্রোহ :- ফুলগুড়ি বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারের শোষণ নীতির উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি । এই বিদ্রোহ ইংরেজদের নূতন কর আরোপ করা বা রাজস্বের হার বাড়ানো থেকে বিরত রাখতে পারেনি । ব্রিটিশ সরকার সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দূর করার পরিবর্তে পুলিশ বাহিনীর শক্তি বাড়িয়ে তাদের ভীত করতে চেয়েছিল । অসমের স্থানে স্থানে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল । ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে অসমের চিফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড রাজস্ব কর থেকে আশি শতাংশ এমনকি কোনো কোনো স্থানে একশ শতাংশ বাড়ান । ফলে কামরূপ জেলার রঙ্গিয়ার জনগণ ‘ রাইজমেলের ’ আয়োজনের মাধ্যমে করবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন । ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে সেম্বর একদল উত্তেজিত জনতা রঙ্গিয়া বাজারে লুটতরাজ চালায় । ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই জানুয়ারি কয়েক হাজার মানুষ রঙ্গিয়া থানার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বর্ধিত খাজনা না দেওয়ার শ্লোগান দিয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলেন । ওই একই দিন কামরূপের জেলাশাসক ম্যাক ক্যাব সমস্ত রকম মেলের ( সমাবেশের ) উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন । সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনরত জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে ছত্রভঙ্গ করা হয়। ফলে অনেক মানুষ হতাহত হয় । ম্যাক ক্যাবের এই কার্য ছিল ঘৃণ্য এবং বর্বরতার চূড়ান্ত নিদর্শন । এইভাবে রঙ্গিয়া বিদ্রোহ দমন করা হয় । 

লচিমা বিদ্রোহ :- রঙ্গিয়া বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার গোর্খা রাইফেলসের সৈন্যসহ যথেষ্ট সংখ্যক সামরিক এবং পুলিশ বাহিনী নিম্ন অসমে মোতায়েন করেছিল । এতে ইংরেজরা কিছু সংখ্যক লোকের কাছ থেকে কর আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল । এদিকে ‘ রাইজমেল ’ আয়োজনের মাধ্যমে জনগণকে কর না দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছিল । ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে জানুয়ারি কামরূপ জেলার লাচিমার নিকটবর্তী কল্পা নামক স্থানে এক মারমুখী জনতা দুজন রাজস্ব আদায়কারীকে প্রচণ্ড মারধর করে । ফলে এদের মধ্যে একজনের পরে মৃত্যু ঘটে । ব্রিটিশ পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহীদের ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করে সেনাশিবিরে নিয়ে আসে । কিন্তু প্রায় আট হাজার লোক এইসব বন্দীদের মুক্তির দাবিতে সেনাশিবির ঘেরাও করে । বরপেটার মহকুমা শাসক মাধবচন্দ্র বরদলৈ এই ঘটনার সময় উপস্থিত থাকলেও উত্তেজিত জনতার ভয়ে মধ্যরাতে তিনি শিবির পরিত্যাগ করে জেলাশাসক ম্যাক ক্যাবের সহযোগিতা প্রার্থনা করেন । ২৫ শে জানুয়ারি জেলাশাসক ম্যাক ক্যাব ৫৯ জন রাইজমেলের দলপতিকে গ্রেপ্তার করে এদেরকে তাদের জন্য একটি কারাগার নির্মাণের কাজে লাগান । বিচার অপেক্ষাধীন বন্দীর ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যবহার আইন বহির্ভূত ছিল সেইদিন বিকালবেলা ছয় হাজার মানুষের উত্তেজিত জনতা বন্দীদের মুক্তির দাবিতে একত্রিত হন । জেলাশাসক গুলির আদেশ দিলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে । ইংরেজরা রাইজমেলের দলপতিদের বলদের মতো মাঠে হালচাষ করতে বাধ্য করে । এভাবে রাইজমেলের নেতাদের চূড়ান্ত অপমান করতে গিয়ে ইংরেজরা নিজেদের কু – কীর্তির পরিচয় তুলে ধরেছিল । 

