Class 12 History Chapter 4 দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য

Class 12 History Chapter 4 দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য (সাংস্কৃতিক অগ্রগতি) Question Answer in Bengali Medium | AHSEC Class 12 History Question Answer, দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর চতুর্থ অধ্যায় to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapters Assam Board Class Class 12 History Chapter 4 দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য (সাংস্কৃতিক অগ্রগতি) Notes and select needs one.

Class 12 History Chapter 4 দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য (সাংস্কৃতিক অগ্রগতি)

Join Telegram channel

Also, you can read the SCERT book online in these sections Class 12 History Chapter Class 12 History Chapter 4 দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য (সাংস্কৃতিক অগ্রগতি) Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 12 History Chapter Class 12 History Chapter 4 দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য (সাংস্কৃতিক অগ্রগতি) These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 12 History Chapter Class 12 History Chapter 4 দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য (সাংস্কৃতিক অগ্রগতি) Solutions for All Subjects, You can practice these here.

দার্শনিক প্রত্যয় ও স্থাপত্য (সাংস্কৃতিক অগ্রগতি)

প্রথম খণ্ড

Chapter: 4

HISTORY

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। সাঁচী স্তুপ কোথায় অবস্থিত?

উত্তরঃ ভূপাল হতে ২০ কিমি উত্তর-পূর্বে কংখিরা গ্রামে।

প্রশ্ন ২। সাঁচী স্তুপ কখন আবিষ্কৃত হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৮১৮ সালে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Join Now

প্রশ্ন ৩। ‘তাজউল – ইকবাল তোয়ারিখ ভূপাল’ নামক গ্রন্থের রচয়িতা কে?

উত্তরঃ সাহজাঁহা বেগম।

প্রশ্ন ৪। সাঁচী স্তুপ কার স্মৃতিসৌধ?

উত্তরঃ গৌতম বুদ্ধের।

প্রশ্ন ৫। সাঁচীকে কখন বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে ঘোষণা করা হয়?

উত্তরঃ ১৯৮৯ সালে।

প্রশ্ন ৬। প্রাচীন বৈদিক যুগের সময়সীমা কত?

উত্তরঃ খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ হতে ১০০০ অব্দ।

প্রশ্ন ৭। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক কে?

উত্তরঃ গৌতম বুদ্ধ।

প্রশ্ন ৮। গৌতম বুদ্ধ কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

উত্তরঃ কপিলাবস্তু নগরের লুম্বিনী উদ্যানে।

প্রশ্ন ৯। গৌতম বুদ্ধ কোথায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন?

উত্তরঃ বুদ্ধগয়ায়।

প্রশ্ন ১০। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের নাম কি?

উত্তরঃ ত্রিপিটক।

প্রশ্ন ১১। জৈন ধর্মের প্রবর্তক কে?

উত্তরঃ মহাবীর।

প্রশ্ন ১২। জৈনদের ধর্মগ্রন্থের নাম লেখ।

উত্তরঃ কল্পসূত্র।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ হতে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে দার্শনিক সত্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ঐতিহাসিকগণ কি কি উৎস ব্যবহার করেন?

উত্তরঃ দার্শনিক সত্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক ব্যবহৃত উৎসসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ সাহিত্য।

(খ) প্রাচীন স্থাপত্য, ভাস্কর্য, স্মৃতিসৌধ ও লিপিসমূহ।

প্রশ্ন ২। সাঁচী স্তুপ কোথায় অবস্থিত? এর একটি বৈশিষ্ট্য লেখ।

উত্তরঃ সাঁচী স্তুপ ভূপাল হতে ২০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে সাঁচী কংখিরা নামক গ্রামে পাহাড়ের উপর অবস্থিত।

এটা ভূপাল রাজ্যের প্রাচীনতম ও বিস্ময়কর বৌদ্ধ স্মৃতিসৌধ।

প্রশ্ন ৩। কে এবং কেন সাঁচীর পূর্বদিকের প্রবেশদ্বার তুলে নিতে চেয়েছিল?

উত্তরঃ ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয়গণ সাঁচী সম্পর্কে অত্যধিক আগ্রহ প্রকাশ করত। ফরাসিগণ সাঁচীর পূর্বদিকের প্রবেশদ্বার উঠিয়ে নিতে সাহজাঁহা বেগমের অনুমতি চেয়েছিলেন। তারা একে ফ্রান্সের যাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য নিতে চেয়েছিল।

প্রশ্ন ৪। সাঁচী স্তুপ কে সংরক্ষণ করেছিল? দুইজন পৃষ্ঠপোষক বা সংরক্ষণকারীর নাম উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূপাল রাজ্যের শাসকগণ সাঁচী স্তুপ সংরক্ষণ করেছিলেন। বেগম সাহজাঁহা এবং তাঁর উত্তরসূরী সুলতান জাঁহা বেগম এই প্রাচীন স্থাপত্যটি সংরক্ষণের জন্য অর্থ মঞ্জুর করেন।

প্রশ্ন ৫। সাঁচী স্তুপের তাৎপর্য কি?

উত্তরঃ সাঁচী স্তুপের তাৎপর্য নিম্নরূপ:

(ক) সাঁচী স্তুপ সর্বাধিক সংরক্ষিত বৌদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ। এটি একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য প্রতিকল্প।

(খ) এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধকেন্দ্র। এর আবিষ্কার বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আমাদের অনুমানের পরিবর্তন করে।

প্রশ্ন ৬। খ্রিস্টপূর্ব একহাজার বছরের মধ্যবর্তীকালের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্ববিখ্যাত চিন্তাবিদদের নাম উল্লেখ কর।

উত্তরঃ খ্রিস্টপূর্ব একহাজার বছরের মধ্যবর্তীকালের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্ববিখ্যাত চিন্তাবিদদের নাম নিম্নরূপ:

(ক) ইরানের জরাথুষ্ট্র।

(খ) চীনের কং জি।

(গ) গ্রিসে সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল।

(ঘ) ভারতে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ।

প্রশ্ন ৭। কোন্ গ্রন্থ আদি বৈদিক পরম্পরা সম্পর্কে তথ্যাদি প্রদান করে? এই গ্রন্থে উল্লিখিত তিনজন দেবতার নাম লেখ।

উত্তরঃ ঋকবেদ আদি বৈদিক পরম্পরা সম্পর্কে তথ্যাদি প্রদান করে। এই গ্রন্থে উল্লিখিত তিনজন দেবতা হলেন — অগ্নি, ইন্দ্র ও সোমা।

প্রশ্ন ৮। প্রাচীনকালের দুইটি যজ্ঞের নাম লেখ। কে এবং কেন তা সম্পাদন করতেন?

উত্তরঃ প্রাচীনকালের দুইটি যজ্ঞ হল রাজসূয় যজ্ঞ ও অশ্বমেধ যজ্ঞ। এই যজ্ঞগুলি রাজাগণ সম্পাদন করতেন।

প্রশ্ন ৯। ভারত উপমহাদেশের বাইরে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার হওয়া দেশগুলির নাম লেখ।

উত্তরঃ ভারত উপমহাদেশের বাইরে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার হওয়া দেশগুলির নাম হল — চীন, কোরিয়া, জাপান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া।

প্রশ্ন ১০। বৌদ্ধধর্মের দুটি সম্প্রদায়ের উল্লেখ কর।

উত্তরঃ বৌদ্ধধর্মের দুটি সম্প্রদায় হল – 

(ক) হীনযান। এবং 

(খ) মহাযান।

প্রশ্ন ১১। জৈনধর্মের দুটি সম্প্রদায়ের উল্লেখ কর।

উত্তরঃ জৈনধর্মের দুটি সম্প্রদায় হল — 

(ক) দিগম্বর। এবং 

(খ) শ্বেতাম্বর।

প্রশ্ন ১২। বুদ্ধের জীবন সম্পর্কিত চারটি স্থানের নাম লেখ যেখানে স্তুপ নির্মিত হয়েছিল?

উত্তরঃ বুদ্ধের জীবন সম্পর্কিত চারটি স্থানের নাম লেখ যেখানে স্তুপ নির্মিত হয়েছিল হল —

(ক) লুম্বিনী।

(খ) বুদ্ধগয়া।

(গ) সারনাথ। ও 

(ঘ) কুশীনগর।

প্রশ্ন ১৩। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক বুদ্ধদেবের ধর্ম কেন গ্রহণ করেছিল?

উত্তরঃ বুদ্ধদেব জনসাধারণের মধ্যে সত্য ও অহিংসার বাণী পৌঁছে দিতে থাকেন। তিনি বলতেন যে সৎ জীবনযাপনের জন্য বলির বিধানসহ ব্যয়বহুল যাগ – যজ্ঞের কোন প্রয়োজন নেই। জাতিভেদ প্রথারও কোন মূল্য নেই। সৎ পথে থেকে সহজসরল জীবনযাপন করেই মানুষ সুখ – শান্তি লাভ করতে পারে। বুদ্ধ তাঁর বাণী সাধারণ মানুষের ভাষা ‘পালি’-তে প্রচার করতেন। সাধারণ মানুষ বুদ্ধদেবের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে বুদ্ধদেবের ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

প্রশ্ন ১৪। বৌদ্ধধর্মের সমসাময়িককালে আর কোন্ ধর্ম বিকশিত হয়েছিল?

