Class 12 History Chapter 10 রাজা ও কালক্রমণিকা

Class 12 History Chapter 10 রাজা ও কালক্রমণিকা Question Answer in Bengali Medium | AHSEC Class 12 History Question Answer to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapters Assam Board Class Class 12 History Chapter 10 রাজা ও কালক্রমণিকা Notes and select needs one.

Class 12 History Chapter 10 রাজা ও কালক্রমণিকা

Join Telegram channel

Also, you can read the SCERT book online in these sections Class 12 History Chapter 10 রাজা ও কালক্রমণিকা Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 12 History Chapter 10 রাজা ও কালক্রমণিকা These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 12 History Chapter 10 রাজা ও কালক্রমণিকা Solutions for All Subjects, You can practice these here.

রাজা ও কালক্রমণিকা

দ্বিতীয় খণ্ড

Chapter: 10

HISTORY

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। মোগল শব্দটি কোন্ শব্দ হতে উদ্ভূত হয়েছে?

উত্তরঃ ‘মংগোল’ শব্দ হতে।

প্রশ্ন ২। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

উত্তরঃ বাবর।

প্রশ্ন ৩। ‘জাংগল বুক’-এর লেখক কে?

উত্তরঃ রুডয়ার্ড কিপলিং।

প্রশ্ন ৪। আবুল ফজল কে ছিলেন?

উত্তরঃ আকবরের মন্ত্রী ও সাহিত্যিক ছিলেন।

প্রশ্ন ৫। কোন্ যুদ্ধের পর ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত সুদৃঢ় হয়?

উত্তরঃ পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ।

প্রশ্ন ৬। আকবরের সময় মেবারের রাণা কে ছিলেন?

উত্তরঃ প্রতাপ সিংহ।

প্রশ্ন ৭। কোন্ মোগল সম্রাট ইংরেজদের ভারতে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ জাহাঙ্গির।

প্রশ্ন ৮। আকবরের রাজস্বমন্ত্রী কে ছিলেন?

উত্তরঃ টোডরমল।

প্রশ্ন ৯। ঔরঙ্গজেবের উৎখাত করা দাক্ষিণাত্যের দুটি রাজ্যের নাম লেখ।

উত্তরঃ বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা।

প্রশ্ন ১০। আকবর কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

উত্তরঃ সিন্ধুর অমরকোটে।

প্রশ্ন ১১। আকবর কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?

উত্তরঃ ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ১২। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ কখন ঘটে?

উত্তরঃ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ১৩। হলদিঘাটের যুদ্ধ কখন ঘটে?

উত্তরঃ ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ১৪। হলদিঘাটের যুদ্ধ কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়?

উত্তরঃ মোগল ও রাণা প্রতাপের মধ্যে।

প্রশ্ন ১৫। জাহাঙ্গিরের প্রকৃত নাম কি?

উত্তরঃ সেলিম।

প্রশ্ন ১৬। ইংরেজ প্রতিনিধি হকিন্স ও স্যার টমাস রো কোন্ মোগল সম্রাটের রাজত্বকালে ভারতে আসেন?

উত্তরঃ জাহাঙ্গিরের।

প্রশ্ন ১৭। কোন্ মোগল সম্রাট ইংরেজদের সুরাটে বাণিজ্যের অনুমতি দেন?

উত্তরঃ জাহাঙ্গির।

প্রশ্ন ১৮। ‘মোগল চিত্র-শিল্প’ নামক চিত্রাঙ্কন রীতি কে প্রবর্তন করেন?

উত্তরঃ জাহাঙ্গির।

প্রশ্ন ১৯। দিল্লির লালকেল্লা কে নির্মাণ করেন?

উত্তরঃ শাহজাহান।

প্রশ্ন ২০। জামা মসজিদ কে নির্মাণ করেন?

উত্তরঃ শাহজাহান।

প্রশ্ন ২১। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু কখন হয়?

উত্তরঃ ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে।

প্রশ্ন ২২। টোডরমল কে ছিলেন?

উত্তরঃ আকবরের রাজস্বমন্ত্রী।

প্রশ্ন ২৩। আকবর তাঁর সাম্রাজ্যকে কি নামে বিভক্ত করেন?

উত্তরঃ সুবায়।

প্রশ্ন ২৪। আকবরের সময় কে কর সংগ্রহ করত?

উত্তরঃ দিওয়ান।

প্রশ্ন ২৫। ‘মনসবদারি’ প্রথার প্রবর্তন কে করেন?

উত্তরঃ আকবর।

প্রশ্ন ২৬। শুদ্ধ উত্তরটি খুঁজে বের কর:

(ক) আকবরের সময়ে উপনিষদ/মহাভারত/রামচরিত মানস সংস্কৃত থেকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।

উত্তরঃ মহাভারত।

(খ) সম্রাট আকবরের রাজসভায় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ছিলেন হরিদাস/তানসেন।

উত্তরঃ তানসেন।

(গ) ফতেপুর সিক্রি/মোতি মসজিদ/শালিমার বাগ শাহজাহানের সময় নির্মিত।

উত্তরঃ মোতি মসজিদ।

প্রশ্ন ২৭। মোগল রাজত্বকালে লেখকদের নাম ও তাঁদের গ্রন্থরাজির বিষয়ে উল্লেখ কর।

উত্তরঃ 

গ্রন্থের নামলেখকের নাম
তুজুক-ই-বাবরিবাবর
তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরিজাহাঙ্গির
আকবরনামাআবুল ফজল
আইন-ই-আকবরিআবুল ফজল
হুমায়ুননামাগুলবদন বেগম
রামচরিত মানসতুলসীদাস

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

১। যোগল কাদের বলা হত?

উত্তরঃ মোগল নামটি ‘মঙ্গল’ শব্দ হতে উদ্ভূত হয়েছে। যদিও এই নামটি এখন ব্যবহার করা হয়, শাসকীয় রাজবংশ নিজে এই নামটি মনোনীত করেনি। মঙ্গোলগণ তাদের আদি বাসস্থান হতে মধ্য এশিয়ার পশ্চিমাংশে গিয়ে সেই স্থানের মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এই অঞ্চলের লোক তাদের ‘মোগল’ বলেছিল।

প্রশ্ন ২। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন? তাঁকে কেন ভারতে জোর করে পাঠানো হয়?

উত্তরঃ বাবর ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ভারতে নূতন ভূখণ্ড ও সম্পদের সন্ধানে তাঁকে জোর করে পাঠানো হয়েছিল।

প্রশ্ন ৩। হুমায়ুন কে ছিলেন? তাঁকে কেন ভারত হতে বহিষ্কার করা হয়েছিল?

উত্তরঃ হুমায়ুন বাবরের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি আফগান নেতা শেরশাহের কাছে পরাজিত হয়ে ভারত হতে পলায়ন করেন।

প্রশ্ন ৪। তিনজন মোগল শাসকের নাম লেখ।

উত্তরঃ তিনজন মোগল শাসক হলেন — 

(ক) বাবর। 

(খ) হুমায়ুন। ও 

(গ) আকবর।

প্রশ্ন ৫। কাকে ‘গ্রেট মোগল’ বলা হয়? তিনি কখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন?

