Class 9 Social Science Chapter 4 মানের অসম আক্রমণ Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 9 Social Science Chapter 4 মানের অসম আক্রমণ and select needs one.
Class 9 Social Science Chapter 4 মানের অসম আক্রমণ
Also, you can read SCERT book online in these sections Class 9 Social Science Chapter 4 মানের অসম আক্রমণ Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 9 Social Science Chapter 4 মানের অসম আক্রমণ These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 9 Social Science Chapter 4 মানের অসম আক্রমণ for All Subject, You can practice these here…
মানের অসম আক্রমণ
Chapter – 4
প্রথম খন্ড : ইতিহাস
পাঠ্য পুস্তকের প্রশ্নোত্তরঃ
● অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ
১। ১৭৬৪ সালে মান রাজা বদৌপায়ার আমলে মানরা কোন দেশ জয় করেছিল ?
উত্তরঃ ১৭৬৪ সালে মান রাজা বদৌপায়ার আমলে মানরা আরাকান দেশটি জয় করেছিল।
২। মান এবং ব্রিটিশের মধ্যে কখন থেকে শক্রতার সৃষ্টি হয় ?
উত্তরঃ আরাকান দলের পরেই মান এবং ব্রিটিশের মধ্যে শক্রতার সৃষ্টি
হয়।
৩। মানের উপদ্রবে থাকতে না পেরে শ্রীহট্টে পালিয়ে যাওয়া কাছাড়ের রাজার নাম কি ছিল ?
উত্তরঃ মানের উপদ্রবে থাকতে না পেরে শ্রীহট্টে পালিয়ে যাওয়া কাছাড়ের রাজার নাম ছিল গোবিন্দ চন্দ্র।
৪। কোন যুদ্ধে আহোমের পরাজয়ের খবর পেয়ে পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাইর মৃত্যু হয়েছিল ?
উত্তরঃ ঘিলাধারী যুদ্ধে আহোমদের পরাজয়ের খবর পেয়ে পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাইর মৃত্যু হয়েছিল।
৫। বৈশালী হুকুং কি ?
উত্তরঃ বৈশালী হুকুং হলো বদলের নেতৃত্বে মানদের সামরিক অভিযানের বর্ণনা।
৬। বৈশালী মুং-ডুন-চুন-খাম কি ?
উত্তরঃ বৈশালী মুং-ডুন-চুন-খাম হলো মানদের সামরিক অভিযানের দ্বিতীয় বর্ণনা।
৭। বদনচন্দ্রের সঙ্গে মান সেনা আসার সময় অসমের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন ?
উত্তরঃ বদনচন্দ্রের সঙ্গে মান সেনা আসার সময় অসমের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই।
৮। বদনচন্দ্র কতজন মান সৈন্য সঙ্গে এনেছিলেন ?
উত্তরঃ বদনচন্দ্র প্রায় ৬০০০জন মান সৈন্য সঙ্গে এনেছিলেন।
৯। বদনচন্দ্র অসমে ঢুকে কতজন অতিরিক্ত সৈন্য জোগাড় করেন ?
উত্তরঃ বদনচন্দ্র অসমে ঢুকে প্রায় ৮০০০জন অতিরিক্ত সৈন্য জোগাড় করেন।
১০। বদনচন্দ্রকে চন্দ্রকান্ত সিংহ কি উপাধি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী করেন ?
উত্তরঃ বদনচন্দ্রকে চন্দ্রকান্ত সিংহ বরফুকন উপাধি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী করেন।
১১। মানের আক্রমণ কোন কোন সালে হয়েছিল ?
উত্তরঃ মানের আক্রমণ হয়েছিল ১৮১৭, ১৮১৯, ১৮২১ সালে।
১২। কোন সালে বদনচন্দ্রকে হত্যা করা হয় ?
উত্তরঃ ১৮১৭ সালের আগস্ট মাসে বদনচন্দ্রকে হত্যা করা হয়।
শুদ্ধ উত্তর বেছে বের করঃ
প্রশ্ন ১। ১৮১৬/ ১৮১৭/ ১৮১৯ সালে মানেরা অসমের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিল।
উত্তরঃ ১৮১৭ সালে।
প্রশ্ন ২। জগন্নাথ ঢেকিয়াল ফুকন/বদনচন্দ্রর বরফুকন/চন্দ্রকান্ত বুড়াগোঁহাই রুচিনাথ বুড়াগোঁহাইর ভাই ছিলেন।
উত্তরঃ জগন্নাথ ঢেকিয়াল ফুকন।
প্রশ্ন ৩। বদনচন্দ্রের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ১৮১৬/ ১৮১৭/ ১৮১৮ সালের আগষ্ট মাসে।
উত্তরঃ ১৮১৭ সালের আগষ্ট মাসে।
প্রশ্ন ৪। রাজমাওঁ নুমলী চন্দ্রকান্ত সিংহ/ পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই-এর মাতা ছিলেন।
উত্তরঃ চন্দ্রকান্ত সিংহের।
প্রশ্ন ৫। ইয়াণ্ডাবু সন্ধি ১৮১৮/ ১৮২৬/ ১৮২৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে স্বাক্ষর করা হয়েছিল ?
