Class 12 Political Science Chapter 1 বিশ্ব রাজনীতিতে শীতল যুদ্ধের যুগ

Class 12 Political Science Chapter 1 বিশ্ব রাজনীতিতে শীতল যুদ্ধের যুগ Question Answer | AHSEC Class 12 Political Science Question Answer in Bengali to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapters Class 12 Political Science Chapter 1 বিশ্ব রাজনীতিতে শীতল যুদ্ধের যুগ Notes and select needs one.

Class 12 Political Science Chapter 1 বিশ্ব রাজনীতিতে শীতল যুদ্ধের যুগ

Join Telegram channel

Also, you can read the SCERT book online in these sections Class 12 Political Science Chapter 1 বিশ্ব রাজনীতিতে শীতল যুদ্ধের যুগ Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 12 Political Science Chapter 1 বিশ্ব রাজনীতিতে শীতল যুদ্ধের যুগ Solutions for All Subjects, You can practice these here.

বিশ্ব রাজনীতিতে শীতল যুদ্ধের যুগ

Chapter: 1

প্রথম খন্ড (সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি)

অতি-সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। শীতল যুদ্ধ বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ বলতে আমেরিকা ও তার মিত্রগোষ্ঠীর সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়া ও তার মিত্রগোষ্ঠীর মধ্যে চলতে থাকা প্রতিযোগিতা, চাপা উত্তেজনা ও ধারাবাহিক পারস্পরিক যুদ্ধং দেহি মনোভাবকে বোঝায়।

প্রশ্ন ২। শীতল যুদ্ধ কখন আরম্ভ হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।

প্রশ্ন ৩। NATO-র সম্পূর্ণ রূপ লেখ।

উত্তরঃ North Atlantic Treaty Organization.

প্রশ্ন ৪। ওয়ারশ (Warsaw) চুক্তি কি?

উত্তরঃ ওয়ারশ চুক্তি হল শান্তি, মৈত্রী ও পারস্পরিক সহায়তার একটি চুক্তি। চুক্তিটি ১৯৫৫ সালে ২০ বছর সময়সীমার জন্য স্বাক্ষরিত হয়।

প্রশ্ন ৫। ওয়ারশ (Warsaw) চুক্তির মূল উদ্দেশ্য কি ছিল?

উত্তরঃ ন্যাটো (NATO) শক্তিকে প্রতিরোধ করা।

প্রশ্ন ৬। বাক্যটি শুদ্ধ কর:

আমেরিকা সমাজবাদী আদর্শ অনুসরণ করে।

উত্তরঃ আমেরিকা পুঁজিবাদী আদর্শ অনুসরণ করে।

প্রশ্ন ৭। শূন্যস্থান পূর্ণ কর:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ______ আরম্ভ হয়।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ।

প্রশ্ন ৮। শীতল যুদ্ধের সময় নির্ধারণ কর।

উত্তরঃ ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত শীতল যুদ্ধের সময়কাল।

প্রশ্ন ৯। হ্যাঁ বা না লেখ:

শীতল যুদ্ধ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলতে থাকা প্রতিযোগিতা।

উত্তরঃ হ্যাঁ।

প্রশ্ন ১০। NIEO- র সম্পূর্ণ রূপটি লেখ।

উত্তরঃ New International Economic Order.

প্রশ্ন ১১। CENTO বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ Central Treaty Organization।

প্রশ্ন ১২। রোধকরণ বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ রোধকরণ কথার অর্থ প্রতিহত করা বা নিরুৎসাহিত করা।

প্রশ্ন ১৩। LOCs কি?

উত্তরঃ Line of Controls বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা।

প্রশ্ন ১৪। NAM-এর সম্পূর্ণ রূপটি লেখ।

উত্তরঃ Non Aligned Movement.

প্রশ্ন ১৫। কিউবার সংকট কি ছিল?

উত্তরঃ আণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সংকট।

প্রশ্ন ১৬। UNCTAD কি?

উত্তরঃ United Nations Conference on Trade & Development.

প্রশ্ন ১৭। দুটি মহাশক্তিধরের নাম লেখ।

উত্তরঃ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়ন)।

প্রশ্ন ১৮। NAM-এর উদ্দেশ্য পৃথকীকরণ কি?

উত্তরঃ না।

প্রশ্ন ১৯। কোন্ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের মহানগর হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে দুটি আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল?

উত্তরঃ ১৯৪৫ সালে।

প্রশ্ন ২০। LDCs কি?

উত্তরঃ Least Developed Countries (স্বল্পোন্নত দেশ)।

অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ২১। কিউবায় মিসাইল সংকট কখন সংঘটিত হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৯৬২ সালে।

প্রশ্ন ২২। শীতল যুদ্ধকে long twilight কে বলেছেন?

উত্তরঃ মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি।

প্রশ্ন ২৩। Central Treaty Organization (CENTO) কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৯৫৪ সালে।

প্রশ্ন ২৪। কোন্ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরি আক্রমণ করেছিল?

উত্তরঃ ১৯৫৬ সালে।

প্রশ্ন ২৫। বাগদাদ চুক্তি কখন স্বাক্ষরিত হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৯৫৫ সালে।

প্রশ্ন ২৬। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি কখন হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৯৯১ সালে।

প্রশ্ন ২৭। জোসেফ টিটো কে ছিলেন?

উত্তরঃ যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র শক্তি এবং বিরোধী শক্তি বলতে কি বোঝায়?

উত্তরঃ মিত্র শক্তি বলতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স জোটকে বোঝায়। বিরোধী শক্তি বলতে জার্মানি, ইতালি ও জাপান জোটকে বোঝায়।

প্রশ্ন ২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি কখন ঘটে?

উত্তরঃ ১৯৪৫ সালের ১৪ই আগস্ট জাপান নিঃশর্তভাবে মিত্রগোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

প্রশ্ন ৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অভ্যুত্থান হওয়া দুটি মহাশক্তিধর দেশের নাম উল্লেখ কর।

উত্তরঃ দুটি মহাশক্তিধর দেশ হল—আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।

প্রশ্ন ৪। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোন্ দুটি শহরের উপর আণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল?

উত্তরঃ আণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল—জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে।

প্রশ্ন ৫। মহাশক্তিধর দেশের ক্ষুদ্র মিত্রগোষ্ঠীর কেন প্রয়োজন হয়?

উত্তরঃ মহাশক্তিধর দেশের ক্ষুদ্র মিত্রগোষ্ঠীর প্রয়োজন হয় যাতে এরা ক্ষুদ্র মিত্রগোষ্ঠী থেকে কিছু সুযোগ আদায় করতে পারে; যেমন—তেল ও খনিজ সম্পদ, অস্ত্র ও সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করার অঞ্চল, সামরিক ব্যয়ভার বহন ইত্যাদি।

প্রশ্ন ৬। পাশ্চাত্য মিত্রগোষ্ঠী ও প্রাচ্যের মিত্রগোষ্ঠী বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ পাশ্চাত্য মিত্রগোষ্ঠী বলতে আমেরিকার নেতৃত্বে পরিচালিত গোষ্ঠী এবং প্রাচ্যের মিত্রগোষ্ঠী বলতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে মিত্রগোষ্ঠীকে বোঝায়।

প্রশ্ন ৭। দুটি বৃহৎ শক্তিধর দেশের মধ্যে সংগঠিত হওয়া দুটি অস্ত্রসংবরণ চুক্তির বিষয়ে উল্লেখ কর।

উত্তরঃ অস্ত্রসংবরণ চুক্তি দুটি নিম্নরূপ:

(ক) পরিকল্পিত অস্ত্রসংবরণ চুক্তি – ১ (১৯৯১)

(খ) পরিকল্পিত অস্ত্রসংবরণ চুক্তি – ২ (১৯৯৩)

প্রশ্ন ৮। কখন এবং কোথায় প্রথম গোষ্ঠীনিরপেক্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তরঃ ১৯৬১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ৬ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেলগ্রেড-এ প্রথম গোষ্ঠীনিরপেক্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রশ্ন ৯। NATO রাষ্ট্রসমূহের ঘোষণাপত্র কি ছিল?