উত্তরঃ বৌদ্ধধর্মের সমসাময়িককালে বেশ কয়েকটি নূতন ধর্ম বিকশিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান হল জৈন ধর্ম।

প্রশ্ন ১৫। বৌদ্ধধর্মের তিনটি মন্ত্র কি কি?

উত্তরঃ বৌদ্ধধর্মের মন্ত্র তিনটি নিম্নরূপ:

(ক) বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি।

(খ) সংঘং শরণম গচ্ছামি।

(গ) ধর্মং শরণম গচ্ছামি।

প্রশ্ন ১৬। বৌদ্ধধর্মের চারটি মহৎ সত্যের উল্লেখ কর।

উত্তরঃ বৌদ্ধধর্মের চারটি মহৎ সত্য নিম্নরূপ:

(ক) পৃথিবী দুঃখময়।

(খ) মানুষের আশা – আকাঙ্খা থেকে দুঃখের উৎপত্তি হয়।

(গ) আশা – আকাঙ্খা দমন করলে মুক্তি সম্ভব হয়।

(ঘ) সেই মুক্তির জন্য অষ্টাংগিক মার্গ বা আটটি পথ অনুসরণের প্রয়োজন আছে।

প্রশ্ন ১৭। অষ্টাংগিক মার্গ বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ অষ্টাংগিক মার্গ হল — সৎ চিন্তা, সৎ সিদ্ধান্ত, সৎ বাক্য, সৎ আচরণ, সৎ কর্ম, সৎ চেষ্টা, সৎ স্মৃতি ও সৎ ধ্যান।

প্রশ্ন ১৮। ত্রিপিটক তিনটি কি কি?

উত্তরঃ ত্রিপিটক তিনটি নিম্নরূপ:

(ক) বিনয় পিটক।

(খ) সূত্ত পিটক।

(গ) অভিধর্ম পিটক।

প্রশ্ন ১৯। পূর্ব কাকে বলে?

উত্তরঃ মহাবীরের বাণীসমূহ পরবর্তীকালে মোট চৌদ্দটি খণ্ডে সংগৃহীত করা হয়। এইগুলোকে একত্রে ‘পূর্ব’ বলে।

প্রশ্ন ২০। আসামে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কিরূপ?

উত্তরঃ আসামে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব সীমিত হলেও একেবারে নগণ্য নয়। বিশেষত উজান আসামের শ্যাম, আইটনীয়া, চিংফৌ, খামতি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর লোক আজও বৌদ্ধধর্মের উপাসক।

প্রশ্ন ২১। বাবা গুরু নানকের যে-কোন তিনটি বাণী লেখ।

উত্তরঃ বাবা গুরু নানকের তিনটি বাণী নিম্নরূপ:

(ক) ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি রাখবে।

(খ) ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।

(গ) ঈশ্বর সর্বত্র ও সর্বশক্তিমান।

প্রশ্ন ২২। সর্বপ্রথম কে এবং কবে হাম্পি আবিষ্কার করেছিলেন?

উত্তরঃ কর্নেল কলিন মার্কেন্‌জি নামে একজন ইংরেজ অভিযন্ত্রা ১৮০০ সনে হাম্পি আবিষ্কার করেছিলেন।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। খ্রিস্টপূর্ব একহাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ের প্রথমার্ধকে বিশ্ব ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ বলে কেন গণ্য করা হয়?

উত্তরঃ খ্রিস্টপূর্ব একহাজার বছরের মধ্যবর্তীকালের প্রথমদিককে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ বলে গণ্য করা হয়। কারণ এই যুগে ইরানে জরাথুস্ট্র, চীনে কংজি, গ্রিসে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, ভারতে মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ এবং আরও বহুসংখ্যক দার্শনিক চিন্তাবিদের অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল। এইসকল মনীষীগণ অস্তিত্বের রহস্য, মহাজাগতিক প্রচলিত নীতি ও মানব সম্বন্ধে বুঝতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তদুপরি সেই যুগেই নূতন রাজ্য ও নগরের দ্রুত বিকাশ ঘটেছিল এবং গাঙ্গেয় উপত্যকায় সামাজিক ও আর্থিক জীবনে নানাপ্রকার পরিবর্তন এসেছিল। এইসকল দার্শনিক-চিন্তাবিদ এই অগ্রগতিসমূহের বিষয়েও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রশ্ন ২। ভূপাল রাজ্যের সবচেয়ে প্রাচীন প্রাসাদসমূহ কোথায় ছিল? সাঁচী স্তুপের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বার বাইরে নিয়ে যাওয়া হতে কিভাবে রক্ষা করা হয়েছিল?

উত্তরঃ ভূপাল রাজ্যের সর্বাধিক কৌতূহলোদ্দীপক অট্টালিকা সাঁচীর কানাখেরা নামক এক সুন্দর গ্রামে অবস্থিত। গ্রামটি পাহাড়ের ঊর্ধ্বমুখী স্থানে অবস্থিত। এর দূরত্ব ভূপাল হতে ২০ মাইল উত্তর – পূর্বদিকে।

ঊনবিংশ শতকের ইউরোপীয়গণের সাঁচী স্তুপ সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সেই একই সময়ে সাঁচীর স্থাপত্য সম্পর্কে ফরাসিগণেরও কৌতূহল দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা উক্ত স্থানের সর্বাধিক সুন্দরভাবে সংরক্ষিত পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারটি নিজ দেশে নিয়ে সংগ্রহশালায় রাখার জন্য নবাব সাহজাঁহা বেগমের অনুমতি চেয়েছিলেন। অন্যদিকে কিছুসংখ্যক ইংরাজ শাসকও এই প্রবেশদ্বারটি ইংল্যান্ডে নেওয়ার জন্য আর্জি জানিয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ইংরেজ ও ফরাসি উভয়ই এই দ্বার দুইটির ঢালাই সাঁচ গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে হল এবং মূলদ্বারখানি যেখানে ছিল সেখানেই থাকল।

প্রশ্ন ৩। প্রাচীন যুগে ভারতে উৎসর্গ-সংক্রান্ত পরম্পরা কি ছিল?

উত্তরঃ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ হতে ১৮০০ অব্দের মধ্যে সংকলিত ঋকবেদ নামে পরিচিত বৈদিক পরম্পরার গ্রন্থখানাকে ধরে অনাদিকাল হতে চলে আসা ও পরম্পরাগতভাবে ধর্মীয় প্রত্যয় তথা বিশ্বাস ও লোকাচারের বিষয়ে জানতে পারা গিয়েছে। বহু দেবদেবী, বিশেষত অগ্নি, ইন্দ্র এবং সোমার গুণগান সম্বলিত শ্লোকসমূহে ঋকবেদ সমৃদ্ধ হয়েছে। উৎসর্গের সময় এইরূপ বহুসংখ্যক শ্লোক উচ্চারিত হয়েছিল এবং সমবেত সকলে গোধন, সন্তান, সু – স্বাস্থ্য সং সুদীর্ঘ জীবন বাসনায় প্রচলিত প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেছিল।

প্রথমদিকে উৎসর্গসমূহ সামগ্রিকভাবে সম্পাদনা করা হত। কিন্তু পরবর্তীকালে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৫০০ এবং পরবর্তী সময়) কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়ির কর্তা পরিবারের মঙ্গল কামনা করে এই কাজ সম্পাদন করতেন। অধিক বাহুল্যকরণে ‘রাজসূয়’ ও ‘অশ্বমেধ’ যজ্ঞের সময় ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ দ্বারা পরিচালিত ধর্মীয় নীতি-নিয়মের মধ্যে স্বয়ং দলপতি বা রাজাই উৎসর্গ কার্য সমাধা করতেন।

প্রশ্ন ৪। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতককে ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয় কেন?

উত্তরঃ নিম্নলিখিত কারণে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতককে ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়:

(ক) খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৈদিক পরম্পরা তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। উপনিষদের গুরুত্ব বৃদ্ধির ফলে ধ্যানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। জনগণ নির্বাণ লাভের নূতন পথ খুঁজে পেতে কৌতূহলোদ্দীপক হয়। ফলস্বরূপ, সমাজে নূতন নূতন দার্শনিক প্রত্যয় আবির্ভূত হয়।

(খ) নূতন দার্শনিক প্রত্যয় আবির্ভাবের ফলে বহু নূতন ধর্মীয় গোষ্ঠী জন্মলাভ করে। এদের মোট সংখ্যা ৬২টি ছিল। এইগুলির মধ্যে একমাত্র জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম জনগণকে অধিক প্রভাবিত করেছিল।

(গ) জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম ধ্যান ও আত্ম – নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। তাদের মতবাদ উপনিষদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। সুতরাং উপনিষদের দার্শনিক প্রত্যয় জনপ্রিয়তা লাভ করে।

প্রশ্ন ৫। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নূতন ধর্মীয় মতবাদ আবির্ভাবের কারণসমূহ দেখাও।

উত্তরঃ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর পূর্ব ভারতে অনেক নূতন ধর্মীয় মতবাদ আবির্ভূত হয়েছিল। এর প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) বৈদিক ধর্মের জটিলতা: আদিপর্বে বৈদিক সভ্যতা অত্যন্ত সহজ ও সরল ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা জটিল হয়ে যায়। সুতরাং জনগণ একটি সহজ ধর্ম চেয়েছিল।

