Class 9 Bengali Chapter 14 আত্মকথা

Class 9 Bengali Chapter 14 আত্মকথা Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 9 Bengali Chapter 14 আত্মকথা and select needs one.

Class 9 Bengali Chapter 14 আত্মকথা

Join Telegram channel

Also, you can read SCERT book online in these sections Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 9 Bengali Chapter 14 আত্মকথা for All Subject, You can practice these here…

আত্মকথা

               Chapter – 14

খ – বিভাগ পদ্যাংশ

ক্রিয়াকলাপ-

১। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদিমার নাম কী ছিল ?

(ক) মেনকাসুন্দরী

(খ) অলকাসুন্দরী

(গ) সারদাসুন্দরী

(ঘ) দিগম্বরী

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Join Now

উত্তরঃ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদিমার নাম মেনকাসুন্দরী।

২। ব্রজবাবু কে ?

উত্তরঃ লেখক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠতাত পুত্র ব্রজবাবু।

৩। দেবেন্দ্রনাথের প্রথম গানটি কী ছিল লেখাে।

উত্তরঃ দেবেন্দ্রনাথের প্রথম গানটি ছিল—“হবে, কি হবে দিবা আলােকে, জ্ঞান বিনা সব অন্ধকার।

৪। তােমার জ্ঞাত একটি চাণক্য শ্লোক উল্লেখ করাে যেমন-

উত্তরঃ বিদ্বত্বঞ্চ নৃপতঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।

৫। দেবেন্দ্রনাথের বাড়িতে যে সভাপতি ছিলেন তার নাম কী ?

(ক) দেবকান্ত চূড়ামণি

(খ) শ্যামাচরণ

(গ) ব্রজবাবু

(ঘ) কমলাকান্ত চূড়ামণি

উত্তরঃ (খ) কমলাকান্ত চূড়ামণি।

৬। কমলাকান্ত চূড়ামণির বাড়ি কোথায় ছিল ?

উত্তরঃ কমলাকান্ত চূড়ামণির বাড়ি ছিল বাঁশবেড়ে।

৭। চূড়ামণির পুত্রের নাম ছিল—

(ক) শ্যামাচরণ

(খ) বরদাচরণ

(গ) কালীচরণ

(ঘ) ব্রজগােপাল

উত্তরঃ (ক) শ্যামাচরণ।

৮। দশটি বাক্যে লেখাে।

ধৌম্য ঋষি কে ? তার সম্পর্কে যা জান লেখাে।

উত্তরঃ মহর্ষি দেবলের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধৌম্য। উৎকোচক তীর্থে তার সঙ্গে পাণ্ডুপুত্র অর্জুনের সাক্ষাৎ হয়। অর্জনের প্রার্থনায় তিনি পাণ্ডবদের পৌরােহিত্য করেন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে ব্যাঘ্রপদ নামে এক বেদ বেদাঙ্গ পারদর্শী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার পুত্র ধৌম্য। যুধিষ্ঠিরের ময়দানব নির্মিত সভায় উপস্থিত ঋষিদের অন্যতম। লঙ্কাসমর বিজয়ী রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করার জন্য তিনি অযােধ্যায় গমন করেন।

৯। সঠিক উত্তর নির্বাচন করাে।

১। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতার নাম বলাে।

(ক) মেঘনাথ

(খ) রবীন্দ্রনাথ

(গ) দ্বারকানাথ

(ঘ) গগনেন্দ্রনাথ

উত্তরঃ গ) দ্বারকানাথ ঠাকুর।

২। শ্যামাচরণ দেবেন্দ্রনাথকে পড়তে বলেছিলেন-

(ক) রামায়ণ

(খ) মহাভারত

(গ) ভাগবত

(ঘ) পুরাণ

উত্তরঃ (খ) মহাভারত।

৩। তােমাদের ধর্মে মতি হউক- এই কথাটি কোন গ্রন্থে আছে।

(ক) রামায়ণ

(খ) ভাগবতে

(গ) মহাভারতে 

(ঘ) গীতাঞ্জলিতে

উত্তরঃ (গ) মহাভারতে।

১০। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।

(ক) ভালােই তাে আমি তােমাকে পড়াইব’—উক্তিটি কার ?

উত্তরঃ উক্তিটি কমলাকান্ত চূড়ামণির।

(খ) আমার পিতার মৃত্যু হইয়াছে—উক্তিটি কার ?

উত্তরঃ উক্তিটি শ্যামাচরণের।

(গ) দেবেন্দ্রনাথ কীভাবে ঈশ্বরকে লাভ করতে চেয়েছেন ?

উত্তরঃ দেবেন্দ্রনাথ জ্ঞানের আলােকে ঈশ্বরকে লাভ করতে চেয়েছেন।

১১। সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।

(ক) ঈশ্বর লাভের জন্য দেবেন্দ্রনাথ কী কী করলেন।

উত্তরঃ দেবেন্দ্রনাথ কৌচে বসে ঈশ্বর বিষয়ক চিন্তা করতেন, বােটানিক্যাল উদ্যানের মধ্যস্থলে যে একটা সমাধিস্তম্ভ আছে সেখানে বসে থাকতেন। মহাভারত পাঠ করতেন।

(খ) কমলাকান্ত চূড়ামণির সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের সম্পর্ক কেমন ছিল ?

উত্তরঃ দেবেন্দ্রনাথের বাড়ির একজন সভাপতি ছিলেন কমলাকান্ত চূড়ামণি। তাঁর বাড়ি ছিল বাঁশবেড়ে। তিনি সুপণ্ডিত ও তেজস্বী। লেখককে খুব ভালাে বাসতেন। লেখক তাকে ভক্তি করতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কমলাকান্ত চূড়ামণির কাছে মুগ্ধবোেধ ব্যাকরণ পড়তেন।

(গ) ঈশ্বরের তত্ত্বকথার হদিস দেবেন্দ্রনাথ কার নির্দেশে কোথায়। পেয়েছিলেন ?

