Class 12 Economics Chapter 7 স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতীয় অর্থনীতি ও ভারতীয় অর্থনীতি (1950-1990)

Class 12 Economics Chapter 7 স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতীয় অর্থনীতি ও ভারতীয় অর্থনীতি (1950-1990) | Class 12 Economics Question Answer in Bengali to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter AHSEC Board HS 2nd Year Economics Chapter 7 স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতীয় অর্থনীতি ও ভারতীয় অর্থনীতি (1950-1990) Notes and select needs one.

Class 12 Economics Chapter 7 স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতীয় অর্থনীতি ও ভারতীয় অর্থনীতি (1950-1990)

Join Telegram channel

Also, you can read the SCERT book online in these sections Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given AHSEC Board Bengali Medium Class 12 Economics Chapter 7 স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতীয় অর্থনীতি ও ভারতীয় অর্থনীতি (1950-1990) Solutions for All Subject, You can practice these here.

দীর্ঘ উত্তরধর্মী প্রশ্নোত্তর 

প্রশ্ন ১। সবুজ বিপ্লব কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?

উত্তরঃ খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে নতুন কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। নতুন কার্যক্রমের মূল স্তম্ভ’ তিনটি। 

(১) উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার। 

(২) সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। এবং 

(৩) রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ঔষধের ব্যবহার। 

এই নতুন কার্যক্রমকে ‘নতুন কৃষি কৌশল’ বলা হয়। এই নতুন কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে কৃষি উৎপাদন এত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে যে অনেকে একে বিপ্লবাত্মক আখ্যা দিয়েছেন। উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার এই ঘটনাকেই ‘সবুজ বিপ্লব’ বলা হয়ে থাকে।

সবুজ বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

(১) উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার: চিরাচরিত নিম্ন ফলনশীল বীজের পরিবর্তে নতুন উচ্চ ফলনশীল বীজের প্রবর্তন করা হয়েছে। এই ধরনের বীজ কৃষি গবেষণার ফলে উদ্ভাবিত হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল বীজের শারীরবৃত্তীয় গুণ হচ্ছে এর মাধ্যমে মাটির মধ্যে সঞ্চিত পুষ্টিসাধক বস্তুগুলি গাছের পাতা বৃদ্ধিতে রূপান্তরিত হয়, ফলে ছোটো ছোটো গাছে খুব বেশি ফলন হয়।

(২) রাসায়নিক সারের অধিক ব্যবহার: উচ্চ ফলনশীল বীজের ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার বেশি করে ব্যবহার করতে হয়। প্রথম দিকে দরকার হয় নাইট্রোজেন সার ও পরের দিকে দরকার হয় ফসফরাস সার।

(৩) পর্যাপ্ত সেচের সুবিধা: উচ্চ ফলনশীল বীজের জন্য দরকার পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা। পর্যাপ্ত জলের যোগান না হলে আশানুরূপ ফলন হয় না। তাই ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে জলসেচের ব্যবস্থা করতে হয়।

(৪) কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার: অধিক উৎপাদন ও একাধিক বার ফসল ফলানোর জন্য কৃষিক্ষেত্রে কিছু কিছু যন্ত্রপাতির ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন- সেচের জন্য চাই টিউবওয়েল ও পাম্পসেট। ঔষধ ছড়ানোর জন্য চাই স্প্রেয়ার। এছাড়া ট্রাক্টর, টিলার, থ্রেসার প্রভৃতিও প্রয়োজন হয়।

প্রশ্ন ২। সবুজ বিপ্লবের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করো।

উত্তরঃ সবুজ বিপ্লবের ফলাফল নিচে বর্ণনা করা হল –

(১) উৎপাদন অনেকগুণ বেড়েছে: এই প্রযুক্তি গ্রহণ করার ফলে মোট উৎপাদন অনেকগুণ বেড়েছে। 1966-67 সালে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় 75 মিলিয়ন টন, 2016-17 সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় 275 মিলিয়ন টনে। দেশ এখন খাদ্যশস্যে স্বনির্ভর হতে পেরেছে। বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা বন্ধ হয়েছে। তবে নতুন প্রযুক্তির সুফল ধান ও গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে যতটা লক্ষ করা গেছে, ডাল, তৈলবীজ, জোয়ার, বাজরা প্রভৃতি শস্যের ক্ষেত্রে ততটা লক্ষ করা যায়নি। উৎপাদন কেন আশানুরূপ বাড়েনি তার কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত বীজ ব্যবহার করা হয় নি।

(২) কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব অনিশ্চিত: নতুন প্রযুক্তির ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছে না কমেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। একদিকে, সারা বছরে একাধিক বার ফসল ফলানোর জন্য শ্রমিক চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চ ফলনশীল বীজের ক্ষেত্রে আগাছাগুলি একাধিক বার নিড়ানি দিতে হয়। কারণ আগাছা সারা শুষে নেয়। একাধিক বার নিড়ানি দেওয়ার জন্য বেশি শ্রমিক দরকার। আবার অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে কর্মসংস্থান কিছুটা কমেও যাচ্ছে।

(৩) বড়ো চাষ বেশি সুফল ভোগ করেছেঃ  নতুন প্রযুক্তির সুফল বড়ো চাষি বেশি করে ভোগ করেছে। নতুন প্রযুক্তি ব্যয়সাধ্য বলে ছোটো চাষি নতুন প্রযুক্তির সুফল গ্রহণ করতে পারছে না। এর ফলে নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তিত হওয়ার গ্রামাঞ্চলের আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে, ছোটো চাষি এবং ভূমিহীন কৃষক নতুন প্রযুক্তির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন প্রযুক্তি সমানভাবে প্রচলিত না হওয়ায় দেশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

(৪) আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধিঃ সবুজ বিপ্লবের ফলে রাজ্যগত ও অঞ্চলগত বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সবুজ বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি গম উৎপাদক এলাকাগুলি অধিক উন্নত হয় কারণ নতুন প্রযুক্তি প্রথমে গমের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী হয়।

(৫) নতুন প্রযুক্তি ও দারিদ্র্য: নতুন প্রযুক্তি একদিকে শ্রমের চাহিদা বাড়ায় অন্যদিকে খাদ্যশস্যের দাম কমায়। যেহেতু দরিদ্রদের প্রধান ভোগ্যদ্রব্য হল খাদ্যশস্য আর যেহেতু দরিদ্ররা শ্রমশক্তি বিক্রি করে আয় করে। তাই নতুন প্রযুক্তি দারিদ্র্য কমায়, দরিদ্রদের অনুকূল হয়।

(৬) কৃষি ও শিল্পের সংযোগ: সবুজ বিপ্লবের প্রভাব ভারতে কৃষির সঙ্গে শিল্পের সংযোগ সুদৃঢ় হয়। অর্থাৎ কৃষির উন্নয়নের সাথে সাথে কৃষির উপকরণ হিসাবে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা বাড়ে তা শিল্পায়নের সহায়ক হয়ে ওঠে। ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে সংযোগ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য।

সর্বশেষ বলা যায়, কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির দরুণ – এদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে অনেকটাই সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব অপরিহার্য।

প্রশ্ন ৩। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা আলোচনা করো।

উত্তরঃ ভারতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের মূলভিত্তি হল কৃষি। কৃষি ভারতীয় সভ্যতার ধারক। কৃষি ভারতের মেরুদণ্ড। 

ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব কতখানি তা আলোচনায় আলোকপাত করা হল –

(১) জীবনধারণের মূল উৎস হিসাবে কৃষিঃ ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষিকার্য হল এদেশের জনগণের মূল কর্মসংস্থান। বর্তমান ভারতে মোট শ্রমশক্তির প্রায় 58% কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত। প্রতি দশজনের মধ্যে প্রায় ছয়জনই জীবিকার সাথে সাথে কৃষির ভূমিকা অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় খানিকটা কমলেও তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

(২) ভারতের জাতীয় আয়ে কৃষির ভূমিকা: ভারতের জাতীয় আয়ের একটি বড়ো অংশ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র থেকে আসে। ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কালে দেশের জাতীয় আয়ের প্রায় 57% কৃষি থেকেই আসে। 2017-18 এর ভারতের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে বলা যায়, দেশের জাতীয় আয়ের 17% কৃষিক্ষেত্র থেকে এসেছে। যেখানে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডের মতো উন্নত দেশগুলিতে কৃষির ভূমিকা জাতীয় আয়ের 3-4% । এই হিসেবে বিচার করলে দেখা যায়, ভারতের অর্থনীতিতে কৃষিক্ষেত্রের গুরুত্ব যথেষ্ট বেশি।

