Class 12 History Chapter 14 মহাত্মা গান্ধী ও জাতীয় আন্দোলন

Class 12 History Chapter 14 মহাত্মা গান্ধী ও জাতীয় আন্দোলন Question Answer | AHSEC Class 12 History Question Answer to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapters Assam Board Class Class 12 History Chapter 14 মহাত্মা গান্ধী ও জাতীয় আন্দোলন Notes and select needs one.

Class 12 History Chapter 14 মহাত্মা গান্ধী ও জাতীয় আন্দোলন

Join Telegram channel

Also, you can read the SCERT book online in these sections Class 12 History Chapter 14 মহাত্মা গান্ধী ও জাতীয় আন্দোলন Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 12 History Chapter 14 মহাত্মা গান্ধী ও জাতীয় আন্দোলন These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 12 History Chapter 14 মহাত্মা গান্ধী ও জাতীয় আন্দোলন Solutions for All Subjects, You can practice these here.

প্রশ্ন ১৪। খিলাফত আন্দোলন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

অথবা,

খিলাফৎ আন্দোলন কি? ভারতে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন? গান্ধিজী এই আন্দোলন কেন সমর্থন করেছিলেন?

উত্তরঃ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলন হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর তুরস্কের খলিফাকে জার্মান পক্ষে যোগ দেওয়ার অজুহাতে ইংরেজ সরকার সিংহাসনচ্যুত করলে সেখানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আরম্ভ হয়। তা খিলাফত আন্দোলন নামে খ্যাত। ভারতের মুসলমানগণ খলিফার সমর্থনে ভারতে আন্দোলন আরম্ভ করেন। মহাত্মা গান্ধী মুসলমানদের এই আন্দোলনকে কংগ্রেসের আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্য স্থাপিত হয়।

প্রশ্ন ১৫। লবণ সত্যাগ্রহ সম্পর্কে লেখ।

অথবা,

লবণ আইন অমান্য বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে গান্ধীজি লবণ আইন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। লবণ উৎপাদনে ব্রিটিশের একচেটিয়া অধিকার ছিল। বিদেশ হতে আমদানি করা লবণ ভারতবাসীকে বেশি দামে গ্রহণ করতে বাধ্য করানো হত। গান্ধীজি এই আইন রদ করার জন্য বড়লাটের সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করেন। কিন্তু বড়লাট তাঁর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। অতঃপর গান্ধীজি ঐতিহাসিক লবণ সত্যাগ্রহ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ গান্ধীজি ৭৮ জন অনুগামীসহ ‘সবরমতী’ আশ্রম হতে গুজরাটের ডাণ্ডি অভিমুখে লবণ আইন ভঙ্গের জন্য যাত্রা শুরু করেন। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘ডাণ্ডি অভিযান’ নামে খ্যাত। ৬ই এপ্রিল গান্ধীজি ডাণ্ডির সমুদ্রতীরে লবণ তৈরি করে আনুষ্ঠানিকভাবে লবণ আইন ভঙ্গ করেন। লবণ আইন ভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সর্বত্র আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। লবণ আইন অমান্যের সিদ্ধান্ত দেশের কৃষক-সম্প্রদায়ের আন্তরিক সমর্থন লাভ করে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Join Now

প্রশ্ন ১৬। গান্ধী-আরউইন চুক্তির মূল শর্তগুলি কি কি ছিল?

উত্তরঃ গান্ধী-আরউইন চুক্তির মূল শর্তগুলি নিম্নরূপ:

(ক) আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত রাখা হবে।

(খ) সব বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে।

(গ) সমুদ্রতীরে লবণ তৈরির অনুমতি দেওয়া হবে।

(ঘ) লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজি যোগদানে রাজি হন।

দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। অহিংসা নীতি কাকে বলে? কে, কখন ও কোথায় তা উদ্ভাবন করেছিলেন?

উত্তরঃ সত্যের প্রতি একান্ত অনুরাগ এবং হিংসা না করে সত্যের পথে অগ্রসর হওয়াই হল অহিংস নীতি।

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজি দেশের সক্রিয় রাজনীতিতে অহিংসা নীতি প্রবর্তন করেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড হতে ব্যারিস্টারি পাস করে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘নাচালে আইন ব্যবসা শুরু করেন। দক্ষিণ আফ্রিকাতেই গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। সেইসময় দক্ষিণ আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে বহু ভারতীয় বাস করত। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার এই সকল প্রবাসী ভারতীয়দের ওপর অকথ্য অত্যাচার করত। এই সকল ভারতীয়দের কোন ভোটাধিকার ছিল না। তারা কোন ভালো জায়গায় বাস করতে পারত না। ভারতীয়দের নানা অপমানজনক শর্ত মেনে চলতে হত। এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষদের উপর এইরূপ বৈষম্যমূলক ও অমর্যাদাকর আচরণ গান্ধীজিকে বিচলিত করে। দক্ষিণ-আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অহিংসভাবে গণআন্দোলন সংগঠিত করেন। দক্ষিণ-আফ্রিকার আন্দোলনে গান্ধীজি এক নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এই পদ্ধতি অহিংসা সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।

গান্ধীজি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের অস্ত্র হিসাবে ‘সত্যাগ্রহ’ নীতি প্রয়োগ করেন। বেদ, গীতা, উপনিষদ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ইত্যাদি পাঠ করে গান্ধীজি মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি সম্পর্কে অবহিত হন। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক রাসকিন রচিত ‘শেষপর্যন্ত এবং রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয় রচিত ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ নামক দুইটি গ্রন্থ তাঁকে নীতি ও কর্মসূচী রূপায়ণে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। অহিংসা সত্যাগ্রহের দুইটি মূল আদর্শ হল- (ক) সত্যের প্রতি একান্ত অনুরাগ, এবং (খ) অহিংস উপায়ে সত্যের পথে অগ্রসর হওয়া। একজন আদর্শ সত্যাগ্রহী কোন অবস্থাতেই অন্যায়ের সাথে আপোস করবে না। আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় সে কিছুতেই হিংসার আশ্রয় অবলম্বন করবে না। এইজন্য প্রয়োজন অনুশীলন ও অধ্যবসায়। গান্ধীজির মতে দুর্বল বা কাপুরুষরাই হিংসার আশ্রয় অবলম্বন করে। কেবলমাত্র চরিত্রবান ও সাহসী ব্যক্তির পক্ষে অহিংসা সত্যাগ্রহের পথ অনুসরণ করা সম্ভব।

গান্ধীজি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অহিংসা সত্যাগ্রহ নীতি প্রয়োগ করে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, শক্তিশালী ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নিরস্ত্র ভারতবাসীর সশস্ত্র সংগ্রামে ভারতবাসীর সাফল্য সম্ভব নয়। তাই ভারতবাসীর নৈতিক শক্তি ও অহিংস পদ্ধতিকে ভিত্তি করে অধিকার ও সম্মান রক্ষার সংগ্রামে সত্যাগ্রহর আদর্শ প্রয়োগ করেন। অহিংসা সত্যাগ্রহের আদর্শ জাতীয়তাবাদী ভারতীয়দের নব-প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে।

প্রশ্ন ২। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ। কি কারণে তিনি এই আন্দোলন স্থগিত করেছিলেন?

