Class 11 Advanced Bengali Chapter 15 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)

Class 11 Advanced Bengali Chapter 15 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ) Question Answer | AHSEC Class 11 Advanced Bengali Question Answer to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapters Class 11 Advanced Bengali Chapter 15 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ) Notes and select needs one.

Class 11 Advanced Bengali Chapter 15 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)

Join Telegram channel

Also, you can read the SCERT book online in these sections Class 11 Advanced Bengali Chapter 15 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ) Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 11 Advanced Bengali Chapter 15 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ) Solutions for All Subjects, You can practice these here.

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)

Chapter: 15

ADVANCED BENGALI

রচনাভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

১। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন কী ? এই নির্দশনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 

অথবা, 

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘চর্যাপদাবলী’ গ্রন্থখানি অন্য কী নামে পরিচিত ? গ্ৰন্থখানিকে কে, কোথা থেকে উদ্ধার করে প্রকাশিত করেন ? এই গ্রন্থ সম্বন্ধে যা জান, লেখো।

অথবা, 

বাংলা ভাষার আদিতম গ্রন্থের নাম কী ? এই গ্রন্থ সম্পর্কে যা জানো সংক্ষেপে লেখো।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Join Now

উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে পুঁথিটি আবিষ্কার করেন। পুঁথিটিতে মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ পাওয়া গেছে। প্রত্যেক পদের শেষে বৌদ্ধ পণ্ডিত মুনিদত্ত সংস্কৃতে তার টীকা সংযোজিত করেছেন। চব্বিশজন পদকর্তা বা সিদ্ধাচার্য এই সমস্ত সাধন গুণ বিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন। প্রত্যেক পদের শেষে পদকর্তার নাম দেওয়া আছে বলে পদটির রচনাকার সম্বন্ধে জানা যায়। চর্যাপদের ভাষাতত্ত্ব আলোচনা করে ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রভৃতি পণ্ডিতেরা মনে করেন, এর রচনাকাল দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে হওয়াই সম্ভব। ভাষা ও ছন্দের দিক দিয়ে চর্যাপদ বাংলার নিকটতম। দুর্বোধ্য রহস্যময় ভাষায় এইপদগুলি রচিত হয়েছে। তাই চর্যাপদের ভাষা ‘সন্ধ্যাভাষা’ নামে পরিচিত। চর্যাপদে ফুটে উঠেছে সেই সময়ের দরিদ্র মানুষের জীবনকথা। যারা সমাজে ব্রাত্য, অন্তজ তাদের সামাজিক পারিবারিক চিত্রই চর্যাপদের মূল প্রতিপাদ্য।

২। কে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি রচনা করেন ? এই কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

অথবা, 

বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য সম্বন্ধে যা জানো লেখ।

উত্তরঃ বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি রচনা করেন।

প্রাকচৈতন্যযুগে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য বড় চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। কাব্যটি ১৯১৬ খ্রীঃ প্রকাশিত। বসন্তরঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় ১৩১৬ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাকিল্যা গ্রাম থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি আবিষ্কার করেন। এই কাব্যে মোট তেরোটি খণ্ড আছে। প্রথম খণ্ডটির নাম জন্মখণ্ড এবং শেষ খণ্ডটি ‘রাধাবিরহ’। কৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে কংসবধের জন্য কৃষ্ণরাধাকে ফেলে মথুরায় চলে যাওয়া পর্যন্ত কাহিনি এই কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। রাধা, কৃষ্ণ, বড়াই এই তিনটি চরিত্রই কাব্যের প্রধান কুশীলব। কাব্যে ব্যবহৃত ভাষা আদি মধ্যযুগের বাংলা। তাই এখনকার পাঠকের এই সব অর্থ বুঝতে কষ্ট হয়। কাব্যটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গেই কাব্যের প্রাচীনতা ও বড়চণ্ডীদাসের যথার্থ পরিচয় নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে যাই হোক আদি- মধ্যযুগের আদি রসাত্মক কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাংলা সাহিত্যে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে।

৩। কবি বিদ্যাপতি ও তাঁর রচিত কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, 

কবি বিদ্যাপতি সম্পর্কে যা জানো লেখ।

অথবা, 

কবি বিদ্যাপতি কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ? তাকে কি নামে অভিহিত করা হয় ? তাঁর রচিত কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ কবি বিদ্যাপতি বিহারের দ্বারভাঙ্গার মধুবনী মহকুমার অন্তর্গত বিসফী গ্ৰামে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে অভিনব জয়দেব ‘ নামে অভিহিত করা হয়।

বিদ্যাপতি মিথিলার শিবসিংহের সুহৃদ ছিলেন। বিদ্যাপতি বাঙালি নন, একছত্র বাংলা পংক্তি রচনা করেননি অথচ তার মাতৃভাষা মৈথিলীতে কাব্য রচনা করেও বাঙালির হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত আছেন। তাঁর অধিকাংশ কাব্য বিভিন্ন রাজাদের আদেশে লিখেছেন । তাঁর কাব্যগুলি হলো – ‘কীতিলতা’, ‘ভূপরিক্রমা’, ‘লিখনাবলী’, ‘শৈবসর্বস্বহার’, গঙ্গাবাক্যাবলী’, ‘বিভাগসার’, ‘দূর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ ইত্যাদি। কবি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির কর্ণধার ছিলেন । শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি মতের প্রতি তার সমদর্শিতা ছিল। দূর্গা, গঙ্গা, কালিকাকে ভক্তি নিবেদন করেও তিনি সংস্কৃত গ্রন্থাদি লিখেছিলেন।

৪। অনুবাদ সাহিত্য কাকে বলে ? বাংলা সাহিত্যের দুটি অনুবাদ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, 

চৈতন্যপূর্ববর্তী অনুবাদ সাহিত্যের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ খ্রীষ্ট্রীয় পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃত মহাকাব্যের যে অনুবাদরীতির ধারা প্রচলিত হয় তাকেই অনুবাদ সাহিত্য বলে। এই অনুবাদ সাহিত্য হুবহু আক্ষরিক অনুবাদ নয় বরং ভাবানুবাদ।

