Class 12 History Chapter 7 ভক্তি ও সুফী পরম্পরা Question Answer in Bengali Medium | AHSEC Class 12 History Question Answer, দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সপ্তম অধ্যায় to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapters Assam Board Class Class 12 History Chapter 7 ভক্তি ও সুফী পরম্পরা Notes and select needs one.
Class 12 History Chapter 7 ভক্তি ও সুফী পরম্পরা
Also, you can read the SCERT book online in these sections Class 12 History Chapter 7 ভক্তি ও সুফী পরম্পরা Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 12 History Chapter 7 ভক্তি ও সুফী পরম্পরা These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 12 History Chapter 7 ভক্তি ও সুফী পরম্পরা Solutions for All Subjects, You can practice these here.
ভক্তি ও সুফী পরম্পরা
দ্বিতীয় খণ্ড
Chapter: 7
HISTORY
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। ‘ভক্তি’ শব্দের উল্লেখ প্রথম কোথায় পাওয়া যায়?
উত্তরঃ উপনিষদে।
প্রশ্ন ২। ভক্তিবাদের মূল কথা কি?
উত্তরঃ ঈশ্বর এক।
প্রশ্ন ৩। ভক্তিবাদের উদ্ভব প্রথম কোথায় হয়?
উত্তরঃ দাক্ষিণাত্যের তামিল রাজ্যে।
প্রশ্ন ৪। আলোয়াররা কি পন্থী ছিলেন?
উত্তরঃ বৈষ্ণবপন্থী।
প্রশ্ন ৫। নায়নাররা কি পন্থী ছিলেন?
উত্তরঃ শৈবপন্থী।
প্রশ্ন ৬। তামিল সাহিত্যে আলোয়ারদের সংকলিত সাহিত্যসম্ভারকে কি বলে?
উত্তরঃ দিব্য প্রবন্ধম্।
প্রশ্ন ৭। ইসলাম ধর্মের উদারনৈতিক মতবাদকে কি বলে?
উত্তরঃ সুফিবাদ।
প্রশ্ন ৮। সুফি ধর্মের গুরুকে কি বলা হয়?
উত্তরঃ পীর।
প্রশ্ন ৯। খানকা কি?
উত্তরঃ পীরদের কর্মকেন্দ্র।
প্রশ্ন ১০। ভারতে ‘চিশতি’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
উত্তরঃ মইনুদ্দিন চিশতি।
প্রশ্ন ১১। ‘মহান’ ও ‘লঘু’ পরম্পরার প্রবক্তা কে?
উত্তরঃ সমাজতাত্ত্বিক রবার্ট রেডক্লিফ।
প্রশ্ন ১২। কবীর কখন জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তরঃ ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে।
প্রশ্ন ১৩। গুরু নানক কখন জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তরঃ ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে।
প্রশ্ন ১৪। আমীর খসরু কে ছিলেন?
উত্তরঃ মহান কবি, সংগীতজ্ঞ ও নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অনুগামী ছিলেন।
প্রশ্ন ১৫। আসামে ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা কে ছিলেন?
উত্তরঃ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। ভক্তি বলতে কি বোঝ?
উত্তরঃ ‘ভক্ত’ ধাতুর সঙ্গে ‘ক্তিন’ প্রত্যয় যোগ হয়ে সংস্কৃত ভাষায় ভক্তি শব্দের উদ্ভব হয়েছে। ‘ভজ’ মানে সেবা ও ‘ক্তিন’ মানে ভালোবাসা। আভিধানিক অর্থে ভক্তি বলতে ঈশ্বরের প্রতি পরম অনুরাগ ও শ্রদ্ধাকেই বোঝায়। পূজনীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকেও ভক্তি বলা হয়।
প্রশ্ন ২। সুফিবাদ কাকে বলে?
উত্তরঃ হিন্দু ধর্মের মতো ইসলাম ধর্মেও এক উদারনৈতিক মতবাদ গড়ে উঠেছিল। এটি ‘সুফিবাদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সুফিবাদের মতে প্রেম ও ঐকান্তিক ভক্তির মাধ্যমে ভগবানকে লাভ করা যায়। নিরন্তর প্রার্থনা, ব্রত, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি তাদের মতে নিরর্থক। সুফিবাদ সহনশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
প্রশ্ন ৩। ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা তিনজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভক্তিবাদ আন্দোলনের প্রবক্তা তিনজন ব্যক্তি হলেন—
(ক) শ্রীচৈতন্যদেব।
(খ) নানক। ও
(গ) শ্রীমন্ত শঙ্করদেব।
প্রশ্ন ৪। ভক্তি আন্দোলনের নেতাদের ধর্ম ছাড়াও সমাজ সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়ার উদ্দেশ্য কি ছিল?
উত্তরঃ ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় ভক্তিবাদ ধর্মীয় সংস্কার সাধন ছাড়াও কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে নব নব উপাদান সংযোজন করে তা সুদৃঢ় করেছিল। যদিও ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাকেই শুধু ভক্তি বলে অভিহিত করা হয়েছিল তবুও ঐশ্বরিক শক্তির উপাসনার মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ঘটিয়ে সকল প্রকার কল্যাণসাধনের কাজকেও ভক্তির অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা হত। উদ্দেশ্য ছিল সমাজের কুসংস্কার দূরীভূত করা।
প্রশ্ন ৫। আলোয়াররা কে? তাঁদের ধর্মের মূল মত কি ছিল?
উত্তরঃ ভক্তিবাদের প্রথম উদ্ভব হয় দাক্ষিণাত্যের তামিল রাজ্যে। খ্রিস্টিয় নবম শতক থেকে দাক্ষিণাত্যে আলোয়ার সম্প্রদায় ভক্তিবাদের ধারণার ভিত্তিতে সামাজিক জাগরণ আনার প্রয়াস করেছিল। আলোয়াররা বৈষ্ণবপন্থী ছিলেন।
আলোয়াররা পুরোপুরি বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। তাঁদের মতে বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ এবং সৃষ্টির মূল। অহংভাবগুলো ত্যাগ করে ভগবানের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারলে মোক্ষলাভ হয়। মানুষ নিজের ভিতরই ভগবানকে পেতে পারে। তাই জীবে প্রেমই ভগবৎ প্রেমের আধার।
প্রশ্ন ৬। দিব্য প্রবন্ধম্ কি?
উত্তরঃ আলোয়াররা ভারতীয় সংস্কৃতিতে বৈষ্ণব আন্দোলনের একটি নূতন ধারার সংযোজন ঘটান। তাঁরা ভক্তিবাদের ধারণাগুলো গীতবাদ্যের মাধ্যমে জনমানসে জাগ্রত করেন। পরবর্তীকালে আলোয়ারদের মৌখিক সাহিত্যের কির্তিরাজি সংকলিতরূপে প্রকাশ পায়। তামিল সাহিত্যে আলোয়ারদের সংকলিত সাহিত্যসম্ভারকে ‘দিব্য প্রবন্ধম’ বলা হয়।
প্রশ্ন ৭। সুলতানি যুগে হিন্দু-ইসলামী সংস্কৃতি কিভাবে উৎপত্তি লাভ করেছিল?
উত্তরঃ সুলতানি যুগে হিন্দু সংস্কৃতি ও মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল। এইভাবেই হিন্দু-ইসলামী সংস্কৃতির উৎপত্তি হয়েছিল।
প্রশ্ন ৮। গুরু নানকদেব কোথায় ও কখন জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তরঃ গুরু নানকদেব পাঞ্জাবের তালবন্দী নামক গ্রামে ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রশ্ন ৯। কবীরকে কারা পালন করেছিলেন? কবীরের অনুগামীদের কি বলা হয়?