উত্তরঃ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে নি। তাছাড়া বিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধের ফলে সমগ্র দেশে খাদ্যাভাব, মহামারী ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শাসন-সংস্কারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সমগ্র দেশে আন্দোলনের আগুন আবার জ্বলে ওঠে। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ সরকার শাসন-সংস্কার দূরে রেখে কঠোর দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রবর্তন এই দমননীতির অঙ্গবিশেষ। এই আইনে সম্মতি না দেওয়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী লর্ড চেমসফোর্ডকে অনুরোধ করেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে।

রাওলাট আইন ছিল দমনমূলক। এই আইন অনুসারে বিনা বিচারে যে-কোন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আটক রাখা যেত। এই আইনের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশে হরতাল, শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ দ্বারা এর প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু সরকার দমনমূলক নীতি অব্যাহত রেখে পাঞ্জাবে সামরিক আইন বলবৎ করে।

এই সামরিক আইন, দমন-নীতি প্রভৃতি অগ্রাহ্য করে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। অমৃতসর শহরের নিকটবর্তী এই স্থানে সেদিন নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর ব্রিটিশ সরকারের সেনানায়ক ডায়ার গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে বহু নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করে। বহুলোক আহতও হয়।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও বিক্ষোভ আরম্ভ হয়। এই বিক্ষোভের জন্য বহু সত্যাগ্রহী বিভিন্ন রকমের শাস্তিও পেয়েছিলেন। অবশেষে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেন।

ইতিমধ্যে বিশ্বযুদ্ধে তুর্কীদের উপর ইংরেজের অমানবীয় আচরণে ভারতের মুসলমানগণ ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। মহম্মদ আলি ও সৌকত আলি নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে মুসলমানগণ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে খিলাফৎ আন্দোলন গড়ে তোলেন। গান্ধীজি কংগ্রেসের আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফৎ আন্দোলন সংযুক্ত করতে সমর্থ হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা এবং ঐ বৎসরের শেষদিকে নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনে যৌথ আন্দোলনের নীতি গ্রহণ করা হয়। এই যৌথ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল-

(ক) পাঞ্জাবে ব্রিটিশের অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিবাদ।

(খ) তুর্কী সাম্রাজ্যের উপর ব্রিটিশের অবিচারের প্রতিবাদ। এবং

(গ) ভারত স্বরাজ গঠন।

এই অহিংস আন্দোলনের সূচনা করেন মহাত্মা গান্ধী। অহিংস অসহযোগ এবং আইন অমান্য — এই দুইটিই অহিংসার আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে গান্ধীজি আন্দোলনে এক নূতন যুগের সূচনা করেন।

ব্রিটিশ সরকারকে অচল করে দেওয়ার জন্য আইনসভা, বিচারালয়, সরকারি চাকরি, স্কুল, কলেজ প্রভৃতি বর্জন করে অহিংস আন্দোলনে যোগদান করার জন্য গান্ধীজি ভারতবাসীকে আহ্বান জানান। জমির খাজনা ব্রিটিশ সরকারকে জমা না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। আফিং, ভাঙ, মদ, সিগারেট প্রভৃতি বিদেশি মাদকদ্রব্য বর্জন করতেও বলা হয়। চরকায় সুতা কাটা, খদ্দরের কাপড় পরা আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মহাত্মা গান্ধীর প্রতি অসীম শ্রদ্ধার জন্য ভারতবাসী এইগুলি মেনে নিয়ে আন্দোলনে যোগদান করে।

লালা লাজপত রায়, মতিলাল নেহরু, মহম্মদ আলি, সৌকত আলি, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ দেশের প্রায় অধিকাংশ নেতা এই আন্দোলনে যোগদান করেন। আসাম হতে চন্দ্রকান্ত শর্মা, তরুণরাম ফুকন, নবীনচন্দ্র বরদলৈ প্রমুখ নেতারাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

অসহযোগ আন্দোলনকে দমন করার ব্যাপক আন্দোলন আরম্ভ হয়। ঠিক তখনই ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স-অব-ওয়েলস ভারতে আসেন। সেইদিন দেশের সর্বত্র বিক্ষোভ দেখানো হলে জনতার উপর নির্মম লাঠি চালানো হয় এবং ব্যাপক ধরপাকড় আরম্ভ হয়। মহাত্মা গান্ধীজি সহ বহু নেতা কারারুদ্ধ হলেন। পুলিশের অত্যাচারে বহু লোকের মৃত্যু ও অনেক লোক আহত হয়। পুলিশের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরা নামক স্থানে বিক্ষুব্ধ একদল জনতা একটি থানা আক্রমণ করে কয়েকজন পুলিশকে হত্যা করে।

অহিংসা আন্দোলনের মধ্যে এই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটার প্রতিবাদে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। গান্ধীজির এইরূপ সিদ্ধান্তে জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। গান্ধীজির ছয় বৎসরের কারাবাস হয়। এদিকে তুরস্কের গাজী মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক বিজয়ী হলে সুলতান গদিচ্যুত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতের খিলাফৎ আন্দোলনের অবসান ঘটে এবং তখনই অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের যবনিকা পড়ে।

প্রশ্ন ৩। কি কি কারণে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল উল্লেখ কর।

উত্তরঃ রাওলাট সত্যাগ্রহ ব্যর্থ হলেও, তা দুভাবে ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করে। 

(ক) রাওলাট-সত্যাগ্রহ গান্ধীর জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তির গভীরতা প্রমাণ করে। এবং 

(খ) জাতিধর্মনির্বিশেষে দেশের সাধারণ মানুষকে একমঞ্চে এনে এক লক্ষ্যে আন্দোলিত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। খিলাফৎ আন্দোলনকে সামনে রেখে গান্ধীজি হিন্দু ও মুসলমান জনতাকে একই মঞ্চে এনে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

