Class 9 Bengali Rachana | রচনা

Class 9 Bengali Rachana | রচনা Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 9 Bengali Rachana | রচনা and select needs one.

Class 9 Bengali Rachana | রচনা

Join Telegram channel

Table of Contents

Also, you can read SCERT book online in these sections Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 9 Bengali Rachana | রচনা for All Subject, You can practice these here…

রচনা

আসামের উৎসব-সংস্কৃতি-লােকধর্ম

প্ৰাচীন কাল থেকেই আসামের রহস্য ও মােহময় আকর্ষণে দলে দলে মানুষ এসেছে এখানে। সকলকেই আসাম সাদরে গ্রহণ করেছে এবং বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির সংমিশ্রণে এখানকার সংস্কৃতি ও লােকধর্ম গঠিত হয়েছে।

পৌরাণিক যুগে প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপের খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত ছিল। যদিও প্রাচীনকালে এখানে আর্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে তবু তা সেখানে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। নাগা, কুকী, মিশটি, আরব, মিকির প্রভৃতি নানা জাতির অবদানে আসামের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

বাংলার মতাে নানা উৎসব ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আসাম তার লােকধর্ম অভিব্যক্ত করেছে। দুর্গোৎসব, বিহু উৎসব, শৈব-গীত, রামায়ণী গান, রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসমবাসী তাদের ঈশ্বরের অন্তরােপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছে। এই অনুষ্ঠানগুলিই এখানে লােকউৎসবের রূপ ধারণ করেছে। আসামের সকল শ্রেণির মানুষ এইসব উৎসবে মাতােয়ারা হয়ে উঠে আসামের লােকধর্ম এখানকার মানুষের অন্তরের মুক্ত অভিব্যক্তি বলা যায়।

এখানকার লােকধর্মের প্রধান কেন্দ্র হল কামরূপ কামাখ্যাদেবীর মন্দির। এটি একটি মহাতীর্থ। এই মহাতীর্থকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা কিংবদন্তী। রাজা নরনারায়ণ কামাখ্যাদেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরে প্রতিষ্ঠাতা দেবী কামাখ্যা। কামাখ্যা শক্তিসাধনার একটি প্রধান কেন্দ্র । বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এসে দেবীর উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করেন । আহাৈম রাজাদের সময়ে এখানে দুর্গা কালী প্রভৃতি দেবদেবীর পূজার প্রচলন। শ্রীকৃষ্ণের লীলা উৎসবও এখানে অনুষ্ঠিত হয়।

এখানকার সর্বপ্রধান লােকভিত্তিক উৎসব হল বিহু উৎসব। বহাগ, কাতি ও মাঘ এই তিনটি বিহু তিনটি বিশেষ ঋতুতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ঋতু উৎসব হলেও এগুলি ধর্মানুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বহাগ বা বৈশাখী বিহু বসন্ত ও নববর্ষের উৎসব। এতে আসামের মানুষ কোন উন্মুক্ত স্থানে, বাঁশবনের ছায়ায় বা আম্রকুঞ্জে ঢাকঢোল বাজিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। নাচ ও গান করে, গানগুলি হল বিহুগীত। বিষয় প্রকৃতি ও প্রেম। দুইমাস- চৈত্র ও বৈশাখে চলে এই উৎসব। আশ্বিনের শেষ দিন থেকে শুরু হয় কাতি বিহু বা কাঙালী বিহু। এই সময় তুলসীতলায় প্রদীপ দেওয়া হয় এবং আকাশপ্রদীপ জ্বালা হয়। তিনটি বিহুর মধ্যে মাঘ বা ভােগালী বিহু সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব। ঘরে ঘরে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য। সকলে মিলে মিশে ভাল ভাল খাদ্যদ্রব্য খায়। এই উৎসব আসামবাসীর প্রাণের উৎসব।

লােকধর্মের সঙ্গে আসামে লােকউৎসব মিশে রয়েছে। এখানে এক সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ আর তাতে সকলে মিলে প্রতিটি মুহূর্তকে যেন উৎসব মুখর করে তােলে। নৃত্যগীত চলে প্রতিদিনই। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এখানে সকলে লােকউৎসবের সামিল হয়। তাই আসাম যেন জাতীয় সংহতির পীঠস্থান।

