Class 10 Bengali Chapter 14 কাণ্ডারী হুঁশিয়ার Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 10 Bengali Chapter 14 কাণ্ডারী হুঁশিয়ার and select needs one.
Class 10 Bengali Chapter 14 কাণ্ডারী হুঁশিয়ার
Also, you can read SCERT book online in these sections Class 10 Bengali Chapter 14 কাণ্ডারী হুঁশিয়ার Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 10 Bengali Chapter 14 কাণ্ডারী হুঁশিয়ার These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 10 Bengali Chapter 14 কাণ্ডারী হুঁশিয়ার for All Subject, You can practice these here…
কাণ্ডারী হুঁশিয়ার
Chapter – 14
অনুশীলনীর প্ৰশ্নোত্তরঃ
অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তরঃ
১। টীকা লেখো।
(ক) পলাশী।
(খ) কাজী নজরুল ইসলাম।
(ক) পলাশী — পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ৫০ কি. মি. উত্তরে ভাগীরথী নদীর পাড়ে পলাশী অবস্থিত। পলাশীর সবচেয়ে বড় শহর বেলডাঙ্গা। পলাশী বিশেষভাবে পরিচিত ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার মধ্যে যুদ্ধের জন্য।
(খ) কাজী নজরুল ইসলাম — ২৪শে মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়েছিল। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ১৯ আগস্ট বাংলাদেশের ঢাকা শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। কবির বাবা ছিলেন কাজী ফকির আহমদ এবং মা সুহেদা খাতুন।
১৩২৬ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় নজরুলের প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয়। তাঁর কাব্যের মধ্যে অগ্নিবীণা (১৯২২), দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশী, ছায়ানট, সাম্যবাদী, সর্বহারা, চক্রবাক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নজরুলের বহু কবিতা ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয় এবং কবি কারারুদ্ধ হন। বিদ্রোহের উদ্দীপনা ছড়ানো কবিতা ছাড়াও নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক অনেক কবিতা আছে। সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে তাঁর অসংখ্য গান।
প্রশ্ন ২। যথাযথ উত্তর দাও।
(ক) “কাণ্ডারী হুশিয়ার” কবিতার কবি—
(ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
(খ) সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।
(গ) নজরুল ইসলাম।
(ঘ) রজনীকান্ত সেন।
উত্তরঃ (গ) নজরুল ইসলাম।
(খ) খঞ্জর শব্দের অর্থ কী?
(ক) বন্দুক।
(খ) দা।
(গ) ছুরি।
(ঘ) কাঁচি।
উত্তরঃ (গ) ছুরি।
(গ) ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি কোন কাব্যের অন্তর্গত
(ক) অগ্নিবীণা।
(খ) চন্দ্রবিন্দু।
(গ) সর্বহারা।
(ঘ) বুলবুল।
উত্তরঃ (গ) সর্বহারা।
(ঘ) মাতৃমুক্তি পণ কে করেছে?
(ক) কাণ্ডারী।
(খ) হিন্দুরা।
(গ) মুসলমানেরা।
(ঘ) কবি নজরুল।
উত্তরঃ (ঘ) কবি নজরুল।
(ঙ) বাঙালীর খুনে কার খঞ্জর লাল হয়েছিল?
(ক) ইংরেজের।
(খ) মীরমদনের।
(গ) ক্লাইভের।
(ঘ) মোহন লালের।
উত্তরঃ (গ) ক্লাইভের।
প্রশ্ন ৩। অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর দাও।
(ক) পলাশির যুদ্ধ কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল?
উত্তরঃ পলাশির যুদ্ধ নবাব সিরাজদ্দৌলা ও ইংরেজের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল।
(খ) পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর প্রধান কে ছিলেন?
উত্তরঃ পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর প্রধান ছিলেন লর্ড ক্লাইভ।
(গ) ‘‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতার কবি কে?
উত্তরঃ ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতার কবি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
(ঘ) মাতৃমন্ত্র শব্দের অর্থ কী?
উত্তরঃ মাতৃমন্ত্র শব্দের অর্থ মায়ের মন্ত্রে দীক্ষিত।
(ঙ) কবি কবিতায় মহাভারত বলতে কি বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ কবি কবিতায় মহাভারত বলতে মহান দায়িত্বকে বুঝিয়েছেন।
(চ) কবির মতে অসহায় জাতি কারা?
উত্তরঃ কবির মতে অসহায় জাতি হলো বাঙালিরা।
(ছ) কবিতাটি কবির কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত?
উত্তরঃ কবিতাটি কবির সর্বহারা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।
(জ) কবিতায় কাকে কাণ্ডারী বলেছেন?
উত্তরঃ কবিতায় মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবীদের কাণ্ডারী বলেছেন।
(ঝ) কোন সালে পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল?
উত্তরঃ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল।
(ঞ) ‘ভারতের দিবাকর’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ ‘ভারতের দিবাকর’ বলতে কবি ভারতের মুক্তিসূর্যকে বুঝিয়েছেন।
প্রশ্ন ৪। নীচের প্রশ্নগুলির সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
(ক) ‘আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ’—উক্তিটির প্রকৃত অর্থ কী?
উত্তরঃ কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতাটিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও গভীর দেশাত্মবোধের মন্ত্র বললে অতিরঞ্জিত হবে না। কাণ্ডারী হলো জনগণের অধিনায়ক। কাণ্ডারীকে মহাপরীক্ষার কালরাত্রি অতিক্রম করতে হবে। ভয়াল মৃত্যুর হাতছানিতে দোদুল্যমান তরণীকে উত্তাল সমুদ্রের বুকের উপর দিয়ে চালিয়ে স্বাধীনতার স্বর্ণ প্রদীপ্ত তোরণে উপনীত করানোতেই সংগ্রামের সার্থকতা নিহিত।
(খ) ‘ওই গঙ্গায়’ বলতে কবি কোন গঙ্গার কথা বলেছেন? সেখানে কীভাবে ভারতের রবি পুনর্বার উদিত হবে?
উত্তরঃ ‘ওই গঙ্গায়’ বলতে কবি ‘পলাশীর প্রান্তর’ রূপ গঙ্গার কথা বুঝিয়েছেন।
কবি স্বাধীনতাকামী কাণ্ডারীকে তাঁদের মহাদায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন যে- তাদের সামনে রয়েছে পলাশির প্রান্তরে ক্লাইভের হত্যালীলার প্রতিশোধের কথা। যে সকল দেশবাসী ফাঁসির মঞ্চে তাঁদের জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন তাঁদের অতৃপ্ত আত্মা আজ অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে- তাঁদের পরে কোন জাতীয় বীর দেশ ও জাতির জন্য মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত হয়ে আছেন?
(গ) কারা ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন? তিনজন শহিদের নাম লেখো।
উত্তরঃ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে দেশপ্রেমিকেরা বীরের মতো জীবন উৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন কবি নজরুল তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন। জীবনের মহান ব্রতে ব্রতী হয়ে বীর দেশপ্রেমিকেরা হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেছেন জীবনের জয়গান। হাজার হাজার দেশপ্রেমিক বীরকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন করতে হয়েছে।
তিনজন শহিদ হলেন-মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী হাজরা।
(ঘ) পলাশির যুদ্ধে নবাবের পক্ষে-কোন কোন বীর প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহিদ হয়েছিলেন?
উত্তরঃ পলাশির যুদ্ধে নবাবের পক্ষে মীরমদন ও মোহনলাল প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন।
(ঙ) কারা অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে কাদের বলিদান লক্ষ্য করছেন?