(৩) শিল্প উৎপাদনে কৃষির ভূমিকা: কৃষির উন্নয়ন শিল্পের অগ্রগতি ঘটাতে সাহায্য করে। এদেশের অধিকাংশ শিল্প কৃষিভিত্তিক। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে – পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, বনস্পতি শিল্প ও বাগিচা শিল্পগুলি মূলত কৃষির কাঁচামালের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল এবং দেশের অন্যান্য শিল্পগুলিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার সম্প্রসারণের জন্যও কৃষির উন্নতি প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রের আয় বৃদ্ধি পেলে তবেই কৃষিক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত আয় শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। তার ফলে শিল্পের বিকাশ ঘটবে।

(৪) রপ্তানি বাণিজ্যে কৃষির ভূমিকাঃ আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে চা, পাট জাতীয় দ্রব্য, বস্ত্র ইত্যাদি সারা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছে। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেকেই কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি থেকে উদ্ভূত হয়। রপ্তানি বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হলে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির সমস্যা এড়াতে হলে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্তই প্রয়োজন।

(৫) স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা: কৃষিক্ষেত্রের উন্মুক্ত প্রাঙ্গন ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দেশের পরিবেশকে অনেকটা দূষণমুক্ত রাখতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তু সংস্থানের ভারসাম্য ও দূষণমুক্ত পরিবেশ একান্ত অপরিহার্য এবং যার উৎস হল কৃষিক্ষেত্র।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ডই হল কৃষি এবং কৃষির উন্নতি ছাড়া ভারতের অর্থনীতির উন্নতি সম্ভব নয়।

প্রশ্ন ৪। ভারতীয় কৃষির স্বল্প উৎপাদনশীলতার কারণগুলি আলোচনা করো।

উত্তরঃ কৃষির উৎপাদনশীলতা কম হওয়ার কারণগুলোকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি- 

(১) সাধারণ কারণ। 

(২) প্রতিষ্ঠানগত কারণ। এবং 

(৩) প্রযুক্তিগত কারণ। 

এই তিন ধরনের কারণকে আমরা একে একে ব্যাখ্যা করব।

(১) সাধারণ কারণ: প্রথমত, কৃষিতে জনসংখ্যার চাপ খুব বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কৃষিজমির যোগান স্থির। ফলে মাথাপিছু কর্ষিত জমিত যোগান হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, অ-কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগের সুযোগ সেই হারে বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বাড়তি জনসংখ্যা কৃষিতেই ভিড় করছে। এর ফলে কৃষিতে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষিতে জোতের খণ্ডীকরণ ও অসংবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এর ফলেও জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের কৃষকদের গুণগত মান খুবই নিম্ন। অধিকাংশ কৃষকই নিরক্ষর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন। তার ফলে, তারা নতুন ধরনের উৎপাদন কৌশল প্রয়োগ করতে পারে না। এজন্যও কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা কম থাকে।

(২) প্রতিষ্ঠানগত কারণ: প্রথমত, ভারতের জোতের আয়তন খুবই ক্ষুদ্র। জোতের আয়তন খুব ছোটো হওয়ার জন্য উন্নত প্রথায় যন্ত্রের সাহায্যে নিবিড় চাষ করা সম্ভব হয় না।

দ্বিতীয়ত, ভারতে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, যারা জমির মালিক তারা নিজেরা চাষ করে না। জমির মালিকরা প্রজাদের কাছে জমি ইজারা বিল করে থাকে। এই প্রজাদের কাছ থেকে যে কোনো সময়ে জমি কেড়ে নেওয়া হতে পারে। প্রজাদের চাষ করার অধিকারের কোনো স্থায়িত্ব নেই। ফলে তারা অধিক ফসল ফলাতে উৎসাহী হয় না।

(৩) প্রযুক্তিগত কারণ: প্রথমত, ভারতে সেকেলে ধরনের উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণ করা হচ্ছে, পশ্চিমি দেশগুলো এবং জাপান কৃষিক্ষেত্রে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে কৃষির উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ভারতের কৃষিতে এখনও চিরাচরিত উৎপাদন কৌশলই ব্যবহৃত হচ্ছে। বলদ এবং লাঙলের সাহায্যে চাষ এখনও অধিকাংশ কৃষকদের কাছে প্রধান প্রযুক্তি।

দ্বিতীয়ত, ভারতের কৃষিকার্য প্রধানত মৌসুমী বৃষ্টিপাতের উপরেই নির্ভরশীল। কোনো বছর অতিবৃষ্টি এবং কোনো বছর অনাবৃষ্টির জন্য কৃষির উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হয়। জলসেচ ব্যবস্থার উপযুক্ত প্রসার না ঘটার জন্যও ভারতের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা এত কম।

প্রশ্ন ৫। ভারতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত ব্যবস্থাগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

প্রথমত, কৃষির উপর নির্ভরশীল জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য অ-কৃষিক্ষেত্রে বিকল্প কর্মনিয়োগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির বিলোপ এবং প্রজাস্বত্বের নিরাপত্তা ও খাজনা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। তাছাড়া, জমির মালিকানার উপর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে সর্বোচ্চ সীমার অতিরিক্ত জমি বন্টন করাও ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান কর্মসূচি।

তৃতীয়ত, সেচ ব্যবস্থার প্রসারের জন্য একদিকে যেমন বড়ো এবং মাঝারি সেচ প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে ছোটো সেচ প্রকল্পের প্রসার ঘটানো হচ্ছে।

চতুর্থত, ঋণ ব্যবস্থার উন্নতি এবং সম্প্রসারণ ঘটানোর জন্য সমবায় সমিতির প্রসার ঘটানো হচ্ছে। আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাংক অফ ইণ্ডিয়া এবং সরকারি ব্যাংকগুলো গ্রামাঞ্চলে অধিক সংখ্যক শাখা বিস্তার করছে।

পঞ্চমত, কৃষিপণ্যের বিপণ্ন ব্যবস্থার উন্নতির জন্যও বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

সর্বোপরি, উন্নত প্রযুক্তি যাতে কৃষকরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ প্রভৃতির যোগান বৃদ্ধি করা হচ্ছে।

প্রশ্ন ৬। ভূমি সংস্কার কাকে বলে? ভূমি সংস্কার কার্যসূচির উদ্দেশ্য কী ? ভারতের ভূমি সংস্কার কর্মসূচির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তরঃ দেশের মোট কৃষির উৎপাদন তথা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং প্রজাস্বত্বের সংস্কারের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে সাম্যের নীতি বজার রাখায় দৃষ্টিতে সরকারের সক্রিয় ভূমিকায় কৃষি কাঠামোতে যে নৈতিক পরিবর্তন আনা হয়েছে তা হল ভূমি সংস্কার।

ভূমি সংস্কার নামক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কর্মসূচি রূপায়ণের পশ্চাতে যে উদ্দেশ্যগুলি নিহিত ছিল- 

সেগুলি হল –

(১) একটি প্রগতিশীল কৃষিকাঠামো গড়ে তুলে কৃষির উৎপাদনশীলতা তথা মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

(২) সংস্কারমূলক কর্মসূচি রূপায়ণের মাধ্যমে প্রজাস্বত্বের সংস্কারের সাথে সাথে জমির ঊর্ধসীমা নির্ধারণ ও খাজনার পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যমে ভারতীয় কৃষিতে ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা অক্ষুণ্ণ রাখা।

(৩) খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে জনসাধারণের সমষ্টিগত চাহিদা পূরণের মাধ্যমে দেশে মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

(৪) খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করা।

এই উদ্দেশ্যগুলি অর্জনের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভূমি সংস্কারমূলক যে কর্মসূচিগুলি গৃহীত হয় সেগুলি হল –

(১) মধ্যস্বত্বভোগীদের বিলোপসাধন।

(২) জমির ঊর্ধসীমা নির্ধারণ ও উদ্বৃত্ত জমির বন্টন।

(৩) প্রজাস্বত্বের সংস্করণ – যেখানে প্রজাস্বত্বের সংস্কারের জন্য তিনটি। বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। 

যথা 

(ক) খাজনার পরিমাণ নির্ধারণ। 

(খ) প্রজাস্বত্বের নিরাপত্তা রক্ষাকরণ। এবং 

(গ) প্রজাদের হাতে পাট্টা চুলে দিয়ে প্রজাদের মালিকানা প্রদান।

(৪) সমবায় কৃষিপ্রথার প্রবর্তন।

(৫) জোতের সংঘবদ্ধকরণ।

প্রশ্ন ৭। ভারতে ভূমি সংস্কার কর্মসূচির ব্যর্থতার কারণগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ স্বাধীন ভারতে ভূমি সংস্কার কার্যসূচির অঙ্গ হিসাবে নানাবিধ আইন প্রণয়ন করা হলেও ভূমি সংস্কার কর্মসূচি সফল হতে পারে নি। 

