Class 12 History Chapter 12 বিদ্রোহ ও রাজ

Class 12 History Chapter 12 বিদ্রোহ ও রাজ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ) Question Answer in Bengali Medium | AHSEC Class 12 History Question Answer to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapters Assam Board Class Class 12 History Chapter 12 বিদ্রোহ ও রাজ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ) Notes and select needs one.

Class 12 History Chapter 12 বিদ্রোহ ও রাজ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ)

Join Telegram channel

Also, you can read the SCERT book online in these sections Class 12 History Chapter 12 বিদ্রোহ ও রাজ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ) Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 12 History Chapter 12 বিদ্রোহ ও রাজ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ) These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 12 History Chapter 12 বিদ্রোহ ও রাজ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ) Solutions for All Subjects, You can practice these here.

বিদ্রোহ ও রাজ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ)

তৃতীয় খণ্ড

Chapter: 12

HISTORY

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কখন আরম্ভ হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ২। কোন্ ঘটনাকে ভারতে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করা হয়?

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহকে।

প্রশ্ন ৩। সিপাহী বিদ্রোহ কখন সংঘটিত হয়?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ৪। ভারতের শেষ মোঘল সম্রাট কে ছিলেন?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।

প্রশ্ন ৫। ভারতে কখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষ হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ৬। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ কোথায় ঘটেছিল?

উত্তরঃ ব্যারাকপুরে।

প্রশ্ন ৭। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে ঝালীর রানি কে ছিলেন?

উত্তরঃ রানি লক্ষ্মীবাঈ।

প্রশ্ন ৮। সিপাহী বিদ্রোহে প্রথম শহীদ কে?

উত্তরঃ মঙ্গল পাণ্ডে।

প্রশ্ন ৯। সিপাহী বিদ্রোহকে কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে আখ্যায়িত করেন?

উত্তরঃ ভি ডি সাভারকার।

প্রশ্ন ১০। কানপুরে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ নানাসাহেব।

প্রশ্ন ১১। দিল্লিতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।

প্রশ্ন ১২। ঝাঙ্গীতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ রানি লক্ষ্মীবাঈ।

প্রশ্ন ১৩। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহীগণ কাকে হিন্দুস্থানের সম্রাট বলে ঘোষণা করেছিলেন?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।

প্রশ্ন ১৪। ভারতের শেষ মোগল সম্রাট কে ছিলেন?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।

প্রশ্ন ১৫। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ প্রথম কোথায় আরম্ভ হয়েছিল?

উত্তরঃ মীরাটে।

প্রশ্ন ১৬। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় ভারতের গভর্নর-জেনারেল কে ছিলেন?

উত্তরঃ লর্ড ক্যানিং।

প্রশ্ন ১৭। ভারতে কখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে?

উত্তরঃ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ১৮। মহারানির ঘোষণাপত্র কখন জারি করা হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ১৯। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতবর্ষের কোন দুইটি অঞ্চলকে বেশি প্রভাবান্বিত করেছিল?

উত্তরঃ উত্তরপ্রদেশ ও বিহার।

প্রশ্ন ২০। কে, কখন অযোধ্যাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন?

উত্তরঃ লর্ড ডালহৌসী ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

প্রশ্ন ২১। মৌলবী আহমেদ-উল্লা শাহ কে ছিলেন? ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে তাঁর অবদান কি ছিল?

উত্তরঃ মৌলবী আহমেদ-উল্লা দক্ষিণ ভারতের ১৮৫৭ সনের একমাত্র পথনির্দেশক ছিলেন।

তিনি দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং হাজার হাজার লোককে জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। সম্পদ শোষণ বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ ভারতবর্ষ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ শাসকগণ ভারতের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ইংল্যান্ডে চালান দিত। একেই সম্পদ শোষণ বলে।

প্রশ্ন ২। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অসন্তোষের দুটি প্রধান কারণ লেখ।

উত্তরঃ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অসন্তোষের প্রধান কারণ দুটি নিম্নরূপ:

(ক) ব্রিটিশ শাসকবর্গ ভারতবাসীকে নানা উপায়ে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে চেষ্টা করে।

(খ) সামাজিক ও ধর্মীয় নানা কারণেও ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয়।

প্রশ্ন ৩। ভারতে প্রারম্ভিক ব্রিটিশবিরোধী যে-কোন দুটি আন্দোলনের নাম লেখ।

উত্তরঃ ভারতে প্রারম্ভিক ব্রিটিশবিরোধী দুটি আন্দোলন নিম্নরূপ:

(ক) ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের বাংলা বিদ্রোহ।

(খ) ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দের উড়িষ্যা বিদ্রোহ।

প্রশ্ন ৪। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের দুটি কারণ লেখ।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের দুটি কারণ নিম্নরূপ:

(ক) ডালহৌসীর স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ।

(খ) এন্‌ফিল্ড রাইফেল-এর প্রবর্তন।

প্রশ্ন ৫। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের যে-কোন দুইজন নেতার নাম লেখ।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের দুইজন নেতার নাম- 

(ক) বাহাদুর শাহ। ও 

(খ) নানা সাহেব।

প্রশ্ন ৬। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার দুটি কারণ লেখ।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার দুটি কারণ নিম্নরূপঃ

(ক) বিদ্রোহীগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত এবং ঐক্যহীন ছিল।

(খ) বিদ্রোহীদের কোন নির্দিষ্ট কর্মপন্থা ছিল না।

প্রশ্ন ৭। সিপাহী বিদ্রোহের যে-কোন দুটি ফলাফল লেখ।

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহের দুটি ফলাফল নিম্নরূপ:

(ক) সিপাহী বিদ্রোহের ফলে ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে এবং সরাসরি ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

(খ) সাধারণ ভারতবাসী রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন ৮। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ নিম্নোক্ত স্থানগুলিতে কার কার নেতৃত্বে পরিকল্পিত হয়েছিল?

কানপুর, ঝালী, বিহার ও লক্ষ্ণৌ

উত্তরঃ কানপুর — নানা সাহেব।

ঝাঙ্গী — রানি লক্ষ্মীবাঈ।

বিহার — কোঁয়র সিং।

লক্ষ্ণৌ (অযোধ্যা) — ব্রিজিস কাদির।

প্রশ্ন ৯। কোন্ কোন্ শ্রেণীর লোক ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ প্রচার করেছিলেন?

উত্তরঃ নিম্নোক্ত শ্রেণীর লোক ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন:

(ক) সাধারণ পুরুষ ও মহিলা।

(খ) ধর্মীয় লোক।

(গ) স্বঘোষিত ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ।

(ঘ) স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

প্রশ্ন ১০। স্বত্ববিলোপ নীতি’ কে প্রবর্তন করেছিল? এই নীতিতে ব্রিটিশ রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা একটি দেশীয় রাজ্যের নাম লেখ।

উত্তরঃ লর্ড ডালহৌসী স্বত্ববিলোপ নীতি প্রবর্তন করেন। এই নীতির দ্বারা প্রথম সাতারা ব্রিটিশ রাজ্যভুক্ত করা হয়।

প্রশ্ন ১১। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে অসমে প্রধান নেতা কে ছিলেন? এই প্রধান নেতার সঙ্গে ফাঁসী দেওয়া অন্য বিদ্রোহী নেতার নাম উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে অসমের প্রধান নেতা ছিলেন মণিরাম দেওয়ান। পিয়ালী ফুকনকে তাঁর সঙ্গে ফাঁসী দেওয়া হয়।

প্রশ্ন ১২। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহীরা কাকে ‘হিন্দুস্থানের সম্রাট’ হিসাবে মনোনীত করেছিলেন? তিনি শেষ জীবন কোথায় অতিবাহিত করেছিলেন?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে।

শেষ জীবন তিনি রেঙ্গুনে অতিবাহিত করেন।

প্রশ্ন ১৩। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের যে-কোন দুটি সামাজিক কারণ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের দুটি সামাজিক কারণ নিম্নরূপ:

(ক) রক্ষণশীল ভারতীয় ব্রিটিশের সামাজিক সংস্কারে অসন্তুষ্ট ছিল।

(খ) পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে একশ্রেণীর ভারতবাসী; ইংরাজদের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন ছিল।

প্রশ্ন ১৪। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের দুটি রাজনৈতিক কারণ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের দুটি রাজনৈতিক কারণ নিম্নরূপ:

(ক) ব্রিটিশগণ দত্তক প্রথার স্বীকৃতি দেয় নি। তারা অযোধ্যা সাঁতারা, ঝালী প্রভৃতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কর।

(খ) ব্রিটিশ সরকার অধিকৃত অঞ্চলে তাদের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এর ফলে ভারতবাসীর মনে তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী অসন্তোষ দানা বাঁধে।

প্রশ্ন ১৫। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় দুইটি ধর্মীয় কারণ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের দুটি ধর্মীয় কারণ নিম্নরূপ:

(ক) ভারতবাসী উপলব্ধি করতে পারে যে ইংরেজগণ তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি ধ্বংস করছে।

(খ) ভারতবাসী খ্রিস্টান মিশনারীদের কার্যকলাপ পছন্দ করত না। সুতরাং তারা ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্তি চেয়েছিল।

প্রশ্ন ১৬। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের তৎকালীন কারণ কি ছিল?