পথরুঘাটের কৃষক বিদ্রোহ :- পথরুঘাটের জনতা ১৮৯৪ সালের জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি রাইজমেলের যোগে খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছিল । বর্ধিত হারে ভূমির খাজনা নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলদৈ মহকুমার কলাইগাঁও , মঙ্গ লদৈ , সিপাঝার এবং পথারুঘাটের কৃষকগণ সভায় মিলিত হয়েছিল । জানুয়ারী মাসের ২৬ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত তিন দিন জোড়া এক বৃহৎ গণসভা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু মহকুমাধিপতি , জিলাধিপতি জে . ডি . অ্যাণ্ডারসনকে সমাবেশ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল।পুলিশ মিলিটারির সাহায্যে খাজনা না দেওয়া কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া কার্য কৃষকদের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছিল । গণসভা পেতে কৃষকগণ একত্রিত হয়েছিল । উপায়ুক্ত অ্যাণ্ডারসন পুলিশ অধ্যক্ষকে শক্তি প্রয়োগ করে কৃষকদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

পুলিশ অধিক্ষক কৃষকদের শক্তি প্রয়োগ করে তাড়াবার চেষ্টা করলে কৃষকেরা উত্তেজিত হয়ে লাঠি উচিয়ে তেড়ে এল । সে অবস্থায় উপাযুক্ত অ্যাণ্ডারসন পুলিশ অধিক্ষককে গুলি চালনা করবার নির্দেশ দিলেন । ফলে বেসরকারী হিসাব অনুযায়ী ১৪০ জন কৃষকের মৃত্যু হয় এবং ১৫০ জন কৃষক আহত হয়েছিল । অন্যদিকে সরকারী হিসাব মতে ১৫ জনের মৃত্যু এবং ৩৭ জন আহত হয়েছিল । পথরুঘাটের কৃষক বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকার অতি কঠোর হাতে দমন করেছিল । কিন্তু ১৮৬১ সাল থেকে চলে আসা এইসব কৃষক বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে অসমীয়া জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ।

প্রশ্ন ৭। ১৮৯৪ সালে পথরুঘাটে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের একটি খতিয়ান তুলে ধরো । 

উত্তরঃ পথরুঘাটের জনতা ১৮৯৪ সালের জানুয়ারীর মাঝামাঝি রাইজমেলের যোগে খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত থাকেনি , খাজনা সংগ্রহেও বাধা প্রদান করেছিল । বর্ধিত হারে ভূমির খাজনা নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলদৈ মহকুমার কলাইগাঁও , মঙ্গলদৈ , সিপাঝার এবং পথরুঘাট তহশিলের কৃষকগণ সভায় মিলিত হয়েছিল । কৃষকরা নিজ নিজ অঞ্চলে রাইজমেল অনুষ্ঠিত করার পর পথরুঘাটে জানুয়ারী মাসের ২৬ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত এক বৃহৎ গণসভা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । এই খবর পেয়ে মহকুমাধিপতি জিলাধিপতি জে . ডি . অ্যাণ্ডারসনকে সেই সম্পর্কে অবগত করেছিল । অ্যাণ্ডারসন সেই সমাবেশ বন্ধ করতে সামরিক বাহিনীর ফৌজ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় । 

পুলিশ মিলিটারির সাহায্যে খাজনা না দেওয়া কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া কার্য কৃষকদের মধ্যে তীব্র অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছিল । প্রায় ২০০ জন লোক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে যাওয়া বেরিংটন সাহেবকে ঘিরে ধরে । কোনক্রমে তিনি জনতার হাত থেকে নিস্তার পেয়ে বিশ্রাম শিবিরে উপনীত হন । সেখানে অপেক্ষারত জিলাধিপতি অ্যাণ্ডারসনকে ঘটনার সবিশেষ অবগত করান বা জানান । উপায়ুক্ত অ্যাণ্ডারসন পুলিশ অধিক্ষককে কৃষকদের শক্তি প্রয়োগ করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন । 