তার কারণগুলি নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

প্রথমত, ভারতে ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে অনেক সময় লাগে। রাজ্য বিধানসভায় এই সংক্রান্ত বিল পাশ হওয়ার পর এটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য। অনেক সময়েই এই সম্মতি পেতে দেরি হয়।

দ্বিতীয়ত, ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত আইনগুলি বলবৎ করার ভার দেওয়া হয়েছে যে সমস্ত আমলাদের হাতে তাদের অনেকেরই স্বার্থ আছে পুরানো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার। সেজন্য আইনগুলি কঠোরভাবে কার্যে রূপায়িত করা সম্ভব হয় নি। আমলাতন্ত্রের সহানুভূতিহীন এবং আগ্রহহীন মনোভাব ভূমি সংস্কার কর্মসূচির সার্থক রূপায়ণের পথে অন্যতম বাধা।

তৃতীয়ত, অনেক সময় আইনের মধ্যে ফাঁক থেকে যায়। এই ফাঁকগুলিকে সদ্ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রেই আইনকে ফাঁকি দেওয়া হয়। যেমন জোতের ঊর্ধসীমা নির্ধারণকারী আইন প্রণয়ন হতে হতে বাড়তি জমি বেনামে হস্তান্তর করা হয়ে যায়।

চতুর্থত, আইন প্রণয়ন করলেও সেই আইনকে কার্যে রূপায়িত করার মতো সদিচ্ছা অনেক সময়েই শাসক দলের থাকে না।

পঞ্চমত, জমি সংক্রান্ত সঠিক তথ্য এবং দলিলপত্রের অভাবের জন্য ভূমি সংস্কার কার্যসূচি সঠিকভাবে রূপায়ণ করা সম্ভব হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, কোনো জমিতে কে প্রজা বা কে ভাগচাষী তার রেকর্ড অনেক সময়েই লিখিতভাবে থাকে না। উপযুক্ত নথিপত্রের অভাবে অনেক সময়েই বর্গাদারদের স্বার্থরক্ষা করা হয় না।

ষষ্ঠত, গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র চাষি ও ভূমিহীন কৃষকদের কোনো জোরালো সংগঠন নেই। তারা দরিদ্র নিরক্ষর এবং সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। ফলে তারা সরকারের উপর ভূমি সংক্রান্ত ব্যবস্থাগুলি রূপায়িত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে না।

প্রশ্ন ৮। ভারতের কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

অথবা, 

ভারতীয় কৃষির সমস্যাগুলি বর্ণনা করো।

উত্তরঃ ভারতের অর্থনীতিতে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মোট জাতীয় আয়ের একটি বড়ো অংশ কৃষিক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত হয়। আবার, দেশের জনসংখ্যারও একটি বড়ো অংশ কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত রয়েছে। ভারতের অর্থনীতির উত্থান পতন কৃষির উত্থানপতনের সঙ্গেই জড়িত। ভারতের কৃষিক্ষেত্রের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে। এগুলো ভারতীয় কৃষির সমস্যাও বটে।

প্রথমত, ভারতের কৃষিব্যবস্থা সনাতন ধরনের। প্রাচীন যুগের সেই লাঙল এবং বলদ দিয়ে এখনও চাষ চলে। সম্প্রতি সবুজ বিপ্লবের প্রসারের ফলে কোনো কোনো অঞ্চলের অবস্থার কিছুটা উন্নত হলেও এখনও অধিকাংশ রাজ্যেই কৃষিপদ্ধতি সেকেলে ধরনের।

দ্বিতীয়ত, ভারতের কৃষি উৎপাদন প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় 70% জলসেচের জন্য বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল। কাজেই অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির ফলে অনেক সময়েই কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।

তৃতীয়ত, ভারতে কৃষি একটি জীবনধারনের উপায় মাত্র। এটিকে লাভজনক বৃত্তি বা পেশা হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। অধিকাংশ কৃষক পরিবারই নিজেদের ভরণপোষণের জন্য কৃষিকার্যে অংশগ্রহণ করে। ফলে বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত সৃষ্টির কোনো তাগিদ এখানে লক্ষ করা যায় না।

চতুর্থত, ভারতীয় কৃষির অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল এখানে কৃষির উৎপাদনশীলতা খুবই কম। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের একর পিছু উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। জাপানে হেক্টর পিছু ধান উৎপাদন যখন 6250 কেজি, তখন ভারতে হেক্টর পিছু ধান উৎপাদন মাত্র 2000 কেজি।

পঞ্চমত, ভারতের কৃষির অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল জোতের গড় আয়তনের ক্ষুদ্রতা। ভারতের জোতগুলোর আয়তন খুবই ছোটো। গ্রামীণ পরিবারের 53% সাধারণতঃ এক একর থেকে 2.46 একর জমির মালিক। তাছাড়া, জমিগুলো যে শুধু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত তাই নয়; জমিগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো থাকে।

ষষ্ঠত, ভারতের কৃষি ব্যবস্থা অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল ব্যাপক প্রচ্ছন্ন বেকারত্বের উপস্থিতি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবের জন্য কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত জনসংখ্যার পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্র থেকে কিছু লোককে সরিয়ে

নিয়ে গেলেও কৃষিক্ষেত্রের মোট উৎপাদন হ্রাস পাবে না।

ভারতীয় কৃষির এই বৈশিষ্ট্যগুলো ভারতীয় কৃষির সমস্যাও নির্দেশ করে।

প্রশ্ন ৯। ‘ভূমি সংস্কার ও সবুজ বিপ্লব’ পরস্পর-বিরোধী বলে তুমি মনে কর কি ? তোমার উত্তরের সমর্থনে যুক্তি দাও।

উত্তরঃ ভারতের কৃষির উৎপাদনশীলতা তথা মোট উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের ভূমি সংস্কারমূলক কর্মসূচি এবং কৃষি উৎপাদনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে, খুব স্বাভাবিকভাবে বলা যায় এই দুই ধরনের পরিবর্তন একে উপরের উপর কমবেশি বিরূপ প্রভাব ফেলে। কারণ, তারা একে অপরের স্বভাব বিরোধী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভূমি সংস্কারমূলক কর্মসূচি দেশের সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কর্মসূচি রূপায়ণের প্রয়াস। পক্ষান্তরে সবুজ বিপ্লব সময়ের সাপেক্ষে কৃষি সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের সাথে সাথে ও কৃৎ-কৌশলগত উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রকট বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়াস।

ভূমি সংস্কারমূলক কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিতে দুটি মূল‌ উদ্দেশ্য অনুসৃত হয় – দেশের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা তথা মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং দ্বিতীয়টি হল কৃষিক্ষেত্রে একটি সাম্যের নীতি বজায় রাখা, পক্ষান্তরে, সবুজ বিপ্লবের ফলে মূলত কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে, সেখানে সাম্যের নীতি ঠাঁই পায় না। কারণ এতে, শুধুমাত্র ধনী কৃষক এমনকি সমৃদ্ধশালী রাজ্যগুলি কৃষি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়। আর সেজন্যই, কৃষিতে উৎপাদনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য তথা রাজ্যভিত্তিক বৈষম্য দারুণভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।

ভূমি সংস্কারমূলক কর্মসুচি রূপায়ণে যে মূল কর্মসূচিগুলি গৃহীত হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হল প্রজাস্বত্বের সংস্কার অর্থাৎ প্রজাদের জমির মালিকানা প্রদান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গরিব চাষিদের হাতে জমির মালিকানা থাকলে তারা আধুনিক যুগের ব্যয় বহুল কৃষিকার্য সম্পন্ন করে কৃষি উৎপাদনে কখনোই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে না।

পরিশেষে বলা যায়, ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারলে দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে ও কৃষি সংস্কৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হতো কিন্তু ভূমিসংস্কারের প্রয়োগ দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কারণে যথোপযুক্তভাবে হয় নি, তা অকপটে বলা যায়।

প্রশ্ন ১০। ভূমি সংস্কার বলতে কী বোঝ ? ভারতে ভূমি সংস্কাররে গুরুত্ব আলোচনা করো।

উত্তরঃ ভূমি সংস্কার বলতে বোঝায় কৃষির উন্নয়নের পথে প্রতিষ্ঠানগত বাধাগুলি অপসারণ করা।

ভারতের অর্থনীতিতে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব নিচে বর্ণনা করা হল –

