Class 10 Bengali Chapter 15 পিতা ও পুত্ৰ Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 10 Bengali Chapter 15 পিতা ও পুত্ৰ and select needs one.
Class 10 Bengali Chapter 15 পিতা ও পুত্ৰ
Also, you can read SCERT book online in these sections Class 10 Bengali Chapter 15 পিতা ও পুত্ৰ Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 10 Bengali Chapter 15 পিতা ও পুত্ৰ These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 10 Bengali Chapter 15 পিতা ও পুত্ৰ for All Subject, You can practice these here…
পিতা ও পুত্ৰ
Chapter – 15
অনুশীলনীর প্ৰশ্নোত্তরঃ
ক্রিয়াকলাপ-
প্রশ্ন ১। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
(ক) সাজাহান কে?
উত্তরঃ সাজাহান হলেন ভারত সম্রাট।
(খ) পিতা-পুত্র পাঠটি কোন নাটক থেকে গ্রহণ করা হয়েছে?
উত্তরঃ পিতা-পুত্র পাঠটি সাজাহান নাটক থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
(গ) সাজাহান নাটকের নাট্যকার কে?
উত্তরঃ সাজাহান নাটকের নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
(ঘ) সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম কী?
উত্তরঃ সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল দারা।
(ঙ) ঔরঙ্গজীব সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠ/কনিষ্ঠ পুত্র। (শুদ্ধ উত্তর লেখো)।
উত্তরঃ ঔরঙ্গজেব সম্রাট সাজাহানের কনিষ্ঠ পুত্র। (শুদ্ধ)।
(চ) সুজা কোথাকার নবাব ছিলেন?
উত্তরঃ সুজা বাংলার নবাব ছিলেন।
(ছ) নাটকে স্বকল্পিত রাজাটি কে?
উত্তরঃ নাটকে স্বকল্পিত রাজা হলেন মোরাদ।
(জ) যশোবন্ত সিংহ কে?
উত্তরঃ যশোবন্ত সিংহ ছিলেন মারওয়ারের অধিপতি।
(ঝ) জয়সিংহ কে?
উত্তরঃ জয়সিংহ ছিলেন বিকানীরের মহারাজ।
(ঞ) দারার স্ত্রীর নাম কী ছিল?
উত্তরঃ দারার স্ত্রীর নাম ছিল নাদিরা।
(ট) জাহানারা কে?
উত্তরঃ জাহানারা হলো ভারত সম্রাট সাজাহানের কন্যা।
(ঠ) মোহম্মদ কার পুত্র ছিল?
উত্তরঃ মোহম্মদ ঔরঙ্গজেবের পুত্র ছিল।
(ড) দারার পুত্রের নাম কী ছিল?
উত্তরঃ দারার পুত্রের নাম ছিল সোলেমান।
(ঢ) মোরাদ কোথায় রাজত্ব করতেন?
উত্তরঃ মোরাদ বাংলায় রাজত্ব করতেন।
(ণ) দিলীর খাঁ কে?
উত্তরঃ দিলীর খাঁ সৈনাধ্যক্ষ।
প্রশ্ন ২। সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
(ক) জাহানারা কে? তার পরিচয় দাও।
উত্তরঃ জাহানারা হলো ভারত সম্রাট সাজাহানের কন্যা। জাহানারা ব্যক্তিত্বময়ী রমণী এবং ঔরঙ্গজেবের প্রতিস্পধিনী। তাঁর বুদ্ধি ক্ষুরধার, ইচ্ছাশক্তি তীব্র, ব্যক্তিত্ব প্রবল, পিতার প্রতি শ্রদ্ধাগভীর এবং ভাইয়ের প্রতিও স্নেহময়ী। নূরজাহানের পর ইতিহাসে এমন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারীচরিত্র মোগল ইতিহাসে দেখা যায় না।
(খ) “আমি যাচ্ছি আপনার সিংহাসন রক্ষা কর্তে”— উক্তিটি কার? কখন কাকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে? এর কারণ কী?
উত্তরঃ উক্তিটি সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার। উক্তিটি দারা পিতা সাজাহানকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে। উদ্ধত সুজা, স্বকল্পিত সম্রাট মোরাদ এবং তার সহকারী ঔরঙ্গজেব বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে ডঙ্কা বাজিয়ে আগ্রায় প্রবেশ করতে চাইলেও স্নেহান্ধ পিতা তাদের শাস্তি দিতে চাইছেন না। অবাধ্য পুত্রদেব বুঝিয়ে শান্ত করতে চাইলে দারা পিতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য উক্তিটি করেছে।
(গ) নাদিরা কার কন্যা? নাদিরার পরিচয় দাও।
উত্তরঃ নাদিরা পরভেজের কন্যা।
নাদিরা দারার মতন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মপ্রাণা, ক্ষমতানিস্পৃহ নারী। নাদিরা স্বামীগত প্রাণা, প্রেমময়ী স্নেহশীলা। তাঁর চরিত্রে সম্রাজ্ঞীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, দম্ভ ও অহমিকার প্রকাশ ঘটেনি। তাঁর কাছে একান্ত কাম্য ছিল শান্ত, নিরুদ্বেগ, সহজ, সরল জীবন। দিল্লীর মসনদের জন্য তিনি লালায়িত হননি।
(ঘ) “কিন্তু তুইও এর মধ্যে যাসনে’—উক্তিটি কার? কখন কাকে, কেন করা হয়েছে? তাঁর প্রকৃত কাজ কি হওয়া উচিত ছিল?
উত্তরঃ উক্তিটি ভারত সম্রাট সাজাহানের। উক্তিটি সাজাহান, কন্যা জাহানারাকে করেছেন।
সাজাহানের তিন পুত্র সুজা, মোরাদ এবং ঔরঙ্গজেব পিতা সাজাহানকে আক্রমণ করতে তৈরি। একমাত্র দারা পিতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি এই বিদ্রোহ দমন করতে চাইছেন। জাহানারাও দারাকে সমর্থন জানিয়েছে। সেও দারাকে যুদ্ধে যাবার জন্য অনুপ্রাণিত করছে।
(ঙ) ‘সাজাহান শুধু পিতা নয় সম্রাট।’ কথাটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তরঃ সম্রাট সাজাহানের অসুস্থতার খবর পেয়ে বঙ্গদেশে সুজা, গুজরাটে মোরাদ এবং দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেব এই তিন পুত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে সসৈন্যে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে। জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা এদের বিদ্রোহ দমনের জন্য সৈন্য প্রেরণের অনুমতি প্রার্থনা করলে স্নেহকাতর পিতা সাজাহান দারার এই প্রস্তাবে প্রথমে অসম্মতি প্রকাশ করেন। কেননা এর ফলে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ হবে, আর এই আত্মঘাতী যুদ্ধে নিজেরাই ধ্বংস হবে। সাজাহান স্নেহকাতর পিতা। তাঁর পুত্ররা মাতৃহারা। মাতার অবর্তমানে তিনি পিতার স্নেহ দিয়েই তাদের মানুষ করেছেন। সেজন্য তিনি স্নেহ দিয়েই বিদ্রোহী পুত্রদের শাসন করবেন।
(চ) ‘পিতা-পুত্র’ পাঠে পিতাপুত্রের পরিচয় দাও।
উত্তরঃ মোগল সম্রাট সাজাহানের চার পুত্র দারা, সুজা, মোরাদ, এবং ঔরঙ্গজেব, কন্যা জাহানারা।
সুজা ছিলেন বাংলাদেশের সুবেদার। মোরাদ নিজে স্বকল্পিত সম্রাট। কনিষ্ঠ পুত্র ঔরঙ্গজেব মোরাদের সহকারী হয়ে আগ্রায় প্রবেশ করার জন্য তৈরি। একমাত্র জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা পিতার নামে রাজ্য পরিচালনা করছেন। সাজাহান আগ্রার রাজপ্রাসাদে একমাত্র কন্যা জাহানারার তত্ত্বাবধানাধীন।
(ছ) ‘পিতা-পুত্র’ পাঠটি কোন নাটকের কোন অঙ্কের কোন দৃশ্য থেকে গ্রহণ করা হয়েছে?
উত্তরঃ ‘পিতা-পুত্র’ পাঠটি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাজাহান নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন ৩। শূন্যস্থান পূর্ণ করো।
(ক) আমার হৃদয় এক …………জানে। সে শুধু……….. শাসন।
উত্তরঃ আমার হৃদয় এক শাসন জানে। সে শুধু স্নেহের শাসন।
(খ) আমি দর্শনে………….. এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য পেয়েছি।
উত্তরঃ আমি দর্শনে উপনিষদে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য পেয়েছি।
(গ) আমি যাচ্ছি আপনার…………… রক্ষা করতে।
উত্তরঃ আমি যাচ্ছি আপনার সিংহাসন রক্ষা করতে।
(ঘ) তা’রা জানুক সম্রাট…………. , …………. কিন্তু…………. নয়?
উত্তরঃ তা’রা জানুক সম্রাট সাজাহান স্নেহশীল কিন্তু দুর্বল নয়?