বাংলা সাহিত্যের দুটি অনুবাদ সাহিত্যের নাম ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’। চৈতন্য পূর্ববর্তী কালে এই দুটি মহাকাব্যের বাংলা অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। রামায়ণের বাংলা অনুবাদ করেন কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁর অনুদিত গ্ৰন্থের নাম ‘রামায়ণ পাঁচালী’। আদিকবি বাল্মীকির সপ্তকাণ্ডে বিভক্ত রামায়ণের বাংলা অনুবাদ করেন কৃত্তিবাস।বিষয়ের সঙ্গে কবির আত্মপরিচয়ও দিয়েছেন কাব্যে। প্রাকচৈতন্যযুগে কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী মহাভারতের সর্বজন খ্যাতি লাভ করেন। পরাগল খাঁ – বিদ্যোৎসাহীর আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর সংক্ষেপে মহাভারতের অনুবাদ করেন। শ্রীকর নন্দী বেদব্যাসের মহাভারত পরিত্যাগ করে জৈমিনি – ভারত অবলম্বনে মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব  অনুবাদ করেন।

৫। কবি কৃত্তিবাসের আবির্ভাবকাল, জীবনী ও রচিত কাব্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

অথবা, 

‘রামায়ণ’ এর শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি কে ? অনুবাদক হিসেবে তাঁর কবি-কৃতিত্বের পরিচয় দাও।

অথবা, 

রামকথা অবলম্বন করে বাংলা ভাষায় কে প্রথম কাব্য রচনা করেন ? তাঁর গ্রন্থখানির নাম কী ? তাঁর কবি প্রতিভা সম্বন্ধে লেখো।

উত্তরঃ কবি কৃত্তিবাসের আবির্ভাবকাল সম্পর্কে কাব্যে উল্লেখ রয়েছে।” “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী  পূর্ণ মাঘ মাসে” অর্থাৎ মাঘ মাসের শেষদিনে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রবিবারে কৃত্তিবাসের জন্ম হয়। ১৩৮৬-৯৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই তাঁর জন্ম হয় বলে পণ্ডিতদের অভিমত।

রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝার ‘রামায়ণ পাঁচালী’ থেকে জানা যায় পদ্মাপারের উত্তর দেশে বিদ্যার্জনের পর গৌড়েশ্বরের দরবারে উপস্থিত হন এবং গৌরেশ্বরের সমাদর  লাভ করেন। তারপর তিনি বাল্মীকির রামকাহিনি অবলম্বনে ‘রামায়ণ পাঁচালী’ রচনা করেন। কাহিনি বর্ণনায় তিনি কিছু প্রক্ষেপ ও পরিমার্জন করেছেন। পয়ার ত্রিপদী ছন্দে তিনি বাল্মীকি রামায়ণের মূল কাহিনিটিকে অতি সংক্ষেপে বিবৃত করেছেন। অবশ্য তিনি মূল বাল্মিকী রামায়ণ ছাড়াও অন্যান্য রামায়ণ ও সংস্কৃত কাব্যাদি থেকে অনেক কাহিনি গ্রহণ করেছিলেন। কৃত্তিবাস বাঙালী জনসাধারণের উপযোগী করে পাঁচালী ঢঙে মূল রামায়ণকে  পরিবেশন করেছেন। মূল রামায়ণের বীর রামচরিত্র কৃত্তিবাসী রামায়ণের ভক্তের ভগবানে পরিণত হয়েছেন। ক্ষত্রিয়বধূ সীতা হয়েছেন সর্বংসহা বাঙালী কুলবধূ, হনুমানের রঙ্গরস প্রভৃতিও বাঙালী সংস্কৃতিরই পরিচায়ক। অর্থাৎ কৃত্তিবাস মূল রামায়ণকে অনেকটা বাঙালীর মনের প্রকৃতির অনুকূলে সাজিয়েছেন। রাম-লক্ষণ-সীতা বাঙালীর ঘরের মানুষ হয়ে গেছেন।

৬। মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদকের নাম কি ? তাঁর রচিত কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, 

কবি কাশীরাম দাস ও তাঁর কাব্য সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করো। 

উত্তরঃ মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস। তাঁর পৈতৃক উপাধি ছিল দেব। বিশালাকায় সংস্কৃত মহাভারতকে কবি কাশীরাম দাস বাঙালীর উপযোগী করে নতুনরূপ দিয়েছেন। কাব্য থেকে কবির সম্বন্ধে কিছু-কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম কমলাকান্ত। তারা তিনভাই। কৃষ্ণরাম, কাশীরাম ও গদাধর। কাশীরামের অনুজ গদাধরের পুত্রের নাম নন্দরাম দাস।

মূল মহাভারতের আদি, সভা, বন ও বিরাটের খানিকটা এই মোট চার পর্বে কবি কাশীরাম দাস সংক্ষেপে মূল কাহিনিকে অনুসরণ করেছেন। 

দু – এক জায়গায় দু-একটি আখ্যান তিনি নিজে বানিয়ে নিয়েছেন। কাহিনির সঙ্গে-সঙ্গে কোথাও কোথাও তত্ত্বও নীতিকথাগুলিকে প্রায় হুবহু অনুবাদ করেছেন। তৎসম শব্দ ও সমাস-সন্ধির বাড়াবাড়ি তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। কাশীদাসী মহাভারতের ঠিক ততটা বাঙালিয়ানা দেখা না গেলেও কাশীরামের বিনয়াবনত বৈষ্ণব মনটি রচনার মধ্যে অকৃত্রিমভাবেই ধরা পড়েছে।

৭। ভাগবতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে ? তাঁর কাব্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর।

অথবা, 

মালাধর বসু কে ? তাঁর কাব্য সম্পর্কের্যা জান লিখ।

উত্তরঃ ভাগবতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হলেন মালাধর বসু। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’। মালাধর বসু ভাগবতের দশম এবং একাদশ স্কন্দের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেন।