প্রথমত, ভারতের কৃষির প্রধান সমস্যা স্বল্প উৎপাদনশীলতা। স্বল্প উৎপাদনশীলতার একটি প্রধান কারণ হল – প্রতিষ্ঠানগত। প্রতিষ্ঠানগত কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ অন-অর্থনৈতিক জোতের প্রাধান্য এবং অনুপযুক্ত ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা। ভারতের জোতের আয়তন খুবই ছোটো। তার ফলে উন্নত প্রথায় যন্ত্রের সাহায্যে চাষ করা সম্ভব হয় না। ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হয় না। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে জোতের খণ্ডীকরণ এবং অসংবদ্ধতা দূর করে বৃহদায়তন সমবায় চাষ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

দ্বিতীয়ত, ভারতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, জমির মালিক তারা নিজেরা জমির চাষ করে না। জমির মালিকরা প্রজাদের কাছে জমি ইজারা বিলি করে থাকে। প্রজাদের চাষ করার অধিকারের কোনো ফলে তারা অধিক পরিমাণ সার প্রয়োগ করে অধিক ফসল ফলাতে আগ্রহী হয় না। এজন্য জমির উৎপাদনশীলতা কম। এই সমস্যার সমাধানের জন্য ভূমি সংস্কার দরকার স্থায়িত্ব নেই।

তৃতীয়ত, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীর বিলোপসাধন করে কৃষি অর্থনীতিকে পরিকল্পিত ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আনা হয়। এর মাধ্যমে দেশের সর্বত্র একই ধরনের ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এক অভিন্ন কৃষিনীতি অনুসরণ ও রূপায়ণ করা সম্ভব হয়।

চতুর্থত, গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় যে বৈষম্য বর্তমান তা দূর করে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্রকৃত চাষিদের জমির মালিকানা প্রদান করা, প্রজা ও ভাগচাষীদের নিরাপত্তা বিধান করা ও খাজনার যার নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এগুলি ভূমি- সংস্কার কর্মসূচির অঙ্গ।

পঞ্চমত, যথোপযুক্ত ভূমি সংস্কারের দ্বারা ব্যয় না বাড়িয়েও কৃষি উৎপাদন বাড়ানো যায়। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত চাষিকে যদি জমি দেওয়া হয় তবে চাষি সর্বশক্তি দিয়ে কৃষির উন্নয়নে মন দেবে। এর ফলে উৎপাদন বাড়বে।

সর্বোপরি, ভূমি-সংস্কারের ফলাফল শুধু গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। তার বাইরে অর্থনীতির বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রেও এর প্রভাব প্রতিফলিত হয়। ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশে, যেখানে কৃষিই প্রধান জীবিকা, ভূমি-সংস্কারের গুরুত্ব আরও বেশি।

প্রশ্ন ১১। ভারতীয় কৃষিক একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে কী কী প্রত্যাহ্বানের সম্মুখীন হয়েছে ?

উত্তরঃ ভারতীয় কৃষির সাম্প্রতিক সমস্যাগুলি হলঃ

প্রথমত, পরিকল্পনার সময়কালে কৃষির পাশাপাশি শিল্পের অগ্রগতির কথা ভেবে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কমতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মোট বরাদ্দের 31% কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করা হয় – যা কমতে কমতে দশম পরিকল্পনায় দাঁড়িয়েছে 14.9%।

দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনার সময়কালে বিশেষত সংস্কারোত্তর অর্থনৈতিক যুগে সরকারের তরফে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস পায়। সেই সঙ্গে আমদানিজাত দ্রব্যে সরকারের যে পরিমাণগত নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল, তা প্রায় পুরোটাই তুলে দেওয়া হয়। কার্যতভাবে, বিদেশি দ্রব্য ভারতের বাজারে ঢুকে পড়ায় ভারতীয় উৎপাদকেরা প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে পারছে না।

তৃতীয়ত, বিশেষ আর্থিক অঞ্চল SEZ গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গিতে জমি অধিগ্রহণের বিষয়টিও সাম্প্রতিককালে কৃষিজাত পণ্যের সংকটের অন্যতম কারণ। সারা ভারতে প্রায় 400টি SEZ ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। 1991 সাল থেকে 2003 সাল পর্যন্ত প্রায় 50 লক্ষ হেক্টর জমি শিল্পায়ণের জন্য অধিগ্রহণ করেছে। সুতরাং, দেশের সীমিত ভূমির প্রধানত  উর্বর ভূমিভাগের একটি বড়ো অংশ কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে না।

পরিশেষে বলা যায়, সময়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রগতিশীলতার পাশাপাশি দেশে কৃষিক্ষেত্রের ভূমিকা দেশের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ক্রমশ কমেছে। বস্তুতপক্ষে, সাধারণ মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মানের উচ্চাশার দৃষ্টিভঙ্গীতে পেশাগত কাঠামোর নতুন ডাকে সাড়া দিচ্ছে। ভারতের কৃষিক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।

প্রশ্ন ১২। প্রাক-স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তরঃ ব্রিটিশ শাসনে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস ঘটে। ভারতকে বিশ্বের বাজারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বিশ্বপুঁজিবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ভারতের অর্থনীতিকে ঔপনিবেশিক কাঠামোয় পুনর্গঠিত করা হয়। এই ধরনের অর্থনীতি বিশ্ব পুঁজিবাদের আলোয় আলোকিত হয় কিন্তু নিজের আলো বিকিরণ করার ক্ষমতা হারায়। বিশ্বের পুঁজিবাদী উন্নয়নের পরিমণ্ডলে জায়গা পায় কিন্তু নিজের উন্নয়নের উদ্দীপক প্রশমিত হয়। জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের উদ্যোগের রাশ থাকে বিদেশি শক্তির হাতে। শিল্পায়নের প্রচেষ্টা চলে বিদেশি উদ্যোগ ও বিদেশি পুঁজির প্রাধান্যবাদের ছত্রছায়ায়। এই ধরনের অর্থনীতি হল এক ধরনের উপগ্রহ অর্থনীতি যার আপাত চেহারাটা আধুনিকতার সাজে সজ্জিত হয় কিন্তু অন্তরটা থেকে যায় পশ্চাৎপদ এক প্রথাগত সম্পর্কের মধ্যে। একে যেমন সামন্ততন্ত্র বলা যায় না, আবার তেমনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও বলা যায় না। এ হল এক ধরনের নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো যাকে ঔপনিবেশিক কাঠামো বলা চলে।

দাদাভাঈ নৌরজী, রমেশ দত্ত, রাণাড়ে, যোশী প্রমুখ অর্থনীতিবিদরা ভারতের ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক চরিত্রটা উন্মোচন করেন। তারা ভারতের অনুন্নতির জন্য ব্রিটিশ শাসনকেই দায়ী করেন। তাঁরা ভারতের অর্থনীতির অবশিল্পায়নের তত্ত্ব তুলে ধরেন, সম্পদ নির্গমন কিভাবে ভারতের অর্থনৈতিক দেহ থেকে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে অর্থনীতির প্রাণশক্তি নিংড়ে নেয় তার ব্যাখ্যা করেন। রমেশ চন্দ্র দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে ব্রিটিশ শাসনে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারত শাসনের জন্য ব্রিটিশ শাসকেরা যে নক্সা রচনা করেছিলেন তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক মারাত্মক নিকাশ যা ফুলে ফেঁপে আজ বাৎসরিক বহু নিযুত স্টার্লিং প্রেরণে এসে দাঁড়িয়েছে। সূচনা থেকেই ভারতবর্ষ এবং ইংল্যাণ্ডের মধ্যেকার আর্থিক সম্পর্ক পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। বিপুল সংগতি, উর্বর মৃত্তিকা এবং অধ্যবসায়ী জনসংখ্যা নিয়েও ভারতবর্ষ দেড়শত বৎসরের ব্রিটিশ শাসনের পর আজ পৃথিবীর মধ্যে দরিদ্রতম দেশ।’

