Class 10 Bengali Chapter 18 উজান গাঙ বাইয়া Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 10 Bengali Chapter 18 উজান গাঙ বাইয়া and select needs one.
Class 10 Bengali Chapter 18 উজান গাঙ বাইয়া
Also, you can read SCERT book online in these sections Class 10 Bengali Chapter 18 উজান গাঙ বাইয়া Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 10 Bengali Chapter 18 উজান গাঙ বাইয়া These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 10 Bengali Chapter 18 উজান গাঙ বাইয়া for All Subject, You can practice these here…
উজান গাঙ বাইয়া
Chapter – 18
অনুশীলনীর প্ৰশ্নোত্তরঃ
অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
১। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম কোন গ্রামে হয়েছিল?
উত্তরঃ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল মিরাশী গ্রামে।
২। সিলেট জেলার একটি মহকুমার নাম বলো?
উত্তরঃ সিলেট জেলার একটি মহকুমার নাম হলো হবিগঞ্জ।
৩। অসমের কয়টি উপত্যকা ও কী কী?
উত্তরঃ অসমের দুটি উপত্যকা—ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও সুরমা উপত্যকা।
৪। মিরাশী নামটি কোন শব্দ থেকে এসেছে?
উত্তরঃ মিরাশী নামটি ‘মিরাশদার’ শব্দ থেকে এসেছে।
৫। অসমের পাঁচপ্রকার ধানের নাম বলো।
উত্তরঃ অসমের পাঁচপ্রকার ধানের নাম হলো—ময়না-শাইল, কার্তিক-শাইল, কালিজিরা, কৃষ্ণচূড়া ও রান্ধুনিপাগল।
৬। রান্ধুনিপাগল কী?
উত্তরঃ রান্ধুনিপাগল একপ্রকার ধানের নাম।
৭। লেখক কোন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন?
উত্তরঃ লেখক মাইনর স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন।
৮। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম তারিখ কত?
উত্তরঃ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম তারিখ হল—১৯১২, সাতাশে অগ্রহায়ণ ১৩১৯ সন।
৯। …………… দেশে বাড়ি আমাদের। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)
উত্তরঃ ধানেব দেশে বাড়ি আমাদের।
১০। এই ……………আমায় গান দিয়েছে।
উত্তরঃ এই ধানই আমায় গান দিয়েছে।
১১। মণিপুরি মিস্ত্রীরা কোন গ্রামের ছিল?
উত্তরঃ মণিপুরি মিস্ত্রীরা ঘনশ্যামপুর গ্রামের ছিল।
১২। ত্রিপুরার পাহাড়চূড়ার নাম কী?
উত্তরঃ ত্রিপুরার পাহাড়চূড়ার নাম আঠারোমুড়া।
১৩। আঠারোমুড়া পাহাড়ের ……………টিলা আমার কিশোর মনকে আকর্ষণ করতো। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)।
উত্তরঃ আঠারোমুড়া পাহাড়ের কাইল্যাছালির টিলা আমার কিশোর মনকে আকর্ষণ করতো ।
১৪। সিলেটের বিখ্যাত নদীর নাম বলো।
উত্তরঃ সিলেটের বিখ্যাত নদী হল খোয়াই।
১৫। “পাগলা গা” বলতে লেখক কোন নদীকে বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ “পাগলা গা” বলতে লেখক খোয়াই নদীকে বুঝিয়েছেন।
১৬। সৈয়দরা কোথা থেকে এসেছেন?
উত্তরঃ সৈয়দরা আরবের ইয়েমেন প্রদেশ থেকে এসেছেন।
১৭। আমাদের পরগণার নাম…………..। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)
উত্তরঃ আমাদের পরগণার নাম তরপ।
১৮। তরপ পরগণার রাজা কে ছিলেন?
উত্তরঃ তরপ পরগণার রাজা ছিলেন সামন্তরাজ আচাকনারায়ণ।
১৯। মিরাশী কিসের জন্য বিখ্যাত?
উত্তরঃ মন্ত্রী রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্তের বাড়ির জন্য মিরাশী বিখ্যাত।
২০। ১৯২২ সালে অসমের মুখ্যমন্ত্রী কে ছিলেন?
উত্তরঃ ১৯২২ সালে প্রমোদচন্দ্র দত্ত অসমের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
২১। চৈতন্যের মাতার নাম কী?
উত্তরঃ চৈতন্যের মাতার নাম শচীদেবী।
২২। দ্বারকানাথ চক্রবর্তী কে?
উত্তরঃ লেখকের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন দ্বারকানাথ চক্রবর্তী।
২৩। কে প্রথম হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে রবীন্দ্রসংগীত গাইয়েছিলেন?
উত্তরঃ দ্বারকানাথ চক্রবর্তী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত গাইয়ে ছিলেন।
২৪। আজানের সুর……………… সুরের খুব কাছাকাছি। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)।
উত্তরঃ আজানের সুর আহিরভৈরোঁর সুরের খুব কাছাকাছি।
২৫। সেকালের বিখ্যাত বেডমিণ্টন খেলোয়াড় কে?