উত্তরঃ সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘এনফিল্ড’ রাইফেল নামক একপ্রকার বন্দুকের প্রবর্তনই সিপাহী বিদ্রোহের তৎকালীন কারণ। সেনাবাহিনীর মধ্যে যখন গুজব রটল যে, হিন্দু ও মুসলমানদের জাতি নষ্ট করবার জন্য এই বন্দুকের টোটাতে গোরু ও শুকরের চর্বি মিশ্রিত করা হয়েছে, তখন অসন্তোষের বহ্নি প্রজ্বলিত হয়ে বিদ্রোহে পরিণত হল।

প্রশ্ন ১৭। দিল্লিতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কে পরিচালনা করেছিলেন? এই বিদ্রোহে দিল্লির উপর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণের প্রভাব কি ছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে দিল্লিতে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন।

বিদ্রোহী কর্তৃক দিল্লি নিয়ন্ত্রণের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র গাঙ্গেয় উপত্যকা ও পশ্চিম দিল্লির সেনা ছাউনিতে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে।

প্রশ্ন ১৮। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কখন ও কোথায় সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল ? বিদ্রোহ কে শুরু করেছিলেন।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ১০ই মে শুরু হয়েছিল। মীরাটের সেনা ছাউনিতে সিপাহীরা আরম্ভ করেছিলেন। বিদ্রোহীরা দেশীয় পদাতিক সেনা ছিল।

প্রশ্ন ১৯। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের বিদ্রোহ করার দুটি কারণ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের বিদ্রোহের দুটি কারণ নিম্নরূপঃ

(ক) উপনিবেশিক সরকার সাঁওতালদের জমির উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেন।

(খ) সাঁওতালগণ তাদের নিজের মতানুসারে একটি আদর্শ বিশ্ব তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

প্রশ্ন ২০। বশ্যতামূলক মিত্রতা নীতির দুটি শর্ত উল্লেখ কর।

উত্তরঃ বশ্যতামূলক মিত্রতা নীতির দুটি শর্ত নিম্নরূপ:

(ক) ইংরেজ সরকার দেশীয় রাজাদের আভ্যন্তরীণ ও বাহিরের বিপদ থেকে সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

(খ) মিত্র রাজাদের রাজ্যে একটি ইংরেজ সেনা ছাউনি রাখা হবে।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অসন্তোষের প্রধান কারণসমূহ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ সরকার শোষণ ও দমন নীতির মাধ্যমে শাসনকার্য পরিকল্পনা করতে থাকে। ফলে ভারতবাসীর মনে ক্রমশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। এর প্রধান প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) ইংরেজ শাসকবর্গ ভারতবাসীকে নানা উপায়ে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে চেষ্টা করে। তাঁরা ভারতবাসীকে রাজনৈতিক অধিকার হতে বঞ্চিত করে। ব্রিটিশ শাসকবর্গের কার্যকলাপ জনমনে দারুণ আশঙ্কা ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে।

(খ) সামাজিক ও ধর্মীয় নানা কারণেও ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল। বিভিন্ন প্রকার সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন প্রভৃতির ফলে জনসাধারণের ধারণা হয়েছিল যে ইংরেজগণ তাদের জাতি ও ধর্ম নষ্ট করবার জন্য ষড়যন্ত্র করছে।

(গ) ইংরেজ সরকারের নূতন অর্থব্যবস্থা বিশেষত কৃষিনীতি ও শিল্পনীতির ফলে পূর্বতন অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। ফলে ভারতবাসীব, আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পায়। দেশীয় রাজ্যগুলি ইংরেজরা অধিকার করায়, তাদের কর্মচারীগণ বেকার হয়ে পড়ে। এইভাবে ভারতবাসীর আর্থিক অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ে। এই সকল নানা কারণে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অসন্তোষ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

প্রশ্ন ২। ভারতে প্রারম্ভিক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ ইংরেজদের দমন ও শোষণমূলক নীতির ফলে ভারতবাসীর মনে সন্তোষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত বাংলাদেশে, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবাসীর অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ইংরেজদের শোষণমূলক রাজস্বনীতি, চিরাচরিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, দেশীয় বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, দেশীয় রীতি-নীতি বিরোধী কার্যকলাপ বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সৃষ্টি করেছিল। মেদিনীপুর হতে শুরু করে দক্ষিণ বিহার, ছোটনাগপুর, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চলে চৌয়াড়দের বিদ্রোহ পুনঃপুনঃ দেখা দিয়েছিল। মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল, সিংভূমের হোজ, ছোটনাগপুরের কোল ও মুণ্ডা, মানভূমের ভূমিজ, রাজমহলের সাঁওতাল বিদ্রোহ, আসামের খাসিয়া, গারো, নাগা ও উড়িষ্যার খোন্দ বিদ্রোহ ইংরেজ শাসকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যা ইংরেজদের অধীনে আসে। পরের বৎসর অর্থাৎ ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে খুরদার রাজা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে খুরদার ইংরেজ শাসন পুনঃস্থাপিত হয়। মাদ্রাজের অন্তর্গত খোন্দমহলে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহ দমন করে খোন্দমহল মাদ্রাজের অধীন হতে সরিয়ে নিয়ে কটকের অধীনে স্থাপন করে। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের পর হতে আসামের খাসিয়া, গারো, নাগা প্রভৃতি উপজাতি ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান বিশেষত বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

প্রশ্ন ৩। সিপাহী বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণগুলি কি ছিল?

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণগুলির মধ্যে লর্ড ডালহৌসির স্বত্ব বিলোপ নীতির প্রয়োগই হল অন্যতম। এই নীতির দ্বারা তিনি সাতারা, ঝাঙ্গী, নাগপুর, সম্বলপুর প্রভৃতি রাজ্যগুলি ইংরেজ অধিকারভুক্ত করেন, দিল্লিশ্বর বাহাদুর শাহকে বিতাড়নের পরিকল্পনা, নানা সাহেবের বৃত্তিলোপ, সিকিমের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং অযোধ্যার বেগমদের উপর অত্যাচার প্রভৃতি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অসন্তোষ বৃদ্ধি করছিল। দেশীয় রাজারা মনে করেছিলেন ইংরেজ সমস্ত ভারতবর্ষ গ্রাস করে ফেলবে। ইংরেজ রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মুসলমান ওমরাহরা যারা এতদিন রাজকার্য পরিচালনা করেছেন তাদের রাজকার্য পরিচালনার কোন অধিকার রইল না। বহু শত বৎসর আধিপত্য খাটানোর পর এইভাবে বঞ্চিত হওয়া মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

প্রশ্ন ৪। সিপাহী বিদ্রোহের সামরিক কারণ কি ছিল?

উত্তরঃ ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও ইংরেজ-বিদ্বেষ সংক্রামিত হয়েছিল। উত্তর ভারতে সৈন্যবাহিনী ব্রাহ্মণ, রাজপুত, উচ্চ জাতি নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংরেজ সরকার বহিঃভারতে ভারতীয় সৈন্যদের পাঠাতে চাইলে ব্রাহ্মণ, রাজপুত প্রভৃতি সৈন্যরা জাতি নাশের ভয়ে ক্ষুব্ধ হল। ইউরোপে যুদ্ধের জন্য ভারতে ইংরেজদের সৈন্য হ্রাস এবং আফগান যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজয় দেশীয় সৈন্যদের সাহস বৃদ্ধি করে। তদুপরি ‘এনফিল্ড’ নামক এক প্রকার রাইফেলের প্রবর্তন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ। এই বন্দুকে টোটা ভরবার সময় একাংশ দাঁত দিয়ে কেটে নিতে হত। গুজব রটল হিন্দু ও মুসলমানকে খ্রিস্টান করবার জন্য সকল টোটায় গোরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত রয়েছে তখন অসন্তোষের বহ্নি প্রজ্বলিত হয়ে সিপাহী বিদ্রোহে পরিণত হল।

প্রশ্ন ৫। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রসার বা বিস্তার সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের উত্তেজনার প্রথম প্রকাশ হয় ব্যারাকপুরে। শীঘ্রই তা মীরাট, লক্ষ্ণৌ, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যভারতের নানাস্থানের বিস্তৃত হয়। প্রত্যেক স্থানে বিদ্রোহীরা ইউরোপীয়গণকে হত্যা করতে লাগল। বিদ্রোহী দল মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে নানা সাহেব, তাঁতিয়া তোপী ও ঝান্সীর রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হলেন মঙ্গল পাণ্ডে। বিদ্রোহীদের প্রধান কেন্দ্র ছিল দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বেরিলী ও ঝালী।

প্রশ্ন ৬। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয় কেন?

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহকে প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ বললে ভুল হবে। তা প্রকৃতপক্ষে একটি গণ বিদ্রোহ বা ভারতের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম। বহু ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন যে প্রথমে এই বিদ্রোহ সিপাহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল।

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ পট্রভি সীতারামাইয়া সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। এই বিদ্রোহ দেশবাসীর মনে দেশপ্রেম জাগরিত করে। এই বিদ্রোহ যদিও ব্যর্থ হয় তথাপি ভবিষ্যৎ আন্দোলনের বীজ বপন করে। এই সময় হতেই ভারতবাসীর হৃদয়ে ইংরেজ শাসকগণকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ হল।

প্রশ্ন ৭। সিপাহী বিদ্রোহের বিফলতার কারণসমূহ উল্লেখ কর।

অথবা,

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিফলতার কারণ লেখ।

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার কারণসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) বিদ্রোহীরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত এবং ঐক্যহীন ছিল।

(খ) তারা ভারতের সকল অঞ্চলের এবং সকল শ্রেণীর সমর্থন লাভ করতে ব্যর্থ।

(গ) বিদ্রোহীদের কোন নির্দিষ্ট কর্মপন্থা ছিল না।

(ঘ) তাদের মধ্যে যোগ্য নেতার অভাব ছিল।

(ঙ) শিখ ও গোর্খাগণ প্রধানত ইংরেজের পক্ষে বিদ্রোহ দমন করেছিল।

(চ) বিদ্রোহীরা সমগ্র ভারতের প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে নি। এই সকল কারণে ইংরেজরা প্রথমে বিপর্যস্ত হলেও সংহতি ও সামরিক সম্ভারের বলে বিদ্রোহীদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।

প্রশ্ন ৮। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল কি ছিল?