1757 সালে পলাশি যুদ্ধের পর এদেশে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর রাজনৈতিক শাসনের সূচনা হয়। এর আগে থেকেই কোম্পানী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। তারা এদেশ থেকে পণ্যসামগ্রী কিনে বিদেশে বিক্রি করত। এই পর্যায়ে ভারতের বহির্বাণিজ্য দেশকে ধাতুমুদ্রা আমদানিতে সাহায্য করত। কোম্পানীরাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এদেশ থেকে আদায় করা রাজস্বের একটা অংশ ইংরেজদের লাভ হিসেবে দেখিয়ে সেই টাকায় কোম্পানী ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসা থেকে লাভের অংশ এদেশে বিনিয়োগ করে না, তা পাঠানো হয় বিদেশে। অর্থাৎ ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’র নীতি চালু হয়। পরবর্তীকালে ইংল্যাণ্ডে শিল্পবিপ্লবের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ইংরেজদের রাজতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। চার্টার আইনের সাহায্যে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ক্ষমতা খর্ব করা হয়। ব্রিটিশ পুঁজিবাদের স্বার্থের সঙ্গে ভারতের শাসনকে যুক্ত করা হয়। পুঁজিবাদের স্বার্থে ভারতে পণ্য দখলের জায়গা নেয় ‘বাজার দখল’। ভারতের ব্রিটিশ পণ্য বিক্রি করা এবং ভারত থেকে কাঁচামাল ও খাদ্য নিয়ে যাওয়ার তাগিদে বৈদেশিক বাণিজ্যের অভিমুখ পরিচালিত হয়। ভারতের অর্থনীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপগ্রহ অর্থনীতি হিসাবে গড়ে উঠে। রিকার্ডোর আপেক্ষিক সুবিধা নীতি অনুসরণ করে ভারতকে কৃষি অর্থনীতিতে বিশেষায়ণ ঘটাতে বাধ্য করা হয়। যে ভারত ছিল শিল্প পণ্য রপ্তানিতে অগ্রণী তাকে কৃষিপণ্য রপ্তানি ও শিল্প পণ্য আমদানিতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে ভারতের গৌরবময় কুটির ও হস্তশিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অবশিল্পায়নের অভিঘাত নেমে আসে ভারতের জনজীবনে। ভারতের বাজার ব্রিটিশ পণ্যের জন্য অবাধ হয়ে যায়।

প্রশ্ন ১৩। ভারতে রেলপথ সম্প্রসারণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ ভারতে ব্রিটিশ পুঁজি লগ্নী করার সর্বাপেক্ষা লাভজনক ক্ষেত্র ছিল রেলপথ। ভারতীয় রেলপথের জনক গভর্ণর লর্ড ডালহৌসী 1853 খ্রীষ্টাব্দে বলেছিলেন, রেলপথ গড়ে উঠলে ভারতে শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন সম্ভব হবে। 1853 খ্রীষ্টাব্দে সর্বপ্রথম গ্রেট ইণ্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানী বোম্বাই ও থানের মধ্যে রেললাইন বসায়। পরের বছর ইষ্ট ইণ্ডিয়া রেল কোম্পানী হাওড়া ও হুগলীর মধ্যে রেললাইন বসায়। 1870 সালে বোম্বাই ও কলকাতার মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রথমদিকে রেলপথের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বড় বড় বন্দরগুলির মধ্যে যোগাযোগ সহজ করা। পরবর্তীতে রেলপথের উদ্দেশ্য ব্যাপক হয়। যেমন – দুর্ভিক্ষ নিবারণ, অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, কয়লাখনির উন্নয়ন এবং জনসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। 1858 খ্রীষ্টাব্দ থেকে 1905 খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে 36000 মাইল জুড়ে রেলপথ তৈরি হয়। 1905 সালে রেলওয়ে বোর্ড গঠন করা হয় এবং রেলপথের পরিচালনার দায়িত্ব এই বোর্ডের হাতে দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ভারতে রেলপথের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে কিন্তু 1914 থেকে 1921 সালের মধ্যে যুদ্ধজনিত পরিস্থিতির চাপে রেলপথের সম্প্রসারণ ব্যাহত হয়।

প্রশ্ন ১৪। ভারতীয় রেলপথের সম্প্রসারণের ফলাফল বর্ণনা করো।

উত্তরঃ রেলপথের প্রবর্তনের পূর্বে ভারতের পরিবহন ব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল না এবং তা ছিল ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক। সিন্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকা ছাড়া সর্বত্র পরিবহন ব্যবস্থা ছিল ব্যয়বহুল। অভ্যন্তরীন পরিবহন ব্যবস্থা ছিল ঘোড়া ও গরুর গাড়ী। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করতে এই শকটগুলির গতি ছিল অত্যন্ত মন্থর। এই কারণে জিনিসপত্রের যোগান ও বাজারের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত।  কিন্তু রেলপথের প্রবর্তনের ফলে ভারতের পরিবহন ব্যবস্থায় এক বিপ্লব আসে ও ভারতীয় অর্থনীতির রূপান্তর ঘটে। দেশের বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় যাতায়াতের খরচ অনেক কমে যায় এবং সেই সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ সহজ হয়। অল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে পণ্যসামগ্রী বহন করার ফলে সেগুলির দাম সস্তা হয়। রেল যোগাযোগের ফলে সম্প্রসারণ ঘটে, আধুনিক শিল্পের ও খনি শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটে। কিন্তু রেলপথ নির্মাণে ব্রিটিশ মূলধন লগ্নী করার ফলে সর্বশ্রেণির মানুষের উপর বিরাট করের বোঝা নেমে আসে। ইংল্যাণ্ডে কলে তৈরী পোষাক পরিচ্ছদ ভারতের হাটে বাজারে এসে পড়ায় দেশী স্মৃতি শিল্পের বিরাট ক্ষতি হয়। গ্রামীণ কুটির শিল্পগুলি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। অবশ্য রেলপথের মাধ্যমে ভারতবাসী যে উপকৃত হয় নি এমন কথা বলা যায় না।

প্রশ্ন ১৫। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের চিরাচরিত অর্থনীতিতে কী ধরনের ভাঙন দেখা দেয় তা আলোচনা করো।

উত্তরঃ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে শিল্প ও বাণিজ্যে ভারতবর্ষে যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী ছিল। শিল্প বাণিজ্যে সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষ ছিল পৃথিবীর কারখানা। মসলিন ও সূতা বস্ত্রে ঢাকা ছিল জগৎ বিখ্যাত। বারাণসী ও আহমেদাবাদের কিংখাব, পুনপুনের রঙিন তাঁতের কাপড়, কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের পশমের শালের চাহিদা বিদেশের বাজারে ছিল ব্যাপক। লোহা, তামা, রূপা ও সোনা প্রভৃতি ধাতু নির্মিত দ্রব্যের জন্য ও ভারত বিখ্যাত ছিল। লোহার অস্ত্রশস্ত্র, তরোয়াল, তীর-ধনুক, বর্শা, কামান, বন্দুক প্রভৃতি নির্মাণেও ভারতীয়রা দক্ষ ছিল। দস্তা, পারদ, মৃৎশিল্প, চর্ম শিল্প প্রভৃতিতেও ভারত যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে। ইংরেজরা ইউরোপে ভারতীয় স্মৃতিবস্ত্র ও মশলার ব্যবসা করে প্রচুর লাভবান হয়েছিল। বিদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের ব্যাপক চাহিদার ফলে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের পর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতকে যথেচ্ছভাবে শোষণ করে ভারতীয় সম্পদ ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যাওয়া। স্বভাবতই ইংরেজদের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতি ভারতের চিরাচরিত অর্থনীতির ওপর প্রবল আঘাত আনে এবং এর ফলে ভারতের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

ইংরেজ আগমনে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। দেশের অধিকাংশ মানুষ সেদিন গ্রামেই বাস করত এবং গ্রামগুলি তাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে। রেলপথ প্রবর্তনের ফলে ইংল্যাণ্ডে প্রস্তুত সস্তাদামের পণ্যসামগ্রী প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ভারতের কুটির শিল্পগুলি ধ্বংস হয় এবং দরিদ্র তাঁতী ও কারিগরদের জীবনে বেকারত্ব নেমে আসে।

কোম্পানী অনুসৃত নীতির ফলে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বেকার শিল্পী ও বণিকেরা জীবিকা নির্বাহের জন্য ক্রমাগত জমিতে ভিড় করতে থাকে। এর ফলে জমিতে চাপ বৃদ্ধি পায় এবং পারিবারিক কৃষিজমি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। এতে আয় অপেক্ষা ব্যয়ই বৃদ্ধি পায়। হতাশাই ছিল কৃষকদের জীবনের সম্বল।

প্রশ্ন ১৬। ভারতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গুরুত্ব আলোচনা করো।

উত্তরঃ ভারতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি উপস্থাপন করা যায়।

প্রথমত, ভারতের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে মূলধন গঠনের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরা পরিকাঠামো বা বহিরঙ্গ উন্নয়নে উৎসাহী নয়, কারণ এক্ষেত্রে বিনিয়োগের ফলপ্রসূকাল দীর্ঘ এবং মুনাফার হার নিম্ন। সরকার অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মূলধনী দ্রব্য ও যন্ত্রপাতি উৎপাদন  করে দেশের মূলধন গঠনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের ন্যায় দেশে আয় ও সম্পদ বন্টনে বৈষম্য কমানোর জন্যও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, সামাজিক ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

চতুর্থত, দেশের সম্পদের উপযুক্ত বন্টন ও ব্যবহারের জন্যও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

পঞ্চমত, ভারতের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক কম, জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নত করে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব।

ষষ্ঠত, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য টাকার বাজার এবং মূলধনের বাজার উন্নত হওয়া প্রয়োজন। উপযুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকাও প্রয়োজন। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই এগুলি অর্জন করা সম্ভব।