উত্তরঃ প্রকাশ পাড়ুকোন।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও
১। ‘কই লালুবাবু? চালাও’ —উক্তিটি কার? এখানে লালুবাবু কে? কী চালানোর কথা বলা হল ওখানে?
উত্তরঃ উক্তিটি লেখক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের। এখানে লালুবাবু লেখক নিজে। এখানে লেখককে গান গাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
২। কোন পীর শ্রীহট্ট বিজয় করেছিলেন? তিনি কোথা থেকে কখন এসেছিলেন? সঙ্গে করে তিনি কী এনেছিলেন?
উত্তরঃ পীর শাহ্ জালাল শ্রীহট্ট বিজয় করেছিলেন। তিনি আরবের ইয়েমেন প্রদেশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে সিলেটে এসেছিলেন। তিনি যুগল কবুতর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।
৩। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ির কাঠের স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন যে দুজন মিস্ত্রী তাদের নাম বলো।
উত্তরঃ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ির কাঠের স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন যে দুজন মিস্ত্রি তাঁরা হলেন—ঘনশ্যামপুরের দুই মণিপুরী মিস্ত্রি ভীম সিং এবং খাওজাং সিং।
৪। খোয়াই নিয়ে যে গান লিখেছেন তা লেখো।
উত্তরঃ খোয়াই নিয়ে যে গান লিখেছেন তা হলো— “আমার গাঁয়ের শীর্ণ নদীটির শীতল জলে। চাঁদের ডিঙা ভেসে চলে।”
৫। ‘শান্ত, শিষ্ট’ লাজুক মেয়েটি।’—এখানে কার কথা বলা হল?
উত্তরঃ এখানে খোয়াই নদীর কথা বলা হল।
৬। লেখকের অনুসরণে খোয়াইয়ের বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ খোয়াই ছিল শুকনো নদী। বালির চর ঝিলমিল ঝিলমিল করে। পশ্চিমে বয়ে যাওয়া শীর্ণস্রোতা, ঝলমল বালুর পাহাড়ী নদী। সাধারণ নদীর মতো নয়—অন্যরকম কিছু জাগাত লেখকের মনে।
৭। ‘এ আমার কাছে এক আশ্চর্যবোধ নিয়ে আসত।’—উক্তিটি কার? প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ উক্তিটি লেখক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের।
লেখকদের ঘাটটি ছিল খোয়াইয়ের ক্ষেমেশ্বরী ঘাট। কোনো কোনো পণ্ডিত বলতেন ক্ষেমঙ্করী। জায়গাটি খুব উল্লেখযোগ্য—সেই ঘাটে গাঁয়ের সব মৃতদেহ দাহ করা হত। শ্মশানঘাটে সবসময়েই পড়ে থাকত কোনো বিছানা, কলস, পাটি, শ্মশানচূড়া বা নিশান। বিছানাগুলি খুব তাড়াতাড়ি চুরি হয়ে যেত। মানুষের চরম দারিদ্র্য যেন ভয়ের আগ্রাসী ক্ষমতাকে হার মানাত। মৃতের দ্রব্য ঘরে নেওয়া অমঙ্গল—এই ভয়কেও ছাড়িয়ে যেত দারিদ্র্যের প্রয়োজন। এই ঘটনাটি লেখকের মনের মধ্যে আশ্চর্য অনুভূতি জাগাত।
৮। আননপুর কী?
উত্তরঃ লেখকের গ্রামের দক্ষিণে একটানা ধানের মাঠ, তারপরে আশলা, আননপুর এইসব গ্রাম।
৯। ‘বাল্লা’ কী?
উত্তরঃ ‘বাল্লার’ বর্তমান নাম খোয়াই। লেখকের বাড়ির কাছের রেলস্টেশন খোয়াই।
১০। লেখকের অনুসরণে সেকালের দুটি রেল স্টেশনের নাম বলো।
উত্তরঃ লেখকের অনুসরণে সেকালের দুটি রেলস্টেশন হল—লস্করপুর এবং সাটিয়াজুরি।
১১। অমলা দত্ত কেন বিখ্যাত বলো।
উত্তরঃ রায়বাহাদুর প্রমোদ দত্তের মেয়ে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য অমলা দত্ত সম্ভবত সিলেটের প্রথম গায়িকা যিনি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করেছিলেন।
১২। নীলাম্বর চক্রবর্তী কে?