(ঙ) আমার পুত্র ……………সুজার বিরুদ্ধে যাত্রা করার জন্য লিখছি।
উত্তরঃ আমার পুত্র সোলেমানকে সুজার বিরুদ্ধে যাত্রা করার জন্য লিখছি।
(চ) আর তার সঙ্গে………….. মহারাজ………….. আর…………. দিলীর খাঁকে পাঠাচ্ছি।
উত্তরঃ আর তার সঙ্গে বিকানীরের মহারাজ জয়সিংহ আর সৈন্যাধ্যক্ষ দিলীর খাঁকে পাঠাচ্ছি।
৪। রচনাধর্মী উত্তর লেখো।
প্রশ্ন ১। সাজাহানের পিতৃস্নেহের যথাযথ বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রচিত ‘সাজাহান’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাজাহান -সাজাহানের ট্র্যাজেডির কারণে নাটকটি ট্র্যাজেডি অভিধা পায়। সম্রাট সাজাহানের দ্বিধাবিভক্ত হৃদয়ের পরিচয় রয়েছে নাটকে। সাজাহান ছিলেন ‘গ্রেট মোগল’-এর তৃতীয় মোগল—ভারতবর্ষের সম্রাট। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন পুত্র-কন্যার জনক। স্বভাবতই সাজাহানের মধ্যে দুটি সত্তার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় আর এই দুই সত্তার অস্তিত্বের সমন্বয় করতে না পেরে সাজাহানের জীবন এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে।
সাজাহান ট্র্যাজিক নায়ক। ব্যক্তি হিসেবে সাজাহান অতি ভাল ও অতি মন্দর মাঝামাঝি একজন সাধারণ মানুষ। সম্রাট সাজাহান নয়-এই ব্যক্তি সাজাহানের—চার পুত্র ও দুই কন্যার পিতা সাজাহানের জীবনের বিপর্যয়ের চিত্র অঙ্কনই ছিল সম্ভবত নাট্যকারের উদ্দেশ্য। কারণ সাজাহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাসের কোন বিপর্যয়ে সাজাহান পীড়িত হয়নি—তাঁর আত্মা ক্রন্দন করে উঠেছে তাঁর আপন সন্তানদের পরিণতি ও ব্যবহারে।
চরিত্রের মধ্যেই নিহিত থাকে এই চরিত্রের ভাগ্যবিপর্যয়ের কারণ। চরিত্রের অন্তর্নিহিত কোন ত্রুটি অথবা বিচারবিভ্রান্তিমূলক ত্রুটি চরিত্রটিকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। সাজাহানের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। তাঁর চরিত্রের ত্রুটি হলো সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও সম্রাটসুলভ আচরণে তাঁর ঘাটতি ছিল—বিদ্রোহী পুত্রদের প্রতি সম্রাটের যে আচরণ করা ন্যায়সঙ্গত তা তিনি করতে পারেন নি। পুত্র ঔরঙ্গ জেবের সম্বন্ধে তাঁর ধারণার বিচারের ত্রুটি থেকে গিয়েছে। স্নেহান্ধ পিতা হিসেবে সাজাহান চেয়েছেন অবাধ্য এবং বিদ্রোহী পুত্রদের স্নেহের শাসনে বশ করতে। এ সম্বন্ধে তাঁর উক্তি, ‘আমার হৃদয় এক শাসন জানে, সে শুধু স্নেহের শাসন।’ অবশ্য এই সময় সাজাহানের সম্রাটসত্তার কিছুটা অবশিষ্ট ছিল, সেজন্য দারা ও জাহানারার পরামর্শে বিদ্রোহী পুত্রদের দমন করার জন্যে সৈন্য প্রেরণ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেবকে আগ্রার দুর্গে, ঔরঙ্গজেবের শর্ত মেনে নিয়ে পুত্রস্নেহের আতিশয্যে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন—এটি তাঁর জীবনের চরমতম ভুল। সাজাহান নিজে বন্দী হয়েছেন—অন্যান্য পুত্রেরা নিহত হয়েছে। আত্মক্ষয়ের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে সাজাহানকে জীবনের শেষ দিনগুলি অতিক্রম করতে হয়েছে।
তিনটি স্তরের মধ্যে দিয়ে নাট্যকার সাজাহানের সম্রাটসত্তা ও পিতৃসত্তার দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন। নাটকের শুরু থেকে আগ্রাদুর্গে বন্দী হওয়া পর্যন্ত ঘটনাকাল নাটকের প্রথম স্তর। এই স্তরে সাজাহানের সম্রাটসত্তার আত্মাভিমান বজায় ছিল। এর পরের স্তর ঔরঙ্গজেবের দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ এবং নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা- এই স্তরে সাজাহানের সম্রাটসত্তার পরাজয় সম্পূর্ণ। ঔরঙ্গজেব যে তিনি জীবিত থাকতে সিংহাসনে আরোহণ করতে পারে- এ তাঁর কল্পনায় ছিল না। এই অভাবনীয় ঘটনায় সাজাহান অর্ধোন্মাদ। তৃতীয় স্তরের ঘটনায় মোরাদের আসন্ন মৃত্যুর ছায়া এবং দাবার বন্দী হওয়ার ঘটনায় সাজাহান সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। সব কিছু হারিয়ে সাজাহান শুধু আর্তনাদই করে গিয়েছেন।
সাজাহান চরিত্রের বিবর্তনের প্রথম স্তরে নাট্যকার ‘সাজাহানের সম্রাটসত্তার রূপটি দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের পিতৃসত্তার চেহারাটিরও পরিচয় দিয়েছেন। সাজাহান আক্ষেপ করেছেন : ‘ঈশ্বর পিতাদের এই বুকভরা স্নেহ দিয়েছিলে কেন? কেন তাদের হৃদয়কে লৌহ দিয়ে গড়নি।’ পরক্ষণেই দারার যুক্তি মেনে নিয়েছেন—সম্রাটসত্তা জাগ্রত হয়েছে তাঁর অন্তরে। সাজাহান বলেছেন, ‘বেশ তাই হোক’ -তারা জানুক যে সাজাহান শুধু পিতা নয়, সাজাহান সম্রাট।’
সাজাহান চরিত্রের দ্বিতীয় স্তরের ঘটনাবলী হলো ধর্মটি ও সামুগড়ের যুদ্ধে দারার পরাজয় এবং ঔরঙ্গজেবের আগ্রায় প্রবেশ। এই স্তরে সাজাহানের সম্রাটসত্তার অবসান ঘটে। সাজাহান ভেবেছিলেন স্নেহের শাসনে উদ্ধৃত পুত্র ঔরঙ্গজেবকে বশ করবেন কিন্তু তা হয় নি। অবশ্য পুত্রের ঔদ্ধত্যে সাজাহানের অভিমানে আঘাত লাগলেও তিনি পুত্রের যুদ্ধ-পারদর্শিতায় গর্বিত। সাজাহান সে কথা জানিয়েছেন, “সে আমার উদ্ধৃত পুত্র। আমার লজ্জা, আমার গৌরব।” কিন্তু গৌরবের অবসান হয়- সাজাহান ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দী হন। সাজাহান তখন, শেষবারের মতো সম্রাটসত্তাকে জাগিয়ে তুলতে চাইলেন, “আমি সম্রাট সাজাহান। এই কে আছ। নিয়ে এসো আমার বর্ম, আর তরবারি।” কিন্তু সাজাহানের আহ্বানে কেউ সাড়া দেয় না। সাজাহানের সম্রাটসত্তা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে। সাজাহান চীৎকার করে ওঠেন, “পিতা সব, আর নিজে না খেয়ে পুত্রদের খাইও না, বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়িও না—তাদের শাস্তি দিতে যদি তোমার বুকে ব্যথা লাগে তো বুক ভেঙ্গে ফেলো। চোখে জল আসে তো চোখ উপড়ে ফেলো, আর্তনাদ করতে ইচ্ছে হয় তো নিজের টুটি চেপে ধরো।”
এর পরে সাজাহান চরিত্রের তৃতীয় স্তর। আগ্রার দুর্গে বন্দী সাজাহান জানতে পারলেন সুজা সপরিবারে আরাকানে পলাতক, ভিক্ষুক অবস্থায় জীবনযাপন করছে, মোরাদ গোয়ালিয়রে বন্দী, দারাও বন্দী, সকলেরই মৃত্যু আসন্ন। এই স্তরে সাজাহান সম্পূর্ণ উন্মাদ। কখনও জিজ্ঞাসা করেন “ভাই ভাইকে হত্যা করবে?” আবার কখনো জাহানারাকে আশীর্বাদ করেন, “যেন তোর পুত্র না হয়, শত্রুরও যেন পুত্র না হয়।” শেষকালে ঔরঙ্গজেবের শীর্ণ দেহ, কোটরাগত, চক্ষু, শুষ্ক পাণ্ডুর মুখ দেখে সাজাহান সকল অপরাধের নায়ককে পুত্র বলেই ক্ষমা করেন।
সাজাহান চরিত্রটি পিতৃসত্তা ও সম্রাটসত্তার দ্বন্দ্বে আলোড়িত হলেও শেষপর্যন্ত পিতৃসত্তাই জয়ী হয়েছে। চারপুত্রের হত্যার নায়ক পিতার দুঃখের কারণ ঔরঙ্গ জেবকে শেষ পর্যন্ত সাজাহান ক্ষমা করেন কেবল এই ভেবেই যে, সেই-ই একমাত্র জীবিত পুত্র।
প্রশ্ন ২। দারার চরিত্র বর্ণনা করো।
উত্তরঃ দারা সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং সর্বাপেক্ষা প্রিয়জন। সাজাহান দারাকে যে বিশেষ স্নেহ করতেন তার কারণ দারার মানবোচিত গুণ। ইতিহাসও দারার ব্যক্তিত্বের এই দিকটি সমর্থন করে। নাট্যকার দারার চরিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে ইতিহাস-বর্ণিত দারাকেই নিষ্ঠাসহকারে অনুসরণ করেছেন।
