Class 9 Bengali Boichitrapurna Assam | বৈচিত্রপূর্ণ আসাম Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 9 Bengali Boichitrapurna Assam | বৈচিত্রপূর্ণ আসাম and select needs one.
Class 9 Bengali Boichitrapurna Assam | বৈচিত্রপূর্ণ আসাম
Also, you can read SCERT book online in these sections Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 9 Bengali Boichitrapurna Assam | বৈচিত্রপূর্ণ আসাম for All Subject, You can practice these here…
আহােমগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। আহােমেরা আদিতে কোন জাতির লােক ছিলেন ?
উত্তরঃ আহােমেরা আদিতে টাই জাতির মানুষ ছিলেন।
২। আহােমদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল ?
উত্তরঃ আহােমদের আদি বাসস্থান ছিল চীন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বর্তমানে ইউনান প্রদেশের মুংমাও রাজ্যে এই অঞ্চল অবস্থিত।
৩। আহােমগণ কত বছর অসম শাসন করেছিলেন ?
উত্তরঃ প্রায় ৬০০ বছরের অধিক কাল আহােমগণ অসম শাসন করেছিলেন।
৪। আহােমদের আদি ভাষা কী ছিল ?
উত্তরঃ আহােমদের আদি ভাষা টাই বা শ্যান ছিল।
৫। আহােমদের কয়েকটি উৎসবের নাম লেখাে।
উত্তরঃ আহােমদের দ্বারা পালিত উৎসবগুলি হলাে মে-ডাম, মে-ফী, ওমা, চাইফা, রিকখন, জাসিংফা, লাইলুংখাম ইত্যাদি।
৬। সংক্ষেপে টীকা লেখাে।
(ক) লাচিত বরফুকন।
(খ) সতী জয়মতী।
(গ) টেঙাই।
(ঘ) দেওধাই ফুকন।
(ঙ) কৃষ্ণকান্ত সন্দিকৈ।
(চ) পদ্মনাথ গােহাঞি বরুয়া।
উত্তরঃ (ক) লাচিত বরফুকন – অসমের ইতিহাসে দেশপ্রেমিক বীর বলে বিশেষভাবে পরিচিত লাচিত বরফুকনের জন্ম হয়েছিল ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পিতার নাম ছিল মােমাই তামুলি বরবরুয়া। বাল্যকাল থেকেই লাচিত ছিলেন যথেষ্ট সাহসী, সৎ এবং স্পষ্টবাদী। পিতার রাজকার্য নিরীক্ষণ করে তিনি অনেক কথাই শেখার সুযােগ পেয়েছিলেন।
অতি অল্পকালের মধ্যে নিজের দক্ষতায় রাজঘরে লাচিত নিযুক্তি পেয়েছিলেন। প্রথমে তাকে রাজমন্ত্রী মহাশয়ের ‘হঁচতিধরা তামুলি’ হিসাবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। এরপর ‘ঘােড়া বরুয়া’ পদবি লাভ করেন। অতঃপর ‘দোলীয়া বরুয়া এবং ‘শিমুলগুরিয়া ফুকন’-এর পদে নিযুক্তি লাভ করেন। সেই সময় মিরজুমলা অসম আক্রমণ করায় লাচিত দিখৌমুখে শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। লাচিতের পারদর্শিতা ও পরাক্রমের পরিচয় পেয়ে তৎকালীন আহােম রাজা চক্ৰধ্বজ সিংহ লাচিতকে প্রধান সেনাপতি করে বরফুকন পদে নিযুক্ত করেছিলেন।
১৬৬৭ সালের ২০ আগস্ট আহােম ও মােগলদের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই যুদ্ধে আহােম সৈন্য অতি সুকৌশলে মােগলদের আক্রমণ করে এবং যুদ্ধে অগ্রসর হয়। আহােম সৈন্য নিজের দক্ষতায় ও সাহসিকতায় মােগল দুর্গ অধিকার করে এবং মােগল সৈন্যদের বিদ্ধস্ত করে। মােগলদের সঙ্গে হওয়া এই যুদ্ধ জয়ের ফলে অসমীয়া সৈন্যরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। সেনাপতি হিসাবে লাচিত বরফুকনও যথেষ্ট প্রশংসিত হন।
অসমীয়া সেনার হাতে মােগল সেনার পরাজয়ের খবর যখন মােগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব জানতে পারেন তিনি এই লজ্জা ও অপমানের প্রতিশােধ নেওয়ার সংকল্প নেন। তিনি রামসিংহের নেতৃত্বে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী অসম আক্রমণ করবার জন্য পাঠান। লাচিত বরফুকনও প্রবল পরাক্রমে শক্তিশালী মােগলদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য তৈরি ছিলেন। মােগলদের আটকাবার জন্য আমিনগাঁওয়ের কাছে একটি দুর্গ তৈরির দায়িত্ব নিজের মামার উপর দিয়েছিলেন। কিন্তু দায়িত্বে অবহেলা করার জন্য দুর্গের কাজ অসমাপ্ত হওয়ায় লাচিত প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হন এবং তলােয়ারের এক কোপে নিজের মামার শিরচ্ছেদ করেন এবং বলেন, দেশের চেয়ে মামা বড় নয়। লাচিতের এই উগ্রমূর্তি দেখে দুর্গের কাজে নিযুক্ত মজদুরেরা ভীষণ ভয় পেয়েছিল এবং প্রচণ্ড পরিশ্রম করে এক রাতের মধ্যে সেই গড় বা দুর্গ তৈরির কাজ সম্পূর্ণ করেছিল। সেই গড় বা দুর্গকে আজও ‘মােমাই কাটা গড়’ বলে জানা যায়। আজও ‘লাচিতের সেই ‘দেশের চেয়ে মামা বড় নয়’ উক্তিটি দেশপ্রেমমূলক বাক্য বলে গণ্য হয়।
আহােম ও মােগলদের সর্বশেষ যুদ্ধ শরাইঘাটের যুদ্ধ। ১৬৭১ সালে মার্চ মাসে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় লাচিত ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। আহােম সেনাপতি লাচিত অসুস্থ থাকায় অসমিয়া সৈন্যদের মনােবল অনেকটা কমে যায়। এই সুযােগে মােগল সেনারা যুদ্ধে বেশ কিছুটা অগ্রসর হওয়ার সুযােগ পায়। এতে অসুস্থ লাচিত অস্থির হয়ে ওঠেন। যুদ্ধে অসমিয়া সৈন্যদলের পিছু হটতে দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। দুর্বল অসুস্থ শরীরেই প্রচণ্ড প্রতাপের সঙ্গে পরাভূত অসমীয়া সেনাদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। তার প্রচণ্ড বীরত্বের সামনে মােগল সেনারা দাঁড়াতেই পারল না। এভাবে লাচিতের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং প্রবল প্রতাপ প্রদর্শনের জন্যে আহােমরা যুদ্ধে জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল।
কিন্তু শরাইঘাট যুদ্ধের কিছুদিন পরেই গুয়াহাটিতে লাচিত বরফুকনের মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন একজন অতুলনীয় বীর এবং দেশপ্রেমিক। আহােম-মােগল যুদ্ধে প্রদর্শিত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম এবং সফল নেতৃত্বের কাহিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
(খ) সতী জয়মতী – সতী জয়মতী তুং-খঙ্গিয়া গােত্রের লাঙ্গি গদাপাণির স্ত্রী ছিলেন। রাজকুমারী সতী জয়মতী জীবৎকালে আহােম রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর জটিল রূপ নিয়েছিল। মন্ত্রী লালুকসােলা বরফুকন তখন অসমের অশান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। তারই প্রচেষ্টায় অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক রাজকুমার থাকা সত্ত্বেও মাত্র চৌদ্দবছরের ছ্যু-লিক-ফাকে অসমের রাজা হিসাবে অভিষেক করান হয়। ছ্যু-লিক-ফা বা রত্নধ্বজ সিংহ বয়সে বালক বলে প্রজাদের মধ্যে তিনি লরা রাজা নামে পরিচিত হন। লালুকসােলা ছ্যু-লিক-ফাকে রাজা করেই সে সময়ের রাজা ছ্যু-দৈয়-ফা-কে হত্যা করেছিলেন। এছাড়া আতন বুঢ়াগোঁহাই-কেও সবংশে হত্যা করে নিজের পছন্দের জন- দিঘলা আঙ্গিকে বুঢ়াগোঁহাই এবং লাই থেপেনাকে বরগোহাই পদে বসান। এছাড়াও লালুকসােলা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য লরা রাজার সঙ্গে নিজের পাঁচ বছরের মেয়ের বিয়ে দেন। বঙ্গের নবাবের আশ্বাস পেয়ে লালুকসােলার মনে আহােম রাজ্যের রাজা হওয়ার লালসা প্রবল হয়ে উঠেছিল।
রাজপরিবারের কয়েকজন রাজকুমারেরই রাজা হওয়ার যােগ্যতা ছিল। এদের যে কোন কেউ বিদ্রোহ করে সিংহাসনে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে এ আশঙ্কা ছিল লালুকসােলার। কিন্তু আহােম সম্প্রদায়ের নিয়ম মতে কোনাে অঙ্গচ্ছেদ রাজকুমার রাজা হতে পারেন না। সেজন্য লালুকসােলার পরামর্শমতে লরা রাজা আহােম রাজকুমারদের হত্যা কিংবা অঙ্গচ্ছেদ পর্ব শুরু করেন।
তুং-খুঙ্গিয়া গােত্রের লাঙ্গি গদাপাণি ছাড়া বাকি সব গােত্রের রাজকুমারদের লালুক বরফুকনের গুপ্তচরেরা ধরে ধরে অঙ্গচ্ছেদ বা হত্যা করলেন। কিন্তু গদাপাণির কোনাে সন্ধান তারা পেলেন না।
গদাপাণি ও জয়মতী তাদের দুই ছেলে লাই-লেচাই সহ তুংখঙ্গে বসবাস করছিলেন। লালুক-ছালিকফার রাজকুমার নিধনের সংবাদ পেয়ে দুই ছেলেকে নাগা রাজ্যের কোনাে এক নিভৃত স্থানে লুকিয়ে রাখে। নিজের দুই ছেলের সাথে গদাপাণিকেও লুকিয়ে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করেন জয়মতী। প্রথমে সম্মত না হলেও পরে নাগার ছদ্মবেশে নাগা পাহাড়ে আত্মগােপন করেন গদাপাণি। কিন্তু গদাপাণিকে খুঁজে না পেয়ে লরারাজার লােকেরা জয়মতীকেই রাজসভায় নিয়ে এসেছিলেন।
স্বৰ্গদেউ- এর আদেশ ঘােষণা করে লালুকসােলা জয়মতীকে গদাপাণির সংবাদ জানতে চান। কিন্তু রাজকুমারী জয়মতীর কাছ থেকে কোনাে উত্তর না পাওয়ায় লালুকসােলার নির্দেশে চাওদাঙ (প্রহরী) জয়মতীকে জেরেঙার কাছে কোনাে নির্জন স্থানে নিয়ে এসে গদাপাণির সংবাদ বের করবার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। চাওদাঙ জয়মতীকে অনেকভাবে বুঝিয়ে ফুসলিয়ে, ভয় দেখিয়েও গদাপাণির কোনাে সংবাদ বের করতে না পেরে জয়মতীর উপর নির্যাতন শুরু করেন। কিন্তু সমস্ত ধরনের নির্যাতন নীরবে সহ্য করে ১৪ দিন পর ১৬৭৯ সালের ১৩ চৈত্র সতী জয়মতী মৃত্যুবরণ করেন। অসমীয়া নারীর পবিত্রতার উদাহরণ-সতী জয়মতী। তিনি নারীর অসীম মনােবলের মাহাত্ম্য, স্বামীর হিতার্থে স্ত্রীর মহান ত্যাগের আদর্শ জগতে প্রতিষ্ঠা করে যান।
সতী জয়মতীর জ্যেষ্ঠ পুত্র রুদ্ৰসিংহ মায়ের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করার উদ্দেশ্যে জেরেঙ্গা পাথারে ১৬৭৯ সালে সাগর-সদৃশ বৃহৎ পুকুর খনন করে নাম দিয়েছিলেন জয়সাগর। এর পাঁচ বছর পর রুদ্ৰসিংহ মাতৃরক্তে পবিত্র জেরেঙ্গা পাথারে রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং নাম রাখেন রংপুর। এছাড়া তিনি পুরনাে রাস্তা ও বড় রাস্তার মাঝখানে মায়ের নামে ময়দান (ক্ষেত্র) নির্মাণ করেছিলেন। এই পবিত্র ময়দান আজও সতী জয়মতীর স্মৃতি অক্ষুন্ন করে রেখেছে।
(গ) টেঙাই মহন – পণ্ডিত টেঙাই মহনের জন্ম হয়েছিল ১৭১৫ সনের চরাই-দেউয়ের মহুং-মাইচেউ পরিবারের তকরির ঘরে। তিন ভাইবােনের সবচেয়ে ছােটো ছিলেন তিনি।