১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি এই কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি চৈতন্য-পূর্ব যুগেই রচিত হয়। দশম স্কন্দে কৃষ্ণজন্ম থেকে দ্বারকালীলা পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। একাদশ স্কন্দে বর্ণিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের তনুত্যাগ ও যদুবংশ ধ্বংসের ঘটনা। এছাড়াও গ্রন্থে নানা তত্ত্বকথা, ধমতত্ত্ব কৃষ্ণের আলোচনার মারফতে বর্ণিত হয়েছে। কাহিনির দিকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলেই গ্রন্থে তত্ত্বাংশ অনেকটা খর্ব হয়েছে। পয়ার ত্রিপদীতে ঘটনাবস্তু বিবৃত হয়েছে। সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ করলেও কোন-কোন স্থানে বাঙালীর ঘরের কথাকেও তিনি তাঁর রচিত গ্ৰন্থে স্থান দিয়েছেন। চৈতন্যদেবের প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজ ও সাহিত্যে যে নবজাগরণের শুরু হয় তার কিছু আভাস শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ে আছে।

৮। মঙ্গলকাব্য কাকে বলে ? বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যের উল্লেখ করো। 

অথবা, 

মঙ্গলকাব্যকে মঙ্গল বলা হয় কেন ? মঙ্গল কাব্য কত প্রকার ? কয়েকটি মঙ্গলকাব্যের উল্লেখ করো।

উত্তরঃ বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা প্রচার সম্বন্ধীয় একপ্রকার আখ্যানকাব্যকে মঙ্গলকাব্য বলে। ‘চণ্ডীমঙ্গল’, ‘মনসামঙ্গল’, ‘ধর্মমঙ্গল’, ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে পরিচিত মঙ্গলকাব্য। এইসব মঙ্গলকাব্যের দেব-দেবীরা অনেক পূর্ব থেকে ছড়ায়, পাঁচালীতে, মেয়েলী ব্রত কথায় নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চদশ শতক থেকে কয়েকজন কবির কৃতিত্বে নির্মিত হয় মঙ্গলকাব্য। মানুষের মঙ্গল কামনায় এই কাব্যগুলি পড়া হত বলেই এই কাব্যগুলিকেই মঙ্গল বলা হত। আবার কেউ-কেউ মনে করেন এক মঙ্গলবার থেকে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত এই কাব্যগুলি পড়া হতো বলে হয়ত তাই এই কাব্যগুলিকে মঙ্গলকাব্য বলা হয়। চণ্ডী, মনসা, ধর্ম, পঞ্চানন প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবী বাঙালীর আর্যেতর সংস্করণ বহন করে চলেছে মঙ্গলকাব্যে। মঙ্গলকাব্যের খানিকটা অংশে দেবকাহিনি এবং বাকি অংশে মর্ত্যকাহিনি বর্ণিত হয়। তাই মঙ্গলকাব্যগুলি মোটামুটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত থাকে।

৯। মনসামঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি কে? তাঁর কবি কৃতিত্বের পরিচয় দাও।

অথবা, 

কবি বিজয়গুপ্ত ও তাঁর রচিত মনসামঙ্গল কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদান কর।

উত্তরঃ বাংলায় মনসামঙ্গল কাব্যের তিনটি ধারা। পূর্ববঙ্গ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি বিজয়গুপ্ত। বরিশাল জেলার আধুনিক গৈলা গ্রামে বিজয়গুপ্ত জন্ম হন। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। পিতার নাম সনাতন। জননী রুক্মিনী। ১৩০৩ সালে সর্বপ্রথম বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’ ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। এই কাব্যের ভাষা অনেকটা আধুনিক। তাঁর কাব্যের মনসার ঈর্ষাকুটিল বিষাক্ত চরিত্রটি মোটামুটি মন্দ হয়নি। শিবের হাস্যকর ভাড়ামি ধুলি-ধূসর মঙ্গলকাব্যের আদর্শকে স্মরণ করিয়ে দেয়। চাঁদসদাগরের চরিত্রে প্রচণ্ড পৌরুষের সঙ্গে স্থূলতার সমাবেশ এর মহিমা ক্ষুন্ন হয়েছে। বেহুলার চরিত্রাঙ্কনে কবি সমস্ত মাধুর্য ও মহিমা ঢেলে দিয়েছেন। স্থূল রঙ্গরসে বৈদ্য কবির কৃতিত্ব লক্ষ্য করা যায় এই কাব্যে।

১০। মনসামঙ্গল কাব্যধারার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করো।

উত্তরঃ বাংলায় মনসামঙ্গলের তিনটি ধারা দেখা যায়।

(১) রাঢ়ের ধারা – (বিপ্রদাশ, কেতকাদাশ ক্ষেমানন্দ, সীতারাম দাস, রসিব মিশ্র প্রমুখ)

(২) পূর্ববঙ্গের ধারা যাতে ‘পদ্মপুরাণ’ রচিত হয়। (নারায়ণদেব, বিজয়গুপ্ত প্রভৃতি)

(৩) উত্তরবঙ্গ ও কামরূপের ধারা (তন্ত্র-বিভূতি, জগজ্জীবন ঘোষাল প্রভৃতি) কাহিনির দিক থেকে উত্তরবঙ্গের ধারা একটু পৃথক। এতে ধর্মমঙ্গলের বেশ প্রভাব আছে। কেউ-কেউ মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনির মধ্যে মঙ্গলকাব্যের লক্ষণ ও ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন।

১১। শ্রীমঙ্গল কাব্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করো। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি কে ? তার কৃতিত্ব ও কাব্য সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, 

কালকেতু ফুল্লরার কাহিনি কোন মঙ্গলকাব্যের অন্তর্গত ? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি কে ? তাঁর সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র অঙ্কন কর।

উত্তরঃ ষোড়শ শতাব্দীর মধ্য আবির্ভূত তিনজন কবি মানিকদত্ত, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও মাধব আচার্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্যকে ব্রতকথার সংকীর্ণতা থেকে উদ্ধার করে মঙ্গলকাব্যে মর্যাদা দেন।

চণ্ডীমঙ্গল কখনো ‘ভবানীমঙ্গল’ আবার কখনো ‘অভয়ামঙ্গল’ নামেও খ্যাত। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দুটি খণ্ড লক্ষ্য করা যায়। একটি আখেটিক খণ্ড অর্থাৎ ব্যাধ কালকেতুর গল্প আর একটি বণিক খণ্ড অর্থাৎ বণিক ধনপতি সদাগরের কাহিনি।

‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী। তাঁর কাব্য সাধারণতঃ ‘অভয়ামঙ্গল’ নামে পরিচিত। কাব্যের গোড়ার দিকে আত্মকাহিনি সংযোজন করেন। তাঁর জীবন ও তৎকালীন রাষ্ট্রসংকটের নির্মম বাস্তব চিত্র অতি নিষ্ঠার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনা ও বিস্তারে তাঁর কাব্যের কালকেতু – ফুল্লরা – ভারুদত্ত, লহনা – ফুল্লনা, দুর্বলা-শ্রীমন্ত প্রভৃতি চরিত্রগুলি আমাদের প্রতিবেশী ও অতি পরিচিত চরিত্র বলে মনে হয়। পশুদের মুখের কথায় পরোক্ষভাবে ফুটে ওঠেছে বাংলার সমাজ জীবন। মুঘল- পাঠানের বিরোধের কথাও কাব্য ইঙ্গিতে বিদ্যমান। সরল পরিহাস, সুখ-দুঃখের ছোট-ছোট ছবি, হাসি কান্নার ধূপছায়া প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য মুকুন্দরামের কাব্যকে বিশেষত্ব করে তুলেছে।

১২। ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের কাহিনির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

অথবা, 

ধর্মমঙ্গল কাব্য ও কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করে যে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে তাকেই ধর্মমঙ্গল কাব্য বলে।

উল্লেখ্য, রাঢ় দেশে ধর্মঠাকুর এখনো জাগ্রত দেবতা। সমস্ত ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনি দেখা যায়।

(১) রাজা হরিশচন্দ্রের গল্প। এবং 

(২) লাউসেনের গল্প। 

হরিশচন্দ্রের কাহিনিতে দেখা যায়, রাজা হরিশচন্দ্র নিঃসন্তান ছিলেন, ফলে তাদেরকে সকল প্রজারা অবজ্ঞা করত। রাজা-রাণী প্রজাদের কাছে অবজ্ঞা পেয়ে মনের দুঃখে রাজ্য ত্যাগ করেন। তাঁরা বল্লুকা নদীর তীরে এসে দেখলেন লোক জড় হয়ে ধর্মঠাকুরের পূজা করছেন, তখন তাঁরাও শেখানে ধর্মঠাকুরের উপাসনা করতে লাগলেন। ধর্মঠাকুরের আশীর্ব্বাদে তাদের একটি পুত্র সন্তান হয়। তবে প্রতিজ্ঞা করতে হল পুত্র জন্মলাভের পর ধর্মের কাছে বলি দিতে হবে, তাতেই দম্পতি রাজী হলেন কারণ তাতে আঁটকুড়ো নামটি মুছবে। পুত্রসন্তান জন্মের পর রাজারাণী প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যান। ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণবেশে উপস্থিত হয়ে রাজপুত্রের মাংস খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ে যায়। 

তারা রাজপুত্র লুইচন্দ্রকে কেটে ব্যঞ্জণ তৈরি করে ব্রাহ্মণকে দেন। তখন ধর্মঠাকুর তাদের প্রতিজ্ঞা রক্ষণের নিষ্ঠা দেখে নিজ মূর্তি ধরে রাজপুত্রকে ফিরিয়ে দেন। লাউসেনের অদ্ভূত বীরত্বের কাহিনিকে কেন্দ্র করে এ অংশ রচিত। অত্যন্ত বিশজন কবি ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু কারো মধ্যে মৌলিক প্রতিভার বড়ো একটা চিহ্ন পাওয়া যায়না। ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদিকবি ময়ূর ভট্ট। সপ্তদশ শতাব্দীর ধর্মমঙ্গল কবিদের মধ্যে রূপরামচক্রবর্তীর খানিকটা প্রতিভা ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে মোট চারজন কবি ধর্মমঙ্গল কাব্যে হস্তক্ষেপ করেছেন। এঁরা হলেন – রূপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, সীতারাম দাস এবং যদুনাথ রায়। রূপরাম চক্রবর্তী প্রথম লাউসেনের কাহিনিকে ছড়া, পাঁচালী ও ব্রতকথার সংকীর্ণ সীমা থেকে উদ্ধার করে মঙ্গলকাব্যের আকার দিয়েছেন।

১৩। বাংলা সাহিত্য ও সমাজজীবনে চৈতন্যদেবের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তরঃ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে বাংলার সাহিত্য ও সমাজ জীবনে ঐশ্বর্যের ধারা গভীর ভাবে বিকশিত হয়। ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও নৈতিক প্রয়োজনই চৈতন্যাবতারের আবির্ভাব হয়েছিল। চৈতন্য আদর্শ বাংলার সমাজ জীবনে এক নতুন চিন্তাধারার সূচনা করে যা বাংলার সমাজে চৈতন্য – রেঁনেসাঁস নামে পরিচিত।

চৈতন্য জীবনকথা নিয়ে রচিত জীবনী কাব্য বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার উন্মেচন করে। চৈতন্য জীবনী কাব্যগুলির মধ্যে বৃন্দাবন দাসের ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, লোচনাদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ ইত্যাদি’। শ্রীচৈতন্যের মানব মূর্তি ও ভাগবত মূর্তির ও যথাযথ বর্ণনা বয়েছে এই 

জীবনকাব্যগুলির মধ্যে। কবিদের বর্ণনায় সমসাময়িক গৌড়ের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চৈতন্যদেবের তিরোধান সম্পর্কে বিভিন্ন কাব্যে ভিন্ন তথ্য বর্ণিত হয়েছে। চৈতন্য-ধর্ম-দর্শন তত্ত্বকথার সার চৈতন্যজীবনী কাব্যে অত্যন্ত দক্ষতায় বর্ণিত হয়েছে। চৈতন্যদেবের প্রভাবে সাধ্যসাধনার নতুন তত্ত্ব সূচিত হয়।

১৪। বাংলাভাষায় চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, 

কবি বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’ সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো ।

অথবা, 

শ্রীচৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে রচিত যে কোন দুটি জীবনী কাব্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

উত্তরঃ বাংলা ভাষায় চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলি হল বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’ কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ লোচন দাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, গোবিন্দদাসের ‘কড়চা’, চূড়ামণিদাসের ‘গোবিন্দবিজয়’ ইত্যাদি।

চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলির মধ্যে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত কাব্যই সুপরিচিত, জনপ্রিয় এবং কাব্যগুণান্বিত। এই কাব্যের নাম প্রথম ছিল ‘চৈতন্যমঙ্গল’। পরে তাঁর মায়ের আদেশে কাব্যটিকে ‘চৈতন্যভাগবত’ নামকরণ করেন। ‘চৈতন্যভাগবত’ তিনটি খণ্ডে এবং ৫১টি অধ্যায়ে বিভক্ত। যথা- আদিখণ্ড (পনেরো অধ্যায়), মধ্যখণ্ড (ছাব্বিশ অধ্যায়), অন্ত্যখণ্ড (দশ অধ্যায়)। চৈতন্যের জীবনকথা, চৈতন্যধর্ম সম্প্রদায় ও চৈতন্য প্রবর্তিত ভক্তির কথা বৃন্দাবন দাস তার কাব্যে সরলভাবে বর্ণনা করেছেন। ‘চৈতন্যভাগভতে’ শুধু শ্রীচৈতন্যের জীবনলেখ্য বর্ণিত হয়নি, সমসাময়িক গৌড়ের সামাজিক, রাষ্ট্রিয় ও সাংস্কৃতিক চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যে গৌড়, উৎকল, বৃন্দাবন, দক্ষিণভারত এই সমস্ত অঞ্চলের ভক্তিধর্ম ও দার্শনিকতাকে তিনি অত্যন্ত দক্ষতায় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এই কাব্যটি তিনটি খণ্ডে মোট বাষট্টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। তিনি কাহিনি বাদ দিয়ে গেলেও তিনি বৈষ্ণবদর্শন, ভক্তিশাস্ত্র ও চৈতন্যতত্ত্ব নিয়ে গুরুতর আলোচনায় মত্ত হলেন মে গ্রন্থের আয়তন বেড়েই চলল। অন্তখণ্ডে তিনি দিব্যোন্মাদ দশাগ্রস্থ চৈতন্যদেবের অন্তর্জীবনের ক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবরসের উদ্ঘাটন করলেন।

১৫। চৈতন্যোত্তর যুগের দুইজন বৈষ্ণব কবির কবিকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, 

যে কোন একজন বৈষ্ণব পদকর্তা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা,

বৈষ্ণবপদাবলী- সাহিত্যে জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাসের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা কারো।

উত্তরঃ চৈতন্যোত্তর যুগের বৈষ্ণব পদকর্তা জ্ঞানদাস বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞানদাসের ভণিতাযুক্ত প্রায় চারশপদ প্রচলিত। ব্রজবুলি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই তিনি পদ লিখেছেন। তবে তাঁর যা কিছু প্রতিভা কবিকৃতি ও গৌরব সব বাংলা পদের উপর নির্ভর করছে। জ্ঞানদাসের দুটি একটি বাৎসল্যরসের পদ ভারি চমৎকার। জ্ঞানদাস পদ রচনায় চণ্ডীদাসকে অনুসরণ করতেন। তাই তাঁর পদের রাধা-কৃষ্ণের সঙ্গে চণ্ডীদাসের রাধাকৃষ্ণের মিল রয়েছে।

গোবিন্দদাস পদ রচনা করেছেন বিদ্যাপতির পদাঙ্ক অনুসরণ করে। গোবিন্দদাসের শ্রেষ্ঠ পদগুলি ব্রজবুলিতে রচিত। গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ভাব ও ভাষাকে আত্মস্থ করে তার সঙ্গে চৈতন্যযুগের ভাবাদর্শকে মিলিয়ে এক অভিনব গীতিধারা সৃষ্টি করলেন। চৈতন্যদেবকে অবলম্বন করে লেখা তার গৌরচন্দ্রিকার পদ এখনও কীর্তনীয়াদের প্রধান অবলম্বন। গোবিন্দদাসের রাধার দেহের সঙ্গে আছে হৃদয়ের অতল রহস্যব্যঞ্জনা, গভীর আর্তি, সান্ত্বনাহীন বিরহ, মিলনের উল্লাস এবং তার সঙ্গে অর্মত্যচারী আকাঙ্খার ঊর্ধ্বগতি

গোবিন্দদাসের রাধাকে বিদ্যাপতির রাধার চেয়ে স্বতন্ত্র মহিমা দিয়েছে। গোবিন্দ দাসের সাধনা মঞ্জরীভাবের সাধনা। তাই তার বহুপদে শ্রীরাধা-কৃষ্ণকে সেবা করার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে।

১৭। চৈতন্যদেবের জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, 

বাংলা সাহিত্যের কোন যুগকে চৈতন্যযুগ বলা হয় ? চৈতন্যদেবের জীবনী সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

উত্তরঃ মধ্যযুগকে বাংলা সাহিত্যের চৈতন্যযুগ বলা হয়। ভক্ত কবিদের চৈতন্যজীবনী কাব্য থেকে চৈতন্যদেবের অপূর্ব কাহিনির বেশ পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমি শ্রীহট্ট। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন বৈদিক ব্রাহ্মণ। তিনি বিদ্যার্জনের জন্য নবদ্বীপে বসবাস করেন এবং এখানেই শচীদেবীকে বিয়ে করে এদেশেই থেকে যান। তাঁদের প্রথম সন্তান বিশ্বরূপ অল্প বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। তারপর তাদের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান ১৪০৭ বঙ্গাব্দের ২৩ ফাল্গুন জন্ম নেয়। ইনিই বাল্যকালে নিমাই, যৌবনে গৌরাঙ্গ ও সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীচৈতন্য নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ভক্তরা তাঁকে মহাপ্রভু বলে ডাকতেন। মাত্র তেইশ বছর বয়সে ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দে পিতৃপিণ্ড দিতে তিনি গদাধামে গিয়েছেন। 