দারার ভূমিকা সাজাহান নাটকে অন্যতম প্রধান চরিত্রের ভূমিকা। তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন অসুস্থ পিতার প্রতিনিধি হিসেবেই। সুস্থ অবস্থায়ও সাজাহান দারাকে নিজের কাছেই রেখে দিতেন। এর কুফলও ফলেছিল। সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্যে যে রাজনীতিক জ্ঞান, শাসন পরিচালনার জন্যে ব্যক্তিত্বের যে কঠোরতা দরকার দারার মধ্যে বিলক্ষণ তার অভাব থেকে গিয়েছিল। সম্রাটের স্নেহচ্ছায়ায় বর্ধিত হবার ফলে বয়সে দারা বেড়ে উঠলেও সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণের মানসিক প্রস্তুতি তাঁর মধ্যে গড়ে ওঠেনি। দারা চরিত্রের মানসিক গঠনটাই ছিল আলাদা। মধ্যযুগের সেই ধর্মান্ধতার যুগে দারা ছিলেন ধর্ম সম্বন্ধে উদার এক ব্যক্তিত্ব। হিন্দুদর্শন, বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি পাঠে তাঁর মধ্যে এক ধরনের উদার চিন্তাধারার উদ্ভব হয়—হিন্দুদের তিনি ভালবাসতে শুরু করেন। দারার এই মানসিকতা দেখে মনে হয় যথার্থ তিনিই আকবরের প্রপৌত্র হবার উপযুক্ত ছিলেন। আর ঠিক এই জন্যেই ঔরঙ্গজেব তাঁকে বিধর্মী আখ্যা দেন।
নাটকে দারার আবির্ভাব প্রথম দৃশ্যেই। এই সময় অসুস্থ পিতার পরামর্শে তিনিই সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন কিন্তু কোন অন্যায় সুযোগ গ্রহণের যে তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না তা তার উক্তি থেকে স্পষ্ট। তিনি সাজাহানকে জানিয়েছেন, ‘আমি এ সাম্রাজ্য চাই না। আমি দর্শনে, উপনিষদে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য পেয়েছি। আমি যাচ্ছি আপনার সিংহাসন রক্ষা করতে।’ বস্তুত দারা যে নিজেকে কখনই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখতে চান নি নাটকের মতো ইতিহাসেও তার প্রমাণ রয়েছে। নাট্যকার দারার শেষ পরিণতির রূপরেখা অঙ্কনে ইতিহাসকেই বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছেন। ইতিহাস অবশ্য সেভাবে দারার মৃত্যুজনিত সাধারণ প্রতিক্রিয়ার কথা জানায় নি। নাট্যকার যেহেতু মানবিক দলিল রচনা করেছেন সেজন্য দারার করুণ এবং নৃশংস মৃত্যুর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা জানিয়েছেন। হস্তীপৃষ্ঠে দারা ও তার পুত্রের নগর প্রদক্ষিণের ব্যাপারটি যে কিভাবে সাধারণকে প্রভাবিত করেছিল তার বর্ণনা পাই জাহানারার উক্তিতে “তাদের এই অবস্থা দেখে এই রাজপুরীর একটি লোকও ছিল না যে কাঁদেনি।” দারার মৃত্যুর পর দিলদারের উক্তি, “একটা পর্বত ভেঙে পড়ে রয়েছে, একটা সমুদ্র শুকিয়ে গিয়েছে, একটা সূর্য মলিন হয়ে গিয়েছে।”
দারা জীবন দিয়ে জন্মের ঋণ শোধ করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর আক্ষেপোক্তি বড়ই করুণ, ‘ঈশ্বর পূর্বজন্মে কি মহাপাপ করেছিলাম’। তবুও দারা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারান নি। দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে দারাকে দেখা যায় রাজপুতানার মরুভূমিতে—সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সকলেই এমন বিপর্যস্ত যে সকলকে হত্যা করে দারা নিজেও আত্মহত্যায় উদ্যত। কিন্তু এই চরম বিপর্যয়ের অবস্থাতেও দারা ঈশ্বরকে স্মরণ করেছেন, ‘ঈশ্বর …তোমাকে অনেকবার স্মরণ করেছি। কিন্তু এমন দুঃখে এমন দীনভাবে, এমন কাতর হৃদয়ে আর কখনও ডাকিনি। দয়াময়, রক্ষা কর।’ মানবিক বোধের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রতি এই আস্থা দারাকে কোন অনৈতিক কাজে প্রণোদিত করতে পারেনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সমস্ত রকম মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী।
স্ত্রী নাদিরার প্রতি দারার আচরণেও এই মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটেছে। দারা যেভাবে তাঁর স্ত্রীকে ভালবেসেছেন মোগল হারেমে তা বিরল দৃষ্টান্ত। নাদিরার মৃত্যুশয্যার পাশে দারার যে বিলাপরত রূপ দেখা যায় তা কোন মোগল যুবরাজের মনে হয় না। মনে হয় একজন প্রেমবিহ্বল পত্নীবৎসল স্বামী বিলাপরত।
দারার মৃত্যু সেজন্য কেবলই একজন সম্রাট পুত্রের মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু সৎ, পবিত্র মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন মানুষের মৃত্যু। সেই কারণে একে সাধারণ মৃত্যু হিসেবে গণ্য করা যাবে না- একজন উদার মানবপ্রেমিক, আদর্শ পুত্র, আদর্শ পিতা ও স্বামীর রাজনীতির ক্রুর চক্রান্তের যুপকাষ্ঠে প্রদত্ত বলি হিসেবেই একে দেখতে হবে। দারার মৃত্যু তাই দার্শনিক জ্ঞানী দিলদারের কাছে, “এ বড় মহিমময় দৃশ্য। …ব্রহ্মাণ্ডর একদিকে সৃষ্টি একদিকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সংসারেও তাই। এ একটা ধ্বংস-বিরাট পবিত্র মহিমময়।”
প্রশ্ন ৩। জয় সিংহ সম্পর্কে যাহা জান লেখো।
উত্তরঃ ‘সাজাহান’ নাটকের অন্যতম চরিত্র জয়সিংহ। তিনি জয়পুরের মহারাজ। জয় সিংহ ঐতিহাসিক চরিত্র এবং মুঘলদের অনুগত। এই নাটকে সাজাহানের ঐতিহাসিক পতন ও ঔরঙ্গজেবের অভ্যুত্থানে জয়সিংহের ভূমিকাটি স্মরণীয়। তিনি দোষে-গুণে গড়া রক্তমাংসেব খাঁটি চরিত্র। জয় সিংহ সাজাহানের বিশ্বস্ত সেনাধ্যক্ষ। ঔরঙ্গজেবের অভ্যুত্থানের সময় জয় সিংহ এবং অন্যান্য সেনাপতিবৃন্দ দারাকে সাহায্য না করে কৌশলে নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করেছেন। তাঁরা সময় সুযোগ মত ঔরঙ্গজেবের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। অবশ্য ঔরঙ্গ জেব ভীষণ সুযোগসন্ধানী রাজপুরুষরূপে কথিত এবং নাটকে তার সেই ভূমিকাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার সুযোগসন্ধানী ভূমিকাটুকু জয় সিংহ নাটকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাঁর কোনো অনুতাপ নেই। তিনি সুজাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন আবার দারার ব্যাপারে সোলেমানকে তিনি গোপন নির্দেশের কথা জানিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জয় সিংহ দারার প্রভুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয়ী ও ঔরঙ্গজেবের প্রভুত্ব মেনে নেওয়ার কারণে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
জয় সিংহ ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিনি প্রবলতর শাসকের অনুগ্রহভাজন হতে জ্যোতিষীর সহযোগিতা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কে ভারত সম্রাট হবেন? জ্যোতিষীর গণনায় ঔরঙ্গজেবের উত্থান অবশ্যম্ভাবী জেনে তিনি তাঁর পক্ষ অবলম্বন করেছেন। জয় সিংহ একাই আনুগত্যকে স্বীকার করেন নি। তিনি দিলীর খাঁ সহ অন্যান্য সেনাপতিদেরও ঔরঙ্গজেবের আনুগত্য গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। দারার বিপর্যয়ে তাঁর পুত্র সোলেমান জয় সিংহের কাছে নতজানু হয়ে কাতর প্রার্থনা জানালেও জয় সিংহ তাঁকে সহযোগিতা করেন নি এবং তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কোনো গ্লানি অনুভব করেন নি। দিলীর খাঁ শেষ অবধি যে বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিতে পারেন নি জয়সিংহ নির্বিধায় সেই ভূমিকা পালন করেছেন।’ জয় সিংহ রাজপুতজাতির ইতিহাসে যে চিরকালের কলঙ্ক এবং তাঁর সেই অধঃপতন জাতীয় চরিত্রের গৌরবকে আহত করে। আত্মস্বার্থের সিদ্ধিসাধন জয় সিংহের মূল বৈশিষ্ট্য বলেই তিনি অকপটে দিলীর খাঁকে বলতে পারেন, “এক ফোঁটা চোখের জলে গলে গেল খাঁ সাহেব। তোমার মঙ্গল তুমি বুঝলে না।” কোনো নৈতিকতা জাতীয়তাবোধ স্বদেশ চিন্তা তাকে উদ্বোধিত বা অনুপ্রাণিত করে না। দিলীর খাঁর পাশে যেন জয় সিংহ কালিমাময় চরিত্র। একমাত্র ঔরঙ্গজেব তাঁর গুণগ্রাহী। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের ছলনা উপলব্ধি করার মতো কুটবুদ্ধি জয় সিংহের নেই। যশোবন্ত সিংহ ঔরঙ্গজেবের বিরোধী পক্ষের ব্যক্তি হলেও জয় সিংহের ব্যক্তিগত সুহৃদ, সেজন্য তিনি জয় সিংহের কাছে এমনভাবে অভিনয় করলেন যে জয় সিংহের সুহৃদ বলেই তিনি তাঁকে মার্জনা করতে চান। যশোবন্ত সিংহের দেশ প্রীতি জয় সিংহের দেশপ্রীতি অপেক্ষা অনেক উন্নত মহিমায় আসীন। তিনি একবার রাজসিংহ, জয় সিংহ এবং যশোবন্ত সিংহের মিলিত বাহিনীর দ্বারা মোঘল তাড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু জয় সিংহ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তাঁর পক্ষে ঔরঙ্গজেবের প্রভুত্ব অনেক মর্যাদাকর ছিল কিন্তু রাজসিংহের প্রভুত্ব অমর্যাদাকর বলে মনে হয়েছিল। জয় সিংহ সংকীর্ণ, বিদ্বেষপরায়ণ, দেশপ্রেমাক্ষম, কাপুরুষ এবং খোসামুদে। প্রকৃতপক্ষে তাঁকে এক ঘৃণ্য ব্যক্তিরূপে চিত্রিত করা চলে। তাঁর চরিত্র কথাতেই স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে—“আমি কোন উচ্চ প্রবৃত্তির ভান করি না, সংসার আমার কাছে একটা হাট, যেখানে কম দামে বেশি পাব সেখানেই যাব। তিনি কাজভুক্ত নন, পর-পদানত, এবং তিনি আনুগত্যকে ধর্ম বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে নিজেকে মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু আদৌ সেই পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন নি, উপরন্তু তাঁর চাটুকারিতার জন্য ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।”
প্রশ্ন ৪। যশোবন্ত সিংহের চরিত্র আলোচনা করো।
উত্তরঃ দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সাজাহান’ নাটকে যে চরিত্রটির আচার ও ব্যবহার অসঙ্গতিপূর্ণ সেই চরিত্রটি হলো যোধপুরাধিপতি মহারাজ যশোবন্ত সিংহ। দ্বিধাগ্রস্ততা ও দুর্বলতাই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সমালোচকের ভাষায়—‘একদিকে সখ্যস্থাপন, আনুগত্যের ইচ্ছা, অন্যদিকে রাজপুত অহঙ্কার—এই দুয়ের মধ্যে তিনি ঘুরপাক খাচ্ছেন। মহারাজ যশোবন্ত সিংহ দারা কর্তৃক ঔরঙ্গজেব ও মোরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরিত হলেও ঔরঙ্গজেবের কূটকৌশল ও মোরাদের শৌর্যে পরাজিত হন। তিনি যথার্থ রাজপুতের মতো সম্মুখ যুদ্ধে বিশ্বাসী ছিলেন বলে ঔরঙ্গজেবের কপটতার অনুরূপ কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করেন নি। তিনি রাজপুত-চরিত্রের সরলতা, নির্ভীকতার অহঙ্কার করেছেন। ঔরঙ্গ জেব জানতেন যে যশোবন্ত সিংহের রাজপুত দর্পই তাঁর পতনের কারণ হবে। নাটকের শেষ পরিণতিতে লক্ষ্য করা যায় যে, শেষ পর্যন্ত যশোবন্ত সিংহ ঔরঙ্গজেবের করদ-রাজ-এ পরিণত হয়েছে। যশোবন্ত সিংহ দর্পহীন, ম্লান ব্যক্তিত্ব—আর এইখানেই যশোবন্ত সিংহের ট্র্যাজেডি। নাটকের প্রথমাঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যেই লক্ষ্য করা যায় যে, পরাজিত যশোবন্ত সিংহ স্বরাজ্য যোধপুরে প্রত্যাগমন করলে মহামায়ার আদেশে তাঁর মুখের উপর দুর্গদ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যশোবন্ত সিংহের বিড়ম্বনা হলো যুদ্ধে পরাজয় আর এই পরাজয়ের ফলে পত্নীর তিরস্কার ও অবমাননা।
দ্বিতীয় অঙ্কের পঞ্চম দৃশ্যে নাটকে যশোবন্ত সিংহ পুনরায় আবির্ভূত হন। ঔরঙ্গ জেব যখন দিল্লীতে সম্রাট হয়ে বসেছেন তখন যশোবন্ত এসেছেন সুজার বিরুদ্ধে এসে তিনি যুদ্ধে তাঁকে সহযোগিতা করতে। কিন্তু রাজসভায় এসে তিনি ঔরঙ্গজেবকে প্রশ্ন করেছেন- ‘কী অপরাধে আমাদের দয়ালু সম্রাট আজ বন্দী, আর কি স্বত্বে আপনি পিতা বর্তমানে তাঁর সিংহাসনে বসেছেন।’ ঔরঙ্গজেব যশোবন্তের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না দিয়ে, তাঁর বিরোধিতা না করে তাঁকে সপক্ষে গ্রহণের কথা বলেছেন। তাঁর আনুগত্য দাবি করেছেন। যশোবন্ত তার উত্তরে জানিয়েছেন- ‘আমি আজ এ সভায় জাহাপনার দয়ার ভিখারী হয়ে আসি নাই। তিনি বাহুবলে সম্রাটকে মুক্ত করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন। ঔরঙ্গজেব যশোবন্তের সংকল্পকে ধূলিসাৎ করার কথা ঘোষণা করেছেন। যশোবন্ত সিংহের কাছে শায়েস্তা খাঁ আর মীরজুমলা দুইজনেই নেমকহারাম ও শয়তান। প্রকাশ্য সভায় জাহানারা ঔরঙ্গজেবের বিরোধিতা করতে এসে ঔরঙ্গজেবের বাকচাতুর্যে পরাজিত হন। ঔরঙ্গজেব সভাসদদের কাছ থেকে সমর্থন আদায় করেন। যশোবন্ত সিংহও তাঁকে সমর্থন জানান। দ্বিধাগ্রস্ততা ও দুর্বলতা যশোবত্তের চরিত্রবৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দেয়।
যশোবন্ত সিংহের দোলাচলচিত্ততার জন্যই সুজা ঔরঙ্গজেবের হাতে পরাজিত হয়। যশোবন্ত সুজার পক্ষে যোগ দিলে হয়তো সুজা জয়লাভ করতেন এবং সাজাহান মুক্ত হতেন। কিন্তু যশোবন্তের চঞ্চলমতিত্ব ঔরঙ্গজেবের জয়ের পথ নিশ্চিত করেছে। ঔরঙ্গজেবের বিরোধিতা করলেও শেষ অবধি তাঁর বিরোধিতা কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারেনি। যশোবন্তের চরিত্রে হিন্দুরাজ্য ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন থাকলেও তা কখনো বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। যশোবন্ত যতখানি বাক্যবীর ততখানি কর্মবীর নন। শেষ অবধি লক্ষ্য করা যায় যশোবন্ত সিংহ ঔরঙ্গজেবের বশংবদ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য যশোবন্ত সিংহের এই অধঃপতনের জন্য মহামায়ার ভূমিকাও ক্রিয়াশীল ছিল। স্ত্রী মহামায়ার অবজ্ঞা ও ধিক্কারের ফলে যশোবন্ত সিংহ যেন পত্নীর উপরে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উদ্দীপ্ত হয়েছেন। তিনি রাজপুত বীরের আদর্শভ্রষ্ট হয়ে এক নিষ্প্রভ ম্লান ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। মহাতেজস্বিনী রাজপুত রমণীর আদর্শ স্বামী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে যশোবন্ত সিংহ ‘সাজাহান’ নাটকে সাধারণ মানুষের অন্তরে পর্যন্ত না থেকে ঔরঙ্গজেবের বশংবদ গোলাম হয়ে পড়েছেন।
নাটকে যশোবন্ত চরিত্রের আরও একটি দিক লক্ষ্য করা যায়। তাঁর চারিত্রিক কলঙ্ক তাঁকে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। যশোবন্ত দারাকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ঔরঙ্গজেবের পক্ষে যোগদান করে এই কাজের জন্যে তিনি গুর্জর প্রদেশ লাভ করেন। আর ঠিক এই কারণেই তিনি স্ত্রীর ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। পত্নী মহামায়া যুদ্ধে পরাজিত, বিশ্বাসঘাতক স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন, “…যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে এসে, কৃতঘ্ন হয়ে ফিরে এসে —তুমি চাও আমার ভক্তি না? মহামায়ার দৃষ্টিতে যশোবন্তের চরিত্রের এই দিকটি প্রকাশিত, জানো সমস্ত রাজপুতানা তোমায় ধিক্কার দিচ্ছে। হায় স্বামী। কি বলবো, তোমার এই অপমানে আমার শিরায় অগ্নিস্রোত বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে অপমান তোমাকে স্পর্শও করছে না। অপদার্থ বটে।”