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহের ফলাফল নিম্নরূপ:

(ক) কোম্পানির রাজত্ব শেষ হয় এবং ভারতের শাসনভার ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে ন্যস্ত হয়।

(খ) ভারতের গভর্নর জেনারেল, ভাইসরয় বা রাজপ্রতিনিধি উপাধি লাভ করেন।

(গ) ইংল্যান্ড রাজমন্ত্রীগণের মধ্য হতে একজন ভারত সচিব নিযুক্ত হন এবং তিনি পনেরো জন সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিষদের সাহায্যে ভারতের শাসনকার্য পরিচালনা করবেন বলে স্থির হয়।

(ঘ) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মহারানির ঘোষণাপত্রও সিপাহী বিদ্রোহের একটি ফল। তা ভারতের মহাসনদ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’ স্বরূপ।

(ঙ) দেশীয় নরপতিগণের সন্তোষের জন্য ‘স্বত্ব বিলোপ-নীতি’ বিলোপ করা হয়।

(চ) সাধারণ ভারতবাসী তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নব-যুগের সূচনা করে।

প্রশ্ন ৯। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ইংরেজ সমগ্র ভারতের উপর আধিপত্য স্থাপন করে। দেশীয় রাজাগণকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় অথবা তাদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীই দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সন্তুষ্ট ছিল না। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে হিন্দু ও মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধ হবার সুযোগ পায়। উভয় সম্প্রদায়ই সেই সময়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। তাঁকে ‘ভারত সম্রাট’ বলে ঘোষণা করা হয়। তিনি ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ উপাধি গ্রহণ করেন। তাতে ইংরেজরা স্থায়ী হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বিভেদের নীতি বা ‘Divide and Rule’ গ্রহণ করে।

প্রশ্ন ১০। সিপাহী বিদ্রোহের জন্য ডালহৌসী কতটুকু দায়ী ছিলেন?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের জন্য লর্ড ডালহৌসী যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী ছিলেন। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক মাত্রেই একথা স্বীকার করে থাকেন যে ডালহৌসী ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে তিনি কোন প্রকার নৈতিকতা বা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কথা বিবেচনা করতে প্রস্তুত ছিলেন না। স্বত্ব-বিলোপ নীতির উদ্ভাবন করেছিলেন ইংল্যান্ডস্থ কোম্পানীর ডাইরেক্টর সভা। কিন্তু ডালহৌসীর পূর্ববর্তী গভর্নরগণ এই নীতির প্রয়োগ করেন নি। ডালহৌসী এই নীতি প্রয়োগে প্রয়াসী হন। এই নীতির দ্বারা তিনি সাতরা, ঝালী, নাগপুর, সম্বলপুর প্রভৃতি রাজ্যগুলি ইংরেজদের অধিকারভুক্ত করেন। দিল্লির বাহাদুর শাহকে বিতাড়নের পরিকল্পনা, নানা সাহেবের বৃত্তিলোপ, সিকিমের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং অযোধ্যার বেগমের উপর অত্যাচার প্রভৃতি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অসন্তোষ বৃদ্ধি করছিল। এইভাবে ডালহৌসী ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করেছিল। লর্ড ডালহৌসী ভারতবর্ষ ত্যাগের পূর্বে বিদ্রোহ শুরু না হলেও তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির কঠোর প্রয়োগ এবং অপরাপর নানাবিধ কারণে বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সুতরাং এই বিদ্রোহের জন্য ডালহৌসী যে যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী ছিলেন, তা অনস্বীকার্য।

প্রশ্ন ১১। সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ:

(ক) নানা সাহেব।

(খ) ঝালীর রানি লক্ষ্মীবাঈ। 

(গ) কোত্তর সিং। 

(ঘ) তাঁতিয়া তোগী। 

(ঙ) মঙ্গল পাণ্ডে।

উত্তরঃ (ক) নানা সাহেব: নানা সাহেব ইংরেজদের বৃত্তিভোগী শেষ পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর পোষ্যপুত্র ছিলেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়ার মৃত্যু হলে তিনি ইংরেজদের নিকট বৃত্তি দাবি করেন। কিন্তু ইংরেজগণ এই বৃত্তি দিতে অস্বীকার করলে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম (সিপাহী বিদ্রোহ) শুরু হয়। কানপুরে তিনি সিপাহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কানপুরের ইংরেজগণকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সেনাপতি হ্যাভলক ও নীল কানপুর অধিকার করলে নানা সাহেব নিরুদ্দেশ হলেন। সম্ভবত তিনি নেপালে গমন করেছিলেন।

(খ) ঝালীর রানি লক্ষ্মীবাঈ: ঝালীর রানি লক্ষ্মীবাঈ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অপুত্রক অবস্থায় ঝাঙ্গীর রাজার মৃত্যু হলে ডালহৌসী ঐ রাজ্যটি ব্রিটিশ রাজ্যভুক্ত করেন। বিংশবর্ষীয়া রানির উপর অত্যাচার করে মৃত রাজার ঋণ আদায় করা হয়েছিল। তিনি রাজ্য উদ্ধার করবার জন্য সিপাহীদের উত্তেজিত করেছিলেন। তাঁতিয়া তোপীর সহযোগিতায় অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে তিনি এই বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন। পুরুষের বেশে উন্মুক্ত তরবারি হাতে এই বীরাঙ্গনা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেন।

(গ) কোওর সিং: কোঁত্তর সিং সিপাহী বিদ্রোহে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন রাজপুত দলপতি। তিনি বিহারের জগদীশপুরের তালুকদার ছিলেন। কোঁত্তর সিং সিপাহী বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলমানগণকে সমবেতভাবে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি নিজ অনুচরবর্গসহ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণও করেছিলেন।

(ঘ) তাঁতিয়া তোপী: তাঁতিয়া তোপী ছিলেন একজন মারাঠা ব্রাহ্মণ। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে তিনি নানা সাহেবের সঙ্গে কানপুরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গোয়ালিয়রের বিদ্রোহী সৈন্যের সাহায্যে ঝাঙ্গীর রানি লক্ষ্মীবাঈকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করে তিনি পরাভূত হলেন। কিন্তু রানি ও তাঁতিয়া তোপী হঠাৎ গোয়ালিয়র দুর্গ অধিকার করে নানা সাহেবকে পেশোয়া ঘোষণা করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে তাঁতিয়া তোপী পরাস্ত হয়ে ৮ হাজার অনুচরসহ রাজপুতানায় পলায়ন করেন। পর বৎসর তিনি ধৃত ও প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হলেন।

(ঙ) মঙ্গল পাণ্ডে: মঙ্গল পাণ্ডে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন। তিনি জাতিতে বাঙালি ব্রাহ্মণ ছিলেন। এনফিল্ড নামক বন্দুকে গোরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত টোটা ব্যবহারের ফলে তিনি অন্যান্য বিদ্রোহীদের মতো শঙ্কিত ছিলেন। সিপাহীদের উপর ইংরেজ পদস্থ কর্মচারীদের ব্যবহারে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। এনফিল্ড রাইফেল সম্পর্কিত বিভিন্ন বিতর্কিত আলোচনার ভিত্তি জানতে চাইলে জনৈক ইংরেজ সামরিক অফিসার তাঁকে অপমানিত করলে মঙ্গল পাণ্ডে গুলি চালান। ফলে বিদ্রোহ শুরু হয়। সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৯শে মার্চ মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসি হয়। তিনি ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ।

প্রশ্ন ১২। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতের সামরিক বাহিনীতে যে পরিবর্তন সাধন করা হয়, তা উল্লেখ কর।

অথবা,

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের পর ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে কি ধরনের পরিবর্তন করা হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী দায়ী ছিল। সুতরাং বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়। বিদ্রোহের পূর্বে ভারতে ব্রিটিশ রাজকীয় সেনা ও কোম্পানির সেনা—এই দুই প্রকার সেনাবাহিনী ছিল। কিন্তু বিদ্রোহের পর উভয় সেনাবাহিনীকে একত্রীকরণ করা হয়। এর ফলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে একতার ভাব পরিলক্ষিত হয়। ব্রিটিশ সেনার হার কম থাকায় ব্রিটিশ সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। মোট চল্লিশ হাজার ব্রিটিশ সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৬৫ হাজার করা হয়। অপর দিকে ভারতীয় সেনা সংখ্যা ২,১৫,০০০ হতে হ্রাস করে মোট ১,৪০,০০০ করা হয়। সামরিক বিভাগের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে ইউরোপীয়গণকে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তী ৫০ বৎসর সামরিক বিভাগে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয় নি।

প্রশ্ন ১৩। অধীনতামূলক মিত্রতা কে এবং কেন প্রবর্তন করেছিলেন?

অথবা,

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ লর্ড ওয়েলেসলি দেশীয় রাজ্যগুলিকে ইংরেজদের প্রভাবে আনার জন্য অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তন করেন। এই নীতি অনুসারে-

(ক) দেশীয় রাজাকে ইংরেজের বশ্যতা স্বীকার করে অপর রাজাগণের সঙ্গে সন্ধিবিগ্রহ করবার অধিকার ত্যাগ করতে হত ও একদল ইংরেজ সৈন্যের ব্যয়ভার বহন করতে হত। এবং 

(খ) এর বিনিময়ে ইংরেজগণ দেশীয় রাজাকে বহিঃশত্রুর ও গৃহপশুর আক্রমণ হতে রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করতেন।

এই নীতির ফলে দেশীয় রাজন্যবর্গ স্বাধীনতার বিনিময়ে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি পেলেন।

প্রশ্ন ১৪। স্বত্ব বিলোপ নীতি’ কে এবং কেন প্রবর্তন করেছিলেন?

অথবা,

স্বত্ব বিলোপ নীতি সম্পর্কে একটি টীকা লেখ।

উত্তরঃ লর্ড ডালহৌসী স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। ডালহৌসী ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন বিস্তারের জন্য তিনি এই নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। এই নীতির প্রধান শর্ত ছিল যে ইংরেজ অধীন বা ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত কোন দেশীয় রাজ্যের রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তার রাজ্য ইংরেজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। মৃত রাজার দত্তক বা পোষ্য পুত্রকে উত্তরাধিকারী বলে স্বীকার করা হবে না। এই নীতি প্রয়োগ করে ডালহৌসী সাঁতারা, ঝালী, নাগপুর, চৈৎপুর, সম্বলপুর প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ইংরেজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অসন্তোষের কারণসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ সুদীর্ঘ সময় ভারতে মুসলমান শাসনে ভারতবাসীর কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন হয় নি। মুসলমান অপশাসনে অতিষ্ঠ ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানায়। ভারতবাসী ভেবেছিল যে ব্রিটিশ শাসনে তাদের সার্বিক বিকাশ সম্ভব হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের সেই মোহ ভঙ্গ হয়। ভারতবাসীর মনে ক্রমশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। 

এর প্রধান কারণসমূহ নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:

(ক) রাজনৈতিক: ব্রিটিশ শাসকগণ ভারতবাসীকে নানা উপায়ে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করবার চেষ্টা করে। তারা ভারতবাসীকে রাজনৈতিক অধিকার হতে বঞ্চিত করে। ব্রিটিশ শাসকবর্গের কার্যকলাপ বিশেষত লর্ড ডালহৌসির স্বত্ব বিলোপ নীতির দ্বারা রাজ্য অধিকার এবং কতকগুলি উপাধি ও বৃত্তি লোপ করার ফলে ভারতীয় রাজন্যবর্গ এবং জনসাধারণের মনে দারুণ আশঙ্কা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। দিল্লির বাহাদুর শাহকে দিল্লির প্রাসাদ হতে বিতাড়নের পরিকল্পনা এবং পদচ্যুত দ্বিতীয় বাজীরাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্র নানা সাহেবকে পৈত্রিক বৃত্তি হতে বঞ্চনা প্রভৃতি কার্যাবলী ভারতের সর্বত্র ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ আনয়ন করল।