উত্তরঃ আকবরকে ‘গ্রেট মোগল’ বলা হয়। তিনি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

প্রশ্ন ৬। মোগল ইতিহাসের রচয়িতা কারা ছিলেন? তাঁরা কোন্ চারটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ মোগল দরবারের ইতিহাসবিদগণ মোগল ইতিহাস রচনা করেন। তাঁরা নিম্নোক্ত চারটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন:

(ক) শাসকের সঙ্গে জড়িত ঘটনাবলী।

(খ) রাজপরিবার।

(গ) রাজদরবার।

(ঘ) যুদ্ধ ও প্রাদেশিক শাসন।

প্রশ্ন ৭। মোগল শাসনকালে পারসিতে অনুদিত হওয়া দুটি সংস্কৃত সাহিত্যের নাম লেখ।

উত্তরঃ মোগল শাসনকালে পারসিতে অনুদিত হওয়া দুটি সংস্কৃত সাহিত্য হল — রামায়ণ ও মহাভারত।

প্রশ্ন ৮। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা কে? এই প্রতিষ্ঠানটি কখন স্থাপিত হয়েছিল?

উত্তরঃ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছিল।

প্রশ্ন ৯। সু-ই-কুল ধারণাটি কি ছিল?

উত্তরঃ সু-ই-কুল-এর অর্থ হল চূড়ান্ত শাস্তি। আবুল ফজল-এর উল্লেখ করেছেন। এটা সুশাসনের ভিত্তি। এর মূল কথা নিম্নরূপ:

(ক) কেউ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অবজ্ঞা করতে পারে না।

(খ) অন্তঃকলহ থেকে বিরত থাকা।

প্রশ্ন ১০। জিজিয়া কি ছিল এবং কে এটা বিলোপ করেন? কে এটা পুনঃপ্রবর্তন করেন?

উত্তরঃ জিজিয়া একপ্রকার কর যা অ-মুসলমানদের উপর ধার্য করা হত। আকবর ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে এটা বিলোপ করেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেব এটা পুনরায় প্রবর্তন করেন।

প্রশ্ন ১১। মোগল রাজত্বকালে রাজস্ব নির্ধারণের মূল ভিত্তি কি ছিল?

উত্তরঃ মোগল আমলে আবাদি জমি জরিপ করে সেই জমিতে উৎপন্ন বস্তুর ১/৩ অংশমূল্য রাজস্ব হিসাবে নির্ধারণ করা হত।

প্রশ্ন ১২। বহির্দেশ থেকে মোগলরা কি কি সামগ্রী আমদানি করত?

উত্তরঃ মোগলরা বহির্দেশ থেকে সোনা, লোহা, টিন, রেশম, হাতির দাঁত, মণি-মুক্তা ইত্যাদি আমদানি করত।

প্রশ্ন ১৩। আকবর কেন তাঁর শাসনকালে ধর্মের ক্ষেত্রে উদারতা দেখিয়েছিলেন লেখ।

উত্তরঃ আকবর ধর্মের ক্ষেত্রে এক উদার মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। সর্বধর্মের মানুষকে তিনি ধর্মীয় আলোচনায় ডেকেছিলেন। এই আলোচনা হয়েছিল ‘ইবাদতখানায়’। এই আলোচনা থেকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে এক সমন্বয় গড়ে তুলতে পারলে প্রজাদের মধ্যে সংহতি ও ঐক্য সুদৃঢ় হবে। তাই আকবর সব ধর্মের সারমর্ম নিয়ে ‘দিন-ই-ইলাহি’ নামে এক নূতন ধর্ম প্রচলন করেন।

প্রশ্ন ১৪। মীর বাক্সী কে ছিলেন? তিনি কোন্ কার্য সমাধা করেছিলেন?

উত্তরঃ মীর বাক্সী মোগল দরবারে বেতন প্রদানকারী ছিলেন।

তিনি মোগল দরবারে মোগল সম্রাটের বামদিকে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং সকল প্রার্থীদের মনোনীত করার জন্য উত্থাপিত করতেন।

প্রশ্ন ১৫। ঔরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্য পতনের জন্য কতটুকু দায়ী ছিলেন?

উত্তরঃ ঔরঙ্গজেব অনুসৃত বিভিন্ন নীতির ফলে দেশময় অসন্তোষ ও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। পাঞ্জাবে সৎনামী নামে এক হিন্দু সম্প্রদায় এবং মথুরায় জাঠ জাতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। বুন্দেলরাজ ছত্রশাল একটি স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। মোগল সাম্রাজ্যের অন্তস্বরূপ রাজপুত জাতি বিদ্রোহী হয় এবং শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গজেবের আদেশে শিখ গুরু তেগ বাহাদুরের প্রাণদণ্ড হয়। শিখরা ধর্ম ও আত্মরক্ষার জন্য এক যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হয়। সুতরাং ঔরঙ্গজেবের অনুদার নীতির ফলে তাঁর জীবিত অবস্থাতেই সাম্রাজ্য পতনের সূত্রপাত হয়। সুতরাং ঔরঙ্গজেবই মোগল সাম্রাজ্য পতনের জন্য মূলত দায়ী।

প্রশ্ন ১৬। মোগল মহানুভবদের যে-কোন তিনটি উল্লেখনীয় বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে লেখ।

উত্তরঃ মোগল মহানুভবদের উল্লেখনীয় তিনটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

(ক) তুর্কী, মিশর, সিরিয়া, ইরাক, রাশিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি থেকে কর্মচারীদের নিয়োগ করা হত।

(খ) সকল সরকারি কর্মচারীকে প্রশাসনিক ও সামরিক কর্তব্য সম্পাদন করতে হত।

(গ) সমাজের সকলশ্রেণীর জনগণ থেকে কর্মচারী নিয়োগ করা হত।

প্রশ্ন ১৭। মোগল দরবারে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার তিনটি পদ্ধতির বিষয়ে বর্ণনা কর।

উত্তরঃ মোগল দরবারে পাণ্ডুলিপি নিম্নোক্ত তিনটি উপায়ে প্রস্তুত করা হত:

(ক) কাগজ নির্মাতাগণ পাণ্ডুলিপির জন্য কাগজ তৈরি করে দিতেন।

(খ) লেখকগণ মূল ভাষ্য থেকে পুস্তক রচনা করতেন।

(গ) গিল্ডারগণ পুস্তকের পৃষ্ঠার বর্ণনা দিতেন।

প্রশ্ন ১৮। গুলবদন বেগম কে ছিলেন? তাঁর লিখিত গ্রন্থটি কি ছিল?