উত্তরঃ ঈশ্বরের তত্ত্বকথার হদিস দেবেন্দ্রনাথ কমলাকান্ত চূড়ামণির পুত্র শ্যামাচরণের নির্দেশে মহাভারতে পেয়েছিলেন। শ্যামাচরণের নির্দেশেই লেখক মহাভারত পড়তে আরম্ভ করেছিলেন। মহাভারতের একটি শ্লোক লেখকের নজরে পড়েছিল- ধর্মে মতিভবতু বঃ সততােথিতানাং- তােমাদের ধর্মে মতি হােক, তােমরা সতত ধর্মে অনুরক্ত হও, সেই এক ধর্মই পরলােকগত ব্যক্তির বন্ধু, অর্থ ও স্ত্রীদিগকে নিপুণভাবে সেবা করলেও তাদের আয়ত্ত করা যায় না এবং তাদের স্থিরতাও নেই।

১২। দশটি বাক্যে উত্তর দাও।

(ক) কিন্তু আমার মনের যে বিষাদ, সেই বিষাদ’—উক্তিটি কার ? তার এমন বিষাদের কারণ ব্যাখ্যা করাে।

উত্তরঃ উক্তিটি লেখক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

ঈশ্বর বিষয়ে চিন্তা করতে করতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন বিষাদগ্রস্ত হয়েছিল। তিনি কীসে শান্তি পাবেন, কীভাবে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবেন সেই চিন্তা করতে করতে দিশাহারা। তিনি কখন ভােজন করছেন, কখন কৌচে শুয়েছেন কিছুই জানতে পারছেন না। জীবন নীরস, পৃথিবী শ্মশানতুল্য বলে মনে হচ্ছে। সুযােগ পেলেই লেখক বােটানিক্যাল গার্ডেনে চলে যেতেন। ঐ নির্জন বাগানের মধ্যস্থলে অবস্থিত সমাধিস্তম্ভে বসে থাকতেন। চারিদিক অন্ধকার মনে হত। বিষয়ের প্রতি প্রলােভন নেই, কিন্তু ঈশ্বরের ভাবও কিছু পাচ্ছেন না। পার্থিব ও স্বর্গীয় সকল প্রকার সুখের অভাব, কিছুতেই সুখ নেই, কিছুতেই শান্তি নেই। দুই প্রহরের সূর্যের রােদকেও যেন অন্ধকার মনে হত।

(খ) কমলাকান্ত চূড়ামণির সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের সম্পর্কের বিবরণ দাও।

উত্তরঃ লেখক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ীতে কমলাকান্ত চূড়ামণি নামে একজন সভাপণ্ডিত বাস করতেন। কমলাকান্ত চূড়ামণির আদিনিবাস বাঁশবেড়ে। তিনি সুপণ্ডিত ও তেজস্বী। লেখকের যখন বয়স অল্প তখন তিনি চূড়ামণি মহাশয়কে খুব ভালবাসতেন ও ভক্তি করতেন। লেখক চূড়ামণি মহাশয়ের কাছে একদিন মুগ্ধবােধ ব্যাণ পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কমলাকান্ত চূড়ামণি রাজি হলেন। একদিন চুড়ামণি একটি কাগজে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে সই করিয়ে নিলেন। যাতে লেখা আছে তার পুত্র শ্যামাচরণকে চিরকাল লেখক প্রতিপালন করবেন। চুড়ামণির প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল। কিছুদিন পরে সভাপণ্ডিত চূড়ামণির মৃত্যু হয়। চূড়ামণির অঙ্গীকারপত্রে সই ও তার মৃত্যুর পরে সেই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্কের গভীরতা ও নিবিড়তা সহজেই অনুমান করা যায়।

(গ) দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বর অন্বেষণে কী কী উপায় অবলম্বন করেছিলেন ?

উত্তরঃ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন ছিল বিষাদময়। তিনি ঈশ্বর বিষয়ে খুবই চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। সুযােগ পেলেই লেখক বােটানিক্যাল গার্ডেনে চলে যেতেন। সেখানে একটি সমাধিস্তম্ভে বলে ঈশ্বরের চিন্তা করতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃত পড়তে উদ্যোগী হলেন। কমলাকান্ত চূড়ামণির পুত্র শ্যামাচরণের কথায় মহাভারত পড়তে আরম্ভ করেছিলেন। মহাভারতের “ধর্মে মতিভবতু বঃ সততােথিতানাং” শ্লোকটি পড়ে বড় উৎসাহ বােধ করলেন। দেবেন্দ্রনাথ কল্পতরু হয়ে গেলেন। তিনি নিজের সমস্ত জিনিস আত্মীয় পরিজনের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। লেখকের জ্যেষ্ঠতাত পুত্র ব্রজবাব মুটে এনে লেখকের ভাল ভাল ছবি, বহুমূল্য গৃহসজ্জা সমস্ত কিছু নিয়ে গেলেন। লেখক সমস্ত আসবাব বিলিয়ে দিলেন।

(ঘ) উপমন্যুর কথা কোন গ্রন্থে আছে ? উপমন্যুর কথা তােমার নিজের ভাষায় বর্ণনা কর।

উত্তরঃ মহর্ষি দেবলের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন ধৌম্য। উৎকোচক তীর্থে তার সঙ্গে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সাক্ষাৎ হয়। অর্জুনের প্রার্থনায় তিনি পাণ্ডবদের পৌরােহিত্যে ব্রতী হন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে, ব্যাঘ্রপদ নামে এক বেদ বেদাঙ্গ পারদর্শী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার পুত্র ধৌম্য যুধিষ্ঠিরের ময়দানব নির্মিত সভায় উপস্থিত ঋষিদের অন্যতম ছিলেন। লঙ্কাসমর বিজয়ী রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করার জন্য তিনি অযােধ্যা গমন করেন।

লিঙ্গ পুরাণে বলা হয়েছে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাসের অন্যতমা পত্নী পীবরীর গর্ভে উপমন্যু জন্মগ্রহণ করেন। বশিষ্ট বংশীয়, মহর্ষি আয়ুষ ধৌম্যের অন্যতম শিষ্য ছিলেন উপমন্যু। অবন্তীনগরে সন্দীপন নামে এক দ্বিজের কাছে বহু শিষ্য অধ্যয়ন করত। সেই দ্বিজ উপমন্যুকে গাভী সমর্পণ করলেন। তাকে গােচারণে পাঠালেন। উপমন্যু গুরুর আদেশ মাথায় নিয়ে গােচারণে গেলেন। কয়েকদিন পরে উপমন্যুর হৃষ্টপুষ্ট শরীর দেখে গুরু জানতে চাইলেন সে কী খায়, কোথায় পায়। শিষ্য হাত জোড় করে উত্তর দিলেন যে গাভীদের দোহন করার পর যতটুকু দুধ অবশিষ্ট থাকে সে তাই খায়। গুরু বললেন তিনি এতদিনে সব জানতে পারলেন এই জন্যই বাছুরগুলি সব দুর্বল হয়ে পড়েছে। 