(ক) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তাই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে মিত্রপক্ষ তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ভেঙে দেয়। তুর্কি সুলতান ‘খলিফা’ হিসেবে সমগ্র ইসলাম সমাজে সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর মর্যাদা পেতেন। ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের প্রতি অবমাননা বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়কে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে। এর প্রতিবাদে শুরু হয় খিলাফৎ আন্দোলন। ভারতের মুসলমান সমাজও সেই আন্দোলনের অংশীদার হন। মৌলানা আজাদ, হাকিম আজমল খাঁ এবং হসরৎ মোহানির নেতৃত্বে একটি ‘খিলাফৎ কমিটি’ গঠিত হয়। গান্ধীজি খিলাফৎ আন্দোলনকে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। গান্ধীজি মনে করেন যে, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের এমন সুযোগ আগামী একশো বছরেও আর আসবে না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় খিলাফৎ আন্দোলনকে সমর্থন জানান। ‘ইয়ং-ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় তিনি লেখেন—“মুসলমানকে যদি আমার ভাই বলে মনে করি, তাহলে তার বিপদ হলে এবং ন্যায় তার দিকে থাকলে, তাকে প্রাণপণে সাহায্য করাই আমার কর্তব্য।” খিলাফৎ কমিটি গান্ধীজির বক্তব্যে অভিভূত হয়। সৌকত আলি, মহম্মদ আলি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, আজমল খাঁ প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ গান্ধীজির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মুসলমান নেতাদের যৌথ উদ্যোগে ‘নিখিল ভারত খিলাফৎ সম্মেলন’ গঠিত হয় (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ)। নভেম্বর মাসে খিলাফৎ সম্মেলনের অধিবেশনে তাঁরা গান্ধীজিকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। এই সম্মেলনেই স্থির হয় যে, সরকার খিলাফৎ সমস্যার দ্রুত মীমাংসা না করলে সরকারের প্রতি ‘অসহযোগ’ নীতি অনুসরণ করা হবে। জুডিথ ব্রাউন-এর মতে, খিলাফৎ সম্মেলনেই গান্ধীজি প্রথম ‘অসহযোগ’ নীতির কথা চিন্তা করেন।

(খ) গান্ধীজি খিলাফৎ সত্যাগ্রহের সাথে কংগ্রেসকে যুক্ত করে বৃহত্তর অসহযোগ আইন-অমান্য আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এই সময় হান্টার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে জালিয়ানওয়ালাবাগে মাইকেল ও ডায়ারের অপরাধকে অত্যন্ত লঘু করে দেখানো হয়। যুদ্ধের কারণে খাদ্যাভাব ও অর্থসংকট, খিলাফতের প্রশ্নে মুসলমানদের ক্ষোভ, হান্টার কমিশনের রিপোর্টজনিত ভারতবাসীর ক্ষোভকে ভিত্তি করে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেন। জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (সেপ্টেম্বর, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ) গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। ‘স্বরাজ’ অর্জনকে তিনি আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দেন–“ভারতীয়দের মর্যাদা ও দাবির প্রতি উদাসীন ও বিবেকহীন এই বিদেশি সরকারের সাথে কোন রকম সহযোগিতা করা পাপ।” তিনমাস পর নাগপুর অধিবেশন অসহযোগ আইন-অমান্যের প্রস্তাব নেয়।

প্রশ্ন ৪। কোন্ সাল হতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করা হয়েছিল? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে আইন অমান্য আন্দোলনের ভূমিকা উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করা হয়েছিল গান্ধীজি নেহেরু রিপোর্টের সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ সরকারকে স্মরণ করিয়ে ভারতে ডোমিনিয়নের, মর্যাদা দাবি করেন। তিনি তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় পূর্ণ স্বরাজের লক্ষ্যে এগারো দফা দাবি সরকারের কাছে পেশ করেন। কিন্তু সরকার ওইসব দাবি অগ্রাহ্য করে দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করে সকলপ্রকার বিক্ষোভ দমনে তৎপর হয়। এই সময় ব্রিটিশ সরকার সুভাষচন্দ্র সহ আরও কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে এক আইনের বলে লবণের উপর দ্বিগুণ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করা ছিল সরকারি আইনের বিরুদ্ধে। এর ফলে জনসাধারণ বিশেষ অসুবিধায় পড়ে। গান্ধীজি ভাইসরয় লর্ড আরউইনকে লবণ উৎপাদনের ব্যাপারে সমস্ত সরকারি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার দাবি করেন। লর্ড আরউইন এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলে গান্ধীজি লবণ সত্যাগ্রহের দ্বারা আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ ৭৯ জন অনুগামীকে নিয়ে সবরমতী আশ্রম থেকে গুজরাটের সমুদ্রতীরে ডাণ্ডির দিকে পদযাত্রা শুরু করেন। তাঁর এই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে সমুদ্রতীরে লবণ প্রস্তুত করে লবণ আইন ভঙ্গ করা। ডাণ্ডি অভিযান সারাদেশে নতুন আশার সঞ্চার করে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল গান্ধীজি সমুদ্রতীর থেকে একমুঠো লবণ হাতে তুলে নিয়ে সরকারি লবণ আইন ভঙ্গ করলে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়। আইন অমান্য আন্দোলনকে কার্যকরী করতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে, যেমন—মাদ্রাজ, মুম্বাই, বাংলা, আসাম ইত্যাদি অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে লবণ প্রস্তুত শুরু হয়। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি অন্যান্য কর অস্বীকার করা হয়। বিদেশি দ্রব্য বয়কট, সরকারি দোকানের সামনে বিক্ষোভ এবং ধর্মঘটের মাধ্যমে আইন অমান্য আন্দোলনকে আরও সক্রিয় করে তোলা হয়। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে এই আন্দোলনে যোগদান করে।

আইন অমান্য আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে পুলিশ লবণ সত্যাগ্রহীদের উপর চরম অত্যাচার শুরু করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। সর্বোপরি সরকার জাতীয় কংগ্রেসকে বে-আইনি দল হিসাবে চিহ্নিত করে। এছাড়া আন্দোলনকারীদের সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। প্রায় ৬০,০০০ সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়।

প্রশ্ন ৫। গান্ধীজিকে কেন জনগণের নেতা হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীজি বিশ্বকে আন্দোলনের এক নতুন রূপ দেখিয়েছিলেন। তাঁর আন্দোলন সত্য ও অহিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দরে গান্ধীজি জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সে আইন পড়ার জন্য ইংল্যান্ড যান। সেখান থেকে মাত্র ২৪ বছর বয়েসে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। সেখানে তিনি প্রথম নাগরিক অধিকার নিয়ে তাঁর অহিংস আন্দোলন শুরু করেন। ১৯১৫ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন ও পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নতুন দিক তিনি দেখাতে পেরেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অনেকগুলি জাতীয় আন্দোলন শুরু করেছিলেন; যেমন—অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন। তাঁর আন্দোলনগুলির মূল ভিত্তি ছিল সত্য ও অহিংসা। তিনি ভারতবর্ষের সর্বস্তরের মানুষকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মহিলারা জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে অহিংস আন্দোলন তরবারি থেকে অনেক শক্তিশালী। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়।