১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অদ্বৈত ও নিত্যানন্দের ওপর বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের ভার দিয়ে নিজে পুরীধামে যাত্রা করলেন এবং ভক্তিপথ গ্রহণ করলেন। গৌড়ের কাছে রামকেলিতে এসে তার দুই প্রসিদ্ধ ভক্ত লাভ হয়। এরা হলেন সনাতন ও রূপ। ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি পুরীধামে অবস্থান করেন এখানেই তার তিরোধান হয়। এই আঠারো বৎসরের মধ্যে তিনি অধিকাংশ সময় দিব্যভাবে বিভোর হয়ে থাকতেন। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কোন প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন কবি তাঁদের কাব্যে ভিন্ন মত পোষণ করেন। জয়ানন্দ বলেছেন, “যখন চৈতন্যদেব পুরীধামে রথযাত্রার উৎসবে আষাঢ় মাসে রথের অগ্রভাগে নাচতে নাচতে বিভোর হয়ে থাকেন। তখন তার বাম পায়ে ইটের টুকরো বিধে যায়। কয়েকদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়।” আবার কেউ বলেন, তিনি জগন্নাথের শরীরে লীন হয়ে যান।

১৮। শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি কে ? তাঁর রচিত পদাবলী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

অথবা, 

কবি রামপ্রসাদ ও তাঁর শাক্ত পদাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে শক্তি অর্থাৎ উমা-পার্বতী-দূর্গা-কালিকাকে কেন্দ্র করে যে গান রচিত হয় তাকে শাক্তগান কিংবা শাক্তপদাবলী বলে। এই পদের কবিগণ সাধক ও কবি।

শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ অংশের নাম ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’। মা দুর্গাকে কেন্দ্র করে এই সমস্ত গান রচিত হয়েছিল। রামপ্রসাদ সেন শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি। নিজের গানে তিনি সহজ, সাদা-মাঠা সুর দিতেন, তার গানগুলিকে ‘রামপ্রসাদী’ সঙ্গীত বলা হয়। রামপ্রসাদ ‘কালীকীর্তন’ ও ‘কৃষ্ণকীর্তন’ নামে দুখানি কাব্য লিখেছেন। প্রথমে মুদ্রিত রামপ্রসাদের পদাবলীর সংখ্যা ছিল প্রায় একশো। এখন তা বেড়ে-বেড়ে প্রায় তিনশোয়ে দাঁড়িয়েছে। এই গানগুলির মধ্যে কয়েকটা স্তর লক্ষ্য করা যায় –

(১) উমাবিষয়ক (আগমনী ও বিজয়া)।

(২) সাধন বিষয়ক (তন্ত্রোক্ত সাধনা)।

(৩) দেবীর বিরাট স্বরূপ-বিষয়ক।

(৪) তত্ত্বদর্শন ও নীতি বিষয়ক।

আদ্যাশক্তির স্বরূপ এবং তার সঙ্গে কবির বাৎসল্যরসের যে চিত্র উদঘাটিত হয়েছে, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই।

১৯। মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনিটি সংক্ষেপে বিবৃত করো। এই ধারার অন্যতম কবি নারায়ণদেবের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

অথবা, 

‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কাহিনীটি সংক্ষেপে বিবৃত করো। এই ধারার যে কোনো একজন কবির কৃতিত্ব আলোচনা করো।

উত্তরঃ মঙ্গলকাব্য সমূহের মধ্যে মনসামঙ্গল কাব্যের জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। সর্প পূজাকে কেন্দ্র করে মনসামঙ্গল কাব্যের সৃষ্টি। দেবী মনসা শিবের কন্যা। জরৎকারু তাঁর স্বামী এবং আস্তিক মুনি তাঁর পুত্র। পাতালের নাগপুরী হতে তিনি পিতা শিবের নিকটে আসেন।

শিবের আদেশ ছিল চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করলে মর্তলোকে মনসার পূজা প্রচারিত হবে। কিন্তু শৈব চাঁদ সদাগর মনসার পূজা দিতে নারাজ। অথচ চাঁদ পূজা না দিলে পৃথিবীতে মনসার পূজা প্রচারিত হবে না। সুতরাং দেবী মনসার সাথে চাঁদের বাধল বিবাদ। চাঁদের ছয় পুত্রের মৃত্যু হল সর্পাঘাতে। চাঁদ সদাগরের বাণিজ্য তরী ‘সপ্তডিঙা মধুকর’ হল জলমগ্ন। অল্পকাল মধ্যে ধন সম্পদ হারিয়ে চাঁদ রিক্ত হয়ে পড়লেন।

ইতিমধ্যে চাঁদ সদাগরের সপ্তম পুত্র লখিন্দর জন্মগ্রহণ করে। নির্দিষ্ট সময়ে নিছনি নগরের সদাগর সায়বেনের কন্যা বেহুলার সাথে তার বিবাহ হয়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস বাসর রাতে সর্পাঘাতে লখিন্দরের মৃত্যু হয়। বেহুলা অসতির অপবাদ দূর করতে এবং মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরে পেতে স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে ভেলায় গঙ্গার স্রোতে ভাসে। নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে অবশেষে বেহুলা মনসা সহচরি নেতা ধোপানীর সাহায্যে স্বর্গ রাজ্যে উপস্থিত হন। নৃত্যগীতে তিনি স্বর্গের দেবতাদের সন্তুষ্ট করেন। শিবের আদেশে তখন মনসা বেহুলার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। চাঁদ সদাগরের ছয় পুত্র, মাঝি মাল্লারাও পুনরুজ্জীবিত হয়। সপ্তডিঙা মধুকর ভেসে ওঠে। পুত্রবধূ বেহুলার একান্ত অনুরোধে চাঁদ সদাগর শেষ পর্যন্ত বামহাতে মনসার পূজা দেন। অতঃপর মর্ত্যলোকে মনসার পূজা প্রচলিত হয়।