সপ্তমত, ভারতের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে বেকার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করছে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে। তাছাড়া, সরকার এই উদ্দেশ্যে শ্রম-নিবিড় উৎপাদন কৌশল উৎসাহিত করতে পারে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের ন্যায় দেশে নানা কারণে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

প্রশ্ন ১৭। 1948 সালের শিল্পনীতি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তরঃ স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের শিল্প বিকাশে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই উদ্দেশ্যে 1948 সালে স্বাধীন ভারত সরকারের প্রথম শিল্পনীতি ঘোষিত হয়। 1948 সালের শিল্পনীতিতে সরকার ভারতে মিশ্র অর্থনীতি প্রবর্তনের কথা ঘোষণা করে। যে অর্থনীতিতে সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্র সহাবস্থান করে, তাকেই মিশ্র অর্থনীতি বলে। 1948 সালের শিল্পনীতিতে শিল্পগুলোকে চারভাগে ভাগ করা হয়।

প্রথম শ্রেণিতে ছিল জাতীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শিল্প, যথা – অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ, পরমাণু শক্তি উৎপাদন এবং রেল পরিবহন। এই তিনটি শিল্প সরকারের একচেটিয়া থাকবে।

দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল কয়লা, লৌহ-ইস্পাত, বিমান নির্মাণ, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও বেতার যন্ত্রপাতি এবং খনিজ তেল শিল্পাদি। এ সমস্ত ক্ষেত্রে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দশ বছরের জন্য কাজ করতে অনুমতি দেবে। এই শিল্পগুলোর ক্ষেত্রে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের একমাত্র অধিকার রাষ্ট্রেরই থাকবে।

তৃতীয় শ্রেণিতে কুড়িটি শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বস্ত্র, সিমেন্ট, সার, কাগজ, চিনি, লবণ, মোটরগাড়ী, ভারী যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। সাধারণভাবে এগুলো বেসরকারি মালিকানায় থাকবে। তবে জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হলে সরকার এদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবে।

চতুর্থ শ্রেণিতে ছিল অবশিষ্ট শিল্প সমূহ। এগুলো বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হবে। তবে প্রয়োজন হলে সরকার এই শিল্পগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

প্রশ্ন ১৮। ভারতের শিল্পক্ষেত্রে সাফল্যগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ শিল্পক্ষেত্রের নিম্নলিখিত সাফল্যগুলি উল্লেখযোগ্য 

(১) জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান: শিল্পের উন্নতির ফলে জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান ক্রমাগত বাড়ছে। সালে জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান ছিল। সুতরাং পরিকল্পনাকালে ভারতের শিল্পের অগ্রগতি ঘটছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

(২) পরিকাঠামো শিল্পের উন্নতি: যে সমস্ত শিল্প সামগ্রিকভাবে দেশের শিল্পোন্নয়নে সাহায্য করে তাদের পরিকাঠামো শিল্প বলে। যেমন বিদ্যুৎ, কয়লা, ইস্পাত, তৈলশোধন প্রভৃতি। পরিকল্পনাকালে এ সমস্ত শিল্পে উৎপাদন বহুগুণ বেড়েছে।

(৩) ভারী ও মুলধনি দ্রব্যের শিল্পের প্রসার: পরিকল্পনার যুগে ভারী ও মূলধনি দ্রব্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। দ্বিতীয় পরিকল্পনা থেকে মূল ও ভারী শিল্পের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। নানা ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্য, লৌহ ও ইস্পাত, যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি এখন দেশের মধ্যেই উৎপাদিত হয়।

(৪) স্থায়ী ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি: পরিকল্পনাকারে স্থায়ী ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বহুগুণ বেড়েছে। বিশেষত, সপ্তম পরিকল্পনা থেকে উদারিকারণের নীতি গ্রহণের ফলে টেলিভিশন, মোটর সাইকেল, স্কুটার, রেফ্রিডারেটর প্রভৃতি স্থায়ী ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে।

(৫) শিল্পোৎপাদনে বৈচিত্র্যতা: পরিকল্পনাকারে শিল্পোৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। সরকারি শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সরকারি ক্ষেত্রের প্রসারের ফলে ভারতে শিল্পায়নের ভিত অনেক মজবুত হয়েছে।

(৬) প্রযুক্তিগত উন্নতি: অনেক শিল্পে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটেছে। ভারত আজ ইলেক্ট্রনিক এবং পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে। একেবারে সাম্প্রতিক প্রযুক্তি এসকল শিল্পে ব্যবহৃত হয়।  

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পরিকল্পনাকালে ভারতীয় শিল্পের উল্লেখযোগ্য উন্নতি‌ ঘটেছে।

প্রশ্ন ১৯। 1950 সালের শিল্পনীতি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তরঃ 1950 সালে নতুন ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়। 1951 সাল থেকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা শুরু হয়। 1954 সালে ভারতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার‌ লক্ষ্য ঘোষিত হয়। এছাড়া, 1956 সাল থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দ্রুত শিল্পায়নের এক কার্যক্রম গৃহীত হয়। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার একটি নতুন শিল্পনীতি ঘোষণার প্রয়োজন অনুভব করে। তাই 1956 সালে শিল্পনীতিতে শিল্পগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম শ্রেণিতে (Schedule A) ছিল সতেরোটি শিল্প। এদের উন্নয়নের দায়িত্ব থাকবে সরকারের উপর। এই শিল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রতিরক্ষা ও তার সাজসরঞ্জাম, আণবিক শক্তি, লৌহ-ইস্পাত, রেল পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, টেলিফোন প্রভৃতি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে (Schedule B) ছিল বারোটি শিল্প। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অ্যালুমিনিয়াম, মিশ্র ধাতু, মেশিন টুলস, রবার, রাসায়নিক সার, অ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রভৃতি। বলা হয় যে, এই শিল্পগুলোকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হবে। তৃতীয় শ্রেণিতে (Schedule C) বাকি সমস্ত শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই শিল্পগুলোর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের দায়িত্ব বেসরকারি উদ্যোগের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।

প্রশ্ন ২০। ভারতবর্ষের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সাদৃশ্যমূলক/ সাধারণ উদ্দেশ্যগুলি লেখো।

উত্তরঃ ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপঃ

(১) উচ্চহারে উন্নয়ন: এটি ভারতীয় পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ভারতের বিভিন্ন পরিকল্পনায় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। তারপর সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের হার নির্ধারণ করা হয়েছে।

(২) অর্থনৈতিক সাম্য: এটিও ভারতীয় পরিকল্পনার একটি প্রধান উদ্দেশ্য। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে এই উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া প্রয়োজন। ভারতে আয় ও সম্পদ বন্টনে বৈষম্য দূর করার জন্য বিভিন্ন পন্থা ও কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।

(৩) অর্থনৈতিক স্বয়ম্বরতা অর্জন: ভারতীয় পরিকল্পনার আর একটি উদ্দেশ্য হল স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্থ হল যে, দেশটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। একদিকে এর অর্থ হল বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা কমানো, অন্যদিকে এর তাৎপর্য হল আমদানি কমানো এবং আমদানি-পরিবর্ত দ্রব্য দেশের মধ্যে তৈরি করা। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনায় নানা কৌশল গৃহীত হয়েছে।

(৪) বিভিন্ন ক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ: এটি আমাদের পরিকল্পনার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। ষষ্ঠ পরিকল্পনায় প্রথম এই উদ্দেশ্য নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য হল অর্থনীতিকে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল অর্থনীতিতে রূপান্তরিত‌ করা। নতুন এবং উন্নত উৎপাদন কৌশল প্রবর্তনের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

(৫) ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণ: ভারতীয় পরিকল্পনার আর একটি উদ্দেশ্য হল অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে তা দূর করা। দ্বিতীয় পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিকল্পনাতেই সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

(৬) দ্রুত শিল্পায়ন: এটি ভারতীয় পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় মূল ও ভারী শিল্পের উপর সর্বাধিক জোর দেওয়

প্রশ্ন ২০। ভারতবর্ষের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সাদৃশ্যমূলক/সাধারণ উদ্দেশ্যগুলি লেখো।

উত্তরঃ ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপ –

(১) উচ্চহারে উন্নয়ন: এটি ভারতীয় পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ভারতের বিভিন্ন পরিকল্পনায় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। তারপর সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের হার নির্ধারণ করা হয়েছে।

(২) অর্থনৈতিক সাম্য: এটিও ভারতীয় পরিকল্পনার একটি প্রধান উদ্দেশ্য। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে এই উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া প্রয়োজন। ভারতে আয় ও সম্পদ বন্টনে বৈষম্য দূর করার জন্য বিভিন্ন পন্থা ও কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।

