Class 10 Bengali Chapter 17 শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 10 Bengali Chapter 17 শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ and select needs one.
Class 10 Bengali Chapter 17 শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ
Also, you can read SCERT book online in these sections Class 10 Bengali Chapter 17 শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 10 Bengali Chapter 17 শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 10 Bengali Chapter 17 শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ for All Subject, You can practice these here…
শ্ৰীকান্ত ও ইন্দ্ৰনাথ
Chapter – 17
অনুশীলনীর প্ৰশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন ১। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর লেখো।
(ক) শ্রীকান্ত পাঠটি লেখকের কোন গ্রন্থের অন্তর্গত?
উত্তরঃ শ্রীকান্ত পাঠটি লেখকের শ্রীকান্ত (১ম পর্ব) গল্পের অন্তর্গত।
(খ) শ্রীকান্তের বন্ধুটির নাম কী?
উত্তরঃ শ্রীকান্তের বন্ধুটির নাম ইন্দ্রনাথ।
(গ) ইন্দ্রনাথ নির্জন জঙ্গলে কোন সুরে বাঁশি বাজাতো?
উত্তরঃ ইন্দ্রনাথ নির্জন জঙ্গলে সহজ রামপ্রসাদী সুরে বাঁশি বাজাতো।
(ঘ) হেডমাস্টার মহাশয় ইন্দ্রনাথের মাথায় কোন টুপি দেবার আয়োজন করেছিলেন?
উত্তরঃ হেডমাস্টার মহাশয় ইন্দ্রনাথের মাথায় গাধার টুপি দেবার আয়োজন করেছিলেন।
(ঙ) ইন্দ্ৰনাথ ক্লাশে কী দুষ্টুমি করেছিল?
উত্তরঃ ইন্দ্রনাথ ক্লাসে হিন্দুস্তানি পণ্ডিতের চুলের শিখা কেটে দিয়েছিল।
(চ) শ্রীকান্তের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ কোথায় হয়েছিল?
উত্তরঃ শ্রীকান্তের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ খেলার মাঠে হয়েছিল।
(ছ) শ্রীকান্তের মেজদা কয়বার এন্ট্রান্স ফেল করেছিলেন?
উত্তরঃ শ্রীকান্তের মেজদা দুবার এন্ট্রান্স ফেল করেছিলেন।
(জ) মেজদাদের বাড়ির দারোয়ান কাকে চোর বলে ধরেছিল?
উত্তরঃ মেজদাদের বাড়ির দারোয়ান ভট্চায্যিমশাইকে চোর বলে ধরেছিল।
(ঝ) নেকড়ে বাঘটি কোথায় লুকিয়ে বসেছিল?
উত্তরঃ উঠোনের একপ্রান্তে ঝোপের মধ্যে নেকড়ে বাঘটি লুকিয়ে বসেছিল।
(ঞ) শ্রীনাথের বাড়ি কোথায়?
উত্তরঃ শ্রীনাথের বাড়ি বারাসাতে।
(ট) ইন্দ্রনাথ কতবার মাছ চুরি করে বেঁচে এসেছিল?
উত্তরঃ ইন্দ্রনাথ বহুবার মাছ চুরি করে বেঁচে এসেছিল।
(ঠ) শ্রীনাথ আগের দিন শ্রীকান্তদের বাড়িতে কি সেজে গান গেয়েছিল?
উত্তরঃ শ্রীনাথ আগের দিন শ্রীকান্তদের বাড়িতে নারদ সেজে গান গেয়েছিল।
(ড) ইন্দ্রনাথ কাদের বাড়ির ছেলে?
উত্তরঃ ইন্দ্রনাথ রায়েদের বাড়ির ছেলে।
প্রশ্ন ২। সংক্ষিপ্ত উত্তর লেখো।
(ক) পিসিমা মেজদাকে অপরকে শাসন করবার ব্যাপারে কী উপদেশ দিয়েছিলেন?
উত্তরঃ পিসিমা মেজদাকে অপরকে শাসন করবার ব্যাপারে বলেছিলেন— “তোমাদের ভাগ্যি ভাল যে। সত্যিকারের বাঘ ভাল্লুক বার হয়নি, যে বীরপুরুষ তোমরা, আর তোমার দরওয়ানরা। ছেড়ে দাও বেচারীকে। আর দূর করে দাও দেউড়ির ঐ খোট্টাগুলোকে। একটা ছোট ছেলের যা সাহস, একবাড়ি লোকের তা নেই”।
(খ) শ্রীনাথ কে? সে কেন এসেছিল?
উত্তরঃ শ্রীনাথ একজন বহুরূপী। বারাসাতে তাঁর বাড়ি। সে প্রতি বছর একই সময় একবার করে রোজগার করতে আসে। কালও সে শ্রীকান্তদের বাড়িতে নারদ সেজে গান শুনিয়ে গিয়েছিল। ঘটনার দিন ছিনাথ এসেছিল বাঘ সেজে।
(গ) ইন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তরঃ ইন্দ্রনাথ রায়েদের বাড়ির ছেলে। তাঁর চরিত্রের প্রধান লক্ষণ নিঃশঙ্ক সাহস। কঠিন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামই তার স্বাভাবিক জীবনধর্ম। ইন্দ্রনাথ বুকভরা দুর্জয় সাহস নিয়ে নিশ্ছিদ্র নিশীথে খরস্রোতা নদীতে ক্ষুদ্র ডিঙি ভাসিয়ে দিয়ে মাছ চুরি করতে যায়।
(ঘ) স্কুল থেকে রেলিং পার হয়ে ইন্দ্রনাথের পলায়নের কারণ কী ছিল—তা লেখো।
উত্তরঃ শ্রীকান্তের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের যখন আলাপ হয় তখন সে স্কুলে আর পড়ে না। শোনা যায়—হেডমাষ্টার মহাশয় অবিচার করে তাঁকে গাধা আখ্যা দেবার আয়োজন করেছিল। এতে ইন্দ্রনাথ খুব মর্মাহত হয়। হেডমাষ্টারের প্রতি ঘৃণাবশত স্কুল ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল আর ফিরে যায় নি। বাড়ির অভিভাবকদের বহু চেষ্টাতেও ইন্দ্রনাথকে স্কুলমুখো করা যায়নি।
(ঙ) বৃদ্ধ রামকমল ভট্টাচার্য আফিং খেয়ে কি করেছিলেন?