উত্তরঃ লেখকের বাড়ির কাছেই ছিল নীলাম্বর চক্রবর্তীর বাড়ি। শ্রীচৈতন্যদেবের মা শচীদেবীর পিতৃগৃহ।
১৩। মিরাশী কী কী কারণে বিখ্যাত সবিস্তারে লেখো।
উত্তরঃ লেখকের পরগণার নাম তরপ। ত্রিপুরার মহারাজার অধীনে সামন্তরাজ আচাকনারায়ণ ছিলেন গ্রামের তরপ পরগণার রাজা। গ্রামের এলিট সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলেন শিক্ষিত ছোট ছোট জমিদার, চাকুরিজীবী এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। লেখকের মন্ত্রী রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্রের বাড়ির জন্য মিরাশী বিখ্যাত। তিনি ১৯২২ সালে অসমের শিক্ষামন্ত্রী হন। পরবর্তীকালে গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলারও হন। স্ত্রীশিক্ষার মাপকাঠিতে মিরাশী যথেষ্ট বিখ্যাত ছিল। রায়সাহেব মহেন্দ্র দত্তের মেয়ে সুপ্রভা দত্ত পরে কলকাতার ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। রায়বাহাদুর প্রমোদ দত্তের মেয়ে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য অমলা দত্ত সিলেটের প্রথম গায়িকা যিনি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করেছিলেন। হবিগঞ্জ সাবডিভিশনের জলশুকা গ্রামের রেবা রায়, শিক্ষিত ঘরের হয়ে, যিনি প্রথম প্রকাশ্য মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শনের সাহস দেখিয়েছিলেন।
গ্রামের শিক্ষিতদের একটা বড়ো অংশ ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা স্মৃতিতীর্থ, সাংখ্যতীর্থ, ষড়দর্শনতীর্থ প্রভৃতি। এদের টোলগুলিতে ছাত্ররা আসত বাইরে থেকে, তারা গুরুর বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করত।
পুব মিরাশীর দত্তদের মধ্যে ডাক্তার, উকিল, হাকিম, পুলিশ-অফিসার প্রভৃতি ছিল। কিন্তু পশ্চিম মিরাশীর বিশ্বাস এবং চৌধুরীরা জমিদারির আভিজাত্য নিয়েই থাকতে ভালোবাসত। পরের চাকরি করার মনোবৃত্তি ছিল না।
১৪। দ্বারকানাথ চক্রবর্তী কে? তিনি কোন গ্রামে বসবাস করতেন?
উত্তরঃ দ্বারকানাথ চক্রবর্তী লেখকের গ্রামের স্কুলের হেডমাষ্টার। তিনি আসতেন মিরাশী গ্রামের উত্তরে গাভীগাঁও থেকে। সেখানে অনেক শিক্ষিত লোকের বসবাস। দ্বারকানাথবাবু শুধু শিক্ষিত নন-তিনি গান ভালোবাসতেন, নিজে গান গাইতেন। তিনিই প্রথম লেখককে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ান স্কুলের অনুষ্ঠানে।
১৫। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পিতা মাতার নাম লেখো।
উত্তরঃ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পিতার নাম হরকুমার বিশ্বাস এবং মায়ের নাম সরোজিনী বিশ্বাস।
১৬। কুলগুরু কে ছিলেন?
উত্তরঃ কুলগুরু ছিলেন মৌলভিবাজারের গোঁসাই বংশের গোঁসাইজি।
১৭। জয়নাথ নন্দী কে? তিনি কীভাবে রায়সাহেব উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন?
উত্তরঃ জয়নাথ নন্দী একজন কবি, সম্পর্কে লেখকের দাদু। জয়নাথ নন্দী কবিয়াল হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর একটি কবিদলও ছিল। জয়নাথ নন্দী শিক্ষিত হলেও কৃষির প্রতি টান অনুভব করতেন। তিনি ছিলেন রীতিমতো কৃষি বিশেষজ্ঞ। তাঁর ফলানো গোল আলু সারা সিলেটের কৃষি প্রদর্শনীতে প্রথম হয়েছিল। তদানীন্তন আসাম গভর্নর বিটসন্ বেল প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন। জয়নাথ নন্দীকে এই কৃতিত্বের জন্য “রায়সাহেব” উপাধিতে ভূষিত করেন।
টীকা লেখো–
অমলা দত্ত — মিরাশী গ্রামে বসবাসকারী রায়বাহাদুর প্রমোদ দত্তের মেয়ে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা অমলা দত্ত সম্ভবত সিলেটের প্রথম গায়িকা যিনি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করেছিলেন।
সুপ্রভা দত্ত — রায়সাহেব মহেন্দ্র দত্তের মেয়ে সুপ্রভা দত্ত কলকাতার ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন।