উত্তরঃ গুলবদন বেগম হুমায়ুনের ভগ্নী ছিলেন। তিনি ‘হুমায়ুননামা’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থখানি রচনা করেন।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। মোগল প্রশাসন পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ মোগল যুগে সম্রাটই শাসনক্ষেত্রে সর্বেসর্বা ছিলেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন পদাধিকারী ছিলেন। আকবর তাঁর সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ‘সুবায়’ (প্রদেশ) ভাগ করেছিলেন। সুবার শাসনব্যবস্থা সুবেদারদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। সুবাগুলোকে ‘সরকার’ ও ‘পরগণা’য় ভাগ করা হয়েছিল। আকবরের সময়ে ‘মনসবদারি’ প্রথার প্রবর্তন হয়। মনসবদাররা সাধারণ প্রশাসন ও সামরিক বিভাগ দুটি দেখাশোনা করতেন। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ছিল মোগল শাসনের এক উল্লেখযোগ্য দিক। স্থলপথ ছাড়াও সমুদ্র দিয়ে বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করা হয়েছিল।

প্রশ্ন ২। কলা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সংগীতের ক্ষেত্রে মোগলদের অবদান সংক্ষেপে বর্ণনা কর।

উত্তরঃ মোগলদের ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বলা যায়। মোগল সম্রাটগণের বেশ কয়েকজন নিজে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। মোগল যুগে আরবি, ফারসি, হিন্দি, সংস্কৃত ইত্যাদি ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষায় বহু অমূল্য গ্রন্থ রচিত হয়। বাবরের আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-আকবরি’ গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ুননামা’ প্রভৃতি সাহিত্যজগতের অমূল্য সম্পদ। আকবরের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থের পারসি অনুবাদ করা হয়েছিল।

শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা ‘ভগবতগীতা’ ও ‘উপনিষদ’ পারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। মোগল যুগে ব্রজবুলি ভাষার পূর্ণ চর্চা হয়েছিল। কবি তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’ এই যুগে রচিত হয়। মোগল শাসকরা সংগীতেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ তানসেন আকবরের রাজসভা মুখরিত করতেন। ‘সুরদাস’ এই যুগের আর একজন সংগীতজ্ঞ। বর্তমানেও ভারতীয় কলা-সংস্কৃতি, সংগীত-নৃত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচলিত বহু ধারা মোগলযুগের সৃষ্টি।

প্রশ্ন ৩। মোগল যুগের স্থাপত্য শিল্পকলা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ মোগল যুগে স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্প উচ্চস্থান লাভ করে। আগ্রার তাজমহল, দিল্লির লালকেল্লা, জামা মসজিদ ইত্যাদি মোগল যুগের অবদান। আকবরের রাজত্বকালে মোগল স্থাপত্যশিল্পের মূল ভিত গড়ে ওঠে। আগ্রার নিকটবর্তী ফতেপুর সিক্রি, বুলন্দ দরওয়াজা, পঞ্চমহল প্রভৃতি আকবরের স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। জাহাঙ্গিরের সময়ে মোগল স্থাপত্য ও চিত্রশিল্প আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। শাহজাহানের রাজত্বকাল স্থাপত্য শিল্পের স্বর্ণযুগ বলা যায়। তার সময়ে মোগল স্থাপত্য শিল্প পূর্ণ রূপ পায়। পৃথিবী বিখ্যাত ‘তাজমহল’, ‘ময়ূর সিংহাসন’ শাহজাহানের স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

প্রশ্ন ৪। ভারতে মোগল সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আকবরের গৃহীত ব্যবস্থাগুলি উল্লেখ কর।

উত্তরঃ বিজেতা হিসাবে আকবরে ছিল অসাধারণ সাহস, রণনৈপুণ্য, বাহুবল ও দূরদর্শিতা। তিনি সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন সত্য, কিন্তু ভারতে স্বীয় আধিপত্য বিস্তারের জন্য অযথা রক্তপাত বা যুদ্ধে লিপ্ত হতেন না। প্রথমে তিনি মিত্রতা নীতি দ্বারা শত্রুকে বশীভূত করার চেষ্টা করতেন, কিন্তু অকৃতকার্য হলে যুদ্ধ দ্বারা তাকে জয় করতেন। বিজিত শত্রু বশ্যতা স্বীকার করলেই আকবর তাঁর প্রতি বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করতেন। চিতোর ব্যতীত সমগ্র রাজপুতানা তাঁর মিত্রতা নীতিতে বশীভূত হয়। তিনি তাঁর কৌশল ও রণনৈপুণ্যে দুর্ধর্ষ পাঠানদের পরাজিত করে সমগ্র উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যের কিয়দংশ অধিকার করেন। রাজ্যলাভের সময় আকবরের রাজ্য মাত্র দিল্লি ও আগ্রায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তাঁর রাজ্যজয়ের ফলে এই সামান্য ভূখণ্ডও বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তাঁর অনুসৃত মৈত্রীনীতির ফলে সাহসী রাজপুত জাতি মোগল সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করতে যথেষ্ট সাহায্য করেন।

প্রশ্ন ৫। আকবরের গৃহীত রাজপুত নীতি সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণাত্মক চিত্র তুলে ধর।

উত্তরঃ আকবর রাজপুতদের আগ্রাসী নীতির পাশাপাশি সম্প্রীতি স্থাপনের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। আকবর বুঝেছিলেন যে সাহসী ও স্বাধীনতাপ্রিয় রাজপুতদের সাময়িকভাবে পরাস্ত করে নিজের রাজ্যের সঙ্গে সামিল করলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হবার নয়। অন্যদিকে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার ও তার স্থায়িত্বের জন্যও রাজপুতদের সহযোগিতা নিতান্ত প্রয়োজন। তাই আকবর মোগল-রাজপুত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে সম্পর্ক দৃঢ় করে তুলেছিলেন। ছোট-বড় রাজপুত রাজ্যও এই মৈত্রীর সুবাদে মোগলদের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু রাজপুত রাজ্য মেবার মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেনি। তাই মেবারের ক্ষেত্রে আকবর আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন। তিনি মেবারের কিছু স্থান অধিকার করলেও প্রতাপ সিংহের দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদা বোধকে সম্মান জানিয়ে তিনি মেবার অভিযান প্রত্যাহার করেন। বশ্যতা স্বীকারকারী রাজপুত রাজাদের আকবর স্বায়ত্ব-শাসনের অধিকার দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন ৬। শ্রেষ্ঠ মোগল সম্রাট হিসাবে আকবরের স্থান নির্ণয় কর।

উত্তরঃ ভারতের ইতিহাসে আকবর অনন্যসাধারণ স্থান অধিকার করেছেন। মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন উদার, মহৎ, কষ্টসহিষ্ণু, শ্রমশীল ও অধ্যবসায়ী। তাঁর চরিত্রে সরলতা, অমায়িকতা, গাম্ভীর্য প্রভৃতি গুণের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি সমদর্শী ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন এবং তাঁর ধর্মমতও উদার ছিল। তাঁর স্মৃতি ও মানসিক শক্তি অতিশয় প্রখর এবং জ্ঞানপিপাসা অদম্য ছিল। মহতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সুন্দরের প্রতি কোমলতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিজেতারূপে (as a conqueror) তাঁর ছিল অসাধারণ বাহুবল, রণনৈপুণ্য, সাহস ও বুদ্ধিকৌশল। তিনি স্বভাবত নিষ্ঠুর ও রক্তপিপাসু বিজেতা ছিলেন না। পরাজিত শত্রুর প্রতি সহৃদয়তা ছিল তাঁর চরিত্রের একটি মহান গুণ। শাসকরূপে স্বেচ্ছাচারী হলেও আকবর রাজনীতিকুশল, গুণগ্রাহী ও প্রজারঞ্জক ছিলেন। আকবর যে কেবল ভারতবর্ষের মুসলমান নরপতিগণের মধ্যেই সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তা নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও তাঁর স্থান অতি উচ্চে। তিনি কেবল একজন শ্রেষ্ঠ দিগ্বিজয়ী বীর বা একটি সুবৃহৎ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন না, তিনি এই বিশাল ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের সমন্বয়ের মাধ্যমে এক অখণ্ড ও সার্বভৌম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চেষ্টা করেছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজি, মহম্মদ-বিন্-তুঘলক বা ঔরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য তাঁর অপেক্ষা বৃহত্তর ছিল, কিন্তু তা ছিল একমাত্র সামরিক শক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং ধর্মবিদ্বেষের সংকীর্ণতায় সীমাবদ্ধ। মুসলমান সম্রাটগণের মধ্যে একমাত্র আকবরই মিত্রতা নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে সামরিক শক্তিকে সাম্রাজ্যবিস্তারে দ্বিতীয় উপায়রূপে গ্রহণ করেছিলেন।