অসংখ্য জাতির মিলনক্ষেত্র এই আসাম। নানা স্থান থেকে নানা মানুষের ধারা এখানে মিলিত হয়েছে। তাই নানা উৎসবের মধ্যে এসেছে বৈচিত্র্য। জাতীয় সংহতির পক্ষে নানা উৎসবের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। আসামের লােক উৎসব সমূহের মধ্যে তার প্রাণসম্পদ লুকানাে রয়েছে। তাই রাজনীতির অনুপ্রবেশে যাতে আসামের লােকধর্ম বিঘ্নিত না হয় সেদিক লক্ষ্য রাখা বিশেষ প্রয়ােজন।

আসামের রেশম শিল্প

আসামের রেশমশিল্প বিশ্ববিখ্যাত। প্রাচীনকাল থেকেই তার নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে মুগা রেশমবস্ত্র পাওয়া যায়। গুটিপােকা পালন ও রেশমবস্ত্র উৎপাদনে চীনদেশের মতাে কামরূপের খ্যাতি ছিল। বােড়াে সম্প্রদায় প্রথম গুটিপােকার চাষ শুরু করে।

সারা ভারতে যত রেশম উৎপাদিত হয় তার বেশির ভাগ হয় আসামে। চাষবাসের ঋতুর আগে ও পরে অবসর সময়ে কৃষক সম্প্রদায় রেশম উৎপাদন করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই কাজে নিযুক্ত থাকে।

রেশম উৎপাদনের প্রথমে চাই রেশমকীট পালন। ওরা গুটি তৈরি করে। গুটি হতে আঁশ পাওয়া যায়। এই আঁশ তিন রকমের—এড়ি, পাট ও মুগা। প্রধানত তিনশ্রেণির রেশমকীট দেখা যায়

১। এড়ি 

২। মুগা 

৩। পাট। 

এড়ি পােকারা রেড়ি গাছের পাতা খায়। মুগা রেশমের উপরিভাগ।তিন রকম রেশম থেকেই রেশম বস্ত্র উৎপাদিত হয়। বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে এই পােষাক ব্যবহৃত হয়। এখানকার নারীসমাজ রেশমবস্ত্র উৎপাদনে অগ্রণী। তারা গুটি পােকা পালনের কাজও করে। সমবায় সমিতির মাধ্যমে গুটি পােকার চাষ হয়। রেশম কীটের শ্রেণিবিভাগ মত রেশম বা সিল্কের শ্রেণিবিভাগ হয়। এড়ি পােকারা যে রেশম তৈরি করে তা থেকে এণ্ডিবস্ত্র তৈরি হয়। শীতের সময় এর খুব চাহিদা। মুগাবস্ত্র হয় সােনালী হলুদ রঙের। পাট রেশমের আঁশ সব চাইতে মােলায়েম ও মসৃণ। এর রং সাদা আর হলুদের মাঝামাঝি। আসামের নানা অঞ্চলে ব্যাপক রেশমবস্ত্র উৎপাদিত হয়। দরং জেলায় এড়ি ও পাট রেশমবস্ত্র বেশি উৎপন্ন হয়, মুগা হয় কম। গােয়ালপাড়া অঞ্চলে এড়ি সবচেয়ে বেশি হয়, মুগা ও পাট রেশমবস্ত্র উৎপন্ন হয় কম। গারাে পার্বত্য অঞ্চলে এড়ি চাষ প্রধান। নওগাঁ ও কামরূপে তিন রকম রেশম উৎপন্ন হয়। শিবসাগর জেলায় মুগা হয় খুব বেশি। এড়ি সুতাে দিয়া তৈরি হয় বােরকাপড়, এড়ি পশরা ও চাদর। পুরুষরা এইগুলি ধুতি ও আংরাখা রূপে ব্যবহার করে। পাট ও মুগার সুতা দিয়া মেখলা; চাদর, রিহা, চেলেও, ব্লাউজ শাড়ি প্রভৃতি তৈরি হয়।