উত্তরঃ NATO-র ঘোষণাপত্রে উল্লেখ ছিল যে ন্যাটো সদস্যভুক্ত কোন রাষ্ট্রকে আক্রমণ ন্যাটোভুক্ত সকল সদস্যরাষ্ট্রকে আক্রমণ বলে গণ্য করা হবে এবং সংগঠনের প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পরকে সাহায্য করার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।

প্রশ্ন ১০। NIEO কি একটি ধারণাই ছিল, যা কোনদিন শৃঙ্খলায় পরিণত হতে পারেনি?

উত্তরঃ NIEO একটি ধারণাই ছিল। তা শৃঙ্খলায় পরিণত হতে পারেনি। কারণ স্বল্পোন্নত দেশগুলি উন্নত রাষ্ট্রসমূহের উপর অধিক নির্ভরশীল ছিল।

প্রশ্ন ১১। রোধকরণ যুক্তি বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ রোধকরণ যুক্তি বলতে বোঝায় কোন একটি দেশ অপর কোন দেশকে ইচ্ছাকৃতভাবে পরমাণু অস্ত্র দ্বারা আক্রমণ করবে না।

প্রশ্ন ১২। শীতল যুদ্ধের সূচনার মূল কারণটি লেখ।

উত্তরঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মতাদর্শগত বিভেদই শীতল যুদ্ধের সূচনার মূল কারণ।

প্রশ্ন ১৩। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ কেন মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের জন্য সহায়ক ছিল?

উত্তরঃ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের জন্য সহায়ক ছিল, কারণ মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ তাদের কাছ থেকে নানারকম সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে পারত কিছু সাহায্যের বিনিময়ে।

প্রশ্ন ১৪। মিত্রশক্তি এবং অক্ষশক্তি বলতে কি বোঝায়?

উত্তরঃ মিত্রশক্তি বলতে বোঝায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জোটকে।

অপরদিকে অক্ষশক্তি বলতে বোঝায় জার্মানি, ইতালি ও জাপানের জোটকে।

প্রশ্ন ১৫। কমিউনিস্ট পরিমণ্ডলের তিনটি দেশের নাম লেখ।

উত্তরঃ কমিউনিস্ট পরিমণ্ডলের তিনটি দেশ হল—সোভিয়েত ইউনিয়ন, রুমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া।

প্রশ্ন ১৬। গোষ্ঠী নিরপেক্ষতা কি এক নেতিবাচক নীতি?

উত্তরঃ গোষ্ঠী নিরপেক্ষতা বা জোট নিরপেক্ষতা কোন নেতিবাচক নীতি নয়। জোট নিরপেক্ষতাবাদ বলতে সেই সকল দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে বোঝায় যারা সোভিয়েত জোট বা মার্কিন জোট কোনটার সঙ্গে যুক্ত না হয়েও বিশ্ববাজারে নিজেদের জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় ভাবধারার মর্যাদা অর্জন ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে সচেষ্ট।

প্রশ্ন ১৭। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিকতা হতে মুক্ত হওয়া যে-কোন চারটি দেশের নাম লেখ।

উত্তরঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হওয়া চারটি দেশ হল— ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ব্রহ্মদেশ।

প্রশ্ন ১৮। ২০তম NATO শীর্ষ সম্মেলন কোথায় এবং কত সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তরঃ ২০তম NATO শীর্ষ সম্মেলন শিকাগোতে ২০১২ সালের ২০শে মে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রশ্ন ১৯। সোভিয়েত পরিমণ্ডলে যোগদানকারী দেশসমূহের নাম লেখ।

উত্তরঃ সোভিয়েত পরিমণ্ডলে যোগদানকারী দেশসমূহের নাম হল–পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি এবং রুমানিয়া। এরা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিল।

অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ২০। শীতল যুদ্ধের দুইটি এলাকা চিহ্নিত কর।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধের দুইটি এলাকা নিম্নরূপ:

(ক) শীতল যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হল আফগানিস্তান।

(খ) শীতল যুদ্ধের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হল কোরিয়া।

প্রশ্ন ২১। ন্যাটো (NATO) বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে ১২টি রাষ্ট্রকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর অতলান্তিক চুক্তি প্রতিষ্ঠান (North Atlantic Treaty Organization) বা ন্যাটো (NATO) নামে একটি পশ্চিমী জোট গঠিত হয়। এই সংগঠন ঘোষণা করে যে ইউরোপ অথবা উত্তর আমেরিকায় এই সংগঠনের যে-কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণকে গোটা সংগঠনের বিরুদ্ধেই অভিযান হিসাবে গণ্য করা হবে। সংগঠনের প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পরকে সাহায্য করার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।

প্রশ্ন ২২। সেন্টো (CENTO) বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ায় (মধ্যপ্রাচ্যে) আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলির স্বার্থ সুরক্ষার জন্য ১৯৫৫ সালে বাগদাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিই ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় চুক্তি সংগঠন (Central Treaty Organization, CENTO) নামকরণ করা হয়। সেন্টো একটি সামরিক আঁতাত। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তান সেন্টো পরিত্যাগ করলে তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

প্রশ্ন ২৩। শীতল যুদ্ধের সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট ইউনিয়ন তাদের বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত সামরিক চুক্তি দুটির নাম কি?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধের সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট ইউনিয়ন তাদের বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে যে দুটি সামরিক চুক্তি করেছিল তা হল—

(ক) ন্যাটো (NATO)। এবং 

(খ) ওয়ারশ চুক্তি।

প্রশ্ন ২৪। ওয়ারশ চুক্তি ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ১৯৫৫ সালের মে মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্বীয় জোট ওয়ারশ চুক্তি (Warsaw Pact) সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমী জোট ন্যাটোর (NATO) সামরিক শক্তিকে প্রতিহত করা এবং শান্তি ও মৈত্রী স্থাপনে পরস্পরকে সাহায্য করা।

দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। শীতল যুদ্ধ শীতল হয়ে থাকল, গরম যুদ্ধে কেন পরিবর্তিত হয়নি?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসেবে উত্থানের সাথে সাথেই শীতল যুদ্ধের সূচনা হয়। দুটি দেশই পারমাণবিক অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান ছিল। পারমাণবিক শক্তিধর হওয়া স্বত্ত্বেও কোন পক্ষই সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে আগ্রহী ছিল না, কেননা পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণাম উভয় পক্ষের কাছেই অপরিসীম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্ররোচনা সত্ত্বেও কোন পক্ষই যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চায়নি, কেননা নিজের নিজের দেশ ও সম্প্রদায়কে কোন রাজনৈতিক মুনাফার লোভে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ফলে শীতল যুদ্ধ শীতল হয়ে থাকল, গরম যুদ্ধে পরিবর্তিত হয়নি।

প্রশ্ন ২। মহাশক্তিধর দেশসমূহ যে চুক্তিব্যবস্থার নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই চুক্তিসমূহ সমগ্র বিশ্বকে দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছিল বলে তুমি মনে কর কি? যুক্তি দাও।

উত্তরঃ মহাশক্তিধর দেশসমূহ যে চুক্তিব্যবস্থার নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই চুক্তিসমূহ সমগ্র বিশ্বকে দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছিল বলে আমি মনে করি।

শীতল যুদ্ধ শুধুমাত্র শক্তি প্রদর্শনের, সামরিক সংঘবদ্ধতার ও শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার মধ্যেই সীমিত ছিল না। বাস্তবে এটি ছিল একটি আদর্শগত সংঘাত। সমগ্র বিশ্বের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ব্যাপারে দুটি শক্তির মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী শক্তিসমূহ উদার গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছিল। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রাচ্যের মিত্রশক্তিসমূহ সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল।

প্রশ্ন ৩। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহকে কিভাবে সাহায্য করে?