গাভীর দুধ খায় তার লাজলজ্জা নেই বলে এই কাজ করতে নিষেধ করলেন। গুরু আজ্ঞা বহণ করে চলে যাবার কয়েকদিন পরে আবার গুরু ডেকে পাঠিয়ে একই প্রশ্ন উপমন্যুকে জিজ্ঞাসা করলেন। উপমন্যু উত্তর দিল যেদিন গুরুদেব এই কাজ করতে বারণ করেছেন সেদিন থেকে সে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছে। এরপর গুরু আদেশ দিলেন উপমন্যু ভিক্ষা করে যা পাবে সব গুরুকে দিয়ে দিতে হবে। -উপমন্যু গুরুর আদেশ পালন করল। কয়েকদিন পরে পুনরায় উপমন্যুকে গুরু একই কথা জিজ্ঞাসা করলেন। উপমন জানাল যে সে অরণ্যের ভিতরে গাভী রেখে নগরে যায়। সেখানে সারাদিনে যে ভিক্ষা পায় সেই ভিক্ষা গুরুদেবকে দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় ভিক্ষা যা পায় তাই দিয়েই উপমন্যুর দিন চলে। গুরুদেব হেসে বললেন এ কেমন বিচার। রাত্রের শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা সে নিজের করে নেয়। দিন ও রাত্রিতে যা ভিক্ষা পাবে সবই গুরুদেবকে দিয়ে দিতে হবে। বনে সারাদিন গাভী বিচরণ করে ক্ষুধায় উপমন্যু অস্থির হয়ে আকন্দগাছের নরম পাতা খায়। 

দুর্বল শীর্ণ শরীরে দেখতে পায় না। তা সত্ত্বেও সে গাভী চরায়। ঘুরতে ঘুরতে জলহীন কূপের মধ্যে পড়ে গেল। সন্ধ্যাবেলায় গাভীর পাল গৃহে ফিরলেও উপমন্যু ফিরল না। শিষ্যকে না দেখতে পেয়ে গুরুর মন দুঃখিত হল। নিজে তিনি অরণ্যের ভিতর শিষ্যকে খুঁজতে গেলেন। দ্বিজবরের ডাকে উপমন্যু কৃপের ভিতর থেকে সাড়া দিল। কূপের মধ্যে কিভাবে পড়ে গেল জানতে চাইলে উপমনু বলল আকন্দের পাতা খেয়ে চোখ অন্ধ হয়ে কূপের ভিতর পড়ে গেছে। দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারের দয়ায় উপমন্যু চোখ ফিরে পেল এবং কূপ থেকে উঠে এল। সন্তুষ্ট হয়ে গুরুদেব আশীর্বাদ করলেন চারটি বেদে উপমন্য পারঙ্গম হবে। গুরুর বচনে সর্বশাস্ত্রে উপমনু জ্ঞানী হয়ে উঠল।

১৩। রচনাধর্মী উত্তর লেখা।

(ক) দেবেন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম সাধনার কথা বর্ণনা করাে।

উত্তরঃ দেবেন্দ্রনাথের সহজাত কবিমন তার আধ্যাত্মিক অনুভূতিকে সর্বক্ষণই সক্রিয় ও রসসিক্ত করে রেখেছে। অধ্যাত্ম যােগযুক্ত ঋষি-দৃষ্টি দ্বারা তিনি কখনও দৃশ্যমান জগৎকে অগ্রাহ্য করে অতীন্দ্রিয় অরূপলােকে কাল্পনিক বিহারে নিমগ্ন হননি। দেবেন্দ্রনাথ মর্ত্যলােকেরই সৌন্দর্য সাগরে অবগাহন করে তার ধর্ম পিপাসা নিবৃত্ত করেছেন। বিশ্বসৌন্দর্য ও বিশ্বস্রষ্টা পরমেশ্বর তার নিকট পরস্পর কখনও পৃথক সত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়নি। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন তিনি (ঈশ্বর) শােভার আকর, সৌন্দর্য্যের সাগর। সকলেই তাহার সৌন্দর্য হইতে সৌন্দর্য ধারণ করিতেছে, তাহার প্রভাবে প্রভাকর প্রভা দিতেছে- সুধাকর সুধা বর্ষণ করিতেছে- বিদ্যুৎ মেঘের অন্ধকার মধ্যে আলােক দিতেছে। তিনি এই জগতের জীবন ও আলােক। তাঁহাকে যদি আমরা দেখিতে না পাইতাম, তবে সকলি প্রভাহীন মলিন হইয়া থাকিত, নক্ষত্র তারা খচিত অনন্ত আকাশও শােভাশূন্য হইত। তিনি বিনা এই জগৎ সংসার শূন্যগৃহ। শূন্য গৃহের শােভা কোথায়- সেই প্রকার আমাদের হৃদয়। তিনি বিনা এ হৃদয় শূন্য হৃদয়, হৃদয় যদি তাহার সত্তাতে পূর্ণ না থাকে, তবে সে শুষ্ক হৃদয় লইয়া কি হইবে ?