উত্তরঃ ১৮২৬ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষর করা হয়েছিল।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। মণিপুর এবং আরাকানে মানের রাজ্য বিস্তার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মানেরা ব্রক্ষদেশের রাজা পশ্চিমদিকে রাজ্য বিস্তারের সূচনা করেছিল। ইংরাজ বঙ্গদেশে পলাশী যুদ্ধ জয় করার কয়েক বছর পর মানেরা আগে ব্রক্ষদেশের রাজা আলং পায়া মণিপুরে এক সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের পর ব্রক্ষদেশের রাজা আলাংপাশ মণিপুরে একটা সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি ১৭৫৯ সালে মণিপুরের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করে সিংবুসিম নামে এক মান রাজার আমলে ১৭৬৫ সালে মান সৈন্য পুনরায় মণিপুর আক্রমণ করে কয়েক হাজার মণিপুরী লোককে ব্রক্ষদেশে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরের রাজা জয়সিংহকে দেশান্তরিত করেছিল। এর পর মান সেনা বারংবার মণিপুর আক্রমণ করে সেখানে নিজের আধিপত্য কায়েম করে।
১৭৮৪ সালে মান রাজা বদৌপায়ারের আমলে মান সেনা আরাকান জয় করে। আরাকান দখল করার সঙ্গে সঙ্গে মান সেনা মারগুই দীপপুঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম সীমান্তের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর পযর্ন্ত সমগ্ৰ বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এই অবস্থায় মানেরা ব্রিটিশের সঙ্গে অন্তরাষ্ট্রীয় সীমারেখার অংশীদারে পরিণত করার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করে। এরপর থেকে দুইশক্তি পরস্পরের শক্র হয়ে পড়ে। আরাকানে মানরাজা ক্রমান্বয়ে বিশেষ করে বদৌপায়া এবং তাঁর নাতি বাগিদাত্তর রাজত্বকালে তাঁদের রাজ্যবিস্তার নীতি মণিপুর ও অসমের দিকে প্রসারিত করার চেষ্টা করে।
১৮১৯-২৩ সালের মধ্যে তাঁরা মণিপুরের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করে সরজিৎ সিং, গম্ভীর সিং এবং সুরজিৎ সিং নামে তিনজন রাজকুমারকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। এই তিনজন কাছাড়ের দিকে পালান। তাদের উপদ্রবে থাকা সম্ভব নয় মনে করে কাছাড়ের রাজা গোবিন্দচন্দ্র শ্রীহট্টে পালিয়ে ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু ইংরেজ গোবিন্দচন্দ্রকে সাহায্য না করায় তিনি মান রাজার শরণাপন্ন হন। মানরা কাছাড়ে নিজেদের আধিপত্য চাপানোর আশায় ১৮২৩ সালে গোবিন্দচন্দ্রের সমর্থনে মণিপুরের রাজকুমার গম্ভীর সিংহের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
প্রশ্ন ২। পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোঁহাইর স্বেচ্ছাচারিতা কীভাবে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের জন্ম দিয়েছিল আলোচনা কর।
উত্তরঃ পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোঁহাই-এর দৌরাত্ম্য সহ্য করতে না পেরে বহুসংখ্যক মানুষ কমলেশ্বর সিংহের রাজত্বকালে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দান করে পানীমুরা নামক একজন লোক। সেজন্য এই বিদ্রোহকে বলা হয় “পানীমুরা বিদ্রোহ”। পূর্ণানন্দ শ্রীনাথ বরুয়ার মাধ্যমে বহুলোকের বিরুদ্ধে বিচারের নাটক করে তাদের কঠোর শাস্তি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তৎসত্ত্বেও পূর্ণানন্দের দৌরাত্ম্যের সমাপ্ত হয় নি।
কমলেশ্বর সিংহের মৃত্যু হওয়ায় চন্দ্রকান্ত সিংহ নামে এক কিশোরকে ১৮১০ সালে। আহোম রাজপদে অধিষ্ঠিত করে। সে পূর্ণানন্দের মতোই রাজকীয় মর্যাদা ও দম্ভভাবে রাজ্যশাসন করেছিল। কমলেশ্বর সিংহের রাজত্বকালে পূর্ণানন্দের বিরুদ্ধে এই প্রকার বিরোধিতা বা বিদ্রোহ চালিয়েছিল। কমলেশ্বর সিংহের রাজত্বকালে সৎরাম চাড়িঙ্গীয়া ফুকনের বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্ৰহণ করেছিলেন। এই বিদ্রোহে প্রায় ৯৭জন মর্যাদাসম্পন্ন লোক জড়িত ছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহ দুর্বল হয়ে পড়ায় পূর্ণানন্দ সকলকে গ্ৰেপ্তার করতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোঁহাইর বিরুদ্ধে রাজা চন্দ্রকান্ত সিংহ ব্রিটিশ সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। কোম্পানীর সরকার সেই সময় নেপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোঁহাইর বিরুদ্ধে রাজা চন্দ্রকান্ত সিংহ ও বদনচন্দ্র ফুকনকে সাহায্য দিতে পারে নি। বদনচন্দ্র ব্রক্ষদেশে গিয়ে ব্রক্ষরাজা বদৌপায়ার কাছে পূর্ণানন্দের বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্য চান। বদৌপায়া পূর্ণানন্দের বিরুদ্ধে ৬০০০ হাজার সৈন্য পাঠান বদনচন্দ্র সৈন্য সহ ১৮১৭ সালের মার্চ মাসে অসমে প্রবেশ করেন। বুড়াগোঁহাই তাদের গতিরোধ করতে একদল সৈন্য পাঠান। ঘিলাধারী নামক স্থানে দুই দলে এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। ঠিক সেইসময় পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাইয়ের মৃত্যু হয়। মানরা বর্মীযুদ্ধে জয়ী হয়।
সুতরাং দেখা যায় যে পূর্ণানন্দের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের পরিণাম স্বরূপ অসমে মানের শাসন কায়েম হয় এবং মানরা তাদের শাসন শুরু করে। পরে ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধে ব্রিটিশ জয়লাভ করে অসম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়।
প্রশ্ন ৩। পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাইর বিরুদ্ধে সংঘটিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল ?
উত্তরঃ (২ নং প্রশ্নোত্তর লিখ)
প্রশ্ন ৪। বদনচন্দ্র বরফুকনের নেতৃত্বে মানরা অসম আক্রমণ করেছিল কি না, যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ কর।
উত্তরঃ (৪ নং প্রশ্নোত্তর লিখ)
প্রশ্ন ৫। বদনচন্দ্র বরফুকনের নেতৃত্বে অসমে মানের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ বদনচন্দ্র বরফুকনের সঙ্গে পূর্ণানন্দের মনোমালিন্য দেখা দেয়। বুঢ়াগোঁহাই বদনচন্দ্রকে বন্দী করতে লোক পাঠিয়েছিলেন। বদনচন্দ্র কলিকাতায় পালান। তিনি কলিকাতায় ইংরেজ সরকারকে অসম আক্রমণ করার প্ররোচনা দেন। কিন্তু ইংরাজ সরকার রাজী না হওয়ায় বদনচন্দ্র বরফুকন কলিকাতাস্থিত বর্মীদূতের সঙ্গে মিলিত বর্মীদের রাজধানী অমরপুরীতে চলে যান।
তিনি রাজা বদৌপায়ায়ের সাহায্যপ্রার্থী হয়। ব্রক্ষরাজ ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে আট হাজার সৈন্য পাঠিয়ে অসম আক্রমণ করান। ঘিলাধারীতে (১৮১৬খ্রিঃ) আহোম সৈন্য পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের পর পূর্ণানন্দ মারা যান।