উত্তরঃ ইংরেজ শ্বেতকায় সাহেব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম ছল-চাতুরী, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতাকে অস্ত্ররূপে গ্রহণ করেছে। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বহু দেশপ্রেমিককে প্রাণ বিসর্জন করতে হয়েছে। দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি, সেজন্য তাদের আত্মা এখনো অশান্ত। বীর শহিদদের অশরীরী আত্মা অলক্ষ্যে এসে দাঁড়িয়ে বর্তমান স্বাধীনতার যোদ্ধাদের বলিদান লক্ষ্য করছেন।
৫। রচনাধর্মী উত্তর লেখো।
প্রশ্ন ১। ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার সারাংশ লেখো।
উত্তরঃ বাংলার বিপ্লবী বীর তরুণ কবি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পূজারী কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সমস্যা সংকুল সংকটময় মুহূর্তে দেশনেতাকে দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে দেশ বাঁচানোর দায়িত্ব এবং সংকটময় পরিস্থিতিতে সাবধান থাকার কথা বলেছেন। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের বুকে যাত্রীনৌকা বিপন্ন ;এই নৌকা পরিচালনার ভার যে মাঝি বা কাণ্ডারীর, তাকে সতর্ক হতে হবে না হয় ব্যাতা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে যাত্রীনৌকা ডুবে গিয়ে অসংখ্য প্রাণের বিনাশ হবে। যাত্রীবাহী নৌকা সুরক্ষিতভাবে পরিচালনার ভার যেমন কাণ্ডারীর উপর সমর্পিত তেমনি দেশরূপী সমস্যাক্ষুব্ধ বিপন্ন নৌকার যাত্রী অর্থাৎ দেশবাসীদের রক্ষার ভারও দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত দেশনেতার। সমস্ত জাতিবাদ, প্রাণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি বিসর্জন দিয়ে তার কর্তব্য সমগ্র জাতির মুক্তি আন্দোলনকে ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া অর্থাৎ দেশকে স্বাধীন করা। কবির বক্তব্য হিন্দু ও মুসলমান ইত্যাদির প্রশ্ন না তুলে দেশের প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী সেনানীকে সঙ্গে নিয়ে দেশমুক্তির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। পরাধীনতার সাগর অতিক্রম করে স্বাধীনতার উপকূলে দেশরূপ, তরীকে পৌঁছে দিতে হবে। আজ দেশনেতার কাছে কঠিন মাতৃমুক্তিপণের সময় উপস্থিত। মুক্তি আন্দোলনে উৎসর্গীকৃত প্রাণ অসংখ্য শহীদের ঐকান্তিক লক্ষ্যকে অনুসরণ করে, দেশনেতাকে মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। আজ জাতপাত, সম্প্রদায় বা অপর কোনো কলুষিত ভাবনায় গ্রস্ত না হয়ে কেবলমাত্র মানুষ জাতির মুক্তি কামনায় ও দেশের স্বাধীনতার জন্য সাবধানতার সঙ্গে সচেষ্ট থাকতে হবে। কবি একথা বারংবার দেশনেতাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। কবি পলাশীর যুদ্ধের কথাও মনে করিয়ে দিয়ে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। আজ দেশনেতাকে মুক্তি সংগ্রামের উপযুক্ত নেতৃত্ব দিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে উদ্ধার করতে হবে এবং দেশবাসীকে ইংরেজদের গুলামীর হাত থেকে মুক্তি দিতে হবে। সমগ্র কবিতাটি জুড়ে কবির দেশনেতার প্রতি সাবধানবাণী বীরত্বের সুরে অনুরণিত।
প্রশ্ন ২। কবি নজরুল সম্পর্কে যা জান বর্ণনা করো।
উত্তরঃ বিশ্বকবি কবীন্দ্র রবীন্দ্রের প্রখর কিরণে বাংলা সাহিত্যাকাশ যখন প্রদীপ্ত তখন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ২৪শে মে, বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে, পিতা কাজী ফকির আহম্মদ ও মাতা বেগম জাহেদা খাতুনের গৃহে ভূমিষ্ঠ হলেন অনন্য প্রতিভাধর স্বভাবকবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পিতা দারিদ্র্য-পীড়িত পরিবারে দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত পরিমণ্ডলজাত এই ষষ্ঠ সন্তানের নামকরণ করেছিলেন ‘দুখু মিঞা’-যা তাঁর ভবিষ্যজীবনের বিশেষ ইঙ্গিতদ্যোতক। অতি শৈশবে মাত্র নয় বৎসর বয়সে পিতৃহীন হয়ে নিম্নপ্রাথমিক পাশের পরই তিনি মক্তবে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত হন। প্রতিবেশী স্নেহপ্রবণ গুরুজনদের নিকট তিনি ছিলেন ‘নজর আলী’ নামে খ্যাত; আবার সাধু-সন্ত, বাউল-ফকির দরবেশ, পীর-পয়গম্বর প্রভৃতির সান্নিধ্য তাঁর প্রিয় ছিল ; তাই তাঁকে আধ্যাত্মিক চেতনাব্যঞ্জক ‘তারা খ্যাপা’ নামে অভিহিত করা হয়। শৈশবেই তাঁর অনন্যসাধারণ মেধা ও কবিত্বশক্তির পরিচয় মেলে। দশ বৎসর বয়সেই তিনি লেটোর দলে যোগদান করেন এবং গান রচনা করে সুরারোপ করেন। এই সময় তিনি ‘শকুনি বধ’, ‘চাষার সং’, ‘রাজপুত্র’ প্রভৃতি সুমধুর সঙ্গীতবহুল পালাগান রচনা করেন।
কঠোর জীবন সংগ্রামে ব্যাপৃত নজরুল মাত্র মাসিক এক টাকা বেতনে একটি চা-রুটির দোকানে কর্মগ্রহণ করেন ; তাঁর সুকণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতে আকৃষ্ট পুলিশ সাবইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লা তাঁকে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে নিজ-গৃহভত্যরূপে নিযুক্ত করেন। সহৃদয় কাজী রফিজউল্লার সহযোগিতায় নজরুল পুনরায় অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র নজরুল ৪৯ নং বাঙালী পল্টনে যোগদান করেন। সৈনিকরূপে যোগ্যতা-প্রদর্শনে তিনি হাবিলদার পদে উন্নীত হন; করাচি সেনানিবাসে অবস্থানকালে তাঁর রচিত বেশ কিছু সংখ্যক গল্প-কবিতা সঙ্গীত প্রভৃতি বঙ্গদেশীয় পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রেরিত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বযুদ্ধাবসানে তিনি কলকাতায় আগমন করেন এবং সম্পূর্ণরূপে সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত হন। বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নজরুলের প্রথম গল্প ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকায়।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী তেজোদৃপ্ত বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হয় এবং রবীন্দ্রযুগে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শক্তিশালী ‘বিদ্রোহী কবি’ রূপে অভিহিত হলেন। মানবতাবাদী কবি শোষক, অত্যাচারী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী নির্মম-নিষ্ঠুর মানুষের বিরুদ্ধে নির্ভীকচিত্তে বিদ্রোহজ্ঞাপন করেছেন। সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, পৌরুষহীন স্থবিরতা ও জড়ত্বের বিরুদ্ধে এবং ধর্মধ্বজাধারী মৌলবাদী ভণ্ডদের বিরুদ্ধেই ছিল তার তীব্র বিদ্রোহ ও আপোসহীন সংগ্রাম। কবি মানুষের মনের শিকল ছিন্ন করে, আত্মশক্তিকে জাগরিত করে হাতের ‘শিকল ভাঙ্গার গান’ গেয়েছেন। তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ ‘রুদ্রঝংকারে এবং ‘বিষের বাঁশী’ তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ভারতভূমিতে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের হৃদপিণ্ডে কম্পন সৃষ্টি করে। অবিরল ধারায় ‘নবযুগ’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘ধুমকেতু’, ‘লাঙল’ প্রভৃতি পত্রিকায় একের পর এক তাঁর কাব্য-কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থ, ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ‘বিষের বাঁশী’ কাব্য এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রলয় শিখা’ কাব্য ইংরেজ সরকার কর্তৃক বেআইনি ঘোষিত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এবং ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ রচনাদ্বয় প্রকাশের অপরাধে ইংরেজ সরকার নজরুলকে গ্রেপ্তার করে এবং হুগলি জেলে রাজবন্দীদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে তিনি ঊনচল্লিশ দিন অনশন করেন। তাঁর জীবনাশঙ্কায় রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে তাঁকে টেলিগ্রাম করেন, ‘Give up hunger strike. Our literature claims you. দীর্ঘ এক বৎসর একুশ দিন কারাবাস করেন নজরুল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সমিতির সদস্য হন এবং স্বরাজদলের মুখপত্র ‘লাঙল’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ২৫শে এপ্রিল, প্রচলিত রীতি-নীতি ধর্ম সমাজ প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানিয়ে তিনি কুমিল্লার গিরিবালা দেবীর কন্যা প্রমীলা বা আশালতা সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন এবং সন্তানের নামকরণ হয় ‘কৃষ্ণমহম্মদ’। সুতরাং ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ কেবলমাত্র তাঁর আবেগময় কাব্যকল্পনা নয়, নিজ জীবনে প্রমাণিত সত্য। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি, কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনোদ্দেশ্যে রচিত ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ সঙ্গীতধর্মী কবিতাটি এবং ছাত্র সম্মেলনের জন্য রচিত ‘ছাত্রদলের গান’ প্রভৃতি করিতাগুলি একদিকে দেশবাসীকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, অপরদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমন্ত্রে দীক্ষিত করে মানবতার জয় ঘোষণা করে।
সুকণ্ঠ গায়ক কবি দেশাত্মবোধক গান, বাউল সঙ্গীত, ভাটিয়ালী গান, শ্যামাসঙ্গীত, পালাগান, রাগ-রাগিনী প্রধান ওস্তাদীগান প্রভৃতি ‘নজরুলগীতি’ নামে বাংলা সঙ্গীতজগতে বিশেষভাবে সমাদৃত। মন-দোলানো সাড়া জাগানো প্রায় সাড়ে চার হাজার সংখ্যক সঙ্গীতের জন্য কবি অবিস্মরণীয় ও অনন্য। ‘দারিদ্র্য’জর্জরিত কবির জীবনে একাধিক দুর্ঘটনার মধ্যে অন্যতম চরম আঘাত পান তাঁর প্রিয়তম দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদ ‘বুলবুল’-এর বসন্ত রোগাক্রান্ত মৃত্যুতে। সঙ্গ রচয়িতা সুরস্রষ্টা কণ্ঠশিল্পী কবি ছিলেন ‘বেতারবার্তা’ কলকাতা কেন্দ্র-প্রচারিত ‘নবরাগ মালিকা’, ‘হারামণি’ ও ‘গীতিবিচিত্র’ অনুষ্ঠানের পরিচালক। নজরুল সৃষ্ট বাংলা গজল গান সঙ্গীতসমাজে আজও বিশেষভাবে সমাদৃত।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পত্নী প্রমীলা নজরুল দুরারোগ্য পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং তাঁর ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসার্থে কবি কপর্দকহীন হয়ে পড়েন। আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয়ে মুহ্যমান কবি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৯ই আগস্ট কলকাতা বেতার কেন্দ্রে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ছোটদের আসরে’ গল্প পরিবেশনকালেই বাক্-শক্তি রোহিত হয়ে পড়েন। তার এক বৎসর পূর্বেই ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’-তে রজত জয়ন্তী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সভাতে সভাপতি হিসাবে কবির ভাষণ ‘আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম-সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম’। লণ্ডন, ভিয়েনা, রাশিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ কবির রোগনিরাময়ে ব্যর্থ হন। ‘অগ্নিবীণা’র অগ্নিগর্ভ বিদ্রোহী কবি চিরদিনের জন্যই নীরব হলেন।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ -প্রদানে সম্মান প্রদর্শন করে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার কর্তৃক কবিকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি প্রদত্ত হয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি. লিট্. দ্বারা সম্মানিত করে।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে কবিপত্নী প্রমীলা নজরুলের মৃত্যুর দশ বৎসর পর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে যান এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কবিকে মাসিক এক হাজার টাকা ভাতা প্রদত্ত হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৯শে আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘ চৌত্রিশ বৎসর দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত থেকে ‘প্রেমহীন’ নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায়’ নিলেন। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি কবির মরণে শোকপ্রকাশ করেন, ‘তাঁর মৃত্যু ভারত ও বাংলাদেশকে রিক্ত করে দিয়েছে।’ কবি অন্নদাশংকরের ভাষায়-
‘আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে।
ভাগ হয়নি কো নজরুল।
এপার ও ওপার বাংলা সাহিত্যাকাশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সমগ্র বাংলা ও বাঙালির অত্যাপন কবি বহুবিচিত্র প্রতিভায় চিরভাস্বর।
বহুমুখী প্রতিভাধর কবির বহুবিচিত্র রচনা-সম্ভার –
(ক) কাব্য কবিতাগ্রন্থ : অগ্নিবীণা (১৯২২) ; দোলন চাঁপা (১৯২৩); ভাঙ্গার গান (১৯২৪); ছায়ানট (১৯২৪); বিশের বাঁশী (১৯২৪); পুবের হাওয়া (১৯২৫); চিত্তনামা (১৯২৫);সাম্যবাদী (১৯২৫); সর্বহারা (১৯২৬);ঝিঙে ফুল (১৯২৬) ; ফণি-মনসা (১৯২৭); সিন্ধু হিল্লোল (১৯২৭) ; জিঞ্জীর (১৯২৮); সঞ্চিতা (১৯২৮) ; সন্ধ্যা (১৯২৯) ; চক্রবাক (১৯২৯); প্রলয়শিখা (১৯৩০); চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০) ; নতুন চাঁদ (১৯৪৫) ; মরু ভাস্কর (১৯৫৭) ; সঞ্চয়ন (১৯৫৫); শেষ সওগাত (১৯৫৮); ঝড় (১৯৬০); সাত ভাই চম্পা শিশু-কবিতা সঙ্কলন।
(খ) অনুবাদ কাব্য-কবিতাগ্রন্থ : রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ (১৯৩০) ; কাব্যে আমরা (১৯৩৩) ; রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম (১৯৩৩)।
(গ) গল্পকাহিনি-গ্রন্থ : ব্যথার দান (১৯২২) ; রিক্তের বেদন (১৯২৪); শিউলি মালা (১৯৩১)।
(ঘ) উপন্যাসগ্রন্থ : কুহেলিকা (১৯২৭) : বাঁধনহারা (১৯২৭); মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) ; জীবনের জয়যাত্রা (?)।
(ঙ) প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ : যুগবাণী (১৯২২) ; রাজবন্দীর জবানবন্দী (১৯২৩); রুদ্রমঙ্গল ; দুর্দিনের যাত্রী ; ধূমকেতু (১৯৬০)।
(চ) নাট্যগ্রন্থ : ঝিলিমিলি (১৯৩০) ; আলেয়া (১৯৩১); মধুমালা (১৯৫৯); পুতুলের বিয়ে।
(ছ) পাঠ্যগ্রন্থ : মক্তব-সাহিত্য। (১৯৩০)।
(জ) নজরুল গীতি-সংগ্ৰহ গ্রন্থ : বুলবুল (১৯২৮) ; চোখের চাতক (১৯২৯) ; নজরুল-গীতিকা (১৯৩০) ; সুরসাকী (১৯৩১); জুলফিকার (১৯৩২) ; বনগীতি (১৯৩২) ; চন্দ্রবিন্দু (১৯৬৪); ২য় প্রকাশ ; গুল বাগিচা (১৯৩৩); সুর-লিপি (১৯৩৪); সুর-মুকুর (১৯৩৪) ; গীতি শতদল (১৯৩৪); গানের মালা (১৯৩৪) ; বুলবুল (১৯৫২); ২য় খণ্ড, সন্ধ্যা-মালতী ; রাঙাজবা (১৯৬৮) ; দেবীস্তুতি (গীতি-আলেখ্য)।
(ঝ) চলচ্চিত্র-কাহিনি : সাপুড়ে, বিদ্যাপতি।
(ঞ) পত্রপত্রিকা সম্পাদনা ও পত্রসাহিত্য রচনা : নবযুগ (দৈনিক পত্রিকা) ; ধূমকেতু (অর্ধ-সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকা); নওরোজ (মাসিক পত্রিকা) ; নজরুল পত্রাবলী (পত্র-সংগ্রহ)।