(খ) সামাজিক: সামাজিক ও ধর্মীয় নানা কারণেও ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল। সতীদাহ প্রথা নিবারণ, হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ বিধান প্রভৃতি সামাজিক সংস্কার এবং ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, রেলপথ, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির প্রবর্তন এবং বিদেশি খ্রিস্টানদের পারিবারিক সম্পত্তি লাভের অনুকুলে আইন প্রণয়ন প্রভৃতির ফলে জনসাধারণের ধারণা হয়েছিল যে ইংরেজগণ তাদের জাতি ও ধর্ম নষ্ট করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণা বাংলা, বিহার ও অযোধ্যায় বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল।

(গ) অর্থনৈতিক: ব্রিটিশ শাসনের প্রথমাবস্থাতেই ভারতের বিভিন্ন অংশে বিদেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জোর করে চাপানো হয়েছিল। এর ফলে পূর্বতন অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়লেও নূতন অর্থব্যবস্থা চালু হয় নি। এতে ভারতবাসীর আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পেল। বেন্টিঙ্কের আমলে নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত করায় অনেক লোক নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। দেশিয় রাজ্যগুলি ইংরেজরা অধিকার করায়, তাদের কর্মচারীগণ বেকার হয়ে পড়ল। এতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

উপরের আলোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নানা কারণে ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে এই অসন্তোষের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং পরবর্তীকালে তা স্বাধীনতা সংগ্রামের আকার ধারণ করে।

প্রশ্ন ২। ভারতে প্রারম্ভিক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

অথবা,

উনিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশবিরোধী উত্থানসমূহের একটি বিবরণ প্রদান কর।

উত্তরঃ ভারতবর্ষে ইংরেজদের রাজনৈতিক অধিকারের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশেই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সর্বপ্রথম শুরু হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলাদেশে ইংরেজগণ নবাব তৈরির ক্ষমতা অর্জন করে এবং নবাবের মসনদের পশ্চাতে প্রকৃত শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় তখন হতেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সূত্রপাত হয়।

বাংলা ও বিহারে বিদ্রোহ: ইংরেজদের শোষণমূলক রাজস্বনীতি, চিরাচরিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, দেশীয় বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, দেশীয় রীতিনীতি-বিরোধী কার্যকলাপ বাংলা এবং বিহারের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের জেলাসমূহে, বিহারের বিভিন্ন স্থানে, ছোটনাগপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। রংপুর ও দিনাজপুরে ইংরেজ কোম্পানি নিযুক্ত রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ দেখা দিলে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তা দমন করতে হয়। বিষ্ণুপুর ও বীরভূমের রাজাদের প্রতি ইংরেজদের দুর্ব্যবহার, দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়া সত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ের কঠোর ব্যবস্থা প্রভৃতির ফলে যে অব্যবস্থা দেখা দিয়েছিল সেই সুযোগে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে সেই অঞ্চলে ব্যাপক চুরি, ডাকাতি, খুন প্রভৃতি শুরু হলে সাময়িকভাবে ইংরেজ শাসন প্রায় উৎখাত হয়ে গিয়েছিল। এই সকল স্থানে ইংরেজ শাসন পুনঃস্থাপন করতে বহু সময় ও শক্তি ব্যয় করতে হয়েছিল।

আদিবাসীদের বিদ্রোহ: আদিবাসীদের মধ্যে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা সবসময়েই লেগেছিল। পশ্চিম মেদিনীপুর হতে শুরু করে দক্ষিণ বিহার, ছোটনাগপুর, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চলে চোয়াড়দের বিদ্রোহ পুনঃপুনঃ দেখা দিয়েছিল। মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল, সিংভূমের হোজ, ছোটনাগপুরের কোল ও মুণ্ডা, মানভূমের ভূমিজ, রাজমহলের সাঁওতাল বিদ্রোহ, আসামের খাসিয়া ও উড়িষ্যার খোন্দ বিদ্রোহ ইংরেজ শাসকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। মেদিনীপুর ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের অধীনে গিয়েছিল এবং জঙ্গলমহলে ইংরেজ শাসন কার্যকরী হতে দীর্ঘকাল সময় লেগেছিল। স্থানীয় ভূ-স্বামীরা ইংরেজ শাসন সহজে মেনে নেয় নি। ধলভূমের রাজা জগন্নাথ দলের নেতৃত্বে চোয়াড়গণ এবং কর্হল পাল, ডোলকা, বড়ভূম প্রভৃতি স্থানের রাজাগণ যুগ্মভাবে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। নবাবগঞ্জ এবং ঝরিয়ার জমিদারগণ ইংরেজদের রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর ধরে এই বিদ্রোহ চলেছিল এবং পরে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ: সহজ প্রকৃতির সাঁওতালরা ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছিল। হাজারিবাগ, মানভূম প্রভৃতি স্থান হতে সাঁওতালরা রাজমহল পাহাড়ি অঞ্চলে চলে এসে বসবাস শুরু করে। তাদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মহাজনরা তাদের শোষণ করতে থাকে। তাছাড়া সরকারি খাজনা আদায়কারী, রেল কর্মচারী প্রমুখ সকল ব্যক্তিবর্গই তাদের উপর নানা প্রকার জুলুম শুরু করে। সাঁওতালী স্ত্রীলোকদের মান সম্ভ্রম নষ্ট করতেও তারা ছাড়ে না। এই সকল কারণে তারা মহাজন, পুলিশ, সরকারি কর্মচারী প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। সাহেবদের হাত হতে জমি মুক্ত করতে না পারলে এই অসহনীয় অবস্থার অবসান ঘটবে না এই কথা তাদের জনৈক ধর্মগুরু প্রচার করলে, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আংশিকভাবে সফল হয়। সাঁওতাল পরগণা নামে একটি পৃথক অঞ্চল গঠন করে এক বিশেষ ধরনের প্রশাসন সেখানে চালু করতে ইংরেজরা বাধ্য হয়।

উড়িষ্যার বিদ্রোহ: ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যা ইংরেজদের অধীনে আসে। কিন্তু স্থানীয় রাজাদের অনেকেই ইংরেজ শাসন সহজ মনে গ্রহণ করে নি। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে খুরদার রাজা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, কিন্তু এই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করা হয়। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই ‘পাইক’-রা সরকারি রাজস্ব আদায়কারীদের এবং পুলিশকে আক্রমণ শুরু করে খাজাঞ্চিখানা জ্বালিয়ে দেয়। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে খুরদায় ইংরেজ শাসন পুনঃস্থাপিত হয়। পুরী তখনও ইংরেজদের অধিকার অমান্য করে চলেছিল। শেষ পর্যন্ত ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করা হয়।

খোন্দ বিদ্রোহ: খোন্দদের বাসস্থান খোন্দ মহল মাদ্রাজের (চেন্নাই) অধীনে ছিল। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে গুমসুব নামক স্থানের রাজা ধনঞ্জয় ভারি ও ইংরেজদের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে প্রথম ধনঞ্জয় ভারিকে ইংরেজরা গ্রেপ্তার করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে তার রাজ্য দখল করে নেয়। ধনঞ্জয় খোন্দ মহলের খোন্দ জাতির সাহায্য চাইলে ভোরা বিষরী নামে জনৈক নেতার অধীনে তারা ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ অবশ্য ইংরেজরা দমন করতে সমর্থ হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে পুনরায় বিদ্রোহ দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত তা দমন করে খোন্দ মহল মাদ্রাজের অধীন হতে সরিয়ে নিয়ে কটকের অধীনে স্থাপন করা হয়।

অহোম বিদ্রোহ: ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের কালে ইংরেজরা অহোম রাজ্যের মধ্য দিয়ে সৈন্য প্রেরণ করে। সেই সূত্রে অহোম রাজ্যের সঙ্গে স্থির হয় যে, ব্রহ্মযুদ্ধ অবসানে অহোম রাজ্যকে ইংরেজ নিরাপত্তাহীন স্থাপন করা হবে এবং অহোম রাজ্য অহোম রাজার অধীনেই থাকবে। কিন্তু ব্রহ্মযুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজরা অহোম রাজ্য হতে রাজস্ব আদায় এবং সেইখানে প্রশাসনিক কার্যকলাপ শুরু করে। অহোম রাজসভার সর্বপ্রকার ক্ষমতা খর্ব করা হয়। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে অসমীয়া বা অহোম রাজ পরিবারের গোমধর কোঁওরকে রাজা বলে ঘোষণা করে এক বিদ্রোহের সূচনা করে। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আবার দ্বিতীয় বিদ্রোহের পরিকল্পনা রচিত হয়। এতে খামতি, সিংপো, মণিপুরী, গারো, খাসিয়া সকল জাতির লোক যোগদান করে। কিন্তু বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা ইংরেজরা পূর্বেই জানতে পারে। ফলে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।

মুসলমান বিদ্রোহ: বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মুসলমান শাসকের নিকট হতে ইংরেজরা বাংলার শাসনভার হস্তগত করে নিলে এবং শাসন ব্যবস্থাকে ইংরেজ অধ্যুষিত করে তুললে বহু সম্ভ্রান্ত মুসলমান ও রাজকর্মচারী মর্যাদাহীন ও কর্মচ্যুত হলেন। অধিকন্তু ইংরেজদের মুসলমান কর্মবিরোধী জীবনযাত্রার ধরন সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে তাদের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করল। এইভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক দিক দিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ ক্রমেই বিদ্রোহের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।

প্রশ্ন ৩। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কারণ ব্যাখ্যা কর।

অথবা,

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা,

সিপাহী বিদ্রোহের বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করে এর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ লেখ।

অথবা,

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কি কারণে ভারতীয় সিপাহীরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল? সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা,

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ধর্মীয় বিশ্বাস কতদূর প্রভাবিত করেছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই সিপাহী বিদ্রোহ হল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।

কোন একটি যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিদ্রোহ বা বিপ্লবের মতো বিরাট ঘটনা একদিনে কোন একটিমাত্র কারণে ঘটে না। সেইরূপ সিপাহী বিদ্রোহের পশ্চাতে বহুদিনের পুঞ্জীভূত 