(৩) অর্থনৈতিক স্বয়ম্বরতা অর্জন: ভারতীয় পরিকল্পনার আর একটি উদ্দেশ্য হল স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্থ হল যে, দেশটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। একদিকে এর অর্থ হল বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা কমানো, অন্যদিকে এর তাৎপর্য হল আমদানি কমানো এবং আমদানি-পরিবর্ত দ্রব্য দেশের মধ্যে তৈরি করা। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনায় নানা কৌশল গৃহীত হয়েছে।

(৪) বিভিন্ন ক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ: এটি আমাদের পরিকল্পনার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। ষষ্ঠ পরিকল্পনায় প্রথম এই উদ্দেশ্য নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য হল অর্থনীতিকে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল অর্থনীতিতে রূপান্তরিত‌ করা। নতুন এবং উন্নত উৎপাদন কৌশল প্রবর্তনের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

(৫) ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণ: ভারতীয় পরিকল্পনার আর একটি উদ্দেশ্য হল অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে তা দূর করা। দ্বিতীয় পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিকল্পনাতেই সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

(৬) দ্রুত শিল্পায়ন: এটি ভারতীয় পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় মূল ও ভারী শিল্পের উপর সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়। পরবর্তী‌ পরিকল্পনাগুলিতেও শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই এটা প্রয়োজন।

(৭) দারিদ্র্য দূরীকরণ: ভারত এক বিশাল জনসংখ্যা দরিদ্র। এজন্যই পঞ্চম ও তার পরবর্তী পরিকল্পনায় দারিদ্র্য দূরীকরণ পরিকল্পনার একটি প্রধান উদ্দেশ্যরূপে গৃহীত হয়।

প্রশ্ন ২১। পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হিসাবে ‘সমৃদ্ধির সঙ্গে সমতা’এর ব্যাখ্যা করো।

উত্তর। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং সমতা – পরিকল্পনার এই উদ্দেশ্য দুটি একে অপরের স্বভাববিরোধী অর্থাৎ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সমষ্টিবাদী অর্থবিদ্যার ধারণার ভিত্তিতে বলা যায় সমাজের উচ্চ আয়সম্পন্ন ব্যক্তিদের সঞ্চয় প্রবণতা নিম্ন বা মধ্য আয় সম্পন্ন ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি। সুতরাং, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য গরিব লোকদের সপক্ষে আয় ও সম্পদের পুনর্বন্টন হলে প্রাপ্তিসাধ্য সঞ্চয়ের পরিমাণ কমবে এবং ভোগ বাড়বে। এই ভোগ বৃদ্ধি দ্রব্যের বাজারে চাহিদা বাড়াতে খানিকটা সক্ষম হলেও তা ভারতের মতো স্বল্পোন্নত দেশে অর্থনৈতিক প্রসারের ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকরী হয় না। পক্ষান্তরে, বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় তা অর্থনৈতিক প্রসারের হারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই, এই দুই উদ্দেশ্য একে অপরের সংগতিহীন।

প্রশ্ন ২২। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে ভারতে জীবিকা কাঠামোর কীরূপ পরিবর্তন ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করো।

অথবা, 

জীবিকার কাঠামো বলতে কী বোঝ ? ভারতীয় জাতীয় আয়ে বিভিন্ন খণ্ড থেকে আসা অবদানের ধারা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

উত্তরঃ পেশার ভিত্তিতে একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে মূলত তিনটি ক্ষেত্রে ভাগ করা হয়। 

যেমন 

(১) প্রাথমিক ক্ষেত্র।

(২) মাধ্যমিক ক্ষেত্র বা শিল্প ক্ষেত্র। 

(৩) তৃতীয় ক্ষেত্র বা পরিষেবা ক্ষেত্র। 

প্রাথমিক ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত আছে কৃষি বা সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী। এই সংশ্লিষ্ট কাজগুলি হল পশুপালন, বনসৃজন, মাছ ধরা বা মাছ চাষ করা ইত্যাদি। শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত কাজগুলি হল উন্মুক্ত খনি ও সুড়ঙ্গ খনি, উৎপাদন ও নির্মাণ শিল্পের কাজগুলি। তৃতীয় ক্ষেত্র অর্থাৎ পরিষেবা ক্ষেত্রটি ব্যবসা বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ও গবেষণামূলক কার্যাবলি সম্বলিত ক্ষেত্র। 

পরিকল্পনার যুগে ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রগতিশীলতার স্বাক্ষ্য বহনকারী যে সূচকগুলির কথা ভাবা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম একটি হল পেশাগত কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশের জাতীয় আয়ে ক্ষেত্রভিত্তিক বিভাজনের পরিবর্তনমুখীতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে জাতীয় আয়ে কৃষিক্ষেত্রের গুরুত্ব কমতে থাকে। সেই সঙ্গে দেশের জাতীয় আয়ে শিল্পের এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের ভূমিকা বাড়তে থাকে।

পরিকল্পনার সময়কালে দেশের জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রগত বিভাজনের চিত্রটি তালিকায় দেখানো হল।

ক্ষেত্রভিত্তিক বিভাজন (শতাংশে)

ক্ষেত্রসমূহ1950-511980-812014-15
১। প্রাথমিক ক্ষেত্র59.038.117.4
২। শিল্প ক্ষেত্র13.025.930.0
৩। পরিষেবা ক্ষেত্র28.036.052.6

তথ্যসূত্র: ভারত সরকারে অর্থনৈতিক সমস্যা।

সময়ের সাপেক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের জাতীয় আয়ে ক্ষেত্রগত বিভাজনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতির পেশাগত কাঠামোর এই চিত্রটি অটুট থাকলে দেশে অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকবে – তা খুব সহজেই বলা যায়।

প্রশ্ন ২৩। মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলতে কী বোঝ ? মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো। মিশ্র অর্থনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা দুটি দেশের নাম লেখো।

উত্তরঃ মিশ্র অর্থব্যবস্থা এমন এক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয় ধরনের অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি পরিলক্ষিত হয়। মিশ্র অর্থব্যবস্থার ধারণাটি এসেছে 1930-এর দশকের সময়কাল থেকে। 1930-এর অর্থনীতিবিদ জে. এম. কেইনস ধনতান্ত্রিক দেশগুলিকে আংশিকভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখার আহ্বান জানান।

মিশ্র অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

১। এই ধরনের অর্থব্যবস্থায় দামব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দুই-ই সক্রিয় থাকবে।

২। বেসরকারি ক্ষেত্র ও সরকারি ক্ষেত্র পাশাপাশি থাকবে এবং বেসরকারি ক্ষেত্র সরকার দ্বারা আংশিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।

৩। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির মতো উৎপাদক ও ভোক্তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অনেকটাই বজায় থাকবে।

৪। সমাজতান্ত্রিক দেশের মতো পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখার চেষ্টা থাকবে।

মিশ্র অর্থব্যবস্থা অনুসরণ করা দুইটি দেশ হল – ভারতবর্ষ, পাকিস্তান।

প্রশ্ন ২৪। ভারতের মতো স্বল্পোন্নত দেশে কৃষিক্ষেত্রে অধিকতর বিনিয়োগের পক্ষে যুক্তিগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

উত্তরঃ ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষিক্ষেত্রে অধিকতর বিনিয়োগের পক্ষে যুক্তিগুলি

(১) প্রবৃদ্ধর উচ্চতর হার: ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কৃষিরই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত কারণ কৃষিই হল জনগণের কর্মসংস্থানের প্রধান উপায় এবং জাতীয় আয়েরও এটি অন্যতম প্রধান উৎস। ভারতের পরিকল্পনার অভিজ্ঞতার‌ ভিত্তিতে দেখা যায় যে, এই ধরনের দেশে কৃষিক্ষেত্রের সমৃদ্ধি প্রবৃদ্ধির হারকেও বাড়িয়ে দেয়।

(২) জনসাধারণের জন্য খাদ্যশস্য সরবরাহ: কৃষিক্ষেত্র থেকেই জনগণের জন্য‌খাদ্য সরবরাহ পাওয়া যায় এবং তার ফলে খাদ্য ঘাটতি এড়ানো যায় ও বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়।

(৩) শিল্পের জন্য কাঁচামাল: কৃষিক্ষেত্রের বিকাশকে শিল্পায়নের প্রথম অধ্যায়রূপে গণ্য করা চলে; কারণ এখান থেকেই বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রধান কাঁচামাল পাওয়া যায়। যেমন – পাট, তুলা, চাপাতা ইত্যাদি। বলা হয় যে, কৃষিক্ষেত্র বিকাশের একটি পর্যায়ে উপনীত হলে তবেই শিল্পায়নের জন্য অর্থব্যবস্থা উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন করে।