পুলিশ অধিক্ষক কৃষকদের শক্তি প্রয়োগ করে তাড়াবার চেষ্টা করলে কৃষকরা উত্তেজিত হয়ে লাঠি উচিয়ে তেড়ে এলে হুটোপুটি আক্রমণের তোড়ে পুলিশ – মিলিটারি , প্রশাসনিক কর্মচারি কেউই চোখ খুলতে পারেননি । সেই অবস্থায় উপায়ুক্ত পুলিশ অধিক্ষককে গুলি চালনা করবার নির্দেশ দিলেন । ফলে বেসরকারী হিসাব অনুযায়ী ১৪০ জন কৃষকের মৃত্যু হয় এবং ১৫০ জন কৃষক আহত হয়েছিল । অন্যদিকে , সরকারী হিসাব মতে ১৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ৩৭ জন আহত হয়েছিল। 

পথরুঘাটের কৃষক বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার অতি কঠোর হাতে দমন করেছিল । এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার অপরাধে সরকারী ভাষ্য মতে , মোট ৩৭ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে বিচার করা হয়েছিল । মঙ্গলদৈর মহকুমাধিপতি রেনসম সাহেব বিচার কার্য সমাধা করেছিলেন । এই বিদ্রোহে গ্রেপ্তার করা লোকদের মধ্যে আকুল শেখ এবং অন্যান্য ছয়জনকে শাস্তি প্রদান করা হয় । বাকি সকলকে মুকুব করে দিয়েছিল । 

প্রশ্ন ৮। ১৮৫০ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জয়ন্তীয়াদের বিদ্রোহের বিষয়ে একটি টীকা প্রস্তুত করো । 

উত্তরঃ জয়ন্তীয়া রাজ্য ১৮৩৫ সালে রাজা রাজেন্দ্র সিংহের হস্তগত হয়ে ইংরেজের হাতে যায় । জয়ন্তীয়া পাহাড় কোম্পানীর রাজ্যের সঙ্গে সামিল করায় স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনচেতা জয়ন্তীয়া জনজাতির লোকেরা বিক্ষুব্ধ হয়েছিল । ভূমি দখলের চেয়েও ব্রিটিশ প্রশাসকের উৎপীড়নের দরুন চিন্টেং বা জয়ন্তীয়ারা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল । জনজাতিরা উন্মুক্তভাবে সকলে মিলেমিশে মাছ ধরে , খড়ি কাটে এবং খড় সংগ্রহ করে , তাই সেইসব অঞ্চলের ওপর ব্রিটিশ প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাজস্ব সংগ্রহের পথ প্রশস্ত করে । তদুপরি জয়ন্তীয়াদের ধর্মীয় এবং পরম্পরাগত অনুষ্ঠানপর্ব , তথা সামাজিক জীবনেও হস্তক্ষেপ করেছে ইংরেজরা , সুদূর অতীতকাল থেকে ব্যবহার করে আসা অস্ত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং অনুশাসন চাপিয়ে দেওয়ায় স্বাধীনচেতা পাহাড়িয়া জনজাতিটি ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে তারা তাদের সর্দার এবং দলেদের সঙ্গে গ্রামের সভায় মিলিত হয়েছিল এবং ইংরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চালিয়েছিল । অন্যদিক কোনো দিন নগদ ধন হিসাবে রাজস্ব কর ইত্যাদি যারা দেয়নি , সেই রকম একটি পার্বত্য জাতি জয়ন্তীয়াদের উপর ব্রিটিশরা কর্তৃত্ব জাহির করার অছিলায় গৃহ – কর , আয়কর ইত্যাদি আরোপ করেছিল । 