(খ) জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা: শূদ্রকে উচ্চ তিন বর্ণের মানুষ অত্যন্ত ঘৃণা করত। এই নিম্নশ্রেণীর মানুষ অন্য একটি নতুন ধর্মের প্রত্যাশা করেছিল যা তাদের যথার্থ মর্যাদা দিতে পারে।

(গ) জটিল ভাষা: বৈদিক ধর্মের সকল গ্রন্থই সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ছিল। সাধারণ মানুষ সংস্কৃতের মতো এত জটিল ভাষা উপলব্ধি করতে পারত না।

(ঘ) মহামানবের জন্ম: খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা হিন্দুধর্মে কিছু সংস্কার আনয়ন করেন এবং একে নূতন পর্যায়ে উপস্থাপন করেন। তাঁদের মতবাদ জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম নামে সমধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

প্রশ্ন ৬। মহাযান বৌদ্ধধর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী হতে বৌদ্ধধর্মের ধারণা ও ক্রিয়াকাণ্ডের অনেক পরিবর্তন হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুরানো বৌদ্ধধর্ম নিজ চেষ্টায় নির্বাণ লাভে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছিল। তদুপরি বুদ্ধকে একজন ব্যক্তি হিসাবে ধরে তাঁরা নিজের প্রচেষ্টায় জ্ঞান ও নির্বাণ লাভ করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়েছিল। কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধধর্মে ত্রাণকর্তার ধারণার উদ্ভব ঘটে। ফলে এই জনই একমাত্র মুক্তিদাতা — এইরূপ একটি বদ্ধমূল বিশ্বাস মাথাচড়া দিয়া ওঠে। অতিশয় দয়ালু বলে পরিচিত বোধিসত্ত্বগণ নিজ প্রচেষ্টায় বহুগুণের অধিকারী হয় এবং পুঞ্জীভূত সৎগুণসমূহের দ্বারা নির্বাণ লাভ করে পৃথিবী হতে চলে যাওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করেন। বুদ্ধ ও বোদ্ধিসত্ত্বের মূর্তিপূজা নব্য বৌদ্ধধর্মের একটি আবশ্যকীয় পরম্পরায় পরিণত হয়েছিল।

এই নূতন চিন্তাধারাটি মহাযান নামে পরিচিত হয়েছিল। এই নব্য বৌদ্ধধর্ম গ্রহণকারীগণ পুরানো পরম্পরাপন্থীগণকে হীনযান নাম দেন।

প্রশ্ন ৭। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের অবনতির কারণসমূহ কি কি ছিল?

উত্তরঃ ভারতে বৌদ্ধধর্মের অবনতির প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) মৌর্যবংশের পতনের পর ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী সূঙ্গ বংশের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই বৌদ্ধধর্ম রাজপ্রসাদ লাভে বঞ্চিত হয় এবং এর অবনতি আরম্ভ হয়। কুষাণ সম্রাটগণের মধ্যে কয়েকজন বৌদ্ধধর্মের অনুরক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু সরল ও সহজ নৈতিক অনুশাসনগুলির পরিবর্তে বুদ্ধদেবের পূজা ও বুদ্ধভক্তি প্রাধান্যলাভ করেছিল। তখন তা হিন্দুধর্মেরই এক শাখায় পরিণত হয়ে পড়ে।

(খ) তান্ত্রিক মতবাদের প্রাধান্য লাভের ফলে প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। উত্তর ভারতের গুপ্তসম্রাটগণের ও তাঁদের পরবর্তী কয়েকটি রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায়, কুমারিল ভট্ট, শঙ্করাচার্য প্রভৃতি ধর্মপ্রচারকগণের প্রভাবে এবং লিঙ্গায়েৎ, শ্রীবৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ের আবির্ভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান হল।

(গ) মিহিরকুল এবং বখতিয়ার খিলজীর মতো শাসকদের বৌদ্ধ – বিদ্বেষ ও আক্রমণের ফলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ভারতবর্ষ হতে প্রায় বিলীন হয়ে গেল। কিন্তু বৌদ্ধ দর্শন এবং মৈত্রী, করুণা, অহিংসা মন্ত্রের প্রভাব আজও ভারতবাসীকে পৃথিবীর সম্মুখে গৌরবান্বিত করছে।

প্রশ্ন ৮। হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যসমূহ দেখাও।

উত্তরঃ হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে নানা বিষয়ে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আছে:

(ক) জৈন এবং বৌদ্ধরা হিন্দু ধর্মের কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী।

(খ) কিন্তু তাঁরা বেদবিরোধী এবং যাগযজ্ঞ, পশুবলির নিন্দাকারী। বৌদ্ধ ও জৈন উভয়েই জাতিভেদের বিরোধী; কিন্তু জাতিভেদের প্রতি বিতৃষ্ণা ও জৈনধর্ম অপেক্ষা বৌদ্ধধর্মে অধিক তীব্র।

(গ) উভয় ধর্মের প্রধান অঙ্গ অহিংসা এবং পবিত্র নৈতিক জীবনযাপন।

(ঘ) কিন্তু জৈনদিগের অহিংসার ধারণা বৌদ্ধদিগের অপেক্ষা বেশি ব্যাপক।

(ঙ) হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম অপেক্ষা জৈনধর্মের সাদৃশ্য বেশি। জৈনগণ হিন্দুদের ন্যায় ধর্মকার্যে পুরোহিত নিয়োগ করেন এবং হিন্দুদের কোন কোন দেবতার পূজ়াও করেন।

প্রশ্ন ৯। হীনযান ও মহাযান বলতে কি বোঝ? তাদের মধ্যে পার্থক্য দর্শাও।

উত্তরঃ খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে বৌদ্ধধর্মারলম্বীরা দুইটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়, যথা — হীনযান ও মহাযান। মহাযান হল বৌদ্ধধর্মের নূতন রূপ। কণিষ্কের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্মের এই দিক প্রকাশিত হয়।

হীনযানগণ নিরাকার সাধনা ও আত্ম – অনুশীলনের দ্বারা নির্বাণ লাভ করাকেই শ্রেষ্ঠধর্ম বলে মনে করেন। কিন্তু মহাযানীরা বুদ্ধকে অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে পূজার্চনার মাধ্যমে নির্বাণ লাভের সিদ্ধান্ত নেন।

হীনযান ও মহাযানদের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ:

হীনযানমহাযান
(ক) হীনযানগণ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা বুদ্ধকে তাঁদের ঈশ্বর বলে মনে করেন।(ক) মহাযানগণ ঈশ্বরে বিশ্বাস, করেন। তাঁরা বুদ্ধকে তাঁদের ঈশ্বর মনে করে।
(খ) হীনযানে মূর্তিপূজার কোনো স্থান নেই।(খ) মহাযানে মূর্তিপূজা প্রচলিত।
(গ) হীনযানদের বুদ্ধের প্রতি আস্থা আছে কিন্তু বোধিসত্ত্বের উপর কোন আস্থা নেই।(গ) মহাযানগণ বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বকে পূজা করেন।
(ঘ) হীনযানগণ অষ্টমার্গকে পবিত্র জীবনযাপনের উপায় বলে মনে করেন।(ঘ) মহাযানগণ সৎ জীবনের জন্য বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের পূজার উপর গুরুত্ব প্রদান করেন।
(ঙ) হীনযানদের মতে জীবের প্রধান উদ্দেশ্য হল নির্বাণ লাভ।(ঙ) মহাযানদের মতে স্বর্গলাভ জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য।

প্রশ্ন ১০। সাঁচী স্তুপ টিকেছিল, কিন্তু অমরাবতী স্তুপটি নেই কেন?

উত্তরঃ অমরাবতী স্তুপ সাঁচী স্তুপের বহুপূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু পণ্ডিতগণ সেইসময় এইসব স্মৃতিসৌধ রক্ষা করার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। সাঁচী স্তুপ ১৮১৮ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এইসময় চারটি প্রবেশদ্বারের তিনটি সঠিক অবস্থায় ছিল। এইগুলি এখনও পর্যন্ত সুন্দর অবস্থায় আছে। চতুর্থ প্রবেশদ্বারটি বর্তমানে ভগ্নাবস্থা প্রাপ্ত। সম্পূর্ণ গম্বুজটি সুন্দর অবস্থায় আছে। অন্যদিকে অমরাবতীর মহাচৈত্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তা বর্তমানে অতীতের গৌরব হারিয়েছে।

প্রশ্ন ১১। শিলালিপিসমূহের সাক্ষ্যের কিছুসংখ্যক সীমাবদ্ধতা উল্লেখ কর।

উত্তরঃ শিলালিপিসমূহের সাক্ষ্যের কিছুসংখ্যক সীমাবদ্ধতা নিম্নরূপ:

(ক) শিলালিপিসমূহের সাক্ষ্যের শিলালিপিতে ব্যবহৃত শব্দসমূহ পরিষ্কার নয়।

(খ) শিলালিপিতে ব্যবহৃত শব্দসমূহের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব নয়।