রাজপুত ঐতিহ্যের বীরত্ব ও সাহসিকতা যশোবন্তের থাকলেও কোনো সময় সে নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। রাণা রাজসিংহের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখলেও সেই স্বপ্নকে সে বাস্তবায়িত করতে পারেনি সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের কারণে।
প্রশ্ন ৫। ‘পিতা-পুত্র’ পাঠটির সারাংশ লেখো।
উত্তরঃ ভারত সম্রাট সাজাহান বৃদ্ধ। তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। আগ্রার রাজপ্রাসাদে একমাত্র কন্যা জাহানারার তত্ত্বাবধানাধীন। তাঁর চার পুত্র দারা, সুজা, মোরাদ ও ঔরঙ্গজীব। দারা জ্যেষ্ঠ পুত্র। পিতার নামে রাজ্য পরিচালনা করছেন তিনি। সম্রাটের দ্বিতীয় পুত্র সুজা বাংলার নবাব কিন্তু উদ্ধত স্বভাবের মানুষ। তৃতীয় পুত্র নিজে স্বকল্পিত সম্রাট। কনিষ্ঠ পুত্র ঔরঙ্গজীব মোরাদের সহকারী হয়ে আগ্রায় প্রবেশ করার সুযোগ সন্ধানে তৎপর। হঠাৎ সম্রাটের ভিত্তিহীন মৃত্যু সংবাদ ভারতের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায়, দারা জ্যেষ্ঠ পুত্র ভারত সম্রাট হবে ভেবে সুজা, মোরাদ এবং ঔরঙ্গজীব দারার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। সকলে একই সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। খবরটি দারার কাছে পৌঁছোলে দারা বিদ্রোহী ভ্রাতাদের সমুচিত শাস্তি দেবার জন্য কৃত সংকল্প হন। ভগ্নী জাহানারাকে দারার পক্ষে মতপোষণ করায় সম্রাট সাজাহান মেয়েকে এ ব্যাপারে চুপ থাকতে বলেন। জাহানারা এতে রাজী নহেন।
এ কাজে অথর্ব পিতা সাজাহান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। তাঁর ধারণা পরিণত বয়স্ক পুত্রেরা তার নিকট অল্প বয়স্ক নির্বোধ শিশুমাত্র এখনও। তিনি চান তাঁর পুত্রদের আগ্রায় আণয়ন করে মৃদু ভর্ৎসনার দ্বারা সম্রাট বিরোধী কার্যকলাপ থেকে নিবৃত্ত করতে। কারণ তিনি এখনও জীবিত আছেন।
সম্রাট দারার প্রতি স্নেহশীল হলেও অন্যান্য পুত্রদের প্রতিও তার একই পরিমাণ স্নেহ-মমতা-মায়া আছে। রাজার নির্দেশ দায় যেন তাঁর ভাইদের প্রতি খড়্গ হস্ত না হন। নিরুৎসাহ দারা পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ তাঁর বাক্য লঙ্ঘন করতে পারেন না। কন্যা জাহানারা এমতাবস্থায় পিতার নিকট জানতে চায় যে এটা কি সম্রাট সাজাহানের উপযুক্ত কথা। এ দৌর্বল্য তাঁর সাজে ? পিতা জানান যে তারা তাঁর পুত্র, তিনি শুধু জানেন স্নেহের শাসন। মাতৃহারা সন্তানেরা সম্রাটের হৃদয়ের এক শাসনই জানবে। তাঁর কাছে স্নেহ ছাড়া আর কোনও যুক্তি নেই। দারার স্ত্রী নাদিরা দারাকে শুধু একটি অনুরোধ জানায় যে এই যুদ্ধ আর নয়। দারা শেষবার জানায় যে এ যুদ্ধ অনিবার্য তিনি সৈন্যদের যুদ্ধে যাবার আজ্ঞা দিতে চান। সম্রাট সাজাহান জাহানারাকে জানান যে সে যেন এ আবর্জনায় পা না দেয়। অন্তত যে পবিত্র থাকুক।
প্রশ্ন ৬। ‘পিতা-পুত্র’ পাঠটি কোন নাটকের অংশ বিশেষ? নাট্যকার সম্পর্কে যাহা জান লেখো।
উত্তরঃ ‘পিতা-পুত্র’ পাঠটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাজাহান নাটকের অংশ বিশেষ।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাট্যপ্রতিভার মধ্যলগ্নে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) আবির্ভাব। মধুসূদন, দীনবন্ধু বাংলা নাট্যসাহিত্যকে আধুনিক চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, কিন্তু তার পরে গিরিশচন্দ্র, মদনমোহন বসু প্রভৃতি নাট্যকারেরা পৌরাণিক ও ধর্মমূলক নাটক রচনা করে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকেই ফিরিয়ে আনেন। দ্বিজেন্দ্রলাল কিন্তু ঐ পথে পদচারণা করেন নি- তিনি যুগ প্রেক্ষিতকে স্মরণে রেখে নাট্যসাহিত্যকে আধুনিক চিন্তা চেতনার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকগুলিকে মোটামুটি চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা চলে—
(ক) প্রহসন।
(খ) নাট্যকাব্য।
(গ) ঐতিহাসিক নাটক।
(ঘ) সামাজিক নাটক।
(ক) প্রহসন – দ্বিজেন্দ্রলাল ছয়খানি বিদ্রুপাত্মক নাটক ও প্রহসন রচনা করেন। কল্কি অবতার (১৮৯৫), বিরহ (১৮৯৭), ত্র্যহস্পর্শ (১৯০০), প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২) পুনর্জন্ম (১৯১১), আনন্দবিদায় (১৯১২)।
‘কল্কি অবতার’ প্রহসনটির অধিকাংশ সমিল পদ্যে লেখা। এই প্রহসনটিতে নব্যহিন্দু, ব্রাহ্ম, রক্ষণশীল পণ্ডিত ও বিলেতফেরত এই পাঁচটি সম্প্রদায়ের উপর বিদ্রূপের শরজাল বর্ষিত হয়েছে। পাঁচটি সম্প্রদায়ের বিরোধ তুঙ্গে উঠলে বিষ্ণু কল্কি অবতাররূপে আবির্ভূত হন। ‘কল্কি অবতার’ প্রহসন হিসাবে উচ্চশ্রেণীর নয় ;সংলাপ দুর্বল। তবে এই প্রসহনটির অন্যতম সম্পদ এর হাসির গানগুলি। দ্বিতীয় রচনা ‘বিরহ’ একটি বিশুদ্ধ প্রহসন। গোবিন্দ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর তৃতীয় পক্ষের কুরূপা স্ত্রী নির্মলার কৌতুককর দাম্পত্য কলহে কাহিনীর সূত্রপাত। ইন্দুভূষণ, চপলা, রামকান্ত প্রভৃতি আলোচ্য প্রহসনের অপরাপর চরিত্র। উপকাহিনীর অতিরিক্ত প্রাধান্য নাট্যকারের আসল উদ্দেশ্যকে পরিস্ফুট হতে দেয়নি। তবে এর সঙ্গীতগুলি কৌতুকরসে পরিপূর্ণ।
‘ত্র্যহস্পর্শ’ (১৯০০) প্রহসন হিসাবে সার্থক নয়। বিবাহবিভ্রাট কাহিনী আলোচ্য নাটকের বিষয়বস্তু। ‘বৃদ্ধবয়সে বিজয়গোপালের বিবাহলিপ্সা, পুত্র আনন্দগোপালের সঙ্গে কৌতুককর সংঘর্ষ, রানীর মিথ্যা মৃত্যুরটনা, বিবাহবাসরে একাধিকবার পাত্রের পরিবর্তন, পিতাপুত্রের বিবাদমীমাংসার মুহূর্তেই পিতামহ ও পিতৃব্যের ঈপ্সিত পাত্রীর কণ্ঠে মাল্যদান প্রভৃতি ঘটনা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মিলনমধুর পরিণতি লাভ করেছে।’
‘প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০২) সমাজবিদ্রূপমূলক প্রহসন। বিলেতফেরত সমাজের অর্থলোলুপতা, কৃত্রিমতা ও বিলাসিতার চিত্র আঁকাই প্রহসনটির উদ্দেশ্য।
‘পুনর্জন্ম’ (১৯১১) দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ প্রহসন। আলোচ্য প্রহসনে এক কৃপণ, নির্মম ও স্বার্থপর সুদখোরের হাস্যকর পরিণতি দেখানো হয়েছে।
‘আনন্দ বিদায়’ (১৯০২) দ্বিজেন্দ্রলালের শিল্প প্রতিভার পরিচয় বহন করে না ; হাসির গান ব্যতীত এখানে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই।
(খ) নাট্যকাব্য – দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যকাব্যগুলির এক শ্রেণীতে আছে ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা’ (১৯০৮), ‘ভীষ্ম’ (১৯১০)। আর এক শ্রেণীতে আছে ‘তারাবাঈ (১৯০৩) এবং ‘সোরাব-রুস্তম’ (১৯৩৮)। ‘তাঁরাবাঈ’ ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক নাট্যকাব্য। ‘সোরাব রুস্তম’ ফিরদৌসী রচিত ‘শাহনামা’ কাহিনী অবলম্বনে অপেরা।
‘পাষাণী’ নাটকে অহল্যা, ইন্দ্র ও গৌতমের কাহিনী রূপায়িত হয়েছে। অহল্যাকে নাট্যকার প্রণয়মুগ্ধা নারীরূপে চিত্রিত করেছেন। আলোচ্য নাটকে নাট্যকার নারীর সংস্কারমুক্ত হৃদয়াবেগকে সমাজশাসনের ঊর্ধ্বে রূপ দিতে চেয়েছেন। পাষাণী নাটকে এইভাবে নাট্যকার পুরাণকাহিনীর নবরূপায়ণ ঘটিয়েছেন।