প্রশ্ন ৭। জাহাঙ্গির কে ছিলেন? তাঁর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ জাহাঙ্গির হলেন আকবরের পুত্র যুবরাজ সেলিম। আকবরের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম জাহাঙ্গির নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তিনি আকবরের নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। তিনি মেবারের রাণা প্রতাপ সিংহের পুত্র অমর সিংহের সঙ্গে এক সন্ধি করে সাময়িকভাবে মোগল-রাজপুত সংঘর্ষের অবসান ঘটান। ইংরেজ প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন হকিন্স এবং স্যার টমাস রো জাহাঙ্গিরের সময়ে ভারতে আসেন। সুরাটে ব্যবসা-বাণিজ্যের কুঠি নির্মাণের জন্য তিনি ইংরেজদের অনুমতি দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গির ‘মোগল চিত্রশিল্প’ নামে এক চিত্রাঙ্কন প্রবর্তন করেন। জাহাঙ্গিরের প্রশাসনে তাঁর পত্নী নূরজাহানের বিশেষ ভূমিকা ছিল।

প্রশ্ন ৮। শাহজাহানের রাজত্বকালকে মোগল স্থাপত্য শিল্পের স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন?

উত্তর। শাহজাহানের রাজত্বকালে শিল্প পূর্ণ রূপ পায়। শাহজাহান তাঁর স্থাপত্যশিল্পে সাদা মার্বেল পাথর ব্যবহার করেছিলেন। পৃথিবীবিখ্যাত ‘তাজমহল’, ‘ময়ূর সিংহাসন’ শাহজাহানের স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তাজমহল বিশ্বের এক ঐতিহ্যমণ্ডিত সম্পদের স্বীকৃতি লাভ করেছে। দেওয়ান-ই-খাস, দেওয়ান-ই-আম, মোতি মসজিদ, জামা মসজিদ, শিশমহল, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধিক্ষেত্র ইত্যাদি স্থাপত্যগুলো সম্রাট শাহজাহানের অপূর্ব সৃষ্টি। এই সকল কারণেই শাহজাহানের রাজত্বকালকে মোগল স্থাপত্যশিল্পের স্বর্ণযুগ বলা হয়।

প্রশ্ন ৯। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ কর।

উত্তরঃ মোগল সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) মোগল সাম্রাজ্যের বিশাল আয়তন এর পতনের একটি প্রধান কারণ। বিশাল সাম্রাজ্য সুচারুরূপে শাসনের দক্ষতা আকবর পরবর্তী মোগল শাসকদের ছিল না।

(খ) ঔরঙ্গজেবের সন্দিগ্ধ চরিত্র, অনুদার ধর্মনীতি ও সুদীর্ঘ জীবন মোগল সাম্রাজ্য পতনের জন্য আংশিকভাবে দায়ী ছিল।

(গ) ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটগণ দুর্বল, অকর্মণ্য ও বিলাসী ছিলেন। প্রশাসনের দিকে তাঁদের দৃষ্টি ছিল না।

(ঘ) অষ্টাদশ শতকের মোগল দরবারে ওমরাহগণ ষড়যন্ত্রপ্রিয় ও স্বার্থপর ছিলেন। তাদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধবিগ্রহ মোগল সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

(ঙ) মোগল সামরিক শক্তির দুর্বলতা সাম্রাজ্য পতনের অন্যতম কারণ।

প্রশ্ন ১০। আকবরের ধর্মনীতি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা,

‘দীন-ই-ইলাহী’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ ধর্ম বিষয়ে আকবর বড়ই উদার ছিলেন। সকল ধর্মের বিরোধের ঊর্ধ্বে থেকে তিনি রাজ্যে সকলকেই স্বাধীনভাবে স্বধর্ম পালন করতে দিতেন। আকবর ছিলেন সত্যের অনুসন্ধানী সম্রাট। কোন ধর্মকেই তিনি অবহেলা করতেন না। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফতেপুর সিক্রিতে একটি ‘ইবাদংখানা’ বা আরাধনাগৃহ নির্মাণ করেন। এখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, ফারসি প্রভৃতি ধর্মের পণ্ডিত ও সাধু ব্যক্তিগণ সমবেত হতেন। তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে গভীর রাত্রি পর্যন্ত তাঁদের নিকট বিভিন্ন ধর্মের ব্যাখ্যা শ্রবণ করতেন। ভারতের সকল সম্প্রদায়ের লোককে একই ধর্মের আশ্রয়ে আনবার জন্য বিভিন্ন ধর্মের সার নিয়ে আকবর এক নতুন ধর্ম প্রচার করেন। এই ধর্মের নাম দীন-ই-ইলাহী। এই বিশ্বজনীন ধর্মের পরিকল্পনা মহৎ ও প্রশংসনীয় ছিল সত্য, কিন্তু তা সর্বসাধারণ গ্রহণ করেন নি। স্বাভাবিক উদারতার জন্য আকবর তাঁর বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনকেও এই নূতন ধর্মমত গ্রহণ করতে বাধ্য করেননি। দৈনন্দিন জীবনে তিনি ফারসি, হিন্দু ও জৈন আচার কিছু কিছু গ্রহণ করেন। এই সকল কারণে গোঁড়া মুসলমানগণ আকবরকে প্রীতির চক্ষে দেখতেন না। এমনকী, দেশে বিদ্রোহও উপস্থিত হয়েছিল। আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দীন-ই-ইলাহী লোপ পায়। আকবর যদি দীন-ই-ইলাহী দ্বারা ভারতের বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়কে একই সাম্রাজ্য ও একই ধর্মের অধীনে মিলিত করতে পারতেন, তাহলে ভারতে বহু পূর্বেই এক শক্তিমান মহাজাতি সংগঠিত হতে পারত।

প্রশ্ন ১১। আকবরনামা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ আকবরনামা আবুল ফজল লিখিত মোগল শাসন বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে আরম্ভ করে আবুল ফজল সুদীর্ঘ ১৩ বছরে আকবরনামা রচনার কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন। গ্রন্থখানি বিভিন্ন ঘটনার বাস্তব বিবরণ ও শাসন-সংক্রান্ত দলিল বিশেষ। আকবরনামা গ্রন্থখানি তিন অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এর প্রথম দুইটি অধ্যায় ইতিহাস ও তৃতীয় অধ্যায়টি হল ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থ। প্রথম অধ্যায়ে আদম হতে আরম্ভ করে আকবরের জীবনের এক স্বর্গীয় কালচক্রের মানবজাতির ইতিহাস বর্ণনা করা আছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আকবরের রাজত্বের ৪৬ বছরের বর্ণনা করা হয়েছে। আকবরনামা গ্রন্থের উদ্দেশ্য ছিল আকবরের রাজত্বকালের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের বিবরণ দেওয়া। আকবরনামাতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের সামাজিক বিবরণের পরম্পরা রক্ষা করে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করা হয়েছে।