প্রশ্ন ৩। কোন পটভূমিতে কবি ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতা লিখেছিলেন তা বর্ণনা করো।
উত্তরঃ কবিতাটির জন্মলগ্নে ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের বাতাবরণ খুব দুর্যোগপূর্ণ, ভ্রাতৃবিচ্ছেদজনিত বেদনার রক্তে ইতিহাস কলঙ্কিত। একদিকে বিপ্লববাদের অগ্নিমশাল, অপরদিকে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন ও আপোষ আলোচনা পথ-কোন পথে স্বাধীনতা অর্জিত হবে এ সম্পর্কে জাতি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় পীড়িত। ইংরেজ শাসক প্রচারিত দ্বিজাতিতত্ত্বের কলঙ্কিত স্পর্শে জাতীয়জীবন ভ্রাতৃবিচ্ছেদের রক্তপঙ্কিল পথ। এই বিভ্রান্তি ও মূঢ়তার কালে জাতিকে ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিচালনাকারীকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। জাতির প্রতিনিধিরূপে নজরুল ইসলাম সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে একটি সুমহৎ ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করলেন। স্বদেশ স্বজাতির যে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে কবিতাটির জন্ম, সেখানে কেবল বক্তব্য নয়, নামকরণেও তার ছায়াপাত অনিবার্য। সেজন্য কবিতায় রাজনৈতিক দুর্যোগের অনুষঙ্গরূপে আসে দুর্গমগিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার ইত্যাদির চিত্রকল্প। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দুর্যোগ, পথভ্রান্তি ও জনসাধারণের দোদুল্যমানতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে-দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ’ ইত্যাদি ছত্রে। কবিতার সূচনায় জাতিকে সাবধান করার ইঙ্গিত, আর পরবর্তী অংশে রয়েছে সর্ব সংস্কারমুক্ত নবযৌবনকে আহ্বান স্বদেশ ও স্বজাতির সংকটক্ষণে নেতৃত্বগ্রহণের জন্য- ‘কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’ সমস্ত বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা, বিভ্রান্তিমনস্কতা, চক্রান্ত ইত্যাদি উত্তীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার স্বর্ণ উপকূলে উপনীত করানো অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য। ফলে কাণ্ডারীকে স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সমাজের নিপীড়িত, অবহেলিতদের সঙ্গে না নিলে স্বাধীনতা সংগ্রামে সফলতা অর্জন করবে না। সাম্প্রদায়িক ঐক্য, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামে সার্থকতা ও সফলতা অর্জনের মৌলিক শর্ত।
প্রান্তরে যে বিশ্বাসঘাতকতা ও ব্যর্থতার ইতিহাস রচিত হয়েছে জাতীয় জীবনে তার পুনরাবৃত্তি অনাকাঙ্ক্ষিত। সেজন্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাণ্ডারী ও স্বাধীনতাকামী জনগণকে সাবধান হতে হবে। জাতির কাণ্ডারীর সমর্থনে সমগ্র জাতি রয়েছে, দেশবাসী রয়েছে। জাতের ক্ষুদ্র সংকীর্ণতার স্বার্থে অনৈক্যের চোরাবালিতে কাণ্ডারী যেন পদক্ষেপ না করেন। জাতীয় আন্দোলনের কাণ্ডারীকে নির্ভীকতার সঙ্গে সম্প্রদায়গত বিভেদচিন্তা বিস্মৃত হয়ে আন্দোলন -সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। তিনি হবেন জাতির স্বার্থের ধারক-বাহক, জাতির আত্মার আত্মীয়। নজরুল ইসলাম কবিতার সূচনায় দেশ ও জাতি সম্পর্কে সামগ্রিক সাবধানবাণী উচ্চারণের পর কাণ্ডারী সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন বলে নামকরণটি সুসংহত ব্যঞ্জনাময় মাধুর্যে দীপ্যমান।
দেশমাতৃকার পরাধীনতার বন্ধনশৃঙ্খল মোচনের জন্য ব্রতচারী অভিযাত্রী-দলের যাত্রা শুরু হয়েছে, তাদের অগ্রসরণের পথে দুর্লঙ্ঘ্য পর্বত, দুর্ভেদ্য বনভূমি, অসীম মরু প্রান্তর আর সীমাহীন সমুদ্রের দুরন্ত দুর্বার জলোচ্ছ্বাস; তবুও এ সমস্ত সত্ত্বেও রাত্রি অবসিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপনীত হতে হবে স্বাধীনতার তোরণ তীর্থে, অজস্র প্রকৃতিক বিপদ সত্ত্বেও যাত্রীদের সাবধান থাকতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ঘনান্ধকার রাত্রিতে সমুদ্রাভিযানের পথের মতো দুর্গম-ঝটিকা বিক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্রবক্ষে দোদুল্যমান তরণী, উত্তাল জলরাশি নিত্য তরণীকে আঘাতরত, মাঝি নিত্য পথ ভুল করছে, পাল ছিন্নভিন্ন, এই সময় কে আছে যে সাহসের সঙ্গে যাত্রীদলকে লক্ষ্যে উপনীত করতে পারবে। কবি সেজন্য শেষ পর্যন্ত নবযৌবনরূপী প্রাণকে আহ্বান জানান যে সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে যাত্রীকুলকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করাবে। কবিতাটির এই সাধারণ বক্তব্যের অন্তরালে কিন্তু সংগুপ্ত আছে এক রূপকাশ্রিত বক্তব্য। জাতির রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা, জাতিবৈরিতা, বহুতর চক্রান্ত প্রতিমুহূর্তে স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি করার যে ষড়যন্ত্রে রত, কবি তাকেই আলোচ্য স্তবকে রূপায়িত করতে প্রয়াসী। জাতীয় নেতৃত্ব দ্বিধান্বিত, দ্বিধাগ্রস্ত, সংশয়ের চোরাবালিতে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম যাতে বিপর্যস্ত না হয় সেই জন্যই কবির নবযৌবনদূতরূপী শক্তির আহ্বান-যে স্বাধীনতার সূর্যোদয় সমাসন্ন করবে; পরাধীনতার তমসাবৃত লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি প্রদান করে জাতির হস্তধৃত করাবে মুক্তির ললিত লগ্ন।
নিঃসীম ঘন তমসাবৃত রাত্রিতে যাত্রীদের যাত্রা শুরু হয়েছে ; এই ঘনান্ধকার রাত্রিতে, নানা দুর্যোগের বিষম জালে যখন জাতি পর্যুদস্ত তখন জাতীয় নেতৃত্বের ভার যাদের উপর অর্পিত তাদের সাবধান হতে হবে। যথেষ্ট নিপুণতার সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। কেননা, এতদিন পর্যন্ত যারা বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত ছিল ; সামাজিক-অর্থনৈতিক অধিকার যাদের দেওয়া হয়নি, নানা বিভেদ অনৈক্যে যারা নিজবাসভূমে পরবাসীর ন্যায়—সেই বঞ্চিত, নির্যাতিতের দীর্ঘকালের ক্রমপুঞ্জিত অভিমান আজ যেন বিস্ফোরণের চূড়ায় উপনীত ; সমগ্র জাতীয় জীবনের আজ অগ্নিগর্ভ অবস্থা। আজ যদি সেই লাঞ্ছিত, সর্বহারা মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের যোগ্য উত্তরাধিকারী না করা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের যোগদান যদি সুনিশ্চিত করা না যায় তবে ব্যর্থতার অন্ধকার ব্যতীত কিছুই পাওয়া যাবে না। সেজন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের প্রতি, তরণীর কাণ্ডারীর প্রতি কবির একান্ত আবেদন- ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যখন জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সর্বাঙ্গীণ সংগ্রামের বিপুল প্রস্তুতি, অপরদিকে তখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের অকথ্য অত্যাচার, কুটিল ষড়যন্ত্র ; জাতিবিদ্বেষে জর্জরিত ভারত, ভেদাভেদে শ্রীহীন ভারতবর্ষ। এই সময় এমন সুদক্ষ সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রয়োজন যিনি সম্প্রদায় বিশেষের প্রশ্ন না তুলে জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে উপনীত করাবেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পথ ভয়ঙ্কর বিপদের দ্বারা লাঞ্ছিত ; বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীর অত্যাচারে জাতীয় জীবন অত্যাচারিত, রক্তাক্ত বেদনায় দীর্ণ। মৃত্যু ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের মনে আজ পরিণাম সম্পর্কে সংশয়ের উদয় হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা কাণ্ডারী নিশ্চয়ই এই দিকভ্রান্তির, লক্ষ্যভ্রষ্টতার, ব্রতভ্রষ্টতার শিকার হবেন না। পারস্পরিক হানাহানিতে রত থাকলেও পথের দুর্জয় প্রতিবন্ধকতা পার করে স্বাধীনতার স্বর্ণতীর্থে জাতিকে পৌঁছে দিতে হবেই। কবি জাতিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন-পলাশীর প্রান্তরের সেই ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতার কথা যেদিন বাঙালীর বক্ষরক্তে রঞ্জিত ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ক্লাইভের নেতৃত্বে ও কৌশলে, জাতির বিশ্বাসঘাতকতার পঙ্কলিপ্ত অধ্যায় অমূল্য স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের স্মৃতি মনে করে জাতি যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্বুদ্ধ হয়। পলাশীর বেদনা, অপমান, লাঞ্ছনা জাতীয় চিত্তে যেন অনিঃশেষ থেকে তাকে স্বাধীনতা অর্জনে প্রাণিত করে। ইংরেজের অধীনতা পাশ থেকে মুক্তি লাভের জন্য সুদীর্ঘকালের স্বাধীনতা সংগ্রামে অজস্র শহীদের বক্ষোরক্তে পরাধীনা জননীর চরণ রক্তলাঞ্ছিত হয়েছে;শত শহীদ ফাঁসির মৃত্যুরজ্জু কণ্ঠে ধারণ করে মরণবরণের মাধ্যমে জীবনের সীমাহীন জয়গান উচ্চারণ করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে সংকল্পে অনুপ্রাণিত যে মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদের দল প্রাণ বলিদান দিয়েছিলেন, তাঁরা আজ অচরিতার্থ স্বপ্নের, আদর্শের বাস্তব রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রতীক্ষাকাতর। তাঁদের সংকল্পের রূপায়ণের দায়িত্ব বর্তমান দেশনায়কের উপর ন্যস্ত। তাঁকে জাত, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ইত্যাদির বিচার করলে চলবে না। কাণ্ডারীকে মহাপরীক্ষার কালরাত্রি উত্তীর্ণ হতে হবে। ভয়াল মৃত্যুর হাতছানিতে দোদুল্যমান তরণীকে উত্তাল সমুদ্র বক্ষের উপর দিয়ে চালিয়ে স্বাধীনতার স্বর্ণপ্রদীপ্ত তোরণে উপনীত করানোতেই সংগ্রামের সার্থকতা নিহিত।
কবিতাটিতে দুর্গম, দুস্তর তিমিররাত্রি, বঞ্চিত, পুঞ্জিত, অসহায় ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহারের দ্বারা স্বাধীনতা সংগ্রামের দুরধিগম্যতা, বাধাবিঘ্ন, মৃত্যু, শঙ্কা, দুর্লঙ্ঘ্যতা ইত্যাদির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘‘গিরিসংকট ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ ইত্যাদি চিত্রকল্পে স্বাধীনতা সংগ্রামের বন্ধুরতা, বাস্তবতা, কঠিনতা প্রভৃতি রূপায়িত হয়। ‘ক্লাইভ’ ও পলাশী’ ইতিহাস নামবাচক শব্দ দুটি স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র, লুঠেরা মনোবৃত্তি, হীনস্বার্থ-সর্বস্বতা ইত্যাদিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যেন সংগ্রামীদের সাবধান হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে।
প্রশ্ন ৪। কখন কোথায় কেন পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তা বর্ণনা করো?
উত্তরঃ ভারতবর্ষে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠায় পলাশির যুদ্ধ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। পলাশির যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফলাফল সুদূরপ্রসারী হয়েছিল এই কারণে ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় পলাশির যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন।
ইংরেজ ঐতিহাসিক S. C. Hill পলাশির যুদ্ধের কারণ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তাতে মূলত সিরাজকেই যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়েছে। ইংরেজ ঐতিহাসিক হিলের ব্যাখ্যায় সিরাজের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধের কারণগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, সিরাজের অহমিকা ও অর্থলিপ্সা কোম্পানির সঙ্গে সংঘাতের সৃষ্টি করেছিল। দ্বিতীয়ত, মুসলিম কর্তৃক প্রবর্তিত কিছু ব্যবস্থার দরুন মুর্শিদাবাদের হিন্দু রাজকর্মচারীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, ফলে এঁরা যে সিরাজ-বিরোধী চক্রান্ত শুরু করেন তা শেষপর্যন্ত পলাশির যুদ্ধের সূচনা করে। তৃতীয়ত, কয়েকটি বিষয়কে ঐতিহাসিক Hill যুদ্ধের অজুহাত বলেছেন যেগুলি হল-
(i) দস্তকের অপব্যবহারের প্রশ্ন।
(ii) দুর্গ নির্মাণ সংক্রান্ত প্রশ্ন।
(iii) রাজনারায়ণকে রাজনৈতিক আশ্রয়দান সংক্রান্ত প্রশ্ন।
ঐতিহাসিক ব্রিজেন গুপ্ত যেভাবে পলাশির যুদ্ধের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন তা হিলের বিশ্লেষণ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি তাঁর গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে দেখিয়েছেন যে পলাশির যুদ্ধের কারণসমূহ সিরাজের সিংহাসন আরোহণের আগেই গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা নিয়ে উভয় তরফে যে বোঝাপড়ার অভাব ঘটে বা বচসার সৃষ্টি হয় তার দরুন পলাশির যুদ্ধের ক্ষেত্র আগে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় তাঁর গবেষণায় সাম্প্রতিককালের বিতর্কে পলাশির যুদ্ধ সম্পর্কে যে মত প্রকাশ করেছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। রায়ের মতে সিরাজ-বিরোধী ষড়যন্ত্র মূলত মুর্শিদাবাদ অভ্যন্তরীণ চক্রান্তের ফলেই গড়ে উঠেছিল। এতে ইংরেজরা শামিল হয়নি। মুর্শিদাবাদের চক্রান্তকারীরাই ইংরেজদেরকে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী অবশ্য এই জাতীয় মতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন তাঁর একাধিক গ্রন্থে। অধ্যাপক চৌধুরী দেখিয়েছেন যে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ফরাসি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পেছিয়ে পড়েছিল। এই কারণে তারা বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল।
দস্তকের অপব্যবহার, দুর্গ নির্মাণ ইত্যাদি কারণে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্কের বিশেষ অবনতি ঘটে। সিরাজ শেষ অবধি আপস মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন এবং এজন্য খোজা ওয়াজেদকে তিনি আলাপ আলোচনার জন্য ইংরেজদের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু ইংরেজরা খোজা ওয়াজেদকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। কাজেই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশির প্রান্তরে সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ এই যুদ্ধে পরাজিত হন। পরবর্তীকালে মিরজাফরের পুত্র মিরনের আদেশে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর মিরজাফর (১৭৫৭-৬০) বাংলার সিংহাসনে বসেন।
পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজ কোম্পানি একটি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয়ত, কোম্পানি কার্যত রাজস্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তৃতীয়ত, ব্রিজেন গুপ্তের মতে পলাশির পর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ওপর নবাবের কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই হ্রাস পায়। অর্থাৎ সবকিছুর ওপরে ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃপক্ষের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়, যার দরুন অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে নবাব কার্যত বিদেশিদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। চতুর্থত, পলাশির পর স্থানীয় সংঘাতগুলির ক্ষেত্রে কোম্পানির কাউন্সিলাররা যে ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করে তা থেকেও ইংরেজদের রাজনৈতিক প্রাধান্যের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়। সিংহাসনে আরোহণের পর পরই মিরজাফর স্থানীয় প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিবর্গের প্রতিরোধের সম্মুখীন হন এবং এইরূপ পরিস্থিতিতে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করার ফলে তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। পঞ্চমত, পলাশির পর নতুন নবাব বহিঃশক্তিগুলির দিক থেকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তাতেও ইংরেজরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে, ফলে ঐতিহাসিকদের মতে বাংলার নবাবের পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়েও কোম্পানি বিশেষ কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে ওঠে।
পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের দরুন ইংরেজরা প্রভূত অর্থসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। ব্রিজেন গুপ্ত দেখিয়েছেন যে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০-এর মধ্যে কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে ২২,৫০০,০০০ টাকা লাভ করেন। এছাড়াও মোট ৫,৮৭০,০০০ টাকা উপহার হিসেবে কোম্পানির উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের প্রদান করা হয়েছিল। ১৭৫৯-এ ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে জমিদারি লাভ করেন যা থেকে ১৭৬১-৬২-তে মোট রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৩৪,৫৬৭ পাউণ্ড। এই বিপুল অর্থ বাংলা ও বাংলার বাইরে কোম্পানির কর্মচারীরা বিনিয়োগ করে তাদের মুনাফার পরিমাণ বিপুলভাবে বাড়িয়ে তোলেন। ঐতিহাসিকেরা সংগত কারণেই এই প্রসঙ্গে পলাশি লুণ্ঠনের কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। পলাশি উত্তর পর্যায়ে ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তকের অপব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে বিপুল অর্থ পুঞ্জীভূত হওয়ায় ওই অর্থ ইউরোপীয় এজেন্সি হাউসগুলিতে তারা বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে এই সময় থেকে দেশজ ব্যাংকিং সংস্থাগুলির পতন শুরু হয়। বাংলার অর্থনীতির ভাঙনের সূত্রপাত পলাশি উত্তর পর্যায়ের একটি ঘটনা বলেই বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন।
প্রশ্ন ৫। কবি মুক্তিকামী কাণ্ডারীকে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছেন তা বর্ণনা করো।
উত্তরঃ স্বদেশপ্রেমিক বাংলার বিদ্রোহী বীর কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় যাত্রীদের অর্থাৎ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ব্রিটিশ শাসন, শোষণ এবং অত্যাচারে বিপর্যস্ত দেশের মানুষ অর্থাৎ দেশবাসীদের হুঁশিয়ার বা সাবধান হওয়ার কথা বলেছেন। কবি দেখিয়েছেন দুর্গম গিরি কান্তার মরু এবং দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে অর্থাৎ পার হতে হবে সুতরাং যাত্রীদের সতর্ক হওয়া দরকার। কবির বক্তব্য দেশরূপী নৌকা সমস্যা সংক্ষুব্ধ সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাতে দুলছে, সফেন সমুদ্রের জল ফুলে ফুলে উঠছে, মাঝি অর্থাৎ নৌকাচালক (দেশনেতা) মাঝি দিশাহারা হচ্ছে, পাল ছিঁড়েছে অর্থাৎ স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশ জুড়ে দারুণ সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেজন্য কবির জিজ্ঞাসা দেশের হাল ধরার ক্ষমতা কার? কে এমন জোয়ান আছে যে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এগিয়ে আসতে পারবে ও সফেন সমুদ্রের তরঙ্গ বিক্ষোভ এড়িয়ে তরীকে পরপারে পৌঁছে দিতে পারবে অর্থাৎ সমস্ত বিপদ আপদ, সংকট ও বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করে দেশকে স্বাধীন করতে পারবে।
বিপ্লবী বাংলার অগ্নিহোত্রী কবি এবং কালজয়ী সংগীতস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলামের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাটি দেশাত্মবোধ জাগৃত করার উদ্দিপক মন্ত্র। শোষিত পীড়িত, লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত মানুষের ব্যথায়, দেশের পরাধীনতার লজ্জায় এবং মানবতার মুক্তিকামনার উদগ্র বাসনায় কবি অগ্নিবীণা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে যে বাণী সমূহ উচ্চারিত করেছিলেন তারই মূর্তরূপ লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন কাব্য কবিতায়।
‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতা কবির দেশমাতৃকার উদ্ধার কল্পে স্বতন্ত্রতা সংগ্রামী জননায়ক অর্থাৎ নেতার প্রতি তাঁর সতর্ক বাণী নিচয়ের সমষ্টি যা কবিতাকারে কবি হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে প্রকাশিত।
অমর কবি কাজী নজরুল দেশের চরম সঙ্কটময় মুহূর্তেও দেশ ও জাতির চরম বিপর্যয়ের সময় দেশনেতাকে সতর্ক হয়ে দেশরূপী নৌকার হাল শক্ত করে ধরার কথা বলেছেন। কবির ভাবনায় দেশনেতার দায়িত্ব মহান দেশ ও দেশবাসীকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা তাঁর পরম কর্তব্য। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের বুকে ভাসমান নৌকার বিপন্ন যাত্রীদের রক্ষার ভার যেমন সম্পূর্ণ কাণ্ডারীর, তাকে যেভাবেই হোক ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের বুক থেকে লহর তাড়িত যাত্রীসহ বিপন্ন নৌকাকে সাগর পারে পৌঁছে দেওয়ার ভার বা দায়িত্ব যেমন কাণ্ডারীর, তেমনি সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিরূপ সাগর থেকে দেশরূপী নৌকা এবং তার যাত্রীরূপী জনতাকে বিপন্নতার হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার সমস্ত ভার কাণ্ডারী রূপী দেশনেতার। বিপদাপন্ন দিশেহারা যাত্রীদের সঠিক পথ দেখিয়ে গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কর্তব্য দেশনেতার। কবি বারবার দেশনেতাকে সতর্ক করে দিয়েছেন। দেশ সংকটগ্রস্ত জাতি, সম্প্রদায়, ধর্ম, প্রান্ত, বর্ণ, লিঙ্গ প্রভৃতির বৈষম্যের প্রশ্ন আজ ভারতের জনতাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে, তাদের ঐক্য ভঙ্গ করে দিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য বিরুদ্ধ শক্তি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। দেশের জনতা বিভ্রান্ত, তাই এই বিষম পরিস্থিতিতে দেশমুক্তির আন্দোলনকে তরান্বিত করার জন্য এবং সব বিভেদ ভুলে একজাতি, একপ্রাণ, একই পথের পথিক হয়ে, ঐক্যবদ্ধ ভাবে সবাইকে পরিচালনার জন্য দেশনেতাকে হুঁশিয়ার অর্থাৎ সতর্ক হতে হবে। দেশনেতাকে মাতৃমুক্তি পণের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে কোন বিশেষ জাত নয় সমগ্র জাতির উদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং আন্দোলন-কারীদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। কবি বার-বার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন দেশনেতাকে পুনঃ একবার স্বাধীনতার জন্য মরণ পণ সংগ্রামের শপথ নিতে হবে। যে শত শত বীর দেশমাতার মুক্তির জন্য স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে ‘শহীদ’ হয়েছেন, আজ তাঁরাও যেন অলক্ষ্যে এসে দাঁড়িয়ে দেখছেন এবং তাঁদের অশরীরি আত্মা পরোক্ষভাবে তাঁদের উৎসাহিত করেছেন। কবির দেশনেতার প্রতি বক্তব্য তাঁদের জন্য বলিদান দেওয়ার বা আত্মোৎসর্গের সময় সমাগত। দেশ স্বাধীন না হলে তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে না। কবি কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় বার বার কাণ্ডারী অর্থাৎ দেশনেতাকে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