পূর্ণানন্দের পুত্র রুচিনাথ বুঢ়াগোঁহাই হয়ে বর্মী সৈন্যদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কাঠালবাড়ী নামক স্থানে আহোম সৈন্য পরাজিত হলে রুচিনাথ গৌহাটীতে পালান। বর্মীরা জোড়হাট দখল করে চন্দ্রকান্তকে রাজপদে রেখে বদনকে বুড়াগোঁহাই পদে নিযুক্ত করেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে বর্মীগণ স্বদেশে ফিরে যান।
বদনচন্দ্রের প্ররোচনায় মানেরা অসম আক্রমণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বদনচন্দ্রের নেতৃত্বে মানসৈন্যরা অসম অক্রমণ ও যুদ্ধে পরিচালনা করে নি। বদনের অধীনে মানসেনারা অসমে প্রবেশ করে।
প্রশ্ন ৬। মানের অসম আক্রমণের কারণসমূহ আলোচনা কর।
উত্তরঃ কমলেশ্বর সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা চন্দ্রকান্ত সিংহ আহোম সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হন। চন্দ্রকান্ত সিংহ নীচমনা ও স্বার্থপর ছিলেন। বরফুকনের মৃত্যুর পর বদনচন্দ্র নামক একজন দুষ্ট বৃদ্ধি লোককে বরফুকন স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী। তার পুত্রেরা আরও দুরন্ত ছিল। কথিত আছে একবার কোন এক উৎসবে বরফুকন ও তাঁর সঙ্গীসাথী এবং ছেলেরা এক মত্ত হাতীকে ভাং খাইয়ে জনতার দিকে ছেড়ে দিয়েছিল। যখন মত্ত হাতীটি নিরীহ জনগণকে হত্যা করে ঘরবাড়ী ধ্বংস করছিল তখন বরফুকন ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা এবং পুত্রগণ এর কোন প্রতিকার না করে আমোদ প্রমোদে রত ছিলেন। বুড়াগোঁহাইকে এই খবর দিলে তিনি বদনচন্দ্রকে বন্দী করতে লোক পাঠান। বদনচন্দ্র কলিকাতায় ইংরাজদের আশ্রয়ের জন্য পালান।
বদনচন্দ্র কলিকাতায় ইংরাজ সরকারকে অসম আক্রমণ করার জন্য প্ররোচনা দেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার এতে রাজী না হওয়ায় বদনচন্দ্র বরফুকন কলিকাতাস্থিত বর্মী দূতের সঙ্গে মিলে বর্মীদের রাজধানী অমরাপুরীতে চলে যান। তিনি বর্মীরাজ্যের কাছে বুড়াগোঁহাই-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেন এবং বুড়াগোঁহাই-এর হাত হতে অসমকে রক্ষা করবার জন্য বর্মীরাজের সাহায্য প্রার্থনা করেন।
বদনচন্দ্র বরফুকনের সাহায্যার্থে বর্মীরাজ ১৮১৬ সালে একদল বর্মী সেনাবাহিনী বদনের সঙ্গে পাঠান। সেই বাহিনীতে ১৮,০০০ হাজার সৈন্য ছিল। বুঢ়াগোঁহাই তাদের গতিরোধ করবার জন্য একদল সৈন্য পাঠান। ঘিলাধারী নামক স্থানে দুই দলে এক ভীষণ যুদ্ধ হল। ঠিক সেই সময়ে পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোঁহাইয়ের মৃত্যু হয়। মানরা (বর্মী) যুদ্ধে জয়ী হয়। বুঢ়াগোঁহাই-এর পুত্র রুচিনাথ বুঢ়াগোঁহাই এর পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। কাঠালবাড়ীতে আবার আহোমদের সঙ্গে মানদের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধেও আহোমরা পরাজিত হয়। চন্দ্রকান্ত ভয়ে গৌহাটী অভিমুখে পলায়ন করেন। বুঢ়াগোঁহাই রাজাকে ফিরিয়ে আনতে না পেরে নিজেই গৌহাটী অভিমুখে পালান। বর্মী সৈন্যবাহিনী গৌহাটী অধিকার করে বদনচন্দ্রকে পুনরায় বরফুকন পদে অধিষ্ঠিত করেন। ১৮১৭ সালের এপ্রিল মাসে বর্মীরা অসম ছেড়ে চলে যায়।
মান বা বর্মীরা চলে গেলে বরবরুয়ার সঙ্গে বরফুকনের বিবাহ শুরু হলে রাজামাতা ও সভাসদেরা বরবরুয়ার পক্ষ অবলম্বন করে। রাজমাতার আদেশে রূপসিং নামক এক সুবেদার ১৮১৭ সালে বদনচন্দ্রকে হত্যা করে।
বদনচন্দ্রের হত্যা এবং চন্দ্রকান্তের সিংহাসনে চ্যুতির সংবাদ অবগত হয়ে ব্রক্ষরাজ বদৌপা সেনাপতি আলামিঙ্গিকে একদল সৈন্য দিয়ে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে পাঠান। আলামিঙ্গি আহোমদিগকে নাজিরাতে পরাজিত করে যোড়হাট অভিমুখে অগ্ৰসর হলে ভীত হয়ে পুরন্দর সিংহ গৌহাটীতে পালান। সুযোগ বুঝে চন্দ্রকান্ত বর্মীদের সঙ্গে যোগ দিলে বর্মী সেনাপতি তাকেই সিংহাসনে নামেমাত্র রাজা হিসাবে বসান। বাধ্য হয়ে বুড়াগোঁহাই এবং পুরন্দর সিংহ ইংরাজ রাজ্য আশ্রয় গ্ৰহণ করেন। কিন্তু ইংরাজ সরকার তাঁদের সাহায্য করতে অসমর্থ হয়। অপরদিকে চন্দ্রকান্তও বর্মীদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজ রাজ্যে পালান। বর্মীগণ যোগেশ্বরকে সিংহাসনে বসান। চন্দ্রকান্ত একদল সৈন্য নিয়ে বর্মী অধিকৃত রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল জয় করেন। পুরন্দর সিংহও অন্য একদল সৈন্য নিয়ে দুয়ার অঞ্চলে বর্মী সৈন্যদের উত্যক্ত করে তুললে বর্মী সেনাপতি ইংরাজদের নিকট তীব্র প্রতিবাদ জানান কিন্তু ইংরাজ সরকার নীরব থাকে।
প্রশ্ন ৭। মানের অসম আক্রমণের পরিণতি সমূহ বিস্তারিতভাবে দেখাও।
উত্তরঃ অসমের ইতিহাসে মানেদের অসম আক্রমণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। অসম বর্মীদের অধীনে সাময়িকভাবে চলে গিয়েছিল। বর্মী আক্রমণে অসমের বহু জনপদ জনশূন্য হয়, বহুলোক নিহত হয় এবং বন্দী হয়।
বর্মী আক্রমণের অন্যতম প্রধান ফল হল প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধ। বর্মীরা অসম জয় করে বঙ্গদেশ আক্রমণের চেষ্টা চালায়। ইংরেজগণ বর্মীদের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি বন্ধ করতে অসমে প্রবেশ করেন এবং বর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
অসমে আহোম রাজত্বের অবসান হয় বর্মী আক্রমণের ফলে বর্মী আক্রমণ প্রতিহত করতে ইংরেজ অসমে প্রবেশ করে, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে অসম দখল করে নেয়।
বর্মীগণ অসমবাসীর উত্তরঃ নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়ে অসমকে ছারখার করে ফেলে। গ্ৰামের পর গ্ৰাম তারা পুড়িয়ে ফেলে নিরপরাধ ব্যক্তিদের নৃশংসভাবে হত্যা করে এমন কি স্ত্রীলোকদের উপরও অত্যাচার করেছিল। বর্মীদের এই অত্যাচারের রাজত্ব এখনও অসমের লোকেরা “মানর দিন” বলে থাকে।
মানের অত্যাচারে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। কাছাড়, জয়ন্তীয়া, ভুটান এবং বিশেষত বাংলাদেশে অহরহ জনস্রোত বয়ে যাওয়ায় দেশ জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। গ্ৰামগুলি বন জঙ্গলে ভরে যায়। খাদ্যশস্যের পরিবর্তে জমিতে আগাছা গজিয়ে ওঠে। জন মেক কোশ নামক একজন ইংরেজ আধিকারিক মানের আক্রমণের কয়েকবছর পর অসমে এসে অসমের অবস্থার এক করুন বর্ণনা দিয়েছেন— মানের আক্রমণের ফলে এর পরিবেশ এরূপ বিপদ-সংকুল এবং ভয়াবহ হয়ে পড়েছিল যে স্থানীয় লোক এদিক ওদিক চলতে সংকোচ বোধ করত।
এই সময় অসমের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়ে। জনহীনতার জন্য শস্যক্ষেত শষ্যশূন্য হয়ে পড়ে। মানগণ মানুষের বিষয় সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে যায়। মঠ, মন্দির ধ্বংস করে সোনা ও মূল্যবান সামগ্ৰী নিয়ে যায়। মানুষের আর্থিক অবস্থা সংকটজনক হয়ে পড়ে। মানুষের দুর্দশা চরমসীমায় পৌঁছায়।
প্রশ্ন ৮। কোন বিদ্রোহকে ‘পানীমুয়া বিদ্রোহ’ বলা হয় ?