প্রশ্ন ১২। ‘বাদশাহনামা’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

উত্তরঃ আবুল ফজলের একজন শিষ্য আব্দুল হামিদ লাহিরী ‘বাদশাহনামা’ রচনা করেন। তিনটি অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা বাদশাহনামা একখানি সরকারি ইতিহাসবিশেষ ছিল। এর প্রতিটি খণ্ডে দশ চন্দ্রবর্ষের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা আছে। লাহিরীও আকবরের শাসনকালের প্রথম দুটি দশকে (১৬২৭-১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) প্রথম দুটি- খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পরে শাহজাহানের উজীর সাদুল্লা খান এটা সংশোধন করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে লাহিরী তৃতীয় অধ্যায়টি লিখতে না পারার কারণে ইতিহাসবিদ ওয়ারিশ এই অধ্যায়ের কাজ সম্পূর্ণ করেন।

প্রশ্ন ১৩। সম্রাট আকবরের সময়ে ভূমির শ্রেণী বিভাগ কিভাবে হয়েছিল? ভূমির কর কিভাবে নির্ধারণ করা হত?

উত্তরঃ সম্রাট আকবরের সময়ে কৃষির অবস্থা ও মাটির উর্বরতা অনুসারে ভূমির শ্রেণী বিভাগ হয়েছিল। চার শ্রেণীর ভূমি ছিল-

(ক) পলাজ। 

(খ) পরাউতি। 

(গ) চাচর। ও 

(ঘ) বাঞ্জর।

উৎপাদিত শষ্যের এক-তৃতীয়াংশ কর বলে ধার্য করা হত।

প্রশ্ন ১৪। ‘ঝারোকা-দর্শন’ কাকে বলা হয়? কে এবং কেন এই প্রথার প্রচলন করেছিলেন?

উত্তরঃ ‘ঝারোকা’ হল পূর্বমূখী একটি ক্ষুদ্র অলিন্দ বা ব্যালকনি যেখান থেকে সম্রাট আকবর প্রতিদিন সকালে নীচে সমবেত সেনা, ব্যবসায়ী, কৃষক, মহিলা, রুগ্ন শিশু ও অন্যান্যদের দর্শন করতেন।

আকবর জনগণের সার্বিক অবস্থা আলোচনার উদ্দেশ্যে ঝারোকা দর্শন প্রচলন করেছিলেন।

দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। মোগলদের রাজনৈতিক ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা,

মোগল সাম্রাজ্যের প্রসার সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ শেরশাহের মৃত্যুর এক দশকের মধ্যেই তাঁর সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। তাঁর দুর্বল বংশধরদের অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে রাজ্যচ্যুত মোগল শাসক হুমায়ুন দিল্লি ও আগ্রা জয় করে মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন (১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ)। পরের বছরেই তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর নাবালক পুত্র আকবর।

আকবর: আকবর তাঁর রাজত্বের প্রথম চার বছর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্বে রাজ্য চালনা করেন। সেই সময় তিনি আফগানদের বিরুদ্ধে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ) নামতে বাধ্য হন। আফগান নেতা আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমু আগ্রা ও দিল্লি দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আকবর পানিপথের প্রান্তরে তাঁর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। হিমুকে পরাজিত ও হত্যা করে তিনি নিজেকে বিপদমুক্ত করেন এবং রাজ্য বিজয় দ্বারা মোগল শাসনের পরিধি সম্প্রসারণের কর্মসূচী নেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর চার বছরের মধ্যেই আজমীর, গোয়ালিয়র ও জৌনপুর আকবর দখল করে নেন। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে মালবা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রেও আকবর প্রথমে মিত্রতাপূর্ণ বশ্যতা স্বীকারের আহ্বান জানান। কিন্তু একমাত্র খানদেশ ছাড়া কোন রাজ্য সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এমতাবস্থায় তিনি যুদ্ধনীতি নেন এবং আহম্মদনগর আক্রমণ করেন। আহম্মদ- নগরের নাবালক সুলতানের অভিভাবিকা চাঁদবিবি বেরার নাম স্থানটি অর্পণ করে মোগলদের সাথে সন্ধি করেন। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদনগর শহরটি মোগলরা দখল করে নেয়। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে অসিরগড় দুর্গটি মোগলদের অধিকারে আসে। এইভাবে আকবরের সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে গোদাবরী এবং পশ্চিমে হিন্দুকুশ থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত প্রসারিত হয়।

জাহাঙ্গির-এর আমল: আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সেলিম জাহাঙ্গির’ নাম নিয়ে মোগল সিংহাসনে বসেন (১৬০৫–১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ)। কোচবিহারের একাংশ এবং কাছাড় ও শ্রীহট্ট জেলাতে মোগল আধিপত্য স্থাপিত হয়। বাংলার বিদ্রোহী জমিদারদের তিনি বশীভূত করেন। তবে তাঁর আমলে কান্দাহার পারস্য সম্রাট শাহ আব্বাস পুনর্দখল করে নেন। এতে মোগল সাম্রাজ্যের সামরিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।

শাহজাহান-এর আমল: পরবর্তী শাসক ছিলেন জাহাঙ্গিরের তৃতীয় পুত্র খুররম (১৬২৭-১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ)। দাক্ষিণাত্য-যুদ্ধে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি জাহাঙ্গির কর্তৃত্ব ‘শাহজাহান’ (বা, বিশ্ববিজেতা) উপাধি পেয়েছিলেন। এই নামেই তিনি পরিচিত হন। কান্দাহার পুনর্দখলের জন্য শাহজাহান পারস্যের শাহ আব্বাসের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযান পাঠান। তবে সবগুলিই ব্যর্থ হয়। প্রচুর অর্থ ও লোকক্ষয় করে মোগল বাহিনী ব্যর্থতার গ্লানিসহ ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এতে মোগল সাম্রাজ্যের মর্যাদা প্রবলভাবে ক্ষুণ্ন হয়। দাক্ষিণাত্যে তিনি কিছুটা সফল হন। ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদনগর সম্পূর্ণভাবে মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর যোগলের বশ্যতা স্বীকার করে (১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) বার্ষিক কর দিতে সম্মত হয়।

ঔরঙ্গজেবের আমল: উত্তরাধিকার যুদ্ধে ঔরঙ্গজেব পিতা শাহজাহানকে গৃহবন্দী করে এবং ভাইদের হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন এবং দীর্ঘ ঊনপঞ্চাশ বছর (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্ব চালান। ঔরঙ্গজেবের আমলে মোগল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে। তাঁর নির্দেশে বিহারের শাসনকর্তা দাউদ খাঁ পালামৌ জয় করেন (১৬৬১ খ্রিস্টাব্দ)। বাংলার শাসনকর্তা মিরজুমলা সম্রাটের নির্দেশে কুচবিহার জয় করেন। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই কুচবিহার মোগলের হস্তচ্যুত হয়। মিরজুমলার মৃত্যুর পর বাংলার শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁ আরাকানরাজকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম এবং পোর্তুগিজ জলদস্যুদের হাত থেকে সন্দীপ দখল করেন।