নিসর্গ সৌন্দর্য ও ভগবৎ প্রেম দেবেন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে অভিন্ন রূপ গ্রহণ করেছে। ঈশ্বরের সুমহান প্রেমই যে বিবিধভাবে অনন্ত সৌন্দর্যের আশিসধারা পৃথিবীতে বর্ষণ করছে, এটাই মুক্তকণ্ঠে দেবেন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন এবং তার বিবিধ রচনার মধ্য দিয়ে পরমেশ্বরের অনন্ত মহিমাই বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবােধই তার আধ্যাত্মিক চেতনার মূল উৎস। তার অধ্যাত্মমূলক রচনা সহজাত সৌন্দর্যরসে নিষিক্ত হয়ে সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

ভাবের মহত্ত্ব বা গুরুত্ব অনুযায়ী ভাষা প্রয়ােগের ক্ষেত্রেও দেবেন্দ্রনাথের অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। কঠিন ধর্ম বা তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও বর্ণনায় দেবেন্দ্রনাথের গদ্যভাষা কখনও দুর্বোধ্যতা দোষে দুষ্ট হয়নি। তার ভাষা যেমন সহজ, তেমনি চিত্তাকর্ষক হয়েছে। সুনিবিড় ধর্ম অনুভূতির স্নিগ্ধরসে দেবেন্দ্রনাথ তার ভাষাকেও অধিকতর সাবলীল ও সরস করে তুলেছেন। যদিও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির ভক্তি গাঢ় রসােহ্লাসের ফলে কোন কোন দুরূহ ধর্ম বা তত্ত্ব প্রসঙ্গের বিচার বিশ্লেষণ অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়েছে, তথাপি একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভাষা ও রচনারীতির স্বাভাবিক সারল্যে ও লেখকের ঐকান্তিক ধর্মপ্রাণতায় ‘ব্রাহ্ম ধর্মের ব্যাখ্যান” গ্রন্থের প্রতিটি ব্যাখ্যাই সার্থক শিল্প রূপ লাভ করেছে। এই গ্রন্থটিকে দেবেন্দ্রনাথের ধর্ম বা তত্ত্ব বিষয়ক অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থ হতে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করা যায়। দেবেন্দ্রনাথের “ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান” গ্রন্থ প্রসঙ্গে অজিতকুমার চক্রবর্তীর সুচিন্তিত মন্তব্য উদ্ধৃতিযােগ্য। তিনি এই মর্মে লিখেছেন- “শুধু ধর্মতত্ত্ব ও নীতিতত্ত্বের বিচার ও মীমাংসা নয়। একেবারে সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ; শুধু সম্যক দর্শন নয়, একেবারে সর্বেন্দ্ৰিয় হৃদয় মন ও আত্মা সমস্ত দিয়া দর্শন, শুধু একটি সমস্যার নিপুণ বিশ্লেষণ নয়, একেবারে অখণ্ড বােধের দ্বারা সকল সমস্যার, চূড়ান্ত সমাধানের স্পষ্ট নিদর্শন।”

দেবেন্দ্রনাথের আত্মচরিতমূলক প্রবন্ধের একটি বৈশিষ্ট্য যে এর মধ্য দিয়ে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পরিচয় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কোনাে রচনার মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তি পুরুষের স্বচছ প্রতিবিম্বন বা আত্মসত্তার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ সাহিত্যের একটি দুর্লভ গুণ হিসাবে কীর্তিত হয় এবং সাধারণত এটিই সাহিত্যের রূপরীতি।

দেবেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক ভাবােপলব্ধি বাস্তব জীবনবােধের সঙ্গে অবিমিশ্রভাবে জড়িত ছিল। জীবন ও জগত সম্পর্কে তার বিচিত্র কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার অন্ত ছিল না। তার ভাবগম্ভীর অনুভূতির সঙ্গে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির সার্থক সম্মিলনেই দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনী সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠেছে।

তাঁর প্রবন্ধে প্রতিপাদ্য বিষয়ের সুষ্ঠু মীমাংসার জন্য হৃদয়। অনুভূতিজাত নিছক ভাবাবেগের দ্বারাই পরিচালিত হননি- প্রসঙ্গ ও প্রয়ােজনবােধে যুক্তিতর্কের তীক্ষ চাতুর্যের আশ্রয় গ্রহণ করে বিরুদ্ধমত খণ্ডন করেছেন। তিনি তার “আত্মতত্ত্ববিদ্যা” নামক দার্শনিক প্রবন্ধগ্রন্থে শঙ্কর বেদান্ত দর্শন প্রতিপাদিত মতবাদ খণ্ডন করে একদিকে যেমন জড় ও জীবাত্মার দ্বৈত মত প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি জড় ও জীবাত্মার বহুত্ব স্বীকার করে এই উভয় হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পরমাত্মার পৃথক অস্তিত্ব ঘােষণা করেছেন।

(খ) অন্তরের বিষাদ ভাব দূর করার জন্য দেবেন্দ্রনাথ যে উপায় অবলম্বন করেছিলেন তা বর্ণনা করাে।

উত্তরঃ লেখক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদিমার মৃত্যুর পর একদিন বৈঠকখানায় বসে সকলকে জানালেন যে তার কাছে দেবার উপযুক্ত যে যা চাইবে তিনি তাই দেবেন। লেখকের জ্যেষ্ঠতাত পুত্র ব্রজবাবু দুটি বড় আয়না, ছবি ও জরির পােষাক চাইলেন। ব্রজবাবু ভাল ভাল ছবি, বহুমূল্য গৃহসজ্জা নিয়ে চলে গেলেন।

এভাবে সমস্ত আসবাব বিলিয়ে দেবার পরেও লেখকের মনের বিষাদ দূর হল কোনাে কিছুতেই শান্তি পেলেন না। সুযােগ পেলেই দিনের দুই প্রহরে একাকী বােটানিক্যাল উদ্যানে যেতেন। জায়গাটি খুব নির্জন। ঐ বাগানের মধ্যস্থলে যে সমাধিস্তম্ভ ছিল সেটিতে গিয়ে লেখক বসে থাকতেন। বিষাদগ্রস্ত মন চারিদিক অন্ধকার দেখত। বিষয়ের প্রলােভন দুর হলেও ঈশ্বরের ভাব লাভ করতে পারছিলেন না। পার্থিব ও স্বর্গীয় সকল প্রকার সুখেরই অভাব। জীবন নীরস পৃথিবী শ্মশানতুল্য। কিছুতেই সুখ নেই কিছুতেই শান্তি নেই। দুই প্রহরের সূর্যের কিরণকে কালাে মনে হত। সেই সময় লেখক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান রচনা করলেন- “হবে, কি হবে দিবা আলােকে, জ্ঞান বিনা সব অন্ধকার” এটিই লেখকের প্রথম গান, সমাধিস্তম্ভে বসে তিনি গাইতেন।