আসামের রেশম শিল্প এর গর্ব এবং গৌরব। এই শিল্পের উন্নতির জন্য সরকার পক্ষ হতে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এখানকার রেশম শিল্প যাতে তার গৌরব ও ঐতিহ্য বজায় রাখতে পারে সেজন্য সকলকে সতর্ক এবং সচেতন থাকতে হবে।

আমার প্রিয় গ্রন্থকার শরৎচন্দ্র

যে-কোন প্রিয় নির্বাচনই ব্যক্তিগত রুচি-নির্ভর। সেই রুচি-নিরিখেই আমার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বসূরি, তার উত্তরসাধক তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতিভূষণ। জীবন চলমান। সাহিত্যও চলে, এগিয়েই চলে। মহৎ প্রতিভার পুণ্যস্পর্শে সাহিত্যেও কেবলই রূপের পালাবদল। বঙ্কিমচন্দ্রের রােমান্স বা ইতিহাসের ধূসর জগতে শরৎচন্দ্র আমাদের নিয়ে যাননি। রবীন্দ্রনাথের উচ্চবিত্ত বা অভিজাত শ্রেণির চরিত্ররাও তার সাহিত্যের সাম্রাজ্য অধিকার করেনি। আবার পরবর্তী কথাশিল্পী তারাশঙ্কর- মানিক- বিভূতিভূষণের সৃষ্ট চরিত্রদের মতন তার চরিত্ররা তেমন অন্তর্মুখীন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত নয়। নয় বহিৰ্জীবন- অন্তৰ্জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির-উদ্বেল। 

শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ আর নেই। একান্নবর্তী পরিবার আজ বিধ্বস্ত। সমস্যা বদলেছে। স্নেহ মমতার পাত্র যন্ত্র এসে কেড়ে নিয়েছে। নর-নারীর হৃদয়-সম্পর্কে জটিলতা বেড়েছে। বেড়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। সমাজে নানা ভাঙচুর। দেহে-মনে তারই টানা-পােড়েন। শরৎ-সাহিত্যের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিই হয়তাে চোখে পড়ে। সমালােচকরা অনেক সময়ই তার ওপর নির্দয়। তবু আজও তিনি অগণিত পাঠকের হৃদয়-সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত। আজও তিনি বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় । কথাশিল্পী। কিন্তু কেন ? তার সাহিত্যে মনুষ্যত্বের মহিমাই উচ্চারিত হয়েছে। প্রথম ধ্বনিত হয়েছে লাঞ্ছিত মানবাত্মার মহাক্রন্দন।

রবীন্দ্ৰ- প্ৰতিভা – সূৰ্য তখন মধ্য-গগনে। সেই উজ্জ্বল আলােকবিভায় যে-কোন প্রতিভাই তখন ম্লান। সাহিত্যিক-স্বীকৃতি তখন যথার্থই দুঃসাধ্য। তখনই সাহিত্য-দিগন্তে এক নতুন প্রতিভা-নক্ষত্রের উদয় হল। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সেই প্রতিভা অনায়াসেই জনচিত্তকে জয় করল। সেই প্রতিভার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি হলেন বাংলার জনচিত্তজয়ী কথাশিল্পী। দারিদ্র্যের সঙ্গে ছিল তার আবাল্য পরিচয়। হুগলীর দেবানন্দপুরে জন্ম হলেও তাঁর শৈশব কেটেছে ভাগলপুরে মাতুলালয়ে। চাকরিসূত্রে তিনি রেঙ্গুন-প্রবাসী। চৌদ্দ বছর বয়সে কাশীনাথ’ লেখা হলেও ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার প্রাপ্ত মন্দির’ গল্পটিই তার প্রথম প্রকাশিত গল্প। ১৯০৭ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বড়দিদি’-ই সাহিত্য-ক্ষেত্রে তাঁকে দিল স্থায়ী আসন। বৃহত্তর পাঠক-অভিনন্দনে তিনি কৃতার্থ হলেন। ফিরে এলেন কলকাতায়। আত্মনিয়ােগ করলেন সাহিত্যচর্চায় ।