প্রশ্ন ২। মোগল যুগের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ মোগল শাসকদের লক্ষ্য ছিল ঐক্যবদ্ধ ‘ভারত রাষ্ট্র’ গঠন করা। তাই তাঁরা শক্তিশালী কেন্দ্রের নেতৃত্বে একটি দক্ষ ও কার্যকরী শাসন কাঠামো গড়ে তোলেন।

(ক) সম্রাট: মোগল শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। তিনি ছিলেন প্রধান শাসক, প্রধান আইন প্রণেতা ও প্রধান বিচারক। স্বৈরাচারী হলেও মোগল শাসকরা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। ইসলাম ধর্ম ও কোরানের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু ভারতে কঠোর ‘ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র’ গড়ে তোলার কোন চেষ্টা তাঁরা করেন নি। মোগল শাসকদের লক্ষ্য ছিল বহু ধর্ম, জাতি ও ভাষাভাষীর দেশ ভারতবর্ষের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা ও জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়ে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা। সরকারি ভাষা হিসেবে ‘ফারসি’ ভাষার ব্যবহার ও একই মুদ্রাব্যবস্থা দ্বারা তাঁর জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় করেন।

(খ) কর্মীগোষ্ঠী: একটি দক্ষ ও সংগঠিত কর্মীমণ্ডলী মোগল শাসনকাজে সম্রাটকে সহযোগিতা করতেন। এঁরা সম্রাটকে পরামর্শ দিতেন। অবশ্য তা গ্রহণ করা বা না করা মোগল সম্রাটের ইচ্ছাধীন ছিল। মোগল শাসনের প্রথমদিকে ‘ভকিল’ পদটি ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, প্রধানমন্ত্রীর সমতূল্য। পরে ‘ভকিল’ পদ তুলে দেওয়া হয়। ভকিলের সমমর্যাদাসম্পন্ন পদ হিসেবে ‘দেওয়ান’ বা ‘উজির’ পদটি প্রবর্তিত হয়। দেওয়ান, মির-বকশি, মির-সামান এবং সরদ-উস্- সুদর — এই চারটি পদ নিয়ে মন্ত্রণা পরিষদ গড়ে ওঠে।

(অ) দেওয়ান বা উজির ছিলেন মন্ত্রণা পরিষদের প্রথম ব্যক্তি।

(আ) দেওয়ান-এর পরেই ছিল মির-বকশির স্থান। ইনি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধান করতেন।

(ই) মির-সামানের দপ্তর ছিল বর্তমান কালের পূর্ত ও বাণিজ্য দপ্তরের মতো। বাদশাহি হারেম, সরকারি কারখানা, পথঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণ, বাগিচার পরিচর্যা ইত্যাদি কাজ এই দপ্তর চালাত।

(ঈ) ‘সদর-উস্-সুদূর’ বা প্রধান কাজি ছিলেন আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের অধ্যক্ষ।

একঝাঁক দক্ষ ও কর্মঠ কর্মচারী কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে সাহায্য করতেন। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ‘মুহতাশিব’ নামক কর্মচারী। এছাড়া দারোগা-ই ডাকচৌকি, মুস্তাফি, মির আর্জ, মির মঞ্জিল, ওয়াকিনবিশ প্রভৃতি নানা কর্মীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় প্রশাসনে নিযুক্ত ছিল।

(গ) শাসনবিভাগ: আকবর সমগ্র সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশ বা সুবায় বিভক্ত করেন। তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে মোট সুবা ছিল ১৫টি। ঔরঙ্গজেবের আমলে সুবার সংখ্যা বেড়ে হয় ২১টি। সুবার প্রধান শাসক ছিলেন ‘সুবাদার’। সুবাদারের প্রায় সমপর্যায়ভুক্ত ছিলেন ‘দেওয়ান’। দেওয়ান রাজস্ব-সংক্রান্ত কাজ পরিচালনা করতেন। দেওয়ান ও সুবাদার পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে কেউই অধিক ক্ষমতাশালী হতে পারতেন না। সুবার অন্যান্য কর্মচারীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কোতোয়াল, ফৌজদার, আমলগুজার, মিরবহর প্রমুখ। প্রতিটি সুবা ‘সরকার’-এ এবং সরকারগুলি ‘পরগনা’-য় বিভক্ত ছিল। সরকারের প্রধান শাসক ছিলেন ফৌজদার। ‘সিকদার’ ছিলেন পরগনার প্রধান শাসনকর্তা। গ্রামের ব্যাপারে তত্ত্বাবধান করত ‘গ্রাম পঞ্চায়েত’।

প্রশ্ন ৩। শাসকরূপে আকবরের কার্যাবলী আলোচনা কর।

অথবা,

আকবরের শাসন-প্রণালী বর্ণনা কর।

উত্তরঃ মুঘল সম্রাটগণ ভারতীয় পটভূমিকায় ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। মুঘল শাসনে আরব, পারস্য ও ভারতীয় এই ত্রিধারার সমন্বয় হয়েছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার একে ‘ভারতীয় পারিপার্শ্বিকে রচিত পারসিক-আরবিক শাসনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। বাহ্যত মুঘল শাসনের ভিত্তি ছিল মুসলিম ধর্মগ্রন্থ কোরান, শাসনব্যবস্থার রূপ ও পরিভাষা ছিল পারসিক, শাসনক্ষেত্র ছিল ভারতবর্ষ ও শাসিত ছিল ভারতীয়।

(ক) কেন্দ্রীয় শাসন: দিল্লির অন্যান্য মুসলমান সম্রাটগণের মতো আকবরও ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, কিন্তু তিনি স্বেচ্ছাচার প্রয়োগ করতেন প্রজা ও সাম্রাজ্যের কল্যাণের জন্য। তিনি একাধারে সম্রাট, সেনানায়ক, বিচারক ও ধর্মসমস্যা মীমাংসক ছিলেন। শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ স্বতন্ত্র কর্মচারীর হাতে ন্যস্ত ছিল। এদের মধ্যে ‘উকিল’ (প্রধানমন্ত্রী), ‘দেওয়ান’ (রাজস্ব বিভাগের অধ্যক্ষ), ‘উজির’ (অর্থসচিব), ‘প্রধান বক্সী’ (খাজাঞ্চি), ‘সদর’ (ধর্মসচিব) প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

(খ) প্রাদেশিক শাসন: প্রাদেশিক শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আকবর সমস্ত রাজ্যটি পনেরটি ‘সুবায়’ বা প্রদেশে এবং প্রত্যেক ‘সুবা’ কয়েকটি ‘সরকার’ বা জেলায় বিভক্ত করেন। প্রত্যেক সুবা ‘সুবাদার’ উপাধিধারী একজন সামরিক শাসনকর্তার অধীনে থাকত। তিনি নিজে সুবায় সুশাসন ও শান্তি রক্ষার জন্য দায়ি থাকতেন। প্রত্যেক ‘সরকার’ বা জেলার শাসনকর্তার উপাধি ছিল ‘ফৌজদার’। ‘কোতোয়াল’ শহরের শান্তি রক্ষা করতেন এবং ‘কাজী’ ও ‘মীর আদল’-এর উপর বিচারের ভার ন্যস্ত ছিল। ‘মুফূর্তি’ নামক কর্মচারী আইনের ব্যাখ্যা করতেন। গ্রাম পঞ্চায়েত প্রথা প্রচলিত ছিল। অন্যান্য প্রাদেশিক কর্মচারীগণের মধ্যে ‘সদর’ (মসজিদ ও দাতব্য বিভাগের কর্তা), ‘আমীল’ (রাজস্ব আদায়কারী), ‘ওয়াকিনবীশ’ (সংবাদলেখক বা গুপ্তচর), ‘পোতদার’ (হিসাবরক্ষক) প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