রেবা রায় — হবিগঞ্জ সাবডিভিশনের জলশুকা গ্রামের রেবা রায় শিক্ষিত ভদ্রঘরের মহিলা হয়ে প্রথম প্রকাশ্য মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শনের সাহস দেখিয়েছিলেন। সেই সময় রেবা রায় বহু বিতর্ক ও চাঞ্চল্যের কারণ হয়েছিলেন। তাঁর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন ছিল।
হেতিমের মা — সৈয়দাবাদের ইমদাদুল্লা গরিব চাষী –চাষ আবাদে ওস্তাদ। তাঁর জমির রসালো আখ খাবার লোভ খুব ছিল। তিনি প্রায় আখ চুরি করে খেতেন। কিন্তু ইমদাদুল্লার চাইতেও লেখম হেতিমের মাকে বেশি ভয় পেতেন। যেমন চেহারা তেমনি গলা। মুসলমান মহিলা হলেও তিনি পর্দানসীন ছিলেন না। সে ছিল “ধান-ভানা” মেয়ে, ঢেঁকির গোড়ায় হেতিমের মায়ের পা পড়লেই ঢেঁকি বাধ্য ছেলের মতো কাজ করতো। হেতিমের মা লেখকের বাড়িতে প্রায়ই যেত ভাঙার ধান আনার জন্য। তার প্রাপ্য ছিল তুষ, ক্ষুদ এবং চালের অতি সামান্য এক ভাগ। মায়ের সঙ্গে লেখকের খুব খাতির ছিল। ঘরের সিমেন্টের মেঝেতে চৌকাঠের এপাশে আর ওপাশে লেখকের মা এবং হেতিমের মা বসত। গলার বড়ো হাঁসলিটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনেক কথা বলত। হেতিমের মা যদি কোনদিন মাঠে ছেলেদের দুষ্টমি করতে দেখত তাহলে বাজখাঁই গলায় বলত— “ঠাকরাইনরে গিয়া মু কইয়া দিমু”। তখনই মাঠের আনন্দ ছেড়ে সকলে ভালো ছাত্রের মতো স্কুলের দিকে রওনা দিত।
রূপসী গাছ — লেখক যে মাঠে খেলাধূলা করতেন সেই মাঠের মাঝখানে ছিল একটা “রূপসী গাছ”। গাছটিকে ঘিরে ছিল গোল মাটির বেদি। সেখানে গ্রামের লোক পুজোর পরে শীতলা, মনসা বা বনদুর্গার সব মূর্তি রেখে যেত। ঝড়বৃষ্টিতে মূর্তিগুলি ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ত। স্কুলের পর কোনোদিন খেলার শেষে এ জায়গায় এলে লেখক ভয় পেতেন। একটি শ্যাওড়া গাছকেই বিশেষ মর্যাদায় “রূপসী” গাছ তৈরি করা হত। বিশেষ করে নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করলে মেয়েরা ষষ্ঠ দিনে গান গেয়ে সেখানে মঙ্গল কামনা করতে আসত। গানের রেশটি লেখক এখনো মনে রেখেছেন—রূপসীর দরিশনে যাইবায়নি গো সই।
উ বালিউয়েল — গাভীগাঁও-এর সুরেশ রায় শিলঙের একজন বড় অফিসার ছিলেন। তিনি যখন বাড়ি ফিরতেন তখন লেখক এবং তাঁর বন্ধুরা তাঁর কাছ থেকে রাজধানীর অনেক গল্প শুনতেন। সেই সূত্রেই শিলংয়ের রবিনহুড ‘উ বালিউয়েল’ যার ভয়ে সাহেবরা সন্ত্রস্ত থাকত। বেশ কিছুদিন পরে গৌহাটি সেন্ট্রাল জেলে তার সঙ্গে লেখকের বন্ধুত্ব হয়েছিল।
ওঁ বাবা — পুরোহিততন্ত্রের জালে লেখকের পরিবার বাঁধা ছিল। বাড়ির পাহারাদার ছিলেন অসংখ্য দেবদেবী। লেখকের পরিবারে একজন জীবন্ত অবতার জুটেছিলেন—তিনি হলেন ওঁ বাবা। আলিপুর বোমার মামলার এক পলাতক আসামী ছিলেন—প্রকৃত নাম সতীশ চট্টোপাধ্যায়। গেরুয়া পরে মুক্তানন্দস্বামী নামে আত্মগোপন করেছিলেন। পরে আসামের সীমান্তে পরশুরাম কুণ্ডে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আসামের তদানীন্তন অগ্রণী চিকিৎসক। ডিব্ৰুগড় মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ কে. পি. বসু—তাঁকে ডিব্রুগড়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। গ্রামের ডাঃ চন্দ্রকুমার দত্ত ছিলেন আসামের সিভিল সার্জেন—কে. পি. বসুর সাথী। তিনি এসে লেখকের বাবাকে ওঁ বাবা সম্বন্ধে সুন্দর বর্ণনা দেন। লেখকের বাবা আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ডিব্ৰুগড়ে গিয়ে তিনি তাঁর কাছে দীক্ষা নেন।
জয়নাথ নন্দী — জয়নাথ নন্দীর কৃষির প্রতি ছিল অদ্ভুত মমতা। শেষ বয়সে তাঁর একটি নিজের সবজিবাগান ছাড়া কিছুই ছিল না। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর জীবন কেটেছে। তবুও তারই মধ্যে কিছু স্মরণীয় গান রচনা করে গিয়েছেন। তাঁর রচিত একটি কবিগান হল–
দুঃখী ভারতবাসী চাষা/তাদের দশা কী বর্ণিব হায় (তারা) শীতে বানে ঘোরে তুফানে/কত কষ্ট পায়/দিবা ও নিশায়।
ও হায়………….