উত্তরঃ বৃদ্ধ রামকমল ভট্টাচার্য আফিং খেয়ে অন্ধকারে চোখ বুজে হুঁকায় ধূমপান করছিলেন। শ্রীনাথ বাঘ সেজে যেদিন বাড়িতে এসেছিল সেদিন দারোয়ানেরা ব্যস্ততার মধ্যে অন্ধকারে রামকমল ভট্টাচার্যকে চোর ভেবে মারধর করে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিল।
(চ) ঘরের মধ্যে সকলের ভিড়ে পিসেমশায়ের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে যেভাবে প্রকাশ পেয়েছিল তার বিবরণ দাও?
উত্তরঃ হঠাৎ শ্রীনাথ বহুরূপী বাঘ সেজে এসে মেজদাদের বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছিল। সকলে ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েছিল। ঘরের মধ্যে সকলের ভিড়ে পিসেমশায়ের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। তিনি বলছিলেন— “সড়কি লাও—বন্দুক লাও”। শ্রীকান্তদের বাড়ির পাশে গগনবাবুদের একটি মুঙ্গে রি গাদা বন্দুক ছিল। পিসেমশায় সেটি দেখিয়ে কথাগুলি বলছিলেন।
(ছ) “চক্ষের পলকে বারান্দা খালি হয়ে বৈঠকখানা ভরে গেল” – বারান্দা খালি হওয়ার পরিস্থিতি বর্ণনা করো।
উত্তরঃ লেখকের পিসিমার বাড়িতে মেজদার তত্ত্বাবধানে যখন সকলে পড়াশোনায় মগ্ন রয়েছেন এমন সময় লেখকের পিঠের কাছে “হুম” শব্দ হবার সাথে সাথে হৈ চৈ-রৈ রৈ চিৎকার শুরু হয়ে যায়। জানা যায় যে বাড়িতে চিতাবাঘ ঢুকেছে। দেউরির পাহারাদারেরা রামকমল ভট্টাচার্যকে চোর ভেবে প্রহার করতে থাকে। পিসেমশাই তাঁর দুই ছেলেকে বগলে চেপে ধরে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করেন। সকলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারিদিকে বাঘ খুঁজতে লাগল ।
হঠাৎ পালোয়ান কিশোরী সিং “উহ বয়ঠা” বলে একলাফে বারান্দার উপর উঠে পড়লে শুরু হল ঠেলাঠেলি। দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য লোক একসাথে বারান্দায় উঠতে চায়। কেউ মুহূর্তমাত্র দেরি করতে চায় না। উঠোনের একপ্রান্তে ঝোপের মধ্যে দেখা যায় একটি বড় জানোয়ার বাঘের মতোই দেখতে। চোখের পলকে বারান্দা খালি হয়ে বৈঠকখানা ভরে যায়। সেখানে আর জনপ্রাণী নেই।
(ছ) “আচ্ছা, ওর মা কি বারণ করে না”— উক্তিটি কার? কখন, কেন তিনি এই উক্তি করেন তার বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ উক্তিটি পিসিমার।
একদিন রাত্রে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তেমনি অন্ধকার ছিল। কোথাও একটা গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছিল না। লেখক সে গ্রামেই তাঁর পিসির বাড়িতে ছিলেন। রাত্রি প্রায় বারোটা বাজে। এমন সময় সহজ রামপ্রসাদী সুরে মধুর বাঁশীর সুর ভেসে আসতে থাকে। বাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ছিল একটি প্রকাণ্ড ভাগের আম কাঠালের বাগান। সেই বাগানের ভিতর থেকেই সুর ভেসে আসছিল। পিসিমা বড়ছেলের কাছে জানতে চান—রায়েদের ইন্দ্র বাঁশি বাজাচ্ছে কিনা। বড়দা বলেসে ছাড়া এমন কাজ আর কে করতে পারে। বড়দার উত্তর শুনে পিসিমা এই ভয়ঙ্কর অন্ধকারে ওই অদূরবর্তী গভীর ভয়ানক জঙ্গলের কথা স্মরণ করে মনে মনে শিউরে উঠলেন। ভীত কণ্ঠে পিসিমা জানতে চান ইন্দ্রের মা কি ইন্দ্রকে বারণ করে না। কারণ গোসাইদের বাগানে বহু লোক সাপের কামড়ে মারা গিয়েছে। বড়দা জানায়—ওপাড়া থেকে এ পাড়ায় আসার সহজ পথটা ইন্দ্র বেছে নিয়েছে। তাঁর প্রাণের ভয়ও নেই, প্রাণের মায়াও নেই। তাঁর গন্তব্যস্থলে দ্রুত পৌঁছনো নিয়ে ব্যাপার। সে পথে যত বড় বিপদই থাকুক না কেন।
৩। রচনাধর্মী উত্তর দাও।
(ক) “মেজদার কঠোর তত্ত্বাবধানে” শ্রীকান্ত ও অন্য ভাইদের বিদ্যাভ্যাসের একটি সহজ বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ লেখকের পিসিমার বাড়িতে লেখক, তাঁর ছোড়দা, যতীনদা গম্ভীর প্রকৃতির মেজদার অনুশাসনে লেখাপড়া করতেন। সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে লেখক এবং তাঁর ভাইয়েরা প্রতিদিন প্রথামত বাইরের বৈঠকখানায় ঢালা বিছানার উপর রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে বই খুলে পড়তে বসতে হত। বাইরের বারান্দায় একদিকে পিসেমশায় ক্যাম্বিসের খাটের উপর শুয়ে সান্ধ্য তন্দ্রা উপভোগ করতেন। অপরদিকে বৃদ্ধ রামকমল ভট্টাচার্য আফিং খেয়ে অন্ধকারে চোখ বুজে থেলো হুকোয় ধূমপান করতেন। দেউড়িতে শোনা যেত হিন্দুস্থানী পেয়াদাদের তুলসীদাসী সুর।