(গ) সামরিক শাসন: আকবর সৈন্যবিভাগের আমূল সংস্কার করেন। আকবরের পূর্বে সেনাপতি ও কর্মচারীগণকে বেতনের পরিবর্তে জায়গির দেওয়া হত। এতে রাজকোষের অধিক ক্ষতি হত এবং জায়গিরদারগণ প্রবল হবার সুযোগ পেত। এইজন্য আকবর জায়গির দানের প্রথা রহিত করে মনসব প্রথা (মনসব = পদ; মনসবদার = পদাধিকারী) প্রবর্তন করেন। মনসবদারগণ (অর্থাৎ উচ্চশ্রেণীর কর্মচারীগণ) ৩৩ শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। পদের তারতম্য অনুসারে তাঁদের রাজকোষ হতে বেতন দেওয়া হত। যুদ্ধকালে রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে মনসবদারদিগকে সসৈন্যে যোগদান করতে হত। আকবরের পাঁচ প্রকার সৈন্য ছিল। পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনী, নৌবহর ও গোলন্দাজ। মুঘল সৈন্য ও শিবির ছিল চলন্ত শহর। দরবার, মোসাহেব, দপ্তর, কারখানা ও বাজার শিবিরের সঙ্গে ভ্রমণ করত। নৃত্যগীত ও আমোদ-প্রমোদ ছিল শিবিরের অচ্ছেদ্য অংশ।

(ঘ) রাজস্ব শাসন: আকবরের মন্ত্রী রাজা টোডরমল (Todar Mal) শেরশাহের অনুকরণে রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করেন। কৃষির অবস্থা এবং উর্বরতা অনুসারে সাম্রাজ্যের জমি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয় এবং উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশ রাজকর বলে ধার্য হয়। নগদ মুদ্রা বা তার পরিবর্তে শস্য দ্বারা রাজকর দেওয়া হত। আকবর জিজিয়া কর রহিত করেন। হিন্দি ও ফারসি ভাষায় হিসাবপত্র রক্ষিত হত।

প্রশ্ন ৪। মনসবদারি প্রথা বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ জায়গির ব্যবস্থা বৃহত্তর মোগল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও সংহতি বিধানের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। আকবর সুশাসন প্রবর্তনের জন্য একটি দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগের পরিণতি হল মনসবদারি প্রথার উদ্ভব। ‘মনসব’ কথার অর্থ হল পদমর্যাদা। এটি ছিল একাধারে সামরিক ও বেসামরিক মোগল কর্মীমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের মর্যাদার দ্যোতক। ইতিহাসবিদ আহতার আলি এর সংজ্ঞা নির্ণয় করে বলেছেন—“মনসব হল কোন ব্যক্তিকে প্রদত্ত মর্যাদা এবং তার কর্তব্য ও দায়িত্বের পরিচয় ও ভিত্তি।” সামরিক ও অসামরিক—উভয় ক্ষেত্রেই ‘মনসব’ দেওয়া হত। উচ্চ-অভিজাত, বিচারক, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ইত্যাদি প্রতি ক্ষেত্রেই সম্রাট ‘মনসব’ প্রদান করতেন। মনসবদারের নিয়োগ ও পদচ্যুতি ছিল একান্তভাবে সম্রাটের ইচ্ছাধীন। মনসবদারদের সাধারণভাবে সেনাবাহিনী পোষণ করতে হত এবং সম্রাটের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে হত। 

তবে সকল মনসবদারের ক্ষেত্রে সামরিক কর্তব্য বাধ্যতামূলক ছিল না। মনসবদারদের কোন বংশানুক্রমিক দাবি স্বীকৃত ছিল না। একজন মনসবদার ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ এই দুটি পদের অধিকারী হতেন। জাট ও সওয়ার-এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে মতভেদ আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় ‘জাট’ হল মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও ‘সওয়ার’ হল তার অধীনে অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যা। প্রত্যেক মনসবদরদার সেনাবাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য জায়গির পেতেন। আকবরের আমলে মনসবদারদের ত্রিশটি স্তর ছিল। সর্বনিম্ন মনসবদারের অধীনে ১০ জন এবং সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার সেনা থাকত। উচ্চ মনসব মূলত রাজপরিবারের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত। মনসবদারের অধীনস্থ সৈনিকরা তাদের ঘোড়ার সংখ্যার ভিত্তিতে নানা ভাগে বিভক্ত ছিল। যার তিনটি ঘোড়া, তাকে বলা হত ‘শি-আসপা’, যার দুটি ঘোড়া, তাকে বলা হত ‘দু-আসপা’ এবং যার একটি ঘোড়া তাকে বলা হত ‘এক-আসপা’। আবার অনেক সময় দু’জন সৈনিকের একটিমাত্র ঘোড়া থাকত। এদের বলা হত ‘নিম-আসপা’। 

মনসবদারদের বেতন দেওয়া হত দু’ভাবে। কিছু মনসবদার তাদের বেতন বাবদ জমি বন্দোবস্ত পেতেন। এই জমিকে বলা হত ‘জায়গির জমি’ এবং ওই মনসবদার ‘জায়গিরদার’ নামেও পরিচিত হতেন। কিছু লোক নগদে বেতন পেতেন। তাদের বলা হত ‘মনসবদার-ই-নগদি’। মনসবদাররা তাদের এলাকার বাইরে জমি বন্দোবস্ত পেতেন। সম্রাট তাঁর ইচ্ছামতো যে-কোন মনসবদারকে এক জায়গির থেকে অন্য জায়গিরে বদলি করতে পারতেন। মনসবদারের মৃত্যুর পর তার সমস্ত সম্পত্তি সম্রাটের হস্তগত হত।

পাঠ্যপুস্তকের প্রশ্নাবলীর উত্তরঃ

প্রশ্ন ১। মোগল দরবারে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে লেখ।

উত্তরঃ মোগল যুগে সকল গ্রন্থই পাণ্ডুলিপিরূপে অর্থাৎ হাতেলেখা পুঁথিরূপে পাওয়া গিয়েছিল। পাণ্ডুলিপি রচনা করার মুখ্য কেন্দ্র ছিল শাহী কিতাবখানা। কিতাবখানা শব্দটিকে গ্রন্থনায় বলা যায়। লিপিঘর নামক একটি ঘরে যোগল সম্রাটগণের সকল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে রাখা হয়েছিল।

পাণ্ডুলিপি রচনার বিভিন্ন কাজে বহু লোক জড়িত থাকত –

(ক) কাগজ প্রস্তুতকারীগণ পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা প্রস্তুত করত।

(খ) লেখকগণ সুন্দর হাতের অক্ষরে পাঠের নকল করত।

(গ) চিত্রকরগণ পাঠের বিভিন্ন চিত্র অঙ্কন করত।

(ঘ) শিল্পীগণ এর উপর স্বর্ণজলের প্রলেপ দিতেন।

(ঙ) গ্রন্থ বাঁধাইকারীগণ সকল পৃষ্ঠা একত্র করে সুন্দর মোড়কে বাঁধাই করে রাখত।

সুন্দর হাতের অক্ষরে লেখা কার্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বলে বিবেচনা করা হত। পাণ্ডুলিপি সুরক্ষিত করে রাখা হত।

প্রশ্ন ২। মোগল প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ। কেন্দ্র কিভাবে প্রদেশসমূহ নিয়ন্ত্রণ করত?