উত্তরঃ ক্ষমতালাভের এক বছরের মধ্যে স্বর্গদেও গৌরীনাথ সিংহের মৃত্যু হয়েছিল। পূর্ণানন্দ স্বর্গদেওয়ের মৃত্যুর সংবাদটি গোপন করে রেখেছিল এবং কৌশলে অল্পবয়সী কমলেশ্বর সিংহকে অসমের নতুন রাজা হিসাবে নিযুক্তি করে। কোমল বয়সী রাজা বুড়াগোঁহাইর হাতের পুতুলে পরিণত হয়। ১৮১০ সালে কমলেশ্বর সিংহের মৃত্যুর পর পূর্ণানন্দই চন্দ্রকান্ত সিংহ নামে অল্পবয়সী পুত্রকে আহোম রাজপদে অধিষ্ঠিত করে। পূর্ণানন্দের স্বেচ্ছাচারী শাসন দেশের লোকে পছন্দ করত না। ফলে তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছিল। দেশের বহু সংখ্যক মানুষ কমলেশ্বর সিংহের রাজত্বকালে একটি বিদ্রোহ সংগঠিত করে। পানীমুয়া নামের একজন বিদ্রোহের নেতৃত্বে দান করে। সেইজন্য এই বিদ্রোহকে বলা হয় পানীমুয়া বিদ্রোহ।
প্রশ্ন ৯। ১৮১৭ সালে অসমে মানদের হস্তক্ষেপের দুটি ফলাফল উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ১৮১৭সালে অসমে মানদের হস্তক্ষেপের দুটি ফলাফল : ১৮১৭ সালে অসমে মানের আক্রমণ রোধ করতে পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই দামান গগৈ এবং হাওবরার সেনাবাহিনী পাঠালেও বদনের নেতৃত্বে আসা মান সেনার হাতে ঘিলাধারীর যুদ্ধে তারা পরাজিত হন।
ঘিলাধারীতে পাঠানো সেনাবাহিনীর পরাজয়ের খবর পাওয়া মাত্রা পূর্ণানন্দের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র রুচিনাথকে বুড়াগোঁহাই পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। বাবার মত রুচিনাথের গুণ ছিল না। কিন্তু এই চরম বিপর্যয়ের দিনে আহোমদের নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন আর কোনোও আধিকারিক ছিলেন না। মানদের তাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে সেনা জোগাড় করে দিহিটের পূর্বে কাঁঠালবাঁড়িতে তারা মানের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হন এবং যুদ্ধে পরাজিত রুচিনাথ গুয়াহাটিতে পালিয়ে যান।
প্রশ্ন ১০। প্রথম ইঙ্গো-বার্মা যুদ্ধ কখন সংঘটিত হয়েছিল ? এই যুদ্ধটি কোথায় সংঘটিত হয়েছিল ?
উত্তরঃ প্রথম ইঙ্গো-বার্মা যুদ্ধ ১৮২৪ সালে সংঘটিত হয়েছিল। অসম সম্পূর্ণভাবে মানের অধীনে আসার পর মানরা গোয়ালপাড়া, শ্রীহট্ট এবং চট্টগ্রামের পথে ইংরেজ রাজ্যে ঢুকে লুটপাট শুরু করায় মানেদের রাজ্যলিপ্সা বেড়ে যায়। মানেরা নগাঁও থেকে ১৮১৯ সালে তাদের জয় করা মণিপুর রাজ্যের মধ্য দিয়ে কাছাড় রাজ্যে প্রবেশ করে। মান সেনা কাছাড়ে ঢোকায় ইংরেজ এবং মানরাজার সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফলে জেনারেল লর্ড আর্মহাস্ট ব্রক্ষদেশের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল গুয়াহাটি থেকে গোয়ালপাড়া পযর্ন্ত অসমের নিম্ন অঞ্চলে। ইংরেজ সেনা তিন দিক থেকে মানেদের আক্রমণ করেছিল। ম্যাকমোরেইনের অধীনে একটি বাহিনী গোয়ালপাড়া হয়ে ব্রক্ষপুএ দিয়ে গুয়াহাটির দিকে, দ্বিতীয় এক বাহিনী আক্রমণ করেছিল চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্ট সীমান্ত দিয়ে মণিপুর, জয়ন্তিয়া রাজ্যের দিকে। এছাড়া তৃতীয় বাহিনী ইরাবতী নদী দিয়ে রেঙ্গুন অভিমুখে।
প্রশ্ন ১১। ইয়াণ্ডাবু সন্ধির উল্লেখযোগ্য ফলাফলগুলি উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ইয়াণ্ডাবু সন্ধির উল্লেখযোগ্য ফলাফলগুলি হলো—–
(১) মান রাজাকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানিকে এক কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়।
(২) আরাকান এবং তেনাসোরিম প্রদেশ ব্রিটিশের হাতে যায়।
(৩) অসম, কাছাড় এবং জয়ন্তীয়া রাজ্যে মানেরা সবরকম হস্তক্ষেপ করা থেকে বঞ্চিত হয়।
(৪) মানরা মণিপুরের রাজা গম্ভীর সিংহকে রাজা মানতে বাধ্য হয়।
এরকম ইয়াণ্ডাবু সন্ধির শর্তসমূহ ব্রিটিশের অনুকূলে গিয়েছিল। ইয়াণ্ডাবু সন্ধি অসমে মানের ক্ষমতার অবসান ঘটিয়েছিল। এই সন্ধির পর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি অসমে শাসনভার গ্ৰহণ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পত্তন করেছিল। এই সন্ধির ফলে অসম এবং নিকটবর্তী রাজ্যসমূহের ক্ষেত্রে এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
প্রশ্ন ১২। ইয়াণ্ডাবু সন্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে লিখ।
উত্তরঃ য়াণ্ডাবু সন্ধির গুরুত্ব :ই ইয়াণ্ডাবু সন্ধির মধ্য দিয়ে প্রথম ইঙ্গো-বার্মা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল। ইয়াণ্ডাবু সন্ধির মধ্য দিয়ে অসম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশের হাতে যায়। অসমের সঙ্গে সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য ইয়াণ্ডাবু সন্ধি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সন্ধি। এই সন্ধি অসমের ইতিহাসের ধারা বদল করেছিল। এই সন্ধির দ্বারা মান রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি শাসনভার গ্ৰহণ করে।