উত্তরঃ কবীরকে নিরু নামে এক তাঁতি ও তাঁর স্ত্রী নিমা লালনপালন করেছিলেন। কবীরের অনুগামীদের কবীরপন্থী বলা হয়।
প্রশ্ন ১০। ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত দুটি সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত দুটি সম্প্রদায় হল—
(ক) বৈষ্ণব। এবং
(খ) শৈব।
প্রশ্ন ১১। সিলসিলা কি? সিলসিলা কয়প্রকার ও কি কি?
উত্তরঃ সুফিরা অনেকগুলি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। এই সম্প্রদায়গুলিকে সিলসিলা বলা হয়। সিলসিলা দুইভাগে বিভক্ত ছিল, যথা—
(ক) চিশতি সিলসিলা। ও
(খ) সুরাবর্দী সিলসিলা।
প্রশ্ন ১২। মীরাবাঈ কে ছিলেন? তিনি কিসের জন্য জনপ্রিয়?
উত্তরঃ মীরাবাঈ ভক্তি পরম্পরার একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন।
প্রশ্ন ১৩। আলোয়ার ও নায়নার কারা?
উত্তরঃ আলোয়ারগণ বিষ্ণুর উপাসক এবং নায়নারগণ শৈবের উপাসক ছিলেন। উভয় সম্প্রদায়ই তামিল ভাষায় মন্ত্রগীত জপে স্থান থেকে স্থানান্তরে পরিভ্রমণ করত।
প্রশ্ন ১৪। খাজা মইনুদ্দিনের দরগা জনপ্রিয় হওয়ার দুটি কারণ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ খাজা মইনুদ্দিনের দরগা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ দুটি নিম্নরূপ :
(ক) শেখদের মিতব্যয়িতা ও ধার্মিকতা।
(খ) খাজা মইনুদ্দিন ও তাঁর উত্তরসুরীদের মহত্বভাব।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। ভক্তিবাদ বলতে কি বোঝায়?
উত্তরঃ আভিধানিক অর্থে ভক্তি বলতে ঈশ্বরের প্রতি পরম অনুরাগ ও শ্রদ্ধাকেই বোঝায়। পূজনীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকেও ভক্তি বলা হয়। ঈশ্বরের প্রতি অগাধ প্রেম তথা ভক্তির উপর গুরুত্ব দিয়ে পণ্ডিতরা যে মতবাদ সৃষ্টি করেছিলেন তা-ই হল ভক্তিবাদ।
প্রশ্ন ২। ভারতবর্ষে ভক্তিবাদ আন্দোলন গড়ে ওঠার মূল কারণ কি ছিল?
উত্তরঃ মধ্যযুগে ভক্তি-বিষয়ক অনেক মতবাদ আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক জাগরণের সৃষ্টি করেছিল। কালক্রমে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসকদের মতপার্থক্য দেখা দেয়। পরবর্তীকালে সমাজে বসবাসকারী বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিভেদও বেড়ে ওঠে। ফলে সাধারণ শ্রেণীর মানুষ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ খুঁজতে শুরু করে। অন্যদিকে খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মাবলম্বী তুর্কীब- আফগানদের আবির্ভাব হওয়ায় ভারতীয় হিন্দুরা কিছু পরিমাণে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ইসলাম ধর্মে যাগ-যজ্ঞ এবং মূর্তিপূজার প্রথা নেই। এই ধর্মমতে ঈশ্বরের চোখে সবাই সমান। ফলত হিন্দুধর্মে অবহেলিত একাংশ মানুষ এই ধর্মের প্রতি আকর্ষিত হতে শুরু করে। এরূপ পটভূমিতে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কালক্রমে ভক্তিবাদ ভারতীয় ধর্ম ও সমাজে আবির্ভূত হয়।
প্রশ্ন ৩। ভক্তিবাদের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ভক্তিবাদের আদর্শ প্রচারিত হয়েছিল। ভক্তি আন্দোলনের মূলত নিম্নলিখিত দুটি উদ্দেশ্য ছিল:
(ক) হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ভক্তিবাদের প্রচারকরা মূর্তিপুজো এবং জাতিভেদ প্রথার কঠোর সমালোচনা করেন। ভক্তি আন্দোলন এক্ষেত্রে কিছুটা সফলতা অর্জন করেছিল। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি হিন্দু সমাজের একটি বড় অংশ খুব সহজেই মুছে ফেলতে পারেনি। তথাপি ভক্তি আন্দোলন হিন্দুধর্মের অহেতুক গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথার মতো কু-প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে। এই আন্দোলন হিন্দু ধর্মকে একটি শক্তিশালী শক্তিতে পরিণত করার প্রচেষ্টা করে।
(খ) ভক্তি আন্দোলনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সুসম্পর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু এ ব্যাপারে ভক্তি আন্দোলন সাফল্যলাভ করেনি। কারণ ভক্তি আন্দোলন চলাকালীন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হলেও পরবর্তী পর্যায়ে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। তুর্ক-আফগান শাসক এবং সাধারণ মুসলিমরা ভক্তিবাদের রাম-সীতার তত্ত্ব মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। তারা একথাও স্বীকার করেনি যে রাম ও রহিম, ঈশ্বর ও আল্লা একই ঈশ্বরের দুই নাম।
প্রশ্ন ৪। ভক্তিবাদ ভারতীয় সমাজে সাংস্কৃতিক উপাদান সংযোজন করেছে। ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ভক্তিবাদ ধর্মীয় সংস্কার সাধন ছাড়াও নতুন নতুন উপাদান সংযোজন করে আমাদের কলা-সংস্কৃতির ভিত সুদৃঢ় করেছে। ভক্তিবাদের আধ্যাত্মিক দিক ছাড়াও একটি সামাজিক দিক আছে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে, ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় ভারতে সামাজিক পুনর্জাগরণের আশা-আকাঙ্খার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। অন্য একাংশ পণ্ডিতের মতে, ভক্তিবাদ হল ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের এক মাধ্যম। এক কথায় বলা যায়, ভক্তিবাদ হল ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও পরম্পরা বিশ্লেষণের একটি প্রক্রিয়া।
প্রশ্ন ৫। ভক্তিবাদের অবদান উল্লেখ কর।
উত্তরঃ উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের জনজীবনে ভক্তি আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। সেই অবদানগুলি নিম্নরূপ:
(ক) ঈশ্বরপ্রেমে সকল মানুষের সমান অধিকারের তত্ত্ব প্রচারিত হওয়ার ফলে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার কালো হাত অনেকখানি সংকুচিত হয়। হ্রাস পায় সামাজিক বিভেদ ও বৈষম্য।
(খ) রাম ও রহিম বা আল্লাহ ও ঈশ্বর এক—ভক্তিবাদের এই প্রচার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে অনেকটা কাছাকাছি আনতে সাহায্য করে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের পথ প্রশস্ত হয়।
(গ) এর ফলে হিন্দুসমাজ বলীয়ান হয়। কারণ হিন্দুধর্মের অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদজনিত ঘৃণার ফলে নিম্নবর্ণের বহু মানুষ ইসলামধর্ম গ্রহণে আগ্রহী হয়েছিল। অতঃপর তারা ভক্তিবাদের মধ্যেই নিজেদের স্থান খুঁজে পায়।
(ঘ) ভক্তি আন্দোলনের ফলে আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হয়। ভক্তিবাদী সাধকেরা সংস্কৃতর পরিবর্তে আঞ্চলিক ভাষায় নিজ নিজ মতাদর্শ প্রচার করেন। ফলে তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য হয়। বাংলায় চৈতন্য পদাবলী বাংলা ভাষাকে সহজতর করে। কবীরের ‘দোঁহা’ হিন্দি ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। নামদেব মারাঠী ভাষা ও নানক গুরুমুখী ভাষাকে পরিপুষ্ট করেন।
প্রশ্ন ৬। কবীরের মূল শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা,
কবীর সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।