মনসামঙ্গল কাব্যধারায় নারায়ণদেব একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার বোর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত কাব্যের নাম ‘পদ্মপুরাণ’। একমাত্র তাঁর কাব্যই বাংলা ও অসমে প্রচার লাভ করে। কবি একদা কিছুদিন শ্রীহট্টেও ছিলেন। তিনি পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্তমান ছিলেন। নারায়ণদেব কিছুটা পুরাণ ঘোষা কবি ছিলেন। তাই তিনি লৌকিক মনসা কাহিনির চেয়ে পৌরাণিক দেবদেবীর লীলার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। চরিত্র সৃষ্টি, রসবৈচিত্র্য ও কাহিনি গ্রন্থনে নারায়ণদেব, বিজয় গুপ্ত এবং বিপ্রদাস পিপিলাই, এদের চাইতেও অনেক বেশি উঁচুতে। নারায়ণদেব ‘সুকবি বল্লভ’ নামে খ্যাত। তাঁর কাব্য বর্ণনায় সূক্ষ্ম কারুকার্য না থাকলেও গাম্ভীর্যপূর্ণ ছিল।

২০। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরাকান রাজসভার কবিদের কাব্য রচনার গুরুত্ব কোথায় ? এই রাজসভার দুজন প্রধান কবির নাম লেখো। এঁদের মধ্যে যে কোনো একজনের কবি প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তরঃ বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সীমান্ত রাজ্য ছিল আরাকান। আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে সপ্তদশ শতকে নতুন এক শ্রেণির সাহিত্যের সূত্রপাত হয়। এই রাজ্যের রাজাগণ কাব্যচর্চায় উৎসাহী ছিলেন। আরাকান রাজসভার সাহিত্যের প্রধান বিশেষত্ব ধর্ম সম্পর্কিত সংকীর্ণতা আর ধর্ম বিদ্বেষের চিহ্ন নেই – এ সাহিত্যে যদিও বাংলার অন্যত্র তখন চলছে ধর্ম নির্ভর সাহিত্যচর্চা। মানব প্রাধান্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখে ছিল বলে সেখানে প্রাধান্য পেত দেবমহিমা।

সাহিত্যের এই শূন্যতা পূরণ করেন আরাকান রাজসভার মুসলমান কবিগণ। এই কবিরা আরবি, ফারসি, হিন্দি নানা ভাষা থেকে বহু আখ্যান বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন বলে মধ্যযুগীয় গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত হয়ে এ সাহিত্য হয়েছিল সমৃদ্ধ। লোক জীবনের রোমান্টিক প্রণয় গাথা এই কাব্যগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

মুসলমানগণ এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে উঠলেও তাদের সাহিত্য ছিল উপেক্ষিত। কোন দেশের জনসমাজের একটি বড়ো অংশ যদি সাহিত্যে উপেক্ষিত হয় তাহলে সে দেশের সাহিত্য কখনও জাতীয় সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না। আরাকান রাজদরবারের কবিগণ মুসলিম সংস্কৃতি ও ব্যক্তি জীবনকে সাহিত্যে স্থান দিয়ে এ ত্রুটি থেকে বাংলা সাহিত্যকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এইসব কারণে আরাকান রাজসভার সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।

এই রাজসভায় দুজন প্রধান কবি হলেন – দৌলত কাজী ও সৈয়দ আলাওল । দৌলত কাজী – দৌলত কাজী আরাকান রাজ শ্রীসুধমার রাজত্বকালে তাঁর প্রধান আমত্য অসরফ খাঁর আদেশে ‘সতীময়না’, ‘লোরচন্দ্রাণী’ কাব্যটি রচনা করন। তবে তিনি কাব্যটি শেষ করে যেতে পারেন নি। তার পূর্বেই তাঁর মৃত্যু হয় পরবর্তীকালে সৈয়দ আলাওল কাব্যটি সম্পূর্ণ করেন। দৌলত কাজীর ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবে তিনি যে চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন এবং রোসাঙ্গের রাজসভায় কবি হিসেবে সম্বর্ধিত হয়েছিলেন এ কথা নানা সূত্র থেকে জানা যায়। হিন্দী ভাষী এক কবির রচিত ‘মেনা কো সত্‌’ কাব্যকে অবলম্বন করে দৌলত কাজী তাঁর ‘সতীময়না’ কাব্যটি রচনা করেন।

রাজপুত লুর ও তাঁর সতীসাধ্বী পত্নী ময়নামতী সুখে সংসার করেন। এক সময় লোর ময়নামতীর উপর রাজ্যের ভার অর্পণ করে কানন বিহারে যান। সেখানে এক যোগীর কাছে গোহারী দেশের রাজকন্যা চন্দ্রাণীর রূপের কথা শুনতে পান। চন্দ্রাণীর স্বামী বামন মৃগয়ায় গেলে লোর একদিন চন্দ্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক জন্মে। লোর প্রেমিকা চন্দ্রাণীকে নিয়ে পলায়ন করে কিন্তু পথি মধ্যে চন্দ্ৰাণীর স্বামী বামনের সঙ্গে যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে বামনের মৃত্য। হয়। গোহারী রাজের অনুরোধে লোর চন্দ্রাণীকে বিবাহ করে সে দেশের রাজা হন।

এদিকে ময়নামতী স্বামীর খোঁজে চারদিকে লোক পাঠালেন। ময়নামতি তাঁর সতীত্বের নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় দিন কাটাতে লাগলেন। অনেকদিন পর স্বামীর খোঁজ পেয়ে এক ব্রাহ্মণকে সেখানে দূত করে পাঠালেন, বহুদিন পর লোর চন্দ্রাণীকে নিয়ে দেশে ফিরলেন। অতঃপর দুই সতীন স্বামীকে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগলেন । এই হলো কাব্যখানি মূল বিষয়। দৌলত কাজীর রচনার রীতিতে ক্লাসিক ও রোমান্টিক রীতির সুষম মিশ্রণ লক্ষিত হয়।

২১। বাংলা সাহিত্যে ‘চর্যাগীতি’র ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক মূল্য নির্ধারণ করো।

উত্তরঃ বাংলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ। এই গ্রন্থটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য ঐতিহাসিক।