মহাত্মা গান্ধী একজন শুধু সাধু পুরুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী নেতা। তিনি ছিলেন, সরল, পবিত্র, নির্ভিক এবং নিঃস্বার্থ ব্যক্তি। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছিলেন। স্বদেশী বস্তুর ব্যবহারের দ্বারা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতির এবং সমাজে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের চেষ্টা তিনি করেছেন। তাই মহাত্মা গান্ধী প্রকৃত অর্থে ছিলেন দেশের নেতা ও জাতির নেতা অর্থাৎ জনগণের নেতা।

প্রশ্ন ৬। কি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল? চুক্তির শর্তসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ আইন অমান্য আন্দোলন করার অপরাধে ব্রিটিশ ভারত সরকার ১৪ই এপ্রিল (১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ) কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুকে গ্রেপ্তার করে এবং ৫ই মে গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করে। ফলে সমগ্র দেশে আন্দোলন একটি নূতন গতিবেগ লাভ করে।

ইতিমধ্যে ভারতীয়দের সমস্যা সমাধান এবং সংস্কারের উদ্দেশ্যে লর্ড আরউইনের প্রস্তাব অনুসারে লন্ডনে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক বসে। কিন্তু কংগ্রেস এই বৈঠকে যোগদান করেনি। ফলে এই বৈঠক শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রথম গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে চায়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি গান্ধীজি ও আরউইনের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি গান্ধী-আরউইন চুক্তি নামে খ্যাত। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশীদার করা। এই চুক্তির শর্তাবলীতে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার কোন কথার উল্লেখ ছিল না। চুক্তির প্রধান শর্তসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা হবে।

(খ) কংগ্রেসকে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রন জানানো হবে।

(গ) আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত করা হবে।

(ঘ) কংগ্রেসের তরফ হতে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন প্রত্যাহার করা হবে।

(ঙ) আইনগতভাবে বিদেশি পণ্য ও মদের দোকান খোলার বিরুদ্ধে পিকেটিং কার্য চলবে।

(চ) আইন অমান্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা সরকারি নিষেধাজ্ঞাসমূহ প্রত্যাহার করা হবে।

(ছ) বেআইনি ঘোষণা করা সংগঠনসমূহের বিরুদ্ধে থাকা অধিসূচনাসমূহ প্রত্যাহার করা হবে।

(জ) হিংসাত্মক কার্যের সঙ্গে জড়িত নয় এমন কারাবন্দীগণকে মুক্ত করা হবে।

(ঝ) শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে আদায় করা জরিমানার টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

(ঞ) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে অথবা ভূমি রাজস্ব আদায় করার উদ্দেশ্যে বাজেয়াপ্ত করা অস্থাবর বিষয়-সম্পত্তিসমূহ ফেরত দেওয়া হবে।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মার্চ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সভাপতিত্বে করাচিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে উক্ত চুক্তি অনুমোদিত হয়।

প্রশ্ন ৭। ভারত ত্যাগ আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই আন্দোলনকে কেন বিয়াল্লিশ আন্দোলন বা আগস্ট বিপ্লব বলা হয়?

উত্তরঃ ভারত ত্যাগ আন্দোলন বা আগস্ট বিপ্লব ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর শেষ তথা চূড়ান্ত প্রত্যক্ষ বিপ্লব। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির মিত্রশক্তি জাপানের ভারত আক্রমণ করার সম্ভাবনা দেখা দেয়। জাপানের সাফল্যে ভীত হয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা ভারতের জনগণের সহযোগিতা লাভের জন্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্কে ভারতে পাঠায়। কিন্তু ক্রিপসের প্রস্তাবে ভারতকে স্বাধীনতাদানের কোন উল্লেখ না থাকায় কংগ্রেস তা গ্রহণ করেনি। 

ভারত ত্যাগ আন্দোলন প্রস্তাব: জাপানি সৈন্য যখন ভারত সীমান্তে উপস্থিত, সেই সময়ে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্ তাঁর মিশন অকৃতকার্য হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন। ভারতে সর্বত্র এক তীব্র হতাশা দেখা দেয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতায় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিস্মিত হলেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগ করে যেতে বললেন। সমগ্র ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো’ ধ্বনি উত্থিত হয়। মহাত্মা গান্ধী স্পষ্টভাবে বললেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন বজায় থাকলেই জাপান থাকবে না। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ব্রিটিশকে ভারত ত্যাগের জন্য অনুরোধ জানিয়ে এক প্রস্তাব পাস করলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্ট বোম্বাইতে (মুম্বাইতে) কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। পৃথিবীতে শান্তি ও স্বাধীনতা স্থাপন এবং ভারতবাসীদের জাতীয় জীবনের উন্নতি বিধানের জন্য ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া অপরিহার্য এই কথাও প্রস্তাবে গৃহীত হল। পরদিন অর্থাৎ ৯ই আগস্ট প্রাতঃকালে মহাত্মা গান্ধীসহ কংগ্রেসের গণ্যমান্য নেতাকে গ্রেপ্তার করা হল। ব্রিটিশ সরকারের ধারণা ছিল যে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ করলেই আন্দোলন থেমে যাবে। এই উদ্দেশ্যে তারা নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি এবং প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিগুলি বেআইনি বলে ঘোষণা করলেন।

গণ বিদ্রোহ: নেতৃত্বহীন ভারতবাসী সেইদিন ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি সম্পত্তি প্রভৃতি বিনাশ করে ব্রিটিশের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণ তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শন করল। সর্বভারতে এক বহ্নি প্রজ্বলিত হল। বহু রেল স্টেশন, পোস্ট অফিস ও থানা ভস্মীভূত হল। মোট ৫৩৮ বার পুলিশ ও সৈন্যদিগকে গুলিবর্ষণ করবার আদেশ দিতে হয়েছিল।

মহাত্মা গান্ধীর ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ আদর্শে অনুপ্রাণিত লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী ভারতের শহর, নগর, গ্রামাঞ্চল সর্বত্র এক দারুণ গণবিক্ষোভে অংশগ্রহণ করল। ব্রিটিশ প্রশাসন অচল করে দেওয়া এবং যোগাযোগ ও সংযোগ ব্যবস্থা বিনাশ করে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো ছিল এই গণবিক্ষোভের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের মেদিনীপুর জেলায় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন বা ‘আগস্ট বিপ্লব’ এক অভূতপূর্ব সংগঠন ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলন মেদিনীপুরে এক প্রকৃত বিপ্লবের রূপ ধারণ করেছিল। বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা পতাকা হাতে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে অগ্রসর হয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত পুলিশের গুলিতেই তিনি জাতীয় পতাকা হাতে প্রাণদান করে দেশের জন্য চরম আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন।

মেদিনীপুরের ন্যায় বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলায় এবং বিহারের ভাগলপুরে সাময়িকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। কয়েক মাস এই স্বাধীনতা বহাল ছিল।