(গ) শিলালিপিসমূহের প্রকৃত অর্থ বের করা সম্ভব নয়।

(ঘ) এইগুলি কেবল প্রধান ও বিশেষ ঘটনাসমূহের সাক্ষ্য বহন করে।

দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। বুদ্ধদেবের জীবনী সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দে) বর্তমান নেপালের পাদদেশস্থ কপিলাবস্তু নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শুদ্ধোদন ক্ষত্রিয় শাক্যবংশের নায়ক ছিলেন। জন্মের পরেই গৌতমের মাতা মায়াদেবীর মৃত্যু হওয়ায় তিনি বিমাতা ও মাতৃম্বসা গৌতমীর স্নেহযত্নে বর্ধিত হলেন। বাল্যকাল হতেই তিনি স্বভাবত চিন্তাশীল ও সংসারে উদাসীন ছিলেন। সংসারধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য শুদ্ধোদন ষোড়শবর্ষীয় গৌতমকে যশোধারা বা গোপী নাম্নী এক সুন্দরী বালিকার সঙ্গে বিবাহ দিলেন। কিন্তু গৌতমের চিন্তাশীল মন সুখভোগে তুষ্ট থাকতে পারল না। বৌদ্ধগ্রন্থ হতে জানা যায়, এক জরাতুর বৃদ্ধ, জনৈক ব্যধিগ্রস্থ ব্যক্তি, একটি মৃতদেহ এবং জনৈক সন্ন্যাসীর দিব্যকান্তি গৌতমের চিত্তকে আলোড়িত করে তুলল। সৌম্যমূর্তি সন্ন্যাসীকে দেখে তাঁর ধারণা হল যে, এক সন্ন্যাসী ছাড়া জগতে সকলেই অসুখী। কি উপায়ে মানবের দুঃখ দূর করা যায় এই চিন্তায় তিনি আকুল হলেন।

এই সময়ে ২৯ বৎসর বয়সে গৌতমের এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। পুত্র – বাৎসল্য তাঁকে নূতন মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি এক গভীর রাত্রে গৃহত্যাগ করেন। এই গৃহত্যাগের ঘটনা গৌতমের জীবনে মহাভিনিষ্ক্রমণ নামে খ্যাত।

প্রাণের আবেগে গৌতম পরম সত্যের সন্ধানে দীর্ঘ ছয় বৎসরকাল বিহারের নানাস্থানে ভ্রমণ করলেন। শাস্ত্রাদি পাঠ ও কঠোর তপস্যায়ও তিনি শাস্তি পেলেন না। অবশেষে তিনি গয়ার নিকটবর্তী নৈরঞ্জনা (বর্তমান ফল্গুনিরঞ্জন) নদীতীরে বোধিদ্রুমমূলে ধ্যানমগ্ন হলেন। এই অবস্থায় ৩৫ বৎসর বয়সে তাঁর দিব্যজ্ঞান লাভ হল; তিনি দুঃখ হতে নির্বাণ বা মুক্তির পথ আবিষ্কার করলেন। ‘বোধি’ বা দিব্যজ্ঞানের বিকাশে গৌতমের নাম হল ‘বুদ্ধ’ বা জ্ঞানী। গয়াতে যে অংশে বসে তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছিলেন, তার নাম হল বুদ্ধগয়া। বুদ্ধের নাম অনুসারে তাঁর ধর্ম বৌদ্ধধর্ম এবং তাঁর শিষ্যেরা বৌদ্ধ নামে পরিচিত হলেন। বুদ্ধের পিতৃদত্ত নাম সিদ্ধার্থ। গৌতম গোত্রীয় বলে তাঁর নাম ছিল গৌতম এবং শাক্যবংশ বলে অপর নাম ছিল শাক্যমুনি। তিনি তথা হতে বা পরম অবস্থানে গত হয়েছিলেন বলে তাঁর এক নাম হল তথাগত।

বারাণসীর নিকট ঋষিপত্তন (বর্তমান সারনাথ) গ্রামে মৃগবনে পাঁচটি শিষ্যকে বুদ্ধদেব তাঁর প্রথম উপদেশ দান করেন। এই ঘটনা বুদ্ধের জীবনে ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। এই পাঁচজন শিষ্যই পরবর্তীকালে বিশাল বৌদ্ধ সংঘের সূচনা করেছিলেন। কথিত আছে, মগধের রাজা বিম্বিসার, কোশলরাজ প্রসেনজিৎ প্রমুখ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। প্রায় ৪৫ বৎসরকাল সারনাথ, বৈশালী, শ্রাবস্তী, রাজগৃহ প্রভৃতি নানাস্থানে ধর্ম প্রচার করবার পর আশী বৎসর বয়সে বর্তমান গোরক্ষপুর জেলার কুশীনগরে এই মহামানবের দেহান্তর বা পরিনির্বাণ হয় (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৪ বা ৪৮৬ অব্দ)।

প্রশ্ন ২। বুদ্ধধর্মের মূলশিক্ষা সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ গৌতম বুদ্ধ ছিলেন একজন ধর্মসংস্কারক। প্রকৃত অর্থে ভগবান বুদ্ধ কোনো নতুন ধর্মমতের প্রবর্তন করেননি। তিনি কেবলমাত্র প্রচলিত ধর্মমতের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটি তুলে ধরেছিলেন। এইভাবে তিনি প্রচলিত ধর্মমতকে সুষ্ঠুভাবে পুনঃস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মমত ছিল যুগোপযোগী। গৌতম বুদ্ধ সারনাথে অবস্থানকালে তাঁর ধর্মীয় নীতিগুলি ব্যাখ্যা করেছিলেন। এগুলি আজও মানুষের কাছে যথেষ্ট গ্রহণীয়। গৌতম বুদ্ধের মূল বক্তব্য ছিল মানুষের জীবন জন্মের থেকে শেষ অবধি দুঃখময়। তিনি বলেছেন এই দুঃখের হাত থেকে মানুষের নিষ্কৃতি পেতে হলে চারটি মূল সত্য যা আর্য সত্য নামে পরিচিত এবং আটটি পথ অনুসরণ করতে হবে। ঐতিহাসিক রিস ডেভিস (Rhys Davis) মন্তব্য করেছেন যে, বৌদ্ধধর্মের সারমর্ম বুদ্ধের চারটি আর্য সত্য এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের (আটটি পথ) মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।

ত্রিপিটক হল বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। এটি পালি ভাষায় লিখিত। এই গ্রন্থে গৌতম বুদ্ধ যে চারটি আর্য সত্যের কথা বলেছেন তাহল — 

(ক) মানুষের জীবনে কষ্ট-দুঃখ আছে। 

(খ) মানুষের জীবনে দুঃখের কারণ আছে (এর কারণ কামনা, বাসনা ইত্যাদি)। 

(গ) মানুষ ইচ্ছা করলে দুঃখ – কষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারত। এবং 

(ঘ) দুঃখ – কষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সঠিক পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন।

দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গৌতম বুদ্ধ মানুষকে কেবল অতিরিক্ত ভোগ অথবা কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলেননি, তিনি মানুষকে একটি মাঝামাঝি পথ অনুসরণ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। এই পথেই মানুষ মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারবে। এই পথকে তিনি বলেছেন মজঝিম পছা। এই পথ সঠিকভাবে অনুসরণ করার জন্য আটটি নীতি বা আদর্শ অনুসরণ করতে হবে —

(ক) সৎ বাক্য। 

(খ) সৎ কর্ম।

(গ) সৎ জীবন।

(ঘ) সৎ সংকল্প।

(ঙ) সৎ চেষ্টা। 

(চ) সৎ স্মৃতি।

(ছ) সম্যক দৃষ্টি। ও 

(জ) সম্যক সমাধি।

প্রশ্ন ৩। জৈনধর্মের মূল শিক্ষার সারাংশ লেখ।

উত্তরঃ বর্ধমান মহাবীর আনুমানিক খ্রিঃ পূঃ ৫৪০ অব্দে এক ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সিদ্ধার্থ এবং মাতার নাম ত্রিশলা। যশোদা নামে এক ক্ষত্রিয় কন্যার সাথে মহাবীরের বিবাহ হয়। তাঁর একটি কন্যাসন্তান ছিল। কিন্তু জীবের মুক্তির পথ অনসুন্ধানের জন্য তাঁর হৃদয় আকূল হয়ে ওঠে। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে সংসারের মায়ামোহ ত্যাগ করে তিনি ‘প্রবজ্যা’ গ্রহণ করেন ও কঠোর তপশ্চর্যায় নিমগ্ন হন। বারো বছর ভ্রাম্যমাণ জীবনে কঠোর তপশ্চর্যার ফলে তিনি ‘কেবলিন’ বা ‘কৈবল্য’ (সর্বজ্ঞ) ‘জিন’ (বিজয়ী) এবং ‘মহাবীর’ আখ্যা লাভ করেন। ‘জিন’ শব্দ থেকেই ‘জৈন’ নামের উৎপত্তি হয়েছে। দীর্ঘ ত্রিশ বছর গাঙ্গেয় উপত্যকার বিভিন্ন রাজ্যে তিনি ধর্মপ্রচার করেন। সম্ভবত ৭২ বছর বয়সে রাজগৃহের নিকট পাবা নগরীতে তিনি দেহরক্ষা করেন (খ্রিঃ পূঃ ৪৬৮ অব্দে)।