সংক্ষিপ্ত টীকা :
(১) বদৌপায়া।
(২) গম্ভীর সিং।
(৩) গোবিন্দচন্দ্র।
(৪) দামান গগৈ।
(৫) হাওবরা।
(৬) ঘিলাধারীর যুদ্ধ।
(৭) ব্রজনাথ।
(৮) পুরন্দর সিংহ।
(৯) লুকু ডেকাফুকন।
(১০) আলুমিঙ্গি।
(১১) দোয়নীয়া।
(১২) ইয়াণ্ডাবু সন্ধি।
উত্তরঃ (১) বদৌপায়া : বদৌপায়া ছিলেন ব্রক্ষদেশের রাজা। ১৭৮৪ সালে মান সেনা আরাকান জয় করে। বদৌপায়ার রাজত্বকালে রাজ্যবিস্তারের নীতি মণিপুর ও অসম পযর্ন্ত সম্প্রসারিত। বদনচন্দ্র বরফুকন বদৌপায়াকে অসম আক্রমণের দিলে তিনি বিশাল সৈন্যবাহিনী অসমে প্রেরণ করেন। বর্মী সেনা অসমে প্রবেশ করে এটি দখল করে। ১৮৯৯ সালের মে মাসে বদৌপায়ার মৃত্যু হয়।
(২) গম্ভীর সিং : গম্ভীর সিং ছিলেন মণিপুরের রাজকুমার। ১৮১৯-২৩ সালের মধ্যে ব্রক্ষরাজ বদৌপায়া ও তাঁর নাতি বাজিদত্তর রাজত্বকালে মণিপুরের উপর রাজত্ব কায়েম করে গম্ভীর সিং, মরজিৎ সিং ও সুরজিত সিং নামে তিনজন রাজকুমারকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেন। তারা ভয়ে কাছাড়ে পালিয়ে যান।
(৩) গোবিন্দচন্দ্র : গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন কাছাড়ের সর্বশেষ রাজা। তিনি ছিলেন কাছাড়ী রাজবংশের রাজা। মণিপুরের তিন রাজকুমার গম্ভীর সিং, সরজিৎ সিং ও সুরজিৎ সিং ব্রক্ষরাজ বদৌপায়া কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে কাছাড়ে প্রবেশ করলে রাজা গোবিন্দচন্দ্র তাদের বিদ্রোহের ভয়ে শ্রীহট্টে পলায়ন করে ইংরাজদের শরণাপন্ন হন। পরবর্তীকালে মানেরা কাছাড়ে আধিপত্য স্থাপনের আশায় ১৮২৩ সালে গোবিন্দচন্দ্রের সমর্থনে মণিপুরের রাজকুমার গম্ভীর সিংহের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
(৪) দামান গগৈ : দামান গগৈ ও হাওবরা দুজনেই ছিলেন পূর্ণানন্দের সেনাধ্যক্ষ। বদনচন্দ্র বরফুকনের সাহায্যার্থে বর্মীরাজ ১৮১৭ সালে একদল বর্মী সেনা অসমে পাঠালেন। বুড়াগোঁহাই তাদের গতিরোধ করতে দামান গগৈ ও হাওবরার নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠান। কিন্তু বদনচন্দ্রের নেতৃত্বে তারা ঘিলাধারীর যুদ্ধে পরাভূত হন।
(৫) হাওবরা : (৪নং টীকা দেখ)
(৬) ঘিলাধারীর যুদ্ধ : ১৮১৭ সালে ঘিলাধারীর যুদ্ধ মানসেনা ও পূর্ণানন্দ বুঢ়াগোঁহাই-এর সেনাদের মধ্যে সংঘটিত হয়। বদনচন্দ্র বরফুকনের সাহায্যের জন্য বর্মীরাজ ১৮১৭ সালে একজন বর্মী সেনা অসমে পাঠান। পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই তাদের গতিরোধের জন্য একদল সেনা পাঠান। উভয় দলের মধ্যে ঘিলাধারী নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পূর্ণানন্দের সেনাবাহিনী পরাভূত হয়।
(৭) ব্রজনাথ : ১৮১৭ সালে বদনচন্দ্রকে হত্যা করা হয়। বদনচন্দ্রের মৃত্যুর পর রুচিনাথ বুড়াগোঁহাইকে সরকার চালানোর জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু তিনি চন্দ্রকান্তের অধীনে সরকার চালাতে সম্মত হলেন না। তিনি চন্দ্রনাথ সিংহকে অপসারিত করে তাঁর পদে বিজয় বরমুড়া গোঁহাইর পুত্র ব্রজনাথ গোঁহাইকে রাজা করার চেষ্টায় ব্যস্ত হন। বজ্রনাথ গোঁহাই নামে এই লোক পুরন্দর সিংহের সঙ্গে ১৮০৯ সাল হতে কোম্পানীর রাজ্যের চিলমারীতে আশ্রয় নিয়েছিল।
(৮) পুরন্দর সিংহ : পুরন্দর সিংহ ছিলেন শেষ স্বাধীন আহোম রাজা। তিনি ১৮১৮ সালের মার্চ মাসে ইয়াণ্ডাবুর সন্ধির মাধ্যমে বর্মী শাসনের অবসান ঘটে এবং সমগ্ৰ অসমে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৩ সালে রবার্টসন আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরপূর্ব অসম পুরন্দর সিংহকে প্রত্যাপর্ণ করে। তিনি প্রতিশ্রুতি মত বার্ষিক ৫০ হাজার টাকা কর দিতে অক্ষম হন। ১৮৩৮ সালে তাঁকে পুনরায় সিংহাসনচ্যুত করা হয়।
(৯) লুকু ডেকাফুকন : লুকু ডেকাফুকন আহোম রাজা চন্দ্রকান্ত সিংহের রাজত্বকালে একজন রাজকর্মচারী ছিলেন। চন্দ্রকান্ত সিংহ এবং পুরন্দর সিংহ একযোগে বর্মীদের অসম থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাদের চেষ্টা ফলবতী হয়নি। বর্মীরা অসম দখল করে বসে। চন্দ্রকান্ত সিংহ হিন্দুস্থানী ও শিখ সেনার সাহায্যে গৌহাটী অধিকার করে যোড়হাট অভিমুখে রওনা হলেন। চন্দ্রকান্ত সিংহ লুকোডেকা ফুকনের নেতৃত্বে রুচিনাথের বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করে নিজে রংপুর পযর্ন্ত চলে যান। রুচিনাথের কাছে তারা পরাভূত হন এবং সেনাপতি লুকোডেকা ফুকন যুদ্ধে নিহত হন।