আহােম রাজত্বের অন্তিম লগ্নে আহােম দরবারে বিভিন্ন কারণবশতঃ আহােম ভাষার পরিবর্তে ধীরে ধীরে অসমীয়া ভাষার প্রসার লাভ করছিল। অন্যদিকে আহােম ভাষা ক্রমাগত অবহেলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন বার্তালাপ থেকেও এই ভাষা নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করে। এতে সচেতন বুদ্ধিজীবী আহােমেরা এই ভেবে চিন্তিত হয়েছিলেন যদি আহােম ভাষাটি একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় তবে অসমের একটা জীবিত সভ্যতা অসমের ইতিহাস থেকে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আহােমেরা অসমে আসার সময় তাদের সাহিত্য, বুরঞ্জি, ধর্ম, নৈতিকতা, জ্যোতিষ, দর্শন ইত্যাদি অনেক বিষয়ের গ্রন্থ-পুথি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। এছাড়া অসমে আহােম রাজত্বকালেও বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করা হয়েছিল। এই বিশাল জ্ঞান-ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ ভাষাটি লুপ্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে এই গ্রন্থ-পুথিগুলাে থেকে জ্ঞান আহরণ করাও দুষ্কর হয়ে পড়বে। এছাড়া আহােম শব্দও অপভ্রংশ হয়ে বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আহােম ভাষা শিখতে পারে সেজন্য ভাষাবিদ টেঙাই মহন একটি অভিধান প্রণয়নের কাজ আরম্ভ করেন। ১৭৯৫ সালে গৌরীনাথ সিংহের রাজত্বের অন্তিমলগ্নে তিনি বরকাকত হুংমুং পুথি’ নামক এক অভিধান রচনা করেছিলেন। সাঁচি পাতায় লেখা এই পুথিতে সর্বমােট ৪২টি পৃষ্ঠা ছিল। এর আয়তন ৪০ x ১০ সে.মি.। প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ৮-৯টা শারি ছিল। এখানে প্রত্যেক আহােম শব্দের বিপরীতে সম্ভাব্য সব অসমীয়া অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯১২ সালে কোচবিহারের কৈলাশচন্দ্র সেন নামক ব্যক্তির কাছ থেকে টেঙাই মহনের রচিত ‘বরকাকত হুংমুং’ গ্রন্থটি হেমচন্দ্র গােস্বামী মহাশয় উদ্ধার করে ‘বুরঞ্জি এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগে জমা করেছিলেন। টেঙাই মহনের রচিত ‘বরকাকত হুং- মুং’গ্রন্থটির সম্পাদিত রূপই হচ্ছে অসম বুরঞ্জি এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগের তরফ থেকে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ‘আহােম লেক্সিকন’-এর বৃহৎ অর্ষ খণ্ড ।
অসমের প্রথম অভিধান প্রণেতা হচ্ছেন টেঙাই মহন। ‘বরকাকত হুংমুং’গ্রন্থটি ছাড়াও তাঁর রচিত আরও কুড়িটির অধিক পুথি পাওয়া গেছে। আহােম ভাষার পুথি অনুবাদের জন্যে ইংরেজ সরকারের তরফ থেকে তাকে বিলেতে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮২৩ সালে ডিব্ৰুগড় জেলার খুয়াঙে তার মৃত্যু হয়।
(ঘ) দেওধাই ফুকন – চরাইদেউ মহকুমার অন্তর্গত আখৈয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে এক শুভ লগ্নে উম্বরুধর দেওধাই ফুকনের জন্ম। পিতার নাম গঙ্গারাম ফুকন ও মাতার নাম ছিল চাদৈ ফুকন। পিতা গঙ্গারাম ফুকন ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। ডম্বরুধর ফুকন এম. ভি. স্কুলে পড়ার পর টাই ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে নিবিড়ভাবে পড়াশুনা শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে টাই ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন। একজন টাই পণ্ডিত হিসাবে তিনি যথেষ্ট্ খ্যাতিলাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে অসম বুরঞ্জি এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. সূর্যকুমার ভূঞা টাই ভাষার বিশেষজ্ঞ রূপে টাই আহােম বুরঞ্জি অনুবাদের জন্য তাকে গুয়াহাটিতে আমন্ত্রণ করেছিলেন। অসম বুরঞ্জি এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগে চার বছর আহােম পণ্ডিতরূপে কাজ করবার পর ১৯৩৫ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালে টাই ভাষা সংস্কৃতির উন্নতির জন্য প্রথমে একটি স্কুল নির্মাণ করেন। এরপর সেখানে পাটসাঁকো কেন্দ্রীয় টাই অকাদেমির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে অখিল অসম বৌদ্ধ ফ্রালুং সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক টাই শিক্ষা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ১৯৮১ সালের ৮ এপ্রিল পূর্বাঞ্চল টাই সভা গঠন করেন এবং প্রতিষ্ঠাপক সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে ব্যাংককে আয়ােজিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক টাই শিক্ষা সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে একমাস থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহরে থেকে টাই ভাষা ও সংস্কৃতির সাধনা করেছিলেন। এসময় থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানী ইত্যাদি বহু দেশ থেকে আসা বহু পণ্ডিত গবেষক তার আতিথ্য গ্রহণ করে টাই আহােম সংস্কৃতি বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছিলেন।
অসমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত টাই ভাষা সংস্কৃতির বিকাশের উদ্দেশ্যে আজীবন সাধনা করে গেছেন দেওধাই ফুকন। ১৯৯৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ডিব্ৰুগড় জেলার লেঙেরিতে আয়ােজিত পূর্বাঞ্চল টাই-সাহিত্য সভার দশম অধিবেশনের পরদিন হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে ডিব্ৰুগড় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে এই কর্মবীর পুরুষের মৃত্যু হয়।
(ঙ) কৃষ্ণকান্ত সন্দিকৈ – ১৮৯৮ সালে যােরহাটে কৃষ্ণকান্ত সন্দিকৈ-এর জন্ম হয়। তার পিতা রাধাকান্ত ও মাতা নারায়ণী সন্দিকৈ। ১৯১৩ সালে যােরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রেন্স পরীক্ষা দিয়ে কটন কলেজে অধ্যয়ন করেন। এখান থেকে আই, এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করে কলকাতায় যান। কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৯১৭ সালে সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণির সম্মান সহ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে বেদগ্রুপ নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম, এ. পাশ করেন। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আধুনিক ইতিহাস বিভাগে সসম্মানে ১৯২৩ সালে এম. এ. উপাধি লাভ করেন। ১৯২৩-২৭ এই সময়ে তিনি প্যারিস এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক, লাতিন, ইতালিয়ান ইত্যাদি ভাষা অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০ সালে যােরহাট জে. বি. কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কৃষ্ণকান্ত তার অবৈতনিক অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কৃষ্ণকান্ত সন্দিকৈ তার প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন। এবং ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
কৃষ্ণকান্ত সন্দিকৈ ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। সংস্কৃত সাহিত্যে তার ছিল অগাধ জ্ঞান। তার দ্বারা প্রকাশিত ইংরাজি গ্রন্থ তিনটি হল শ্রীহর্ষের নৈষধচরিতের ইংরাজি অনুবাদ ও টীকা সম্বলিত গ্রন্থ, ‘নৈষধ চরিত’ (১৯৩৪), সােমদেবের যশস্তিলকের ভিত্তিতে রচিত ‘যশস্তিলক অ্যাণ্ড ইন্ডিয়ান কালচার’ (১৯৪৯) এবং মারাঠি লেখক প্রবর সেনের প্রাকৃত পুথি সেতুবন্ধনের ভাষ্য ‘সেতুবন্ধন’। এছাড়া কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখেছিলেন। ১৯৫১ সালে লক্ষ্ণৌতে ভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫৩ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। অসমীয়া সাহিত্যের প্রতি তার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। বাঁশি, মিলন, আবাহন, চেতনা ইত্যাদি পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছিলেন। কৃষ্ণকান্ত সন্দিকৈ রচনা সম্ভার-এ এই সকল সংগৃহীত হয়েছে। ১৯৩৭ সালে অসম সাহিত্য সভার গুয়াহাটি অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন তিনি। ভারত সরকার ১৯৫৫ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৭ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে অলংকৃত করেন। গুয়াহাটি এবং ডিব্ৰুগড় বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট উপাধি প্রদান করেন। তিনি জে. বি. কলেজকে এগার হাজার এবং চন্দ্রকান্ত অভিধানের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করে ছিলেন। মৃত্যুর আগে নিজের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যান।
(চ) পদ্মনাথ গােহাঞি বরুয়া – ১৮৭১ সালের ২৪ অক্টোবর উত্তর লখিমপুরের নকারি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পদ্মনাথ গােহাঞি বরুয়া। তার পিতা ঘনরাম এবং মায়ের নাম লক্ষ্মীদেবী। উত্তর লখিমপুর থেকে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিবসাগর হাইস্কুলে ভর্তি হন। যদিও পরে কোহিমা হাইস্কুল থেকে ১৮৯০ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি কলকাতায় যান। সেখানে তিনি এফ. এ. ও আইন পড়েন। সেখান থেকে ফিরে এসে কোহিমা মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক রূপে যােগদান করেন এবং পরে যােরহাটে কিছুকাল শিক্ষকতা করে ১৮৯৩ সালে তেজপুর নর্মাল স্কুলে চলে আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
পদ্মনাথ গােহাঞি বরুয়া কবিতা, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি সাহিত্যের সকল ধারায় পূরদর্শী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগুলি হল- জুরনি, লীলা, চানেকি প্রধান। নাটকের মধ্যে রয়েছে ইতিহাস ভিত্তিক নাটক জয়মতী, গদাধর, সাধনা, লাচিত বরফুকন, বাণ-রাজা। প্রহসন নাটকগুলাে হল- গাঁওবুঢ়া, টেটোন তামুলি, ভূত নে ভ্রম ইত্যাদি। উপন্যাস সমূহ, যেমন- ভানুমতী, লাহরি বিখ্যাত। আত্মজীবনী- মাের সোঁঅরনি, সংগ্রহ সংকলনের মধ্যে আছে সাহিত্য, জীবনী সংগ্রহ, ধর্মমূলক গ্রন্থ- শ্রীকৃষ্ণ, গীতাসার। এছাড়াও ভূগােল দর্পণ, নীতিশিক্ষা, শিক্ষাবিধান ইত্যাদি অনেক পাঠ্যপুস্তক তিনি রচনা করেছিলেন, তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে রয়েছে, বিজুলি, আসাম বুন্তি এবং উষা।
তিনি ১৯১৭ সালে শিবসাগরে অনুষ্ঠিত অসম সাহিত্য সভার প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৬ সালের ৭ এপ্রিল এই সাহিত্যিকের পরলােক প্রাপ্তি হয়েছিল।
কাছাড়ের জনগােষ্ঠী
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। নৃতত্ত্ববিদ বরাক উপত্যকাকে কী বলে অভিহিত করেছেন ?
উত্তরঃ বিভিন্ন ভাষা এবং সংস্কৃতির মানুষের সহাবস্থানের জন্য নৃতত্ত্ববিদরা বরাক উপত্যকাকে Anthropological garden অর্থাৎ ‘নৃতত্ত্বের উদ্যান’ নামে অভিহিত করেছেন।
২। বরাক উপত্যকায় বসবাস করা বিভিন্ন জনগােষ্ঠীসমূহ কী কী ?