প্রথমত ব্রিটিশ গৃহ – কর প্রবর্তন করে । সেই সময় জোয়াইর তহশিলদারকে আড়ালে রেখে জয়ন্তীয়ারা বিদ্রোহের সূচনা করে । এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তীপুর , মূলাগোল , জাফলছেরা ইত্যাদি অঞ্চলে বিদ্রোহের সূচনা হয় । ব্রিটিশ প্রশাসন কঠোর নীতি গ্রহণ করায় ১৮৬১ সালে ওকিয়াং নংবাহ – এর নেতৃত্বে জয়ন্তীয়ারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সজোরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । জয়ন্তীয়ারা ১৮৬২ সালের ১৭ জানুয়ারী তারিখে জোয়াইতে যে ব্রিটিশ ছাউনি রয়েছে , সেখানে অতর্কিতে আক্রমণ করে । বিদ্রোহীরা জোয়াই – চেরাপুঞ্জি এবং চেরাপুঞ্জি – জয়ন্তীপুরের মাঝের দুটো পথেই ওৎ পেতে আগে থেকেই অবরোধ করে রেখেছিল । জয়ন্তীয়াদের উপর ব্রিটিশ সরকার নিয়োজিত ৪৪ নং দেশীয় পদাতিক সৈন্য এবং ৩৩ নং বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ বাহিনীর লোক অমানুষিক অত্যাচার আরম্ভ করেছিল । বিদ্রোহীরাও প্রতিপক্ষের অসংখ্য লোককে হত্যা করেছিল । 

ইংরেজ সরকার ইস্টার্ন কমাণ্ডার বিগ্রেডিয়ার জি . ডি . শ্বায়ারকে সমগ্র জয়ন্তীয়া পাহাড়ের উপর সামরিক ও অসামরিক কর্তৃত্ব প্রদান করেছে , সঙ্গে বি . ডব্লিউ মর্টনকে খাসি – জয়ন্তীয়া পাহাড়ের ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ করেছিলেন । অন্যত্র লাগাতার সরকারী আক্রমণের ফলে জয়ন্তীয়া বিদ্রোহীদের শক্তি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে যাচ্ছিল । ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহীরা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলে সাধারণ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তাদের নেতা ওকিয়াং নংবাহককে কোনো লোক জীবন্ত ধরে এনে ব্রিটিশের হাতে অর্পণ করলে তাকে ১০০০ টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল । অবশেষে ওকিয়াং নংবাহ ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ে এবং বহু লোকের উপস্থিতিতে ব্রিটিশ জোয়াইতে তাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলায় । এই ঘটনা জয়ন্তীয়া বিদ্রোহীদের সকল উৎসাহ একেবারে হ্রাস করে দিয়েছিল এবং অনেকেই স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিল । এভাবেই ১৮৬৩ সালের মধ্যেই জয়ন্তীয়া বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে ।

প্রশ্ন ৯। ১৮৯১ সালে মণিপুরে টিকেন্দ্রজিতের নেতৃত্বে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিষয়ে লেখো। 

উত্তরঃ বহু বছর পূর্ব থেকেই মণিপুর রাজ্য ব্রিটিশের দ্বারা আশ্রিত এবং স্বীকৃত দেশীয় রাজ্যরূপে বজায় ছিল । মণিপুরে সিংহাসন লাভের জন্য ১৮৯০ সালে রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে গৃহকোন্দলের সূচনা হয়েছিল । এই উত্তরাধিকারীর যুদ্ধে অসমের চিফ কমিশনার অনাহক হস্তক্ষেপ করেছিল । ইংরাজের উপস্থিতির সুবিধা গ্রহণ করে যুবরাজ কুলচন্দ্র মহারাজ সুরচন্দ্রকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজেই রাজা হন ( ২১ সেপ্টেম্বর , ১৮৯০ সালে ) । সুরচন্দ্র ইংরাজের সাহায্য ভিক্ষা করেছিল , যদিও তারা কুলচন্দ্রকেই মণিপুরের রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল । কিন্তু তলে তলে চলছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ । 

এই বিদ্রোহের মূল নেতা সেনাপতি টিকেন্দ্রজিতকে দেশান্তরিত করার জন্য ব্রিটিশ নতুন রাজা কুলচন্দ্রকে ব্যতিব্যস্ত করত । কিন্তু দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কাজ করা জনপ্রিয় নেতাকে কেবল ব্রিটিশের কথা মতো দেশান্তরিত করাটা কুলচন্দ্রের পক্ষে সহজ কথা ছিল না । তাই অসমের চিফ কমিশনার জে . ডব্লিউ . কুইন্টন এবং চারজন ইউরোপীয় কর্মচারী তাঁকে পাকড়াও করার জন্য নিজেই এসে মণিপুরে উপস্থিত হলে , স্বাধীনতাকামী মণিপুরীরা তাদের সকলকে হত্যা করে । এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী মণিপুরে প্রেরণ করা হয় । ইংরাজ বাহিনী বীর সেনাপতি টিকেন্দ্রজিতকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয় । 