এরপর দেবেন্দ্রনাথ সংস্কৃত শেখবার জন্য আগ্রহ বােধ করলেন। বাল্যকাল থেকেই সংস্কৃত ভাষার অনুরাগী তিনি। চাণক্যের শ্লোক মুখস্ত করলেন। এছাড়া ভালাে শ্লোক শুনলে সেটিও শিখে নিতেন। তখন লেখকের বাড়িতে কমলাকান্ত চূড়ামণি নামে একজন সভাপণ্ডিত থাকতেন। তিনি সুপণ্ডিত ও তেজস্বী। লেখক বাল্যকাল থেকেই তাকে ভালবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। দেবেন্দ্রনাথ চূড়ামণির কাছে মুগ্ধবােধ ব্যাকরণ পড়তে আরম্ভ করলেন। সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করার জন্যই তার এই প্রচেষ্টা। একদিন চূড়ামণি লেখককে একটি কাগজ দেখালেন। কাগজটিতে লেখা আছে তাঁর পুত্র শ্যামাচরণকে চিরকাল প্রতিপালন করতে হবে। চূড়ামণির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকার জন্য লেখক সানন্দে কাগজটিতে সই করলেন। কিছুদিন পরে চূড়ামণি মারা গেলেন। শ্যামাচরণ লেখকের স্বাক্ষর সম্বলিত কাগজটি নিয়ে উপস্থিত হল, নিরাশ্রয় শ্যামাচরণকে দেবেন্দ্রনাথ আশ্রয় দিলেন।

সংস্কৃত ভাষায় শ্যামাচরণের অধিকার ছিল। ঈশ্বরের তত্ত্বকথা কোথায় পাওয়া যাবে লেখক তার কাছে জানতে চাইলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বরের বিষয়ে জানবার জন্য শ্যামাচরণের কথামতাে মহাভারত পড়তে আরম্ভ করলেন। মহাভারতের একটি শ্লোক তাকে খুব আকৃষ্ট করল—জীবাত্মা সকলের সমষ্টি যে পরমাত্মা নয়। এই প্রসঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের যুক্তিনির্ভর দার্শনিক আলােচনা উল্লেখযােগ্য—“যদি পরমাত্মাকে কেবল জীবাত্মা সকলের সমষ্টি করিয়া বলা যায়, তবে জীবাত্মা সকল ভিন্ন আর পরমাত্মা নাই এই বলা হয়। যেমন, পার্থিব পরমাণুপুঞ্জকে পৃথিবী বলা যায় তেমনি যদি জীবাত্মা পুঞ্জকেই পরমাত্মারূপে কেবল স্বীকার করা যায়, তবে পার্থিব পরমাণু ভিন্ন যেমন পৃথিবীর পৃথক সত্তা নাই তদ্রপ জীবাত্মা সকল ভিন্ন যে আর পরমাত্মার পৃথক সত্তা নাই, এই বলা হয়।

লেখকের ধর্মবিশ্বাস ও মতবাদ তার ধর্মজীবনের প্রথম পর্বে যেরূপ অস্ফুট ও অপবিণত ছিল, তা তিনি পরবর্তী জীবনে সুস্পষ্ট ও সুপরিণত করে তুলেছেন এবং ধর্ম বা তত্ত্বের কোনাে কোনাে অংশ পরিমার্জন ও সংশােধন করে তার নতুন আকৃতি দান করেছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রণীত আত্মজীবনীর মধ্যে তার অন্তর্লোকের অদৃশ্য আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার যেমন বহুল পরিচয় রয়েছে, তেমনি এতে বহির্জগতের সুদৃশ্য রূপচিত্রেরও অভাব নেই। জগতের যে সকল বস্তু তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তারই মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ অনন্ত পরম পুরুষের গৌরবময় মহিমা প্রত্যক্ষ করেছেন। দেবেন্দ্রনাথের দৃষ্টি যেমন সৌন্দর্যের মায়াঞ্জনে মণ্ডিত ছিল, তেমনি মনও ছিল গভীর কাব্য-রসধারায় সিক্ত। কাশী, আগ্রা, এলাহাবাদ, অমৃতসর, সিমলা প্রভৃতি দেশে ভ্রমণকালীন তথাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ ৮৮ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু তার আত্মজীবনীতে ১৮ বছর থেকে ৪১ বছর বয়স পর্যন্ত মাত্র ২৪ বছরের জীবনবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ এতে তার বিশিষ্ট ধর্মজীবনের বিবিধ ঘটনাক্রম ও উত্তর ভারত ভ্রমণের বিচিত্র উপলব্ধির কথা বিকৃত করেছেন। সাধারণ প্রথাসিদ্ধ আত্মজীবনী থেকে দেবেন্দ্রনাথের আত্মচরিত ব্যাখ্যানের মধ্যে একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তাঁর আত্মকথা যেন ধ্যাননিমগ্ন সাধকের নিভৃত মনের সুগভীর আলাপন। “ধর্মে মতির্ভবতু বাঃ সততােঙ্খিতানাং – তােমাদের ধর্মে মতি হােক। তােমরা সতত ধর্মে অনুরক্ত হও। সেই এক ধর্মই পরলােকগত ব্যক্তির বন্ধু, অর্থ ও স্ত্রীদেরকে নিপুণভাবে সেবা করলেও তাদেরকে আয়ত্ত করা যায় না এবং তাদের স্থিরতাও নেই।