উত্তরঃ বরাক উপত্যকায় বসবাসকারী জনগােষ্ঠীসমূহের নাম- বঙ্গীয় সমাজ, মণিপুরি, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া, ভােজপুরি, অসমীয়া, রাজবংশী, বর্মন (ডিমাসা), রংমাই নাগা, মার, কাৰ্বি, রিয়াং, খাসয়া, ভেইফেই, মিজো, চাকমা, কুকি, রাংখল, চিরু, চরৈ, সিমতে, গাংতে, রাজস্থানি, নেপালী।
৩। বরাক উপত্যকায় মানুষের প্রধান জীবিকা কী ?
উত্তরঃ ব্রাক উপত্যকায় মানুষের প্রধান জীবিকা হল- কৃষিকাজ, ব্যবসা এবং চাকরি।
৪। ‘The Background of Assamese Culture’ বইটি কার লেখা ?
উত্তরঃ The Background of Assamese Culture’ বইটি রাজমােহন নাথ রচনা করেছিলেন।
৫। হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত সন্তোষ ট্রফি ফুটবল প্রতিযােগিতায় অসম রাজ্য ফুটবল দলের ম্যানেজার কে ছিলেন ?
উত্তরঃ ১৯৫৭ সালে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত সন্তোষ ট্রফি ফুটবল প্রতিযােগিতায় সুনীল মােহন এ অসম রাজ্য ফুটবল দলের ম্যানেজার ছিলেন।
৬। সংক্ষেপে টীকা লেখাে-
(ক) রাজমােহন নাথ।
(খ) কামালুদ্দীন আহমেদ।
(গ) নন্দলাল বর্মণ।
(ঘ) নলিনীন্দ্র কুমার বর্মণ।
(ঙ) ইরুংবম চন্দ্র সিংহ।
(চ) বিপিন সিংহ।
উত্তরঃ (ক) রাজমােহন নাথ – অসমের ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ব গবেষণা ক্ষেত্রে রাজমােহন নাথ অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি আজীবন অসমের ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ব নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। পেশায় একজন বাস্তুকার হলেও তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত ‘The Background of Assamese Culture’ এ বিষয়ে তার একটি প্রামাণিক গ্রন্থ। শ্ৰীমন্ত শংকরদেবের সাহিত্য এবং দর্শন বিষয়ে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে। তিনসুকিয়ায় অনুষ্ঠিত অসম সাহিত্য সভার ত্রয়ােদশ অধিবেশনে তিনি ইতিহাস শাখার সভাপতিত্ব করেছিলেন।
(খ) কামালুদ্দীন আহমেদ – ইতিহাসবিদ কামালুদ্দীন আহমেদ ছিলেন করিমগঞ্জ কলেজের ইতিহাসের প্রধান অধ্যাপক। পরবর্তীকালে তিনি সেই কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তাঁর সম্পাদিত সাহিত্যপত্রটির নাম ‘দিগ্বলয়। অসমের শিল্প এবং স্থাপত্যের বিষয়ে তাঁর লেখা গ্রন্থটির নাম হল “The Art and Architecture of Assam’ (1994)। এছাড়াও শতাধিক গবেষণাধর্মী নিবন্ধ, উপন্যাস লােকসংস্কৃতি বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
(গ) নন্দলাল বর্মণ – নন্দলাল বর্মণ রাজমন্ত্রী বংশের লােক ছিলেন। তিনি একজন সমাজসেবক ছিলেন। একজন প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী হিসাবেও তিনি সমাজে মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তার জনহিতকর কাজের জন্য বর্মণ সমাজের লােকেরা তাকে মিলাউ’ এবং অন্য সমাজের লােকেরা তাকে মহাজন’বলে সম্বােধন করত। শিক্ষানুরাগী নন্দলাল বর্মণ গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য কাছাড় জেলায় ১৯০১ সালে একটি স্কুল স্থাপন করেছিলেন। স্কুলটির বর্তমান নাম ‘গােবিন্দচন্দ্র মেমােরিয়াল স্কুল।
(ঘ) নলিনীন্দ্র কুমার বর্মণ – নলিনীন্দ্র কুমার বর্মণ পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩০ সালে ডিমা হাসাও জেলার হাফঙের মিশন স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যােগ দিয়েছিলেন। ডিমাহা জাতির ঐতিহ্য এবং পরম্পরা বিষয়ে তিনি বিস্তৃত অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থটির নাম হল The Queen of Cachar or Herombo and the History of Cacharies’। বর্মণ সমাজে প্রচলিত কীর্তন গানের একটি সংকলনও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থটির নাম হল হৈড়িম্বরাজ গােবিন্দাচদ্ৰকৃত হিন্দুশাস্ত্রীয় শ্রদ্ধাদির কীর্তন গীতিকা।
(ঙ) ইরুংবম চন্দ্র সিংহ – ইরুংকম চন্দ্র সিংহ মণিপুরি সমাজে প্রথম অর্থনীতি বিজ্ঞানের সাম্মানিক স্নাতক ছিলেন। গ্রামীণ ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য তিনি নানারকম সদর্থক প্রয়াস চালিয়েছিলেন। দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীকে সাহায্যের জন্য একটি তহবিল গঠন করেছিলেন। এছাড়া তিনি একটি স্কুলও স্থাপন করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির নাম ‘খেলমা হাইস্কুল।
(চ) বিপিন সিংহ – বরাক উপত্যকায় মণিপুরী নৃত্যকলা জগতে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ। নৃত্যকলা চর্চার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য গুরু বিপিন সিংহকে ১৯৬৬ সালে ‘সঙ্গীত নাটক অকাদেমি’ সম্মান অর্পণ করা হয়। মধ্যপ্রদেশ সরকার তাঁকে ‘কালিদাস সম্মান প্রদান করে। কলকাতায় ‘মণিপুরি নর্তনালয়’ নামে নৃত্যকলা শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান তিনি স্থাপন করেন।
কারবিগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। কারবিদের অসমের কলম্বাস বলে কে উল্লেখ করেছিলেন ?
উত্তরঃ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা আমেরিকার আবিষ্কারক কলম্বাসের সঙ্গে তুলনা করে কারবিদের অসমের কলম্বাস বলে উল্লেখ করেছিলেন।
২। কারবিদের পরম্পরাগত সাজ-পােশাক সম্পর্কে কী জান লেখাে।
উত্তরঃ কারবি পুরুষ ও নারীর পােশাক পৃথক। পুরুষেরা হাঁটু পর্যন্ত পে সেলেং, চই হাংথর, চই ইক, চই লক (কারবি জ্যাকেট) পহ’ ইত্যাদি পােশাক পরিধান করে। পহ’ হল কার্বি মাফলার। এটি ৩-৪ ইঞ্চি চওড়া ও প্রায় ৫-৬ ফুট লম্বা। এর দুই মাথায় বিভিন্ন রঙের ফুলের কারুকার্য করা থাকে। সেপান আবু যেটি ৩ ইঞ্চি চওড়া ও ৬ ফুট লম্বা পােশাক। দুই মাথা কড়ি সম্বলিত এক বিশেষ মসৃণ কালাে কাপড় যা কারবি কিশাের-যুবকেরা ব্যবহার করে। মহিলাদের সাজপােশাক হল পিনি, পেকক ও বানকক। এছাড়াও পে সেলেং, পে খনজারি, পে সারপি ইত্যাদি পােশাক মহিলারা পরিধান করে।
৩। কারবিদের উৎসব পার্বণ সম্পর্কে যা জান লেখাে।
উত্তরঃ কারবিদের প্রধান উৎসব-পার্বণগুলি হল পেং, হেমফু, রংকের, জুন ইত্যাদি। পেং হেমফু হল ঘরােয়া উৎসব। এই উৎসবে সাধারণত তিনটি পূজা হয়। রিৎ আংলং, বুইচম ও পেং। এই তিনটি পূজা বছরের শুরুতে করা হয় যাতে পুরাে বছর কোনাে অমঙ্গল না হয়।
সজুনে উৎসব – এই উৎসব হল পারিবারিক উৎসব। প্রতি বছর এটি পালন করা হয় না। ৪, ৫ বা ৯ বছরের মাথায় এই উৎসব পালন করা হয়।
রংকের উৎসব – একে গ্রাম্য উৎসব বলা হয়। বছরের শুরুতে এই উৎসব উদ্যাপন করা হয়। পূজার মূল বেদীতে পাখি, ছাগল, ডিম ইত্যাদি উৎসর্গ করে আরাধ্য দেবতার সন্তুষ্টির জন্য পূজা করা হয়।
৪। কারবিদের মূল গােত্র বা সম্প্রদায় কয়টা ও কী কী ?
উত্তরঃ কারবি জনজাতির পাঁচটি গােত্র (ফৈদ) রয়েছে। এগুলাে হল- টিমুং, টেরন, তেরাং, ইংহি, ইংতি। এছাড়াও প্রতি গােত্রের একাধিক উপগােত্র রয়েছে।
৫। কারবি সমাজে নারীরা পরিধান করেন এমন সাজ-পােশাক এবং অলংকারের নাম লেখাে।
উত্তরঃ কারবি সমাজে নারীরা পরিধান করেন এমন সাজ-পােশাক হল- পিনি, পেকক, ও বানকক, সঙ্গে পে সেলেং, পে খনজারি, পেসারপি ইত্যাদি। নারীরা পরিধান করেন এমন অলংকারগুলি হল- লেকহিকি, নথেংপি, নােলাপ, নােজাংসাই লেক রূয়ে, লেক পাংখারা, লং অয়াে, রই পাংখারা, রই পা ইত্যাদি।
৬। সংক্ষেপে টীকা লেখাে-
(ক) সেমসনসিং ইংতি।
(খ) লংকাম তেরন।
(গ) সামসিং হাঞ্চে।
(ঘ) বংলং তেরাং।
উত্তরঃ (ক) সেমসন সিংইংতি – সেমসন সিং ইংতি হচ্ছেন কারবি আংলঙের স্বপ্নস্রষ্টা ও রূপকার। ১৯১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম কারবি আংলঙের টিকা পাহাড়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম থেংকুরসিং ইংতি ও মাতার নাম রুথ মাধবী। ১৯১৬ সালে গােলাঘাট মিশন স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯২৮ সালে গােলাঘাট বেজবরুয়া হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেছিলেন। এরপর গুয়াহাটি কটন কলেজে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু সেসময় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে তার অধ্যয়ন অসমাপ্ত থেকে যায়। পরে ১৯৩৩ সালে সিলেটের মুরারি চান্দ কলেজ থেকে খ্যাতির সঙ্গে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কার্বি জাতির প্রথম স্নাতক রূপে যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। এরপর গােলাঘাট বেজবরুয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৩ সালে মিকির হিল্স ট্রেক গঠন হওয়ার পর ইংরাজ সরকার তাকে ডেকে নিয়ে ১৯৩৪ সালে নগাঁও জেলার শিক্ষা বিভাগের উচ্চ-পরিদর্শক রূপে নিযুক্ত করেন। তিনি নিজে কয়েকটি কাবি ভাষার পাঠ্যপুস্তক রচনা করে অসমিয়া মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলােতে অতিরিক্ত পাঠ্যপুস্তকরূপে অধ্যয়ন করিয়েছিলেন। তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তকগুলাে হল- বিতুস আকিতাপ, কালাখা আকিতাপ, তেমপুরু ও মপি ইত্যাদি।
(খ) লংকাম তেরন – লংকাম তেরনের জন্ম ১৯৩২ সালে। তিনি একজন সুসাহিত্যিক ছিলেন। তার পিতার নাম দিপ্প তেরন ও মাতার নাম কাচাই হাঞ্চেপি। ১৯৫৭ সালে কাচে রংহাংপির সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ১৯৬৪ সালে মিকির পাহাড় জিলা পরিষদের Public Relation Officer পদে তাকে নিযুক্ত করা হয়। তিনি কাৰ্বি আদরবার-এর সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি পদও অলংকৃত করেছিলেন। তিনি কার্বি সাহিত্যসভায় প্রতিষ্ঠাপক সভাপতি ছিলেন এবং ১৯৮৬ সালে কামপুর অধিবেশনে অসম সাহিত্যসভার উপ-সভাপতি পদেও কার্য সম্পাদন করেছিলেন। তিনি সর্বমােট ৪১টি গ্রন্থ রচনা, সংকলন ও অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলাে হল- রংকেসেং, টামাহিদি, কিতাপকিমি, কারবি লামকুরু, কারবি জনগােষ্ঠী, কাৰ্বি লামকুরু- লামসেং, কারবি ভাষা পরিচয়, কারবি লামতাসাম ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
(গ) সামসিং হাঞ্চে – সামসিং হাঞ্চে একজন কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক, সিনেমা প্রযােজক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যপ্রেমী ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ নগাঁও জেলার সরুবাট মৌজার অন্তর্গত পণ্ডিতঘাট বা আহিকেলক গ্রামে তার জন্ম হয়। তার পিতার নাম জয়সিংহ হাঞ্চে ও মাতার নাম কাএৎ টেরনপি। বাল্যকালে পুরানাে স্থান ত্যাগ করে সপরিবারে হংক্রাম নামক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। হংক্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন আরম্ভ হয়। পরে টিকা মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয় এবং কামপুর মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। আরও পরে ডিফু সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরে সেনাবাহিনীর চাকরিতে যােগদান করেন। এর তিনবছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বৈঠালাংস উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় থেকে হাইস্কুল শিক্ষান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৩ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।
ভাষা সাহিত্যের বিকাশ এবং উন্নতির জন্য তিনি কারবি এবং অসমীয়া ভাষায় কয়েকটি পুস্তক লিখেছিলেন। সেগুলাের নাম হল- তাই হাইমু, কারবি প্রণয়গীত, ছাবিম- আলুন (কারবি রামায়ণ), কুমলিন, রােমির এমুঠি কারবি কবিতা (অনুবাদ) ও সের হজেং নামক কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযােগ্য। ১৯৮৩-৮৪ কারবি সাহিত্যসভার সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৪-৮৫ সালে সভাপতি হয়েছিলেন।
১৯৮৫ সালে বিধানসভার নির্বাচনে তিনি ডিফু সমষ্টি থেকে নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রীসভায় মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। ১৯৯৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়। কারবি ভাষা-সাহিত্যের সাধক এবং পথপ্রদর্শক রূপে তার নাম অসমবাসীর কাছে অমর হয়ে থাকবে।
(ঘ) বংলং তেরাং – ১৯০৯ সালের ১০ অক্টোবর কবি সাহিত্যের পুরােধা বংলং তেরাং-এর জন্ম হয়। তিনি কাৰ্বি সাহিত্যের এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনিই কাৰ্বিসাহিত্যের প্রথম লিখিত রূপ প্রদান করেছিলেন। তার পিতার নাম সার তেরাং এবং মাতার নাম কারেং তিছােপি। তিনি ১৩ বছর বয়স থেকে সাহিত্য রচনা করেন। তার লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ হল- Word Book আসাম আছার (বিবাহের নিয়ম), রূকাসেন, হাইমু, সের হংথম, কারবিকপুসন, কাবি চ রংজে,আরণ আতেং, রংলিন, সার আলুন, সার-লামছাম ইত্যাদি।
১৯৭৩ সালে কারবি সাহিত্যসভার তরফ থেকে তাকে কাবি সাহিত্যের পুরােধা ব্যক্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়। অসম সরকারও তাকে সাহিত্যিক পেনশন প্রদান করে। ২০০১ সালের ১৭ জুলাই তিনি পরলােক গমন করেন।
কোচ রাজবংশীগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। কোচ-রাজবংশীগণ কোন ধর্মের মানুষ ?