বঙ্গদেশে এক সময়ে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের যে প্রচলন ছিল তার প্রামাণ্য গ্রন্থ এই চর্যাপদ । দেহ সাধনাকে মূলধন করে বৌদ্ধ সাধক সম্প্রদায় দেহজ কামনা বাসনা থেকে মুক্তির মে তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তার ইঙ্গিত এই গ্রন্থটির প্রতি পদে পদে বিবৃত। এই কারণে গ্ৰন্থটি ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক দলিল হিসেবে চর্যাপদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা চলে। এক বিশেষ সময়ে বঙ্গদেশের সামাজিক ইতিহাস এই গ্রন্থটির নানা পদে বিভিন্ন রূপক সংকেতের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। সেই সময়ের অন্ত্যজ মানুষের জীবনযাত্রার নানা পরিচয় পদগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। খাদ্যদ্রব্যের যে পরিচয় পদগুলিতে পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, ভাত ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। সঙ্গে লাউ, মাছ, মাংস, তেঁতুল, দুখ এবং মধুও তাদের খাদ্য ছিল। বাসস্থানের ব্যাপারে দেখা যায় যে দরিদ্ররা কুঁড়ে ঘরে এবং সমাজের ধনীশ্রেণীর মানুষ দু’মহলা তিন মহলা ঘরে বাস করত। সমাজের ডোমের বাস ছিল নগরের বাইরে। ঘরে নিদারুণ দারিদ্র্য, হাড়িতে ভাত নেই কিন্তু প্রতিদিনই অতিথি আসে। আবার এরই পাশাপাশি ধনী ব্যবসায়ীরাও যে সেকালে আসর জমাত তার পরিচয়ও রয়েছে। তৎকালীন সময়ের নানা উৎসব অনুষ্ঠানের কথাও চর্যাপদে দেখা যায় । সে সময়ের বিবাহ বর্ণনা, শিকার করা, দাবা খেলা, নাট্যাভিনয় ইত্যাদির নানা পরিচয় চর্যাপদে পাওয়া যায়। তৎকালীন নদীমাতৃক বঙ্গদেশ, পর্বত ও অরণ্যাশ্রিত বঙ্গদেশের পরিচয় জানা যায় এই চর্যাপদ গ্রন্থটি থেকেই। এক বিশেষ সময়ের ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ঐতিহাসিক দলিল জানা যায় এই চর্যাপদ গ্রন্থটি থেকেই। এক বিশেষ সময়ের ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ঐতিহাসিক দলিল এই চর্যাপদ গ্রন্থটি।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘চর্যাপদ’ এক বিশেষ নির্দেশক। মহামহোপধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই পুথিটি আবিষ্কার করে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের লুপ্ত সম্পদকেই শুধু উদ্ধার করেননি, এক ঐতিহাসিক সম্পদ হিসেবেও গ্রন্থটিকে তিনি আমাদের কাছে উপস্থাপিত করেছেন।

চর্যাপদগুলো অন্তরের দিক থেকে ধর্মগীতি হলেও আসলে এগুলোকে গীতিকাব্য বলা চলে। একের অনুভূতি অন্যের অন্তরে সঞ্চার করে দেবার মধ্য দিয়ে চর্যাপদগুলো সাহিত্যিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কবিদের ধর্মতত্ত্ব ও বিশ্বাস সুরের মূর্ছনায় যে ভাবস্বর্গ রচনা করেছে তা এককথায় অতুলনীয়। চর্যাপদের পদগুলোতে যে বাস্তব অথচ কাব্যময় দৃশ্য ধরা পড়ে, তাতে দেখা যায় যে মানুষ এবং প্রকৃতিকে কত নিবিড়ভাবে তাঁরা ভালোবাসতেন। এই প্রকৃতির পটভূমিকায় রোমান্টিকতার এক প্রকাশ দেখা যায় শরবপাদের লেখা ৫০নং পদটিতে। সেখানে দেখা যায় নীল আকাশের নীচে একটি বাড়ি ও তার পাশে সাদা কার্পাস ফুল ফুটেছে।

চর্যাপদের সমস্ত পদগুলোতে যে কাব্যধর্মিতা ও গীতিময়তার প্রকাশ ঘটেছে তা পাঠক চিত্তকে সহজেই আপ্লুত করে। উদাহরণস্বরূপ ভুসুকুপাদের একটি পদের কথা আনা যেতে পারে যেখানে দেখা যায় ব্যাধের দ্বারা আক্রান্ত হরিণ ও তার বিরহ কাতর চিত্রটি। অপূর্ব ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে কবি তা প্রকাশ করেছেন। “তিন নচ্চপই হরিণা পিবই না পাণী/হরিণা হরিণীর মিল অ জানী।” – পদটির ভেতর দিয়ে শুধু হরিণীর হৃদয়ের কথা নয়, সমস্ত বিরহী মানুষের অন্তরের কাতরোক্তিই যেন ধ্বনিত হয়েছে। চর্যাপদের প্রতিটি পদে রয়েছে অজস্র কাব্যময় চিত্রণ – অরণ্যের নিভৃত অন্ধকারে মৃত্যুর ভয়ংকর শিকারীর জাল বিছিয়ে হরিণ ধরা, ভীত সন্ত্রস্ত হরিণের জল গ্রহণ না করা, তৃণ বর্জন করে শান্ত পাহাড়, স্রোতময়ী নদী, অন্ধকার ঘরে চঞ্চল মূষিক, শান্ত সন্ধ্যায় আরতির ঘণ্টা, বক্ষলগ্ন বধূর সহচর্যে মিলন-বিধূর প্রেমিক প্রভৃতি দৈনন্দিন জীবনের অজস্র চিত্র এ কাব্যের সামগ্রী। বাংলা কাব্যে বাস্তবতার প্রথম প্রকাশ এই চর্যাপদে – তাই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম।

চর্যাকারগণ বিভিন্ন অলংকার, ছন্দ এবং শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্টি করেছেন তাতে তাঁদের রচিত পদগুলি হয়ে উঠেছে সে এক নিটোল প্রেমের কবিতা। চর্যাপদের কবিদের একটি বড় কৃতিত্ব পয়ারের সৃষ্টি। বাংলা ভাষায় রচিত পয়ারের প্রাচীনতম নিদর্শন তাঁদের রচিত পদগুলোতেই পাওয়া যায়। দীর্ঘ পয়ার, লঘু পয়ার, ত্রিপদী ইত্যাদির নিদর্শন চর্যাপদে পাওয়া যায়। চর্যাপদে যে গীতিচেতনা লক্ষিত হয়, পরবর্তীকালে তা-ই আউল- বাউল-সাঁই- দরবেশের দানে এবং বৈষ্ণব পদাবলীতে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এখানেই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top