প্রশ্ন ৬। ব্যাখ্যা লেখো।
(ক) দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের “কাণ্ডারী হুঁশিয়ার” শীর্ষক কবিতা থেকে নেওয়া।
ভয় মানুষের চিরশত্রু। ভয়হীনতাই প্রকৃত শক্তি। যে আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী, ভয়কে সে জয় করতে পারে। শক্তিতে ভীতিকে কবলমুক্ত করে, ভয়কে পদদলিত করে, ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে এই পৃথিবীতে যথার্থ মানুষের মত বাঁচতে হবে। নিশ্চেষ্ট ও পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকা অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয়। সে মৃত্যুতে গৌরব নেই। যারা ভীরু, যারা ভয়ে গৃহকোণে সারা জীবন আত্মগোপন করে থাকে, যারা মৃত্যুর পূর্বে বহুবার মরে, তারা মানবতার কলঙ্ক। জীবনতরী সকল সময়ে স্বচ্ছন্দে চালিত হয় না। তরী বাইবার সময় ঝড় তুফানের মধ্যে নৌকার হাল ছেড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে নৌকা সামলানো যায় না। ঝড় তুফানের মধ্যে নিরুদ্যম না হয়ে শক্তি, সাহস, ধৈর্য ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে নৌকা চালনাতেই মাঝির কৃতিত্ব। পরাজয়ী মনোভাব পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে। যত প্রতিকূল অবস্থাই আসুক না কেন, তার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে সংগ্রাম করে জয়লাভ অর্জনেই মহত্ত্ব।
(খ) যুগ যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিমান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান।
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কাণ্ডারী হুঁশিয়ার শীর্ষক কবিতা থেকে সংকলিত।
মানুষ স্বার্থ ও সম্পদের যন্ত্র নয়, সে ভালোবাসাকে বিস্তৃত করে দিতে পারে অনেকের মধ্যে। তার চেয়ে বড়ো পুজো আর কিছুই হতে পারে না। ভর্ৎসনা, শাসন, উপেক্ষা, যাদের ভাগ্যলিপি তাদের আপনার জন্য ভেবে বুকে টেনে নিলে আত্মার উন্নতি হয়। আমরা মানবসেবার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করি। সমাজের চারদিকে অশিক্ষা- কুশিক্ষা -দারিদ্র্য-নিপীড়ন। তার ওপরে জাতিভেদ ও কুংসংস্কার সমাজকে করেছে পঙ্গু। তারও ওপরে আছে প্রাকৃতিক অভিশাপ, দৈব, দুর্দৈব—খরা, বন্যা, ভূমিকম্প। সমাজের বুকে এইসব অভিশাপ মানুষের জীবনকে অভিশপ্ত করে তুলেছে। এই অবস্থায় মায়া- স্নেহ- প্রেম- সহমর্মিতার মতো মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধ নিয়ে মানুষ মানুষের পাশে থাকলে জীবন সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। মহাপুরুষরা বারবার এই অমৃতবাণী আমাদের শুনিয়েছেন। ভজন পূজন সাধন আরাধনা করে যাঁরা দেবতাকে খোঁজেন, বৃথাই তাঁদের সে খোঁজ। ভগবানকে খুঁজতে গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেমে আসতে হবে।
(গ) কাণ্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
উত্তরঃ কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় দেশ ও দেশবাসীর বিপন্ন অবস্থার কথা চিন্তা করে দেশনেতাকে হুঁশিয়ার করার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলন-কারীদেরও জিজ্ঞেস করেছেন—তাদের মধ্যে কে এমন সৎসাহসী বীর দেশভক্ত যুবক আছে যে দেশের ভবিষ্যৎ রচনা করার এই সংকটময় পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসতে পারে।
পরাধীন ভারতবর্ষ ও ভারতীয়রা আজ নানাভাবে বিপন্ন। সমুদ্রবক্ষে যেমন তুফান বা ঝড় উঠলে সমুদ্রের বুকে ভাসমান নৌকা বা জাহাজ ও তার যাত্রী বিপন্ন হয় এবং নৌকার মাঝি বা জাহাজের কাণ্ডারীকে অনেক কষ্টে ধৈর্য সহকারে সেই দোদুল্যমান জাহাজ বা নৌকাকে পরপারে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিতে হয় এবং সতর্ক হতে হয় দেশনেতারূপী কাণ্ডারীকে আজ দেশ ও দেশের জনতার সুরক্ষার জন্য সেই সতর্কতা পূর্ণদায়িত্বে গ্রহণ করতে হবে।
(ঘ) ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর।
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাণ্ডারী হুঁশিয়ার নামক কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে স্বদেশ প্রেমিক বীর বিদ্রোহী কবি মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেই অজুহাতে দেশনায়ককে সতর্ক করে দিয়েছেন।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গার তীরের প্রশস্ত ভূমি পলাশির লক্ষবাগ, আম্রকুঞ্জে বাংলার শেষ স্বাধীনচেতা নবাবের সঙ্গে লর্ড ক্লাইভের ইশারায় সেনাপতি মীরজাফর যুদ্ধের নামে কেবল একটা প্রহসন করেছিল মাত্র। এই যুদ্ধে অগণিত বাঙালী বীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে শেষপর্যন্ত প্রাণ দিয়েছে কিন্তু যুদ্ধে জয় সম্ভব হয়নি। এই যুদ্ধেই ভারতের স্বাধীনতার সূর্য গঙ্গার জলে ডুবে গিয়েছে অর্থাৎ অস্তমিত হয়েছে। এবং ইংরেজদের ভারতে রাজ্য বিস্তারের গোড়াপত্তনও ঘটেছে, তারই পরাজয়ের পরিণাম হিসেবে।
কবি পলাশীর যুদ্ধের ষড়যন্ত্রের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আগামী সংগ্রামের তৈরির জন্য সাবধান হতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য যে সাবধান থাকা প্রয়োজন, কবি বার-বার সেকথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
(ঙ) ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ শীর্ষক কবিতা থেকে নেওয়া। প্রস্তুত অংশে কবি স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতে যে দেশপ্রেমিক বীরেরা জীবন উৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন, তিনি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। কবির বক্তব্য ইংরেজ শ্বেতকায় সাহেব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানা রকম ছল-চাতুরী, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতাকে অস্ত্ররূপে গ্রহণ করেছে। হাজার হাজার দেশপ্রেমিক বীরকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন করতে হয়েছে। দেশ এখনও স্বাধীন হয়নি, সেজন্য তাদের আত্মা আজও অশান্ত। বীর শহীদদের অশরীরি আত্মা আজ অলক্ষ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্যে কবি বলছেন—’জীবনের মহান ব্রতে ব্রতী হয়ে তাঁরা হাসি মুখে ফাঁসি কাষ্ঠে জীবন ত্যাগ করেছেন, তাই তাদের জন্য শ্রদ্ধা অর্পণ মহৎ উদ্দেশ্যে প্রাণত্যাগ দ্বারাই সম্ভব। কবি এই প্রসঙ্গে দেশনেতাকে পুনরায় আর একবার সচেতন করে দিয়েছেন।
প্রশ্ন ৭। তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
(ক) ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
উত্তরঃ জাতিভেদ প্রথা অত্যন্ত নিন্দাকর এবং অসভ্যতার লক্ষণ। মনুষ্যত্বের এই লাঞ্ছনায় সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেশ ও জাতি দুর্বল হয়ে পড়ে। মাতৃমুক্তি মানসে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ দেশনেতাকে সেজন্য সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন থেকে সকল ডুবন্ত মানুষকে তার মাতার সন্তান, ভাই হিসাবে পরিচয় দিতে হবে।