এই বিদ্রোহ দমন করতে ব্রিটিশ সরকার সর্বপ্রকার দমনমূলক অত্যাচার নীতি অনুসরণ করতে লাগলেন। প্রায় দশ হাজার লোক পুলিশ ও মিলিটারির গুলিতে প্রাণ হারায় এবং অসংখ্য লোক কারারুদ্ধ হয়। নেতৃত্ববিহীন জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে কোন কোন ক্ষেত্রে বিদ্রোহ স্বাভাবিকভাবেই হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। মহাত্মা গান্ধী হিংসাত্মক কার্যাবলীর বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিবাদ হিসাবে দীর্ঘ তিন সপ্তাহ অনশনে ব্রতী হন। অনশনকালে গান্ধীজির জীবন যখন সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে তখন ব্রিটিশ সরকার বিনাশর্তে তাঁকে মুক্তিদানে অস্বীকৃত হয়। সমগ্র দেশবাসীর প্রার্থনায় মহাত্মা গান্ধী দীর্ঘ তিন সপ্তাহের কঠোর অনশন-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।

প্রশ্ন ৭। ভারত ত্যাগ প্রস্তাবের মূল লক্ষ্যসমূহ আলোচনা কর। কোন্ তারিখে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল?

উত্তরঃ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের প্রচেষ্টায় স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ই মার্চ ভারতে উপনীত হয়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনা ব্যর্থ হলে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল ক্রিপস মিশন ইংল্যান্ডে প্রত্যাগমন করে।

ক্রিপস্ মিশন ব্যর্থ হলে ভারতের সর্বত্র এক তীব্র হতাশা দেখা দেয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতায় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিস্মিত হলেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগ করে যেতে বললেন। সমগ্র ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ ধ্বনি উত্থিত হয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ব্রিটিশকে ভারতে ত্যাগের জন্য অনুরোধ জানিয়ে এক প্রস্তাব পাস করে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্ট বোম্বাইতে (মুম্বাইতে) কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। উক্ত প্রস্তাবের উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) একটি নির্দিষ্ট দিনে হরতাল পালন করার সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার অনশন ও ব্রত উপাসনা পালন করা, এবং হরতালের জন্য কোন দোকানি বা ব্যবসায়ীকে জোর-জুলুম না করা। হরতালের দিন সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সত্যাগ্রহ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা।

(খ) আন্দোলন মূলত লবণ আইন ভঙ্গ করে অবৈধভাবে লবণ প্রস্তুত করা।

(গ) ভূমিরাজস্ব আদায় বন্ধ করা। এর দুইটি দিক ছিল—জমিদারি এলাকায় জমিদার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলে তার প্রাপ্য অংশটুকু দান করা হবে; কিন্তু সরকারে প্রাপ্য অংশটুকু আদায় হবে না।

তদানীন্তন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতে আন্দোলন কাৰ্যসূচী সম্পর্কে গান্ধীজির কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না।

সে যাই হোক গান্ধীজির মতে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সত্য ও অহিংসায় বিশ্বাসী কংগ্রেসী ও অকংগ্রেসী সকল ভারতীয়ই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। দেশের স্বাধীনতাকামী বিপুল জনতা দেশের সর্বত্র অংশগ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল।

প্রশ্ন ৮। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা/কৌশল সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা,

ভারতের জাতীয় আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর অবদান আলোচনা কর।

উত্তরঃ জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা অক্টোবর কাথিয়াবাড়ের অন্তর্গত পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। রাজকোর্ট ও ভাবনগরে স্কুল ও কলেজী শিক্ষালাভের পর ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য লন্ডন গমন করেন। ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি স্বদেশে ফিরে আসেন। গান্ধীজি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির থাকায় ভারতে আইন ব্যবসায়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারেন নি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ: ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি একটি বিশেষ মামলা পরিচালনার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয়দের উপর অত্যাচার করে তাদের জীবন ও সম্পত্তি বিপন্ন করার প্রতিবাদে গান্ধীজি সেখানে সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করে ন্যায় ও সত্যের মর্যাদা রক্ষার জন্য নীরবে সকল অত্যাচার সহ্য করে শত্রু মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তাঁর চেষ্টায় দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত ন্যাটালের ভারতীয়গণ ভোটাধিকার লাভ করেন।

ভারতের সত্যাগ্রহ: দক্ষিণ আফ্রিকা হতে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বিহারের চম্পারণ জেলায় কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেন। এর পর আহমেদাবাদের বস্ত্রকল শ্রমিকদের উপর মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সাফল্য অর্জন করেন।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করে প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দের অন্যতম হলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস গান্ধীজির ‘অহিংসা-অসহযোগ’ এবং ‘সত্যাগ্রহ’ প্রস্তাব গ্রহণ করে জাতীয় আন্দোলন চালনার পূর্ণ দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করে। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য তিনি আইন সভার সদস্যগণকে এবং সরকারি কর্মচারীগণকে পদত্যাগ, ছাত্রছাত্রীদের ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত বিদ্যালয় এবং আইনজ্ঞদের আদালত বর্জনের আহ্বান করেন। বহু ভারতবাসী বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে সত্যাগ্রহে যোগদান করতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্দোলন অহিংসাচ্যুত হওয়ায় গান্ধীজি আন্দোলন স্থগিত করেন।

খিলাফৎ আন্দোলন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরস্কের খলিফাকে জার্মান পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অজুহাতে ইংরেজ সরকার সিংহাসনচ্যুত করলে ভারতীয় মুসলমানগণ খলিফার পক্ষে ভারতে আন্দোলন আরম্ভ করেন। গান্ধীজি মুসলমানদের এই আন্দোলনকে কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত করেন।

আইন অমান্য আন্দোলন: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের গান্ধীজির নেতৃত্বে আইন অমান্য ও বরদৌলী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ভারতীয় জনগণ অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। কিন্তু এই আন্দোলন হিংসায় রূপান্তরিত হলে তিনি তা বন্ধ করে দেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি ডাণ্ডি অভিযান করে লবণ আইন অমান্য করে কারাবরণ করেন।

গোলটেবিল বৈঠক: ব্রিটিশ সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় উপনীত হবার জন্য ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কংগ্রেস তা বয়কট করে। বড়লাট আরউইনের সঙ্গে গান্ধীজির একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। মুসলীম লীগ নেতা জিন্নার চাপে ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা প্রস্তাবের পক্ষপাতী থাকায় গান্ধীজি ডিসেম্বর মাসে বৈঠক ত্যাগ করে এসে দেখেন যে জাতীয়তাবাদের উপর সরকারি নির্যাতন চলছে। গান্ধীজি বড়লাটের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হন। তাঁকে ও অন্যান্য নেতাকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পদত্যাগ: ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের শর্ত অনুযায়ী ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস মোট নয়টি প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করে। কিন্তু কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া ইংরেজ সরকার ভারতকে যুদ্ধে লিপ্ত করার প্রতিবাদে গান্ধীজির নির্দেশে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি ‘’ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন করলে ভারতের জনগণ তাতে অভূতপূর্ব সাড়া দেন। সরকারি অত্যাচারে অসংখ্য নর-নারী এই আন্দোলনে প্রাণ হারান।