উত্তরঃ কবীর প্রচার করেন যে, মানুষ নানা নামে ডাকলেও আল্লাহ্ বা ঈশ্বর এক। তাঁর অবস্থান মানুষের অন্তরে। নিছক আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তাঁকে পাওয়ার জন্য চাই আন্তরিক ভক্তি ও প্রেম। কবীর বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর সাধনার জন্য মূর্তিপূজা বা নামাজের প্রয়োজন নেই। সন্ন্যাস-জীবনেরও দরকার নেই। গৃহে অবস্থান করেই তাঁকে পাওয়া সম্ভব। নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলেই ঈশ্বরের আসন পাতা আছে। কবীরের ভক্তি, নিষ্ঠা ও সদাচার বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কবীর শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু ছোট ছোট কবিতা রচনা করে নিজের বক্তব্য সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। এগুলি ‘কবীরের দোহা’ নামে খ্যাত।
প্রশ্ন ৭। গুরু নানকদেবের মূল শিক্ষাসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা,
গুরু নানক সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।
উত্তরঃ ভক্তিবাদের আর এক প্রধান প্রবক্তা ছিলেন গুরু নানক। তিনি ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোরের সন্নিকটে তালওয়ান্দী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। নানকের ধর্মের প্রধান তিনটি সূত্র–এক ঈশ্বর, গুরু এবং নামজপ। তাঁর মতে, ঈশ্বর অমর, সত্যদ্রষ্টা, নির্ভীক, শত্রুহীন, অজ ও স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি এই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির নির্দেশ দেন। তাঁর মতে, গুরু হলেন সমুদ্র এবং শিষ্য হল নদী। শিষ্যকে গুরুতে বিলীন হয়ে মহত্ত্ব লাভ করতে হবে। নানক ভোগবিলাস ও সন্ন্যাস-এর মধ্যপন্থা অনুসরণে নির্দেশ দেন। তিনিও কবীরের মতো জাতিভেদ বা অস্পৃশ্যতার বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সহনশীলতার বাণী প্রচার করে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করেন। বর্তমানে তাঁর শিষ্যগণ ‘শিখ’ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন ৮। ভক্তি আন্দোলনে শ্রীচৈতন্যদেবের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ বাংলাদেশে ভক্তিবাদের আদর্শে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন চৈতন্যদেব। তিনি নদীয়া জেলায় এক শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল নিমাই। চব্বিশ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র ও দর্শনে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথাকে দৃঢ় ভাষায় অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষই আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হতে পারে। চৈতন্য-প্রচারিত ধর্মের তিনটি মূলকথা ছিল—জীবে দয়া, ঈশ্বরে ঐকান্তিক ভক্তি এবং সেই ভক্তিবাদ জাগরণের জন্য নাম-সংকীর্তন। তাঁর হাজার শিষ্য বাংলা, ওড়িশা ও দাক্ষিণাত্যে ভক্তিধর্মের প্লাবন বইয়ে দেন। তিনি নিজে কোন ধর্মসম্প্রদায় গঠন করেননি। তবে পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীরা ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’ নামে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করেছেন। আচার্য সুকুমার সেন শ্রীচৈতন্য-প্রচারিত ভক্তিবাদকে ‘নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন—“তার (চৈতন্যদেব) প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে বাঙালির প্রতিভা কি ধর্মে, কি দার্শনিক চিন্তায়, কি সাহিত্যে, কি সংগীতকলায় সর্বত্র বিচিত্রভাবে স্ফূর্ত থেকে থাকে। এটাই বাঙালিজাতির প্রথম জাগরণ।”
প্রশ্ন ৯। আদি ভক্তি পরম্পরার বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ আদি ভক্তি পরম্পরার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:
(ক) বিশাল সংখ্যক ভক্তসহ কবি-সাধুদের আবির্ভাব ঘটে। তারা ভক্তি আন্দোলনের পরম্পরার সূচনা করে।
(খ) ভক্তি আন্দোলনের সাধু-সন্তগণ মহিলা ও নিম্নশ্রেণীর লোকদের উপযুক্ত মর্যাদা দানের মাধ্যমে গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য পরম্পরা ভঙ্গ করেন।
(গ) ভক্তি পরম্পরায় বৈচিত্র্যতা পরিলক্ষিত হয়।
(ঘ) ভক্তি পরম্পরা দুইভাগে বিভক্ত, যথা—সগুণ ও নির্গুণ।
সগুণ হল একটি বিশেষ দেবতা, যেমন—বিষ্ণু, শিব ও তাঁদের বিগ্রহ পূজা করা। তা বিগ্রহ বা মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী। অন্যদিকে নির্গুণ ভক্তি ভগবানের নিরাকার রূপ পূজা করে। তা ভগবানের গুণকীর্তন করে।
প্রশ্ন ১০। সুফিবাদ কি? সুফিবাদের মূল আদর্শসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ইসলাম ধর্মের সূচনাকাল থেকেই ইসলামে এক শ্রেণীর অতীন্দ্রিয়বাদী ও রহস্যবাদী মানুষ ছিলেন। পরবর্তীকালে এঁরা ‘তাসায়ুফ’ বা ‘সুফি’ নামে পরিচিত হন। অবশ্য ‘সুফি’ নামটাই বেশি প্রচারিত হয়েছে। ইউসুফ হুসেন-এর মতে—“ইসলামের বক্ষদেশ থেকেই সুফিবাদের জন্ম।” পবিত্র কোরানে ত্যাগ, তিতিক্ষা, বৈরাগ্য ও আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হজরত স্বয়ং ছিলেন অতীন্দ্রিয়বাদী এবং মরমী (mystic)। হজরত সংযমী হওয়াকে ঈশ্বরলাভের অন্যতম শর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভোগবিলাস-এর প্রাচুর্য দেখা যায়। নানাপ্রকার গোঁড়ামি ধর্মকে গ্রাস করতে থাকে। এতে শঙ্কিত হয়ে কিছু সংস্কারক ইসলামের নিগুঢ় তত্ত্ব প্রচারে আগ্রহী হন এবং সুফিবাদের প্রচার শুরু করেন।
মূল আদর্শ: সুফিবাদের মতে, ত্যাগ ও ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। সুফিরা পৌত্তলিকতার বিরোধী এবং একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। এঁদের মতে—“ঈশ্বর হলেন এক এবং সবকিছুই ঈশ্বরের অংশ।” এঁরা প্রচার করেন ‘আসক্তি’ থেকেই আসে ভোগপ্রবণতা; এবং ভোগপ্রবণতা জন্ম দেয় পাপ, যার জন্য ব্যক্তি ক্লেশ ভোগ করে। এজন্য সুফি-সন্তরা সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করতেন। তবে তাঁরা নির্জন পাহাড়ে না থেকে লোকালয়ে থেকেই নিজেদের বাণী প্রচার করতেন। একটি মত অনুসারে সুফি সাধনার দশটি স্তর ছিল, যথা—তওবা (অনুশোচনা), ওয়ারা (নিবৃত্তি), জুহদ (ধার্মিকতা), ফকর (দারিদ্র্য), সবর (সহ্য করা), শূকর (কৃতজ্ঞতা), খুফ (অন্যায়কে ভয়), রজা (ঈশ্বরের করুণালাভের ইচ্ছা), তওয়াস্কুল (আনন্দে-বিষাদে অচঞ্চল থাকা) এবং রিজা (ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ)। এই স্তরগুলি অতিক্রম করলে ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায়।
প্রশ্ন ১১। সুফি সংগঠন কিরূপ ছিল? ভারতে সুফি সম্প্রদায়ের বিস্তার সংক্ষেপে ব্যক্ত কর।
উত্তরঃ হিন্দু ধর্মের ন্যায় সুফি ধর্মে গুরু-শিষ্যর সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুকে কেন্দ্র করে সুফি সন্ন্যাস-জীবন আবর্তিত হয়। গুরুকে বলা হয় ‘পীর’ বা ‘খাজা’। পীরদের কর্মকেন্দ্রকে বলা হয় ‘‘দরগা’ বা ‘খানকা’। সুফি ধর্মের অনুগামীদের বলা হয় ‘ফকির’ বা ‘দরবেশ’। দ্বাদশ শতকের মধ্যে সুফিরা প্রায় বারোটি সম্প্রদায় বা সিলসিলায় বিভক্ত হয়ে পড়েনি। তার মধ্যে ‘চিতি’ ও ‘সুহরাবাদী’ সম্প্রদায় সুলতানি যুগে বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছিল।