উত্তরঃ কোচ রাজবংশীগণ হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ।
২। কোচ-রাজবংশীদের ভাষা এবং সংস্কৃতির সম্পর্কে কী জান লেখাে।
উত্তরঃ কোচ-রাজবংশীগণের ভাষা এবং সংস্কৃতির বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতজন বিভিন্ন আলােচনা করেছেন। জর্জ এব্রাহাম গ্রিয়ারসন যাঁকে ভারতীয় ভাষার জনক বলা হয় তিনি কোচ রাজবংশী সকলের মাতৃভাষা বলেছেন। কোচ-রাজবংশীদের মাতৃভাষা রাজবংশী ভাষার নিজস্ব শব্দসম্ভার, সর্বনাম, নিজস্ব ক্রিয়ারূপ, শব্দরূপ, মৌখিক এবং লিখিত সাহিত্য, উচ্চারণভঙ্গি, নিজস্ব বাক্যগঠন পদ্ধতি ইত্যাদি আছে। যা গ্রিয়ারসন সাহেব “ভারতীয় জরিপ গ্রন্থে”,(Linguistic Survey of India) তে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এই ভাষা আধুনিক অন্যান্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলি থেকে পৃথক এবং স্বতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাষা।
কোচ-রাজবংশীদের মূলত দুটি ধারা রয়েছে। মেঘালয় ও মেঘালয়ের অসম সীমান্ত অঞ্চলের কিছু সংখ্যক কোচ মানুষ সুপ্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতির আজও লালন করে চলেছেন। তাদের ধারাটি আর্যেতর। অন্যদিকে পশ্চিম অসম, উত্তরবঙ্গ, নেপাল, বিহার ইত্যাদি অঞ্চলের রাজবংশী মানুষদের ভাষা-সংস্কৃতি হল আর্য-ভাষা সংস্কৃতি। এরা শুধু রাজবংশী হিসাবে আর্য ভাষা-সংস্কৃতি লালন করে। দুটি পৃথক রকমের ভাষা-সংস্কৃতি লালন করলেও নৃতাত্ত্বিক ভাবে সকল কোচ-রাজবংশী মানুষদের শিকড় একটাই, আর তা হল কোচ। কোচ-রাজবংশীরা মূলত মঙ্গলীয় গােষ্ঠীর মানুষ। পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করলেও কোচ রাজবংশীদের সুপ্রাচীন একটি ভিন্নধর্মী উজ্জ্বল ও চমকপ্রদ সংস্কৃতি আছে। হিন্দু আচার নীতি গ্রহণ করলেও কোচ রাজবংশীদের নিজস্ব আচার সংস্কার, পূজা-পার্বণ, ধর্মীয় বিশ্বাস, খাদ্যসম্ভার, পােশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, গীতবাদ্য ইত্যাদি আছে।
কোচ-রাজবংশীদের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহের নিজস্ব আচার, মৃতের আত্মার অস্তিত্বের বিশ্বাস, নানা ইন্দ্রজাল- ক্রিয়া, তন্ত্র- মন্ত্রাদিতে বিশ্বাস, প্রকৃতির সৃষ্টিশক্তিকে মাতৃরূপে পূজা করা, বটগাছকে পূজা করা, জীব-জন্তুকে পূজা, ভূত-প্রেত অপদেবতাদের উপর বিশ্বাস, নানাধরনের বাধা নিষেধ বা অনুশাসন, খােয়া, বেশমা বা বিযুয়া, পুষুনা, কাতিগজা, চড়ক পূজা, গাজন, মনসা, শীতলা, মাসান, কালী ইত্যাদি পূজাগুলােতে অর্ধহিন্দু বা জনজাতিয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সামাজিক কাজে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, পান-সুপারি, চাউলের গুঁড়া ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়। হিন্দু দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা নিজস্ব বিধি অনুসারে করে থাকে। অন্যান্য কিছু পূজা যেমন তারা করে থাকে সেগুলাে হল বুড়ােবুড়ি, তিস্তাবুড়ি, হুদুম পূজা, গ্রাম পূজা, ধাম পূজা, মাশান, যখা, সােনারায়, কাতি, ষাইটল ইত্যাদি। ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যে আমাতি, যাত্রাপূজা, চড়ক পূজা, সত্যনারায়ণ, ত্রিনাথ পূজা ইত্যাদি রয়েছে।
৩। কোচ-রাজবংশীদের খাদ্য ও সাজপােশাক সম্পর্কে টীকা লেখাে।
উত্তরঃ কোচ-রাজবংশীদের নিজস্ব খাদ্যসম্ভার এবং পােশাক পরিচ্ছদ রয়েছে। খাদ্য তালিকায় আছে- ছেকা, পেক্কা, ভেল্কা, সিদল, সুটকা, টোপলাভাত, যা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। পােশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে- মহিলাদের পাটানি, বুকুনি, ফোতা, ছেউটা, অলংকারের মধ্যে রয়েছে হাতের মুঠাখারু, চূড়, শাখা, বাজু, গলার সূর্যহার, চন্দ্রহার, সিক্কাহার, কানে মাকিরি, অন্তি, নাকে নােলক, ফুল পায়ে তােলা খারু, ফেলা খারু ইত্যাদি।
৪। কোচ-রাজবংশীদের গীত বা গীতিকথা সমূহ কী কী ?