সারাদিন মাঠে বেয়ে হাল
(কিন্তু) তাদের অতি পোড়া কপাল
হায় হায় রে….. ।
তারা দেশে ফলায় ধান চাল
ঘরে থাকে না মুষ্টি চাল।
উপত্যকা — অসমের ছিল দুটি উপত্যকা—ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং সুরমা উপত্যকা।
ক্ষেমেশ্বরী ঘাট — লেখকের গ্রামের ঘাটটি ছিল খোয়াইয়ের ক্ষেমেশ্বরী ঘাট। কোনো কোনো পণ্ডিত বলতেন ক্ষেমঙ্করী। সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা— ক্ষেমঙ্করী ঘাটে আশেপাশের গ্রামের সব মৃতদেহ দাহ করা হত। শ্মশানঘাটে সবসময়েই বিছানা, কলস, পাটি, শ্মশানচূড়া বা নিশান পড়ে থাকত।
ছমীর মিঞা — লেখক স্কুলে যেতেন সৈয়দাবাদ গ্রামের কোণা দিয়ে। সেই তল্লাটের বীরপুরুষ ছমীর মিঞার সাথে প্রায় সাক্ষাৎ হত। দূর থেকে লেখক তাঁকে ডাকতেন— “বাঘে- খাউরা-ছমীর”। তিনি ভূমিহীন চাষি। তার প্রধান জীবিকা ছিল পুব পাহাড়ের মৌচাক ভেঙে মধু বিক্রি করা। ছমীর নিজে মধু খাক বা না খাক ছমীরের দৌলতে গরম চাকভাঙা মধু লেখক অনেক খেয়েছেন।
মধু বিক্রেতা ছমীর মিঞার জীবন ছিল ভয়ংকর। মধু খেতে ভালুক নাকি ভালোবাসে, ছমীর মিঞার সাথে ভালুকের তিনবার লড়াই হয়েছে পাহাড়ে। একবার চিতাবাঘের সঙ্গে তার ধারালো দা-এর ঘা খেয়ে বাঘ ঘায়েল হয়ে পালিয়েছিল। সঙ্গীরা বাঁশের দোলায় বাঘের ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে গ্রামে এসেছিল। ছমীরের মুখে ঘাড়ে সর্বত্র ছিল মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন, কাঁধ ঝুলে গিয়েছিল, সেজন্য সে একটু হেলে লেংচে লেংচে হাটত। লেখক তাঁকে শ্রদ্ধাও করতেন ভয়ও পেতেন। সামনা সামনি পড়লেই তার দাগকাটা মুখে একগাল হেসে বলত—“কিতাবা লালুবাবু—ইস্কুল যাওনি”। লেখক স্কুলে যান, কিন্তু বাঘে-খাউরা ছমীর লেংচে লেংচে পাহাড়ে যায়—বগলে দা, হাতে আগুন ধরাবার খড়ের লম্বা “বিরুনি”। জঙ্গলে সে মৌচাক ভাঙে। বাঘ ভালুকের ভয় তার থাকে না।
গণনাট্য আন্দোলন — গণনাট্য হল নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে সাম্প্রতিকতম সংযোজন। প্রধানত সমকালীন সমাজের দর্পণরূপে এই নাটকের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটলেও এই জাতীয় নাটকে বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, খাদ্য সমস্যা এবং সময় সময় রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রধান বিষয়বস্তু রূপে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। এই নাটকগুলি প্রধানত “নবনাট্য সংঘ” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রথম বাংলার কৃষক সমাজের প্রতি অত্যাচার ও উৎপীড়নের চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়েছিল দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ” নাটকের মাধ্যমেই। সেখানে নীলকর সাহেবদের দ্বারা নীল চাষীরা যে নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার সহ্য করেছিল তার মর্মস্পর্শী উপস্থাপন ঘটানো হয়েছে। নাট্যবিশারদদের অভিমত এই নাট্যরীতির মধ্যেই গণনাট্যের বীজ লুক্কায়িত রয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাতে যে অজন্মা ও খরা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল তার পরিণতি হিসেবে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে দেখা দেয় অভূতপূর্ব মন্বন্তর। রাষ্ট্রনৈতিক মদত প্রচ্ছন্নভাবে এই মন্বন্তরের পেছনে কাজ করে গেছে। এই পটভূমিতে নট ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচনা করেছিলেন “নবান্ন” নাটক। এই ‘নবান্নে’র মধ্য দিয়েই ঘটেছে গণনাট্যের