ভারত-বিভাগ: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিভাগের প্রস্তাব গান্ধীজি প্রথমে নাকচ করেছিলেন, কিন্তু পরে নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তাতে সম্মতি দান করেন।

স্বাধীনতার পূজারি ব্যতীত অস্পৃশ্যতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর অবদান অসামান্য। কিন্তু কালের প্রভাবে অহিংসা মন্ত্রের পূজারি মহাত্মা গান্ধীকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি আততায়ীর হাতে প্রার্থনাসভায় প্রাণ দিতে হয়।

ভারতের জাতীয় জীবনে মহাত্মা গান্ধীর জীবন একটি বিরাট শিক্ষাস্বরূপ। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যগুলির এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল গান্ধীজির চরিত্রে। জাতিকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে যে জাতীয়তাবোধের প্রয়োজন, মহাত্মা গান্ধী তা ভারতীয়দের মধ্যে জাগিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী সত্যই মহান আত্মার যুগপুরুষ ছিলেন। তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে চলতে পারলে শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বের মঙ্গল সাধিত হবে। গান্ধীজি ভারতীয় জাতির জনক।

পাঠ্যপুস্তকের প্রশ্নাবলীর উত্তরঃ

প্রশ্ন ১। সর্বসাধারণের মনে মহাত্মা গান্ধী কিভাবে নিজের পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন?

উত্তরঃ মহাত্মা গান্ধী সহজ জীবন ও উন্নত দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তিনি নিম্নোক্ত উপায়ে সাধারণ মানুষকে নিজের পরিচয় দিতেন: 

(ক) গান্ধীজি পেশাগত অথবা বুদ্ধিদীপ্তের মতো আচরণ করতেন না। তিনি হাজার হাজার কৃষক, শ্রমিক ও কারিগরের মধ্যে মিশে থাকতেন।

(খ) তিনি অতি সাধারণ মানুষের পোশাক পরিধান করতেন। তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন ও তাদের ভাষায় কথা বলতেন। তিনি অতি সাধারণ ধুতি ও চাদর পরিধান করতেন। তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থাকতে ও তাদের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসতেন।

(গ) গান্ধীজি প্রতিদিন চরকায় সুতা কাটতেন। তিনি অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের এটাই অনুসরণ করতে উৎসাহ দিতেন। বস্তুত তিনি মানসিক ও শারীরিক শ্রমের সংমিশ্রণের পক্ষপাতী ছিলেন।

(ঘ) গান্ধীজি পরম্পরাগত জাতিব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না।

(ঙ) তিনি সদা মাতৃভাষায় কথা বলতেন।

প্রশ্ন ২। কৃষকগণ মহাত্মা গান্ধীকে কিভাবে উপলব্ধি করেছিল?

উত্তরঃ কৃষকগণ গান্ধীজিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত। তারা তাকে অলৌকিক ক্ষমতাযুক্ত একজন মহানব্যক্তি বলে গণ্য করত। তারা বিশ্বাস করত যে ঈশ্বর গান্ধীজিকে তাদের অভাব-অভিযোগগুলির সমাধানের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তারা গান্ধীজিকে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে গণ্য করেছেন যিনি স্থানীয় নেতাদের উপর আধিপত্য স্থাপন করবেন। এইজন্য কৃষকগণ গান্ধীজিকে ‘গান্ধীবাবা’, ‘গান্ধী মহারাজ’ অথবা ‘মহাত্মা’ বলে সম্বোধন করত। গান্ধীজি তাদের রক্ষা করবেন বলে তারা মনে করত। তারা গান্ধীজির সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন পছন্দ করত।

প্রশ্ন ৩। জাতীয় সংগ্রামে লবণ আইন কেন একটি বিচার্য বিষয় হয়ে পড়েছিল?

উত্তরঃ বৃটিশ শাসনকালে লবণ আইন সরকারকে লবণ তৈরির একচেটিয়া অধিকার প্রদান করে। অধিকাংশ ভারতবাসীই এই আইন অস্বীকার করে, কারণ লবণ হল দৈনন্দিন জীবনযাত্রার এক অপরিহার্য্য সামগ্রী। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ব্যক্তিগত কাজে লবণ তৈরি বেআইনি বলে ঘোষণা করে। তারা জনগণকে অধিক মূল্যে দোকান হতে লবণ কিনতে বাধ্য করে। সরকারের একচেটিয়া অধিকার থাকার জন্য সাধারণ মানুষ এই ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারত না।

গান্ধীজি বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন লোক ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে জনগণ লবণ আইন সমর্থন করে না। সুতরাং লবণ আইন তার লক্ষ্যবস্তু ছিল। জনগণ যেহেতু ব্রিটিশ শাসনে অসন্তুষ্ট ছিলেন সেই হেতু তিনি জনগণকে লবণ আইনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছিলেন এবং লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। সুতরাং লবণ আইন জাতীয় আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছিল।

প্রশ্ন ৪। জাতীয় আন্দোলন অধ্যয়নের জন্য সংবাদপত্র কেন একটি প্রয়োজনীয় মাধ্যম হিসাবে গণ্য করা হয়?

উত্তরঃ সমসাময়িককালের সংবাদপত্রগুলি জাতীয় আন্দোলন অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আমাদের অধিক জানতে হলে আমাদের ইংরেজি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সংবাদপত্র অধ্যয়ন করতে হবে। 

সংবাদপত্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে গণ্য করা হয় নিম্নলিখিত কারণসমূহের জন্য:

(ক) সমসাময়িককালের সংবাদপত্রসমূহ মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের নানাবিধ খবর পরিবেশন করে।

(খ) এই সংবাদপত্রগুলি মহাত্মা গান্ধীর গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ, ভাষণ ও বিবৃতি পরিবেশন করেছিল।

(গ) সংবাদপত্রগুলি সাধারণ ভারতবাসী কিভাবে মহাত্মা গান্ধীকে উপলব্ধি করেছিল তা পরিবেশন করে।

অবশ্য সংবাদপত্রের সংবাদ সাবধানতা অবলম্বনপূর্বক পাঠ করা উচিত কারণ কখনও কখনও পরিবেশিত সংবাদ অতিরঞ্জিত হয়ে থাকে।

প্রশ্ন ৫। চরকাকে কেন জাতীয়তাবাদের প্রতীকরূপে নির্বাচন করা হয়েছিল?