বিস্তার: ভারতে ‘চিতি’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মঈনুদ্দিন চিশতি। তাঁর প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল আজমির। ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বখতিয়ার কাকি। কাকির শিষ্য ফরিদউদ্দিন শকর প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এই সম্প্রদায়ের নিজামউদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮–১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন কিংবদন্তী পুরুষ। তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ও উদার মতামতে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বিখ্যাত কবি আমির খসরু ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এমনকী স্বয়ং সুলতান আলাউদ্দিন খলজি নিজামুদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ভারতে ধর্মসমন্বয়ের ইতিহাসে এঁদের অবদান আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। সুহরাবাদী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ শিবাহউদ্দিন সুহরাবাদী। চিত্তি সম্প্রদায়ের সাথে এঁদের নীতিগত ও কার্যপদ্ধতিগত কিছু প্রভেদ ছিল। যেমন, এঁরা রাজ্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বা সরকারি পদ গ্রহণ করতেন। চিতিদের মতো দরিদ্রের জীবনযাপনের এঁরা পক্ষপাতী ছিলেন না। এই গোষ্ঠীর আর এক জনপ্রিয় সাধক ছিলেন হামিদউদ্দিন নাগরী। ‘আল-কাদেরী’ ও ‘ফিরদৌসী’ নামক আরও দুটি সুফি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ভারতে ছিল।
প্রশ্ন ১২। সুবাবদী সিলসিলা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ বাগদাদে সুরাবর্দী সিলসিলার জন্ম দিয়েছিলেন শেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দী। তিনি ভারতবর্ষে তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে প্রেরণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সুফি সম্প্রদায় সুরাবর্দী সিলসিলা নামে খ্যাত। সুরাবর্দী সম্প্রদায়ভুক্ত সুফি সাধকদের মধ্যে ছিলেন শেখ হামিদউদ্দিন নাগৌরী, শেখ বাহউদ্দিন জাকারিয়া প্রমুখ। শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া মুলতান অঞ্চলে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে সুফিবাদের আদর্শ প্রচারে ব্রতী হন। জাকারিয়া চিশতি সম্প্রদায়ের কৃচ্ছ্রসাধনের পথ অবলম্বন না করে বৈভবের মধ্যে দিন যাপন করতেন। তিনি রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করতেন। সম্ভবত মধ্যযুগের ভারতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ধনী মুসলিম সাধক। জাকারিয়ার মৃত্যুর পর সুরাবর্দী সিলসিলা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়—মুলতান এবং উচ্চ শাখা। তাঁর পুত্র বদরুউদ্দিন আরিফ মুলতান শাখার প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হন। অন্যদিকে জাকারিয়ার শিষ্য সৈয়দ জালালউদ্দিন বুখারী উচ্চের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বুখারী বহু হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তকরণ করেন।
প্রশ্ন ১৩। চিশতি ও সুরাবর্দী সিলসিলার মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
উত্তরঃ প্রতিষ্ঠান ও নীতিগতভাবে চিশতি ও সুরাবর্দী সিলসিলার মধ্যে পার্থক্য ছিল। যেমন সুরাবর্দী সিলসিলাভুক্ত অনুগামীরা অবাধে সুলতান এবং ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। তারা আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু চিশতিরা যে অর্থ সংগ্রহ করতেন তা গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। প্রতিষ্ঠানগত দিক থেকে পার্থক্যের মধ্যে বলা যায় চিশতি সিলসিলার খানকার সকলের জন্যই উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু সুরাবর্দীদের খানকায় একমাত্র উচ্চ এবং ধনী শ্রেণীই প্রবেশ করতে পারতেন। তাদের সঙ্গে সমাজের অবহেলিত নিপীড়িত গরিব মানুষের কোন সম্পর্ক ছিল না।
প্রশ্ন ১৪। সুফিবাদের প্রভাব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভারতীয় সমাজ ও জনজীবনে সুফিবাদের গভীর প্রভাব নিম্নরূপ:
(ক) সুফিদের সহজ সরল জীবনযাত্রা, নীতিবোধ ও সাম্যচেতনা নানাস্তরের মানুষকে একত্রিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। জাতিধর্মনির্বিশেষে মানুষের সমাবেশ সামাজিক উত্তেজনার অবসান ঘটায়।
(খ) সুফিবাদের সহনশীল ধর্মনীতি বহু হিন্দুকে ইসলামধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে। ইসলাম ধর্মের সহিষ্ণুতার সুফিতত্ত্ব সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভেদ দূর করে সহাবস্থানের পটভূমি তৈরি করে দেয়।
(গ) সুফি সাধকরা ইসলামের ভারতীয়করণ করেন। সুফিবাদের সংস্পর্শে এসে বহু মুসলিম শাসক ও অভিজাত ধর্মক্ষেত্রে সহনশীলতার নীতি নেন। ফলে রাষ্ট্রীয় ঐক্য সুদৃঢ় হয়। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার যে প্রকাশ দেখা যায়, তার সূচনা সুলতানি আমলে সুফিবাদের দ্বারাই ঘটেছিল।
(ঘ) অধ্যাপক সিদ্দিকির মতে, সামাজিক সচলতার (mobility) উপাদান ছিল সুফি দর্শন। সুফিবাদের সাম্যভাবনা সামাজিক নিম্নস্তরের বহু মানুষকে উচ্চক্রমে উত্তরণে সাহায্য করেছিল।
(ঙ) শিক্ষা ও সাহিত্যের বিকাশে সুফিবাদের বিশেষ অবদান ছিল। সুফিদের খানকাগুলি বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান অর্জনের বিশেষ কেন্দ্র ছিল। এখানে সমবেত হয়ে দীন-দরিদ্র সহ বহু মানুষ শিক্ষা নিতে পারত।
(চ) সুফি সাধকরা হিন্দি ভাষায় গান রচনা করে এবং বাণী প্রচার করে হিন্দি ভাষার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেন।
প্রশ্ন ১৫। সুফি ও ভক্তি পরম্পরার মধ্যে সাদৃশ্য উল্লেখ কর।
উত্তরঃ সুফি ও ভক্তি পরম্পরার উৎপত্তিস্থান পৃথক, কিন্তু উভয় পরম্পরার আদর্শের মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রধান প্রধান সাদৃশ্যগুলি নিম্নরূপ:
(ক) মানবতাবাদ: উভয় পরম্পরা বা আন্দোলন মানুষকেই মূল বিষয় হিসাবে গণ্য করে। তারা সকল মানুষকে শান্তি-সম্প্রীতির মধ্যে বাস করার পরামর্শ দেয়।
(খ) মানুষের প্রতি ভালবাসা: উভয় আন্দোলন বা পরম্পরা মানুষের প্রতি ভালোবাসায় বিশ্বাসী। সুফি ভক্তি আন্দোলনের সাধু ও সত্তগণ মানুষকে ভালোবাসতে উপদেশ দান করেছিলেন। মানুষকে ভালোবাসা হল ঈশ্বরকে ভালোবাসা।
(গ) গুরুর প্রশংসা: সুফি ও ভক্তি উভয় পরম্পরার সাধুসন্তগণ ধ্যানে তাঁদের গুরুর প্রশংসা করেন। একটি পার্থক্য হল যে সুফিরা তাদের গুরুকে ‘পীর’ বলে অভিহিত করেন।
(ঘ) সহনশীল: সুফি সাধু-সত্তগণ সকল হিন্দু ও মুসলমানগণকে সহনশীল হতে উপদেশ দিতেন।
(ঙ) ঈশ্বরে বিশ্বাস: উভয় পরস্পরা বা আন্দোলন ভগবানে বিশ্বাসী। সুফিগণ ব্যক্ত করেন যে ভগবান একজনই এবং অবশিষ্ট সকলেই তাঁর সন্তান।
প্রশ্ন ১৬। ‘মহান’ ও ‘লঘু’ পরম্পরা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ সমাজতাত্ত্বিক রবার্ট রেডক্লিফ ১২শ শতাব্দীর একটি কৃষক সমাজের সাংস্কৃতিক আচরণের বর্ণনা দিতে ‘মহান’ ও ‘লঘু’ পরম্পরা এই ধারণা দুইটি সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে কৃষকগণ সমাজে প্রভূত্বশালী শ্রেণি, যেমন—পুরোহিত ও শাসকগণের পালন করা কর্মকাণ্ড ও পদ্ধতিকে অনুসরণ করেছিল। এই কর্মকাণ্ডকে রেডক্লিফ মহান পরস্পরা আখ্যা দিয়েছেন। একই সময়ে কৃষকগণ প্রভুত্বশালী শ্রেণীর পালন না করা আরও কিছু সংখ্যক স্থানীয় আচরণবিধি পালন করে। একে তিনি ‘লঘু’ পরম্পরা বলে অভিহিত করেছেন। রেডক্লিফ এটাও মনে করেছিলেন যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধিত হওয়া পারস্পরিক আদান-প্রদানের জন্য ‘মহান’ ও ‘লঘু’ দুইটি পরম্পরার পরিবর্তন হয়।