উত্তরঃ গান-গীতিকথার মধ্যে কোচ- রাজবংশীদের ভাওয়াইয়া গান, বিভিন্ন পূজার গান, রাবণ গান, কুশান গান, দোবােরা গান, বিষহরি গান, মারৈ পূজার গান, তুকখা গান, লাহাংকারী গান, নটুয়া, শাঙি চকীর গান, ডাক নাম, জাগ গান ইত্যাদি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।
৫। সংক্ষেপে টীকা লেখাে –
(ক) জননেতা শরৎচন্দ্র সিংহ।
(খ) অম্বিকাচরণ চৌধুরী।
(গ) অরুণকুমার রায়।
(ঘ) রুক্মিণীকান্ত রায়।
(ঙ) তরুণ পানিরাম দাস।
উত্তরঃ (ক) জননেতা শরৎচন্দ্র সিংহ – শরৎচন্দ্র সিংহের জন্ম হয়েছিল ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি। পিতার নাম লালসিং সিংহ এবং মাতা আয়াচিনি সিংহ। অসমের রাজনীতিতে ছিলেন একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। প্রকৃতার্থে তিনি ছিলেন জনতার নেতা। গান্ধীবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত বহুমুখী প্রতিভাধারী ছিলেন। জনসেবা করাই ছিল তার জীবনের ব্রত। অসমকে এক দুর্নীতিমুক্ত রাজ্য হিসাবে গড়া ছিল তার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার জন্য জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি চারবার অসম বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৭২-৭৮ সাল পর্যন্ত অসমের মুখ্যমন্ত্রী রূপে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। কিছু উল্লেখযােগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
এই পরিকল্পনাগুলি হল-
১। জরুরিকালীন রবিশস্য।
২। কৃষিনিগম।
৩। পঞ্চায়েতরাজ।
৪। তদারক কোষ প্রকল্প।
৫। আকলন পত্র।
৬। খাদ্যশস্যের সরকারি ব্যবসায়।
৭। শিক্ষানুষ্ঠান সংস্কার প্রকল্প।
৮। শিলং থেকে দিশপুরে অস্থায়ী রাজধানী স্থানান্তকরণ।
৯। গ্রাম পঞ্চায়েত সমবায় সমিতি।
এই জননেতা ২০০৫ সালে ৯৩ বছর বয়সে স্বর্গলােক প্রাপ্ত হন।
(খ) অম্বিকাচরণ চৌধুরি – ১৯৩০ সালে ১৬ আগস্ট বঙ্গাইগাঁও জেলার অন্তর্গত বরপারা গ্রামে অম্বিকাচরণ চৌধুরীর জন্ম হয়েছিল। পিতা নরেশ্বর চৌধুরি এবং মাতা ছিলেন কাশীশ্বরী চৌধুরি। মেধাবী অম্বিকাচরণ চৌধুরি বঙ্গাইগাঁও থেকে স্কুলশিক্ষা লাভ করে ১৯৫৫ সালে কটন মহাবিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে শিলং-এ সরকারি চাকরি করা কালীন বি.টি. পাশ করেন। ছাত্রাবস্থা থেকে অম্বিকাচরণ বিভিন্ন সামাজিক কাজে জড়িয়ে ছিলেন।
অম্বিকাচরণ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছােট বড় ৩২ খানা ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমালােচনা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। ইংরাজি, অসমিয়া, রাজবংশী তিনটি ভাষাতেই সমান দক্ষ ছিলেন। ইংরাজি ও অসমীয়াতে শতাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অসম সাহিত্য সভা তাঁকে ‘রত্নপীঠের রত্ন’ উপাধি প্রদান করে। উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক সংস্থা তাকে ‘কামতারত্ন’ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি সাহিত্যিক পেনশন লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষক সংস্থা তাকে ‘শিক্ষাবান্ধব’ উপাধি দেয়।
(গ) অরুণকুমার রায় – ১৯২৫ সালের ৮ অক্টোবর অরুণকুমার রায়ের জন্ম হয়েছিল। তিনি বঙ্গাইগাঁও-এর ছিপন ছিলা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার পিতার নাম ছিল প্রকাশচন্দ্র রায় এবং মা ছিলেন অভয়েশ্বরী রায়। তিনি এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়াশুনা করেন তারপর বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার সান্নিধ্য গ্রহণ করে আর. সি. পি. আইতে যােগদান করেছিলেন। তিনি বামপন্থী মতাদর্শ প্রচারের জন্য কারাবাস করেছিলেন। গৃহরক্ষীবিভাগে কিছুদিন কাজ করার পর কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। কোকরাবার মহকুমা পরিষদ এবং শালমারা পরিষদের সভাপতিও ছিলেন তিনি। এরপর প্রতিরক্ষা সংস্থার নিম্ন অসমের সমন্বয়কের দায়িত্ব বহন করে ১৯৯৩ সালে কোচ-রাজবংশী সাহিত্যসভা গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কোচ-রাজবংশী জনজাতি ভাষা-সংস্কৃতির উন্নতি সাধনে প্রাণপাত করেছিলেন। রাজবংশী ভাষায় কোচ-রাজবংশীদের সংস্কৃতিমূলক বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়াও নাটক, কবিতা, শব্দকোষ প্রণয়ন করেন। ২০০৪ সালে তিনি অসম সরকারের থেকে এককালীন সাহিত্যিক অনুদান লাভ করেন। ২০১৩ সালে অসম সরকারের সঞ্চালকালয় দ্বারা পরিচালিত গুরুশিষ্য পরম্পরা প্রকল্পের অধীনে ‘লােকসংস্কৃতির গুরু’ হিসাবে স্বীকৃতি ও সম্মান লাভ করেন। কোচ-রাজবংশী জনগােষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতির জন্য যে অবদান তিনি রেখে গিয়েছেন তার স্বীকৃতি স্বরূপ কোচ-রাজবংশী সাহিত্যসভা অরুণকুমার রায়কে ২০১৬ সালে সাহিত্য রত্ন’ সম্মান প্রদান করে।
(ঘ) রুক্মিণীকান্ত রায় – রুক্মিণীকান্ত রায় হলেন পশ্চিম অসমের কোচ-রাজবংশী সম্প্রদায়ের একজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী এবং হাস্যরসিক ব্যক্তি। তিনি সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও উচ্চশিক্ষা লাভ করে জীবনে সফলতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শৈক্ষিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধার্মিক প্রভৃতি সকল পর্যায়ই সমাজের পক্ষে আদর্শ স্বরূপ। তিনি একজন মেধাবী ছাত্র এবং রাজবংশী ভাষায় সুদক্ষ বক্তা ছিলেন।
সমাজের উন্নতির জন্য অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মঠ-মন্দির ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনেও জিলা পর্যায় থেকে রাজ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন সাধারণ কেরানি থেকে কলেজের অধ্যাপক, অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভাল ফুটবল খেলােয়াড় হিসাবেও তার পরিচিতি ছিল। জীবনের শেষ বয়সে একজন সুদক্ষ বক্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। কৃষ্ণানন্দ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে এসে তিনি কিছু ধূর্ম বিষয়ক তত্ত্বগভীর প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
(ঙ) দুরন্ত তরুণ পানিরাম দাস – সমাজকর্মীতথা মুক্তিযােদ্ধা–তরুণ পানিরাম দাসের জন্ম হয় ১৯১৭ সালের ৭ এপ্রিল। এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এবং আজীবন শুধু খদ্দর ধুতি পরিধান করা এই পানিরাম ছিলেন ত্যাগী, দেশপ্রেমের আদর্শে অবিচল সংগ্রামী, সমাজকর্মী। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসে যােগদান করে ১৯৪১ সালে মহাত্মা গান্ধির সত্যাগ্রহে যােগদান করে কারাবরণ করেন। তিনি নিজ দেশের উন্নতির জন্যে প্রাণপাত করেছিলেন। ২০০৫ সালে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি- ড. এ.পি.জে. আব্দুল কালাম এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। এই বছরই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক পথরুঘাটে আয়ােজিত কৃষক শহিদ দিবস’-এ তাকে ‘খাদি পরিহিত সেনাধ্যক্ষ’ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল।
২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর এই স্পষ্টবাদী দুরন্ত তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীর মৃত্যু হয়। দেশের উন্নতির অবদানে স্বীকৃতি স্বরূপ সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জ্ঞাপন করা হয়েছিল।
গড়িয়া, মরিয়া ও দেশীগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। বক্তিয়ার খিলজি কখন অসমে প্রবেশ করেছিল।
উত্তরঃ ১২০৫-০৬ খ্রিস্টাব্দে তিব্বত-চীন জয় করার মানসে বঙ্গের তুর্কি সেনাপতি বক্তিয়ার খিলজির কামরূপে প্রবেশ ঘটেছিল।
২। বক্তিয়ার খিলজি কেন অসমে প্রবেশ করেছিল ?
উত্তরঃ তিব্বত-চীন জয় করবার মানসে বঙ্গের তুর্কী সেনাপতি বক্তিয়ার খিলজি অসমে প্রবেশ করেছিল।
৩। বক্তিয়ার খিলজি কার হাতে পরাস্ত হয়েছিল ?
উত্তরঃ কামরূপের রাজা পৃথুর কাছে বক্তিয়ার খিলজির শােচনীয় পরাজয় হয়েছিল।
৪। ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া প্রথম জনজাতীয় রাজার নাম কী ?
উত্তরঃ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া প্রথম জনজাতীয় রাজা হলেন ‘আলী মেচ’।
৫। অসমে কাকে গড়িয়া বলা হয় ?
উত্তরঃ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত স্থানীয় লােকেরা গড়িয়া বলে পরিচিত হয়।
৬। অহােম রাজত্বকাল পর্যন্ত অসমে একাংশ খিলঞ্জিয়া লােকের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার দুটি কারণ বর্ণনা করাে।
উত্তরঃ অহােম রাজত্বকাল পর্যন্ত অসমে একাংশ খিলঞ্জিয়া লােকেদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার দুটি কারণ হল-
(ক) বিভিন্ন সময়ে অসমে এসে থেকে যাওয়া যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হওয়ার ফল স্বরূপ একাংশ স্থানীয় লােক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
(খ) বিভিন্ন সময় ধর্মপ্রচারক পীর-সাধকদের বাণীর প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একাংশ স্থানীয় লােক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
৭। মরিয়া ও দেশী জনগােষ্ঠীর বিষয়ে বর্ণনা করাে।
উত্তরঃ আহােম রাজত্বকালে কাসা-পিতলের সঙ্গে জড়িত ইসলাম ধর্মাবলম্বী লােকেদের মরিয়া বলে জানা যায়। মরিয়া লােকেদের উজান জার ও হাজোতে দেখা যায়।
দেশীয় জনগােষ্ঠীর লােকেরা মূলত অবিভক্ত গােয়ালপাড়া জিলার বাসিন্দা। অবিভক্ত গােয়ালপাড়া কোচ-রাজবংশী ভাষা সংস্কৃতিসম্পন্ন ইসলামধর্মীয় স্থানীয় লােকেরা দেশী মুসলমান বলে পরিচিত। এরা মূলত কোচ-রাজবংশী, মেচ কছারি ইত্যাদি স্থানীয় জনগােষ্ঠী থেকে ধর্মান্তরিত লােক।
৮। সংক্ষেপে টীকা লেখাে-
(ক) বাঘ হাজারিকা।
(খ) আজান ফকির সাহাব।
(গ) সৈয়দ আব্দুল মালিক।
(ঘ) নবাব সাইদুর রহমান।
উত্তরঃ (ক) বাঘ হাজারিকা – বাঘ হাজারিকার প্রকৃত ইসমাইল সিদ্দিকী। তিনি অতি সাহসী এবং পরাক্রমী ছিলেন। বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঘকে পরাজিত করে অবিশ্বাস্য শক্তির পরিচয় দিয়ে বাঘ নাম অর্জন করেছিলেন। অদম্য সাহস এবং কর্মদক্ষতার জন্য আহােম রাজত্বকালে হাজারিকা পদবি লাভ করেছিলেন তিনি। শরাইঘাটের যুদ্ধে লাচিত বরফুকনের সহযােগী সহসেনাপতিরূপে প্রবল পরাক্রমে মােঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
(খ) আজান ফকির সাহাব – ইসলাম ধর্মের পবিত্র বাণীসমূহ সহজ সরল ভাষায় জনগণের মধ্যে প্রচার করেছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে আজান ফকির ছিলেন অন্যতম। তার প্রকৃত নাম শাহ মিলন। তিনি সুদূর বাগদাদ থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য অসমে এসেছিলেন। আজান পীর বা শাহ মিলানের নামে প্রচলিত আঠকুরি জিকির অসমিয়া ভাষার অমূল্য সম্পদ। রাজা গদাধর সিংহের সময়ে রুপাই গরিয়া দা ধরা নামের একজন ইসলাম ধর্মীয় অধিকারীর চক্রান্তে পড়ে রাজা ফকিরের চোখ উপড়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু রাজা পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরাগুড়ি চরে মাটি বৃত্তি দিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে দিয়েছিলেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তিনি প্রত্যেকদিন সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে আজান দিতেন বলে লােকে তাকে আজান ফকির নাম দিয়েছিল।
(গ) সৈয়দ আব্দুল মালিক – ১৯১৯ সালে গােলাঘাট জেলার নাহরনি গ্রামে সৈয়দ পরিবারে আব্দুল মালিকের জন্ম হয়। পিতা ছিলেন সৈয়দ রহমত আলী। সৈয়দ আব্দুল মালিক একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক ছিলেন। তার প্রথম রচিত গল্প ‘বন্ধ কোঠা’ ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। তার রচিত অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ইত্যাদি অসমিয়া সাহিত্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে।
১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত গুয়াহাটী বিশ্ববিদ্যালয়ের লােক-সংস্কৃতি বিভাগের গবেষণা প্রকল্পের অধীনে অসমীয়া জিকির ও জারি বিষয়ক গবেষণা করেছেন। ১৯৭৭ সালে অসম সাহিত্যসভার সভাপতি ছিলেন। ১৯৫২-৫৫ সাল পর্যন্ত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের উপ-সভাপতি ছিলেন। অঘরি আত্মার কাহিনি’ নামে উপন্যাসটির জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়া সাহিত্যাচার্য উপাধি, আজান ফকির পুরস্কার, হারমনি পুরস্কার, এবং শংকরদেব পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি ফেলােশিপ পান। ভারত সরকার তাকে ১৯৮৪ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৯২ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে। বহু প্রতিভার অধিকারী এই সাহিত্যিক ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর ইহলীলা সম্বরণ করেন।
(ঘ) নবাব শহিদুর রহমান – নবাব শহিদুর রহমান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন অন্যতম নেতা ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে নবাবশহিদুর রহমান আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম অসমীয়া শহিদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর বােমাবর্ষণে ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
গারােগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। গারােদের উপ-জনগােষ্ঠীগুলি কী কী ?
উত্তরঃ বাসস্থান এবং ভাষার দিক থেকে গারােদের আমবেং, মাতসি, মাতাবেং, গারগানসি, দুয়াল, রুগা এবং মেগাম উপজনগােষ্ঠীতে ভাগ করা হয়।
২। গারাে বসতি প্রধান অঞ্চলগুলির নাম লেখাে।
উত্তরঃ বর্তমান সময়ে গারাে জনগােষ্ঠীগুলির লােকেরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যে ছড়িয়ে আছে। এছাড়া বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জায়গায়ও এরা বসবাস করছে।
৩। গারােদের মধ্যে যারা পুজো করে তাদের কী বলে অভিহিত করা হয় ?