সার্থক প্রকাশ। এই সময় উৎপল দত্ত, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী, সলিল সেন প্রমুখ নাট্যকারগণ যুদ্ধোত্তর বাংলার সমাজ সমস্যার ভয়াবহ রূপটিকে নাটকের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে গণনাট্য একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়ে একটি স্বতন্ত্র নাট্যরীতির পত্তন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ধারার অন্যতম প্রেরণাস্থল বলে চিহ্নিত হয়েছে নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন। নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে এটি একটি সম্পদ বিশেষ।
দিগিন বন্দোপাধ্যায়ের ‘অন্তরঙ্গ’, ‘তরঙ্গ’, ‘বাস্তুভিটা’, ‘মোকাবিলা প্রভৃতি। তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়াতার’, ‘উলুখাগড়া’, ‘পথিক’। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’, ‘যতুগৃহ’, ‘মরাচাঁদ’, ‘জননেতা’। উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’ ইত্যাদি নাটক উল্লেখযোগ্য।
গোবর্ধন — গোবর্ধন ছিলেন লেখকের স্কুলের সহপাঠী। বাবা চাষী হলেও কিছুটা সম্পন্ন। সেজন্য ছেলেকে মানুষ করার জন্য পড়াশোনা করাচ্ছে। গোবর্ধন পড়াশোনায় ভালো ছিল না। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলেই প্রবীণ মাষ্টার রজনী দত্ত নাকের ওপর ঝুলন্ত চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ বের করে হেড়ে গলায় তিরস্কার করতেন। লেখক বন্ধুর তিরস্কৃত হওয়া পছন্দ করতেন না।
দীননাথ শীল — দীননাথ শীল ছিলেন লেখকের অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ যাত্রাভিনেতা এবং দলের অধিকারী। দলের নামই ছিল “দীননাথ শীলের দল”। বাড়ি ছাড়ার পর লেখকের সঙ্গে শিলঙে তাঁর দেখা হয়েছিল। যাত্রা করতে গিয়ে শীতের মধ্যে দারিদ্র্যে, কষ্টে অবস্থা খুব খারাপ। লেখকেরা কয়েকজন মিলে লাবান্ এর “আসামিস্ হল” ভাড়া করে তাদের যাত্রা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। সেখানকার আসাম ক্লাব এবং বাঙালি হরিসভার সাহায্যে কিছু টাকারও ব্যবস্থা হয়।
দীর্ঘ উত্তর লেখো
১। প্রমোদচন্দ্র দত্ত কে? তাঁর সম্পর্কে যা জান লেখো।
উত্তরঃ প্রমোদচন্দ্র দত্ত ছিলেন মন্ত্রী।
রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র ছিলেন মিরাশী গ্রামের গর্ব। ১৯২২ সালে তিনি আসামের শিক্ষামন্ত্রী হন। পরবর্তীকালে গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলার হন।
২। ছমীর মিঞার জীবন সম্পর্কে যা জান লেখো।
উত্তরঃ লেখক স্কুলে যেতেন সৈয়দাবাদ গ্রামের কোণা দিয়ে। সেই তল্লাটের বীরপুরুষ ছমীর মিঞার সাথে প্রায় সাক্ষাৎ হত। দূর থেকে লেখক তাঁকে ডাকতেন—“বাঘে-খাউরা-ছমীর”। তিনি ভূমিহীন চাষি। তার প্রধান জীবিকা ছিল পুব পাহাড়ের মৌচাক ভেঙে মধু বিক্রি করা। ছমীর নিজে মধু খাক বা না খাক ছমীরের দৌলতে গরম চাকভাঙা মধু লেখক অনেক খেয়েছেন।
মধু বিক্রেতা ছমীর মিঞার জীবন ছিল ভয়ংকর। মধু খেতে ভালুক নাকি ভালোবাসে, ছমীর মিঞার সাথে ভালুকের তিনবার লড়াই হয়েছে পাহাড়ে। একবার চিতাবাঘের সঙ্গে তার ধারালো দা-এর ঘা খেয়ে বাঘ ঘায়েল হয়ে পালিয়েছিল। সঙ্গীরা বাঁশের দোলায় বাঘের ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে গ্রামে এসেছিল। ছমীরের মুখে ঘাড়ে সর্বত্র ছিল মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন, কাঁধ ঝুলে গিয়েছিল, সেজন্য সে একটু হেলে লেংচে লেংচে হাটত। লেখক তাঁকে শ্রদ্ধাও করতেন ভয়ও পেতেন। সামনা সামনি পড়লেই তার দাগকাটা মুখে একগাল হেসে বলত—“কিতাবা লালুবাবু—ইস্কুল যাওনি”। লেখক স্কুলে যান, কিন্তু বাঘে-খাউরা ছমীর লেংচে লেংচে পাহাড়ে যায়—বগলে দা, হাতে আগুন ধরাবার খড়ের লম্বা “বিরুনি”। জঙ্গলে সে মৌচাক ভাঙে। বাঘ ভালুকের ভয় তার থাকে না।