ধর্মমত: মহাবীর তাঁর পূর্ববর্তী তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের ধর্মনীতিকে নিজ ধর্মাদর্শের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। পার্শ্বনাথ প্রচারিত চারটি মূল নীতি ছিল — 

(ক) অহিংসা। 

(খ) মিথ্যা না বলা। 

(গ) চুরি না করা (অচৌর্য)। এবং 

(ঘ) পরদ্রব্য গ্রহণ না-করা (অপরিগ্রহ)। 

এগুলি ‘চতুৰ্যাম’ নামে খ্যাত। মহাবীর এই চারটি নীতি গ্রহণ করেন এবং এর সাথে আরো একটি নীতি যোগ করেন। এই পঞ্চম নীতিটি হল ব্রহ্মচর্য, অর্থাৎ সংযমপূর্ণ পবিত্র জীবনযাপন করা। ‘পঞ্চমহাব্রত’ নামে খ্যাত এই পাঁচটি নীতিই জৈনধর্মের সারকথা। জৈনধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার বা অস্বীকার করা হয়নি। জৈনরা জীবের ব্যাপক অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এদের মতে, জীব শুধু প্রাণীজগতে নেই, লতা, গুল্ম, মাটি, পাথর, ধাতু সবেতেই প্রাণ আছে। কর্মের বন্ধনই জীবকে অপবিত্র করে তোলে। কর্মফল ভোগ করতেই জীবের পুনর্জন্ম ঘটে। এই কর্মবন্ধন ছিন্ন করতে পারলেই জীবনের ‘মোক্ষ’ বা মুক্তিলাভ ঘটবে। মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে মহাবীর তিনটি পথ নির্দেশ করেছেন, যথা — সৎ – বিশ্বাস, সৎ – আচরণ ও সৎ – জ্ঞান। এই তিনটি নীতি ‘ত্রি-রত্ন’ নামে খ্যাত। জৈনগণ ছিলেন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনে বিশ্বাসী। জৈনধর্মে অহিংসার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

প্রশ্ন ৪। বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তার কারণসমূহ কি কি ছিল?

অথবা,

বৌদ্ধধর্মের সফলতার কারণ নির্ধারণ কর।

উত্তরঃ আজকাল ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু বুদ্ধের দেহত্যাগের পাঁচশত বৎসরের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম সমগ্র এশিয়ায় বিস্তারলাভ করে। এই অসামান্য সাফল্যের কারণগুলি নিম্নরূপ:

(ক) বৈদিক যুগের শেষভাগে পূর্ব ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে এক প্রবল আন্দোলন উপস্থিত হয়। বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের নীরস অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞে পশুবলি প্রভৃতি নিষ্ঠুর প্রথা ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের প্রভুত্ব ও অত্যাচার এবং জাতিভেদের কঠোরতার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের মনে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

(খ) বেদ ও উপনিষদের উচ্চতত্ত্ব সাধারণ লোকে বুঝতে পারত না। সুতরাং বৈদিক ধর্ম সাধারণের ধর্মপিপাসা মেটাতে পারল না।

(গ) জীবজন্তুর প্রতি সমবেদনায় অনেকের অন্তর পূর্ণ হয়ে উঠল। উপনিষদের ঋষিরা অহিংসার বাণী প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। এর ফলে ধর্মসংস্কারের এক প্রবল প্রচেষ্টা আত্মপ্রকাশ করল এবং দেশের নানাস্থানে বৈদিক ধর্মবিরোধী অনেক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হল। ক্ষত্রিয় সম্প্রদায় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। বৌদ্ধধর্ম তৎকালীন বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে এই জনজাগরণেরই পরিণতি। কালোপযোগী ধর্ম বলে বৌদ্ধধর্ম সহজেই বিস্তারলাভ করে।

(ঘ) বৌদ্ধধর্মে জাতিভেদ প্রথা ছিল না এবং সাধারণের দুর্বোধ্য সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে জনসাধরণের বোধগম্য পালি ভাষায় তা প্রচারিত হত। কাজেই জনসাধারণ সহজেই এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হত।

(ঙ) মগধের রাজা বিম্বিসার ও কোশলের রাজা প্রসেনজিৎ এই ধর্ম গ্রহণ করায় তা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রসারলাভ করে। রাজর্ষি অশোক, কুষাণসম্রাট কণিষ্ক এবং মহারাজ হর্ষবর্ধনের ধর্মপ্রাণতা ও পৃষ্ঠপোষকতা বৌদ্ধধর্মের সফলতার অন্যতম প্রধান কারণ।

(চ) বৌদ্ধ সংঘের কল্যাণে বৌদ্ধধর্ম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রশ্ন ৫। পৌরাণিক হিন্দুত্ববাদ কিভাবে বিকাশ লাভ করেছিল ? তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ কর।

উত্তরঃ পৌরাণিক হিন্দুত্ববাদ ত্রাণকর্তার (saviour) ধারণা হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। হিন্দুধর্মে দুটি মতবাদ বিকাশলাভ করেছিল। এইগুলি হল বৈষ্ণববাদ ও শৈববাদ। বৈষ্ণবদের প্রধান দেবতা ছিলেন বিষ্ণু এবং মহাদেব বা শিব ছিলেন শৈবদের প্রধান দেবতা। উভয় মতবাদেই একটি নির্দিষ্ট দেবতার পূজাপ্রথা প্রচলিত ছিল। এইরূপ পুজার্চনায় দেবতা ও ভক্তের মধ্যে একটি বন্ধন দেখা যেত। অর্থাৎ ভক্ত ও দেবতার মধ্যে একটি প্রেম ও আরাধনা তথা ভক্তির যোগসূত্র দেখা যায়। একে ভক্তি বলা হয়।

অবতারবাদ: বৈষ্ণববাদের ক্ষেত্রে বিষ্ণুর অবতারগণকে কেন্দ্র করে বহু আনুষ্ঠানিক ভক্তি – অর্চনার আয়োজন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই পরম্পরার অন্তর্গত অবতারগণের মোট সংখ্যা ছিল দশ জন। দুষ্টশক্তির আধিপত্যের ফলে উদ্ভব হওয়া বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের বিভীষিকার তর্জন – গর্জনের হাত হতে পৃথিবীকে রক্ষা করবার জন্য বিষ্ণু দশাবতার রূপ ধারণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অবতার জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তদুপরি এক – একজন স্থানীয় দেবতাকে বিষ্ণুর অবতার বলে বিশ্বাস করার ফলে ধর্মীয় পরম্পরাসমূহ পূর্বের তুলনায় অধিকতরভাবে একজোট হবার একটি নূতন পথ উন্মোচন হয়েছিল।

ভাস্কর্য: দশাবতার বিভিন্ন রূপে অন্যান্য দেবদেবীর সঙ্গে ভাস্কর্যে স্থান লাভ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ শিবকে লিঙ্গ হিসাবেও পূজা করা হয়। কখনও অবশ্য শিবকে মানবরূপেও দেখানো হয়। ঠিক সেইভাবে কিছু প্রতীক চিহ্ন, যেমন – শিবসজ্জা, অলঙ্কার ও দেবতার হাতে থাকা অস্ত্র – শস্ত্র বা মাঙ্গলিক সামগ্রী; বসবার ভঙ্গি প্রভৃতির দ্বারা দেবতা এবং তাদের চরিত্রের লক্ষণযুক্ত অন্যান্যদের বিষয়ে কিছু জটিল ধারণা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে দেখা যায়।

পৌরাণিক কাহিনি: খ্রিস্টীয় দশম শতকের মধ্যভাগে ব্রাহ্মণগণ সংকলিত পুরাণে সন্নিবিষ্ট কতিপয় কাহিনির সঙ্গে পরিচিত হলে ভাস্কর্যসমূহের অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করা আরম্ভ হয়। বলাবাহুল্য যে, সেই সময়ের কাহিনিসমূহের অধিকাংশই পুরাণে পাওয়া যায়। দেবদেবীর কাহিনিকে ধরে শত শত বছর ব্যাপী চলে আসা নানা ধরনের কাহিনি অধিকাংশই এর মধ্যে পড়ে। এইগুলি সংস্কৃতে লিখিত ছিল এবং সকলেই পাঠ করতে পারত।

পুরোহিত, বণিক ও সাধারণ শ্রেণীর যে সকল পুরুষ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে জনসাধারণের সঙ্গে তাদের ভাব ও বিশ্বাস বিনিময় এবং এর পারস্পরিক ক্রিয়াসমূহের ফলে পুরাণের অধিকাংশ কাহিনির বিকাশ ঘটেছিল। উদাহরণস্বরূপ বাসুদেব কৃষ্ণ ছিলেন মথুরা অঞ্চলের একজন শীর্ষস্থানীয় দেবতা। কিন্তু বহু শতাব্দী ব্যাপী তার পূজা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্তারলাভ করেছিল।

প্রশ্ন ৬। স্তুপগুলি কিভাবে এবং কেন নির্মাণ করা হয়েছিল? আলোচনা কর।

অথবা,

সাঁচী স্তুপ কিভাবে আবিষ্কার হয়েছিল?