উত্তরঃ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহকে নিম্নোক্ত রূপে সাহায্য করে:

(ক) ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলিকে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও খনিজ সম্পদে আধিপত্য বিস্তার করতে সহায়তা করে।

(খ) ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলিকে তাদের ভৌগোলিক এলাকায় প্রবেশাধিকার প্রদান করে যাতে তারা সেখান হতে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে।

(গ) মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলি গোয়েন্দা কাজের প্রয়োজনীয় অবস্থান ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিতে অতি সহজে পেয়ে থাকে।

(ঘ) ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ একত্রে সামরিক ব্যয়ভার দিতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন ৪। শীতল যুদ্ধের যুগে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন (NAM)-এর ভূমিকা আলোচনা কর।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধোত্তরকালে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে:

(ক) গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা করে।

(খ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামাজিক ও আর্থিক পরিকাঠামো পুনর্গঠনের দায়িত্ব গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের উপর নিয়োজিত, যা একমাত্র যুদ্ধমুক্ত বিশ্বেই সম্ভব। গোষ্টী নিরপেক্ষ আন্দোলন এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

(গ) নবস্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশসমূহ সাম্রাজ্যবাদের বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। সুতরাং এই দেশসমূহ বিশ্বশান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টায় গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত বিশ্বগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(ঘ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রক্ষা ও জাতি বৈষম্যমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

প্রশ্ন ৫। আদর্শগত পার্থক্যই শীতল যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল বলে তুমি মনে কর কি?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ হল মূলত বিশ্বের মহাশক্তিধর দুটি রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত সংঘের বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। শীতল যুদ্ধ শুধুমাত্র শক্তি প্রদর্শনের, সামরিক সংঘবদ্ধতার ও শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার মধ্যে সীমিত ছিল না। সমগ্র বিশ্বের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ব্যাপারে দুটি শক্তির মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী শক্তিসমূহ উদার গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছিল, অপরদিকে সোভিয়েত সংঘের নেতৃত্বে প্রাচ্যের মিত্রশক্তিসমূহ সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। শীতল যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব দুটি পৃথক গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায় এবং প্রত্যেক গোষ্ঠীই নিরপেক্ষ দেশগুলিকে তাদের গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তাই বলা হয়ে থাকে যে শীতল যুদ্ধ ক্ষমতা দখলের একটি সহজ লড়াই এবং এর সঙ্গে আদর্শের খুব একটা যোগ নেই।

প্রশ্ন ৬। গোষ্ঠীনিরপেক্ষ আন্দোলন গঠনে ভারতের ভূমিকা নির্ণয় কর।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধের সময় গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসাবে শীতল যুদ্ধের প্রতি ভারতের দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া ছিল—

(ক) যাতে দুই বৃহৎ শক্তিগোষ্ঠীর প্রভাবে না পড়ে সে বিষয়ে যত্নবান হওয়া। এবং 

(খ) উপনিবেশবাদকে পরাস্ত করে নতুনভাবে স্বাধীনতা লাভ করা রাষ্ট্রগুলি যাতে কোন বৃহৎ শক্তিগোষ্ঠীতে যোগদান না করে তার প্রতিবাদ করা। ভারতবর্ষই চেষ্টা করেছিল যাতে দুটো বৃহৎ শক্তিগোষ্ঠীর মধ্যে পুরোদমে যুদ্ধ সংঘটিত হতে না পারে। শীতল যুদ্ধের তীব্রতা কমানোর জন্য ভারত বিশ্ব রাজনীতিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করা পছন্দ করেছে।

প্রশ্ন ৭। বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ আমরা দেখেছি শীতল যুদ্ধ কিভাবে পৃথিবীকে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী জোটে ভাগ করে ফেলার দিকে এগোচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ঔপনিবেশবাদ হতে সদ্য মুক্তি পাওয়া দেশগুলিকে জোট নিরপেক্ষতা একটি তৃতীয় বিকল্পের সন্ধান দেয়।

১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২৫টি রাষ্ট্রের উপস্থিতিতে। 

নিম্নোক্ত তিনটি কারণে এই সম্মেলন সম্ভবপর হয়েছিল:

(ক) ভারত, যুগোশ্লাভিয়া, মিশর, ইন্দোনেশিয়া ও ঘানা এই পাঁচটি দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা।

(খ) শীতল যুদ্ধের পরিধির বিস্তার ও ক্রমবর্ধমান চাপা উত্তেজনা।

(গ) আন্তর্জাতিক আঙিনায় আফ্রিকার ঔপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত বহু নতুন রাষ্ট্রের চমকপ্রদ প্রবেশ।

বেলগ্রেড সম্মেলনে গৃহীত নীতিগুলি হল—বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা, নিরস্ত্রীকরণ, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ঔপনিবেশবাদের বিরোধিতা, বর্ণবৈষম্য ও জাতি বিদ্বেষের অবসান, আণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ প্রভৃতি।

প্রশ্ন ৮। NATO-র সদস্য রাষ্ট্রগুলি কি কি?

উত্তরঃ ন্যাটো (NATO) হল ১৯৪৯ সালে ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় বারোটি রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত পশ্চিমী সামরিক জোট। এই জোটের প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পরকে সাহায্য করার জন্য দায়বদ্ধ ছিল। NATO-র সদস্য রাষ্ট্রগুলি হল বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা।

প্রশ্ন ৯। মিত্র শক্তি ব্যবস্থার আদর্শগত কারণ কি?

অথবা,

মিত্রতা ব্যবস্থার আদর্শগত কারণসমূহ লেখ।

উত্তরঃ মিত্র শক্তি ব্যবস্থার আদর্শগত কারণসমূহের ভিতর আদর্শের মিল থাকা দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতা দ্বারা নিজেদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। সে সময় পশ্চিমী দেশসমূহকে স্বাধীনতার পৃষ্ঠপোষকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছিল আর সোভিয়েত রাশিয়াকে স্বেচ্ছাচারী শাসনের পৃষ্ঠপোষক বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল। তার উপর আমেরিকা সাম্যবাদী আন্দোলনকে সমূলে ধ্বংস করার পক্ষপাতিত্বমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল। তদুপরি গ্রীসের পর ভিয়েতনাম পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রতেই এই নীতি জোর করে কার্যকর করা হচ্ছিল।

প্রশ্ন ১০। রাষ্ট্রীয় ও দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের জন্য দুই বিশ্বশক্তি কেন সহায়তা করেছিল?

অথবা,

মহাশক্তিদ্বয় কেন রাষ্ট্রীয় ও দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছিল?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ বলতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলতে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চাপা উত্তেজনা ও ধারাবাহিক সংঘর্ষকে বোঝায়। সৌভাগ্যবশত এটি কোন ‘উত্তপ্ত যুদ্ধ’ বা কোন সর্বগ্রাসী যুদ্ধের দিকে দুটি মহাশক্তিকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। প্ররোচনা সত্ত্বেও কোন পক্ষই যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চায়নি কেননা নিজের নিজের দেশ ও সম্প্রদায়কে কোন রাজনৈতিক মুনাফার লোভে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া সমর্থনযোগ্য হতে পারেনা। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা সত্ত্বেও দুটি শক্তিই উত্তপ্ত হওয়া অথবা যুদ্ধ বাধিয়ে তোলার পরিবর্তে শীতল থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করে।

প্রধান দুটি শক্তিগোষ্ঠীর অন্তর্গত রাষ্ট্রসমূহ যুক্তিবাদী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। যে-কোন যুদ্ধে প্রধান দুটি শক্তি সামিল হয়ে পড়লে তার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে সে বিষয়ে এই সকল রাষ্ট্রসমূহের কোন সন্দেহ ছিল না। তাই যে-কোন যুদ্ধের ফলে মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পুঁজিবাদী আদর্শের উপর আস্থা রাখা মার্কিন নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ ও সাম্যবাদী আদর্শের উপর আস্থা রাখা সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ রাষ্ট্রীয় ও দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করে।

প্রশ্ন ১১। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত রাশিয়া দ্বারা কিউবাতে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করার কারণ কি ছিল?