প্রশ্ন ১৭। মীরাবাঈ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।
উত্তরঃ মীরাবাঈ সম্ভবত ভক্তি পরম্পরার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত মহিলা কবি। তাঁর জীবন, তাঁর রচনা করা ভজনসমূহের আধারে প্রণয়ন করা হয়েছে। মীরাবাঈ মারোয়ার মিরাট জেলার এক রাজপুত রাজকুমারী ছিলেন। তাঁকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজস্থানের মোয়াড়র জিসোদিয়ে বংশের একজন রাজকুমারের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। তিনি স্বামীকে পরিত্যাগ করে পত্নী ও মাতার পরম্পরাগত দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণকে একমাত্র প্রেমিক হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তিনি বহুসংখ্যক অন্তর্যামী ভাবপ্রবণ গীত রচনা করেছিলেন। কিছুসংখ্যক পরম্পরা মতে মীরাবাঈ-এর গুরু ছিলেন বাইদাস নামে একজন চর্মকার। তাঁর রচিত ভজনসমূহ আজও পরিবেশিত হয়।
প্রশ্ন ১৮। খানকাহ কি? চিশতি খানকাহে কিভাবে জীবনযাপন করা হয় সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তরঃ সাংগঠনিকভাবে সুফিগণ খানকাহর চারদিকে গোষ্ঠী সংগঠিত করতে থাকে। খানকাহ গণ শেখ, পীর বা মুর্শিদ নামক শিক্ষক দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হত।
চিশতি খানকাহ সমাজজীবনের কেন্দ্রস্থলে ছিল। ইহা মুক্ত রন্ধনশালা বা লঙ্গরখানা সংস্থাপিত করে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শেখের নিকট আসত। শেখের ধর্মালোচনায় বহুলোকের সমাগম হত। শেখের মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি অনুগামীদের পবিত্রস্থানে পরিণত হয়।
দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। ভক্তি পরম্পরার বিকাশ সম্পর্কে একটি টীকা লেখ।
উত্তরঃ ভারতবর্ষে মধ্যযুগের সূচনা হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই হিন্দুধর্মের অবক্ষয় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, পুরোহিত শ্রেণীর অযৌক্তিক অনুশাসন ইত্যাদির ফলে হিন্দুসমাজ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। কেবল তাই নয়, প্রাচীন ভারতীয়দের আধ্যাত্মিক জীবনযাত্রার মান অনেকাংশেই মলিন হয়ে আসছিল। ভারতে তুর্কি আক্রমণের প্রাক্কালে হিন্দু সমাজে জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা অত্যন্ত কঠিন ও অমানবিক পর্যায়ে অবস্থান করেছিল। এই সমাজব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করত ব্রাহ্মণ শ্রেণী। সমাজের নিম্নস্তরে অধিষ্ঠিত শূদ্রদের অস্পৃশ্য বলে মনে করা হত। শূদ্রদের মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বর সাধনা করার কোন অধিকার ছিল না। ভারতে ইসলামের আবির্ভাবের সূচনাপর্বে জাতিভেদ প্রথা আরও জটিল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে সমাজের নিম্নশ্রেণীর নিপীড়িত অবহেলিত মানুষরা জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথার মতো কুব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর হয়।
হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে হিন্দু মনীষী ও দার্শনিকরা প্রচার করেন যে ঈশ্বর সাধনার জন্য কোনপ্রকার বিধিনিষেধ মানার প্রয়োজন নেই। তাঁরা প্রচার করেন যে, সমাজে সব শ্রেণীর মানুষের ঈশ্বর সাধনার অধিকার রয়েছে। ঈশ্বরের কাছে ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ বলে কোন প্রভেদ নেই। সকলেই তাঁর কাছে সমান। তাঁরা প্রচার করেন যে ঈশ্বরের সান্নিধ্য ও আশীর্বাদ লাভ করতে হলে প্রয়োজন ভক্তি (devotion)। ভক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। ভক্তিবাদ ছিল সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর। তাঁরা বলেন ভক্তিই একমাত্র মোক্ষলাভের অর্থাৎ মুক্তির পথ দেখাবে। হিন্দু মনীষীদের ভক্তিবাদের প্রচার যেমন একদিকে গোঁড়া হিন্দু সমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, তেমনি অন্যদিকে সমাজের নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের মন খুব সহজেই জয় করতে পেরেছিল। হিন্দু সমাজের মধ্যে ভক্তিবাদ যেভাবে আলোড়িত করে তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। একেই সংক্ষেপে ভক্তি আন্দোলন বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ঐতিহাসিকদ্বয় ওয়েবার (Weber) এবং গ্রিয়ারসন (Grierson) মনে করেন যে মোক্ষলাভ (salvation) অর্থাৎ মুক্তি পাওয়ার পথ ভক্তি অর্থাৎ (devotion)-এর ধারণা এসেছিল খ্রিস্ট ধর্ম থেকে। অনেকের ধারণা ইসলাম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হিন্দু ধর্মকে প্রভাবিত করেছিল। তারই ফলস্বরূপ ভক্তিবাদের সূচনা হয়। একথাও বলা হয়েছে যে ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা রামানন্দ ইসলামের বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বস্তুত আন্দোলন হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী তিন রকম উপায়ে মুক্তি বা মোক্ষলাভ করা যায়। এগুলি হল—
(ক) জ্ঞান (Knowledge)
(খ) কর্ম (Duty)। এবং
(গ) ভক্তি (Devotion)।
বিভিন্ন হিন্দু ধর্মপ্রচারক বিভিন্ন সময়ে এই তিন আদর্শের কথা তুলে ধরেছেন। ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগে হিন্দু ধর্মপ্রচারকরা মোক্ষলাভের উপায় ভক্তির আদর্শের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে কয়েকটি মিল লক্ষ্য করা যায়। এই প্রচারক কোন বিশেষ সামাজিক বা ধর্মীয় শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না এবং কেউই কোন নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চান নি। ভক্তিবাদের ধর্মপ্রচারকদের কোন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় আদর্শের উপর অন্ধবিশ্বাস ছিল না। তাঁরা বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এক। কেবলমাত্র তিনি বিভিন্ন নামে, যেমন-কৃষ্ণ, রাম, শিব বা আল্লা নামে পরিচিত। ভক্তিবাদের প্রচারকরা জাতপাতের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন। তাঁরা মুর্তিপুজোর বিরোধী ছিলেন।
প্রশ্ন ২। ভক্তি পরস্পরার কয়েকজন বিখ্যাত সাধকের বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ধর্ম সংস্কার আন্দোলন হিসাবে ভক্তি আন্দোলন সর্বপ্রথম শুরু হয় দক্ষিণ ভারতে। প্রকৃতপক্ষে অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ভারত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের পীঠস্থানে পরিণত হয়। বৈষ্ণব এবং শৈব সাধকরা ভক্তির আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা পরবর্তীকালে শঙ্কর, রামানুজ, বাসব, বল্লভাচার্য, মাধব প্রমুখ মনীষীরা আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন। রামানুজ ও রামানন্দ ভক্তির আদর্শকে উত্তর ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
(ক) রামানুজ: ভক্তিবাদের আদি প্রচারক ছিলেন সাধক রামানুজ। তিনি বলতেন, কর্মের দ্বারা আসক্তি সৃষ্টি হয়। একমাত্র ভক্তিযোগই মুক্তির পথ দেখায়। রামানুজের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে চতুর্দশ শতকে রামানন্দ উত্তর ভারতে ভক্তি আন্দোলন শুরু করেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রামানন্দের বারোজন প্রধান শিষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাধক কবীর।