(১০) আলুমিঙ্গি : আলুমিঙ্গি ছিলেন বর্মীসেনাদের সেনাপতি। বদনচন্দ্র বরফুকনের হত্যা ও চন্দ্রকান্ত সিংহের সিংহাসনচ্যুতি ইত্যাদির খবর নিয়ে তাদের পক্ষীয় একদল লোক বর্মী রাজের কাছে চলে গেল। আহোম সৈন্যরা চন্দ্রকান্ত সিংহের একটি কান কেটে তার অঙ্গচ্ছেদ করে দিয়েছিল যাতে তিনি পুনরায় সিংহাসন দাবী করতে না পারেন। বদনের হত্যার খবর পেয়ে বর্মীরাজ খুব ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি আলুমিংগি নামক সেনাপতির অধীনে ১৮১৯ সালে ১০,০০০ সৈন্যর এক বিশাল বাহিনী পাঠান। নাজিরাতে আহোমদের সঙ্গে বর্মীদের ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আহোম সৈন্য পরাজিত হয়। পুরন্দর সিংহ ভয়ে গৌহাটীতে পালান। চন্দ্রকান্ত সিংহ জগপুরে বর্মী সৈন্যের সঙ্গে মিলিত হলেন। তাকে পুনরায় সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
(১১) দোয়নীয়া : ব্রক্ষরাজ বদৌপায়ার মৃত্যুর পর তাঁর নাতি বাজিদাও ব্রক্ষদেশের রাজা হন। তিনিও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন। সুতরাং ব্রক্ষদেশের নূতন রাজার সিংহাসনপ্রাপ্তিতে অসমের ক্ষেত্রে নীতিগত কোনো পরিবর্তনের সূচনা হয় নি। বরং সামরিক অভিযান বেশি শক্তিশালী করে তোলা হয়েছিল। এই সময়ে মানের আক্রমণের সুযোগ নিয়ে বহু অবস্থাসম্পন্ন অসমীয়া মানুষ অসমীয়া লোকের উপর অত্যাচার উৎপীড়ন শুরু করেছিল। এই সকল লোককে বলা হয় দোয়নীয়া। প্রকৃতপক্ষে মানদের চেয়ে দোয়নীয়াদের অত্যাচার প্রবল ছিল। দেশ জয়, নিজ আহার সংগ্ৰহ, ধনোপার্জন করাই মানদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু সেই দোয়নীয়াদের হিংসা, লোভ প্রভৃতি রিপুর বশবর্তী হয়ে তারা অত্যাচার করত।
(১২) ইয়াণ্ডাবু সন্ধি : মান বা বর্মী ও ইংরাজদের মধ্যে ইয়াণ্ডাবুর সন্ধি হয়। এই সন্ধির দ্বারা প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৮২৬ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী ইয়াণ্ডাবুর সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ইয়াণ্ডাবুর সন্ধির ফলে বর্মীরাজা আহোম কাছাড়, জয়ন্তিয়া ও মণিপুর রাজ্যের উপর তাঁর অধিকার সম্পূর্ণ ত্যাগ করেন এবং এই সমস্ত রাজ্যে পুনরায় হস্তক্ষেপ হতে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিও দেন। বর্মী রাজা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্ধির শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হন। বর্মীরাজা মণিপুরের রাজা গম্ভীর সিংহকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। ইয়াণ্ডাবুর সন্ধির ফলে অসমে বর্মী শাসনের অবসান হয় এবং অসমে ব্রিটিশ আধিপত্য স্থাপনের পথ সুগম হয়।
অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরঃ
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। দ্বিতীয় ব্রক্ষযুদ্ধের পর পুরন্দর সিংহ, বুড়াগোঁহাই বরবরুয়া ও বড় গোঁহাই-এর পরিণতি কি হয়েছিল ?
উত্তরঃ পুরন্দর সিংহ ও বুড়াগোঁহাই ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে পালান কিন্তু বরবরুয়া ও বড়গোঁহাই-এর প্রাণদণ্ড হয়।
প্রশ্ন ২। দ্বিতীয় বর্মীযুদ্ধের সময় ব্রক্ষদেশীয় বাহিনীর সেনাপতি কে ছিলেন ?
উত্তরঃ দ্বিতীয় বর্মীযুদ্ধের সময় ব্রক্ষদেশীয় বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন আলুমিঙ্গি।
প্রশ্ন ৩। প্রথম বর্মী আক্রমণের সময় বুড়াগোঁহাই কে ছিলেন ?
উত্তরঃ পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই-এর মৃত্যুর পর রুচিনাথ বুড়াগোঁহাই।
প্রশ্ন ৪। বদনচন্দ্রকে কে কখন হত্যা করে ?
উত্তরঃ বদনচন্দ্রকে ১৮১৮ সালে হত্যা করে রূপ নামক এক সুবেদার।
প্রশ্ন ৫। চন্দ্রকান্তকে কেন একটি কান কেটে দেওয়া হয়েছিল ?
উত্তরঃ চন্দ্রকান্তকে একটি কান কেটে দেওয়া হয়েছিল যাতে তিনি আর আহোম সিংহাসন দাবী না করেন।
প্রশ্ন ৬। দ্বিতীয় বর্মী আক্রমণ কখন হয়েছিল ?
উত্তরঃ দ্বিতীয় বর্মী আক্রমণ হয়েছিল ১৮১৯ সালে।
প্রশ্ন ৭। চন্দ্রকান্ত সিংহ দ্বিতীয়বার কখন গৌহাটীতে পালিয়ে যান ?
উত্তরঃ ১৮২১ সালের এপ্রিল মাসে।
প্রশ্ন ৮। তৃতীয় ব্রক্ষযুদ্ধের সময় ব্রক্ষদেশীয় সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি কে ছিলেন ?
উত্তরঃ মিহিমাঙ্গা বন্দুলা।
প্রশ্ন ৯। মহাগড়ের যুদ্ধ কাদের সঙ্গে হয়েছিল ?
উত্তরঃ চন্দ্রকান্ত সিংহ ও বর্মীদের মধ্যে।
প্রশ্ন ১০। প্রথম মান আক্রমণের সময় বুড়াগোঁহাই কে ছিলেন ?
উত্তরঃ পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই।
প্রশ্ন ১১। লংকাকাণ্ডের অসমীয়া অনুবাদ কে কোন্ আহোম রাজার আমলে করেছিলেন ?
উত্তরঃ শ্রীকান্ত সূর্য বিপ্র, রাজা কমলেশ্বর সিংহের আমলে।
প্রশ্ন ১২। গৌরীনাথ সিংহ কেন ইংরেজ সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন ?
উত্তরঃ মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ দমনের জন্য।
প্রশ্ন ১৩। বদনচন্দ্র কেন ব্রক্ষদেশ গিয়েছিলেন ?
উত্তরঃ ব্রক্ষদেশের রাজার নিকট সাহায্য প্রার্থনার জন্য।
প্রশ্ন ১৪। চন্দ্রসিংহ কেন গৌহাটীতে পালিয়ে গিয়েছিলেন ?