উত্তরঃ গান্ধীজি প্রতিনিয়ত চরকার ব্যবহার করতেন। 

নিম্নোক্ত কারণে তিনি চরকাকে জাতীয়তাবাদের প্রতীকরূপে নির্বাচন করেছিলেন:

(ক) চরকা শারীরিক শ্রমের প্রতীকস্বরূপ। মহাত্মা গান্ধী সর্বদা শ্রমের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন। তিনি নিজহাতে কাজ করতে ভালোবাসতেন। অবশ্য তিনি চরকাকে একপ্রকার যন্ত্রবিশেষ মনে করতেন।

(খ) গান্ধীজি যন্ত্রের বিরোধী ছিলেন, কারণ তা মানুষকে দাসত্বে পরিণত করে। তিনি যন্ত্র ও প্রযুক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রমের মর্যাদার প্রতি গুরুত্ব আরোপের প্রতীক হিসাবে চরকার প্রশংসা করতেন।

(গ) গান্ধীজি মনে করতেন যে চরকা মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করতে পারবে, কারণ তা মানুষের আয় বৃদ্ধি করে।

(ঘ) চরকার ঢাকার কার্য গান্ধীজিকে পরম্পরাগত জাতিভেদের সীমারেখা অতিক্রম করতে সহায়তা করেছিল।

বস্তুত, গান্ধীজি চরকাকে জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসাবে নির্বাচন করতে চেয়েছেন। সুতরাং তিনি অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের চরকা ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছিলেন।

প্রশ্ন ৬। অসহযোগ আন্দোলনকে কেন একপ্রকার প্রতিবাদ বলে গণ্য করা হয়?

অথবা,

“অসহযোগ আন্দোলন একপ্রকার প্রতিবাদ।” বিস্তৃত আলোচনা কর।

উত্তরঃ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে নি। তাছাড়া বিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধের ফলে সমগ্র দেশে খাদ্যাভাব, মহামারী ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শাসন-সংস্কারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সমগ্র দেশে আন্দোলনের আগুন আবার জ্বলে ওঠে। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ সরকার শাসন-সংস্কার দূরে রেখে কঠোর দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রবর্তন এই দমননীতির অঙ্গবিশেষ। এই আইনে সম্মতি না দেওয়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী লর্ড চেমসফোর্ডকে অনুরোধ করেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে।

রাওলাট আইন ছিল দমনমূলক। এই আইন অনুসারে বিনা বিচারে যে-কোন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আটক রাখা যেত। এই আইনের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশে হরতাল, শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ দ্বারা এর প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু সরকার দমনমূলক নীতি অব্যাহত রেখে পাঞ্জাবে সামরিক আইন বলবৎ করে।

এই সামরিক আইন, দমন-নীতি প্রভৃতি অগ্রাহ্য করে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। অমৃতসর শহরের নিকটবর্তী এই স্থানে সেদিন নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর ব্রিটিশ সরকারের সেনানায়ক ডায়ার গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে বহু নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করে। বহুলোক আহতও হয়।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও বিক্ষোভ আরম্ভ হয়। এই বিক্ষোভের জন্য বহু সত্যাগ্রহী বিভিন্ন রকমের শাস্তিও পেয়েছিলেন। অবশেষে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেন।

ইতিমধ্যে বিশ্বযুদ্ধে তুর্কীদের উপর ইংরেজের অমানবীয় আচরণে ভারতের মুসলমানগণ ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। মহম্মদ আলি ও সৌকত আলি নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে মুসলমানগণ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে খিলাফৎ আন্দোলন গড়ে তোলেন। গান্ধীজি কংগ্রেসের আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফৎ আন্দোলন সংযুক্ত করতে সমর্থ হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা এবং ঐ বৎসরের শেষদিকে নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনে যৌথ আন্দোলনের নীতি গ্রহণ করা হয়। এই যৌথ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল-

(ক) পাঞ্জাবে ব্রিটিশের অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিবাদ।

(খ) তুর্কী সাম্রাজ্যের উপর ব্রিটিশের অবিচারের প্রতিবাদ। এবং

(গ) ভারত স্বরাজ গঠন।

এই অহিংস আন্দোলনের সূচনা করেন মহাত্মা গান্ধী। অহিংস অসহযোগ এবং আইন অমান্য—এই দুইটিই অহিংসার আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে গান্ধীজি আন্দোলনে এক নূতন যুগের সূচনা করেন।

ব্রিটিশ সরকারকে অচল করে দেওয়ার জন্য আইনসভা, বিচারালয়, সরকারি চাকরি, স্কুল, কলেজ প্রভৃতি বর্জন করে অহিংস আন্দোলনে যোগদান করার জন্য গান্ধীজি ভারতবাসীকে আহ্বান জানান। জমির খাজনা ব্রিটিশ সরকারকে জমা না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। আফিং, ভাঙ, মদ, সিগারেট প্রভৃতি বিদেশি মাদকদ্রব্য বর্জন করতেও বলা হয়। চরকায় সুতা কাটা, খদ্দরের কাপড় পরা আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মহাত্মা গান্ধীর প্রতি অসীম শ্রদ্ধার জন্য ভারতবাসী এইগুলি মেনে নিয়ে আন্দোলনে যোগদান করে।

লালা লাজপত রায়, মতিলাল নেহরু, মহম্মদ আলি, সৌকত আলি, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, সরোজিনী নাইডু প্রমুখ দেশের প্রায় অধিকাংশ নেতা এই আন্দোলনে যোগদান করেন। আসাম হতে চন্দ্রকান্ত শর্মা, তরুণরাম ফুকন, নবীনচন্দ্র বরদলৈ প্রমুখ নেতারাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

অসহযোগ আন্দোলনকে দমন করার ব্যাপক আন্দোলন আরম্ভ হয়। ঠিক তখনই ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স-অব-ওয়েলস ভারতে আসেন। সেইদিন দেশের সর্বত্র বিক্ষোভ দেখানো হলে জনতার উপর নির্মম লাঠি চালানো হয় এবং ব্যাপক ধরপাকড় আরম্ভ হয়। মহাত্মা গান্ধীজি সহ বহু নেতা কারারুদ্ধ হলেন। পুলিশের অত্যাচারে বহু লোকের মৃত্যু ও অনেক লোক আহত হয়। পুলিশের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরা নামক স্থানে বিক্ষুব্ধ একদল জনতা একটি থানা আক্রমণ করে কয়েকজন পুলিশকে হত্যা করে।

অহিংসা আন্দোলনের মধ্যে এই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটার প্রতিবাদে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। গান্ধীজির এইরূপ সিদ্ধান্তে জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। গান্ধীজির ছয় বৎসরের কারাবাস হয়। এদিকে তুরস্কের গাজী মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক বিজয়ী হলে সুলতান গদিচ্যুত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতের খিলাফৎ আন্দোলনের অবসান ঘটে এবং তখনই অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের যবনিকা পড়ে।

প্রশ্ন ৭। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনাসমূহ কেন অমীমাংসিত হয়েছিল?