(খ) কবীর: কবীর প্রচার করেন যে, মানুষ নানা নামে ডাকলেও আল্লাহ্ বা ঈশ্বর এক। তাঁর অবস্থান মানুষের অন্তরে। নিছক আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তাঁকে পাওয়ার জন্য চাই আন্তরিক ভক্তি ও প্রেম। কবীর বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর সাধনার জন্য মূর্তিপূজা বা নামাজের প্রয়োজন নেই। সন্ন্যাস-জীবনেরও দরকার নেই। গৃহে অবস্থান করেই তাঁকে পাওয়া সম্ভব। নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলেই ঈশ্বরের আসন পাতা আছে। কবীরের ভক্তি, নিষ্ঠা ও সদাচার বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কবীর শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু ছোট ছোট কবিতা রচনা করে নিজের বক্তব্য সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। এগুলি ‘কবীরের দোহা’ নামে খ্যাত।
(গ) গুরু নানক: ভক্তিবাদের আর এক প্রধান প্রবক্তা ছিলেন গুরু নানক। তিনি ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোরের সন্নিকটে তালওয়ান্দী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। নানকের ধর্মের প্রধান তিনটি সূত্র হল—এক ঈশ্বর, গুরু এবং নামজপ। তাঁর মতে, ঈশ্বর অমর, সত্যদ্রষ্টা, নির্ভীক, শত্রুহীন, অজ ও স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি এক ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির নির্দেশ দেন। তাঁর মতে, গুরু হল সমুদ্র এবং শিষ্য হল নদী। শিষ্যকে গুরুতে বিলীন হয়ে মহত্ত্ব লাভ করতে হবে। নানক ভোগবিলাস ও সন্ন্যাস-এর মধ্যপন্থা অনুসরণের নির্দেশ দেন। তিনিও কবীরের মতো জাতিভেদ বা অস্পৃশ্যতার বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সহনশীলতার বাণী প্রচার করে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করেন। বর্তমানে তাঁর শিষ্যগণ ‘শিখ’ নামে পরিচিত।
(ঘ) শ্রীচৈতন্য: বাংলাদেশে ভক্তিবাদের আদর্শে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন চৈতন্যদেব। তিনি নদীয়া জেলায় এক শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল নিমাই। চব্বিশ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র ও দর্শনে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথাকে দৃঢ় ভাষায় অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষই আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হতে পারে। চৈতন্য-প্রচারিত ধর্মের তিনটি মূলকথা ছিল—জীবে দয়া, ঈশ্বরে ঐকান্তিক ভক্তি এবং সেই ভক্তিবাদ জাগরণের জন্য নাম-সংকীর্তন। তাঁর হাজার শিষ্য বাংলা, ওড়িশা ও দাক্ষিণাত্যে ভক্তি ধর্মের প্লাবন বইয়ে দেন। তিনি নিজে কোন ধর্মসম্প্রদায় গঠন করেননি। তবে পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীরা ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’ নামে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করেছেন। আচার্য সুকুমার সেন শ্রীচৈতন্য প্রচারিত ভক্তিবাদকে ‘নৈতিক’ ও ‘আধ্যাত্মিক শিক্ষা’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন ৩। ভক্তি পরম্পরার মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ সুলতানি আমলে ভক্তি আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বস্তুত বৌদ্ধ ধর্মের পতনের পর আমাদের দেশে ভক্তিবাদী আন্দোলনের মতো এত ব্যাপক জনপ্রিয় আন্দোলন আর সংঘটিত হয়নি বলে কোন কোন ঐতিহাসিকদের ধারণা। ভক্তি পরম্পরা বা ভক্তিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:
(ক) ভক্তিবাদের মূল কথা হল আত্মার সাথে পরমাত্মার তথা ভক্তের সাথে ভগবানের রহস্যময় বা অতীন্দ্রিয় মিলন।
(খ) ভক্তিবাদী সাধকেরা প্রথাগতভাবে কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না কিংবা তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে কোন গোষ্ঠী গড়ে তোলার কথা চিন্তা করেননি। কোন বিশেষ ধর্মমতের বন্ধনে তাঁরা আবদ্ধ ছিলেন না কিংবা কোন ধর্মশাস্ত্রের প্রতিও তাঁদের অন্ধ আনুগত্য ছিল না। চিন্তার স্বাধীনতা এবং একান্ত আধ্যাত্মচর্চার মাধ্যমে তাঁরা সৃষ্টির প্রকৃত রহস্য অনুসন্ধান করতেন।
(গ) সত্যের আলোকদর্শনের জন্য ভক্তিবাদীরা কোনরূপ আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন না। কোন অপরিবর্তনীয় বা দুষ্পরিবর্তনীয় মতবাদ যা কিনা যুক্তি-তর্ক দ্বারা সমর্থিত নয়, তার প্রতি এঁদের কোন আস্থা ছিল না।
(ঘ) ঈশ্বরের একত্বে (Unity of God) ছিল তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস। কৃষ্ণ, শিব, রাম, আল্লাহ্ সবাই ভক্তিবাদীদের হৃদয়মন্দিরে একাকার হয়ে বিরাজ করতেন। অধিকাংশ ভক্তিবাদী সাধক পৌত্তলিকতা বিরোধী ছিলেন।
(ঙ) ভক্তিবাদী সাধকেরা প্রচার করেন ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। সকল ধর্মে নানা নামে একই ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। তাঁরা বলেন যে, আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনেই ঘটে মোক্ষলাভ বা মুক্তি। নিষ্কাম কর্মের দ্বারা মোক্ষলাভ সম্ভব। কিন্তু নিষ্কাম কর্মের সাধনা খুব দুরূহ কাজ। বস্তুত বেদ ও উপনিষদে ভক্তিযোগের নির্দেশ বর্তমান। কিন্তু সেখানে জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
(চ) ভক্তিবাদীরা অন্য দুটি পথ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভক্তিযোগের উপর গুরুত্ব দেন। তাঁরা দৃঢ়তার সাথে প্রচার করেন যে, একমাত্র ভক্তি এবং আত্মনিবেদনের মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব। এঁদের মতে, ধর্মীয় সত্য এবং বিশ্বাস সর্বদা যুক্তিনির্ভর হতে পারে না। এক্ষেত্রে মানুষের আবেগ এবং ইচ্ছার একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ভক্তিবাদীদের ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভালবাসার এই তত্ত্বটিকে ড. মজুমদার ভারতের ধর্মভাবনার ইতিহাসে ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রধান ও স্থায়ী অবদান বলে উল্লেখ করেছেন।
(ছ) ভক্তিবাদী সাধকেরা মনে করেন, ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং একান্ত ভক্তিমার্গের সাধনার পথ কঠিন। তবে এই কাজে ভক্তের প্রয়োজন একজন গুরুর সান্নিধ্য। গুরু ভক্তকে সঠিক পথের নির্দেশ দেন। অন্ধকার থেকে আলোকে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের জন্য গুরুর পথনির্দেশিকা আবশ্যিক।