অথবা,

কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট কি ছিল?

উত্তরঃ ১৯৬১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে পুঁজিবাদী শক্তি আমেরিকা কিউবা আক্রমণ করবে। কারণ কিউবা ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার মিত্র রাষ্ট্র। সেই সময় ফিদেল কাস্ত্রো সাম্যবাদী রাষ্ট্র কিউবার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সাম্যবাদী রাষ্ট্রের সমর্থক রাষ্ট্র হিসাবে কিউবার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাশিয়াই পালন করার চেষ্টা করছিল। যার ফলে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাশিয়াই কিউবাতে ১৯৬২ সালে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করেছিল, যার ফলে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের সূত্রপাত হবার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে ওঠে। একেই কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট বলে।

প্রশ্ন ১২। কিসের ভিত্তিতে ভারতের জোট নিরপেক্ষ নীতির সমালোচনা করা হয়েছিল?

উত্তরঃ অনেকের মতে জোটনিরপেক্ষতা এমন কোন মহৎ আন্তর্জাতিক আন্দোলন ছিল না। ভারতের স্বার্থরক্ষায় এর অবদান ছিল যৎসামান্য। 

নিম্নোক্ত কারণে ভারতের জোট-নিরপেক্ষ নীতি সমালোচিত হয়:

(ক) একথা বলা হয় যে ভারতের জোট নিরপেক্ষতা ‘সুনীতিহীন’ ছিল। আরও বলা হয়ে থাকে যে নিজের জাতীয় স্বার্থ অনুসন্ধানে ব্যস্ত ভারত আন্তর্জাতিক বহু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় দৃঢ় অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়।

(খ) ভারতের অবস্থান অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরোধী ছিল। জোটভুক্ত হওয়ার জন্য অন্য রাষ্ট্রকে সমালোচনা করে ভারত নিজে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ১৯৭১ সালে ২০ বছরের জন্য ‘মিত্রতার চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ‘ট্রিটি অফ ফ্রেন্ডশিপ’ নামে পরিচিত। অন্যদের চোখে এই পদক্ষেপ সোভিয়েত জোটে সামিল হওয়ার নামান্তর মাত্র।

প্রশ্ন ১৩। শীতল যুদ্ধ সৃষ্টির যে-কোন চারটি কারণ লেখ।

উত্তরঃ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (US) ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (USSR) বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসেবে উত্থানের সাথে সাথেই শীতল যুদ্ধের সূচনা হয়। 

শীতল যুদ্ধের প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) শীতল যুদ্ধ মূলত বিশ্বের মহাশক্তিধর দুটি রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত সংঘের বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।

(খ) আদর্শগত সংঘাত শীতল যুদ্ধের আরও একটি মুখ্য কারণ। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট উদার গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিস্তারে সচেষ্ট ছিল, অপরদিকে সোভিয়েত সংঘের নেতৃত্বাধীন জোট সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র বিস্তারের পক্ষে ছিল।

(গ) নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষ্যে এবং বিশ্ববাণিজ্যে কর্তৃত্ব স্থাপনের লক্ষ্যে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে শীতল যুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ।

(ঘ) পারমাণবিক শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নেওয়া আগ্রাসন নীতি এবং এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল ইত্যাদি থেকে সামরিক ও রাজনৈতিক লাভ তোলা থেকে সোভিয়েত সংঘকে বিরত করার চেষ্টা শীতল যুদ্ধের আরও একটি কারণ।

প্রশ্ন ১৪। দুই মহাশক্তিকে কারা সহযোগিতা করেছিল?

উত্তরঃ সাম্যবাদী রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়া ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আমেরিকার মধ্যে দেখা দেওয়া আদর্শগত পার্থক্যের ফলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের বিভীষিকা দেখা দিয়েছিল। সাম্যবাদী আদর্শের উপর আস্থা রেখে রাশিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য রাষ্ট্রীয়করণের নীতি অবলম্বন করেছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী আমেরিকা তার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ছোট ছোট রাষ্ট্রে থাকা প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত তৈলজাত ও খনিজাত সম্পদ, ভোগ দখল করার প্রবণতা বাড়তে থাকল। বিশেষ করে স্থলক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিসমূহ যে যে রাষ্ট্রে অস্ত্র-শস্ত্র ও সেনা অভিযান করতে পারল, সেই সেই রাষ্ট্রের সম্পদ ভোগ করার সুবিধা লাভ করল। তদুপরি এই ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলিই বৃহৎ শক্তিজোটকে অবিরাম সহযোগিতা করেছিল।

প্রশ্ন ১৫। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন-এর সাফল্য সম্পর্কে একটি টীকা লেখ।

উত্তরঃ গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্বে নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করার পরিবর্তে সক্রিয়ভাবে শান্তিপূর্ণ আর নিরাপদ বিশ্ব রাজনীতি গড়ে তোলায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই নিরপেক্ষ আন্দোলন মহাশক্তির কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করে দেশীয় এবং বৈদেশিক নীতির উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। এই ক্ষেত্রে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের বিশ্ব রাজনীতির প্রতি সম্পূর্ণ একাত্মতা বোঝায় না। এক সক্রিয় ও গঠনমূলক নীতিতে স্বাধীনতা যত খর্ব হয় গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন ততই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১৬। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের চারজন নির্মাতার নাম লেখ।

উত্তরঃ নিম্নলিখিত চারজন গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের নির্মাতা:

(ক) ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।

(খ) ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ।

(গ) মিশরের রাষ্ট্রপতি আবু নাসের।

(ঘ) যুগোশ্লোভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো।

প্রশ্ন ১৭। শীতল যুদ্ধ কি?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এক নূতন ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়েছে যা ‘শীতল যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই শীতল যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। সাধারণভাবে বলা যায় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগামী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুগামী পশ্চিমী শক্তিগুলির মৈত্রীসম্পর্ক ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর সেই মৈত্রী ভেঙে যায়। এই সময় উভয় পক্ষই নিজ নিজ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়। তাদের মধ্যে নতুন ক্ষমতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক ‘শীতল যুদ্ধ’ বা ‘স্নায়ু যুদ্ধ’ নামে অভিহিত হয়।

প্রশ্ন ১৮। শীতল যুদ্ধের চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) শীতল যুদ্ধ কোন সশস্ত্র সংগ্রাম নয়।

(খ) শীতল যুদ্ধে জড়িত রাষ্ট্রগুলি যেমন একদিকে উভয়ের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক গঠন করতে প্রস্তুত, তেমনি অপর দিকে আদর্শগত কারণে একে অন্যকে দুর্বল করার প্রচেষ্টাও দেখা যায়।

(গ) শীতল যুদ্ধে জড়িত রাষ্ট্রগুলি নিজ সামরিক শক্তি প্রচার করার মাধ্যমে প্রকৃত যুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরও বৃদ্ধি করে। শীতল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি দুইটি শিবিরে বিভক্ত হয়েছে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপন ইচ্ছায় এই দুই পরস্পর বিরোধী শিবিরকে সমর্থন করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

(ঘ) শীতল যুদ্ধের মাধ্যমে প্রত্যেক রাষ্ট্রই বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।

(ঙ) শীতল যুদ্ধের আবহাওয়ায় বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।

প্রশ্ন ১৯। শীতল যুদ্ধের অবসানে রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকা কি?