ব্রিটিশ কর্মচারিকে হত্যা করা , ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করার অপরাধে টিকেন্দ্রজিতকে ফাঁসি দেওয়া হয় । রাজা কুলচন্দ্রকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয় । একজন মণিপুরী নাবালক রাজকুমার চূড়চন্দ্রকে রাজা ঘোষণা করা হয় ( সেপ্টেম্বর , ১৮৯১ সালে ) । রাজা নাবালক হওয়ায় ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিকে মণিপুরের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় । মণিপুর আড়াই লাখ টাকা বিদ্রোহের ক্ষতিপূরণ হিসাবে ব্রিটিশ সরকারকে দিয়েছে । এছাড়াও বছরে ৫০,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল । এইভাবে মণিপুর রাজ্যে ইংরাজের আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল । 

সংক্ষেপে টীকা লেখো

১। অসমে ইংরাজ প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থা । 

২। মণিরাম দেওয়ান । 

৩। ফুলগুরি ধাওয়া । 

৪। লচিমার কৃষক বিদ্রোহ । 

৫। পথরুঘাটের রণ । 

৬। অসমে কৃষক বিদ্রোহের গুরুত্ব । 

৭। টিকেন্দ্রজিৎ । 

উত্তরঃ ১। অসমে ইংরাজ প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থা :- অসমে ব্রিটিশ শাসনের পূর্ববর্তী অবস্থায় মুদ্রা হিসাবে রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিল না । কিন্তু ইংরাজের প্রবর্তিত টাকার মাধ্যমে মাটির খাজনা এবং অন্যান্য কর সংগ্রহ ব্যবস্থা অসমীয়া প্রজার অবস্থা শোচনীয় করে তুলছিল । 

ব্রিটিশ সরকারের নতুন ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধির নীতি এবং মুদ্রা অর্থনীতি অসমীয়া আমজনতার মনে তীব্র অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছিল । এই মুদ্রা অর্থনীতি অসমে সুদখোর মহাজন শ্রেণির সৃষ্টি করেছিল এবং অসমীয়া প্রজা এই সুদখোর মহাজন শ্রেণির কাছ থেকে টাকা ধার করে হলেও ভূমিরাজস্ব সরকারকে দিতে বাধ্য হয়েছিল । এই মহাজন শ্রেণি ছিল বহিরাগত ব্যবসায়ী ; মারোয়ারি ( কেঞা ) এবং বাঙ্গালি মহাজন । 

তদুপরি ইংরাজরা ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে উজান অসমে চা বাগান স্থাপন করেছিল । চা চাষিদের উৎসাহিত করবার জন্য বাগানের অন্তর্গত ভূমির রাজস্ব রেহাই দিয়েছিল। ফলে ভূমি রাজস্বের বোজা দরিদ্র সাধারণ কৃষককে বহন করতে হয়েছিল । 

২। মণিরাম দেওয়ান :- মণিরাম দেওয়ান ছিলেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একজন দক্ষ ও বিশ্বস্ত কর্মচারী । ক্যাপ্টেন নিউফডিল এই দক্ষ ও প্রতিভাশালী অসমীয়া অভিজাতকে যোরহাটে ১৮২৮ সালে সেরেস্তাদার নিযুক্ত করেছিলেন । এই কার্যে তিনি বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন । অহোম অভিজাতদের মধ্যে যখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিস্তার লাভ করেছিল তখন মণিরাম তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন । ১৮৩৯ সালে পুরন্দর সিংহ সিংহাসনচ্যুত হলে মণিরাম ইংরেজদের উপর খুব অসন্তুষ্ট হন এবং তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে কোনো কাজ করতে অরাজি হন । তিনি পুরন্দর সিংহের পৌত্র কন্দর্পেশ্বর সিংহের রাজ্য প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করে বিফল হন । 