মেজদার কঠোর তত্ত্বাবধানে ঘরের ভিতরে তিনভাই নিঃশব্দে পড়াশোনা করতেন। ছোড়দা, যতীনদা এবং লেখক পড়তেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে। দুবার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তৃতীয়বারের জন্য প্রস্তুত/হচ্ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির মেজদা। তাঁর প্রচণ্ড শাসনে একমুহূর্ত সময় নষ্ট করার উপায় কারো ছিল না। লেখকদের পড়ার সময় ছিল সাড়ে সাতটা থেকে নটা পর্যন্ত। এই সময়টুকুর মধ্যে কথাবার্তা বলে মেজদার যাতে “পাশের” পড়ার বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য তিনি প্রত্যেকদিন পড়তে বসেই কাঁচি দিয়ে কাগজ কেটে কুড়ি ত্রিশটি টিকিটের মতো বানাতেন। তার কোনোটাতে লেখা থাকত—“বাইরে”, কোনোটাতে “থুথু ফেলা”, কোনোটাতে “নাকঝাড়া”, কোনোটাতে “তেষ্টা পাওয়া” ইত্যাদি। যতীনদা একটি “নাকঝাড়া” টিকিট নিয়ে মেজদার সামনে ধরলো, মেজদা তাতে সই করে লিখে দিলেন—হুঁ—আটটা তেত্রিশ মিনিট থেকে আটটা সাড়ে চৌত্রিশ মিনিট পর্যন্ত অর্থাৎ এইটুকু সময়ের জন্য সে নাক ঝাড়তে যেতে পারে। ছুটি পেয়ে যতীনদা টিকিট হাতে উঠে যেতেই ছোড়দা ‘থুথু ফেলা’ টিকিট পেশ করলেন। মেজদা “না” লিখে দিলেন। সেজন্য ছোড়দা মুখ ভারী করে মিনিট দুই বসে থেকে “তেষ্টা পাওয়া” আর্জি দাখিল করে দিলেন। এবার মঞ্জুর হল। মেজদা সই করে লিখলেন—হুঁ-আটটা একচল্লিশ মিনিট থেকে আটটা সাতচল্লিশ মিনিট পর্যন্ত। পরোয়ানা নিয়ে ছোড়দা হাসিমুখে বের হতেই যতীনদা ফিরে এসে হাতের টিকিট দাখিল করলেন। মেজদা ঘড়ি দেখে সময় মিলিয়ে একটা খাতা বের করে সেই টিকিট আঠা দিয়ে আটকিয়ে রাখলেন। সমস্ত সাজ সরঞ্জাম মজুত থাকত তার হাতের কাছেই। সপ্তাহখানেক পরে এইসব টিকিটের সময় ধরে কৈফিয়ৎ তলব করা হত।
এইরূপে মেজদার অত্যন্ত সতর্কতায় ও সুশৃঙ্খলতায় কারোর সামান্যতম সময় নষ্ট হত না। প্রতিদিন এভাবে দেড়ঘণ্টা খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করে রাত নটার সময় লেখক এবং তার ভাইয়েরা ভিতর বাড়িতে শুতে যেতেন। লেখক মনে করেন তখন নিশ্চয়ই মা সরস্বতী তাঁদের কৃপা করতেন। পরের দিন স্কুলে যথাযোগ্য সম্মান লাভ করতেন। কিন্তু মেজদার ভাগ্য এতটাই খারাপ যে নির্বোধ পরীক্ষকেরা পড়াশোনায় “মনোযোগী” মেজদাকে কিছুতেই চিনতে পারল না। নিজের এবং অপরের লেখাপড়ার প্রতি এত প্রবল অনুরাগ, সময়ের মূল্য সম্বন্ধে এমন সূক্ষ্ম দায়িত্ববোধ থাকলেও তাঁকে বারবার ফেল করিয়ে দিত। এটি অদৃষ্টের পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
(খ) ইন্দ্ৰনাথ কলম ফেলে নৌকার দাঁড় হাতে নিয়েছিল কেন? তার বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ শরৎচন্দ্র-সৃষ্ট ইন্দ্রনাথ চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার—ইন্দ্রনাথ এক মহাবিস্ময়। তার স্বল্পপরিসর জীবনে যে বিচিত্র গুণাবলীর সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় একটি পূর্ণায়ত দীর্ঘজীবনে সেই গুণাবলীর খুব সামান্য অংশই প্রত্যক্ষীভূত হয়। শ্রীকান্তের সঙ্গে যখন তার পরিচয় হয় তখন সে শৈশব অতিক্রম করে কৈশোরে পদার্পণ করেছে এবং সেই কৈশোর বয়সের মধ্যেই জীবনবৃত্ত সম্পূর্ণ করে পাঠকের বিস্ময়ের এক বৃহত্তর অংশকে অধিকার করে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাঠকের সেই বিস্ময়বোধের সঙ্গে মিশে থাকে ইন্দ্রনাথের জন্য শ্রদ্ধাবিমিশ্র একবিন্দু অশ্রুজল ও জীবনব্যাপী হাহাকার। ইন্দ্রনাথের জীবনে কিশোর হৃদয়ের সাহস, নির্লিপ্ততা, চঞ্চলতা, পরোপচিকীর্ষা প্রভৃতি সর্ববিধ বৈশিষ্ট্যের সর্বোত্তম সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু তা’ বলে তার জীবনকে এ্যাডভেঞ্চারমুখী বীরধর্মাশ্রিত হঠকারী কিশোরের জীবন বলে ব্যাখ্যা করা যুক্তিযুক্ত হবে না। কেননা, তার জীবনে নিঃস্বার্থপরতা, পরদুঃখকাতরতা এবং সর্বোপরি সংস্কারমুক্ত উদার মানসিকতা সাধারণ কিশোরের সংজ্ঞায় বিচারের অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এমনকি বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য কিশোর চরিত্রের পর্যালোচনা করেও তার প্রকৃত দোসর মেলে না। ড. সুবোধ সেনগুপ্ত