উপন্যাসেই শরৎ-প্রতিভার যথার্থ বিকাশ। সংসারের পরিচিত সাধারণ নবকককৃনারীই তাঁর উপন্যাসের পাত্রপাত্রী। তাদেরই সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, দ্বন্দ্ব-মিলন, ঈর্ষা-প্রেমের অশ্রুসিক্ত কাহিনী তিনি লিখে গেছেন। ঘরের কথাকে এমন মর্মস্পর্শী আবেগ সহানুভুতি মথিত ভাষায় শরৎচন্দ্রের আগে আর কেউ লেখেননি। দুঃখী, ব্যথিতের জন্য তিনি উজাড় করে দিলেন তার হৃদয়ের বেদনা-উৎস। সেখানকার যত করুণাবারি সমস্তই বর্ষিত হল এই অবহেলিত নিরুপায় মানুষের জন্য। তাঁর উপন্যাসের কতকগুলাে আয়তনে ক্ষুদ্র, কতকগুলাে বৃহৎ।

তার ‘কাশীনাথ’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’, ‘বড়দিদি’, ‘মেজদিদি, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘পরিণীতা’, ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘দত্তা’, ‘পণ্ডিতমশাই’ প্রভৃতি ক্ষুদ্রায়তন উপন্যাসে গার্হস্থ্য জীবনের নানা মান-অভিমান, ঈর্ষা-দ্বন্দ্ব, স্নেহ-প্রীতির মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কোথাও মাতৃত্বের হাহাকার, কোথাও নিকষিত হেম প্রেমের রসমাধুর্য, কোথাও ব্যর্থ প্রেমের দীর্ঘশ্বাস, সকরুণ বিলাপ; কোথাও ভুল বােঝাবুঝির অন্তর্বেদনা, কোথাও প্রীতিপ্রেমের পুণ্য বাধনে সেই অন্তরচারী বেদনার নিরসন। আবার ‘পল্লীসমাজ’, বামুনের মেয়ে’, ‘দেনা পাওনা ইত্যাদি উপন্যাসে পল্লীর তুচ্ছতা, সঙ্কীর্ণতা, দলাদলি, নীচতার রুঢ়-রুক্ষ বাস্তব ছবি এঁকেছেন। শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’, উপন্যাসে ঘােষণা করেছেন সমাজ-অস্বীকৃত প্রেমের মহিমা। গৃহদাহ’, আধুনিক জটিল মনস্তত্ত্ব-নির্ভর নরনারীর করুণ জীবন- আলেখ্য। পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন’ উপন্যাসে হয়েছে আধুনিক সমাজ-বিবর্তনের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। কিন্তু সর্বত্রই মানবতার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নির্যাতন, সংস্কার পঙ্গু বিধিনিষেধের হৃদয়হীনতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।

শরৎ প্রতিভা মূলতঃ উপন্যাস বা বড় গল্প আশ্রয় করেই সৃষ্টিমুখর হয়েছে। তার প্রতিভা ছােটগল্প রচনার অনুকূল ছিল না। তবু যে সামান্য কটি ছােটগল্প তিনি লিখেছেন সেখানেও তার অনায়াস সিদ্ধি। তার রচিত ‘মহেশ’, ‘অগভীর স্বর্গ’, ‘একাদশী বৈরাগী’ বাংলা ছােটগল্পের সম্পদ। তিনি ছিলেন সমাজ-সচেতন শিল্পী। সমাজের ভাঙন, বিকৃতি পচনশীলতাকে তিনি যেমন নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেছেন তেমনি নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের জন্য করেছেন অশ্রু বিসর্জন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন মানবতার বাণী। মহেশ’ সমাজ-নিষ্পেষণের এক নির্মম, বিশ্বস্ত দলিল। গফুর নিপীড়িত দরিদ্র অসহায় কৃষক সমাজের প্রতিনিধি। 

সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এসে এই গল্পে ভিড় করেছে। শেষ পর্যন্ত হৃদয়হীন সমাজ-প্রতিনিধিদের অত্যাচারে রাত্রির অন্ধকারে নিঃসহায় গফুরকে গভীর বেদনা, হাহাকার নিয়ে মেয়ে আমিনার হাত ধরে ফুলবেড়ের চটকলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়। এ তাে শুধু রুধিরাশ্রুসিক্ত গভীর মর্মান্তিক কাহিনীই নয়, এর মধ্য দিয়ে নতুন যুগের পদধ্বনির আভাসও দিয়েছেন মরমী লেখক। দুলে বাগদী, ঘরের, স্বামী পরিত্যক্তা বধূ অভাগী সতীত্বের জোরে মাথায় সিঁদুর, পায়ে আলতা মেখে স্বামী-পুত্র রেখে স্বর্গে যাওয়ার ঐকান্তিক কামনা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল, কিন্তু জন্মদুঃখিনী অভাগীর সৎকারের জন্যে সমাজের নিষ্ঠুর বিধানে সামান্য কাঠও দুর্লভ হয়ে যায়। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতায় অভাগী-পুত্র কাঙালী সমাজের প্রকৃত চেহারাটা প্রত্যক্ষ করে ‘বুড়া হইয়া গিয়াছিল। একাদশী বৈরাগী’ -তে সমাজব্রাত্য কুশীদজীবী একাদশীর মধ্যেও সত্যের মহিমা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। জন্মসূত্রেই মানুষ মহৎ হয় না, কর্মসূত্রে, মনুষ্যত্ববােধের জাগরণেই মানুষ মহ, মানুষ বৃহৎ।

যে দুলভ গুণে মহাকালের দরবারে শরৎ-সাহিত্যের অমরতার প্রাথনা, তা হল তার গভীর মানবতাবােধ। তিনিই প্রথম নিপীড়িত লাঞ্ছিত বঞ্চিত মানুষের ব্যথা, বেদনাকে সাহিত্যের বিষয় করেছেন। সমাজ-অনুশাসন কবলিত ম্লান মূক মুখে ভাষা দিয়েছেন। মানবতার পাদপীঠেই শিল্পীর নত-নম্র শ্রদ্ধার অর্ঘ। তিনি ব্যথাহত কণ্ঠে পাঠকের কাছে কবুল করে গেলেন, ‘সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই-যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত-মানুষ যাদের চোখের জলের কোনাে হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেল সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই-এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠাল আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে। তাই বাস্তবের রুঢ় রুক্ষ অসুন্দরের মধ্যেই তিনি সুন্দরের আরাধনা করেছেন। পঙ্কের মধ্যেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন পঙ্কজের অমলিন সৌন্দর্য। শরৎ-সাহিত্যে নারী-চরিত্র এক বিশেষ মর্যাদায় হয়েছে অনন্যা। নারী এখানে চিরন্তন কল্যাণী সত্তায় মহিমাময়ী। অন্নদাদিদি রাজলক্ষ্মী অভয়া সাবিত্রী কিরণময়ী বিজলী চন্দ্রমুখী সমাজের কলঙ্কতিলক পরেও নারীত্বের মহিমায় আজও ভাস্কর। কিশাের চরিত্র অঙ্কনেও লেখক সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার ইন্দ্ৰনাথ শ্রীকান্ত কেষ্ট রাম অমূল্য নরেন অবিস্মরণীয় চরিত্র।

শুধু বিষয় বা চরিত্র অঙ্কনেই যে শরৎচন্দ্র দক্ষ শিল্পী তা নয়, তিনি দুঃখী মানুষের অন্তহীন দুঃখের কাহিনী রচনা করতে গিয়ে যে অনবদ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন তারও বিকল্প নেই। সেই ভাষাও দরদী মনের স্পর্শে এক অননুকরণীয় সম্পদ হয়ে উঠেছে। তিনি বর্তমানের সার্থক রূপকার, ভবিষ্যৎ কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ। তারই প্রদর্শিত পথে আজ কথাসাহিত্যে সমাজব্রাত্য মানুষের ভিড়, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। শরৎ-সাহিত্যেই গণকণ্ঠ প্রথম ধবনিত হয়েছিল। মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতেই তিনি কলম ধরেছিলেন। যথার্থই ‘দেশের মৃত্তিকা থেকে নিল যারে হরি,/ দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে ধরি। মৃত্যু শাসনেও তিনি মৃত্যুঞ্জয়, প্রেমের আসনেই তাঁর অমর প্রতিষ্ঠা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top