মণিরাম তখন ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের পথ বেছে নিলেন । ১৮৫৭ সালে উত্তর ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের বিস্তার লক্ষ্য করে মণিরাম উৎসাহিত হন । তিনি তাঁর বাঙালী বন্ধু মধু মল্লিকের সাহায্যে কন্দর্পেশ্বর সিংহের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেন এবং তাঁকে স্থানীয় সিপাহীদের সাহায্যে বিদ্রোহের জন্য তৈরি হতে উৎসাহিত করেন । কন্দর্পেশ্বর সিংহ যোরহাট ও গোলাঘাটের সিপাহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন । কিন্তু কন্দপেশ্বর সিংহ ও মণিরামের বিদ্রোহের প্রচেষ্টা বেশি দূর অগ্রসর হবার আগে ধরা পড়ে । ধৃত হওয়ার পর কন্দপেশ্বর সিংহকে বর্ধমানে অন্তরীণ করা হয় এবং মণিরাম দেওয়ানকে ১৮৫৮ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি যোরহাটে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয় । 

৩। ফুলগুরি ধাওয়া :- ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ফুলগুরি বিদ্রোহই ছিল অসমের প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলন । নগাঁও – এর নিকটবর্তী একটি স্থানের নাম ফুলগুরি।ওই এলাকায় মূলত লালুঙ এবং কাছাড়ী উপজাতি মানুষের বসবাস ছিল । যেহেতু আফিংয়ের প্রতি তাদের প্রচণ্ড আসক্তি ছিল । সেহেতু অসমের অন্যান্য স্থান থেকে ফুলগুরিতে আফিংয়ের ব্যবহার বেশি ছিল । ব্রিটিশ সরকার ব্যক্তিগত মালিকানায় আফিং চাষ নিষিদ্ধ করায় ফুলগুরির মানুষ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । তাছাড়া আফিংয়ের মূল্য বাড়ানোয় তাদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায় । তাদেরকে আয়ের একটি ভাল অংশ আফিংয়ের আসক্তি পূরণে ব্যয় করতে হত। তাছাড়া ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন কর আরোপ করায় ফুলগুরির মানুষের আয়ের বড় অংশই কর প্রদানে শেষ হয়ে যেত । 

এমতাবস্থায় একটি গুজব ছড়ায় যে ব্রিটিশ সরকার পান , সুপারি , বাগানের ফল ইত্যাদি চাষের উপরও কর আরোপ করবে । তখন পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে । অবশেষে , ফুলগুরির মানুষ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই অক্টোবর ‘ রাইজমেলের ’ মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সমবেত হয় । ব্রিটিশ পুলিশ বলপ্রয়োগ করে এই সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে উদ্যাত হয় । এতে সমবেত কৃষকরা উত্তেজিত হয়ে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং সহকারী পুলিশ কমিশনার লেফটেনেন্ট সিঙ্গারকে হত্যা করে । এই ঘটনাকে বলা হয় ‘ ফুলগুরি ধাওয়া ’ এর পর ইংরেজ সরকার শক্তহাতে এই বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হয় । বিদ্রোহীদের হয়ত মৃত্যুদণ্ড নতুবা আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় । 

ফুলগুরি বিদ্রোহ অসফল হলেও এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে । এই বিদ্রোহ ছিল অসমের কৃষকদের ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম গণ আন্দোলন । এই বিদ্রোহের সময় প্রথমবারের মতো মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ফুলগুরি বিদ্রোহীদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল । এছাড়া ফুলগুরি বিদ্রোহ গ্রামীণ জনগণ এবং উপজাতি মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়েছিল । 