বলেছেন, “এক ব্যারির পিটার প্যানের কথা এই সম্পর্কে মনে আসিতে পারে।” তাঁকে অনুসরণ করেই বলা যায় যে, পিটার প্যানের জন্য ব্যারি যে পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন তা’ রূপকথার ইন্দ্রজালে ঘেরা। তার ঐশ্বর্য অবিসংবাদিত; তার সাংকেতিকতা কল্পনাকে দোলা দেয়। তবু বস্তুজগতের সঙ্গে তার সংস্রব ক্ষীণ এবং তাঁর রূপে আমরা মুগ্ধ হলেও আমাদের সন্দেহপরায়ণ বুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে নিরস্ত হয় না। কিন্তু ইন্দ্রনাথ রূপকথার রাজ্যে বাস করে না, সে ইঙ্গিতের সাহায্যে আমাদের চকিত করে না। তার সংযোগ কঠিন বাস্তবের সঙ্গে হলেও তার জীবনাচরণে রোমান্সের পরমাশ্চর্যময় সুদূরতা আছে।
ইন্দ্রনাথের চরিত্রের প্রধান লক্ষণ তার নিঃশঙ্ক সাহস। জীবনকে একান্ত আপনার, নিজস্ব করে পাবার ব্যাকুলতাই তাকে অসম সাহসী করেছে। সে জীবনের আনন্দব্রতী কিশোর, ভয়ের সঙ্গে সে চির অপরিচিত। সেই আনন্দব্রতের ধারাই হল জীবনকে মৃত্যুর সঙ্গে সমান পাল্লা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা। সেজন্য সে বুকভরা দুর্জয় সাহস নিয়ে নিশ্ছিদ্র নিশীথে খরস্রোতা নদীতে ক্ষুদ্র ডিঙি ভাসিয়ে বিপদসঙ্কুল পরিবেশে মাছ চুরি করতে যায়। সেখানে কালান্তক যম-সদৃশ জেলেদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সাপ, বুনো শুয়োর প্রভৃতি জন্তুর প্রাণঘাতী আক্রমণকে স্বেচ্ছাবরণ করতেও সে বিন্দুমাত্র ভীত হয় না। জীবনের চরম পরিণতি ‘মরতে একদিন ত হবেই ভাই’ জেনে মৃত্যুর পশ্চাদ্ধাবনকে পিছে ফেলে জীবনের অনব্রত উদযাপনের জন্য সে এগিয়ে চলে। কঠিন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামই তার স্বাভাবিক জীবনধর্ম। অন্যের কাছে যা প্রতিকূল তার কাছে তা-ই অনুকূল ; যে পৃথকে অপরে কণ্টকাকীর্ণ মনে করে, সেই পথই তার পক্ষে কুসুমাস্তীর্ণ। মাছ চুরি করে ফেরার সময় জেলেরা আক্রমণ করলে খরস্রোতা গঙ্গাবক্ষে আত্মরক্ষার অসম্ভব ব্যাপারকে অতি সরল সহজভাবে শ্রীকান্তকে বুঝিয়েছে, ‘দ্যাখ শ্রীকান্ত, কিছু ভয় নেই—ব্যাটাদের চারখানা ডিঙি আছে বটে—কিন্তু যদি দেখিস ঘিরে ফেল্ল বলে—আর পালাবার জো নেই, তখন ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে একডুবে যতদূর পারিস গিয়ে ভেসে উঠলেই হল। তারপর সতুয়ার চড়ায় উঠে ভোরবেলায় সাঁতরে এপারে গঙ্গার ধার ধরে বাড়ি ফিরে গেলেই বাস্!’ শ্রীকান্ত এই প্রস্তাবে হতবাক, কিন্তু ইন্দ্রনাথের পক্ষে এই অভিযান উপভোগ্য।
ইন্দ্রনাথের যে বৈশিষ্ট্যটি আমাদের সবচাইতে বেশি অভিভূত করে তা হল তার চরিত্রের মহামানবসুলভ গুণাবলীর সমাবেশ। মানব চরিত্রের সাধারণ নিয়মে তার চরিত্র বাঁধা নয়। শ্রীকান্তের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎকারটি ঘটেছিল একটি বিপর্যয়ের মুহূর্তে। খেলার মাঠে শত্রুপরিবেষ্টিত শ্রীকান্তকে অপরিচিত ইন্দ্ৰনাথ হঠাৎ উপস্থিত হয়ে মুক্ত করে এবং নিজে বিপদের ঝুঁকি অযাচিতভাবে নিয়ে শ্রীকান্তের নিরাপত্তা বিধানকে সেদিন তার অবশ্য কর্তব্য বলেই বিবেচনা করে। এই কর্তব্যের তাগিদ যে প্রাণ থেকে আসে সে প্রাণ আমাদের ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ সৰ্বস্ব সংকীৰ্ণ, ক্ষুদ্র, স্বার্থসচেতন এবং সদা ভয়ে ভীত প্রাণ নয়। শ্রীকান্তের সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হলে ইন্দ্রনাথ তাকে মাছ চুরি করার সহকারী হিসাবে নিয়ে গিয়ে সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিঃশব্দে অকুণ্ঠচিত্তে নিজে বহন করেছে। ভীষণ মৃত্যুর মুখে নিজে নেমে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু শ্রীকান্তকে একবার বলেনি ‘শ্রীকান্ত, তুই একবার নেমে যা’। জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই বয়সে এই স্বার্থত্যাগের নজির দুর্লভ। সেজন্য তার মতো মহাপ্রাণ যে শ্রীকান্ত সমগ্র জীবনব্যাপী অন্বেষণ আর একটা খুঁজে পেল না সে জন্য তার আক্ষেপের অন্ত নেই। বিশ্রস্রষ্টার সৃষ্টি ক্ষমতার এটা একটা নিদারুণ অক্ষমতা বিবেচনা করে শ্রীকান্ত তার প্রৌঢ় জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছে অত্যন্ত আক্ষেপের সুরে অভিযোগ করে বলেছে, ‘কিন্তু এত বড় একটা মহাপ্রাণ আজ পর্যন্ত তুমিই বা কয়টা দিতে পারিলে?’