উত্তরঃ স্তুপের উৎপত্তি: বৌদ্ধধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থাপত্য-কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হল স্তুপ। মহাপরিনির্বাণ সওন্ত অনুসারে মৃত্যুশয্যায় শায়িত বুদ্ধকে তাঁর শিষ্যরা প্রশ্ন করেছিলেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি কি পরিকল্পনায় নির্মিত হবে? বুদ্ধ তাঁর রুগ্ন হস্ত শূন্যে সঞ্চালন করে একটি অর্ধবৃত্তাকার রেখা অঙ্কন করেন। এ থেকে শিষ্যদের ধারণা হয় যে, তিনি স্তুপ নির্মাণের ইঙ্গিত করছেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, স্তুপ নির্মাণের পদ্ধতি বুদ্ধের পূর্বে, সম্ভবত বৈদিক যুগ থেকেই জ্ঞাত ছিল। বৈদিক রীতি অনুসারে মৃতদেহের ভস্মাবশেষ শ্মশানে প্রোথিত করা হত। সম্ভবত এ থেকেই বৌদ্ধ ও জৈনগণ স্তুপের ধারণা লাভ করেন। তবে পরবর্তীকালে বৌদ্ধদের সাথে স্তুপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন, স্তুপ হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বৌদ্ধগণ প্রথমদিকে তাদের উপাসনাস্থলে স্তুপ নির্মাণ করত, ক্রমশ স্তুপ নির্মাণও পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হতে থাকে এবং বুদ্ধের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানগুলিতে ভক্তগণ স্তুপ নির্মাণ করতে থাকেন।

স্তুপের গঠন: প্রথমে স্তুপের গঠনপ্রণালী ছিল জটিলতা বর্জিত। স্তুপের জন্য নির্দিষ্ট ভূমিতে প্রথমে একটি ‘বেদি’ বা ‘বেদিকা’ প্রস্তুত করা হত। এর উপর গঠিত ক্ষুদ্র বেদিকে বলা হত ‘মেধী’। ‘অণ্ড’ নামে পরিচিত স্তুপের অর্ধগোলাকার, গম্বুজাকার অংশ এই মেধীর উপর রক্ষিত হত। অণ্ডই ছিল স্তুপের মূল উপাদান। অণ্ডের উপরিভাগ সামান্য সমতল হত। এখানে একটি চতুষ্কোণ রেলিং-বেষ্টিত স্থান থাকত। এর মাঝখান থেকে উত্থিত হত একটি কাষ্ঠ অথবা প্রস্তর – নির্মিত দণ্ড। এই দণ্ডকে বলা হত ছত্রদণ্ড। এর সাথে যুক্ত থাকত ছত্রাবলী। স্তুপকে বেষ্টন করে কাঠের বা পাথরের বেষ্টনী থাকত। এই বেষ্টনীর ভিতর একটি আবদ্ধ পথের সৃষ্টি হত, যাকে বলা হত প্রদক্ষিণ পথ। এই পথে স্তুপ প্রদক্ষিণ করে মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করত। এখানে পৌঁছবার জন্য স্তুপের চারদিকে চারটি তোরণদ্বার থাকত। কিছু স্তুপে বুদ্ধদেব বা তাঁর প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ রক্ষিত হত। কিছু স্তুপ বুদ্ধের স্মৃতি-বিজড়িত স্থানে স্থাপিত হত। এই স্তুপগুলিকে স্মারকস্তুপ বলা যায়। এছাড়া ধার্মিক বৌদ্ধগণ বুদ্ধের প্রতীক হিসেবে আরাধনা করার জন্যও কিছু স্তুপ নির্মাণ করতেন। দক্ষিণ ভারতীয় স্তুপগুলির নির্মাণশৈলী ছিল কিছু আলাদা। প্রথমদিকে সমগ্র স্তুপটি নিশ্ছিদ্র ইটের গাঁথনি দিয়ে তৈরি হত। পরে স্তুপের কেন্দ্রে ও বাইরে দুটি গোলাকার প্রাচীর নির্মাণ করে সে – দুটিকে যুক্ত করে মধ্যবর্তী অংশ মাটি দিয়ে পূর্ণ করা হত। সম্ভবত ইটের ব্যবহার কমানোর জন্যই গঠনরীতিতে এ ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। প্রথমে স্তূপের গঠন যেরূপ ছিল, পরবর্তীকালে তাতে আরো কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। স্তুপগুলি ক্রমশই অধিক উচ্চতাপ্রাপ্ত হতে থাকে। গম্বুজগুলি ক্রমশ শঙ্কু আকৃতি লাভ করতে থাকে। ছত্রদণ্ডের উচ্চতা ও ছত্রাবলীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়।

কথিত আছে, মৌর্য সম্রাট অশোক বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ৮৪,০০০ স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। অবশ্য নেপালের স্তুপটি ছাড়া এই যুগের কোন স্তুপকেই তাদের মূলরূপে পাওয়া যায়নি। প্রাচীন স্তুপগুলির মধ্যে ভারহুত, বোধগয়া ও সাঁচীর স্তুপগুলির উল্লেখ করা যায়। সাঁচীর প্রাচীনতম স্তুপটি সম্রাট অশোকের নির্মিত। অবশ্য খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকে এটিকে পুনর্নির্মিত করা হয়েছিল। এর আয়তন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছিল। স্তুপটির চারদিকে এই সময়েই প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। সাঁচীর এই স্তুপটি ভারতের বৃহত্তম স্তুপগুলির অন্যতম। খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকে পুনর্নির্মাণের পর স্তুপটির বনিয়াদের ব্যাস হয় ১২০ ফুট ও উচ্চতা হয় ৫৪ ফুট।

প্রশ্ন ৭। স্তুপসমূহ কিভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ প্রত্যেকটি স্তুপের এক – একটি নিজস্ব ইতিহাস আছে। স্তুপসমূহ কিভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল তারও ইতিহাস আছে। এইরূপ একটি তথ্য উত্থাপন করা হল। ১৭৯৬ সালে একজন স্থানীয় রাজা একটি মন্দির তৈরির জন্য অমরাবতী স্তুপের ধ্বংসাবশেষের উপর গেলে তাঁর পায়ে আঘাত লাগে। তিনি সেই পাথরসমূহ মন্দির নির্মাণের কাজে ব্যবহার করতে স্থির করেন। আবার স্তুপটিকে পাহাড়ের মতো দেখতে মনে হওয়ায় এর মাটির নীচে গুপ্তধন থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। কয়েক বছর পর কলিন নামে একজন বৃটিশ আধিকারিক বহুসংখ্যক ভাস্কর্যের নিদর্শন আবিষ্কার করেন এবং তার বিস্তারিত চিত্র অঙ্কন করেন। কিন্তু এর কোন প্রতিবেদন কখনও প্রকাশিত হয়নি।

১৮৫৪ সালে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্গত গুন্টুর জেলার কমিশনার ওয়াল্টার ইলিয়ট অমরাবতী ভ্রমণ করে সেখান হতে অনেকগুলি ভাস্কর্য কলা (বর্তমান চেন্নাই) নিয়ে যান। তিনি অমরাবতী স্তুপের পশ্চিমে প্রবেশদ্বারখানির ভগ্নাবশেষসমূহ আবিষ্কার করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে তখনকার সময়ে নির্মিত বৌদ্ধ স্তুপসমূহের মধ্যে এই স্তুপটি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। ১৮৫০ সাল হতে অমরাবতীর ভাস্কর্যসমৃদ্ধ ফলকসমূহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে দেখা গেল। কিছুসংখ্যক ফলক কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল – এ আনা হয়। আরও কিছুসংখ্যক মাদ্রাজের ইন্ডিয়া অফিসে যায় এবং আরও কিছু লন্ডনে যায়। কিছুসংখ্যক ভাস্কর্যের নিদর্শন বৃটিশ আধিকারিকগণ তাদের ফুলবাগান সাজানোর জন্য নিয়ে যান। মোটের উপর এই অঞ্চলে কোন ব্রিটিশ ১১ আধিকারিক আসলেই তিনি তার পূর্ববর্তীগণের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অমরাবতীর ভাস্কর্যসমূহ উঠিয়ে নেওয়া একটি নিত্য – নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে যায়।

পাঠ্যপুস্তকের প্রশ্নাবলীর উত্তরঃ

প্রশ্ন ১। উপনিষদীয় চিন্তাবিদদের ধারণাসমূহ দৈববাদী ও বস্তুবাদীগণ হতে পৃথক কি? যুক্তি সহকারে উত্তর দাও।

উত্তরঃ হ্যাঁ, উপনিষদীয় চিন্তাবিদদের ধারণাসমূহ দৈববাদী ও বস্তুবাদীগণ হতে পৃথক। তাদের মধ্যে প্রধান পার্থক্যসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) দৈববাদী ও বস্তুবাদীদের মতবাদের পার্থক্যসমূহ: দৈববাদীগণ বিশ্বাস করেন যে কোন ব্যক্তিই তার কর্মফল হতে রেহাই পাবে না। কোন ব্যক্তিই জীবনযাপনে সুখ অথবা দুঃখ পরিবর্তন করতে পারবে না। তা বাড়ানোও যায় না, কমানোও যায় না। জ্ঞানীগুণীজন মনে করেন যে তারা তাদের সৎকর্মের দ্বারা কর্মফল হতে পরিত্রাণ পাবে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। সকল মানুষকে সুখ – দুঃখের সম্মুখীন হতে হয়।