উত্তরঃ ১৯৪৫ সালের ২৪শে অক্টোবর রাষ্ট্রসংঘ (UNO) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা। শীতল যুদ্ধ প্রশমনে রাষ্ট্রসংঘ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সফল হতে পারে নি। দুই শক্তিধর রাষ্ট্রগোষ্ঠীর মধ্যে শীতল যুদ্ধের ফলে বহুবার বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত হয়। রাষ্ট্রসংঘ শান্তি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। ফলে শীতল যুদ্ধ প্রশমনে রাষ্ট্রসংঘের প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রশ্ন ২০। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ কোন শক্তিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ না দিয়ে স্বাধীনভাবে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করার নীতিকে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি বা জোট নিরপেক্ষ নীতি বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী ও সমাজবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি শক্তিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। এই গোষ্ঠীদ্বয়ের কোনোটিতে যোগদান না করে উভয় শক্তিগোষ্ঠীর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে নিজের জাতীয় স্বার্থ পূরণের জন্য যে বিদেশ নীতি গ্রহণ করা হয় তাকেই গোষ্ঠী নিরপেক্ষ বা জোট নিরপেক্ষ নীতি বলা হয়।

প্রশ্ন ২১। পঞ্চশীল নীতি বলতে কি বোঝ?

উত্তরঃ ভারতের বিদেশ নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এই নীতি অনুসারে ১৯৫৪ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য পাঁচটি নীতি গ্রহণ করা হয়, যা পঞ্চশীল নীতি নামে পরিচিত।

প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বিশ্বশান্তি রক্ষার্থে ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে যে পাঁচটি নীতি (পঞ্চশীল) ঘোষণা করেছিলেন সেগুলি নিম্নরূপ:

(ক) অপরকে আক্রমণ না করা।

(খ) গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

(গ) সমমর্যাদা ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান।

(ঘ) রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক মর্যাদা।

(ঙ) অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা।

পঞ্চশীল নীতির সমালোচকদের মতে এই নীতি হল পাপগ্রস্ত। তথাপি সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে বলা যায় যে ভারত-চীন সম্পর্কের উন্নতির লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত এই নীতিগুলি প্রকৃত অর্থে তৃতীয় বিশ্বের জোটনিরপেক্ষ রাজনীতিকে মজবুত করেছিল।

প্রশ্ন ২২। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির যে-কোন চারটি উদ্দেশ্য উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৯৬১ সালের বেলগ্রেড শহরে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম সম্মেলনে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির অনুসরণকারী দেশগুলির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিম্নলিখিত ঘোষণা করা হয়েছিল:

(ক) গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির অনুসরণকারী দেশ শান্তির জন্য সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে।

(খ) বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির অনুসরণকারী দেশগুলির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করবে।

(গ) শীতল যুদ্ধের বিরোধিতা করবে।

(ঘ) উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করবে এবং বৈদেশিক শাসন হতে মুক্তি লাভের জন্য সব ধরনের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করবে।

প্রশ্ন ২৩। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের যে-কোন চারটি নীতি উল্লেখ কর।

উত্তরঃ গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান নীতিসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নির্মূল করা।

(খ) দেশের জনসাধারণের ইচ্ছা অনুসারে সরকার গঠন করার নীতির প্রতি সম্মান দেখানো।

(গ) বর্ণবৈষম্য নীতির বিরোধিতা করা।

(ঘ) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর গুরুত্ব দেওয়া।

(ঙ) দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।

প্রশ্ন ২৪। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভূমিকা বিষয়ে সংক্ষেপে বর্ণনা কর।

উত্তরঃ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রসংঘের এই গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় এইসব দেশে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলনগুলি এই দেশগুলির মধ্যে একতা রক্ষা করতে সাহায্য করে এসেছে। সুতরাং এই দেশগুলির ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। সম্প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর শীতল যুদ্ধের অবসান হয়েছে। এই পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতেও গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্রশ্ন ২৫। নিরপেক্ষতা ও জোট নিরপেক্ষতার মধ্যে প্রধান পার্থক্য উল্লেখ কর।

উত্তরঃ নিরপেক্ষতা ও জোট নিরপেক্ষতার মধ্যে প্রধান পার্থক্যসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) নিরপেক্ষতা শব্দটি সাধারণত বা মূলত যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু জোট নিরপেক্ষতা যুদ্ধ ও শান্তি পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

(খ) নিরপেক্ষতা শব্দটি সাধারণত আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জোট নিরপেক্ষ শব্দটি মূলত পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। জোট নিরপেক্ষতার অর্থ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নয়।

(গ) নিরপেক্ষতা হল এমন একটি বিষয় যা প্রায় স্বাতন্ত্র্যবাদের মতো। অন্যদিকে জোট নিরপেক্ষতার অর্থ বিজড়িত না করা নয়।

(ঘ) নিরপেক্ষতা একটি নেতিবাচক ধারণা, কারণ তা কোন পক্ষ অবলম্বন করা এড়াতে সাহায্য করে। অন্যদিকে জোট নিরপেক্ষতা হল একটি ইতিবাচক ধারণা, কারণ তা স্বাধীন বৈদেশিক নীতি অবলম্বনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

প্রশ্ন ২৬। ‘নূতন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ বলতে কি বোঝ?

অথবা,

নতুন আন্তঃরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরঃ নূতন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অর্থ হল এমন একটি আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা যাতে বিকাশশীল দেশ (নূতন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত) এবং অনুন্নত দেশসমূহ, উন্নত দেশ, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্বব্যাঙ্ক হতে অন্যান্য দেশের মতো তাদেরও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সাহায্য পেতে পারে। 

নূতন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চারটি মৌলিক দাবি হল নিম্নরূপ:

(ক) উত্তর গোলার্ধের উন্নত রাষ্ট্রগুলি হতে ব্যাপক পরিমাণে সম্পদ দক্ষিণ গোলার্ধের অনুন্নত দেশে প্রেরণ করা।

(খ) বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল প্রভৃতি অর্থ সংস্থায় বিকাশশীল দেশসমূহের প্রতিনিধিত্ব বর্ধিত করা ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান।

(গ) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার।

(ঘ) ন্যায়সঙ্গত শর্তে আর্থিক সাহায্য প্রদান।

প্রশ্ন ২৭। নূতন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার চারটি মৌলিক নীতি উল্লেখ কর।

উত্তরঃ নূতন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার মৌলিক নীতিসমূহ নিম্নরূপ:

(ক) নূতন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা রাষ্ট্রসমূহের সমান সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও অন্য রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

(খ) নূতন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীভুক্ত সকল সদস্য রাষ্ট্রের সহযোগিতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

(গ) নূতন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা বিশ্বের সকল দেশের সাধারণ স্বার্থে সমতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পূর্ণ ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

(ঘ) প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের উপর প্রত্যেক রাষ্ট্রের স্থায়ী সার্বভৌমত্ব। এই সম্পদসমূহ রক্ষার্থে সকল রাষ্ট্র তাদের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

প্রশ্ন ২৮। একমেরু বিশ্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা কিরূপ?

উত্তরঃ নানা কারণে বর্তমান একমেরু বিশ্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রাসঙ্গিক:

(ক) উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের মর্যাদা ও ক্ষমতার একটি স্থান অর্জন করা।

(খ) বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের নিরস্ত্রীকরণের উন্নতি।

(গ) নূতন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

(ঘ) আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিককরণ প্রভৃতির জন্য জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

অতি-দীর্ঘ প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। কিউবার মিসাইল সঙ্কট সম্পর্কে একটি টীকা লেখ। এর তাৎপর্য কি ছিল?