৪। লচিমার কৃষক বিদ্রোহ :- ১৮৯৪ সালের ২১ জানুয়ারী সরুক্ষেত্রী মৌজার লচিমার সন্নিকটে কাল্লা গাঁয়ে মৌজাদার দাসোরাম চৌধুরী এবং মণ্ডল হলিরাম মিশ্র খাজনা সংগ্রহের জন্য বের হলে দুজনকে লোকে বেশ মারধোর করে । কিছু দিন পর মৌজাদারের মৃত্যু হয় । ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বরপেটার মহকুমাধিপতি মাধব চন্দ্র বরদলৈ ৭৫ জন লোককে আটক করেন এবং তাঁর লচিমার বিশ্রাম শিবিরে নিয়ে যান । প্রায় ৩০০০ লোক শিবিরের চারদিকে ঘেরাও করে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল । তিনি আটকাধীন বন্দীদের মুক্ত করে দিতে বাধ্য হন । পরদিন উপায়ুক্ত ম্যাক ক্যাবে ৩০ জন পুলিশ এবং গোর্খা রেজিমেন্টের লোক সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে মোট ৫৯ জন বিদ্রোহী কৃষককে গ্রেপ্তার করেছিলেন এবং তাদের অস্থায়ী জেলে পুরে রেখেছিলেন । 

২৫ তারিখের বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ লোক বন্দীদের মুক্তির ৬০০০ লোকের সাক্ষরিত একটি আবেদন উপায়ুক্তের শিবিরে গিয়ে দাখিল করেন । ম্যাক ক্যাবে কোনো সাড়া না দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে জনতাকে তাড়িয়ে দেন । পুলিশে আটক করা সকলের মধ্যে গোসাঁই দলৈ ও কয়েকজন সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন । বন্দীদেরকে গরুর মতো কাঁধে লাঙ্গল দিয়ে হাল টানিয়ে জনতাকে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে কেউই বিদ্রোহ না করে । লচিমার কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করা এবং হালরাম মিশ্র মণ্ডলকে আঘাত করার অপরাধে ১৬ জনকে বিভিন্ন শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল । লচিমার কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অংশগ্রহণ করার অপরাধে পুষ্পরাম কলিতা , দেবী দত্ত শর্মা , জয়ন্তী বেজ , নির্ভাষা কলিতা , নাউচাকু কলিতা এবং মংগলু কলিতা দু বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেছিল । 

৫। পথরুঘাটের রণ :- দরং জেলার অন্তর্গত মঙ্গলদৈ মহকুমার পথরুঘাটে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল । ওখানকার জনতা , ১৮৯৪ সালের জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি রাইজমেলের যোগে খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত থাকেনি , খাজনা সংগ্রহেও বাধা প্রদান করেছিল । বর্ধিত হারে ভূমির খাজনা নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলদৈ মহকুমার কলাইগাঁও , মঙ্গলদৈ , সিপাঝার এবং পথারু ঘাটের কৃষকরা গণসভায় মিলিত হয়েছিল । জানুয়ারী মাসের ২৬ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত তিন দিন ব্যাপিয়া এক বৃহৎ গণসভা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু মহকুমাধিপতি জে . ডি . অ্যাণ্ডারসনকে সমাবেশ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল । 

পুলিশ মিলিটারির সাহায্যে খাজনা না দেওয়া কৃষকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া কার্য কৃষকদের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছিল । উপায়ুক্ত অ্যাণ্ডারসন পুলিশ অধিক্ষককে রাইজমেল পাতা কৃষকগণকে শক্তি প্রয়োগ করে কৃষকদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুলিশ অধিক্ষক কৃষকদের শক্তি প্রয়োগ করে তাড়াবার চেষ্টা করলে কৃষকেরা উত্তেজিত হয়ে লাঠি উচিয়ে তেড়ে এসেছিল । হুটোপুটি আক্রমণের তোড়ে পুলিশ মিলিটারি প্রশাসনিক কর্মচারি কেউই চোখ খুলতে পারেনি । সে অবস্থায় উপায়ুক্ত পুলিশ অধিক্ষককে গুলি চালনার নির্দেশ দিলেন । ফলে বেসরকারী হিসাবে ১৪০ জন কৃষকের মৃত্যু হয় এবং ১৫০ জন কৃষক আহত হয়েছিল । অন্যদিকে , সরকারী হিসাব মতে ১৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ৩৭ জন আহত হয়েছিল। 

পথরুঘাটের কৃষক বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার অতি কঠোর হাতে দমন করেছিল । এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার অপরাধে মোট ৩৭ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে বিচার করা হয়েছিল । মঙ্গলদৈর মহকুমাধিপতি রেনসম সাহেব বিচার কার্য সমাধা করেছিলেন । 