বাংলা সাহিত্যে ধর্ম বা তত্ত্বমূলক প্রবন্ধ দেবেন্দ্রনাথের পূর্বে রামমােহন রায়, ব্রজমােহন মজুমদার, কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকগণ রচনা করেছেন। তাদের সকলের রচনায় ভাবানুভূতি অপেক্ষা যুক্তিবােধেরই অধিক প্রাধান্য ছিল। তাদের প্রবন্ধে যেরূপ সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ ও শাস্ত্রীয় যুক্তিতর্ক ছিল সেই অনুপাতে রস স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের এই জাতীয় প্রবন্ধে নীরস তত্ত্ব বা তথ্যই একমাত্র মুখ্য হয়ে পরিবেশিত হয়নি। তার মহজাত সৌন্দর্যবােধ ও শিল্পীসুলভ রসচেতনা অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার ফলে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মীয় প্রবন্ধগুলি নিছক তত্ত্বগন্ধী হয় নি। বরং স্থানে স্থানে সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠেছে। লেখক ধর্ম বা তত্ত্ব সম্পর্কিত কোনাে আলােচনা বা মীমাংসায় কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় মহাবাক্যের উপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন না, তার ভাবসমাহিত চিত্তের বিদ্যুৎ স্পর্শে ধর্ম বা তত্ত্বকথাও রসুনিষিক্ত সাহিত্যগুণ অর্জন করেছে। ধর্ম বা তত্ত্ব আলােচনায় দেবেন্দ্রনাথ শুধু অন্তরের সার্বিক প্রস্তুতিকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছেন। সংশয়যুক্ত শাস্ত্রজ্ঞান নিয়ে ধর্মালােচনায় অবতীর্ণ হওয়া নিরর্থক। তার মতে সংশয়মুক্ত জ্ঞান অর্জন করা তখনই সম্ভব যখন হৃদয় একান্তভাবে পূতস্নিগ্ধ হবে। পূতস্নিগ্ধ চিত্তে ধ্যাননেত্র দ্বারা পরমেশ্বর দর্শন করে যে অনুত ব্যক্তিহৃদয়ে জাগ্রত হবে এবং সেই লব্ধ অনুভূতির সঙ্গে শাস্ত্র-নির্গলিত যে সকল বাক্যসমূহের সহজ একাত্মতা অনুভূত হবে দেবেন্দ্রনাথের মতে তাই ধর্মানােনার একমাত্র প্রামাণ্য বাক্য বলে গৃহীত হতে পারে। “আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ জ্ঞানােজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হৃদয়ই প্রকৃত ব্রহ্মের অধিষ্ঠান ক্ষেত্ৰ-এই বক্তব্যই দেবেন্দ্রনাথের রচনায় প্রধান হয়ে উঠেছে। এই স্বতন্ত্র অনুভূতি বা সুমহান ব্যক্তিগুণের জন্যই ধর্ম বা তত্ত্বালােচনায় পূর্ববর্তী প্রবন্ধকারগণ থেকে দেবেন্দ্রনাথের রচনার মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

পরমেশ্বরের সঙ্গে জীবের সম্বন্ধ নির্ণয় করে দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন—“সমুদয় জগতে তাহার (পরমাত্মা) প্রতিরূপ ; কিন্তু আত্মাতেই তাহার রূপ দেখা যায়, সৃষ্টির সৌন্দর্য মানুষের মুখশ্রীতে, ধার্মিকের কল্যাণতর অনুষ্ঠানে, তাহার ভাবের প্রতিরূপ মাত্র দেখা যায়। আত্মাতেই তাহার সাক্ষাৎ রূপ বিরাজ করিতেছে, সেখানেই তিনি সত্যং জ্ঞানমনন্ত ; রূপে প্রকাশ পাইতেছেন। সেখানে তিনি শান্তং শিবমদ্বৈতং রূপে প্রকাশ পাইতেছেন। তাহার প্রতিরূপ সকল স্থানে। মাতার স্নেহ, ভ্রাতার সৌহাদ্য, পতিব্রতা সুতীর পবিত্র প্রেম এ সকলই তাহার প্রতিরূপ, আত্মাতেই তাহার রূপ প্রকাশ পাইতেছে। সেই “হিরণয়ে পরে কোষে” তিনি সাক্ষাৎ বিরাজ করিতেছেন। সেই সত্যস্বরূপ আনন্দস্বরূপ অমৃতস্বরূপ সেখানে প্রকাশিত হইতেছেন। জগৎ সংসার তাহার বিমল নিরাবয়ব সুন্দর মূর্তি অন্তরে যেমন প্রকাশ পাইতেছে, এমন আর কোনাে স্থানেই নয়।

(গ) ধৌম্য ঋষির উপাখ্যান তথা উপমন্যুর গুরুভক্তির কথা যা জান লেখাে।

উত্তরঃ গুরু আয়ােধধৌম্যের শিষ্য ছিল উপমন্যু। উপমন্যুকে গুরুদেব ডেকে বললেন- আজ থেকে তােমার ওপর আশ্রমের গাভীগুলি রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিলাম। জানাে তাে, এরা হলাে আমাদের সম্পদ। অতএব এদের খুব সাবধানে রক্ষা করাে। উপমন্যু গুরুর নির্দেশে সারাদিন গরুগুলিকে চরিয়ে তাদের খাইয়ে দাইয়ে রােজ সন্ধ্যায় গুরুদেবের কাছে হাজির হত।

কদিন পর গুরুদেব তার দিকে তাকিয়ে বললেন- বৎস উপমনু, তােমাকে তাে বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছে। সারাদিন এতাে পরিশ্রম করাে, তা তুমি এখন খাওয়া দাওয়া করাে ? উপম বলল- আমি এখন ভিক্ষা করে খাই গুরুদেব। গুরুদেব বললেন- আমাকে না জানিয়ে ভিক্ষা করা এবং তা থেকে পাওয়া সমস্ত খাদ্য তােমার একলা খাওয়া- এটা ঠিক হচ্ছে না। এবার থেকে উপমন্যু সারাদিন ভিক্ষা করে যা পেত, সন্ধ্যাবেলা ফিরে গুরুদেবকে সব দিয়ে দিত । গুরুদেবও তা থেকে কিছু তাকে দিতেন না।

কিছুদিন পর তার স্বাস্থ্য আরাে ভালাে হচ্ছে দেখে – গুরুদেব বললেন- বাছা উপমন্যু, তােমার ভিক্ষা করা খাবার আমি নিয়ে নিচ্ছি, তা সত্ত্বেও তােমার শরীর এতাে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে কী করে? তখন উপমনু বলল–একবার ভিক্ষা করে যাই পাই, তা আপনাকে দিই আর দ্বিতীয়বার ভিক্ষা করে যা পাই, তা আমি নিজে খাই।বগুরুদেব তা শুনে বললেন- দেখাে, এটা ঠিক কাজ হচ্ছে না। এতে অন্যান্য ভিখারিদের ক্ষতি হচ্ছে আর তুমিও ধীরে ধীরে লােভী হয়ে উঠছ। সুতরাং এরকম আর কোরাে না । ঠিক আছে গুরুদেব, আমি এমনটি আর করবাে না- বলে সে গুরুকে প্রণাম করে চলে গেল।