(গ) “চল, তোকে ফিরে রেখে আসি কাপুরুষ”—কে, কাকে উদ্দেশ্য করে এরূপ উক্তি করেছে? এর কারণ বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে এরূপ উক্তিটি করেছে।
ঘন নিশীথ রাত্রে খরস্রোতা গঙ্গাবক্ষে ক্ষুদ্র ডিঙি নৌকায় দুই অভিযাত্রী ইন্দ্ৰনাথ ও শ্রীকান্ত। ইন্দ্রনাথ এই অভিযানকালে শ্রীকান্তকে ‘কাপুরুষ’ বলে তিরস্কার করেছে। ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে খুব সন্তর্পণে প্রহরারত জেলেদের অজ্ঞাতে খালের মধ্য দিয়ে ডিঙি-নৌকা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলে। এছাড়া ইন্দ্র জানায় যে জেলেরা জানতে পারলে লগির আঘাতে মাথা ফাটিয়ে পাঁকের মধ্যে পুঁতে ফেলবে এমন ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা। শ্রীকান্ত প্রত্যুত্তরে ঐ পথ ত্যাগ করে অপর পথে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ইন্দ্রনাথ জানায় ঐ পথ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। শ্রীকান্ত ইন্দ্ৰনাথকে মাছ চুরি করার প্রয়োজন নেই জানিয়ে হঠাৎ নৌকার দাঁড় তুলে নিলে নৌকা বেসামাল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তের প্রতি ভীষণ রুষ্ট হয়ে তাকে ‘কাপুরুষ’ বলে তিরস্কার করে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসার কথা বলে।
শ্রীকান্ত তখন চৌদ্দ বৎসর পার করে পনেরো বৎসর বয়সে পদার্পণ করেছে। এই কিশোর বয়সে শ্রীকান্তের নবোদ্ভিন্ন ব্যক্তিত্ব এরূপ তিরস্কারে ভীষণ অপমানাহত হয়। সেজন্য শ্রীকান্ত কাপুরুষ আখ্যার গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে তার কিশোর-ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটিয়ে সশব্দে পুনরায় দাঁড় টানতে শুরু করে। ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে ‘কাপুরুষ’ বলে তিরস্কার করায় এই ভাবে তার প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটে।
নিবিড় নিশীথ অন্ধকার রাত্রে খরস্রোতা গঙ্গাবক্ষে ভাসমান একটি ডিঙি নৌকায় শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথের সহগামী হিসাবে চলেছে। নৌকার দাঁড় ইন্দ্রের হাতে। লক্ষ্যস্থল শ্রীকান্তের অজ্ঞাত এবং চেষ্টা করলেও লক্ষ্যস্থল এই জুটিতেও অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হওয়া সম্ভব নয়। অথচ ইন্দ্রনাথ যে তার লক্ষ্য সম্পর্কে স্থির নিশ্চয় তার প্রমাণ অচিরেই মিললো। ইন্দ্রনাথ দুটি চড়ার মধ্যে প্রবাহিত খালের মতো সংকীর্ণ জলপথের বিপরীত দিকে ডিঙি পরিচালনা করে নিয়ে গিয়ে প্রহরারত জেলেদের দৃষ্টি এড়িয়ে বুনো ঝাউগাছের মধ্য দিয়ে সেই সংকীর্ণ খালে ঢুকলো। জেলেদের ব্যূহ ভেদ করে মাছ চুরি করার জন্য ডিঙি নৌকার এই সতর্ক পরিচালনায় ইন্দ্রনাথ মাঝিগিরিতে যেমন প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তেমনি জেলেদের পশ্চাদ্ধাবনকে ব্যর্থ করে দিয়ে ডিঙিকে কোমরের সঙ্গে দড়ি বেঁধে যেভাবে আবদ্ধ জলাশয় থেকে খরস্রোতা গঙ্গায় নিয়ে গেছে তাতে তার দক্ষতা সপ্রমাণিত হয়েছে। জলপ্রবাহের সর্বস্তরেই যে ডিঙি পরিচালনার শুধুমাত্র দক্ষতা দেখিয়েছে তা-ই নয়, বরং সে পেশাগতভাবে নৌকা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত মাঝিদের পর্যন্ত পরাস্ত করেছে। শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথকে সে পাকা মাঝি হিসাবে অভিহিত করেছে তা’ ভীষণ যুক্তিযুক্ত ও সঙ্গত হয়েছে।
(ঘ) মাছ চুরির প্রসঙ্গে ইন্দ্রনাথের প্রতি শ্রীকান্তের ঘৃণা ও অভিমান হওয়ার কারণ কী?
উত্তরঃ শ্রীকান্তের নমনীয় কিশোর মন যখন আর পাঁচজন বাঙালী ঘরের ছেলের মতোই স্নেহ ও শাসনে চিরাচরিত প্রথায় গড়ে উঠেছিল, জীবনের সেই সন্ধিক্ষণে ইন্দ্রনাথের হঠাৎ করে আবির্ভাবে তার মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা অপ্রত্যাশিত পথে পরিচালিত হতে লাগল। ফুটবল খেলার মাঠে বিপন্ন শ্রীকান্তের উদ্ধারকর্তা হিসাবে ইন্দ্রনাথের আবির্ভাব। ইন্দ্রনাথের সম্পর্কে কৃতজ্ঞতার সূত্র ধরে সেদিন থেকেই শ্রীকান্তের মনে-প্রাণে এলো অনাস্বাদিতপূর্ণ এক নতুন জাগরণ। ইন্দ্রনাথের দুর্জয় সাহস শ্রীকান্তের মনকে তার প্রতি যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ করল। সে অনুভব করল ইন্দ্রনাথের দেহমনের এই ঐশ্বর্য প্রাপ্তি রয়েছে কিন্তু জ্বালা নেই। এই দীপ্তি অনাড়ম্বরভাবে সকলকেই কাছে টানে। শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথের চরিত্রের সেই দীপ্তির টানের একদিন পূর্ব ভূমিকা ছাড়াই তার সঙ্গে নিবিড় নিশীথ অন্ধকার রাত্রে মাছ চুরির উদ্দেশ্যে খরস্রোতা নদীপথে তার সহযাত্রী হয়। গৃহস্থ-ঘরের ভীরু বালক শ্রীকান্ত সেজন্য ভয়াবহ নৌকাযাত্রায় ভয় পেয়েও দুর্জয় সাহসী ইন্দ্রনাথের কাছে ভয় পায়নি বলে জানায়। ইন্দ্রনাথের কাছে এইভাবে শ্রীকান্ত ভয়মুক্তির প্রথম দীক্ষা নেয়। ইন্দ্রনাথ মনস্তত্ত্ববিদের মতোই যেন শ্রীকান্তের ভীতিপূর্ণ হৃদয় জেনেই তাকে ভয়মুক্ত করতে তার চিকিৎসানীতি হিসাবে বলে, ‘এই ত চাই— সাঁতার জানলে আবার ভয় কিসের!’ শ্রীকান্তের ভয়শূন্য ব্যক্তিত্বের প্রথম প্রকাশ ঘটল ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করার মধ্য দিয়ে। ইন্দ্রনাথ তারপর ভয়ের ভয়ঙ্কর স্বরূপ উদঘাটন করে শ্রীকান্তকে আত্মরক্ষার কঠিন পথ অনুসন্ধানের জন্য মানসিক প্রস্তুতির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ছেলেদের সতর্ক প্রহরাধীন খালের মধ্য দিয়ে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়লে জেলেরা লগির ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে পাঁকে পুঁতে ফেলবে—ইন্দ্ৰনাথের মুখে এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনে শ্রীকান্ত ভিন্ন পথে যাওয়ার কথা বললে ইন্দ্রনাথ জানায় বিকল্প পথ আর নেই। এপথেই সতর্কভাবে যেতে হবে। শ্রীকান্ত ভীত হয়ে ইন্দ্রনাথকে মাছ চুরি পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বলায় ইন্দ্রনাথের দ্বারা ‘কাপুরুষ’ আখ্যায় অভিহিত হয়। আহত ব্যক্তিত্ব নিয়ে কাপুরুষ নাম ঘুচানোর জন্য শ্রীকান্ত প্রাণপণে দাঁড় টানতে থাকে। এইভাবে কাপুরুষতার গ্লানি এবং পৌরুষের অভিমান সম্পর্কে ইন্দ্রনাথের সাহচর্যে শ্রীকান্তের অন্তরে চেতনাবোধ জাগে। শ্রীকান্ত সেজন্য জেলেদের হাতে ধরা পড়ার পূর্বে খরস্রোতা নদীতে ডুব সাঁতার দিয়ে মড়া পোড়ানোর কাঠ ধরে ভেসে ছ’-সাত ক্রোশ পথ পার করে সতুয়ার চড়ায় পৌঁছানোর অসম্ভব উপায় ইন্দ্রনাথের কাছে শুনে আর কোন প্রতিবাদ করে নি। ইন্দ্রনাথের কাছে ভয়ে এ তার ব্যক্তিত্বের আত্মসমর্পণ নয়, জীবন ও মৃত্যুকে সমদৃষ্টিতে দেখার মানসিকতার জাগরণই তাকে প্রতিবাদহীন করেছে তবে এত তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ ভয়মুক্ত হওয়া শ্রীকান্তের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ইন্দ্রনাথের সাহচর্যে তার চিত্তে ভয় ভাঙার কাজ যে দ্রুত চলছে তা অনস্বীকার্য।
ইন্দ্রনাথের সাহচর্যে শ্রীকান্ত সর্বোত্তম যে শিক্ষা পেয়েছে তা’হল অপরিসীম স্বার্থত্যাগ। মাছ চুরি করে ফেরার পথে কালান্তক যম-সদৃশ জেলেদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বন্য শূকরসপসংকুল জলা-জঙ্গলময় ভুট্টা-জনারের ক্ষেতে সে নিজে নৌকা থেকে নেমে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছে কিন্তু শ্রীকান্তকে একবারও বলেনি ‘শ্রীকান্ত, তুই এইবার নেমে যা’। ইন্দ্রনাথের এই স্বার্থত্যাগের দীক্ষা শ্রীকান্তকে সেদিন বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
কৈশোর জীবনে ইন্দ্রনাথের কাছে সাহস ও স্বার্থত্যাগের এই শিক্ষা নিয়েই অবশিষ্ট জীবনে শ্রীকান্ত পথনির্দেশ পেয়েছে।
(ঙ) শ্রীনাথ বহুরূপী কোথায় বাস করতো? তাঁর কাজ কী ছিল? সে কেন শ্রীকান্তদের বাড়ি এসেছিল? তার উপস্থিতিতে যে ঘটনা ঘটেছিল তা বর্ণনা করো।
উত্তরঃ শ্রীনাথ বহুরূপী বারাসাতে বাস করতো। সেদিন বহুরূপী ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে লোকের মনোরঞ্জন করে সে অর্থ উপার্জন করতো।
শ্রীনাথের পেশাই ছিল নানা রূপ ধারণ করা। সে অর্থ উপার্জনের আশায় বাঘ সেজে শ্রীকান্তদের বাড়িতে এসেছিল।
লেখকের পিসিমার বাড়িতে এক সন্ধ্যায় লেখক এবং তাঁর ছোঁড়দা, যতীনদা, গম্ভীর প্রকৃতির মেজদা পড়াশোনায় মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ লেখকের পিঠের কাছে “হুম’ শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ছোড়দা ও যতীনদা সমবেত কণ্ঠে প্রচণ্ড চিৎকার করতে শুরু করে। কিছু না বুঝেই মেজদা মুখ তুলে বিকট শব্দ করে দ্রুতবেগে দুই পা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে প্রদীপ উল্টিয়ে দেয়। তখন অন্ধকারের মধ্যে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। মেজদার ছিল ফিটের রোগ। তিনি আঁ আঁ শব্দ করতে করতে প্রদীপ উল্টিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন, আর উঠলেন না।
এদিকে পিসেমশাই তাঁর দুই ছেলেকে বগলে চেপে ধরে তাঁদের থেকেও তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে বাড়ি ফাটিয়ে ফেলছিলেন। বাবা ছেলে দুজন মিলে যেন চিৎকার করার প্রতিযোগিতা চলছিল। এই সুযোগে দেউড়ির সিপাইরা একজন চোরকে ধরে আনে। পিসেমশাই চিৎকার করে হুকুম দিলেন—তাঁকে তীব্র প্রহার করতে। মুহূর্তের মধ্যে চাকরবাকরে, পাশের বাড়ির লোকজনে উঠোন ভর্তি হয়ে গেল। দারোয়ানরা চোরকে মারতে মারতে প্রায় আধমরা করে এনে আলোর সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তখন চোরের মুখ দেখে বাড়িশুদ্ধ লোকের মুখ শুকিয়ে গেল। — দেখা গেল চোরটি প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধ রামকমল ভট্টাচার্য মহাশয়। তখন কেউ জল, কেউ পাখার বাতাস কেউ বা তাঁর চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অপরদিকে ঘরের ভেতরে মেজদাকে নিয়েও একই পরিস্থিতি।
পাখার বাতাস ও জলের ঝাপটা খেয়ে রামকমল প্রকৃতিস্থ হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সবাই জানতে চায়—তিনি ছোটাছুটি করছিলেন কেন। বৃদ্ধ রামকমল কাঁদতে কাঁদতে বললেন—বাঘ নয়, একটা মস্ত ভাল্লুক লাফ মেরে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এলো। ছোড়দা, যতীনদা বারবার বলতে লাগল— ভাল্লুক নয়, একটা নেকড়ে বাঘ হুম করে লেজ গুটিয়ে পাপোশের উপর বসেছিল। মেজদার জ্ঞান ফিরলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে শুধু বলল—“দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার।” সবাই লণ্ঠন নিয়ে ভয়ার্ত চোখে চারিদিকে খুঁজতে লাগল।
হঠাৎ পালোয়ান কিশোরী সিং “উহ বয়ঠা” বলে একলাফে বারান্দার উপর উঠে পড়ল। ভয়ে তখন সকলেই ঠেলাঠেলি শুরু করে। সবাই মিলে একসাথে বারান্দায় উঠতে চাইল। কেউ বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। উঠোনের একপ্রান্তে একটা ডালিম গাছ ছিল, দেখা গেল তারই ঝোপের মধ্যে একটি বড় জানোয়ার বসে আছে। বাঘের মতোই দেখতে, চোখের পলকে বারান্দা খালি হয়ে বৈঠকখানা ভরে গেল। ঘরের ভিতর থেকে পিসেমশাই উত্তেজিত স্বরে বলতে লাগলেন—“সড়কি লাও—বন্দুক লাও”। লেখকের বাড়ির পাশের গগনবাবুদের একটি মুঙ্গেরী গাদা বন্দুক ছিল। পিসেমশাই সেটি লক্ষ্য করেই কথাগুলি বলছিলেন। পিসেমশাই হুকুম দিলেও হুকুম তালিম করার লোক খুঁজে পাওয়া গেল না। কারণ ডালিম গাছটা দরজার কাছে আর তারই মধ্যে বাঘ বসে রয়েছে। হিন্দুস্থানীরা সাড়া দিল না। তামাশা দেখতে যারা বাড়িতে ঢুকেছিল তারাও নিশ্চপ।
এমন বিপদের সময় হঠাৎ ইন্দ্রনাথ এসে উপস্থিত হল। সে বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গণ্ডগোল শুনে বাড়িতে ঢুকেছে। নিমেষের মধ্যে অনেকে ইন্দ্রনাথকে সাবধান করতে লাগল। প্রথমটা সে থতমত খেয়ে ছুটে এসে ভিতরে ঢুকল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে একা নির্ভয়ে উঠোনে নেমে লণ্ঠন তুলে বাঘ দেখতে লাগল।
দোতলার জানলা থেকে মেয়েরা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে এই ডাকাত ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দুর্গানাম জপতে লাগল। পিসিমা ভয়ে কেঁদেই ফেললেন। নীচে ভিড়ের মধ্যে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে হিন্দুস্থানী সিপাইরা তাকে সাহস দিতে লাগল এবং একটা অস্ত্র পেলেই নেমে আসবে এমন ইঙ্গিতও দিল।
ভালো করে দেখে ইন্দ্র বললো—এ বাঘ নয়। তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার দুই থাবা জোড় করে মানুষের গলায় কেঁদে উঠল। পরিষ্কার বাংলায় বলল—সে বাঘ ভাল্লুক নয়—ছিনাথ বহুরূপী।
ইন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠল। ভট্টাচায্যিমশাই খড়ম হাতে সর্বাগ্রে মারতে উদ্যত হলেন। পিসেমশাই মহাক্রোধে হুকুম দিলেন—“শালাকো কান পাকাড়কে লাও”। কিশোরী তাঁকে সবার আগে দেখেছিল—এই অধিকারবোধে সেই নিয়ে বাঘের কান ধরে হিড় হিড় করে টেনে আনল। ভট্চায্যি মশায় তার পিঠের উপর খড়মের এক ঘা বসিয়ে দিলেন। শ্রীনাথ সকলের পায়ে ধরে বলতে লাগল—ছেলেরা অমন করে ভয় পেয়ে প্রদীপ উল্টিয়ে মহামারী কাণ্ড বাধিয়ে তোলায় সেও নিজে ভয় পেয়ে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছিল। ভেবেছিল একটু ঠাণ্ডা হলেই বের হয়ে তাঁর সাজ দেখিয়ে যাবে। কিন্তু ঘটনাক্রম এমন দাঁড়ালো যে সে তার সাহসে কুলোল না।