৬। অসমে কৃষক বিদ্রোহের গুরুত্ব :- অসমে অধিকাংশ কৃষক আন্দোলন ইংরেজদের রাজস্বের হার বৃদ্ধি বা নতুন কর আরোপের জন্য সংঘটিত হয়েছিল । যদিও কৃষক আন্দোলনগুলি ইংরেজদের দমন করতে সক্ষম হয়েছিল , তবুও তারা বুঝতে পেরেছিল যে কর কাঠামোর সংশোধন করা না হলে আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না । সুতরাং ইংরেজরা বাধ্য হয়ে অসমে করের হার কিছুটা কমিয়েছিল এবং ওটিই ছিল অসমে কৃষক আন্দোলনের প্রথম ফল । দ্বিতীয়ত , কৃষক আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা আইন – শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদের সামরিক শক্তি আরও বাড়িয়েছিল । অধিক সংখ্যক সৈন্য অসমের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়েছিল। তৃতীয়ত , অসমে কৃষক আন্দোলনের জন্মদাতা বলে পরিচিত রাইজমেলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ভীষণ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল । 

ইংরেজদের অভূতপূর্ব দমননীতির ফলে “ রাইজমেল ” ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হয়ে পড়েছিল । চতুর্থত , রাইজমেলের দ্বারা আয়োজিত কৃষক আন্দোলনে হিন্দু – মুলসলমান নির্বিশেষে অসমের জনগণ সক্রিয়ভাবে যোগদান করেছিলেন । ফলে এই আন্দোলন দমন হলেও অসমের জনগণের মনে ইংরেজদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং আক্রোশের ভাব থেকে যায় । পঞ্চমত , কৃষক আন্দোলনে কৃষকদের ত্যাগ ও সাহসিকতার উপর অনেক লোকগীতি রচিত হয়েছিল । এইসব লোকগীতি অসমের মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং তাদেরকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে প্রেরণা দিয়েছিল । ষষ্ঠত , কৃষক আন্দোলন অসমের জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল । অসমের মানুষের এই সচেতনতা রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে উঠার ভিত্তি তৈরি করেছিল। 

৭। টিকেন্দ্রজিৎ :- টিকেন্দ্রজিৎ মণিপুর রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন । তিনি ব্রিটিশ বিরোধী একজন প্রধান নেতা ছিলেন । মণিপুরে সিংহাসন লাভের জন্য ১৮৯০ সালের রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে গৃহকোন্দলের সূচনা হয়েছিল। ইংরাজের উপস্থিতির সুবিধা গ্রহণ করে যুবরাজ কুলচন্দ্র মহারাজ সুরচন্দ্রকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজেই রাজা হয় ( ২১ শে সেপ্টেম্বর , ১৮৯০ সাল ) । ব্রিটিশ সরকার নতুন রাজা কুলচন্দ্রকে বিরোধী নেতা টিকেন্দ্রজিতকে দেশান্তরিত করতে ব্যতিব্যস্ত করেছিল । 

কিন্তু দেশের স্বাধীনতা রক্ষার হকে কাজ করে জনপ্রিয় নেতাকে কেবল ব্রিটিশের কথামতো দেশান্তরিত করাটা কুলচন্দ্রের পক্ষে সহজ কথা ছিল না । তাই অসমের চিফ কমিশনার জে . ডব্লিউ , কুইন্টন এবং চারজন ইউরোপীয় কর্মচারী তাকে পাকড়াও করার জন্য নিজেই মণিপুরে এসে উপস্থিত হলে , স্বাধীনতাকামী মণিপুরীরা তাদের সকলকে হত্যা করে । এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবার জন্য একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী মণিপুরে প্রেরণ করা হয় । ইংরাজ বাহিনী বীর সেনাপতি টিকেন্দ্রজিতকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয় । ব্রিটিশ কর্মচারীকে হত্যা করা , ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করার অপরাধে টিকেন্দ্রজিতকে ফাঁসি দেওয়া হয় । 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top