অথবা,

মুঘল প্রাদেশিক প্রশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ মোগল সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশগুলিকে ‘সুবা’ বলা হত। এই সুবাগুলি দেওয়ান, বাখসি ও সর্দার দ্বারা শাসিত হত। প্রাদেশিক শাসনের প্রধান ছিলেন গভর্নর। তাঁকে ‘সুবেদার’ বলা হত। তিনি সরাসরি সম্রাটকে শাসন-সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রেরণ করতেন।

প্রতিটি সুবা বিভিন্ন সরকারে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি সরকারে আবার জেলাও থাকত। ফৌজদার জেলার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। প্রতিটি জেলায় আবার পরগণাও ছিল। এতে আংশিক উত্তরাধিকারী বিষয় থাকত। তাদের কানুনগো, চৌধুরী ও কুয়াজী বলা হত। প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগে বহুসংখ্যক কেরানি, হিসাবরক্ষক, হিসাব পরীক্ষক ও তথ্যপ্রেরক ছিল। তাছাড়াও অভিযান্ত্রিক বিষয়ও ছিল।

প্রশ্ন ৩। মোগল রাজপরিবারের মহিলাগণের ভূমিকা আলোচনা কর।

উত্তরঃ মোগলগণ পারিবারিক ক্ষেত্রে ‘হেরেম’ শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করত। ‘হেরেম’ শব্দটি পারসি শব্দ ‘হারাম’ হতে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ হল ‘পবিত্রস্থান।’ মোগল পরিবার নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ নিয়ে গঠিত ছিল:

(ক) বাদশাহ ও তাঁর পত্নী ও উপপত্নী।

(খ) এর পর দূর ও দূরসম্পর্কীয় লোকগণ, যেমন—মাতা, মাতামহী, ভগ্নী, ছেলে-মেয়ে, খুড়া-খুড়ী প্রভৃতি।

(গ) মহিলা পরিচারিকা ও গোলামবৃন্দ।

মোগল শাসকদের দুইপ্রকার পত্নী থাকত—একজন হলেন বেগম এবং অন্যজন হলেন আখা।

মোগল রানি ও রাজকন্যাগণ আর্থিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতেন।

মোগল দরবারে মহিলাগণ পাণ্ডুলিপি রচনার কাজও করতেন। বাবর কন্যা গুলবদন বেগম ‘হুমায়ুননামা’ নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

মোগল মহিলাগণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতেন। তারা রাজা ও রাজপুত্রের মধ্যে বিবাদের মীমাংসা করতেন।

প্রশ্ন ৪। মোগল সাম্রাজ্যকে এক আদর্শ রাজ্য সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ চিহ্নিত কর।

উত্তরঃ মোগল সাম্রাজ্যকে এক আদর্শ রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার উপাদানসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) ঐশ্বরিক শক্তি হিসাবে রাজাঃ মোগল দরবারে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন তথ্যের দ্বারা বিচার করেছিলেন যে মোগল সম্রাটগণ ভগবান হতে এক ঐশ্বরিক শক্তি লাভ করেছিলেন। এই ধারণা মোগল সাম্রাজ্যকে এক আদর্শ রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছিল।

(খ) একত্রীকরণ শক্তি: মোগল সাম্রাজ্যে হিন্দু, জৈন, শিখ, মুসলমান, জোরাস্ট্রিরিয়ান প্রভৃত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক বাস করত। সম্রাট ছিলেন সকল শক্তি ও শান্তির উৎস। সকল ধর্মীয় গোষ্ঠী ও নৃগোষ্ঠী তাঁর অধীন ছিল। সম্রাটের এই ক্ষমতা মোগল সাম্রাজ্যকে আদর্শ রাজ্য হিসাবে তৈরি করতে সহায়তা করেছিল।

(গ) ন্যায্য সার্বভৌমত্ব—এক সামাজিক চুক্তি: আবুল ফজল ন্যায্য সার্বভৌমত্বকে এক সামাজিক চুক্তি বলে অভিহিত করেছেন। সম্রাট প্রজাগণের মূল চারটি প্রধান সত্তা রক্ষা করেছিলেন। এইগুলি হল-(অ) জীবন (জান); (আ) ধন (মাল); (ই) সম্মান (নামস); ও (ঈ) বিশ্বাস (দীন)।

মোগল রাজতন্ত্রে ন্যায় প্রদান করা সর্বোত্তম সদগুণ বলে ভাবা হত। ন্যায় বিচার দৃশ্যমান করবার জন্য কলাশিল্পীগণ বিভিন্ন প্রতীক তৈরি করেছিলেন।

প্রশ্ন ৫। কি কি বিষয়সমূহ উপমহাদেশের বাইরের অঞ্চলসমূহে মোগল নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির আকার প্রদান করেছিল?

উত্তরঃ নিম্নোক্ত কারকসমূহ উপমহাদেশের বাইরের অঞ্চলসমূহে মোগল নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির আকার প্রদানে সহায়তা করেছিল:

(ক) অটোমান সাম্রাজ্য-তীর্থযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্য: বাণিজ্যের কারণে ব্যবসায়ী ও তীর্থযাত্রার কারণে তীর্থযাত্রীগণের গমনাগমনের প্রতি দৃষ্টি রেখে মোগল সাম্রাজ্য ও অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ অঞ্চলসমূহের মধ্যে সম্পর্ক ও এক, বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থা মক্কা-মদিনার মতো গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে অবস্থিত ‘হিজ’ অর্থাৎ অটোমান আরব ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য ছিল।

(খ) মোগল দরবারে জেসুইটগণ: ইউরোপীয়গণ ভারত বিষয়ে জেসুইট ধর্মপ্রচারক, পর্যটক, কূটনীতিবিদ্ ও ব্যবসায়ীগণের রচনা হতে তথ্যাদি আহরণ করেছিল। মোগল দরবার বিষয়ে ইউরোপীয় লেখকগণের রচিত বিবরণসমূহের মধ্যে জেসুইটদের বিবরণই সবচেয়ে প্রাচীন।

আকবর খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে চেয়েছিলেন। তিনি জেসুইট পুরোহিতদের আমন্ত্রণ করতে গোয়ায় একটি মিশন প্রেরণ করেছিলেন। এই মিশন প্রথমে ফতেপুর সিক্রির ইবাদতখানায় হিন্দু, মুসলমান, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের আমন্ত্রণ করেছিল। মোগল শাসকগণ ঐশ্বরীক তত্ত্বের আধারে প্রভাবশালীরূপে একটি বহুজাতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রশ্ন ৬। ভারতের একখানি মানচিত্র অঙ্কন করে মোগল শাসনাধীন অঞ্চলসমূহ দেখাও।

উত্তরঃ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top