(ক) রাজনৈতিক। 

(খ) সামাজিক ও ধর্মসম্বন্ধীয়। 

(গ) অর্থনৈতিক। এবং 

(ঘ) সমর-বিভাগীয় শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অনেকগুলি কারণ নিহিত ছিল।

(ক) রাজনৈতিক কারণ: লর্ড ডালহৌসীর স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা রাজ্য অধিকার নীতি এবং কতকগুলি উপাধি ও বৃত্তি লোপ করার ফলে ভারতীয় রাজন্যবর্গ এবং জনসাধারণের মনে দারুণ আশঙ্কা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। দিল্লির বাহাদুর শাহকে দিল্লির প্রাসাদ হতে বিতাড়নের পরিকল্পনা এবং পদচ্যুত পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্র নানা সাহেবকে পৈতৃক বৃত্তি হতে বঞ্চনা প্রভৃতি কার্যাবলী ভারতের সর্বত্র অসন্তোষ আনয়ন করে। এই সকল কারণে নানা সাহেব, ঝালীর রানি, অযোধ্যার বেগম এবং অন্যান্য রাজ্যচ্যুত ব্যক্তিগণ ইংরেজের পরম শত্রুতে পরিণত হলেন। সিপাহীরা অনেকে এই সকল দেশীয় রাজ্যের অধিবাসী ছিল বলে এই বিক্ষোভ তাদের স্পর্শ করল।

(খ) সামাজিক ও ধর্মসম্বন্ধীয় কারণ: সতীদাহ নিবারণ, হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ বিধান প্রভৃতি সামাজিক সংস্কার এবং ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির প্রবর্তন এবং বিদেশি খ্রিস্টানদের পারিবারিক সম্পত্তি লাভের অনুকূলে আইন জারি প্রভৃতির ফলে জনসাধারণের ধারণা হয়েছিল যে ইংরেজগণ তাদের জাতি ও ধর্ম নষ্ট করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণা বাংলা, বিহার ও অযোধ্যায় বিশেষ প্রসার লাভ করল।

(গ) অর্থনৈতিক কারণ: ভারতের বিভিন্ন অংশে বিদেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জোর করে চাপানো হয়েছিল। এর ফলে পূর্বতন অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়লেও নতুন ব্যবস্থা চালু হয়নি। এতে জনসাধারণের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পেল। বেন্টিঙ্কের আমলে নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত করায় অনেক লোক নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। দেশীয় রাজ্যগুলি ইংরেজরা অধিকার করায়, তাদের কর্মচারীগণ বেকার হয়ে পড়ে। তাতে ইংরেজের বিরুদ্ধে তাদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(ঘ) সময় বিভাগীয় কারণ: সেনা বিভাগেও ইংরেজ বিদ্বেষ সংক্রামিত হয়েছিল। উত্তর ভারতে সৈন্যবাহিনী ব্রাহ্মণ, রাজপুত উচ্চ জাতি নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের ভারতের বাইরে ব্রহ্মদেশ অর্থাৎ মায়ানমার প্রভৃতি দেশে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। জাতি নাশের ভয়ে সিপাহীরা ক্ষুব্ধ হল। প্রথম আফগান যুদ্ধে ইংরেজের শোচনীয় পরাজয়, ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়াবাসীদের বীরত্বের কাহিনি শ্রবণ, ইউরোপীয় কর্মচারীদের সংখ্যা হ্রাস এবং সেনাদলে উচ্ছৃঙ্খলতার প্রসার ভারতীয় সিপাহীগণকে ব্রিটিশ শক্তি ধ্বংস করতে উৎসাহিত করেছিল।

সাক্ষাৎ কারণ: সৈন্যদলের মধ্যে ‘এন্‌ফিল্ড’ রাইফেল নামক একপ্রকার বন্দুকের প্রবর্তনই সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষাৎ কারণ। সৈন্যদলের মধ্যে যখন গুজব রটল যে, হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই জাতি নষ্ট করবার জন্য ঐ বন্দুকের টোটাতে গোরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা হয়েছে, তখন অসন্তোষের বহ্নি প্রজ্বলিত হয়ে সিপাহী বিদ্রোহে পরিণত হল। বিদ্রোহের প্রথম প্রকাশ হয় পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে। শীঘ্রই মিরাট, লক্ষ্ণৌ, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশে ও মধ্য ভারতের নানা স্থানে প্রসার লাভ করে। প্রত্যেক স্থানে বিদ্রোহীরা ইউরোপীয়গণকে হত্যা করতে লাগল। বিদ্রোহীদল মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপী ও ঝালীর রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ সরকার শীঘ্র বিদ্রোহ দমন করে। বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত এবং তাঁতিয়া টোপীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

বিদ্রোহের ফলাফল: সিপাহী বিদ্রোহের ফলাফল নিম্নরূপ:

(ক) কোম্পানির রাজত্বের শেষ হয় এবং শাসনভার ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে ন্যস্ত হয়।

(খ) ভারতের গভর্নর জেনারেল ‘ভাইসরয়’ বা রাজপ্রতিনিধি উপাধি লাভ করেন।

(গ) ইংল্যান্ডের রাজমন্ত্রীগণের মধ্য হতে একজন ভারতে সচিব নিযুক্ত হন এবং তিনি পনেরো জন সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিষদের সাহায্যে ভারতের শাসনকার্য পরিচালনা করবেন বলে স্থির হয়।

(ঘ) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মহারানির ঘোষণাপত্রও সিপাহী বিদ্রোহের একটি ফল। এটা ভারতের মহাসনদ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’ স্বরূপ।

(ঙ) বিদ্রোহের অভিজ্ঞতার ফলে ভারতে ইংরেজ সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় এবং তোপখানার ভার ইংরেজ সৈন্যের উপর ন্যস্ত হয়।

(চ) দেশিয় নরপতিগণের সন্তোষের জন্য ‘স্বত্ব বিলোপ নীতি’ বিলোপ করা হয়।

(ছ) এইভাবে সিপাহী বিদ্রোহ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নূতন যুগের সূচনা করে।

প্রশ্ন ৪। সিপাহী বিদ্রোহের বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কারণসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা কর। একে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যায় কি?

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহের কারণ: [১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই সিপাহী বিদ্রোহ হল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।

কোন একটি যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিদ্রোহ বা বিপ্লবের মতো বিরাট ঘটনা একদিনে কোন একটিমাত্র কারণে ঘটে না। সেইরূপ সিপাহী বিদ্রোহের পশ্চাতে বহুদিনের পুঞ্জীভূত-

(ক) রাজনৈতিক।

(খ) সামাজিক ও ধর্মসম্বন্ধীয়। 

(গ) অর্থনৈতিক। এবং 

(ঘ) সমর-বিভাগীয় শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অনেকগুলি কারণ নিহিত ছিল।

(ক) রাজনৈতিক কারণ: লর্ড ডালহৌসীর স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা রাজ্য অধিকার নীতি এবং কতকগুলি উপাধি ও বৃত্তি লোপ করার ফলে ভারতীয় রাজন্যবর্গ এবং জনসাধারণের মনে দারুণ আশঙ্কা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। দিল্লির বাহাদুর শাহকে দিল্লির প্রাসাদ হতে বিতাড়নের পরিকল্পনা এবং পদচ্যুত পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্র নানা সাহেবকে পৈতৃক বৃত্তি হতে বঞ্চনা প্রভৃতি কার্যাবলী ভারতের সর্বত্র অসন্তোষ আনয়ন করে। এই সকল কারণে নানা সাহেব, ঝালীর রানি, অযোধ্যার বেগম এবং অন্যান্য রাজ্যচ্যুত ব্যক্তিগণ ইংরেজের পরম শত্রুতে পরিণত হলেন। সিপাহীরা অনেকে এই সকল দেশীয় রাজ্যের অধিবাসী ছিল বলে এই বিক্ষোভ তাদের স্পর্শ করল।

(খ) সামাজিক ও ধর্মসম্বন্ধীয় কারণ: সতীদাহ নিবারণ, হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ বিধান প্রভৃতি সামাজিক সংস্কার এবং ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির প্রবর্তন এবং বিদেশি খ্রিস্টানদের পারিবারিক সম্পত্তি লাভের অনুকূলে আইন জারি প্রভৃতির ফলে জনসাধারণের ধারণা হয়েছিল যে ইংরেজগণ তাদের জাতি ও ধর্ম নষ্ট করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণা বাংলা, বিহার ও অযোধ্যায় বিশেষ প্রসার লাভ করল।

(গ) অর্থনৈতিক কারণ: ভারতের বিভিন্ন অংশে বিদেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জোর করে চাপানো হয়েছিল। এর ফলে পূর্বতন অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়লেও নতুন ব্যবস্থা চালু হয়নি। এতে জনসাধারণের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পেল। বেন্টিঙ্কের আমলে নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত করায় অনেক লোক নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। দেশীয় রাজ্যগুলি ইংরেজরা অধিকার করায়, তাদের কর্মচারীগণ বেকার হয়ে পড়ে। তাতে ইংরেজের বিরুদ্ধে তাদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(ঘ) সময় বিভাগীয় কারণ: সেনা বিভাগেও ইংরেজ বিদ্বেষ সংক্রামিত হয়েছিল। উত্তর ভারতে সৈন্যবাহিনী ব্রাহ্মণ, রাজপুত উচ্চ জাতি নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের ভারতের বাইরে ব্রহ্মদেশ অর্থাৎ মায়ানমার প্রভৃতি দেশে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। জাতি নাশের ভয়ে সিপাহীরা ক্ষুব্ধ হল। প্রথম আফগান যুদ্ধে ইংরেজের শোচনীয় পরাজয়, ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়াবাসীদের বীরত্বের কাহিনি শ্রবণ, ইউরোপীয় কর্মচারীদের সংখ্যা হ্রাস এবং সেনাদলে উচ্ছৃঙ্খলতার প্রসার ভারতীয় সিপাহীগণকে ব্রিটিশ শক্তি ধ্বংস করতে উৎসাহিত করেছিল।