বস্তুবাদীগণ ভিক্ষা, উৎসর্গ ও নিবেদনে বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে যে, পার্থিব জগৎ ছাড়া বহির্জগৎ বলে কিছুই নেই। মানুষ চারটি উপাদানে গঠিত। মৃত্যুর পর তার দেহের মাটির অংশ ধুলায় মিশে যায়, জলীয় অংশ জল, উত্তপ্ত অংশ আগুনে এবং বায়বীয় অংশ বাষ্পে বিলীন হয়ে যায়, এবং তার চেতনটি শূন্যে ভেসে বেড়ায়। অন্যভাবে বলা যায় মৃত্যুর পর আর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।

(খ) উপনিষদের দার্শনিক প্রত্যয়: উপরোক্ত মতবাদসমূহে আত্মা অথবা ভগবানের কোন স্থান নেই। সুতরাং উপনিষদের মতে ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার মিলন হল জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।

প্রশ্ন ২। জৈনধর্মের মূলশিক্ষার সারাংশ লেখ।

উত্তরঃ বর্ধমান মহাবীর আনুমানিক খ্রিঃ পূঃ ৫৪০ অব্দে এক ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সিদ্ধার্থ এবং মাতার নাম ত্রিশলা। যশোদা নামে এক ক্ষত্রিয় কন্যার সাথে মহাবীরের বিবাহ হয়। তাঁর একটি কন্যাসন্তান ছিল। কিন্তু জীবের মুক্তির পথ অনসুন্ধানের জন্য তাঁর হৃদয় আকূল হয়ে ওঠে। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে সংসারের মায়ামোহ ত্যাগ করে তিনি ‘প্রবজ্যা’ গ্রহণ করেন ও কঠোর তপশ্চর্যায় নিমগ্ন হন। বারো বছর ভ্রাম্যমাণ জীবনে কঠোর তপশ্চর্যার ফলে তিনি ‘কেবলিন’ বা ‘কৈবল্য’ (সর্বজ্ঞ) ‘জিন’ (বিজয়ী) এবং ‘মহাবীর’ আখ্যা লাভ করেন। ‘জিন’ শব্দ থেকেই ‘জৈন’ নামের উৎপত্তি হয়েছে। দীর্ঘ ত্রিশ বছর গাঙ্গেয় উপত্যকার বিভিন্ন রাজ্যে তিনি ধর্মপ্রচার করেন। সম্ভবত ৭২ বছর বয়সে রাজগৃহের নিকট পাবা নগরীতে তিনি দেহরক্ষা করেন (খ্রিঃ পূঃ ৪৬৮ অব্দে)।

ধর্মমত: মহাবীর তাঁর পূর্ববর্তী তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের ধর্মনীতিকে নিজ ধর্মাদর্শের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। পার্শ্বনাথ প্রচারিত চারটি মূল নীতি ছিল — 

(ক) অহিংসা।

(খ) মিথ্যা না বলা।

(গ) চুরি না করা (অচৌর্য)। এবং 

(ঘ) পরদ্রব্য গ্রহণ না-করা (অপরিগ্রহ)। 

এগুলি ‘চতুৰ্যাম’ নামে খ্যাত। মহাবীর এই চারটি নীতি গ্রহণ করেন এবং এর সাথে আরো একটি নীতি যোগ করেন। এই পঞ্চম নীতিটি হল ব্রহ্মচর্য, অর্থাৎ সংযমপূর্ণ পবিত্র জীবনযাপন করা। ‘পঞ্চমহাব্রত’ নামে খ্যাত এই পাঁচটি নীতিই জৈনধর্মের সারকথা। জৈনধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার বা অস্বীকার করা হয়নি। জৈনরা জীবের ব্যাপক অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এদের মতে, জীব শুধু প্রাণীজগতে নেই, লতা, গুল্ম, মাটি, পাথর, ধাতু সবেতেই প্রাণ আছে। কর্মের বন্ধনই জীবকে অপবিত্র করে তোলে। কর্মফল ভোগ করতেই জীবের পুনর্জন্ম ঘটে। এই কর্মবন্ধন ছিন্ন করতে পারলেই জীবনের ‘মোক্ষ’ বা মুক্তিলাভ ঘটবে। মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে মহাবীর তিনটি পথ নির্দেশ করেছেন, যথা — সৎ – বিশ্বাস, সৎ – আচরণ ও সৎ – জ্ঞান। এই তিনটি নীতি ‘ত্রি-রত্ন’ নামে খ্যাত। জৈনগণ ছিলেন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনে বিশ্বাসী। জৈনধর্মে অহিংসার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

প্রশ্ন ৩। সাঁচীর স্তুপ সংরক্ষণে ভূপালের বেগমদের অবদান সম্বন্ধে আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূপালের দুইজন নবাব সাহজাঁহা বেগম ও তাঁর উত্তরাধিকারী সুলতান জাঁহা বেগম সাঁচী সহ অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য নানাপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন:

(ক) তাঁরা সাঁচী স্তুপ সংরক্ষণের জন্য অর্থ দান করেছিলেন।

(খ) সুলতান জাঁহা বেগম সাঁচীতে একটি যাদুঘর ও একটি অতিথিশালা নির্মাণের জন্য অর্থ মঞ্জুর করেছিলেন।

(গ) এই অতিথিশালায় জন মার্শাল অবস্থান করে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। সাঁচী সম্পর্কিত তাঁর লিখিত অনেকগুলি গ্রন্থ তিনি জাঁহা বেগমকে দান করেন।

এইভাবে বেগমদের সুস্থ সিদ্ধান্তের ফলে সাঁচী টিকে রয়েছে।

প্রশ্ন ৪। নারীপুরুষগণ কি কারণবশত সংঘে যোগদান করেছিল বলে তুমি মনে কর?

উত্তরঃ নিম্নলিখিত কারণেই সম্ভবত নারী ও পুরুষগণ সংঘে যোগদান করেছিল:

(ক) তারা জগতের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হতে দূরে সরে থাকতে চেয়েছিল।

(খ) সংঘের জীবনযাত্রা সহজ, সরল ও সুশৃঙ্খল ছিল।

(গ) সংঘে থেকে তারা যুদ্ধের দর্শন গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে পারত।

(ঘ) বহুলোক ধর্মশিক্ষক হওয়ার জন্য সংঘে প্রবেশ করেছিল।

(ঙ) সংঘে সকল লোককেই সমান গণ্য করা হত। সংঘে রাজা, সম্ভ্রান্তশালী লোক ও সাধারণ মানুষ থাকত। তারা সবাই অত্যন্ত বিনয়ী ছিল। ভিক্ষু অথবা ভিক্ষুণী হওয়ার পর কারও পূর্বের সামাজিক মর্যাদা থাকত না।

(চ) সংঘের আভ্যন্তরীণ কার্য গণতান্ত্রিক ছিল। তারা আলোচনার মাধ্যমে সহমতে গুরুত্ব প্রদান করত।

প্রশ্ন ৫। সাঁচীর ভাস্কর্যসমূহ বুঝতে বৌদ্ধ সাহিত্যের জ্ঞান কতদূর সাহায্য করে?

উত্তরঃ বুদ্ধের জীবনীগ্রন্থ হতে জানা যায় তিনি এক ঝোপবিশিষ্ট গাছের নীচে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে থেকে মহাজ্ঞান তথা বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। পুরাতন ভাস্করগণের অনেকে বুদ্ধকে মানবীয় রূপে প্রকাশ করা হতে বিরত থেকে কিছুসংখ্যক প্রতীকের দ্বারা তাঁর উপস্থিতির সংকেত দিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ শূন্য আসন বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন অবস্থা বোঝাচ্ছে। তবে একটি কথা স্পষ্ট যে ভাস্কর্যসমূহে থাকা বস্তু বা চিত্তসমূহের সাহিত্যিক ব্যাখ্যা দেওয়া সহজ নয়। উদাহরণস্বরূপ গাছের কথা ধরা যাক। গাছ কেবল গাছই নয়, তা বুদ্ধের জীবনের কোন একটি ঘটনাও বোঝাচ্ছে। এইসব প্রতীক সম্বন্ধে ভালোভাবে বুঝবার জন্য ঐতিহাসিকগণকে যে সকল ভাব এইসকল শিল্প সৃষ্টি করেছে তাদের পরম্পরার সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচিত হতে হবে।

প্রশ্ন ৬। বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মের উত্থানের সঙ্গে জড়িত ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের অগ্রগতির বিষয়ে আলোচনা কর।

উত্তরঃ বৈষ্ণববাদ হিন্দুধর্মের একটি শাখা। এরা বিষ্ণুকে প্রধান দেবতা হিসাবে পূজা করে। ঠিক সেইভাবে শৈববাদ হিন্দুধর্মের একটি পরম্পরা যা শিবকে প্রধান দেবতা (মহাদেব) বলে গণ্য করেন। এইরূপ পূজার্চনা ভক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করে যা ভক্ত ও ঈশ্বরের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে।