ছিনাথ কাকুতি মিনতি করতে লাগল, কিন্তু পিসেমশাই শান্ত হলেন না। পিসিমা উপর থেকে বললেন—সবার ভাগ্য ভালো যে সত্যিকারের বাঘ ভাল্লুক বের হয়নি। ছিনাথকে পিসিমা ছেড়ে দিতে বললেন। কেননা ইন্দ্রনাথের মতো ছোট্ট ছেলের যা সাহস, বাড়ির কারোর তা নেই। পিসেমশাই কোন উত্তর দিলেন না। শুধু কটমট করে পিসিমার দিকে তাকালেন। পিসেমশাই আদেশ দিলেন— উহার ল্যাজ কাটিয়া দাও।” তখন তার সেই রঙিন কাপড় জড়ানো লম্বা খড়ের লেজ কেটে নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। পিসিমা উপর থেকে রাগ করে বললেন—“রেখে দাও ; তোমার ওটা অনেক কাজে লাগবে।”
ব্যাকরণ
৪। (ক) ব্যাসবাক্য-সহ সমাসের নাম লেখো।
(ক) হতভাগা = হত হয়েছে ভাগ্য যার (বহুব্রীহি সমাস)
(খ) মহাশয় = মহান আশয় যার (বহুব্রীহি
(গ) নিদ্ৰাকৰ্ষণ= নিদ্রা দ্বারা আকর্ষণ (তৃতীয়া তৎপুরুষ)
(ঘ) স্বপ্নাবিষ্ট = স্বপ্নে আবিষ্ট (৭মী তৎপুরুষ)
(ঙ) বনপথে = বনের পথে (৬ষ্ঠী তৎপুরুষ)
(চ) স্বার্থত্যাগ = স্বার্থকে ত্যাগ (দ্বিতীয়া তৎপুরুষ)
(ছ) অস্পষ্ট = স্পষ্টতার অভাব (অব্যয়ীভাব সমাস)
(জ) সিংহদ্বার = সিংহ চিহ্নিত দ্বার (মধ্যপদলোপী কর্মধারয়)
(ঝ) বহুদূরাগত = বহু দূর হতে আগত (৫মী তৎপুরুষ)
(ঞ) বাধা বিঘ্ন = বাধা ও বিঘ্ন (দ্বন্দ্ব সমাস)
(খ) বাক্য সম্প্রসারণ করো–
(ক) তুমি একটা অপদার্থ — তোমার ভেতরে পদার্থ বলে কিছু নেই।
(খ) ছেলেটি বাচাল — ছেলেটি খুব বেশি কথা বলে।
(গ) পার্বত্য পথ বন্ধুর — পার্বত্য পথ কোথাও উঁচু কোথাও নিচু।
(ঘ) তিনি অকুতোভয় — তাঁর কোন কিছুতেই ভয় নেই।
(ঙ) তিনি সব্যসাচী — তাঁর দুই হাত সমানে চলে।
(চ) বিনয় আর আমি সতীর্থ — বিনয় এবং আমি একই শিক্ষক মহাশয়ের নিকট অধ্যয়ন করেছি।
(গ) শব্দভাণ্ডার–
যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত সমৃদ্ধ সে ভাষা ততই উন্নত। ভাবকে সার্থকভাবে প্রকাশ করতে হলে যোগ্য শব্দ ছাড়া তা সম্ভব নয়। শব্দ সম্পদ দুটি উপায়ে বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
যেমন– (ক) ধাতুতে অথবা শব্দে নতুন প্রত্যয় যুক্ত করে।
(খ) অন্যভাষা থেকে সরাসরি শব্দ গ্রহণ।
বাংলা শব্দ প্রধানত দুই শ্রেণির। মৌলিক শব্দ ও আগন্তুক শব্দ।
(ক) মৌলিক শব্দগুলো তিন ভাগে বিভক্ত।
তৎসম, তদ্ভব, অর্ধতৎসম।
তৎসম শব্দ — যে সকল শব্দ প্রাচীন আর্যভাষা থেকে গৃহীত হয়ে অপরিবর্তিত রূপে বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করেছে, সেগুলো তৎসম শব্দ। তৎসম অর্থাৎ তার সমান। যেমন– আকাশ, চন্দ্র, বৃক্ষ, হস্ত, পিতা, অন্ন, বায়ু ইত্যাদি।
তদ্ভব শব্দ — তদ্ভব অর্থাৎ তা থেকে উৎপন্ন।
যে সকল শব্দ প্রাচীন ভারতীয় ভাষা থেকে গৃহীত হয়ে নানা পরিবর্তন লাভ করে বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে সেগুলো হল তদ্ভব শব্দ। যেমন—
কায > ক > কাজ।
গ্রাম > গাঁও > গাঁ।
চন্দ্র > চন্ন > চাঁদ।
হস্ত > হ> হাত।
অর্ধ-তৎসম শব্দ — যে সকল শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে গৃহীত হয়েও উচ্চারণ বিকৃত হয়ে আপন সত্তা রক্ষা করতে পারেনি সে-সকল শব্দকে অর্ধতৎসম শব্দ বলে। যেমন—
শ্রী> ছিরি।
মিত্র>মিতির।
প্রণাম> পেন্নাম।
চিত্র> চিত্তির।
গ্রাম> গেরাম।
কৃষ্ণ > কেষ্ট।
২। আগন্তুক শব্দ আবার দুই ভাগে বিভক্ত।
দেশী শব্দ ও বিদেশী শব্দ।
দেশী শব্দগুলো বাংলার নিজস্ব সম্পদ। এগুলো আর্য বা অন্য কোনো ভাষা থেকে বাংলায় স্থান পায়নি এগুলো অনার্য ভাষার শব্দ যেমন অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভারতের আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষার শব্দ। যেমন—ঝিঙ্গা, চুঙা, চাঙারি, ঝাঁটা, ঢোল, ডিঙি, ডাহা, ডাসা, ইত্যাদি শব্দ।
বিদেশী শব্দ — সভ্যতা সংস্কৃতির প্রভাবে অথবা বাংলা ভাষা সমৃদ্ধির ফলে অর্থাৎ ভারতে বিদেশী ভাষাভাষী লোকের আগমনের ফলে, যে সকল জাতির ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করেছে। সে-সব শব্দগুলোকে বিদেশী শব্দ বলা হয়। যেমন—
আরবি — আইন, হুঁকা, জিলা, আতর, কেচ্ছা।
ফরাসি — কুপন, কার্তুজ, কম, তবে, বিস্কুট।
গ্রিক — দাম, সুড়ঙ্গ, কেন্দ্র।
তুর্কি — উর্দু, কাঁচি, কুলি, বিবি।
পর্তুগিজ — চাবি, বোমা, বোতাম, আলপিন, কেরানি, বাসন, বালতি, পেপে ইত্যাদি।
ইংরেজি শব্দ — শার্ট, কোট, স্কুল, বল, হোটেল, সিনেমা, ক্লাব, ট্রেন, চেয়ার, কলেজ, ডাক্তার ইত্যাদি।