‘সীতা’ নাটকের উপাদান সংগৃহীত হয়েছে রামায়ণের উত্তরকাণ্ড ও ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ নাটক থেকে। ‘সীতা’ নাটকে নাট্যকার সীতার চরিত্রে আধুনিক রোমান্টিক প্রকৃতি-প্রীতি, রামচরিত্রে কর্তব্যনিষ্ঠা ও প্রেমচেতনার দ্বন্দ্ব এবং বশিষ্ঠের ব্রাহ্মণ্য কুসংস্কার ও শূদ্রের অধিকারবোধের সংঘাতের চিত্র এঁকেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর পৌরাণিক নাটক ‘ভীষ্ম’তে তিনি সর্বাংশে মহাভারতকে অনুসরণ করেননি। ‘ভীষ্ম’ নাটকের দ্বন্দ্ব গড়ে উঠেছে নায়কের কর্তব্যরক্ষা ও চিরকৌমার্যের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মানুষের সহজ প্রণয়াকুতির।
পাষাণী, সীতা ও ভীষ্ম নাটকে অহল্যা, সীতা ও ভীষ্মের চরিত্রে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সঞ্চার করে নাটকগুলিকে আধুনিক অবয়ব দিতে চেয়েছেন।
(গ) ঐতিহাসিক নাটক – নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা নির্ভরশীল তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলির উপর। ১৯০৫-১৯০৯ পর্যন্ত রচিত দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটক রচনার কালকে ‘স্বর্ণযুগ’ বলা যেতে পারে। এই পর্বে তিনি রাজপুত ও মোগলযুগকে অবলম্বন করে ‘রাণা প্রতাপসিংহ’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬), ‘নূরজাহান’ (১৯০৮), ‘মেবাব পতন’ (১৯০৮), ‘সাজাহান’ (১৯০৮) এই পাঁচখানি নাটক রচনা করেন। ‘প্রতাপসিংহ’, ‘দুর্গাদাস’ ও ‘মেবার পতন’ নাট্যত্রয়ীতে রাজপুত ইতিহাসের প্রাধান্য এবং নূরজাহান’ ও ‘সাজাহান’ নাট্যদ্বয়ে মোগল ইতিহাসের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসকে কেন্দ্র করে দ্বিজেন্দ্রলাল ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) ও ‘সিংহল বিজয়’ (১৯১৫) রচনা করেন।
‘রাণা প্রতাপসিংহ’ নাটকের আখ্যায়িকা টডের রাজস্থান থেকে গৃহীত। রাজ্যভ্রষ্ট রাণা প্রতাপের চিতোর উদ্ধারের কঠোর সংকল্প থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ বছরের কাহিনী এই নাটকে বর্ণিত হয়েছে ; স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় প্রতাপসিংহের শৌর্য-বীর্য, দেশপ্রেম ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের মহিমময় চিত্র আলোচ্য নাটকটিতে অঙ্কিত।
‘দুর্গাদাস’ নাটকের কাহিনীও টডের রাজস্থান থেকে গৃহীত। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষার্ধ আলোচ্য নাটকে রূপায়িত। দুর্গাদাস’ নাটকে নাট্যকার হিন্দু-মুসলমানের মিলনবাণীকে রূপায়িত করতে সচেষ্ট।
‘মেবার পতন’ নাটকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নাট্যকার প্রচারধর্মিতাকে মুখ্য ভূমিকা প্রদান করেছেন। পতনোন্মুখ মেবারের অন্তিম অধ্যায়টিকে নাট্যকার পরম বেদনার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন।
‘নূরজাহান’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নূরজাহান। তবে আলোচ্য নাটকে ইতিহাসের উপাদান কম। শের খাঁ-নূরজাহানের দাম্পত্য জীবন, স্বামীহত্যার প্রতিশোধের জন্য স্বামীহত্তাকে বিবাহ করার সম্মতিদান প্রভৃতি ঘটনা নাট্যকারের স্বকপোলকল্পিত। তবে ‘নূরজাহান’ নাটকে নাট্যকার সর্বপ্রথম শেকসপিয়রীয় নাট্যরীতির রূপায়ণে আংশিক সফলতা অর্জন করেন।
দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে সাজাহান নাটকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রায় অবিসংবাদিত। মঞ্চসাফল্য ও জনপ্রিয়তার দিক থেকেও বাংলা নাটকের ইতিহাসে এই নাটকটি অসাধারণ মর্যাদা লাভ করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভারত ইতিহাসের রাজনৈতিক ঘনঘটনার রূপ গঠনরীতির দিক থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল স্বগতোক্তি বর্জন করেছেন, শেকসপিয়রীয় নাট্যশৈলীর দিকে দৃষ্টি প্রদান করেছেন এবং নাটকীয় গঠনরীতির দিক থেকে রোমান্টিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকীয় চরিত্রগুলি গতিচঞ্চল ও অন্তর্দ্বন্দ্বময় (যেমন সাজাহান, চাণক্য, ঔরঙ্গজেব, নূরজাহান)। ট্র্যাজেডি পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর ‘সাজাহান’ এবং ‘নূরজাহান’ অবশ্যই স্মরণীয়। দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা নাটককে আধুনিক নাট্যরীতির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতে চেয়েছিলেন। এই দিক থেকে তিনি সমকালীন বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রচলিত বাতাবরণকে অস্বীকার করেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের ভক্তিরস বাংলার দর্শককুলকে অন্য কারণে সন্তুষ্ট করলেও তিনি তাঁর দর্শক ও পাঠককুলকে নাট্যবোধের অংশীদার করতে পারেন নি। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর প্রদর্শিত পথ পরিত্যাগ করে বাংলা নাট্যসাহিত্যে প্রকৃত আধুনিকতার প্রতিষ্ঠা করলেন। এক্ষেত্রে তিনি যে পুরোপুরি সফল হয়েছেন তা নয়। কারণ শিল্পীমানসের যে নিরপেক্ষতা নাটকের মূল শর্ত তা গীতিকবিসুলভ আত্মমুগ্ধ ভাবাবেগের কারণে দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকে প্রায় কোন সময়ই রক্ষিত হয়নি। তথাপি, মধুসূদন-দীনবন্ধুর পর তিনিই, নানা ত্রুটি সত্বেও সামগ্রিকভাবে বাংলা নাটকে আধুনিকতার সঞ্চার ঘটালেন। দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে রথীন্দ্রনাথ রায় ঠিকই বলেছেন- দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকে, অতিনাটকীয়তা, উচ্ছ্বাসবাহুল্য ও আতিশয্যজনিত বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, কিন্তু এই দোষগুলির জন্য বাংলা নাটকে তাঁর দানকে অস্বীকার করা যায় না। দ্বন্দ্ববহুল চরিত্রসৃষ্টি, উজ্জ্বল বলিষ্ঠ সংলাপ রচনা, নাটকীয় চমৎকারিত্ব, নূতন টেকনিক প্রয়োগ, শেকসপিয়রীয় নাট্যকলার সার্থক প্রয়োগ, নাটকে আধুনিক চিন্তাচেতনার প্রবর্তন প্রভৃতি বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা নাটকে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।’
পুরাণ ও গ্রীক ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি করে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক রচিত। এই নাটকের প্রধান আকর্ষণ চাণক্য চরিত্র। নাটকটির গঠনরীতিতে বিচ্ছিন্নতা ও বিক্ষিপ্ততা থাকলেও মঞ্চসাফল্যের দিক থেকে চন্দ্রগুপ্ত সফল নাটক।
‘সিংহল বিজয়’ দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রকাশিত। তবে এটিকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় কিনা সে সম্পর্কে সংশয় আছে।
(ঘ) সামাজিক নাটক – দ্বিজেন্দ্রলালের সামাজিক নাটক দুটি-‘পরপারে’ (১৯১২), ‘বঙ্গনারী’ (১৯১৬)। সামাজিক নাটক রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল মৌলিকত্ব দেখাতে পারেননি।
‘পরপারে’ নাটকের বিষয়বস্তু দুর্বল এবং পরিণতি অত্যন্ত আকস্মিক। স্ত্রীর জন্য মাকে পরিত্যাগ, মদ্যপান, গুলি করা, ফেরারী আসামীর জীবনযাপন, সর্বশেষ পরস্পর সম্পর্কিত দীক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি এই নাটকে এমন দ্রুতগতিতে ঘটেছে যে, এখানে কোন শিল্পোৎকর্ষ বা ভাবগভীরতা নেই।