উত্তরঃ আমেরিকার সমুদ্র উপকুলে কিউবা একটি ছোট কমিউনিস্ট দ্বীপরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বন্ধু রাষ্ট্রটিকে কূটনৈতিক ও আর্থিক সাহায্য করে থাকত। ১৯৬১ সালের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা আক্রমণ করে রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রোকে অপসারিত করার পরিকল্পনা করছে জানতে পেরে সোভিয়েত সংঘের নেতৃবৃন্দ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি নিকিতা ক্রুশ্চেভ সিদ্ধান্ত নিলেন কিউবাকে সোভিয়েত রাশিয়ার সমরঘাঁটিতে পরিণত করার।

১৯৬২ সালে ক্রুশ্চেভ কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রাগার স্থাপন করেন। এই সমরাস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বপ্রথম রুশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় নিয়ে আসে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে আমেরিকার এমন শহর ও সমরঘাঁটির সংখ্যাও এর ফলে দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াল।

সোভিয়েত সংঘ কর্তৃক কিউবায় পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের তিন সপ্তাহ পর মার্কিনরা বিষয়টি জানতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডি ও তাঁর পরামর্শদাতারা এমন কোন পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন, যার জন্য দুটি দেশের মধ্যে কোন বড় মাপের যুদ্ধ বেধে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে কিউবা থেকে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার ও ক্ষেপণাস্ত্র সরানোর জন্য রাশিয়াকে বাধ্য করার ব্যাপারেও তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কেনেডি আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজগুলিকে কড়া নির্দেশ দিলেন কিউবা অভিমুখী যে-কোন সোভিয়েত জাহাজের গতিরোধ করার। তিনি বিষয়টিকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছেন সে ব্যাপারে সোভিয়েত সংঘকে সতর্ক করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।

এর ফলে একটি সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ল যা পরবর্তীকালে ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট’ (Cuban Missile Crisis) হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সংঘর্ষের সম্ভাব্য পরিণতির আশঙ্কায় সমগ্র বিশ্ব ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। অবশেষে সমগ্র বিশ্বকে আশ্বস্ত করে উভয়পক্ষই যুদ্ধ পরিহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সোভিয়েত জাহাজ গতি মন্থর করে পশ্চাদপসরণ করে।

তাৎপর্যের বিচারে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট শীতল যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

প্রশ্ন ২। গোষ্ঠীনিরপেক্ষ নীতিকে স্বাতন্ত্রবাদ বা নিরপেক্ষতা বলে মনে কর কি? যুক্তি দর্শাও।

উত্তরঃ গোষ্ঠীনিরপেক্ষতা বা জোটনিরপেক্ষতা যে স্বাতন্ত্রবাদ বা নিরপেক্ষতা নয়, তার কারণ নিম্নরূপ:

(ক) নিরপেক্ষ শব্দটি সাধারণত বা মূলত যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু জোটনিরপেক্ষতা যুদ্ধ ও শান্তি পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

(খ) নিরপেক্ষতা শব্দটি সাধারণত আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জোটনিরপেক্ষ শব্দটি মূলত পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। জোটনিরপেক্ষতার অর্থ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নয়।

(গ) নিরপেক্ষতা হল এমন একটি বিষয় যা প্রায় স্বাতন্ত্র্যবাদের মতো। অন্যদিকে জোটনিরপেক্ষতার অর্থ বিজড়িত না করা নয়।

(ঘ) নিরপেক্ষতা একটি নেতিবাচক ধারণা, কারণ তা কোন পক্ষ অবলম্বন করা এড়াতে সাহায্য করে। অন্যদিকে জোটনিরপেক্ষতা হল একটি ইতিবাচক ধারণা, কারণ তা স্বাধীন বৈদেশিক নীতি অবলম্বনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

প্রশ্ন ৩। শীতল যুদ্ধের সময়কালে গোষ্ঠীনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসাবে ভারতের ভূমিকা আলোচনা কর।

উত্তরঃ জোটনিরপেক্ষতা বলতে সেইসব দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে বোঝায় যাদের নীতি হল সমাজতান্ত্রিক জোট ও পুঁজিবাদী জোট—এই দুই জোটের মধ্যে কোন জোটেই যোগদান না করা। অবশ্য জোটনিরপেক্ষতা বলতে শুধু নিরপেক্ষতা বোঝায় না, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতে জোটনিরপেক্ষতা হল গতিশীল নিরপেক্ষতা।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের একজন নেতা হিসাবে শীতল যুদ্ধের প্রতি ভারতের প্রতিক্রিয়া দুই ধরনের ছিল। একটি স্তরে দুটি জোট হতে সমদূরত্বে থাকার সে সযত্ন প্রয়াস নেয়।

উপনিবেশমুক্ত নতুন রাষ্ট্রগুলির জোটভুক্ত হবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, ভারতের নীতি নঞর্থক বা নিষ্ক্রিয়তা ছিল না। নেহেরু বলেছিলেন জোটনিরপেক্ষতা ‘পালিয়ে যাবার’ নীতি নয়। ভারত বরঞ্চ বিশ্বের ঘটনাবলীতে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করে শীতল যুদ্ধের প্রতিযোগী মনোভাবকে নমনীয় করার চেষ্টা করেছিল। জোটগুলির মতানৈক্য কমিয়ে পূর্ণমাত্রায় কোন যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা ভারত করে। ভারতের কূটনীতিক ও নেতৃবৃন্দ প্রায়শই বার্তালাপ ও মধ্যস্থতা করেছেন শীতল যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে কোরিয়া যুদ্ধের কথা বলা যায়।

ভারত বারংবার সেই সকল আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে সক্রিয় করার প্রচেষ্টা করে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত সংঘের নেতৃত্বাধীন কোন জোটের সদস্য নয়। নেহেরু স্বাধীন ও সহযোগী রাষ্ট্রের একটি অকপট রাষ্ট্রমণ্ডলের উপর বিরাটভাবে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন, যেটি কিনা শেষ করতে না পারলেও শীতল যুদ্ধকে নমনীয় করতে একটি সদর্থক ভূমিকা পালন করে।

ভারতবর্ষ গোষ্ঠীনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্যোক্তা হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে নিজের আচার-আচরণ দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছিল এবং গোষ্ঠীনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল।

প্রশ্ন ৪। শীতল যুদ্ধ অবসানের পর গোষ্ঠীনিরপেক্ষ আন্দোলন নিজ তাৎপর্য হারিয়েছে বলে মনে কর কি? যুক্তি দর্শাও।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধের অবসানে বর্তমান বিশ্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে শীতল যুদ্ধের ফলস্বরূপ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত। এই আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে দুই মেরুগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তা বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষুদে রাষ্ট্রকে তাদের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় যথেষ্ট সাহায্য করেছে এবং রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় যথেষ্ট সহায়তা করেছে। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর মার্কিন আধিপত্য বৃদ্ধির ফলে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নানা বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এমতাবস্থায় নিম্নলিখিত কারণে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক:

(ক) বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্র। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনই বর্তমান বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য, জাপান ও অন্যান্য ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রভাব হতে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহকে প্রভাবমুক্ত করতে সক্ষম হবে।

(খ) জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অধিকাংশই উন্নয়নশীল অথবা অনুন্নত। সুতরাং এই রাষ্ট্রগুলির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

(গ) বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ প্রভূত পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী যা অন্যান্য রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদের কারণ। জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান সারা বিশ্বে সাড়া দেয়, যা বিশ্বের শান্তি রক্ষার এক বৃহৎ প্রচেষ্টা।

(ঘ) বিশ্বের অধিকাংশ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ সন্ত্রাসবাদ, মানবাধিকার, নিরস্ত্রীকরণ, পরিবেশ প্রদূষণ প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত। এই সমস্যাসমূহ জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর সহায়তায় সমাধান করা সম্ভব।

সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বর্তমানে একমেরু বিশ্বে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক, অর্থপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন ৫। ধরা যাক, শীতল যুদ্ধ সংগঠিত হয়নি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকগুলো ক্ষমতার কেন্দ্র সৃষ্টি হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতি ভারতের বৈদেশিক নীতির উপর কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করত কি? তিনটি দিক বা তিনটি অঞ্চলকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পার্থক্য কল্পনা কর।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ যদি সংগঠিত না হত, তাহলে বিশ্ব রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের পরিস্থিতি হত এবং বিশ্ব অন্যভাবে প্রভাবিত হত। 

ভারতের বৈদেশিক নীতির উপর নিম্নে উল্লেখ করা প্রভাব পরিলক্ষিত হত:

(ক) অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক: শীতল যুদ্ধের সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যেরূপ সম্পর্ক ছিল সেই সম্পর্কের পরিবর্তন হলেও হতে পারত। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন হতে পারত।

(খ) কাশ্মীর সমস্যা: শীতল যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত রাজনীতি ভারতের কাশ্মীর সমস্যাকে জটিল করে তুলেছিল। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে দুটি যুদ্ধও সংগঠিত হয়েছিল। আমেরিকা পাকিস্তানকে কাশ্মীর প্রশ্নে সদা সহায়তা করেছিল, এমনকী সামরিক শক্তি দিয়েও সাহায্য করেছিল। কিন্তু শীতল যুদ্ধ সংগঠিত না হলে কাশ্মীর সমস্যা এরূপ জটিল হত না।

(গ) গোষ্ঠীনিরপেক্ষ নীতি: শীতল যুদ্ধের প্রভাব ভারতের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছিল এবং সেই পরিবর্তন হল ভারতের গোষ্ঠীনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য অনেক রাষ্ট্র গোষ্ঠীনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিল। শীতল যুদ্ধ সংগঠিত না হলে এই গোষ্ঠীনিরপেক্ষ আন্দোলনের ধারণা সৃষ্টি নাও হতে পারত।

প্রশ্ন ৬। যুদ্ধোত্তরকালে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের নতুন ভূমিকা সংক্ষেপে বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধোত্তরকালে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে:

(ক) গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা করে।

(খ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামাজিক ও আর্থিক পরিকাঠামো পুনর্গঠনের দায়িত্ব গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের উপর নিয়োজিত, যা একমাত্র যুদ্ধমুক্ত বিশ্বেই সম্ভব। গোষ্টী নিরপেক্ষ আন্দোলন এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

(গ) নবস্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশসমূহ সাম্রাজ্যবাদের বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। সুতরাং এই দেশসমূহ বিশ্বশান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টায় গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত বিশ্বগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(ঘ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রক্ষা ও জাতি বৈষম্যমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

প্রশ্ন ৭। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি সম্পর্কে একটি টীকা লেখ।

উত্তরঃ যেহেতু শীতল যুদ্ধ দুটি জোটের শত্রুতা কমাতে ব্যর্থ হয়, পারস্পরিক সন্দেহ এদেরকে আপাদমস্তক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকতে এবং সর্বদা যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রাখে। যুদ্ধ বন্ধ করতে বিশাল অস্ত্রসম্ভারের প্রয়োজন আছে এরকম ধারণা করা হতে লাগল।

উভয় পক্ষ বুঝতে পারল যে সংযমশীলতা স্বত্ত্বেও যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। দুটি শক্তির মধ্যে যে-কোন একটি অন্য পক্ষের অস্ত্রসংখ্যার ভুল গণনা করতে পারে, একে অন্যের উদ্দেশ্যের ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে। এছাড়াও পারমাণবিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও ছিল। ভুলবশত বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোন একদিক থেকে অস্ত্র নিক্ষেপের আশংকাও ছিল। পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা বা শত্রুপক্ষের দ্বারা সংঘটিত কোন নাশকতামূলক ঘটনা তা জানার উপায় ছিল না। অগত্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত সংঘ একযোগে কিছু পারমাণবিক ও অপারমাণবিক অস্ত্র সীমিত রাখার অথবা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। উভয়পক্ষ রাজী হয় ‘অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ’ (Arms Control)-এর মাধ্যমে বিশ্বে একটি স্থায়ী ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে। 

১৯৬০ সাল থেকে এক দশকের মধ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে তিনটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি তিনটি ছিল সীমিত পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (Limited Test Ban Treaty), পারমাণবিক অস্ত্র সংবরণ চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty) এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধক চুক্তি (Anti-Ballistic Missile Treaty)। এরপরেও বৃহৎ শক্তিদুটি কয়েক দফা অস্ত্র সংবরণের বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসে এবং আরও কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করে। আণবিক শক্তি পরিহার করার মূলে দুই শক্তিগোষ্ঠীর মধ্যে হওয়া স্থায়ী শান্তি ও সমঝোতার চুক্তি অন্যতম কারণ।

প্রশ্ন ৮। নতুন আন্তঃরাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা সংগঠন (NIEO)-এর উদ্ভবের পিছনে বাস্তবতা কি ছিল?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধের সময় জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি শুধুমাত্র শান্তিসংস্থাপক ছিল না, এদের সম্মুখে প্রত্যাহ্বান ছিল অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের ও দেশের জনসাধারণকে দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্ত করার। এদের একটি বৃহৎ অংশ অনুন্নত দেশের শ্রেণীভুক্ত ছিল। নতুন দেশগুলির স্বাধীনতার জন্যও অর্থনৈতিক উন্নতি জরুরি ছিল। ক্রমবর্ধমান উন্নতি ছাড়া কোন দেশেরই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হওয়া সম্ভব ছিল না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পরও ঔপনিবেশিক শক্তির উপর নির্ভরশীল থাকা এবং ধনী দেশগুলির উপর নির্ভরশীল থাকা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না।

এই বাস্তব উপলব্ধি হতেই একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারণার সূত্রপাত, যা নতুন আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা বা নিউ ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক অর্ডার সংক্ষেপে এন আই ই ও (NIEO) নামে পরিচিত।

নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জড়িত উন্নত এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পার্থক্য দূরীকরণের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমগ্র বিশ্বের সমউন্নয়ন এবং সুষম বিকাশের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল। 

উন্নয়নশীল দেশসমূহের প্রবল দাবিতে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় গৃহীত নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যগুলি নিম্নরূপ:

(ক) ধনী ও গরিব সকল দেশের মধ্যে বিশ্বের অর্থনৈতিক সম্পদের উচিৎ এবং ন্যায়সঙ্গত বিতরণের মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমানো।

(খ) অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা জনসাধারণের জীবনধারণের মানদণ্ড উন্নত করা।

(গ) আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যবসা-বাণিজ্যর সংস্কারের জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় মুদ্রার সংস্কার সাধন করা।

(ঘ) উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ করা।

প্রশ্ন ৯। বিশ্ব বাণিজ্য পদ্ধতির সংস্কার সম্পর্কীয় UNCTAD-এর প্রতিবেদনটি কি ছিল?