উত্তরঃ মান সৈন্যদের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
প্রশ্ন ১। সংক্ষিপ্ত টীকা লিখ :
(১) পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই : ঘনশ্যাম বুড়াগোঁহাইর পুত্র পূর্ণানন্দ গোঁহাই ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বুড়াগোঁহাই পদে নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অসম ইতিহাসে তাঁর একটি বিশেষ স্থান আছে।
গৌরীনাথ সিংহের রাজত্বকালে মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ শুরু হলে দূরদর্শী পূর্ণানন্দ বিদ্রোহের গুরুত্ব বুঝতে পেরে রাজাকে বিদ্রোহের সঙ্গে আপোস করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ হলে আহোমগণ চরম দুর্গতির হাত রক্ষা পায়। কিন্তু রাজা গৌহাটীতে পালালে রাজভক্ত পূর্ণানন্দ বিদ্রোহীগণকে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ পযর্ন্ত পথ অবরোধ করে রাখে। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সৈন্য আসায় বিদ্রোহীগণ পশ্চাদপসরণ করে।
এর পর তিনি বিধবস্ত রাজ্যে শাস্তি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বদনচন্দ্রের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় বদনচন্দ্র বর্মী সৈন্যকে অসম আক্রমণ করতে আহবান জানায়।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বর্মী সৈন্যর কাছে আহোম সৈন্য পরাজিত হয়। এর পর পূর্ণানন্দের মৃত্যু হয়। তাঁর মত নিঃস্বার্থ কর্মী বিপদের সময় অসম হারাল।
(২) লতাকাটা রণ : রাজা রাজেশ্বর সিংহের রাজত্বকালে বর্মীগণ মণিপুরের রাজা জয়সিংহকে বিতাড়িত করেছিল। তাঁকে সাহায্য করতে রাজেশ্বর সিংহ একদল সৈন্য পাঠান। এই সৈন্যদল নাগাপাহাড়ের মধ্য দিয়ে মণিপুরের দিকে অগ্ৰসর হয়। কিন্তু নাগাপাহাড়ের দুর্গম ও দুর্ভেদ্য অরণ ভেদ করে বেশি দূর অগ্ৰসর হতে না পেরে তারা ফিরে আসে। কোনো যুদ্ধ না করে শুধুমাত্র জঙ্গলের লতাপাতা কেটেছিল বলে এই ঘটনা লতাকাটা রণ নামে পরিচিত।
(৩) কীর্তিচন্দ্র বরবরুয়া : কীর্তিচন্দ্র বরবরুয়া গেন্ধেলা বরবরুয়া নামেও পরিচিত। রাজেশ্বর সিংহের রাজত্বকালে তাঁর ক্ষমতা বাড়ে। রাজার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি নিজের ক্ষমতা অসম্ভব রকম বাড়ান।
কীর্তিচন্দ্রের এইরূপ অভাবনীয় প্রতিপত্তি দেখে অনেক কর্মচারী মনে মনে তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। নুমলী বরগোঁহাই এইরূপ একজন অসন্তুষ্ট রাজকর্মচারী। তিনি একটি বুরঞ্জী বের করে কীর্তিচন্দ্রের বংশগৌরব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কীর্তিচন্দ্র বেশ কয়েকখানি বুরঞ্জী এনে পরীক্ষা করে আপত্তিকর কথাগুলিকে পুড়িয়ে ফেলেন। এতে অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। তাঁর চেষ্টায় রাজেশ্বর সিংহের পর লক্ষীসিংহ রাজা হন। মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ হলে তাঁর অদূরদর্শীতার জন্য মোয়ামরীয়াগণ রাজাকে বন্দী করে এবং তাঁকে সপরিবারে বধ করে।
(৪) বদনচন্দ্র বরফুকন : হরনাথ সেনাপতির পুত্র বদনচন্দ্র। তিনি কলিয়া-ভোমরার মৃত্যুর পর বরফুকন পদ লাভ করেন। বদনচন্দ্র ছিলেন অত্যাচারী। তিনি পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাইর প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন। বদনচন্দ্রের অত্যাচার ও পূর্ণানন্দের বিরোধিতার জন্য তাঁকে বন্দী করা হবে বলে স্থির হয়। এটা জানতে পেরে বদনচন্দ্র কলিকাতায় পালান। সেখানে ইংরেজের সাহায্য প্রার্থনা করে ব্যর্থ হলে ব্রক্ষদেশে গিয়ে বর্মীরাজার সাহায্য প্রার্থনা করেন। ব্রক্ষদেশের রাজা বড়োপারা অসম আক্রমণের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। বদনের আমন্ত্রণে তিনি ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে বদনের সঙ্গে একদল সৈন্য পাঠান। যুদ্ধের আগেই পূর্ণানন্দের মৃত্যু হয়েছিল। বর্মী সৈন্য আহোম সৈন্যদের পরাজিত করে যোড়হাট দখল করে। চন্দ্রকান্ত সিংহকে রাজপদে রেখে বদনচন্দ্রকে বরফুকন করা হয়। এর পর বর্মীসৈন্য অসম ত্যাগ করলে বদনচন্দ্রই রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন।তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাজমাতা, বরবরুয়া ও বরগোঁহাই প্রভৃতিরা বদনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বদনকে নিহত করে। বদন অসমের যে ক্ষতি করেছিলেন তা অপূরণীয়।
(৫) লালুকসোলা বরফুকন : যে সকল লোক আহোম রাজ্যের দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে লালুকসোলা অন্যতম। তিনি মোমাই তামুলী বরবরুয়ার পুত্র ও লাচিত বরফুকনের ভ্রাতা। লাচিত বরফুকনের মৃত্যুর পর লালুকসোলাকে গৌহাটীতে বরফুকন করে পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন স্বার্থপর স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে-কোন কাজ করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। নিজে ক্ষমতালাভ করবার জন্য লালুক বাংলার সুবাদার আজমতারার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে বিনা যুদ্ধে গৌহাটি মোগলের হাতে তুলে দেন। গৌহাটী হস্তচ্যুত হওয়ার সংবাদ পেয়ে আতা বুড়াগোঁহাই সৈন্য নিয়ে অগ্ৰসর হলেন কিন্তু লালুক সৈন্যদলকে হাত করে বুড়োগোঁহাইকে বন্দী করে রাখলেন দুইমুনি শিলায়। এর পর লালুক রাজধানীতে গিয়ে পর্বতীয়া রাজা চুফৈফাকে হত্যা করে ১৪ বৎসর বয়স্ক চুলিকফাকে সিংহাসনে বসালেন। নূতন রাজাকে হাতের পুতুল করে লালুক রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে পড়লেন। লালুকের আদেশে আতা বুড়াগোঁহাইকে হত্যা করা হয়।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। অসমে বর্মী আক্রমণের ফল কি হয়েছিল ?