প্রশ্ন ৪। সুফিবাদ বা সুফি পরম্পরা বিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ সুলতানি যুগে প্রাচীন বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন, বৈষ্ণব ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্বের পাশাপাশি দুটি সমন্বয়বাদী ধর্মীয় আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এই দুটি ধর্মীয় আন্দোলন সুফি ও ভক্তি আন্দোলন নামে খ্যাত। সুফি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ইসলাম ধর্মমতকে কেন্দ্র করে। ইসলামের জন্মের সময় থেকেই এই ধর্মমতের অন্তর্গত একশ্রেণীর আধ্যাত্মিকতা সম্পন্ন মানুষ তাসায়ুফ (Tasawwuf) বা সুফি নামে পরিচিত ছিলেন। সুফিরা ছিল অতীন্দ্রিয়বাদী অর্থাৎ সুফিরা বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর সম্পর্কে অনুভূতির জন্য পঞ্চইন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক) সাহায্যের প্রয়োজন নেই। সুফিরা মনে করেন যে, মানুষের অন্তরের অর্থাৎ মনের পবিত্রতা থাকলেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করা যায়। ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে প্রয়োজন আন্তরিক প্রেম ও ভক্তি। সুফিরা ইসলামের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করতে মানুষকে উপদেশ দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তি নিবেদন করার মাধ্যমে সংগীত ও নৃত্যের উপর তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। সুফি সাধক রাবেয়া এবং মনসুর হল্লাজ প্রচার করেন ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত প্রেম ও ভক্তি।
সুফি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা ‘সুফি শব্দটি আরবি শব্দ সাফা (Safa) থেকে উদ্ভব হয়েছে যার অর্থ বিশুদ্ধ। যেহেতু ইসলামের অন্তর্গত আধ্যাত্মিকতা সম্পন্ন মানুষের হৃদয়, চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্মের মধ্যে বিশুদ্ধতা রয়েছে। তাই তাদের সুফি বলা হত। আরবি শব্দ সাফ (saf) কথাটির অর্থ কার্পেট। যেহেতু বিশুদ্ধ মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা কার্পেটের উপর বসে ঈশ্বরের ধ্যান করত সেহেতু তাদের সুফি নামে অভিহিত করা হয়। অনেকের ধারণা সুফি শব্দটি আরও একটি আরবি শব্দ (Surf) থেকে এসেছে যার অর্থ উল (wool)। মুসলিম সাধকরা যারা উলের জামাকাপড় পরিধান করত তারাই সুফি নামে পরিচিত হয়। আরবের কুফা (Kufa) নামক অঞ্চলের অধিবাসী আবু হাসিম সর্বপ্রথম সুফি শব্দটি ব্যবহার করেন।
সুফি সাধকরা প্রচার করেন যে ঈশ্বর এক (God is One)। তাঁরা প্রচার করেন যে মানুষ সব রকম পার্থিব অর্থাৎ জাগতিক বিষয়বস্তু ত্যাগ করলে সে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করবে। সুফি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম যারা ইসলামের অনুশাসনের মধ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। সুফিরা সাধারণভাবে জীবনযাপন করার উপর গুরুত্ব দেন। সুফিরা সমস্ত প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে বলেছেন। তারা পশুর মাংস ভক্ষণকে পাপ বলে মনে করতেন। সুফিরা প্রচার করেন যে মানুষের কামনা-বাসনা হল মানুষের সবথেকে বড় শত্রু।
আনুমানিক ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতবর্ষে সুফি চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটে। সুফিদের মানবিক ও উদারনৈতিক দর্শন ভারতবর্ষে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সুফিরা অনেকগুলি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। এই সম্প্রদায়গুলিকে সিলসিলাহ বলা হয়। মনে করা হয় প্রায় ১৭৫টি সিলসিলায় সুফিরা বিভক্ত ছিল। আবুল ফজলের বিবরণ অনুসারে ভারতবর্ষে ১৪টি সিলসিলা সুফি মতবাদ প্রচার করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু এই সিলসিলাগুলির মধ্যে দুটি ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত। এগুলি চিশতি (Chisti) এবং সুরাবর্দী (Suhrawardi) সম্প্রদায় বা সিলসিলা নামে পরিচিত। অন্যান্য সিলসিলাগুলির মধ্যে ফিরদসিয়া (Firdausia), কাদিরী (Qadiri), নক্সবন্দী (Naqshbandi) ইত্যাদি।
প্রশ্ন ৫। ‘চিতি সিলসিলা’ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ চিশতি সিলসিলার প্রবর্তক ছিলেন খাজা আবদুল কাদির চিতি। ভারতবর্ষে চিশতি সম্প্রদায়ের মতাদর্শ প্রচার করতে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন খাজা মইন্উদ্দিন চিশতি। তিনি পূর্ব পারস্যের সিস্তান নামক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। খাজা মইনউদ্দিন ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত সমরখন্দ, বুখারা প্রভৃতি অঞ্চলে ভ্রমণ করার পর ১২০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতবর্ষে এসে আজমীরে শেষদিন অবধি অবস্থান করেন। খাজা মইন্উদ্দিন সমাজের অবহেলিত নীচু জাতের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন মানুষের জন্য কর্তব্য করলেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করা যায়। মইন্উদ্দিনের শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী এবং ফরিদউদ্দিন মাসুদ, যিনি বাবা ফরিদ নামে সমধিক পরিচিত। ইলতুৎমিস কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। কাকীর দেহাবসানের পর বাবা ফরিদ সুফিবাদ প্রচার করেন। বাবা ফরিদ মনে করতেন যে একজন সুফি সাধকের উচিত রাজা বা অভিজাতদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা। তাহলেই সে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে। শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন বাবা ফরিদের একনিষ্ঠ শিষ্য। তিনি উলেমাদের প্রাধান্যকে অস্বীকার করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র প্রকৃত প্রেমের দ্বারাই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়। আউলিয়া ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাসে একজন মহান আধ্যাত্মিক শক্তি ছিলেন। তিনি মানুষকে শিখিয়েছিলেন একমাত্র ঈশ্বরের প্রতি প্রেম নিবেদনের মাধ্যমে জাগতিক বিষয়বস্তুর ভোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা যায়। শেখ নাসিরউদ্দিন চিরাগ ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য সুফি সাধক। তিনি আউলিয়ার শিষ্য ছিলেন। গুরুর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে তিনি গরিবদের নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি রাজন্যবর্গের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেন। অন্যান্য সুফি সাধকদের মধ্যে ছিলেন শেখ সালিম।
পাঠ্যপুস্তকের প্রশ্নাবলীর উত্তরঃ
প্রশ্ন ১। পূজা প্রণালীর সমন্বয় দ্বারা ঐতিহাসিকগণ কি বুঝিয়েছেন উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ বহু ইতিহাসবিদ পূজা প্রণালীর সমন্বয় সম্পর্কে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা দুইটি প্রক্রিয়া কার্যরত অবস্থায় দেখেছেন। একটি হল পৌরাণিক গ্রন্থসমূহ রচনা, সংকলন ও সংরক্ষণ দ্বারা ব্রাহ্মণ্য চিন্তা-চর্চার প্রচার করা। এই গ্রন্থসমূহ সরল সংস্কৃত ভাষায় বৈদিক ক্রিয়ার বাইরে থাকা শূদ্র ও মহিলাগণের বোধগম্য হওয়ার জন্য রচনা করা হয়েছিল। অন্য প্রক্রিয়াটি হল ব্রাহ্মণ্যগণের দ্বারা শূদ্র ও অন্যান্য সামাজিক সম্প্রদায়গণের আচরণ ও বিশ্বাসকে স্বীকৃতি প্রদান করে এক নূতনত্ব রূপ দেওয়া। বস্তুত সমাজতাত্ত্বিকগণের মতে সমগ্র উপমহাদেশের অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস ও পদ্ধতি ‘মহান’ পৌরাণিক সংস্কৃতি পরম্পরা ও ‘লঘু’ পরম্পরার মধ্যে সংঘটিত অবিরাম আদান-প্রদান প্রক্রিয়ার পরিণতিস্বরূপ হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ উড়িষ্যার পুরীতে দেখতে পাওয়া যায়। ১২শ শতকে তার মুখ্য দেবতা জগন্নাথকে বিষ্ণুর একটি রূপ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রশ্ন ২। উপমহাদেশে মসজিদের স্থাপত্যকার্য সার্বজনীন আদর্শ ও স্থানীয় পরম্পরার কতটুকু প্রতিফলিত করে বলে তুমি মনে কর?