৩। লেখকের অনুসরণে তাঁর জীবনের যাত্রাভিনয়ের স্মৃতিকথা বর্ণনা করো।
উত্তরঃ মিরাশী গ্রামের উত্তরে কিছুটা এগোলেই গাভীগাঁও। এই গাভীগাঁও-এর কাছেই গোঁসাইনগর গ্রাম। এই গোঁসাইনগর গ্রামের যে তিনজন লেখকের স্মৃতিতে জড়িয়ে আছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন দীননাথ শীল। দীননাথ শীল ছিলেন সেই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ যাত্রাভিনেতা, এবং দলের অধিকারী, তাঁর দলের নাম ছিল ‘দীননাথ শীলের দল’। তাঁর সঙ্গে লেখকের শেষ দেখা হয় শিলঙে। শীতের মধ্যে যাত্রা করতে গিয়ে দারিদ্র্য ও কষ্টের মধ্যে তার অবস্থা তখন খুব খারাপ। লেখকরা কয়েকজন মিলে লাবান্-এর ‘আসমিস্ হল’ ভাড়া করে যাত্রানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ব্যবস্থার ফলে আসাম ক্লাব এবং বাঙালি হরিসভার সাহায্যে কিছু অর্থের বন্দোবস্ত হয়েছিল।
সেই দলের কমেডিয়ান ছিল গোবর্ধন। মঞ্চে তার উপস্থিতি সকলকে একটা ফুর্তির শিহরণ এনে দিত। নবদ্বীপ হালদার বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমতুল্য না হলেও গোবর্ধন ছিল লেখকের কাছে অসাধারণ অভিনেতা, অসাধারণ অভিনয় করত সে। গোবর্ধন ছিল একজন নিরক্ষর ভাগচাষি অথচ মঞ্চে তার অভিনয় দাপট ও রসবোধ প্রখর ছিল। বেশ কিছুদিন পরে, তিরিশের দশকের গোড়ায়, সাটিয়াজুরি যাবার পথে গোবর্ধনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে লেখক ভেঙে পড়েছিলেন। গোবর্ধনের শেষযাত্রার পরিস্থিতি দেখে লেখকের মনে হয়েছিল, এরকম একজন ওস্তাদ কমেডিয়ানের দুঃখীর মতো চলে যাওয়া উচিত হয়নি। আলোচ্য পাঠ্যাংশে লেখক এই যাত্রাভিনয়ের স্মৃতিকথা বর্ণনা করেছেন।
৪। ‘উজান গাঙ্ বাইয়া’ রচনায় লেখক যে কজন মাঠের মানুষের কৃতীর কথা বলেছেন তাদের দুজনের বিবরণ দাও।
উত্তরঃ কমেডিয়ান গোবর্ধন : গোবর্ধন ছিলেন দীননাথ শীলের যাত্রাদলের অভিনেতা। ছোট বড় সকলের কাছে তার উপস্থিতিই একটা ফূর্তির শিহরণ ছড়িয়ে দিত। তিনি নবদ্বীপ হালদার বা ভানু বন্দ্যোপাধায়ের সমতুল্য হলেও তাঁর স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। তিনি অসাধারণ অভিনয় করতেন। একজন নিরক্ষর চাষী, ভাগ চাষ করত অথচ মঞ্চে উঠলেই তাঁর দুর্দান্ত দাপট, তীব্র রসবোধ। এক ধরনের অশিক্ষিত পটুত্ব ছিল গোবর্ধনের অভিনয়ের মধ্যে—এক সহজাত genius, অথচ তাঁর কথা কেউ জানে না, কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। বহুদিন পরে তিরিশ দশকের গোড়ায়—সাটিয়াজুরি যাওয়ার পথে লেখক দেখলেন—পথে একটি ছোট্ট মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। আর সামনে বাঁশের গায়ে চাটাই দিয়ে বাধা একটি মৃতদেহ কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কার মৃতদেহ জানতে চাইলে মৃতদেহ বহনকারী লোকেরা বলল—গোবর্ধনের মৃতদেহ। আগের দিন খেতে হাল বাইছিল, বাজ পড়ে মারা গেছে। মর্মাহত লেখক শবযাত্রায় কিছুটা পথ সঙ্গ দিয়ে ফিরে গেলেন। কিন্তু ওস্তাদ এন্টারটেইনার কমেডিয়ান গোবর্ধনের মর্মান্তিক মৃত্যু তাঁকে শোকাহত করল।