উত্তরঃ ধার্মিক দিক থেকে গারােগণ পূর্বপুরুষ পূজা-অর্চনায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই সকল পূজা করা লােকদের গারােরা সাংসারেক বলতাে।
৪। গারােরা মূলত কোন ধর্মাবলম্বী ছিলেন? পরে কোন ধর্ম গ্রহণ করেন ?
উত্তরঃ গারােরা মূলত হিন্দুধর্মের অনুসরণে দেব-দেবীর উপাসক ছিলেন। তাদের দেব-দেবী ছিলেন-সালজং, গরেরা, খালখামে, আসিমা, তিংসিমা সুসিমে ইত্যাদি। কিন্তু উনিশ শতকের প্রথম থেকেই খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত হতে শুরু করায় পূজা অর্চনাও ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়।
৫। গারােদের প্রধান বাদ্যযন্ত্রগুলি কী কী ?
উত্তরঃ গারােদেরপ্রধান বাদ্যযন্ত্রগুলাে হল-ঢামা খ্রাম (ঢােলক), গগনা, মহিষের শিঙ নির্মিত বাঁশের পাইপ লাগানাে বাংসী-বাঁশি ইত্যাদি।
৬। সংক্ষেপে টীকা লেখাে –
(ক) রামথে ওয়ার্থে মােমিন।
(খ) রেভারেন্ড গিলবার্থ কেমারাক।
(গ) সােনারাম রংরকগ্রে সাংমা।
(ঘ) হাওয়ার্ড ডেনিসন মােমিন।
উত্তরঃ (ক) রামথে ওয়ার্থে মােমিন – ১৮৩৪ সালে মেঘালয়ের উত্তর গারাে পাহাড়ে অবস্থিত মাটসক গ্রে নামে ছােট গ্রামে রামথে ওয়াস্ত্রে মােমিনের জন্ম হয়। ড. মাইলস ব্রনসনের দ্বারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে কিছুদিন পর দামরাতে এসে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি খ্রিস্টান মিশনগুলির ভারপ্রাপ্ত মিশনারি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। রামথে ওয়ার্থে শুধু মিশন এবং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না। তিনি গােয়ালপারা এবং তুরা নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবেও কার্য নির্বাহ করেছেন। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন লেখক এবং গীতিকার। গারাে সমাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে তিনি চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন।
রামথে ওয়াগ্লে মােমিন মােট ২১টি গান রচনা করেছিলেন। এই গানগুলি গির্জায় উপাসনার সময় গাওয়া হয়। এই গানগুলাে ‘আসনি রিঙানিং’ নামে পরিচিত।
তিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী এবং অর্থনীতিবিদ। তাই তাকে “Father of Modern Garo Community’ বলে অভিহিত করা হয়।
(খ) রেভারেন্ড গিলবার্থ কে মারাক – ১৯২৫ সালে পশ্চিম খাসিয়া পাহাড় এবং দক্ষিণ কামরূপ জেলার সীমান্তে অবস্থিত রাসাংপারা গ্রামে গিলবার্থ কে মারাকের জন্ম। তিনি রেভারেন্ড রামথে এবং সাংমার একমাত্র পুত্র। তিনি ১৯৬০ সালে লিনার্ড থিওলজিকেল কলেজ থেকে ডিগ্রি অব ব্যাচেলর অব রিলিজিয়াস এডুকেশন লাভ করেন।
তিনি কামরূপ জেলার গােহলকোনা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছিলেন। সেই সময় যােরহাট সেমিনারির রেজিস্টার পদে নিযুক্ত হন।
গিলবার্থ কে মারাক স্যুইজারল্যান্ডের জেনেভার ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব খ্রিস্টান এডুকেশনের মুখ্য কর্মালয়ে ভারতের একজন পরামর্শদাতা হিসেবে কার্যনির্বাহ করেন। এর কিছুদিন পর ওয়ার্ড কাউন্সিল অব সার্জের সদস্য হিসেবেও তাকে নিযুক্তি দেওয়া হয়। এর সদস্য হয়ে তিনি পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করেন।
গিলবার্থ কে মারাককে তার কর্মদক্ষতার জন্য খ্রিস্টান সংগঠন তাকে রেভারেন্ড’ উপাধি প্রদান করে। তিনি গারাে ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। তিনি গারাে ভাষায় অনেক কবিতা এবং প্রবন্ধ রচনা করেন। ইংরাজি ২০০৭ সালে মেঘালয়ের তুরায় পরলােক গমন করেন।
(গ) সােনারাম রংরকগ্রে সাংমা – ১৮৬৭ সালে উত্তরপূর্ব গারাে পাহাড়ে এবং গােয়ালপাড়া জেলার সীমান্তে অবস্থিত নাসিরংদিক গ্রামে সােনারাম রংরকগ্রে সাংমার জন্ম হয়। তার পিতার নাম খ্রাংগাবিল মােমিন এবং মাতা সামরে রংরকগ্রে সাংমা। নিশান গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে তুরার মিশন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশােনা করেন। তিনি ছিলেন সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, পরােপকারী, দরদী, এবং অত্যন্ত সহিষ্ণু ব্যক্তি। শােষণের বিরােধিতা করা ছিল তার স্বভাবজাত। সামাজিক অত্যাচার উৎপীড়নের বিরােধিতা করেছিলেন এবং সেগুলাে নির্মূল করবার প্রচেষ্টা আজীবন করে গেছেন তিনি।
সেই সময় ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয়দের বিনা মজুরিতে কাজ করান, গারােদের জুম খেত বন্ধ করে দেওয়া সরকারের এমন দমননীতির বিরােধিতা করেছিলেন সােনারাম। ১৯১৬ সালে ২৭ আগস্ট তিনি পরলােক গমন করেন।
(ঘ) হাওয়ার্ড ডেনিসন মােমিন – “আধুনিক গারাে সাহিত্যের জনক” হাওয়ার্ড ডেনিসন মােমিনের জন্ম হয় ১৯১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, মেঘালয়ের তুরা শহরে। তার পিতা ছিলেন জবাং ডি মারাক। যিনি প্রথম গারাে ব্যক্তি উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা পাড়ি দেন। ১৯০৫-১১ পর্যন্ত আমেরিকার হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডেনিসন স্কুলে’ শিক্ষা লাভ করে।
মাত্র নয় বছর বয়সে হাওয়ার্ড ডেনিসন মােমিন কোলকাতার সেন্ট জেমস ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। হাইস্কুল শিক্ষান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯৩৬ সালে ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। গারাে সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
মােমিন কিছুদিন তুরায় ন্যায় বিভাগে বিচারপতি হিসাবে কাজ করেন। ১৯৪০ সালে গুয়াহাটীর কটন কলেজে ইংরেজির প্রবক্তা হিসেবে তিনি যােগ দেন। সেই সময় গারাে ছাত্র- ছাত্রীদের সাহায্যে তিনি ‘আসিক-খুরাং’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি গারাে ভাষায় কিছু কবিতা রচনা করেন।
১৯৯০ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি মােমিনকে তুরায় KACHALANG (খা সালাং) সম্মান প্রদান করা হয়।
সাঁওতালগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতানুসারে সাঁওতাল’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে ?
উত্তরঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতানুসারে ‘সাঁওতাল’ শব্দটি সংস্কৃত ‘সমান্তরাল’ শব্দ থেকে এসেছে।
২। সাঁওতালদের প্রধান জীবিকা কি ?
উত্তরঃ সাঁওতালদের প্রধান জীবিকা কৃষিকার্য।
৩। মােড়ে হােড়ের প্রধানকে কী বলা হয় ?
উত্তরঃ সাঁওতালদের সামাজিক জীবন প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বতন্ত্র। গ্রামের জনসাধারণকে প্রণালীবদ্ধভাবে শাসন করার জন্য গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে পাঁচজনকে বেছে নেওয়া হত। এই পাঁচজনকে ‘মােড়ে হােড়ে’ বলা হয়। ‘মােড়ে হােড়ে’র প্রধানের উপাধি ‘মাঝহি।
৪। সাঁওতালদের উপাধি কয়টি এবং কী কী ?
উত্তরঃ সাঁওতালদের উপাধি বারােটি। যেমন—মুর্মু, হেম, কিস্কু, বেসরা, টুডু, সরেন, রাস্কে, হাসদা, মার্ডি, চোঁড়ে, পাউরিয়া এবং বেদেয়া। প্রতিটি গােত্রের উপগােত্র আছে। মুর্মুর উপগােত্র ঠাকুর, কিস্কুর উপগােত্র রাপাজ।
৫। সাঁওতালদের কৃষ্টি সম্পর্কে আলােচনা করাে ?