উত্তরঃ এই উপমহাদেশের মুসলমান শাসকগণ বহুসংখ্যক মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তাদের স্থাপত্যকার্য সার্বজনীন বিশ্বাস ও স্থানীয় পরম্পরার এক জটিল সংমিশ্রণ ছিল। এইসকল মসজিদের বৈশিষ্ট্যসমূহ ছিল সার্বজনীন। মসজিদগুলির সক্কার প্রতি এক বিশেষ সঙ্গতি ছিল। কিন্তু স্থাপত্যসমূহের মধ্যে বহু অমিল পরিলক্ষিত হয়। এই অমিলসমূহ অট্টালিকাসমূহের ছাদের নির্মাণ সামগ্রীতে দৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ ত্রয়োদশ শতকে কেরালায় একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। এর ছাদ মন্দিরের শিখরের সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের আটিয়া মসজিদের ছাদ ছিল কোনাকার। আটিয়ার মসজিদ ইট দ্বারা নির্মিত ছিল। আবার কাশ্মীরের শ্রীনগরে ঝিলম নদীর তীরে নির্মিত শাহ হামাদ মসজিদে কাশ্মীরী কাঠ ব্যবহৃত হয়েছিল।
প্রশ্ন ৩। বে-শারিয়া ও বা-শারিয়া সুফি পরম্পরার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যসমূহ কি কি ছিল?
অথবা,
‘বে-সেরিয়া’ ও ‘বা-সেরিয়া’ বলতে কি বোঝ?
উত্তরঃ ইসলাম ধর্মে কতিপয় অতিন্দ্রিয়বাদী ছিলেন। তারা সুফি আদর্শের মৌলিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে খানকাহকে অবজ্ঞা করতেন। তাঁরা ধর্মানুষ্ঠান অস্বীকার করতেন। তারা তাদের জীবনে কঠোর তপশ্চর্যা করতেন। তাঁরা কোলান্দার, মাদারিস, মালাঙ্গি, হাইদারিস প্রভৃতি নানা নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে শারিয়ার সংজ্ঞা দিতেন। সুতরাং তাদের বে-শারিয়া বলা হত। অন্যদিকে বা-শারিয়া সুফীরা হলেন সেইসকল সুফি যারা ইসলামের আদর্শের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। অবশ্য উভয় সম্প্রদায় ইসলামের অন্তর্ভুক্ত।
প্রশ্ন ৪। কবীর অথবা বাবা গুরু নানকের মূল শিক্ষা ও তা প্রচারের উপায়সমূহ বর্ণনা কর।
উত্তরঃ কবীর: কবীর প্রচার করেন যে, মানুষ নানা নামে ডাকলেও আল্লাহ্ বা ঈশ্বর এক। তাঁর অবস্থান মানুষের অন্তরে। নিছক আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তাঁকে পাওয়ার জন্য চাই আন্তরিক ভক্তি ও প্রেম। কবীর বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর সাধনার জন্য মূর্তিপূজা বা নামাজের প্রয়োজন নেই। সন্ন্যাস-জীবনেরও দরকার নেই। গৃহে অবস্থান করেই তাঁকে পাওয়া সম্ভব। নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলেই ঈশ্বরের আসন পাতা আছে। কবীরের ভক্তি, নিষ্ঠা ও সদাচার বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কবীর শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু ছোট ছোট কবিতা রচনা করে নিজের বক্তব্য সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। এগুলি ‘কবীরের দোহা’ নামে খ্যাত।
গুরু নানক: ভক্তিবাদের আর এক প্রধান প্রবক্তা ছিলেন গুরু নানক। তিনি ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোরের সন্নিকটে তালওয়ান্দী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। নানকের ধর্মের প্রধান তিনটি সূত্র হল — এক ঈশ্বর, গুরু এবং নামজপ। তাঁর মতে, ঈশ্বর অমর, সত্যদ্রষ্টা, নির্ভীক, শত্রুহীন, অজ ও স্বয়ংপ্রকাশ। তিনি এক ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির নির্দেশ দেন। তাঁর মতে, গুরু হল সমুদ্র এবং শিষ্য হল নদী। শিষ্যকে গুরুতে বিলীন হয়ে মহত্ত্ব লাভ করতে হবে। নানক ভোগবিলাস ও সন্ন্যাস-এর মধ্যপন্থা অনুসরণের নির্দেশ দেন। তিনিও কবীরের মতো জাতিভেদ বা অস্পৃশ্যতার বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সহনশীলতার বাণী প্রচার করে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করেন। বর্তমানে তাঁর শিষ্যগণ ‘শিখ’ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন ৫। সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ সুফিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:
(ক) সুফিবাদীগণ ধর্মীয় পরিভাষা ও ধর্মতত্ত্ববিদগণ দ্বারা করা কোরান ও সুন্নার বৌদ্ধিক ব্যাখ্যাসমূহের সমালোচনা করেছিল।
(খ) তাঁরা এর পরিবর্তে মুক্তি ও প্রাপ্তির কারণে ঈশ্বরকে ভক্তি ও তাঁর আদর্শসমূহ পালন করতে গুরুত্ব আরোপ করেছিল।
(গ) মহাপুরুষ বলে ধারণা করা পয়গম্বর মহম্মদের জীবন তারা অনুসরণ করে।
(ঘ) তাঁরা নিজে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কোরানের ব্যাখ্যা করে।
(ঙ) সুফিদের মতে ঈশ্বর এক ও সর্বশক্তিমান। প্রত্যেকেই তাঁর সৃষ্টি। এই কারণে সবাই সমান।
প্রশ্ন ৬। ভারতের একখানা মানচিত্রে তিনটি প্রধান সুফি ধর্মস্থান এবং মন্দির সম্পর্কিত তিনটি স্থান নির্দিষ্ট কর (বিষ্ণু, শিব ও ঈশ্বর প্রতিজনের একটি করে।)
উত্তরঃ