স্থাপত্য: সাঁচীর স্তুপ যখন বিকাশলাভ করে তখন মন্দিরের অবস্থিতি ছিল। এই মন্দিরগুলি দেবদেবীর মূর্তি স্থাপনের জন্য নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন মন্দিরগুলি ছিল ছোট চৌকোণবিশিষ্ট কক্ষযুক্ত। তার মাত্র একটি দ্বার ছিল যেখান দিয়ে পূজারি মন্দিরে প্রবেশ করত। ধীরে ধীরে গর্ভগৃহে একটি লম্বা কাঠামো তৈরি হয়। এইসকল মন্দিরের দেয়াল স্থাপত্যকার্যে পরিপূর্ণ ছিল।

ভাস্কর্য: বহুসংখ্যক অবতারকে মূর্তি হিসাবে দেখানো হয়েছে। এই মূর্তিগুলিকে অন্য দেবতা হিসাবে দেখানো হয়েছে। শিবকে লিঙ্গরূপে দেখানো হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য বহুক্ষেত্রে শিবকে মানবরূপে দেখানো হয়েছে। এইসকল চিত্র ভগবানের চিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

প্রশ্ন ৭। কিভাবে এবং কি কারণে স্তুপসমূহ নির্মিত হয়েছিল আলোচনা কর।

উত্তরঃ স্তুপের উৎপত্তি: বৌদ্ধধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থাপত্য – কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হল স্তুপ। মহাপরিনির্বাণ সওন্ত অনুসারে মৃত্যুশয্যায় শায়িত বুদ্ধকে তাঁর শিষ্যরা প্রশ্ন করেছিলেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি কি পরিকল্পনায় নির্মিত হবে? বুদ্ধ তাঁর রুগ্ন হস্ত শূন্যে সঞ্চালন করে একটি অর্ধবৃত্তাকার রেখা অঙ্কন করেন। এ থেকে শিষ্যদের ধারণা হয় যে, তিনি স্তুপ নির্মাণের ইঙ্গিত করছেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, স্তুপ নির্মাণের পদ্ধতি বুদ্ধের পূর্বে, সম্ভবত বৈদিক যুগ থেকেই জ্ঞাত ছিল। বৈদিক রীতি অনুসারে মৃতদেহের ভস্মাবশেষ শ্মশানে প্রোথিত করা হত। সম্ভবত এ থেকেই বৌদ্ধ ও জৈনগণ স্তুপের ধারণা লাভ করেন। তবে পরবর্তীকালে বৌদ্ধদের সাথে স্তুপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন, স্তুপ হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বৌদ্ধগণ প্রথমদিকে তাদের উপাসনাস্থলে স্তুপ নির্মাণ করত, ক্রমশ স্তুপ নির্মাণও পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হতে থাকে এবং বুদ্ধের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানগুলিতে ভক্তগণ স্তুপ নির্মাণ করতে থাকেন।

স্তুপের গঠন: প্রথমে স্তুপের গঠনপ্রণালী ছিল জটিলতা বর্জিত। স্তুপের জন্য নির্দিষ্ট ভূমিতে প্রথমে একটি ‘বেদি’ বা ‘বেদিকা’ প্রস্তুত করা হত। এর উপর গঠিত ক্ষুদ্র বেদিকে বলা হত ‘মেধী’। ‘অণ্ড’ নামে পরিচিত স্তুপের অর্ধগোলাকার, গম্বুজাকার অংশ এই মেধীর উপর রক্ষিত হত। অণ্ডই ছিল স্তুপের মূল উপাদান। অণ্ডের উপরিভাগ সামান্য সমতল হত। এখানে একটি চতুষ্কোণ রেলিং-বেষ্টিত স্থান থাকত। এর মাঝখান থেকে উত্থিত হত একটি কাষ্ঠ অথবা প্রস্তর – নির্মিত দণ্ড। এই দণ্ডকে বলা হত ছত্রদণ্ড। এর সাথে যুক্ত থাকত ছত্রাবলী। স্তুপকে বেষ্টন করে কাঠের বা পাথরের বেষ্টনী থাকত। এই বেষ্টনীর ভিতর একটি আবদ্ধ পথের সৃষ্টি হত, যাকে বলা হত প্রদক্ষিণ পথ। এই পথে স্তুপ প্রদক্ষিণ করে মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করত। এখানে পৌঁছবার জন্য স্তুপের চারদিকে চারটি তোরণদ্বার থাকত। কিছু স্তুপে বুদ্ধদেব বা তাঁর প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ রক্ষিত হত। কিছু স্তুপ বুদ্ধের স্মৃতি-বিজড়িত স্থানে স্থাপিত হত। এই স্তুপগুলিকে স্মারকস্তুপ বলা যায়। এছাড়া ধার্মিক বৌদ্ধগণ বুদ্ধের প্রতীক হিসেবে আরাধনা করার জন্যও কিছু স্তুপ নির্মাণ করতেন। দক্ষিণ ভারতীয় স্তুপগুলির নির্মাণশৈলী ছিল কিছু আলাদা। প্রথমদিকে সমগ্র স্তুপটি নিশ্ছিদ্র ইটের গাঁথনি দিয়ে তৈরি হত। পরে স্তুপের কেন্দ্রে ও বাইরে দুটি গোলাকার প্রাচীর নির্মাণ করে সে – দুটিকে যুক্ত করে মধ্যবর্তী অংশ মাটি দিয়ে পূর্ণ করা হত। সম্ভবত ইটের ব্যবহার কমানোর জন্যই গঠনরীতিতে এ ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। প্রথমে স্তূপের গঠন যেরূপ ছিল, পরবর্তীকালে তাতে আরো কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। স্তুপগুলি ক্রমশই অধিক উচ্চতাপ্রাপ্ত হতে থাকে। গম্বুজগুলি ক্রমশ শঙ্কু আকৃতি লাভ করতে থাকে। ছত্রদণ্ডের উচ্চতা ও ছত্রাবলীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়।

কথিত আছে, মৌর্য সম্রাট অশোক বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ৮৪,০০০ স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। অবশ্য নেপালের স্তুপটি ছাড়া এই যুগের কোন স্তুপকেই তাদের মূলরূপে পাওয়া যায়নি। প্রাচীন স্তুপগুলির মধ্যে ভারহুত, বোধগয়া ও সাঁচীর স্তুপগুলির উল্লেখ করা যায়। সাঁচীর প্রাচীনতম স্তুপটি সম্রাট অশোকের নির্মিত। অবশ্য খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকে এটিকে পুনর্নির্মিত করা হয়েছিল। এর আয়তন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছিল। স্তুপটির চারদিকে এই সময়েই প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। সাঁচীর এই স্তুপটি ভারতের বৃহত্তম স্তুপগুলির অন্যতম। খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকে পুনর্নির্মাণের পর স্তুপটির বনিয়াদের ব্যাস হয় ১২০ ফুট ও উচ্চতা হয় ৫৪ ফুট।

প্রশ্ন ৮। বিশ্বের একখানা মানচিত্রের বহিঃআকৃতি অঙ্কন করে বৌদ্ধধর্ম বিস্তৃতি লাভ করা অঞ্চলসমূহ চিহ্নিত কর। উপমহাদেশ হতে এই অঞ্চলসমূহের স্থল ও জলপথসমূহ বের কর।

উত্তরঃ 

বৌদ্ধধর্ম বিস্তারলাভ করা দেশসমূহ হল – 

(ক) ভারত। 

(খ) শ্রীলঙ্কা।

(গ) চীন। 

(ঘ) জাপান।

(ঙ) কোরিয়া। 

(চ) মায়ানমার।

(ছ) থাইল্যান্ড। ও 

(জ) ইন্দোনেশিয়া।

প্রশ্ন ৯। প্রাচীন ভারতের মন্দির স্থাপত্যবিদ্যার বিকাশের অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত আভাস দাও।

উত্তরঃ প্রাচীন ভারতে মন্দির স্থাপত্যবিদ্যার বিকাশের অগ্রগতির প্রধান বিষয়সমূহ নিম্নরূপ:

(ক) প্রাচীন ভারতে মন্দিরসমূহ সাঁচী স্তুপ বিকাশের প্রায় একই সময়ে উৎপত্তি হয়েছিল।

(খ) প্রাচীন মন্দিরসমূহের অধিকাংশই চতুরাকৃতি ক্ষুদ্র কক্ষের মতো ছিল যাকে গর্ভগৃহ বলা হত। এর একটিমাত্র ফটক ছিল, যার মাধ্যমে পুরোহিত পূজা করার জন্য মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করত।

(গ) মূল মন্দিরের উপর একটি লম্বা কাঠামো ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে উঠত। একে শিখর বলা হয়।

(ঘ) মন্দিরসমূহের দেওয়াল নানা প্রকার কারুস্থাপত্যে চিত্রায়িত ছিল।

(ঙ) প্রাচীন ভারতের কতিপয় মন্দির বিশাল পাথরে খোদিত ছিল যা দেখতে গুহার মতো মনে হয়। অষ্টম শতকের কৈলাশনাথ মন্দির এইরূপ একটি মন্দির। মন্দিরটি একটি সম্পূর্ণ পাহাড়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top