‘বঙ্গনারী’ নাটকে নাট্যকার বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। জীবনের শেষ প্রহরে দ্বিজেন্দ্রলাল সামাজিক নাটক রচনায় মনোনিবেশ করলেও কোন নতুন দিকনির্দেশ করতে পারেন নি।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলালের স্থান – বর্তমানে বাংলা নাটক বলতে আমরা যা বুঝি তার সূত্রপাত ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি। তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ (১৮৫২), জে. সি. গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ (১৮৫২) ইংরেজি নাটকের অনুকরণে বাংলায় নাটক রচনার প্রথম মৌলিক প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা যায়। এই সময় রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলিনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪), উমেশচন্দ্র মিত্রের ‘বিধবা বিবাহ’ (১৮৫৬) ইত্যাদি রচিত হয়। এই পর্বটি বাংলা নাটকের ইতিহাসের প্রথম পর্ব, বাংলা নাটকের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা মধুসূদনের নাটকাবলী দিয়ে। বাংলা ভাষায় মৌলিক নাটক বলতে মধুসূদনের ‘শমিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের নাম উল্লেখযোগ্য। এই পর্বেই অসাধারণ নাট্যপ্রতিভা দীনবন্ধুর আবির্ভাব। তাঁর ‘নীলদর্পণ’, ‘সধবার একাদশী’ প্রভৃতি নাটক যথার্থই আধুনিক চেতনার পরিচয়বাহী।
বাংলা নাটকের তৃতীয় পর্বের সূচনা মনমোহন বসুর হাতে। তবে এই পর্বে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। গিরিশচন্দ্র সামাজিক, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক প্রভৃতি সবরকম নাটক লিখলেও পৌরাণিক নাটকেই তাঁর সিদ্ধি। এই পর্বেই- গিরিশচন্দ্রের শেষ জীবনে বাংলা নাট্যজগতে দ্বিজেন্দ্রলালের আবির্ভাব। ১৮৯০ -এর পরেই দ্বিজেন্দ্রলাল হাসির গান, ব্যঙ্গ কবিতা ও প্রহসনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য জগতে নিজের আবির্ভাবের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। অবশ্য পত্নী-বিয়োগের পরই নাটক রচনায় পুরোপুরি নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন।
নাট্যশৈলীগত নানা ত্রুটি ভও প্রতিভার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলা নাটকের ইতিহাসে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিশিষ্টতা অনস্বীকার্য। তাঁর নাটকের অধিকাংশ সংলাপই উচ্ছ্বসিত ও ভাবাবেগমণ্ডিত। তাঁর নাটকের মঞ্চসাফল্যের অন্যতম কারণ ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ ভাষা।
প্রশ্ন ৫। ব্যাখ্যা করো।
(ক) ‘কিন্তু, তুইও এর মধ্যে যাস্ নে, তোঁর কাজ-স্নেহ-ভক্তি ‘অনুকম্পা’।
উত্তরঃ সাজাহান নাটকের প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্যের অন্তর্গত এই উক্তিটি সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারাকে করেছেন।
বিদ্রোহী পুত্রদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণের জন্য দারা যে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন তাতে প্রথমে সম্মতি দেননি। কিন্তু কন্যা জাহানারার তেজোদীপ্ত যুক্তিপূর্ণ কথায় সাজাহান অনুমতি না দিয়ে পারেন না। অনুমতি দিয়ে ব্যথাদীর্ণ স্নেহকাতর পিতা পুত্রদের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারেন। সেজন্য জাহানারাকে বলেন যে, যেন এই ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের মধ্যে জড়িয়ে না পড়ে। সে নারী, স্নেহ ভক্তি অনুকম্পা নারীর অন্তরের ভূষণ। অন্যপক্ষে সিংহাসনের লোভে আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া আবর্জনাস্বরূপ। জাহানারা যেন এই লোভ হিংসার দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে দূরত্বে রেখে সংসারে সকলকে স্নেহ প্রীতি, প্রেম দিয়ে জয় করে।
(খ) ‘আমি এখন তা বলতে পারি না। সে বড় ভয়ানক না-নাথ, এই যুদ্ধ কাজ নেই।”
উত্তরঃ সাজাহান নাটকের প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্যের অন্তর্গত আলোচ্য উক্তিটি নাদিরা করেছে।
সাজাহানের বিদ্রোহী পুত্রদের দমন করতে দারা সৈন্য প্রেরণের অনুমতি প্রার্থনা করলে সাজাহান উক্তিটি করেছেন। স্নেহকাতর পিতা দারার এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে চান না। কেননা আত্মঘাতী ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের অনিবার্য পরিণাম নিজেদেরই ধ্বংস। সেজন্য তিনি চান স্নেহ দিয়েই এই বিদ্রোহী পুত্রদের শাসন করতে। এছাড়া এই যুদ্ধে যে পক্ষেরই পরাজয় হোক না কেন, সাজাহানের সমান ক্ষতি। যদি দারা পরাজিত হয়, তবে দারা ব্যথিত হবে। যদি সুজা, মোরাদ বা ঔরঙ্গজেব পরাজিত হয়, তবে তারা ব্যথিত হয়ে ফিরে যাবে। ওরা সকলেই তাঁর কাছে সমান বেদনাদায়ক।
নাদিরা স্বামী দারার সুখ দুঃখ বিপর্যয় সকলই শান্ত সহিষ্ণুচিত্তে গ্রহণ করেছেন। নাদিরার চরিত্রে পারিবারিক যুদ্ধবৃত্তির ঐতিহ্য অপেক্ষা স্নেহবাৎসল্য প্রেমব্যাকুলতার আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।
(গ) ‘কিন্তু এ শাস্তি তাদের— একার নয়’।
উত্তরঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত সাজাহান নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাজাহান। নাটকে সম্রাট সাজাহানের দ্বিধাবিভক্ত হৃদয়ের পরিচয় আছে। সাজাহান ছিলেন গ্রেট মোগলের তৃতীয় মোগল ভারতবর্ষের সম্রাট। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি পুত্র-কন্যার জনক। স্বভাবতই সাজাহানের মধ্যে দুটি সত্তার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এই দুই সত্তার অস্তিত্বের সমন্বয় করতে না পেরে সাজাহানের জীবন এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। সাজাহান সম্রাট হলেও পিতৃস্নেহে অন্ধ ছিলেন। স্নেহান্ধ পিতা হিসেবে সাজাহান চেয়েছেন অবাধ্য এবং বিদ্রোহী পুত্রদের স্নেহের শাসনে বশ করতে। এটি ছিল তাঁর জীবনের চরমতম ভুল। এই ভুল সংশোধন করতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সাজাহানের হৃদয়। সাজাহান নিজে বন্দী হয়েছেন— অন্যান্য পুত্রেরা নিহত হয়েছে। আত্মক্ষয়ের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে সাজাহানকে জীবনের শেষ দিনগুলি পার করতে হয়েছে।
(ঘ) ‘পিতা, এই কি আপনার উপযুক্ত কথা—এই দৌর্বল্য কি ভারত সম্রাট সাজাহানকে সাজে।
উত্তরঃ আলোচ্য উক্তিটি সাজাহান নাটকে জাহানারা করেছে। সম্রাট সাজাহানের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে বঙ্গদেশে সুজা, গুজরাটে মোরাদ এবং দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেব এই তিন পুত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে সসৈন্যে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে। সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা এদের বিদ্রোহ দমনের জন্য সৈন্য প্রেরণের অনুমতি প্রার্থনা করলে স্নেহকাতর পিতা সাজাহান দারার এই প্রস্তাবে প্রথমে অসম্মতি প্রকাশ করেন কেননা এর ফলে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ হবে। আর এই আত্মঘাতী যুদ্ধে নিজেরাই ধ্বংস হবে। কিন্তু কন্যা জাহানারা পিতার এ স্নেহ দুর্বলতাকে সম্রাটের কর্তব্যচ্যুতি বলে অভিহিত করে বলে যে পুত্র কেবল পিতার অধিকারী, স্নেহের অধিকারী নয়। অবাধ্য, অন্যায়কারী পুত্রকে শাসন করাও পিতার কর্তব্য।