উত্তরঃ সাঁওতালদের বিবাহের যে উৎসব, সেখানে সাঁওতাল পুরুষরা ধুতি পরিধান করে। এদের প্রধান উৎসব বাহা এবং সহরাই। বিবাহের দিন বরকে হলুদমাখা চাদর এবং সাদা রঙের টুপি পরতে হয়।
সাঁওতালি ভাষায় পােশাককে “হােরঃ বান্দে” বলা হয়। মহিলাদের প্রধান পরিধান লুঙ্গি পাঞ্চি। মহিলারা উর্ধাঙ্গে যে বস্ত্র পরিধান করে তাকে পাঞ্চি এবং শরীরের নিম্নাংশের বস্ত্রকে ‘পাড় হাণ্ড’ (লুঙ্গি) বলা হয়। মহিলারা রুপাের অলংকার পরিধান করেন। নৃত্যগীতের মধ্যে দংসংগীত, দং নৃত্য, লাগঁড়ে গীত, নৃত্য, চহরাই, বাহাগীত উল্লেখযােগ্য। সাঁওতালদের বাদ্যযন্ত্র হল- টামাক, তুমদাঃ, ঢােল ইত্যাদি। বিয়েতে ব্যবহার করা কাঁসার পাত্র- থাল, বাটি, লটা।
৬। সাঁওতালদের সামাজিক জীবন বর্ণনা করাে।
উত্তরঃ সাঁওতালদের সামাজিক জীবন প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বতন্ত্র। সাঁওতাল সমাজ পিতৃপ্রধান। গ্রামের জনসাধারণকে প্রণালীবদ্ধভাবে শাসন করার জন্য গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে পাঁচজনকে নেওয়া হয়। মাঝহি’র উপর গ্রামের সমস্ত সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব থাকে। গ্রামে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে ‘মাঝহি’র কাছে অভিযােগ করা হয়। এদের প্রধান উৎসব বাহা এবং সহরাই। এরা বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র এবং নৃত্যগীতের মাধ্যমে বিবাহের আনন্দ প্রকাশ করে। বিয়েতে বরকে হলুদমাখা চাদর এবং সাদা রঙের টুপি পরানাে হয়। বিবাহের উৎসবে সাঁওতাল পুরুষরা ধুতি পরিধান করেন।
৭। অর্থ লেখাে।
সিন্দুরখাঙি, টটড়বা, হােরঃ বান্দে, মাঝাহি, পাড়হাণ্ড।
উত্তরঃ সিন্দুরখাণ্ডি – হলদিমাখা সাজপােশাক।
টটড়বা – টুপি।
হােরঃ বান্দে – সাজপােশাক।
মাঝহি – গাঁওবুড়া।
পাড়হাণ্ড – লুঙ্গি।
৮। সংক্ষিপ্ত টীকা লেখাে।
(ক) বেনেডিক্ট হেম।
(খ) বদন হাসদা।
(গ) মিথিয়াস টুডু।
(ঘ) রাহেল কিস্কু।
উত্তরঃ (ক) বেনেডিক্ট হেম্বম – কোকরাঝাড় জেলার গােসাইগাঁও মহকুমার পলাশগুরি গ্রামে ১৯৬৭ সালের ১৮ অক্টোবর বেনেডিক্ট হেম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল লক্ষ্মণ হেম এবং মাতার নাম ছিল রানি সরেন। সাঁওতালি ভাষা, সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে তিনি ১৯৯৩ সালে কটন কলেজ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে এম. এস. সি. ডিগ্রি লাভ করেন। গােসাইগাঁও বি, এড কলেজ থেকে বি, এড. পাশ করে তিনি গ্রাহামপুর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যােগদান করেন। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও প্রথম সাঁওতালি ভাষায় ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন।
তিনি একজন সফল বক্তা ও দক্ষ খেলােয়াড় ছিলেন। সময়ানুবর্তিতা তাঁর একটি বড়াে গুণ ছিল। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন কর্মনিষ্ঠ।
মধুমেহ রােগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
(খ) বদন হাসদা – কোকরাঝাড় জেলার খাপরগাঁও গ্রামে ১৯৫৭ সালে বদন সদা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল মামি হাসদা এবং মা সলমা বেসরা। তিনি সাঁওতাল জনগােষ্ঠীকে শিক্ষা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিকে স্বাবলম্বী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি আদিবাসী সেবা সমিতির সভাপতি এবং অসম সাঁওতালি সাহিত্য সভার উপদেষ্টা ছিলেন। কোকরাঝাড় জেলার উপায়ুক্ত তাকে ‘শান্তি এবং ঐক্য পুরস্কারে সম্মানিত করেন।
২০০৭ সালের ১ মে দুবৃত্তের আক্রমণে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন।
(গ) মিথিয়াস টুডু – ১৯৩০ সালের ১৫ তারিখে কোকরাঝাড় জেলার গােসাইগাঁও মহকুমার সান্থাল কলােনির মাটিয়াজুরিতে মিথিয়াস টুডুর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম রেভারেণ্ড কানহু টুডু এবং মাতার নাম মারথা মুর্মু। মাটিয়াজুরি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। কটন কলেজ থেকে বি. এ. ডিগ্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে বি.টি ডিগ্রী লাভ করেন। গ্রাহামপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে তার চাকরি জীবন আরম্ভ হয় তিনি প্রথমবার অসম বিধানসভার বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সাতবার বিধায়কের আসন অলংকৃত করেন। তিনি অসম সরকারের শ্রমিক কল্যাণ বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন।
অসমে সাঁওতাল জনগােষ্ঠী থেকে চল্লিশ বছর অসম বিধানসভাতে প্রতিনিধিত্ব করা তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। অসম সাঁওতালি সাহিত্য সভার সভাপতি, সাঁওতাল ভাষা এবং সাহিত্য গবেষণার প্রতিস্থাপক সভাপতি, গ্রাহামপুর সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, মরনাই চা-বাগান ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি, সেবাপুর মিশন হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট পদে কর্মরত ছিলেন।
তাঁর অন্যতম শখ ছিল বই পড়া, বাগান করা, চাষবাস দেখাশােনা করা বেং শিকার করা। তিনি একজন দক্ষ ফুটবলার ছিলেন।
২০১৭ সালের ১০ জুলাই এই সৎ চরিত্রের মানুষটি মৃত্যুবরণ করেন।
(ঘ) রাহেল কিস্কু – কোকরাঝাড় জেলার গােসাইগাঁও থানার অন্তর্গত বরসনপুর গ্রামে ১৯২৫ সালে রাহেল কিস্কুর জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতার নাম ছিল জহন কিস্কু এবং মাতার নাম ছিল লক্ষ্মী মুমু। শৈশবকাল থেকে তিনি লেখাপড়া করতে ভালােবাসতেন। হারকুটা মিশন থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল। ১৯৫১ সালে লক্ষ্ণেীর একটি মহাবিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তিনিই ছিলেন সাঁওতালদের প্রথম মহিলা স্নাতক।
দরিদ্র শ্রেণির মহিলাদের উন্নতিকল্পে কর্মরত অবস্থাতেই নিজস্ব পুঁজি দিয়ে বিনামূল্যে মহিলাদের জন্য একটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুরু করেছিলেন। তিনি সমাজের দুর্নীতি নিবারণ, মদের প্রচলন ও ডাইনি হত্যা বন্ধ করেছিলেন।
তার কর্মজীবন শুরু হয় গ্রাহামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহশিক্ষয়িত্রী হিসাবে। প্রধান শিক্ষয়িত্রী হিসাবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
সাঁওতাল সাহিত্য জগতের তিনি এক অমূল্য সম্পদ। ২০০১ সালের ৬ এপ্রিল তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চা জনগােষ্ঠী
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। অসমের প্রথম চা বাগান কোনটি এবং কবে স্থাপিত হয়েছিল ?
উত্তরঃ ১৮৩৫ সালে উজান অসমের চাবুয়ায় প্রথমে চায়ের পদ্ধতিগত রােপনকার্য আরম্ভ হয়েছিল।
২। অসমের চা কোম্পানীর নাম কী এবং কবে স্থাপিত হয়েছিল ?
উত্তরঃ অসমের চা কোম্পানীর নাম ‘অসম চা কোম্পানী। ১৮৩৯ সালে স্থাপন করা হয়েছিল।
৩। গিরমিটিয়া এবং আড়কাঠিয়া চালানের বিষয়ে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
উত্তরঃ অসমে চা খেতির জন্য শ্রমিকের অভাব ছিল। শ্রমিকের অভাব হওয়ার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং চীন থেকে শ্রমিক আনা হয়েছিল। শ্রমিক সংগ্রহ করার জন্য কোম্পানি কিছু মধ্যভােগী নিয়ােগ করেছিল। মধ্যভােগীরা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করত। শ্রমিক সংগ্রহ করে আনা কার্যকে মজদুর চালান নামে অভিহিত করা হত।
মজদুর চালান দুই প্রকারের। গিরমিটিয়া চালান এবং আড়কাঠিয়া চালান। যে সকল শ্রমিককে লিখিত চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আনা হয়েছিল তাদেরকে গিরমিটিয়া চালান এবং যে সকল শ্রমিককে বিনা চুক্তিতে কৌশলে সংগ্রহ করা হয়েছিল তাদের আড়কাঠিয়া চালান বলা হয়।
৪। চা জনগােষ্ঠী সমাজের দশটি জাতি উপজাতির নাম লেখাে।
উত্তরঃ চা জনগােষ্ঠী সমাজে বিভিন্ন জাতি, উপজাতি এবং সম্প্রদায় আছে। এদের কিছু হল- ওরাওঁ, মুণ্ডা, সাঁওতাল, কুর্মি, তাতি, ঘাটোয়ার, গােয়ালা, কামার, কাঁসারি, কালিন্দী, কিষাণ, কৈরী খাড়িয়া, খণ্ডাইত, খাল, গঁড়, গরাইত, গঞ্জু, গাজলু, খাসি, গন্দ, সাওঁরা, চুড়ি ইত্যাদি।
৫। চা জনগােষ্ঠীর মধ্যে কী কী ধর্মের লােক আছে ?
উত্তরঃ চা জনগােষ্ঠীর মধ্যে হিন্দু এবং খ্রিস্টানধর্মী লােকের সংখ্যা অধিক। হিন্দুদের বেশির ভাগই শাক্তধর্মী এবং জড় উপাসক। দুর্গা, কালী, মনসা ইত্যাদি দেবদেবীর উপাসক।
৬। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মহিলা শহিদ কে ?
উত্তরঃ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মহিলা শহিদ হল তেজপুর অ্যাণ্ড ঘগরা টি এস্টেটের মাংরি ওরাওঁ।
৭। অসম আন্দোলনের চা বাগানের প্রথম শহিদ কে ?
উত্তরঃ অসম আন্দোলনের চা বাগানের প্রথম শহিদ দরং জেলার কৌপাতি চা বাগানের বাধনা ওরাওঁ।
৮। সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।
(ক) মেঘরাজ কর্মকার।
(খ) সন্তোষ কুমার তপ্ন।
(গ) সাইমন সিং হােড়।
উত্তরঃ (ক) মেঘরাজ কর্মকার – চা জনগােষ্ঠীর যে সকল লােক অসমীয়া ভাষা সাহিত্য চর্চা করে সুনাম অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রথম সাহিত্যিক পেন্সনার হলেন মেঘরাজ কর্মকার। তিনি উজানি অসমের চা বাগানের লােক ছিলেন। তিনি বরুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। চালুক বচন’ তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম। অসম প্ৰকাশন পরিষদ ‘মেঘরাজ কর্মকার রচনাবলী’প্রকাশ করেছে।
(খ) সন্তোষ কুমার তপ্ত – ১৯২৪ সালে সন্তোষ কুমার তপ্ন জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন দরাল তপ্ন এবং মা ছিলেন মারঠা তপ্ন। তিনি যােরহাট জে. বি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর লেখা ‘মুণ্ডা জাতির চমু পরিচয়’ চা জনগােষ্ঠীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ১৯৯৪ সালের ২১ নভেম্বর তিনি পরলােকগমন করেন।
(গ) সাইমন সিং হােড় – সাইমন সিং হােড় ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাছিরাম হােড়, মায়ের নাম ছিল সারা হােড়। তিনি অসমের চা জনগােষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাপক সভাপতি ছিলেন। সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান করে তিনি সমাজসেবা করেছিলেন। খ্রিস্টান হয়েও তিনি হিন্দুধর্মের নামঘর প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের ভূমি দান করেছিলেন। শিক্ষার প্রসার করার জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ২৬ জুন তিনি পরলােকগমন করেন। তিনি অসম আন্দোলনে মৃত্যুবরণকারী চা জনগােষ্ঠীর প্রথম শহীদ।
চুটিয়াগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। চুটিয়াদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল ?
উত্তরঃ হিমালয়ের উত্তরে মানস সরােবরের পূর্বে অবস্থিত স্বাত সরােবরের পাশ্ববর্তী অঞ্চলে চুটিয়াদের আদি বাসস্থান ছিল। সেখান থেকে তারা সােঅনসিরি নদীর পাড়ে পাড়ে পশ্চিমদিকে বর্তমান লখিমপুর অঞ্চলে উপনীত হয়।
২। চুটিয়া শব্দের উৎপত্তি কোন শব্দ থেকে হয়েছিল ?