উত্তরঃ। অসম বর্মীদের অধীনে সাময়িকভাবে চলে গিয়েছিল। বর্মী আক্রমণে অসমের বহু জনপদ জনশূন্য হয়, বহু লোক নিহত হয় এবং বন্দী হয়।
বর্মী আক্রমণের অন্যতম প্রধান ফল হল প্রথম ইঙ্গবর্মী যুদ্ধ। বর্মীরা অসম জয় করে বঙ্গদেশ আক্রমণের চেষ্টা চালায়। ইংরেজগণ বর্মীদের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি বন্ধ করতে অসমে প্রবেশ করেন এবং বর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন অসমে আহোম রাজত্বের অবসান হয় বর্মী আক্রমণের ফলে।
বর্মী আক্রমণ প্রতিহত করতে ইংরেজ অসমে প্রবেশ করে, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে অসম দখল করে নেয়।
প্রশ্ন ২। অসমে বর্মীসৈন্যের দ্বিতীয় ও তৃতীয় আক্রমণ বর্ণনা কর।
উত্তরঃ বদনচন্দ্র বুড়োগোঁহাই হয়ে পূর্ণানন্দের সমর্থকদের উপর অত্যাচার শুরু করেন। তখন রাজমাতা, বরবরুয়া ও বরগোঁহাই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং এর অল্পদিন মধ্যে বদনচন্দ্র রূপসিং সুবেদার নামক এক সিপাহীর হাতে নিহত হন। এই সংবাদ পেয়ে রুচিনাথ ব্রজনাথ নামক একজন রাজকুমারকে সঙ্গে নিয়ে জোড়হাট পৌঁছে ব্রজনাথকে সিংহাসনে বসাতে চান। কিন্তু ব্রজনাথের শরীরে ক্ষত থাকায় তাঁর পুত্র পুরন্দরসিংহকে রাজপদে বসালেন। ইতিমধ্যে চন্দ্রকান্ত রংপুরে পালান।
বদনচন্দ্র ও চন্দ্রকান্তের রাজ্যচ্যুতির সংবাদ পেয়ে বর্মীরাজ আলামিঙ্গির নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার অসমে অভিযান প্রেরণ করেন (১৮১৯)। আহোম সৈন্য নাজিরাতে পরাজিত হয়, পুরন্দরসিংহ গৌহাটিতে পালান। আলামিঙ্গি চন্দ্রকান্তকে আবার রাজপদে বসায়। বর্মীরা গৌহাটি আক্রমণ করলে পুরন্দর সিংহ ও রুচিনাথ ব্রিটিশ রাজ্যে আশ্রয় নেয়। আলামিঙ্গি মিঙ্গিমাহ নামক সেনাপতির নেতৃত্বে একদল সৈন্যবাহিনী রেখে নিজে ব্রক্ষদেশে ফিরে যান। এইবার আক্রমণে অসমে প্রকৃতপক্ষে বর্মী শাসন স্থাপিত হয়। আহোম রাজা বর্মীদের হাতে পুত্তলি হন।
বর্মী কর্তৃত্বে অসহ্য হয়ে চন্দ্রকান্ত জয়পুরের নিকট দুর্গ নির্মাণ করতে থাকেন। এই সংবাদ পেয়ে বর্মী রাজ আহোম সৈন্যকে পরাজিত করলে চন্দ্রকান্ত ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে আশ্রয় নেন। বর্মীরা যোগেশ্বর সিংহকে আহোম সিংহাসনে নামেমাত্র বসাল। সমগ্ৰ ব্রক্ষপুএ উপত্যকা বর্মীদের হস্তগত হয়। এর পর চতুর্থবার বর্মী আক্রমণ। চন্দ্রকান্ত গৌহাটি দখল করে।
প্রশ্ন ৩। পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই দৌরাত্ম্য সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ঘনশ্যাম বুড়াগোঁহাইর পুত্র পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই ১৭৮৪ সালে বুড়াগোঁহাই পদে নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৯৭ সালে এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন অসমের ইতিহাসে তাঁর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। গৌরীনাথ সিংহের আমন্ত্রণে কেপ্টেন ওয়েলসের নেতৃত্বে সামরিকবাহিনী পাঠিয়ে ১৭৯২-৯৪ সালে অসমের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। সেই সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাই।
আহোম রাজা চন্দ্রকান্ত সিংহ এবং বদনচন্দ্র বরফুকনের আক্রমণে মান রাজা ১৮১৭ সালের মার্চ মাসে অসমের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। মানেদের এই হস্তক্ষেপ সংঘটিত হয়েছিল বিশেষত প্রধানমন্ত্রী পূর্ণানন্দ বুড়াগোঁহাইর দৌরাত্ম্য ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে।
রাজ্যের বুড়াগোঁহাই হিসাবে পূর্ণানন্দ ছিলেন অসমী ক্ষমতার অধিকারি তিনি গৌরীনাথ সিংহের রাজত্বকালে পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে ১৭৮২ সালে বুড়াগোঁহাই পদবীতে অধিষ্ঠিত হন। মোয়ামরীয়া বিদ্রোহের সময় রাজা গৌহাটী পালালে আপার অসমে পূর্ণানন্দ সর্বেসর্বা হয়ে পড়েন। ১৭৯৪ সালের মার্চ মাসে গৌরীনাথ কেপ্টেন ওয়েলসের সহায়তায় পুনরায় সিংহাসনে আরোহণ করলেও তিনি ইতিমধ্যে দেশের শক্তি ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই অবস্থায় তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষমতা লাভ করলেও সিংহাসন প্রাপ্তির এক বছরের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।
পূর্ণানন্দের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য দেশের লোক তাকে ভালবাসত না। অনেক লোক তাঁকে চোখেই পারত না। তিনি গৌরীনাথ সিংহের মৃত্যুর সংবাদ গোপন রেখে উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি নিজে মীমাংসা করেছিলেন।
রাজার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে নতুন রাজা একজনের নাম ঘোষণা করার কাজটি বরবরুয়ার কিন্তু রাজার মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করা এবং নতুন রাজার নাম ঘোষণা করার দায়িত্ব বরবরুয়ার। পূর্ণানন্দ রোগশয্যায় থাকা সন্দিকৈ পরিবারের ভদবি নামক একজনকে বরবরুয়া পদবীতে নিযুক্তি করেন। কিন্তু সেও যেহেতু রোগশয্যায় পড়ে আছে সেহেতু সেও ভদবি বরবরুয়ার হয়ে কাজ চালাবার জন্য শিবনাছ তামুলী ফুকনকে দায়িত্ব অর্পণ করে। তার মাধ্যমে গৌরীনাথের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর বয়সী কিনারাম ওরফে কমলেশ্বর সিংহকে রাজা বলে ঘোষণা করা হয়। তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণানন্দ রাজার আদেশে নগাঁওর সিন্ধু বা হাজারিকা ও তার পুত্রকে গ্ৰেপ্তার করে এবং পরে দুইজনকে হত্যা করে। তিনি নগাঁওর প্রায় ৫০০ লোককে ধর্মীয় কারণে হত্যা করে কলং নদীতে ফেলে দেন। এইভাবে পূর্ণানন্দের দৌরাত্ম্য ও অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছায়।
প্রশ্ন ৪। আহোম রাজত্বের পতনের কারণ বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ আহোমগণ খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ হতে প্রায় ছয় শত বৎসর ধরে অসমে রাজত্ব করে। এই দীর্ঘ শাসনের পরও তাদের পতন ঘটে। এর অনেক কারণ দেখা যায়।
(১) অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দুর্বল ও অক্ষম আহোম রাজারা সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁদের দুর্বলতার সুযোগে রাজ্য মধ্যে বিভিন্নরূপ ধবংসাত্মক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
(২) মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ আহোমগণের পতনের অন্যতম কারণ। এই বিদ্রোহে আহোম রাজ্যের সংহতি ও আহোম রাজাদের মানমর্যাদা বিনষ্ট হয় এবং রাজকোষ শূন্য হয়।
(৩) দুর্বল আহোম রাজাদের সময় অভিজাত শ্রেণি উচ্চাকাঙক্ষী, দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বার্থপর হওয়ায় অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়, আহোমদের অবনতি ঘটায়।
(৪) অসমের জলবায়ুর ফলে আহোমগণের শারীরিক অবনতি ঘটে, তাঁদের শৌর্যবীর্য ক্রমে বিনষ্ট হয়ে যায়।