এর উত্তরে সাজাহান বলেছেন- তিনিই স্নেহকাতর পিতা। বিশেষ করে তাঁর পুত্ররা মাতৃহারা। মাতার অবর্তমানে তিনি পিতার স্নেহ দিয়েই তাদের মানুষ করেছেন। সেজন্য তিনি স্নেহ দিয়েই বিদ্রোহী পুত্রদের শাসন করবেন।
(ঙ) তারা জানুক, সম্রাট সাজাহান স্নেহশীল—কিন্তু দুর্বল নয়।’
উত্তরঃ আলোচ্য উক্তিটি সাজাহান নাটকে ভারত সম্রাট সাজাহান করেছেন।
আলোচ্য নাটকটিতে দারার মুখে সুজার বিদ্রোহ ঘোষণা, মোরাদের সম্রাট নাম গ্রহণ এবং ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে মোরাদের যোগাযোগ সাজাহানকে বিচলিত করেছে। তাই তিনি তাদের রাজধানীতে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। সম্রাট কন্যা জাহানারা তাঁর দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন করে দিলেও, সাজাহান কন্যাকে ভর্ৎসনা করেন এবং দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘আমার হৃদয় এক শাসন মানে, সে শুধুই স্নেহের শাসন।
জ্যেষ্ঠপুত্র দারা পিতার কাছে বারংবার অনুমতি প্রার্থনা করেছে বিদ্রোহ দমন করতে। সাজাহান বারংবার অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। জাহানারা দারাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তিনি মনে করেন দারার লড়াই ন্যায়ের সিংহাসন রক্ষা করার লড়াই, দুষ্কৃতকে শাসন করার লড়াই, দেশের কোটি কোটি নিরীহ প্রজাদের অরাজক অত্যাচারের গ্রাস থেকে বাঁচানোর লড়াই। তখন দারা প্রতিজ্ঞা করেছেন- তিনি ভাইদের কাউকে পীড়ন বা বধ করবেন না, কেবলমাত্র তাঁদের বেঁধে পিতার পদতলে এনে দেবেন। তারপর সাজাহানের যা ইচ্ছা তখন পুত্রদের সঙ্গে করবেন। কেননা ভারত সম্রাট সাজাহানের বিদ্রোহী পুত্রেরা এতটুকু অন্তত জেনে রাখুক- সম্রাট সাজাহান স্নেহশীল পিতা কিন্তু দুর্বল সম্রাট নন। বিদ্রোহ দমন করার শক্তি এখনো তার বাহুতে রয়েছে।
প্রশ্ন ৬। তাৎপর্য লেখো।
(ক) কালরাত্রে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
উত্তরঃ নাদিরা দারার মহিষী এবং দারার মতন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মপ্রাণা, ক্ষমতানিস্পৃহা নারী। নাদিরা পতিগতপ্রাণা, প্রেমময়ী, স্নেহশীল এবং ধর্ম-পরায়ণা। তিনি দিল্লীর মসনদের জন্য লালায়িত হননি। স্বামীর সুখ-দুঃখ বিপর্যয় সমস্তই শান্তসহিষ্ণুচিত্তে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষ বীর, সাহসী, রণনিপুণ। নাদিরার কাছে একান্ত কাম্য ছিল শান্ত, নিরুদ্বেগ, সহজ, সরল জীবন। নাটকের প্রথম দৃশ্যেই নাদিরা দুঃস্বপ্ন দর্শন করেছেন এবং দারার আসন্ন যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে তাঁর অন্তরে ভীতিভাব জাগ্রত হয়েছে। তিনি সসঙ্কোচে সেই আশঙ্কা প্রকাশ করে তেজস্বিনী জাহানারার কাছে তিরস্কৃত হয়েছেন। নাদিরার দুঃস্বপ্ন ও আতঙ্ক সত্যে পরিণত হয়েছে।
(খ) এ যুদ্ধ অনিবার্য, আমি যাই।
উত্তরঃ দারা সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং সবচাইতে প্রিয়জন। অসুস্থ পিতার প্রতিনিধি হিসেবেই তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। সম্রাট দারার প্রতি স্নেহশীল হলেও অন্যান্য পুত্রদের প্রতিও তাঁর একই পরিমাণ স্নেহ-মায়া-মমতা। সম্রাটের আদেশ দারা যেন তাঁর ভাইদের প্রতি খড়্গহস্ত না হন। নিরুৎসাহী দারা পিতার আদেশ অমান্য করতে পারে না।
এরকম পরিস্থিতিতে জাহানারা জানতে চায় যে এটা কি সম্রাট সাজাহানের উপযুক্ত কথা। এ দুর্বলতা তাঁর কি সাজে? পিতা জানান যে তাঁর পুত্রদের জন্য তাঁর একটাই শাসন-স্নেহের শাসন। দারার স্ত্রী নাদিরা দারাকে কেবলমাত্র একটি অনুরোধ জানায় যে এই যুদ্ধ আর নয়। দারা শেষবার জানায় যে এ যুদ্ধ অনিবার্য। তিনি সৈন্যদের যুদ্ধে যাবার আজ্ঞা দিতে চান। সম্রাট সাজাহান জাহানারাকে জানান যে সে যেন এ নোংরা স্পর্শে না যায়। সে পবিত্র থাকুক।
(গ) আমি দর্শনে উপনিষদে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য পেয়েছি। সাম্রাজ্য কি অন্তঃপুর। একটা ছেলেখেলা।
উত্তরঃ সাজাহান নাটকে দারা উপনিষদের দর্শনে ও বেদান্তে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ফারসী পণ্ডিতদের সাহায্যে তিনি উপনিষদের ফারসী অনুবাদ করান। তিনি ভারতীয় দর্শন ও উপনিষদকে বড় সাম্রাজ্যরূপে অভিহিত করেছেন।
সাজাহানের অসুস্থতার খবর পেয়ে সুজা, মোরাদ এবং ঔরঙ্গজেব বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিন পুত্রের এই বিদ্রোহের খবর দারা পিতা সাজাহানকে জানায় এবং বিদ্রোহী পুত্রদের দমনের জন্য প্রেরণের অনুমতি চান। পিতা সাজাহান পুত্রদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হলেও তাঁর পিতৃহৃদয় পুত্রদের জীবনহানির ভয়ে সৈন্য প্রেরণের অনুমতি দিতে সম্মত, এই সময় কন্যা জাহানারা প্রবেশ করে ও পিতার উক্তি শুনে প্রতিবাদ জানায়। পিতা সাজাহান যখন বলেছে— ‘তাঁরা আমার পুত্র। আমার হৃদয় শুধু এক শাসন জানে। সে শুধু স্নেহের শাসন।’ এই কথার উত্তরে জাহানারা পিতাকে বলেন যে—পিতা পুত্রের সম্পর্ক অন্তঃপুরের —সাম্রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে এই সম্পর্কে কোন স্থান নেই। কারণ সাম্রাজ্য অন্তঃপুর নয়। একজন প্রজা বিদ্রোহী হলে সম্রাট তাকে শাস্তি দেন। পুত্র বিদ্রোহী হলে সেই একই শাস্তি বিধান সম্রাটের কর্তব্য। পিতাকে কর্তব্যবোধে উদ্দীপ্ত করতে জাহানারা তীব্র তীক্ষ্ণ ভাষায় নিজের আবেগকে প্রকাশ করেছে।
ব্যাকরণ
প্রশ্ন ৭। ব্যাসবাক্যসহ সমাসের নাম লেখো।
(ক) শাসনক্ষম — শাসনে অক্ষম (৭মী তৎপুরুষ)
(খ) মাতৃহারা — মাতার দ্বারা হারা (তৃতীয় তৎপুরুষ)
(গ) সিংহাসন — সিংহ চিহ্নিত আসন (মধ্যপদলোপী কর্মধারয়)
(ঘ) সৈন্যাধ্যক্ষ — সৈন্যদের অধ্যক্ষ (ষষ্ঠী তৎপুরুষ)
(ঙ) অরাজক — ন-রাজক (নঞ তৎপুরুষ)
(চ) নির্মম — মমতা নাই যেখানে (কর্মধারয় সমাস)
প্রশ্ন ৮। বাক্যসংকোচন বা এককথায় প্রকাশ করো।
যা বলা যায় না — অবাচ্য।
রাজা নেই যেখানে — অরাজক।
যে পরে জন্মগ্রহণ করে — অনুজ।
যা দুঃখে লাভ করা যার — দুর্লভ।
বিধান করে যে — বিধায়ক।
বিচলিত মন যার — বিমনা।
বিষ্ণুর গদা — কৌমুদকী।
অশ্ব রাখার স্থান — মন্দুরা।
আকাশ ও পৃথিবী — ক্রন্দসী।
গম্ভীর ধ্বনি, হাতি বাঁধিবার শিকল, চোখের মণি, হস্তীর শাবক, পতিপুত্রহীনা নারী, লালপদ্ম, শ্বেতপদ্ম, হাতীর চিৎকার, পক্ষীর কলরব।
উত্তরঃ গম্ভীর ধ্বনি — মন্ত্র।
হাতি বাঁধিবার শিকল — আন্দু।
চোখের মণি — কনীনিকা।
হস্তীর শাবক — হস্তীশাবক।
পতিপুত্রহীনা নারী — অবীরা।
লালপদ্ম — কোকনদ।
শ্বেতপদ্ম — পুণ্ড্ররীক, পুন্নাগ।
হাতীর চিৎকার — বৃংহন।
পক্ষীর কলরব — কূজন, কলতান।
প্রশ্ন ১০। বিপরীতার্থক শব্দ লেখো।
আসামী — ফরিয়াদী।
নাস্তিক — আস্তিক।
প্রলয় — সৃষ্টি।
উদ্ধৃত — বিনীত।
অপচয় — সঞ্চয়।
আরদ্ধ — সমাপ্ত।
অনুগ্রহ — নিগ্রহ।
ভীত — সাহসী।
বন্ধন — মুক্তি।
তিরস্কার — পুরস্কার।
অজ্ঞ — বিজ্ঞ।
নিজে করো–
নবীন, বিনাশ, সস্তা, পূজক, সাদৃশ্য, গুপ্ত, স্থাবর, সঞ্চয়, অমৃত, প্রসারণ, বর্ধমান, ন্যূন।
উত্তরঃ নবীন — পুরাতন।
বিনাশ — সৃষ্টি।
সস্তা — দামী।
পূজক — সেবক।
সাদৃশ্য — বৈসাদৃশ্য।
গুপ্ত — খোলা।
স্থাবর — অস্থাবর।
সঞ্চয় — ব্যয়।
অমৃত — গরল।
প্রসারণ — সংকোচন।
বর্ধমান — ক্ষীয়মান।
ন্যূন — বেশি।