উত্তরঃ স্বাতিয়া শব্দ থেকে চুটিয়া শব্দের উৎপত্তি হয়েছিল।
৩। চুটিয়াদের একজন বীরাঙ্গনার নাম লেখাে।
উত্তরঃ চুটিয়াদের বীরাঙ্গনার নাম সতী সাধিনী।
৪। নিম্নলিখিত যে কোনাে একজন মানুষের সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখাে।
(ক) সােনারাম চুটিয়া।
(খ) ড. স্বর্ণলতা বরুয়া।
(গ) চিদানন্দ শইকিয়া।
(ঘ) কোষেশ্বর বরুয়া।
উত্তরঃ (ক) সােনারাম চুটিয়া – বর্তমান যােরহাট জেলার কাকজান অঞ্চলের বাম কুকুরাচোয়া গ্রামে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সােনারাম চুটিয়া জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৫ সালে পাঁচটি বিষয়ে লেটার নম্বরসহ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কটন কলেজ থেকে সুখ্যাতি সহ বিজ্ঞান শাখায় স্নাতক হয়েছিলেন। তিনি সংস্কারকামী মনােভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্ৰীমন্ত শংকরদেব সংঘে যােগদান করেন এবং নয়টি কার্যকাল পদাধিকারী হিসাবে কার্য সম্পাদন করেন। তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল- অসমের বৈষ্ণব দর্শনের রূপরেখা, নামধর্ম প্রকাশ, মহাপুরুষ শ্রীহরিদেব চরিত, ভাগবত মাহাত্ম, মহাপুরুষীয়া ধর্ম জিজ্ঞাসা, বেদ ও মহাপুরুষীয়া ধর্ম ইত্যাদি। শ্ৰীমন্ত শংকরদেব সংঘ শ্ৰীমন্ত শংকরদেব মাধবদেব পুরস্কার এবং বৈষ্ণব পণ্ডিত’ উপাধি প্রদান করে জীবনজোড়া অবদানের প্রতি যথাযােগ্য স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
(খ) ড. স্বর্ণলতা বরুয়া – ড. স্বর্ণলতা বরুয়াউত্তর পূর্বাঞ্চলের একমাত্র মহিলা বুরঞ্জীবিদ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। চুটিয়া জাতীর বুরঞ্জী’র মুখ্য সম্পাদিকা A comprehensive History of Assam, Last Day of Ahom Monarchy – A History of Assam From 1769-1826 প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। উল্লেখযােগ্য যে, এর Status of Women in Non-Tribal Societies of Assam নামক গবেষণাপত্রটি বিশেষ সমাদর লাভ করেছিল।
(গ) চিদানন্দ শইকিয়া – বর্তমান গােলাগাট জেলার দ গাঁও-এ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে চিদানন্দ শইকিয়া জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আজীবন শিক্ষাব্রতী, স্বাধীনতা সংগ্রামী সাম্যবাদী দর্শনের সমর্থক ছিলেন। তাঁর রচিত উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হল- ‘সােভিয়েত নারী, ‘সীমান্ত গান্ধী’, ‘মহর্ষি কার্লমার্ক্স’, ‘আগুনে পােড়া সােনা’, ‘শংকর বয়া’, ‘খেরিয়া ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি সােভিয়েত দেশ নেহরু পুরস্কার, সাহিত্যিক পেনশন এবং শিক্ষক পুরস্কার লাভ করেছিলেন। অসমের সাংবাদিকতার জগতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
(ঘ) কোযেশ্বর বরুয়া – লখিমপুর জেলার ঢলপুর মৌজার বরথেকেরাবাড়ি গ্রামে কোষেশ্বর বরুয়া জন্মগ্রহণ করেন। অসম সরকারের সাহিত্যিক পেনসন প্রাপক মানুষটি বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করে অসমিয়া সাহিত্য জগৎকে আলােকিত করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থরাজি হল-কলেজর দুবরি বন, অনুভব, লগন, আগন্তুক, প্রজন্মর উমানত ইত্যাদি কবিতা সংকলন। ধন্য জন্ম ভারতবরিষে, জননেতা ভীমবর দেউরি, ঐতিহাসিক বিবর্তনে অসমের চুটিয়া জনগােষ্ঠী, চুটিয়া রাজা রত্নধ্বজ পাল ইত্যাদি প্রধান। তাছাড়াও তিনি দু’খানা গানের সংকলন করেছিলেন। তিনি ড. আম্বেদকর ফেলােশিপ এবং অসম সরকারের প্রদান করা সতী সাধিনী পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
৫। চুটিয়াদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
উত্তরঃ অসমের আদিম জনগােষ্ঠীর ভিতরে চুটিয়াগণ অন্যতম। অহােম স্বৰ্গদেউ চুহুংমুং ডিহিঙীয়া রাজার রাজত্বকালে চুটিয়া রাজ্য অহােম রাজ্যের অন্তর্গত হয়। চুটিয়াদের বীরাঙ্গনা নারী সতী সাধনী। তিনি অহােমদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং অহােমদের বশ্যতা স্বীকার না করে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে চন্দনগিরি পর্বত থেকে ঝাঁপ দিয়ে দেহত্যাগ করেছিলেন।
হিমালয়ের উত্তরে মানস সরােবরের পূর্বে থাকা স্বাত সরােবরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে চুটিয়াদের আদিম বাসস্থান ছিল। চুটিয়াদের রাজত্ব করা শদিয়া রাজ্যের পুরনাে নাম ছিল কুণ্ডিল নগর। চুটিয়াগণ নিজেদের বিদর্ভরাজ ভীষ্মক- এর বংশধর বলে পরিচয় দেন। এরা দেবী উপাসক। নরবলি সহযােগে তাম্ৰেশ্বরী দেবীর পুজো করতেন। স্বৰ্গদেও গৌরীনাথ সিংহের শাসনকাল থেকেই নরবলি প্রথা বন্ধ হয়েছিল।
চুটিয়াগণ ভাস্কর্য শিল্পেও ঋদ্ধ ছিলেন। মৃত পাখির সঙ্গে বিষ্ণুমূর্তি, শিব পার্বতীর মূর্তি, সূর্যের মূর্তি, তাম্বেশ্বরী মন্দির ইত্যাদি তাঁদের স্থাপত্য ভাস্কর্যের পরিচয় বহন করে। তাছাড়াও সােনার তৈরি ডুগডুগি, সােনালি গলপতা, সােনার কেরু, সােনা ও রূপার গামখারু, চন্দ্রহার, সােনার বেড়াল, তিনভাজের সিংহাসন ইত্যাদি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
চুটিয়া জনগােষ্ঠীর বহুলােক অসমিয়া জাতীর জীবনে অভূতপূর্ব অবদান রেখে গেছেন।
ঠেঙাল কছারিগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। মঙ্গোলীয়া কিরাতদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য কেমন ?
উত্তরঃ মঙ্গোলীয়া গােষ্ঠীর অবয়বের বৈশিষ্ট্য হল- “গায়ের রঙ হলদেটে, চুল কালাে, ঋজু আর ও অমসৃণ, দাড়ি গোঁফ প্রায় নেই, শরীর মােটামুটি লােমহীন, মুখমণ্ডল গােলাকৃতি, নাক চ্যাপ্টা। হনু স্পষ্ট, চোখ ছােট। নেত্রচ্ছেদের ভাঁজ মঙ্গোলীয়দের বিশেষ লক্ষণ।”
২। মঙ্গোলীয়া কিরাতদের সংস্কৃত ভাষায় কী বলা হয় ?
উত্তরঃ মঙ্গোলীয়া কিরাতদের সংস্কৃত ভাষায় কক্ষবাট বলা হয়। কক্ষবাট > কক্ষত > কচ্ছ।
৩। কছারি’ নাম কীভাবে উৎপত্তি হয়েছিল ?
উত্তরঃ অসমের একটি প্রাচীন জাতি কছারি! একসময় এদের কিরাত বলে অভিহিত করা হত। এরা সাধারণত কোনাে বড় নদী বা পর্বতের পাশে বসবাস করত। সেইজন্য সংস্কৃত ভাষায় তাদের কক্ষবাটি বলা হয়। কক্ষবাট > কক্ষত > কচ্ছ। কচ্ছের সঙ্গে অরি যুক্ত হয়ে (কচ্ছ + অরি) কছারি নামের উৎপত্তি হয়েছিল।
৪। ড. ভুবনমােহন দাস মঙ্গোলীয়দের কয়টি ভাগে ভাগ করেছিলেন ?
উত্তরঃ ড. ভুবনমােহন দাস উত্তরপূর্ব ভারতের মঙ্গোলীয়দের শ্রেণিবিভাগ করেছেন।
১। খাসি।
২। বােড়াে।
৩। লুসাই কুকি।
৪। নাগা।
৫। অরুণাচলের জনজাতি।
৬। অন্যান্য।
অন্যান্য জাতির মধ্যে মিসিং, দেউরি, হাজং- এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
৫। ঠেঙাল কছারিরা পৌরাণিক কোন গােষ্ঠী থেকে এসেছে ?
উত্তরঃ ঠেঙাল কছারিরা মঙ্গোলীয় প্রজাতির বােড়াে গােষ্ঠীর পূর্ব শাখা থেকে এসেছে।
৬। ঠেঙাল কছারিদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আলােচনা করাে।
উত্তরঃ ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে অসমের উজানি অঞ্চলের শদিয়ার থেকে দৈয়াং ধনশিরি উপত্যকা এবং নগাঁও পর্যন্ত ঠেঙাল কছারির বংশসমূহের অবস্থান ছিল। ঐতিহাসিক পাকচক্র এবং অর্থনৈতিক কারণগত তারা অসমের বিভিন্ন প্রান্তের ব্রহ্মপুত্রের উত্তর এবং দক্ষিণ পারে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান যােরহাট জেলা থেকে নাগাপাহাড় পর্যন্ত তিতাবরকে কেন্দ্র করে ঠেঙাল কছারিগণ বসতি স্থাপন করেছে। গােলাঘাট জেলার ধনসিরি নদীর পারের ঠেঙাল গ্রাম পঙ্কা, মরঙি, বুঢ়াগােহাই ঘাট, সরপথার, বরপথার, সাউদাংপথার, গমারি, কাৰ্বি আংলং জেলার কলিয়নী, নাজিরা, ডিব্রুগড়ের নাহরনি, সােনাপুর, কৃষ্ণপুর, ঢেকিয়াজুলি, ধেমাজি, গােগমুখ, নাহরবারি, পানিগাঁও, জোনাই ইত্যাদি স্থানে ঘনবসতিপূর্ণ ঠেঙ্গাল কছারির গ্রাম আছে।
৭। সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।
(ক) লৌহপ্রাণ গিরিধর ঠেঙাল।
(খ) কমল কছারি।
উত্তরঃ (ক) লৌহপ্রাণ গিরিধর ঠেঙাল – অসমের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে যে সমস্ত খিলঞ্জিয়া ব্যক্তি উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন গিরিধর ঠেঙাল তাদের অন্যতম। জোরহাট জেলার তিতাবর মহকুমার অন্তর্গত ঠেঙাল মৌজার উলুতলি গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে ১৯২১ সালে ১২উ জানুয়ারি গিরিধর ঠেঙাল জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল জিলিরাম ঠেঙাল এবং মাতার নাম ছিল কান্দুরি ঠেঙাল। শৈশবে মাতৃহারা গিরিধর ঠেঙাল জ্যাঠাইমার কাছে মানুষ হন। যােরহাটের সরকারি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করে জগন্নাথ বরুয়া কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। ১৯৫২ সালে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি. এল. ডিগ্রী লাভ করেন।
শিক্ষক হিসাবে গিরিধর ঠেঙালের কর্মজীবন শুরু হয়। শিক্ষাজগৎ থেকে তিনি রাজনীতিতে যােগদান করেন। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন-এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। জালুকনিবারী উচ্চবিদ্যালয়, তিতাবর নন্দনাথ শইকিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তার নাম উল্লেখযােগ্য।
(খ) কমল কছারি – যােরহাটের তিতাবর মহকুমার ঠেঙাল মৌজার মরধলি কছারি গ্রামে এক কৃষক পরিবারে কমল কছারি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম ছিল উনিরাম কছারি, মায়ের নাম সরু আইতি কছারি। জীবিকার কর্মসূত্রে তিনি শিবসাগর জেলার নাজিরায় বাস করতেন। একাধারে তিনি ছিলেন ভাস্কর্য শিল্পী, চিত্রশিল্পী, বেতার শিল্পী। তিনি অসমের নিয়মিত পত্রিকা প্রতিধ্বনি’, ‘অসমবাণী’, ‘নীলাচল, ‘অগ্রদূত’, ‘সাদিন’, ‘প্রতিদিন’-এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। সংগীত, কবিতা, নাটক রচনা করা ছাড়াও তিনি ফেস্টুন, প্রচ্ছদ তৈরি করতেন। অসম সাহিত্য সভা তাকে “বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা বঁটা”প্রদান করে। শিবসাগর সাহিত্য সভা কমল কছারিকে “কবি কমল কছারি সাহিত্য বঁটা” প্রদান করে।
দরদি কবি কমল কছারি ৬৫ বছর বয়সে ২০১৩ সালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ডিমাসাগণ
পাঠ্যভিত্তিক প্রশ্ন এবং উত্তর
১। ডিমাসারা প্রধানত কয়টি অংশে বিভক্ত ?
উত্তরঃ ডিমাসারা ৪০ জন পিতৃপুরুষের বংশােদ্ভবরূপে ৪০টি বংশ বা ক্লেনে বিভক্ত।
২। ডিমাসা ভাষার সঙ্গে অসমের আর কোন ভাষার মিল দেখা যায় ?
উত্তরঃ ডিমাসা ভাষার সঙ্গে অসমের বােড়াে ভাষার মিল দেখতে পাওয়া যায়।
৩। কৃষি সমাপ্তির পর ডিমাসাদের পালিত উৎসবটির নাম কী ?
উত্তরঃ কৃষি সমাপ্তির পর ডিমাসাদের পালিত উৎসবটির নাম বিছু ডিমা।
৪। ডিমাসাদের গােত্রসমূহের নামের শেষ অক্ষরটি সাধারণত কী হয় ?
উত্তরঃ ডিমাসাদের গােত্রসমূহের নামের শেষ অক্ষরটি ‘চা’ হয়।
৫। ডিমাসাদের কয়েকটি গােত্রের নাম লেখাে।
উত্তরঃ ডিমাসাদের গােত্রের নাম হল লাংথাচা, ডিফুচা, গার্লোচা, হােজাইচা, মাইবংচা ইত্যাদি।