এ যুগে মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠলেও কিছু কিছু কুসংস্কার বা ব্যক্তি-সমাজ-জাতিকে দুর্বল করে দেয় তা সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। জাতিভেদ প্রথা এইরূপ কুসংস্কারের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিভেদকামী মানুষ যেমন ভাষার নামে, বর্ণের নামে, জাতির নামে দাঙ্গা বাধায়, অরাজকতার সৃষ্টি করে ; তেমনই ধর্মের নামেও একে অপরের বুকে অস্ত্রাঘাত করে। ধর্মের নামেও পৃথিবীতে তাই প্রায়শই লুপ্ত হয় মানবিকতাবোধ, সৃষ্টি হয় অনাচার। কে হিন্দু আর কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান আর কে ইহুদি এসব ভেদাভেদ ঈশ্বর সৃষ্টি করে পাঠাননি। এইসব সংকীর্ণ চিন্তা ক্ষুদ্রচেতা মানুষেরই সৃষ্টি। মানুষই মাঝে মাঝে হৃদয়ের দীনতায় নিজের মনুষ্য জন্মের মুখে কালি দেয়। এর জন্যই পৃথিবীতে লুপ্ত হয় মানবিকতাবোধ, সৃষ্টি হয় অনাচার।
কাণ্ডারীর দায়িত্ব যাত্রীসহ নৌকোকে নিরাপদে পরপারে পৌঁছে দেওয়া। তার নৌকায় আরোহীরা কোন্ জাতির তা যেমন সে লক্ষ্য না করেই তাদের উপকূলে পৌঁছে দেয় তেমনই দেশমাতার মুক্তি ও দেশবাসীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্যও দেশনেতাকে ‘সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। কবির সতর্কবাণী—‘জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’। সামনে রেখে তাই কুসংস্কারগুলি ও বিভেদের প্রাচীরগুলি ভেঙে ফেলতে হবে। মহৎপ্রাণ সচেতন দেশনেতা তাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে মনুষ্যত্বের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
(খ) আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ।
উত্তরঃ ধর্মের নাম নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনে বহু নিরর্থক সংস্কারের আধিপত্য ঘটলে শক্তিক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। এতে ধর্মের ভ্রষ্টতা এবং আচারের অত্যাচার-পরায়ণ অন্যায় রূপ প্রকাশ পায়। মিথ্যা ধর্মবিশ্বাসের অভিঘাতে সমাজ শত খণ্ডে ভেঙে পড়ে, ঈশ্বরের নামে মানুষ মানুষকে করে তোলে অশুচি ও অপাংক্তেয়। একারণেই দেখি আচারের বেড়া গেঁথে যে বহু সংখ্যক মানুষকে দূরে সরিয়েছি তাদের দুর্বলতা এবং মূঢ়তা, তাদের আত্মাবমাননা সমগ্র দেশের ওপর চেপে তাকে অকৃতার্থ করে রেখেছে সুদীর্ঘকাল। অথচ আমাদের যা বিশুদ্ধ ; যা আমাদের সনাতন আধ্যাত্মিক সম্পদ, তাদের মানুষের এবং সর্বজীবের মূল্য ভূরি পরিমাণ স্বীকার করেছে। ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু য পশ্যতি স পশ্যতি’—এত বড়ো কথা জানা সত্ত্বেও সকলের মধ্যে আত্মার সম্বন্ধ স্বীকার এবং সমগ্রের এই দৃষ্টিকে আমরা হারিয়ে ফেলি। তার ফলে জাতীয় সত্তা শতধা দ্বিখণ্ডিত হয়ে আমাদের দুরবস্থা হাজির হয়। রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে তাই বলেছিলেন, ‘ধর্মের বিকার ভয়াবহ’।
ধর্মের এই অন্ধতা, বাঁধা নিয়ম, শুচিতা ও কৃত্রিম গণ্ডিতে পড়ে মানুষের মন অসাড় হয়ে যায়। সে তখন নিত্যধর্ম অর্থাৎ সত্যকে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করে। কিন্তু যিনি জানেন মুক্তোর হদিশ, তার কাছে ঝিনুক যেমন আকর্ষণীয় নয়; তেমনই ধর্মের খোলসের ভেতর থেকে সারসত্যের সন্ধান যারা পেয়েছেন তারা ঠুনকো আচার-সংস্কার পরিত্যাগ করেন। নিজের বন্ধন মোচন করে অপরকে মুক্ত করার কর্তব্য তিনি করে যান। কু-সংস্কারের কাছে ধর্ম প্রাথমিকভাবে পরাজিত হয়। কারণ আগাছার মতো অন্ধ সংস্কারের একটা জোর আছে। আপনি বেড়ে ওঠে, তার জন্য চাষ-আবাদের দরকার হয় না, সহজে মরতেও চায় না। অথচ বিশুদ্ধ জ্ঞানের ও ধর্মের উৎকর্ষের জন্য নিরন্তর সাধনা চাই। মানুষের মনুষ্যত্ব সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্যে নয়, আচারের অনুষ্ঠানেও নয়, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ আছে এই সত্যেই সে সত্য। আর এই সত্য থেকে ধর্ম যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন সে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নেই।
(গ) পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ।
উত্তরঃ স্বার্থসর্বস্ব মানুষের স্থান এই পৃথিবীতে নেই। কারণ তারা নিজের স্বার্থের চিন্তায় বিভোর থেকে জগৎ সংসারের কথা ভুলে বসে। সেজন্য এইসব আত্মকেন্দ্রিক মানুষ সমাজের বোঝা, দেশ ও জাতির কলঙ্ক, বেঁচে থেকেও এরা মৃতবৎ।
অমৃতের পুত্র মানুষ—সমস্ত জগৎ সংসারের সে অঙ্গীভূত। বিশ্বের সবকিছুর সঙ্গে, সবার সঙ্গে যখন সে যুক্ত হয় তখনই তার আত্মোপলব্ধি ঘটে। কিন্তু এই বিশ্বচেতনা যখন লুপ্ত হয়, আত্মকেন্দ্রিকতার ক্ষুদ্র গণ্ডিতে যখন সে নিজেকে গুটিয়ে রাখে তখন সে একা। স্বার্থপর মানুষ বৃহৎ জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। মানুষের মহিমা, গরিমা সে তখন উপলব্ধি করতে অক্ষম। সকলের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলে শ্বাস-প্রশ্বাস চলে ঠিকই কিন্তু বেঁচে আছে বলা যায় না। স্বার্থবোধ মানুষকে পশুর স্তরে নিয়ে যায়—যেখানে শুধু পেটের খিদে মেটানোর জন্য যা কিছু করা চলে। কিন্তু মানুষ তো পশু নয়, তার শুধু পেটের খিটে মিটলেই চলে না, তার আছে হৃদয়ের খিদে। মন, জ্ঞান এবং আনন্দ উপলব্ধির জন্য স্রষ্টা তাকে যে হৃদয় দিয়েছেন তার খিদে মেটানোর জন্য তাকে অন্যের দ্বারস্থ হতেই হয়। বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় তার যত নিবিড় হয়, ততই তার হৃদয়ের খিদে মেটে, মানবসত্তা জেগে ওঠে, মানবতার উদ্বোধন ঘটে। স্বার্থের ক্ষুদ্র খোলে তখন তাকে ধরে না। সে মহাবিশ্বজীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। কবির ভাষায় সে ‘সংস্কার মুক্ত হয়ে বিশ্বজীবনপ্রবাহে আত্মসমর্পণ’ করে। বৃহৎ, মহৎ জীবনবোধ তার আত্মাকে প্রসারিত করে, ভূমার আনন্দলাভের অধিকারী হয়।
প্রশ্ন ৮। ব্যাকরণ।
(গ) ব্যাসবাক্যসহ সমাসের নাম লেখো।
যুগান্তর — যুগের অন্তর (ষষ্ঠী তৎপুরুষ)
মহাভার — মহান যে ভার (কর্মধারয় সমাস)
অসহায — ন সহায় (নঞ তৎপুরুষ)
(খ) বিপরীত শব্দ লেখো।
অধিকার — অনধিকার।
দুর্গ — সুগম।
পশ্চাৎ — অগ্র।
সন্দেহ — নিঃসন্দেহ।
অলক্ষ্যে — সম্মুখে।
(গ) নীচে প্রদত্ত শব্দগুলো বাক্যে ব্যবহার করো।
হুঁশিয়ার, হিম্মৎ, সান্ত্রী, অভিযান, সন্তরণ, মাতৃমুক্তি, হানাহানি, মহাভার, পুনর্বার, বলিদান, ত্রাণ, অলক্ষ্যে, বঞ্চিত।
হুঁশিয়ার — নদীর জল ফুলে উঠছে দেখে মাঝি যাত্রীদের হুঁশিয়ার করলেন।
হিম্মৎ — লড়াইয়ে নামার জন্য হিম্মৎ প্রয়োজন।
সান্ত্রী — তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান।
অভিযান — আরোহীরা পর্বত অভিযানে চলেছে।
সন্তরণ — সত্তরণ প্রতিযোগিতায় অনেকে অংশগ্রহণ করে।
মাতৃমুক্তি — বিপ্লবীরা মাতৃমুক্তি পণ করেছে।
হানাহানি — চতুর্দিকে হানাহানি বন্ধ করা প্রয়োজন।
মহাভার — শ্রমিকেরা মহাভার বহন করে দিনের পর দিন চলেছে।
পুনর্বার — সকলে মিলে পুনর্বার সহযোগিতা করেছে।
বলিদান — দেশের স্বার্থে দেশপ্রেমিকেরা আত্মবলিদান দিয়েছে।
ত্রাণ — বন্যায় দুর্গতদের ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।
অলক্ষ্যে — ঈশ্বর অলক্ষ্যে থেকে সব লক্ষ্য করেন।
বঞ্চিত — সর্বহারা মানুষ চিরকাল বঞ্চিতই থেকে যায়।