সাক্ষাৎ কারণ: সৈন্যদলের মধ্যে ‘এন্‌ফিল্ড’ রাইফেল নামক একপ্রকার বন্দুকের প্রবর্তনই সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষাৎ কারণ। সৈন্যদলের মধ্যে যখন গুজব রটল যে, হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই জাতি নষ্ট করবার জন্য ঐ বন্দুকের টোটাতে গোরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা হয়েছে, তখন অসন্তোষের বহ্নি প্রজ্বলিত হয়ে সিপাহী বিদ্রোহে পরিণত হল। বিদ্রোহের প্রথম প্রকাশ হয় পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে। শীঘ্রই মিরাট, লক্ষ্ণৌ, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশে ও মধ্য ভারতের নানা স্থানে প্রসার লাভ করে। প্রত্যেক স্থানে বিদ্রোহীরা ইউরোপীয়গণকে হত্যা করতে লাগল। বিদ্রোহীদল মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপী ও ঝালীর রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ সরকার শীঘ্র বিদ্রোহ দমন করে। বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত এবং তাঁতিয়া টোপীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ: সিপাহী বিদ্রোহকে প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র সিপাহীদের বিদ্রোহ বললে ভুল হবে। এটা প্রকৃতপক্ষে একটি গণবিদ্রোহ বা ভারতের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম। বিদ্রোহের প্রকৃতি ও স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত পোষণ করেন। প্রখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন ও ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই বিদ্রোহকে সরাসরি প্রথম জাতীয় সংগ্রাম বলে স্বীকার করেন নি। অপরপক্ষে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নর্টন, ডাফ ও ফরেস্টার স্বীকার করেছেন যে কালক্রমে এই আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কারও কারও মতে এই বিদ্রোহ যেহেতু জনসাধারণের সহানুভূতি লাভ করতে পারে নি, এতে জাতীয় আদর্শগত ঐক্যের অভাব ছিল, কাজেই এটা সিপাহীদের বিদ্রোহ। কিন্তু বহু ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন যে প্রথমে এই বিদ্রোহে সিপাহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু যে যাই মন্তব্য করে থাকুক না কেন, ঐতিহাসিক কে. এন. মল্লিকের ভাষায়—“গণমানসে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা সংগ্রাম যে স্থান নিয়ে অধিকার করে আছে সে স্থান হতে তাকে বিচ্যুত করা কোন ঐতিহাসিকের পক্ষেই সম্ভব নয়।” বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ পটুভি সীতারামাইয়া বলেছেন—“সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারত ছাড়ো’ নির্দেশবাণী বললেও অযৌক্তিক হবে না, কারণ এই সময় হতেই ভারতবাসীর হৃদয়ে ইংরেজ শাসকগণকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ হয়।”

প্রশ্ন ৫। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ কিংবা ‘জাতীয় আন্দোলন’ এই প্রশ্ন সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী মত আছে। এই সকল বিভিন্ন মতকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা প্রয়োজন:

(ক) জে. বি. নর্টন, ডঃ ডাফ প্রমুখ ব্যক্তিদের মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ প্রথমত সিপাহী বিদ্রোহ হিসাবে শুরু হলেও পরে তা ব্যাপকতা এবং জাতীয় আন্দোলনের প্রকৃতি লাভ করেছিল। সমসাময়িক মার্কিন লেখকও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছিলেন।

(খ) পক্ষান্তরে, জন কে, স্যার সৈয়দ আহম্মদ, জনৈক বাঙালি সামরিক কর্মচারী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের মতে এটা সিপাহীদের বিদ্রোহ ভিন্ন কিছুই ছিল না। অসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা এতে যোগদান করেছিল তাদের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন ও যোগাযোগের সুযোগ গ্রহণ করা।

ডঃ মজুমদার ও ডঃ সেনের অভিমত: উপরোক্ত দুটি মতের প্রথমটির স্ফীত করে সাভারকর, ডঃ এস. বি. চৌধুরী প্রমুখ দেশপ্রেমিকগণ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত, বিদ্রোহের সময় হতে শুরু করে এযাবৎ কোন সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। অধুনা প্রকাশিত ডঃ মজুমদারের The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857 এবং ডঃ সেনের Eighteen Fifty Seven—এই দুইখানি গ্রন্থে নূতন গবেষণালব্ধ তথ্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করা হয়েছে। ডঃ মজুমদার ও ডঃ সেন মোটামুটি একই কথাই বলেছেন। ডঃ মজুমদার বলেছেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ জাতীয় আন্দোলন হিসাবে প্রথম শুরু হয় নি। প্রধানত তা একটি সিপাহী বিদ্রোহ বটে, কিন্তু কোন কোন অঞ্চলে সিপাহী বিদ্রোহই প্রসার লাভ করে জাতীয় আন্দোলনের রূপ লাভ করেছিল। ডঃ সেনও অনুরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বলেছেন যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সিপাহী বিদ্রোহ হিসাবে শুরু হলেও সকল স্থানে এই সিপাহীদের পিছনে জনসাধারণের সমর্থন ছিল। অবশ্য স্থানবিশেষে এই সমর্থনের মাত্রা অল্প বা অধিক ছিল।

অন্যান্য মতবাদ: এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ডঃ মজুমদার বা ডঃ সেনের যুক্তি সর্বক্ষেত্রেই অকাট্য এমন নয়। কেউ কেউ মনে করেন, যে তাঁদের সিদ্ধান্তই গতানুগতিক ও রক্ষণশীল মনোবৃত্তিপ্রসূত। নর্টন ও ডঃ ডাফের মন্তব্য—“বাহাদুর শাহকে বিদ্রোহীগণ কর্তৃক হিন্দুস্থানের সম্রাট বলে ঘোষণা, বাহাদুর শাহের ঘোষণায় দেশের হিন্দু-মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের লোককে ইংরেজ বিতাড়নে অগ্রসর হবার আহ্বান প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহের চরিত্রদান করে থাকেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সামরিক বলে বলীয়ান ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ভারতবাসীর পক্ষে কোন প্রকার আন্দোলন শুরু করবার কল্পনাও আসেনি। সেই সময়ে ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াই করতে সামরিক শক্তিরও প্রয়োজন—এই ছিল ধারণা। এটা ভিন্ন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে কোন প্রকার ঐক্য যে ছিল না, এমন নয়। তদুপরি ব্রিটিশ বিতাড়নই ছিল সেই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। বহুস্থানের কৃষকগণও বিদ্রোহে যোগদান করেছিল, এই প্রমাণও আছে। এমতাবস্থায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সামরিক বিদ্রোহ হিসাবে শুরু হওয়াই ছিল তদানীন্তন পরিস্থিতিতে একমাত্র যুক্তিসঙ্গত পন্থা। সুতরাং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ প্রথমে সামরিক বিদ্রোহ হিসাবে শুরু হয়েছিল। পরে কোন কোন স্থানে জাতীয় রূপ গ্রহণ করেছিল, এইরূপ সূক্ষ্ম পার্থক্যের ভিত্তিতে উপযুক্ত মর্যাদা না দেওয়ার যুক্তি নেই—এই কথা অনেকে মনে করে থাকেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে ভারতবাসীরা জাতীয়তাবোধকে আজকের মানদণ্ডে বিচার করলেও চলবে না। ব্যাপক ব্রিটিশ বিদ্বেষ প্রথমত সেনাবাহিনীর বিদ্রোহে প্রকাশ লাভ করলেও জাতীয় চরিত্র হবার কোন কারণ নেই।

উপসংহারঃ উপসংহারে এই কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। নূতন তথ্যাদি আবিষ্কৃত হলেই এই বিষয়ে যে মতানৈক্য রয়েছে এর অবসান ঘটবে।

প্রশ্ন ৬। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ধর্মীয় বিশ্বাস কতখানি প্রভাবিত করেছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে প্রভাবিত করার অনেক কারণের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত একটি অন্যতম কারণ। ইংরেজ অধিকার ক্রমবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা ও ভাবধারা ভারতবর্ষে বিস্তৃত হয়েছিল। সতীদাহ নিবারণ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, শিশুবলি নিবারণ, ধর্মান্তরিত হিন্দুর সম্পত্তিতে অধিকার আইন (১৮৫৬), খ্রিস্টান মিশনারীদের উগ্র ধর্মপ্রচার, ইংরেজি ভাষার প্রচলন ইত্যাদি সনাতনপন্থী হিন্দুর মনে ধারণা জন্মায় যে ইংরেজরা ভারতীয়দের ইউরোপের ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুগামী করার চেষ্টা করছে। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরাণের অনুশাসনে আস্থাবান মুসলমান ওয়াহাবীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা ইংরেজদের হাতে সধর্মচ্যুত হবার আশঙ্কার কথা মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে তাদের রাজশক্তির বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। তাছাড়া নতুন এনফিল্ড রাইফেলে ব্যবহৃত টোটায় পশুচর্বি ব্যবহৃত হয়। তা দাঁতে কেটে বন্দুকের নলে ভরতে হত এবং এই পশুচর্বি নাকি গোরু ও শূকরের। ফলে হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে জাত খোয়ানোর ভয়ে ভীত হল। ইংরেজরা এই ঘটনাকে অলীক বলে ঘোষণা করলেও তা সিপাহীদের নিকট বিশ্বাসযোগ্য হল না এবং অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হল। এই প্রকার নানা ঘটনা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করায় তা মহাবিদ্রোহকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল।

প্রশ্ন ৭। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিফলতার কারণসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা,

সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ঐক্যবদ্ধভাবে শুরু হলেও তা কার্যত ব্যর্থ হয়। সেনাপতি হ্যাভেলক, নিকলসন, আউট্রাম, লরেন্স প্রমুখ ইংরেজ কর্মচারীগণের সমবেত চেষ্টায় এবং লর্ড ক্যানিং-এর ধৈর্য ও বুদ্ধি কৌশলে শীঘ্রই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার বা বিফলতার প্রধান কারণসমূহ নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:

(ক) সংহতির অভাব: সিপাহী বিদ্রোহের বিফলতার বিভিন্ন কারণের মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিদ্রোহীদের কার্যপন্থা, সময় প্রভৃতির সম্পর্কে উপযুক্ত যোগাযোগ বা সংহতি ছিল না, ফলে একই সময়ে সকল স্থানে বিদ্রোহ যেমন শুরু হয়নি, তেমনি সর্বত্র একই নীতি বা কর্মপন্থা অনুসৃত হয়নি।

(খ) আদর্শ ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য: বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দের মধ্যে আদর্শ ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য ছিল। নানা সাহেব ও বাহাদুর শাহের মধ্যে স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। নানা সাহেব পেশোয়া হবার এবং মারাঠা প্রাধান্য পুনঃস্থাপনের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। বাহাদুর শাহ মোঘল প্রাধান্য পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন।