আবার কিছুদিন বাদে তাকে স্বাস্থ্য-ভালাে অবস্থায় দেখে গুরুদেব বললেন- বাছা উপমন্যু, তােমার ভিক্ষান্ন আমি নিয়ে নিই আর আমার আদেশে তুমি আর দ্বিতীয়বার ভিক্ষা করাে না, তাও রােগা না হয়ে মােটা হচ্ছ কী করে? গুরুকে অভিবাদন জানিয়ে সে বলল—গুরুদেব, আমি এখন গরুর দুধ খেয়ে প্রাণরক্ষা করি। গুরুদেব বললেন—আমি তাে তােমাকে এ বিষয়ে কোনাে অনুমতি দিইনি, তাই এটা করা তােমার উচিত হয়নি। গুরুদেবের কথা শুনে সে মাথা নিচু করে চলে গেল।

এমনি করে আবার কিছুদিন কেটে গেল। রােজ গরু দেখভাল করা, আর সন্ধ্যাবেলা গুরুদেবের কাছে হাজিরা দেওয়া। উপমন্যু তাও রােগা হচ্ছেনা দেখে গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন সেই একই প্রশ্ন- “আমি তােমার সব বন্ধ করে দিলাম, তাও তুমি কী এমন খাচ্ছ, যে তােমাকে শীর্ণ তাে দেখাচ্ছেই না বরং মােটা দেখাচ্ছে? উপমন্যু তা শুনে বলল- গুরুদেব বাছুরগুলাের দুধ খাওয়া হয়ে গেলে চারধারে যে ফেনা পড়ে যায়, আমি সেগুলাে খাই। ওটা ঠিক করছাে না বাছা, বাছুরেরা নিশ্চয়ই তােমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নিজেরা কম খেয়ে তােমার জন্য বেশি ফেনা ফেলে দিচ্ছে। ওদের এভাবে মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত করা তােমার ঠিক হচ্ছেনা-গুরুদেব বললেন। ঠিক আছে, আমি এবার থেকে দুধের ফেনাও খাব না গুরুদেব- এই কথা বলে গুরুকে অভিবাদন জানিয়ে সে চলে গেল।

আগের মতাে তার দিন কাটছে। এখন আর সে কিছুই খেতে পাচ্ছে না। খিদের জ্বালায় সে গাছের লতাপাতা যা পায় তাই খায়। কোনটা খাদ্য কোনটা অখাদ্য- এসবও আর সে বাছতে পারে না। এমনি করে একদিন না জেনে কোনাে এক তিতাে বিষপাতা খেয়ে সে অন্ধ হয়ে গেল। অন্ধ অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে সে পড়ে গেল পরিত্যক্ত এক শুকনাে কুয়াের মধ্যে।

সন্ধ্যাবেলা উপমন্যু আশ্রমে ফিরল না দেখে অন্যান্য শিষ্যদের ডেকে গুরুদেব বললেন- দেখাে, সন্ধ্যা হয়ে গেল। উপমন্যু তাে এখনাে ফিরল না। গভীর অরণ্যে গরু চরাতে গেছে। আমি তার সবরকম খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। হয়তো সে রেগে গিয়ে তাই আশ্রমে ফিরছে না। চলাে, আমরা তাকে পাই কী দেখি।

শিষ্যদের নিয়ে তিনি বনে প্রবেশ করে উপমন্যুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন- বাছা উপমন, তুমি কোথায় ? কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর উপমন্যুর যখন শুনতে পেল গুরুদেবের গলার আওয়াজ তখন সে চিল্কার করে বলল- গুরুদেব আমি কুয়ােতে পড়ে গেছি। কী করে কুয়ােয় পড়ে গেলে? গুরুদেবের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল- আমি বিষপাতা খেয়ে অন্ধ হয়ে গেছি গুরুদেব। গুরুদেব বললেন- তুমি দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদের স্তব করাে, তারাই তােমার চোখ ভালাে করে দেবেন।- বলে গুরুদেব তাকে রেখে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন।

উপমন্যু করুণভাবে অশ্বিনীকুমারদের ডাকতে লাগলেন। বেদে শেখা তাদের নানারকম স্তব স্তুতি করলে পরে অশ্বিনীকুমারেরা খুশি হয়ে তার সামনে এসে বললেন- বৎস উপমন্যু, আমরা তােমার স্তবে খুশি হয়েছি। তােমার অন্ধত্ব ঘুচবে, তুমি আবার চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে। আমরা একটি পিঠে দিচ্ছি- এইটি তুমি খাও। তাদের কথা শুনে উপমন্যু বলল- আমি আপনাদের কথা অবহেলা করতে পারি না কিন্তু আমি গুরুদেবকে নিবেদন না করে এই পিঠে খেতে পারব না। দেববৈদ্যরা তখন বললেন- দেখাে বাছা, তােমার গুরুদেবও একবার এই অবস্থায় পড়েছিলেন, তখন তাকেও আমরা এরকম একটি পিঠে খেতে দিয়েছিলাম। তিনি কিন্তু তার গুরুর আদেশ ছাড়াই গ্রহণ করেছিলেন। অতএব তােমার এ পিঠে খেতে কোনাে বাধা নেই। উপমন্যু বলল- আমি সৰ বুঝলাম কিন্তু গুরুদেবের আদেশ ছাড়া এ পিঠে আমি কিছুতেই খেতে পারব না।

অশ্বিনীকুমারেরা তার এই গুরুভক্তি দেখে খুব খুশি হলেন এবং তার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন। উপম গুরুর কাছে ফিরে এসে সব কথা সবিস্তারে জানাল। গুরু খুশি হয়ে আশীর্বাদ করলেন- আজ থেকে সকল বেদ ও সকল ধর্মশাস্ত্র তােমার স্মরণে থাকবে। এভাবে গুরুদেব শিষ্যকে পরীক্ষা করলেন। শিষ্য পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হল।

অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তর

১। বাক্য পরিবর্তন-

সরলজটিল
১। বিদ্যাহীন ব্যক্তির জীবন বৃথা।১। যে ব্যক্তি বিদ্যাহীন, তাহার জীবন বৃথা।
২। কালকে বৃষ্টির জন্যে স্কুলে যেতে পারিনি।২। যেহেতু কালকে বৃষ্টি হয়েছিল তাই স্কুলে যেতে পারিনি।
৩। বন্দুক থাকলে মােকাবিলা করা যেত।৩। যদি বন্দুক থাকত, তাহলে মােকাবিলা করা যেত।
৪। বেশি পরিশ্রম করলে শরীর ভেঙে পড়বে।৪। যদি বেশিপরিশ্রম কর তাহলে শরীর। ভেঙে পড়বে।
সরলজটিলযৌগিক
১। অসুস্থ থাকার জন্য নিমন্ত্রণে যেতে পারিনি।১। যেহেতু অসুস্থ ছিলাম তাই নিমন্ত্রণে যেতে পারিনি।১। অসুস্থ ছিলাম, সেজন্য নিমন্ত্রণে যেতে পারিনি।
২। সকালে বৃষ্টির জন্য স্কুলে আসতে পারিনি।২। যেহেতু সকালে বৃষ্টি হচ্ছিল তাই স্কুলে আসতে পারিনি।২। সকালে বৃষ্টি হচ্ছিল সেজন্য স্কুলে আসতে পারিনি।
৩। তুমি এর কিছু বিহিত না করলে সমস্ত আয়ােজন পণ্ড হয়ে যাবে।৩। তুমি যদি এর কিছু বিহিত না কর, তাহলে সমস্ত আয়ােজন পণ্ড হয়ে যাবে।৩। তুমি এর কিছু বিহিত করাে নাহলে সমস্ত আয়ােজন পণ্ড হয়ে যাবে।
জটিলসরল
১। যতদিন প্রাণ থাকবে ততদিন পরের দাসত্ব করব না।১। প্রাণ থাকতে পরের দাসত্ব করব না।
২। রাত্রিতে যখন আমাদের নিদ্রাভঙ্গ হল দরজার সামনে অচৈতন্য প্রায় প্রায় কুকুরকে দেখলাম।২। রাত্রিতে আমাদের নিদ্রাভঙ্গ হলে দরজার সামনে অচৈতন্য প্রায় কুকুরকে দেখলাম।
৩। এখনকার কালে সূর্যের আলাের দিনটা যেমন ফুরিয়েছে অমনি শুরু হয়েছে বিজলি আলাের দিন।৩। এখনকার কালে সূর্যের আলোর দিনটা ফুরােতেই শুরু হয়েছে বিজলি আলাের দিন।
৪। যাহাদের ধন আছে তাহারা প্রায়ই অহঙ্কারী হয়।৪। ধনবানেরা প্রায়ই অহঙ্কারী হয়।
৫। তৃষ্ণার জল যখন আশার অতীত হয়, মরীচিকা তখন সহজে ভােলায়।৫। তৃষ্ণার জল আশার অতীত হলে মরীচিকা সহজে ভােলায় ।
৬। যখন প্রভাত হইল, তখন পথিকেরা যাত্রা করিল।৬। প্রভাত হইলেই পথিকেরা যাত্রা করিল।
৭। যে ব্যক্তি বিদ্যাহীন তার জীবন কথা।৭। বিদ্যাহীন ব্যক্তির জীবন বৃথা।
৮। যে টাকা আমার পাওনা আছে, তা শীঘ্রই পরিশােধ করুন।৮। আমার প্রাপ্য টাকা শীঘ্রই পরিশােধ করুন।
৯। প্রজা যদি সুখী হয়, তবে রাজাও সুখী হন।৯। প্রজার সুখেই রাজা সুখী হন।
১০। যদি তুমি পরিশ্রম কর তবে সাফল্য অর্জন করবে।১০। পরিশ্রম করলেই সাফল্য অর্জন করবে।
সরলযৌগিক
১। দরিদ্র হলেও লােকটি সৎ।১। লােকটি দরিদ্র কিন্তু সৎ।
২। সত্য কথা না বললে শাস্তি পাবে।২। সত্য কথা বল, নতুবা শাস্তি পাবে।
৩। অসুস্থ হয়েও রামবাবু মনােবল হারান নি ।৩। রামবাবু অসুস্থ হয়েছেন, কিন্তু মনােবল হারান নি।
৪। ‘প্রভাত হইলে পথিকেরা যাত্রা করিল।৪।প্রভাত হইল, এবং পথিকেরা যাত্রা করিল।
৫। গান্ধিজি সত্যের পূজারি বলে জগতে বিখ্যাত।৫। গান্ধিজি সত্যের পূজারী তাই জগতে বিখ্যাত।
৬। সাবধান না হলে বিপদে পড়বে।৬।সাবধান হও, নচেৎ বিপদে পড়বে।
৭। জিনিস ফেলে রেখে আমরা এগিয়ে চললুম।৭। জিনিস রইল পড়ে, আমরা এগিয়ে চললুম।
৮। প্রাসাদে না গিয়ে রাজা মন্দিরে প্রবেশ করলেন।৮। রাজা প্রাসাদের দিকে গেলেন না, মন্দিরে প্রবেশ করলেন।
৯। অপু এক দৌড়ে ফটক পার রাস্তার উপর আসিয়া দাঁড়াইল।৯। অপু এক দৌড়ে ফটক পার হইল হইয়া এবং রাস্তার উপর আসিয়া দাঁড়াইল।
১০। নক্ষত্র রায়কে সঙ্গে লইয়া মহারাজ পদব্রজে অরণ্যেব দিকে চলিলেন।১০। নক্ষত্র রায়কে মহারাজ সঙ্গে লইলেন এবং পদব্রজে অরণ্যের দিকে চলিলেন।

যৌগিক বাক্য থেকে সরল বাক্য-

যৌগিকসরল
১। আমাদের এক চাকর ছিল, তার নাম শ্যাম।১। শ্যাম নামে আমাদের এক চাকর ছিল।
২। নেশায় শরীরের শক্তি যায় কিন্তু গুরুর কাছে শেখা বিদ্যে যায় না।২। নেশায় শরীরের শক্তি গেলেও গুরুরকাছে শেখা বিদ্যে যায় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top