মোয়াজ্জিন : লেখকের দেশে আউস ও শালিধানের খুব চাষ হত। মাঝে মাঝে আখের চাষ হত। ভোরবেলা কাক ডাকা ভোরে এক বেদনার্ত আর্তনাদ শুনে অনেকদিন লেখকের ঘুম ভেঙে যেত—কাঠের তৈরি আখপেষা কলে আখমাড়াইয়ের আওয়াজে। আবার মাঝে মাঝে আজানের উদাত্ত স্বরে লেখকের ঘুম ভেঙে যেত। আজানে পুকার দিতেন মোয়াজ্জিন। আজানের মধ্যে যে সুর ছিল—পরবর্তী সময়ে লেখক দেখলেন সেটি আহিরভৈরোঁর খুব কাছাকাছি সুর। লেখকের ছোটবেলার music বলতে ছিল আখমাড়াইয়ের গান আর আজানের ডাক।
৫। জয়নাথ নন্দী সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তরঃ শাক্ত কবি রাজকুমার নন্দীর পরিবারের সন্তান কবি জয়নাথ নন্দী। সম্পর্কে তিনি লেখকের দাদু। কবিয়াল হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর একটি কবিদলও ছিল। জয়নাথ নন্দী শিক্ষিত হলেও কৃষির প্রতি টান অনুভব করতেন। তিনি ছিলেন রীতিমতো কৃষি বিশেষজ্ঞ। তাঁর ফলানো গোল আলু সারা সিলেটের কৃষি প্রদর্শনীতে প্রথম হয়েছিল। সেই সময়ের আসাম গভর্নর বিটসন্ বেল্ প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন। জয়নাথ নন্দীকে এই কৃতিত্বের জন্য “রায়সাহেব” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ত্রিশের দশকের স্বদেশি আন্দোলনের ফল হিসেবে যা কিছু ব্রিটিশ প্রশংসিত তাই হাস্যাস্পদ হয়ে উঠেছিল।
জয়নাথ নন্দীর কৃষির প্রতি অদ্ভুত মমতা ছিল। শেষবয়সে তাঁর নিজের একটি সবজিবাগান ছাড়া আর কিছুই ছিল না–দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে তাঁর জীবন কেটেছে। তবু তারই মধ্যে বেশকিছু স্মরণীয় গান রচনা করেছেন। তাঁর রচিত একটি কবি গান হল –
দুঃখী ভারতবাসী চাষা/তাদের দশা কী বর্ণিব হায় (তারা) শীতে বানে ঘোর তুফানে/কত কষ্ট পায়/দিবা ও নিশায়।
ও হায়…
সারাদিন মাঠে বেয়ে হাল
(কিন্তু) তাদের অতি পোড়া কপাল
হায় হায় রে…..।
তারা দেশে ফলায় ধান চাল
ঘরে থাকে না মুষ্টি চাল।
এর পরবর্তী চিতান, পরচিতান ইত্যাদিতে গানটি একটু দীর্ঘ, যেমন কবিগান হয়ে থাকে। কিন্তু সুরের আশ্রয়ে গানটি তখনকার চাষীজীবনের দুঃখ দুর্দশা, অত্যাচার প্রতারণার বাস্তববাদী, দরদী এক কবি—যা তখনকার কবিয়ালদের গানে দুর্লভ ছিল। লেখক গায়ক নির্মলেন্দুকে নিয়ে এই গানটি নৈহাটির প্রাদেশিক গণনাট্য সম্মেলনে গেয়েছিলেন।
জয়নাথ নন্দী লেখকের বাড়িতে যেতেন আত্মীয়তাসূত্রে। লেখকের মাঝে স্নেহ করতেন। লেখক তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। লেখকের পরিবারে জমিদারীসুলভ গণ্ডগোলে মামলা মোকদ্দমা লাঠিবাজি লেগেই থাকত। জয়নাথ অত্যন্ত স্পষ্ট কঠিন ভাষায় লেখকের বাবা ও জ্যাঠাকে ভৎসনা করতেন। তিনি ধর্মকর্ম পূজা আচার বাঁধা নিয়মকে তুচ্ছ করতেন। দার্শনিক সত্তার অধিকার ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের ওপর। সাংসারিক সম্পদ, জমি, ব্যবসা না থাকার জন্য কোনো আফসোস ছিল না। জীবনকে দেখতেন এক নিরাসক্ত, দর্শনচারী ভঙ্গিতে। নক্ষত্রজগতের রোমাঞ্চকর কাহিনি এবং তাঁর বলার ভঙ্গি লেখককে মুগ্ধ করতো। তিনি শুনিয়েছিলেন—আলোর গতিবেগের কথা, মরা নক্ষত্রের আলোর কথা— যা শুনে লেখক উত্তেজনায় শিউরে উঠতেন।
টীকা –
জালালী কইতর — শ্রীহট্টবিজয়ী পীর শাহ্ জালাল চতুর্দশ শতাব্দীতে (১৩০১-১৪০০) সিলেটে পদার্পণ করেন। তিনি যুগল (জোড়া) কবুতর সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। এই কবুতর জালালী কইতর নামে পরিচিত।
বনগীত — অসমিয়া বনগীত একধরনের প্রেমসংগীত। সাধারণত যুবক-যুবতি মহলে এই গানের আদর বেশি। প্রাচীনকালে ওই গান বিহু অনুষ্ঠানে, মাঠে, বনে-বাদাড়ে সমবেতভাবে গাওয়া হত। কাঠ কাটতে গিয়ে কাঠুরিয়ারা বিহুর আবহাওয়ায় বনগীত গাইত। যৌবনের উদ্দীপনা প্রকাশক বনগীতগুলি কৃষিজীবনের আবেগমুখর কথা ও সুরের মূর্ত প্রকাশ। বনগীতে থাকে প্রাকৃতিক দৃশ্যের বাহার।