উত্তরঃ মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ডাণ্ডি যাত্রায় ব্রিটিশ উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে তাদের শাসন চিরস্থায়ী নয়। তাদের যদি দীর্ঘদিন শাসন করতে হয় তাহলে ভারতীয়দের শাসন ও নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এইজন্য ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে পরপর তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের ব্যবস্থা করেন।

প্রথম গোলটেবিল বৈঠক ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে কোন ভারতীয় নেতা যোগদান না করায় বৈঠক নিষ্ফল হয়ে যায়। সুতরাং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গান্ধীজিকে কারামুক্ত করা হয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পুনরায় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গান্ধীজি এতে যোগদান করেন। ফলে গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী গান্ধীজি আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত রাখতে সম্মত হন।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গান্ধীজি কংগ্রেসের পক্ষে বৈঠকে যোগদান করেন। কংগ্রেস সারা দেশের নেতৃত্ব করে, গান্ধীজির এই দাবি মুসলিম লীগ প্রত্যাখ্যান করে। দেশীয় রাজাগণ গান্ধীজির এই দাবি অস্বীকার করেন। তাদের মতে তাদের রাজ্যে কংগ্রেসের কোন এক্তিয়ার নেই। এইরূপ মতানৈক্যের ফলে বৈঠক অমীমাংসিত থেকে যায়। গান্ধীজি ভগ্নহৃদয়ে দেশে ফিরে এসে পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করেন।

প্রশ্ন ৮। জাতীয় আন্দোলনের প্রকৃতি মহাত্মা গান্ধী কিভাবে পরিবর্তন করেছিলেন?

উত্তরঃ জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা অক্টোবর কাথিয়াবাড়ের অন্তর্গত পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। রাজকোর্ট ও ভাবনগরে স্কুল ও কলেজী শিক্ষালাভের পর ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য লন্ডন গমন করেন। ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি স্বদেশে ফিরে আসেন। গান্ধীজি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির থাকায় ভারতে আইন ব্যবসায়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারেন নি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ: ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি একটি বিশেষ মামলা পরিচালনার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয়দের উপর অত্যাচার করে তাদের জীবন ও সম্পত্তি বিপন্ন করার প্রতিবাদে গান্ধীজি সেখানে সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করে ন্যায় ও সত্যের মর্যাদা রক্ষার জন্য নীরবে সকল অত্যাচার সহ্য করে শত্রু মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তাঁর চেষ্টায় দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত ন্যাটালের ভারতীয়গণ ভোটাধিকার লাভ করেন।

ভারতের সত্যাগ্রহ: দক্ষিণ আফ্রিকা হতে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বিহারের চম্পারণ জেলায় কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেন। এর পর আহমেদাবাদের বস্ত্রকল শ্রমিকদের উপর মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সাফল্য অর্জন করেন।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করে প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দের অন্যতম হলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস গান্ধীজির ‘অহিংসা-অসহযোগ’ এবং ‘সত্যাগ্রহ’ প্রস্তাব গ্রহণ করে জাতীয় আন্দোলন চালনার পূর্ণ দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করে। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য তিনি আইন সভার সদস্যগণকে এবং সরকারি কর্মচারীগণকে পদত্যাগ, ছাত্রছাত্রীদের ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত বিদ্যালয় এবং আইনজ্ঞদের আদালত বর্জনের আহ্বান করেন। বহু ভারতবাসী বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে সত্যাগ্রহে যোগদান করতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্দোলন অহিংসাচ্যুত হওয়ায় গান্ধীজি আন্দোলন স্থগিত করেন।

খিলাফৎ আন্দোলন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরস্কের খলিফাকে জার্মান পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অজুহাতে ইংরেজ সরকার সিংহাসনচ্যুত করলে ভারতীয় মুসলমানগণ খলিফার পক্ষে ভারতে আন্দোলন আরম্ভ করেন। গান্ধীজি মুসলমানদের এই আন্দোলনকে কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত করেন।

আইন অমান্য আন্দোলন: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের গান্ধীজির নেতৃত্বে আইন অমান্য ও বরদৌলী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ভারতীয় জনগণ অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। কিন্তু এই আন্দোলন হিংসায় রূপান্তরিত হলে তিনি তা বন্ধ করে দেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি ডাণ্ডি অভিযান করে লবণ আইন অমান্য করে কারাবরণ করেন।

গোলটেবিল বৈঠক: ব্রিটিশ সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় উপনীত হবার জন্য ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কংগ্রেস তা বয়কট করে। বড়লাট আরউইনের সঙ্গে গান্ধীজির একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। মুসলীম লীগ নেতা জিন্নার চাপে ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা প্রস্তাবের পক্ষপাতী থাকায় গান্ধীজি ডিসেম্বর মাসে বৈঠক ত্যাগ করে এসে দেখেন যে জাতীয়তাবাদের উপর সরকারি নির্যাতন চলছে। গান্ধীজি বড়লাটের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হন। তাঁকে ও অন্যান্য নেতাকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পদত্যাগ: ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের শর্ত অনুযায়ী ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস মোট নয়টি প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করে। কিন্তু কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া ইংরেজ সরকার ভারতকে যুদ্ধে লিপ্ত করার প্রতিবাদে গান্ধীজির নির্দেশে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি ‘’ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন করলে ভারতের জনগণ তাতে অভূতপূর্ব সাড়া দেন। সরকারি অত্যাচারে অসংখ্য নর-নারী এই আন্দোলনে প্রাণ হারান।

ভারত-বিভাগ: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিভাগের প্রস্তাব গান্ধীজি প্রথমে নাকচ করেছিলেন, কিন্তু পরে নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তাতে সম্মতি দান করেন।

স্বাধীনতার পূজারি ব্যতীত অস্পৃশ্যতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর অবদান অসামান্য। কিন্তু কালের প্রভাবে অহিংসা মন্ত্রের পূজারি মহাত্মা গান্ধীকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি আততায়ীর হাতে প্রার্থনাসভায় প্রাণ দিতে হয়।

ভারতের জাতীয় জীবনে মহাত্মা গান্ধীর জীবন একটি বিরাট শিক্ষাস্বরূপ। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যগুলির এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল গান্ধীজির চরিত্রে। জাতিকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে যে জাতীয়তা বোধের প্রয়োজন, মহাত্মা গান্ধী তা ভারতীয়দের মধ্যে জাগিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী সত্যই মহান আত্মার যুগপুরুষ ছিলেন। তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে চলতে পারলে শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বের মঙ্গল সাধিত হবে। গান্ধীজি ভারতীয় জাতির জনক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top