(গ) আঞ্চলিক সীমার সীমাবদ্ধতা: সিপাহী বিদ্রোহের প্রসার সমগ্র ভারতব্যাপী ঘটে নি। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্রোহ দেখা দেওয়ার ফলে তা আঞ্চলিক সীমার মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। দক্ষিণ ভারতে এই বিদ্রোহের বিস্তৃতি ঘটেনি।

(ঘ) সুযোগ্য নেতার অভাব: বিদ্রোহী নেতাগণের ব্যাপক বিদ্রোহ পরিচালনার মতো যোগ্যতা ও দক্ষতা ছিল না। ঝালীর রানি, নানাসাহেব, তাঁতিয়া তোপী, কোঁয়র সিং প্রমুখ নেতৃবর্গ নিজ নিজ এলাকায় সুযোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দান করলেও ব্যাপক বিদ্রোহের সামগ্রিক পরিচালনার ক্ষমতা তাঁদের কারও ছিল না। তদানীন্তন দেশীয় রাজাগণের মধ্যে কেউই এই বিদ্রোহে যোগদান করেননি।

(ঙ) ব্রিটিশ কূটকৌশল: সিপাহী বিদ্রোহের পরাজয়ের কারণগুলির মধ্যে ব্রিটিশ কূটকৌশলও উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভীতি প্রদর্শন করে এবং প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে তারা অনেককেই সপক্ষে টানতে সক্ষম হয়েছিল। শিখদের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কৌশল সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী হয়েছিল। মাত্র দশ বৎসর পূর্বে ব্রিটিশ সরকার পাঞ্জাব অধিকার করে শিখ শক্তির অবসান ঘটিয়েছিল, কিন্তু সেই শিখদের ব্রিটিশ-শক্তি এই বিদ্রোহ দমনের কাজে নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিল।

(চ) বিদ্রোহীদের সংগঠনের অভাব: বিদ্রোহকে সমগ্রভাবে পরিচালনার কোন সামগ্রিক পরিকল্পনা বা কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না। ফলে, বিদ্রোহীদের শক্তি ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছিল। কোন কোন স্থানে বিদ্রোহীদের মধ্যে সংগঠনের পরিচয় পাওয়া গেলেও বিদ্রোহকে জয়যুক্ত করতে হলে যে কেন্দ্রীয় পরিচালনা ও পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়, তা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে গড়ে ওঠেনি।

(ছ) বিদ্রোহীদের সামরিক ভুল: ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যাতে দিল্লি অবরুদ্ধ করতে পারে সেইজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না করে বিদ্রোহীগণ অত্যন্ত ভুল করেছিল। তা ভিন্ন, যখন দিল্লি ব্রিটিশ সৈন্য কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়েছিল তখন দিল্লির অভ্যন্তর হতে বাধাদানের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকেও অবরোধকারী ব্রিটিশ বাহিনীকে আক্রমণ করবার চেষ্টা না করে বিদ্রোহীগণ সামরিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল।

(জ) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দক্ষতা: ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সামরিক দক্ষতা, গোলাবারুদের প্রাচুর্য এবং সর্বোপরি একই সেনাপতির নির্দেশানুযায়ী যুদ্ধ করা প্রভৃতির মূলে সিপাহীদের সামরিক দক্ষতার অভাব, ন্যূনতম গোলাবারুদের অপ্রাচুর্য এবং সর্বোপরি বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত নেতৃত্ব তাদের দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা, সামরিক দূরদর্শিতা, উন্নত ধরনের গোলাবারুদ ও দক্ষ সেনাপতিও বিদ্রোহীদের পরাজয়ের কারণ ছিল।

উপরোক্ত কারণ এবং অন্যান্য নানা কারণে সিপাহী বিদ্রোহ কার্যত ব্যর্থ হয়ে যায়। ব্রিটিশরা শীঘ্রই বিদ্রোহ দমন এবং বিদ্রোহীদের অধিকৃত স্থানগুলি পুনরায় অধিকার করে। বিদ্রোহীদের নেতাদের কারারুদ্ধ করা হয়। বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত এবং তাঁতিয়া টোপীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

প্রশ্ন ৮। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে বেগম হজরত মহলের ভূমিকা বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা,

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যায় কি?

উত্তরঃ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ নানা কারণে সংঘটিত হয়েছিল। এই কারণসমূহের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ প্রধান। বিদ্রোহ সর্বপ্রথম বঙ্গদেশের ব্যারাকপুরে শুরু হয়েছিল। তারপর তা সমগ্র উত্তর ভারতে বিস্তার লাভ করে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ও নেতা ইংরেজের বিরুদ্ধে অভাব-অভিযোগের জন্য বিদ্রোহে যোগদান করে। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ নিজেকে হিন্দুস্থানের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। তিনি বিদ্রোহের নেতৃত্বে দেন।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহ অযোধ্যায় শিকড় দৃঢ় করে। লক্ষ্ণৌ ছিল নবাবের শাসনের রাজধানী। প্রয়াত নবাব ওয়াজিদ আলীর বিধবা পত্নী বেগম হজরত মহল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কাদিরকে অযোধ্যার নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করেন এবং নিজে শাসন-সংক্রান্ত সকল কার্য তদারকি করতেন। তিনি রাজনৈতিক বিষয় তদারকিতে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। লক্ষ্ণৌ হতে বিদ্রোহ অন্যান্য স্থানেও বিস্তার লাভ করে। তাঁর নেতৃত্ব এমন শক্তিশালী ছিল যে বিদ্রোহীরা তাঁর বাসস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করত। বেগম হজরত মহল ব্রিটিশ রেসিডেন্সী দখল করতে কৃতসংকল্প ছিলেন। এই ব্যাপারে ফৈজাবাদের মৌলভী আহমেদ উল্লাহ শাহ তাঁকে নানাভাবে সাহায্য ও সহায়তা করে। কিন্তু বেগম রেসিডেন্সীতে প্রবেশ করতে পারেন নি। ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষের প্রচেষ্টায় রেসিডেন্সী সুরক্ষিত থাকে। লক্ষ্ণৌ শহরের পতন হলেও বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে দমন করা যায় নি। বেগম হজরত মহল ও মৌলভী আহমেদ উল্লাহ শাহ অযোধ্যার নানা স্থানে বিদ্রোহী ক্রিয়াকলাপ অব্যাহত রাখেন। দুর্ভাগ্যবশত ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মৌলভীর মৃত্যু হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ মৌলভী সদাই বিদ্রোহের বীজ প্রচার করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশ বেগম হজরত মহলকে দেশ হতে বিতাড়িত করে। তিনি ভারত ত্যাগ করে নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং আর কখনও ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন নি। সুতরাং বেগম হজরত মহল নিঃসন্দেহে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ: ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ।

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ: সিপাহী বিদ্রোহকে প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র সিপাহীদের বিদ্রোহ বললে ভুল হবে। এটা প্রকৃতপক্ষে একটি গণবিদ্রোহ বা ভারতের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম। বিদ্রোহের প্রকৃতি ও স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত পোষণ করেন। প্রখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন ও ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই বিদ্রোহকে সরাসরি প্রথম জাতীয় সংগ্রাম বলে স্বীকার করেন নি। অপরপক্ষে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নর্টন, ডাফ ও ফরেস্টার স্বীকার করেছেন যে কালক্রমে এই আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কারও কারও মতে এই বিদ্রোহ যেহেতু জনসাধারণের সহানুভূতি লাভ করতে পারে নি, এতে জাতীয় আদর্শগত ঐক্যের অভাব ছিল, কাজেই এটা সিপাহীদের বিদ্রোহ। কিন্তু বহু ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন যে প্রথমে এই বিদ্রোহে সিপাহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু যে যাই মন্তব্য করে থাকুক না কেন, ঐতিহাসিক কে. এন. মল্লিকের ভাষায়—“গণমানসে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা সংগ্রাম যে স্থান নিয়ে অধিকার করে আছে সে স্থান হতে তাকে বিচ্যুত করা কোন ঐতিহাসিকের পক্ষেই সম্ভব নয়।” বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ পটুভি সীতারামাইয়া বলেছেন—“সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারত ছাড়ো’ নির্দেশবাণী বললেও অযৌক্তিক হবে না, কারণ এই সময় হতেই ভারতবাসীর হৃদয়ে ইংরেজ শাসকগণকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ হয়।”

প্রশ্ন ৯। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সম্প্রসারণ হওয়া অঞ্চলসমূহ দেখিয়ে ভারতবর্ষের একটি মানচিত্র অঙ্কন কর।

উত্তরঃ 

প্রশ্ন ১০। মুসলমানদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মুসলমান শাসকদের নিকট হতে ইংরেজরা বাংলার শাসনভার হস্তগত করে নিলে এবং শাসন ব্যবস্থাকে ইংরেজ অধ্যুষিত করে তুললে বহু সম্ভ্রান্ত মুসলমান ও রাজকর্মচারী মর্যাদাহীন ও কর্মচ্যুত হলেন। অধিকন্তু ইংরেজদের মুসলমান ধর্মবিরোধী জীবনযাত্রার ধরন সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে তাদের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক দিক দিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ ক্রমেই বিদ্রোহের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৭৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দে মজনু শাহ নামে জনৈক ফকির নেতার নেতৃত্বে বাংলার বিভিন্নাংশে মুসলমান ফকির বাবা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ শুরু করেন। ১৭৮৮-৯০ খ্রিস্টাব্দে ফকির বাবার দল উত্তরবঙ্গের সর্বত্র তাদের কার্যকলাপ বিস্তার করে। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তারা ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ চালাতে থাকে। ফকির বিদ্রোহের অনুরূপ ‘পাগলপন্থী’ নামে মুসলমানদের এক সম্প্রদায় কর্তৃক শুরু হয়েছিল। 

এই সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন টিপু। কিছুকালের জন্য তিনি জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগ করে এক সম্পূর্ণ স্বাধীন শাসন চালু করেন। কিন্তু ক্রমে তাঁর কর্মকেন্দ্রগুলি সরকার দখল করে নেয়। ব্রিটিশবিরোধী অপর একটি আন্দোলন ফরিদপুরের হাজী শরীয়ৎ উল্লার নেতৃত্বে শুরু হয়। শরীয়ৎ উল্লা ইসলাম ধর্মের মৌলিক সংস্কার সাধনের পক্ষপাতী ছিলেন। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি বাংলাদেশে পুনরায় মুসলমান শাসন ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৩৮ হতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বিদ্রোহাত্মক আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শক্তি নিয়ে চলেছিল। ওয়াহাবী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের পবিত্রকরণ ও পুনরুজ্জীবন। কিন্তু এই আন্দোলন মুসলমান শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পূরণ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশবিরোধী হয়ে উঠেছিল। এই কারণে পরবর্তীকালে ওয়াহাবী আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত হয়। এই সকল বিদ্রোহ ব্যতীত মুসলমানগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে লিপ্ত হয়।