(8) স্বল্প পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ: কৃষিক্ষেত্রে বিকাশের জন্য অনেক কম‌ পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন এবং আপেক্ষিকভাবে অধিকতর শ্রম-নিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থার‌ সাহায্যে এই উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

(৫) কারখানাজাত দ্রব্যাদির দেশীয় বাজারের সম্প্রসারণ: কৃষিক্ষেত্রের বিকাশের‌ ফলে কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার বা আয়ের বৃদ্ধি ঘটে এবং তার ফলে স্মৃতিবস্ত্র, তম্বুজাত বস্তু, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, দূরদর্শন, মোবাইল প্রভৃতির মতো দেশীয় ভোগ্যদ্রব্যের অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রসার ঘটে।

(৬) বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন: ভারতের মতো দেশে কৃষিক্ষেত্রে বিকাশের ফলে দেশে রপ্তানির বিকাশের জন্য প্রচুর উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা ও তার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়।

(৭) গ্রামীণ বিকাশ: ভারতের মতো বিশাল দেশে কৃষির বিকাশই গ্রামীণ বিকাশের একটি প্রধান প্রয়োজনীয় শর্ত।

প্রশ্ন ২৫। পরিকল্পনা আয়োগ কত সালে গঠিত হয় ? পরিকল্পনা আয়োগের কার্যাবলী লেখো।

উত্তরঃ 1950 সালে পরিকল্পনা আয়োগ গঠিত হয়। পরিকল্পনা আয়োগ কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অসাংবিধানিক ও অবিধিবদ্ধ সংস্থা। কারণ কার্যতভাবে, এটা একটি উপদেষ্টামূলক সংস্থা।

পরিকল্পনা কমিশনের কার্যাবলী –

(১) পরিকল্পনা কমিশন দেশের সব ধরনের সম্পদ তথা বস্তুগত সম্পদ, অর্থ সংক্রান্ত সম্পদ – এমনকি মানবসম্পদের মূল্যায়ন করে থাকে।

(২) দেশের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনার খসড়াপত্রের প্রণয়ন করে থাকে।

(৩) পরিকল্পনার স্তর বিন্যাস করে থাকে এবং প্রতিটি স্তরে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংকল্প গ্রহণ করা হয়।

(৪) পরিকল্পনার প্রত্যেকটি পর্যায়ের সাফল্যের মূল্যায়ন করে এবং সেই অনুসারে পরিকল্পনার কার্যক্রমের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সুপারিশ করে।

প্রশ্ন ২৬। NITI আয়োগ সম্বন্ধে একটি টীকা লেখো।

উত্তরঃ 2015 সালে ভারতের মোদি সরকার পরিকল্পনা আয়োগের পরিবর্তে ‘নিটি আয়োগ’ নামে বিকল্প সংস্থা গঠন করে। ‘National Institution for Transforming India (NITI)’ এর সংক্ষিপ্ত বাংলা প্রতিরূপ হল নিটি।

মূলত, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠে ভারতীয় অর্থনীতিতে উন্নয়নের পথ সুগম করার দৃষ্টিভঙ্গিতে এই নতুন আয়োগের প্রবর্তন করা হয়।

নিটি আয়োগের চেয়ারম্যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিটি আয়োগের পরিচালনা কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে আছে সমস্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীগণ ও সমস্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের রাজ্যপালগণ। নিটি আয়োগে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু সম্পর্কে সম্যকজ্ঞান সম্পন্ন 3/4 জন পূর্ণ সময়ের সদস্য থাকেন। নিটি আয়োগে C. E. O. ও ভাইস চেয়ারম্যান হলে অমিতাভ কান্ত।

নিটি আয়োগের কার্যাবলী-

(১) ভারত সরকারের আর্থসামাজিক সমস্যাগুলি সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নয়ন প্রকৌশল গ্রহণে ও নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্র পথ নির্দেশ প্রসঙ্গে উপদেষ্টামূলক কার্যাদি সম্পাদনা করা।

(২) আন্তমন্ত্রক আন্তঃরাজ্য সম্পর্ক সুদৃঢ় করে এবং কেন্দ্র রাজ্য সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নীতি প্রয়োগের গতি ত্বরান্বিত করা।

(৩) রাজ্যগুলিকে শক্তিশালী করে তোলার দৃষ্টিভঙ্গিতে সমবায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

(৪) সাধারণ উন্নয়ন প্রণালী থেকে বঞ্চিত সমাজের দুর্বল প্রকৃতির লোকদের উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে নীতি কাঠামো গঠন করা।

(৫) উপর থেকে নীচ পর্যন্ত উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে নীচ থেকে উপর পর্যন্ত উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণের পালা বদল করা।

(৬) রসদ কেন্দ্রস্থল (Resource Centre) এবং জ্ঞানের কেন্দ্রম্বল (Knowledge hub) হিসাবে কাজ করা।

(৭) সরকার কর্মসূচির তত্ত্বাবধান এবং সেগুলিকে মূল্যায়নের দায়ভার নেওয়া।

(৮) প্রযুক্তিগত বিদ্যার উন্নয়ন সাধনে জোর দেওয়া।

প্রশ্ন ১৭। নেহরু-মহলানবিশের উন্নয়ন কৌশল সম্বন্ধে লেখো।

উত্তরঃ স্বাধীনোত্তর ভারতে পরিকল্পনার যুগে প্রথম দিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে কৌশলটি গৃহীত হয় তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, দিগন্তকারী ও সুদূরপ্রসারী। বলাবাহুল্য, 1956 সালে ভারতের দ্বিতীয় পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই কৌশলটি গৃহীত হয়। এই কৌশলটির স্রষ্টা ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট রাশিবিজ্ঞানী প্রবাদ প্রতিম অধ্যাপক প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই কৌশলের একজন বিশিষ্ট সমর্থক ও অনুমোদনকারী। অধ্যাপক পি সি মহলানবিশের এই উন্নয়ন কৌশলটি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘শিল্পায়ন হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমর্থক।’ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কারের সাথে সাথে ভারতীয় অর্থনীতির এই উন্নয়ন কৌশলটি গৃহীত হয়েছিল। বলা যেতে পারে, 1956 সালে এদেশে একটি সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু হয় এবং সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে একটি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশল গৃহীত হয়। এই পরিকল্পিত কৌশলটি হল নেহরু- মহলানবিশের উন্নয়ন কৌশল। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নেহরু-মহলানবিশ উন্নয়ন কৌশলে শিল্পায়নের উদ্দেশ্যে দেশের ভারী শিল্প তথা মূলধনী শিল্পের উন্নয়নের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপের সুপারিশ করা হয় মূলত দেশের শিল্প কাঠামোর উন্নতি সাধনের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কৌশলকে কায়েম করার জন্য। অবশ্য নেহরু- মহলানবিশের উন্নয়ন কৌশলটি সংস্কারের যুগে বাজারি অর্থনীতির নতুন বাতাবরণে টিকে থাকতে পারে নি – তা অকপটে বলা যায়।

প্রশ্ন ২৮। ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তনের মূল কারণ সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

অথবা, 

অর্থনৈতিক সংস্কারের পটভূমিকা এবং আবশ্যকতা বর্ণনা করো।

উত্তরঃ 1991 সালে ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তনের তিনটি মূল কারণ হল –

প্রথমত, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির হার থেকে সরকারি আয় বৃদ্ধি কম হওয়ার জন্যেই বৃহৎ বিত্ত সংকট দেখা দিয়েছিল। সরকারি খণ্ডের উদ্যোগগুলোতে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছিল তবুও কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। 1990 সালের মার্চ মাসে 244 টি সরকারি খণ্ডের ক্ষতিপূরণ বা ভর্তুকি দেওয়া সত্বেও তার মধ্যে 58 টি শিল্প খণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

দ্বিতীয়ত, সীমিত উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি বা বিভিন্ন সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির  ফলে বিশেষভাবে সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষকে একেবারে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল।

তৃতীয়ত, 1990-91 সালে ভারতবর্ষের বৈদেশিক বাণিজ্যের রূপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। নিম্নগামী ভারতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক মূলধনের আমদানি কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে, ভারতীয় অর্থনীতি থেকে প্রচুর মূলধন বেরিয়ে গিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ ভারতবর্ষের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতির পরিমাণ সংকটজনক অবস্থায় পড়েছিল। এ রকম দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বিশ্বব্যাংক ও ভারতীয় অর্থনীতির পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছিল। এ হেন পরিস্থিতিতে পি. ভি. নরসিমহা রাও-এর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারের পদক্ষেপ প্রবর্তন করে।

প্রশ্ন ২৯। ভারতবর্ষের পরিকল্পনার সময়কাল সারণির সাহায্যে প্রদর্শন করো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top