প্রশ্ন ১১। সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে ‘দুইজন ভারতীয় নেতার ভূমিকা বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহে বাহাদুর শাহ, নানা সাহেব, রানি লক্ষ্মীবাঈ, কোত্তর সিং, মণিরাম দেওয়ান প্রমুখ নেতাগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। 

নিম্নে দুই জন ভারতীয় নেতার ভূমিকা আলোচনা করা হল:

(ক) বাহাদুর শাহ: সিপাহী বিদ্রোহের সময় শেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ দিল্লিতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দান করেন। তিনি নিজেকে ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারত সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেন এবং ব্রিটিশ বিতাড়নের জন্য বদ্ধপরিকর হন। তাকে কেবলমাত্র তার অফিসারবৃন্দ এবং উত্তর ভারতের কতিপয় জনতা সাহায্য করেন। ইতিমধ্যে বিদ্রোহ মজাফ্ফরনগর, ঝালী, লক্ষ্ণৌ, অযোধ্যা, কানপুর প্রভৃতি স্থানে বিস্তৃত হয়। ঝালীর রানি লক্ষ্মীবাঈ কতিপয় ব্রিটিশ সেনা দমনে সফল হন। বার্ধক্যের জন্য বাহাদুর শাহ এই সময় উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করেন। গোর্খা সৈন্যের সহায়তায় ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে বাহাদুর শাহ পরাজিত হন। তাঁকে রেঙ্গুনের কারাগারে প্রেরণ করা হয়, সেখানে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

(খ) মণিরাম দেওয়ান: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের সময় আসামে বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন পূর্বতন রাজা দিনেশ বরবরুয়া, মণিরাম দেওয়ান। তিনি প্রথমে তহশীলদার এবং পরে সেরেস্তাদার হয়েছিলেন। তিনি এই কাজে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। অহোম অভিজাতদের মধ্যে যখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষের আগুন বিস্তার লাভ করছিল তখন মণিরাম তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের বিস্তার লক্ষ্য করে মণিরাম উৎসাহিত হন। তিনি তার বাঙালি বন্ধু মধু মল্লিকের সহায়তায় কন্দর্পেশ্বর সিংহের সঙ্গে সহযোগ রক্ষা করেন এবং তাঁকে স্থানীয় সিপাহীদের সাহায্যে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হতে উৎসাহিত করেন। কন্দর্পেশ্বর সিংহ যোড়হাট ও চার ম্যান গোলাঘাটের সিপাহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু কন্দর্পেশ্বর সিংহ ও মণিরাম বিদ্রোহের প্রচেষ্টা বেশিদূর অগ্রসর হবার পূর্বেই ধরা পড়েন। ধৃত হওয়ার পর কন্দর্পেশ্বর সিংহকে বর্ধমানে অন্তরীণ করা হয় এবং মণিরাম দেওয়ানকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি যোড়হাটে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়।

পাঠ্যপুস্তকের প্রশ্নাবলীর উত্তরঃ

প্রশ্ন ১। বিদ্রোহী সিপাহীগণ কেন বহুস্থানে বিদ্রোহের নেতৃত্বের জন্য ভূতপূর্ব শাসকগণকে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিল?

উত্তরঃ ব্রিটিশ শক্তির মোকাবিলার জন্য বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব ও সংগঠনের প্রয়োজন ছিল। 

সুতরাং তারা ব্রিটিশ আগমনের পূর্বে নিম্নোক্ত কারণে নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব কামনা করেছিলেন:

(ক) প্রথমত তারা শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের আশীর্বাদ কামনা করেছিলেন। তারা তাঁকে বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণের আবেদন জানান। প্রথমাবস্থায় বাহাদুর শাহ নেতৃত্ব গ্রহণে ইতস্তত করলেও পরে বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণে সম্মত হন। তা সিপাহীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।

(খ) কানপুরে দ্বিতীয় পেশোয়া বাজীরাওয়ের উত্তরাধিকার নানা সাহেবকে বিদ্রোহের নেতৃত্বে অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন।

(গ) ঝালীর রানি লক্ষ্মীবাঈকেও বিদ্রোহীগণ বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। লক্ষ্মীবাঈ বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে অসীম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে বৃটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।

(ঘ) বিদ্রোহীগণ তদ্রূপ বিহারের আরার জমিদার কোঁয়র সিং-এর সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিদ্রোহীরা কোঁয়র সিংকে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করেন। কোঁয়র সিং তাতে সম্মত হন।

(ঙ) অযোধ্যার লোকও নবাব ওয়াজিদ আলীর অপসারণে খুশি ছিলেন না। সুতরাং যখন তারা ব্রিটিশ শাসন অবসানের খবর পান তখন তার ব্রিটিশ কাদিরকে তাদের নেতারূপে ঘোষণা করে।

প্রশ্ন ২। বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ইঙ্গিত বহন করা তথ্য প্রমাণসমূহ বিষয়ে আলোচনা কর।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্থ। এর প্রমাণসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) সিপাহী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় ছিল। উভয়ই শ্বেত সেনাদের আঘাত করতে চেয়েছিল।

(খ) বিদ্রোহীদের সুযোগ্য নেতা বাহাদুর শাহের সুনেতৃত্বের জন্য বিদ্রোহের গতি ত্বরান্বিত হয়েছিল।

(গ) হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই একতাবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।

(ঘ) বিভিন্ন সেনা ছাউনির মধ্যে সংযোগ স্থাপিত ছিল।

(ঙ) সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ততারও প্রমাণ পাওয়া যায় অযোধ্যা বিদ্রোহের প্রকৃতিতে। অযোধ্যার বিদ্রোহীগণ সেনাবাহিনীর সেনাধ্যক্ষকে ভারতীয়দের দ্বারা সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রদান করেছিল।

প্রশ্ন ৩। ধর্মীয় বিশ্বাস ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাবলী কতটুকু গড়েছিল আলোচনা কর।

উত্তরঃ ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে সতীদাহ প্রথা নিবারণ, হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ বিধান প্রভৃতি সামাজিক সংস্কার এবং ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির প্রবর্তন এবং বিদেশি খ্রিস্টানদের পারিবারিক সম্পত্তি লাভের আইন প্রণয়ন প্রভৃতির ফলে জনসাধারণের ধারণা হয়েছিল যে, ইংরেজগণ তাদের জাতি ও ধর্ম নষ্ট করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণা বাংলা, বিহার ও অযোধ্যায় বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল।

প্রশ্ন ৪। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্রিটিশগণ কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল?

উত্তরঃ সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার নানা প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। সেনাপতি হ্যাভেলক, নিকলসন, আউট্রাম, লরেন্স প্রভৃতি ইংরেজ কর্মচারীগণের সমবেত চেষ্টায় এবং লর্ড ক্যানিং-এর ধৈর্য্য ও বুদ্ধি কৌশল শীঘ্রই বিদ্রোহ দমন এবং বিদ্রোহীদের অধিকৃত স্থানগুলি পুনরায় অধিকার করা হয়। বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত এবং তাঁতিয়া তোপীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

প্রশ্ন ৫। বিদ্রোহীদের মধ্যে একতা নিশ্চিত করার জন্য কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল?

উত্তরঃ বিদ্রোহীদের মধ্যে একতা নিশ্চিত করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হয়েছিল:

(ক) প্রত্যেক বিষয়ে প্রতিটি ঘোষণায় বিদ্রোহীগণ সমাজের সকল শ্রেণীর প্রতি আবেদন জানায়। এই ব্যাপারে তারা জাত ও সম্প্রদায় বিবেচনা করেনি।

(খ) বহুসংখ্যক ঘোষণা মুসলমান রাজাদের দ্বারা ঘোষিত হয়েছিল। কিছু সংখ্যক ঘোষণা অবশ্য তাদের নামে করা হয়েছিল। কিন্তু এই সকল ঘোষণায় হিন্দু জানা মানসিকতাকে বিবেচনা করা হয়েছিল।

(গ) বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের সমান সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

(ঘ) অনেকগুলি প্রচারপত্র বিলি করা হয় যেগুলিতে মোগল শাসনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহাবস্থানের উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণ ঐক্য ও সংহতি ছিল।

প্রশ্ন ৬। অযোধ্যাতেই বিশেষত বিদ্রোহ কেন সর্বাত্মক রূপ লাভ করেছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ উত্তরপ্রদেশে বিশেষত অযোধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমান লক্ষ্ণৌর পার্শ্ববর্তী অযোধ্যা রাজ্য নিজ হাতে নিতে ব্রিটিশগণ বহুদিন হতে চিন্তা করছিল। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যাকে ‘অধীনতামূলক মৈত্রী’ ব্যবস্থার মধ্যে আনয়ন করা হয়। নিজ সৈন্যবাহিনীর স্থানে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী থাকায় নবাবের স্বাধীনতা হ্রাস পায়। ব্রিটিশগণ উপলব্ধি করতে পারবে যে নবাব ওয়াজিদ আলী খাঁ জনপ্রিয় নেতা নন। কিন্তু বাস্তবে তিনি সর্বজনবিদিত নেতা ছিলেন নবাব যখন অযোধ্যা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তখন এক বিশালসংখ্যক জনগণ অনশন করতে থাকে। তারা তাঁকে কানপুর পর্যন্ত অনুসরণ করে।

নবাব ক্ষমতাচ্যূত হলে দরবার ও তার সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটে। এই ভাবাবেগ- পূর্ণ ঘটনার বহিঃপ্রকাশ তাৎক্ষণিক বাহ্যিক ক্ষতির দ্বারা ঘটে। এর ফলে বহুসংখ্যক গায়ক, নর্তকী, কবি, শিল্পী, প্রশাসনিক বিষয়াদের চাকুরির অবসান ঘটে। বহুসংখ্যক লোক তাদের জীবিকা অর্জনের উপায় হারায়, কারণ তাদের পৃষ্ঠপোষক সম্রাট সিংহাসনচ্যূত হন। কৃষক, তালুকদার, জমিদার সর্বশ্রেণীর মানুষ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top