উত্তরঃ বিশ্ব বাণিজ্য পদ্ধতির সংস্কার সম্পর্কীয় একটি প্রতিবেদন ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (United Nations Conference on Trade and Development) ১৯৭২ সালে প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনটির নাম ‘উন্নতির জন্য নতুন বাণিজ্য নীতি’ (Towards a New Trade Policy for Development)।

প্রতিবেদনটি বিশ্ব বাণিজ্য পদ্ধতির সংস্কারের জন্য নিম্নলিখিত প্রস্তাব রাখে:

(ক) অনুন্নত দেশগুলিকে তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কর্তৃত্ব অর্পণ করা, যা এতদিন উন্নত পশ্চিমী দেশগুলি শোষণ করেছে।

(খ) পশ্চিমী বাজারে প্রবেশাধিকার অর্পণ, যাতে অনুন্নত দেশগুলি তাদের উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রয় করার সুযোগ পায় এবং সেজন্য বাণিজ্যকে দরিদ্রতর দেশগুলির জন্য লাভজনক করা।

(গ) পশ্চিমী দেশগুলির প্রযুক্তিবিদ্যার খরচ কমানো।

(ঘ) আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে অনুন্নত দেশগুলিকে অধিকতর ভূমিকা প্রদান করা।

প্রশ্ন ১০। শীতল লড়াইকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্ক কিরূপ ছিল? এই নীতি ভারতের স্বার্থরক্ষায় সহায়ক ছিল কি?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের বৈদেশিক নীতি জোট নিরপেক্ষ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার অনেক পূর্বে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি ঘোষণা করলেন যে, ভারতবর্ষ দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগোষ্ঠী থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখবে। ১৯৪৬ সালে তিনি ঘোষণা করলেন যে ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করবে। স্বাধীনতা অর্জনের পর জোট নিরপেক্ষতা ভারতবর্ষে এর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, ভৌগোলিক অবস্থান, জাতীয় স্বার্থ ও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রভৃতি উপাদানের দরুন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।

নিম্নলিখিত কারণে জোট নিরপেক্ষ নীতি ভারতের স্বার্থ সুরক্ষিত করেছে:

(ক) জোট নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ভারতবর্ষ একটি রাষ্ট্র হিসাবে নিজের পৃথক অস্তিত্ব ও পরিচয় বজায় রেখেছে। এই নীতি ভারতবর্ষকে বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করেছে।

(খ) জোট নিরপেক্ষ নীতি ভারতের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার একটি উৎস। এই নীতির মাধ্যমে ভারত মহাশক্তিধর রাষ্ট্রদ্বয় থেকে আর্থিক সহায়তা অর্জন করেছে। জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার ভিত্তি হল জোট নিরপেক্ষ নীতি।

প্রশ্ন ১১। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ ক্ষুদে রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সামরিক আঁতাতভুক্ত হয় কেন? তিনটি কারণ দাও।

অথবা,

বৃহৎ শক্তিদুটি কেন ক্ষুদ্র দেশগুলির সঙ্গে সামরিক মিত্রতায় আবদ্ধ হয়েছিল? তিনটি কারণ আলোচনা কর।

উত্তরঃ বৃহৎ শক্তিদুটি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষুদ্র দেশগুলির সঙ্গে সামরিক মিত্রতায় আবদ্ধ হওয়ার অনেকগুলি কারণ বর্তমান। 

তার মধ্যে তিনটি কারণ নিচে আলোচনা করা হল:

(ক) কোন একটি দেশের সঙ্গে সামরিক মিত্রতায় আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে সেদেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ ঘটে। এর ফলে সেই দেশের প্রতিবেশী দেশগুলির কার্যকলাপের উপর নজরদারি করা সম্ভব হয়। নানানভাবে সেই দেশগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের জোটে সামিল করার প্রয়াস চালানো যায়।

(খ) যুদ্ধের জুজু দেখিয়ে সেই দেশকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য করা হয়; ফলে নিজেদের তৈরি অস্ত্র বিক্রি করার বাজার পাওয়া সম্ভব হয়। এতে সেইসব ক্ষুদ্রদেশগুলির অর্থনৈতিক অবনতি ঘটলেও নিজেদের আর্থিক লাভ ঘটে এবং প্রয়োজনের অধিক অস্ত্র নিতে তাদের ধার দিয়ে তাদের ঋণপাশে আবদ্ধ করা হয়।

(গ) সামরিক মিত্রতার সুযোগে সেইসব ক্ষুদ্র দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন— খনিজ তেল, কয়লা ইত্যাদি উত্তোলনের জন্য কারিগরি সাহায্য দিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া যায় এবং ক্রমশ তার উপর আধিপত্য কায়েম করা যায়।

এইভাবে ক্রমশ সেই ক্ষুদ্র দেশ এবং তার প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করে সেইসব দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন ১২। অস্ত্র সংবরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি চুক্তি ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একযোগে অস্ত্র সংবরণ এবং কিছু পারমাণবিক ও অপারমাণবিক অস্ত্র সীমিত রাখার অথবা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। উভয়পক্ষ রাজী হয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বে একটি স্থায়ী ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে। 

১৯৬০ সাল থেকে এক দশকের মধ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে তিনটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি তিনটি নিম্নরূপ:

(ক) সীমিত পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (Limited Test Ban Treaty): এই চুক্তি বায়ুমণ্ডলে নভোমণ্ডলে এবং জলের নীচে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৩ সালের ৫ই আগস্ট এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৬৩ সালের ১০ই অক্টোবর থেকে বলবৎ হয়।

(খ) পারমাণবিক অস্ত্র সংবরণ চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty): এই চুক্তি কেবলমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রশালী দেশগুলিকেই পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রাখার আজ্ঞা দেয়, কিন্তু অন্যান্য দেশগুলিকে তা থেকে বিরত করে। যে দেশগুলি ১৯৬৭ সালের ১লা জানুয়ারির পূর্বে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করেছে এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সেই দেশগুলিকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য করা হবে। পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়াও পারমাণবিক বিস্ফোটক কোন অনুষঙ্গের নির্মাণও হতে হবে ১৯৬৭ সালের ১লা জানুয়ারির আগে। বিশ্বের পাঁচটি পরমাণু-শক্তিধর রাষ্ট্র হল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (অধুনা রাশিয়া), ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং চীন। ১৯৬৮ সালের ১লা জুলাই এই চুক্তি ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং মস্কোতে স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৭০ সালের ৫ই মার্চ বলবৎ হয়। ১৯৯৫ সালে এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য সম্প্রসারিত হয়।

(গ) দূরসঞ্চারী ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী চুক্তি (The Anti- Ballistic Missile Treaty): এই চুক্তির বিভিন্ন পর্যায় আছে। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে প্রথম দফার আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ২৬শে মে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা লিওনিড ব্রেজনেভ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে শুরু করে রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ (সিনিয়র)-এর ১৯৯৩ সালের ৩রা জানুয়ারি পর্যন্ত স্বাক্ষরিত চুক্তি দ্বারা বিভিন্ন পর্যায়ে Salt-I, Salt-II, Start-I এবং Start-II-এর মাধ্যমে এই চুক্তি বলবৎ হয়।

প্রশ্ন ১৩। শীতল যুদ্ধ অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করেছে। উভয় বিষয়ের কারণসমূহ কি ছিল?

উত্তরঃ সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে শীতল যুদ্ধ অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। শীতল যুদ্ধ যেহেতু দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উত্তেজনা প্রশমন করেনি সেহেতু তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ প্রভৃতি তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে বাধ্য করেছে। যুদ্ধ প্রতিহত করতে বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার মজুত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করা হয়। সকল প্রকার প্রতিহত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও উভয় শক্তিগোষ্ঠী যুদ্ধ আরম্ভ হতে পারে বলে মনে করে। অস্ত্রের মজুত ভাণ্ডার নিয়ে উভয় শক্তির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিও দেখা দেয়। এছাড়াও পরমাণু দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকতে পারে। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্দিষ্ট পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র ও অপরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলস্বরূপ উভয়পক্ষই নানা সময়ে নানা চুক্তিতে সই করে।

প্রশ্ন ১৪। এটা বলা হয়ে থাকে যে শীতল যুদ্ধ ক্ষমতা দখলের একটি সহজ লড়াই এবং এর সঙ্গে আদর্শ সম্পর্কযুক্ত নয়। তুমি কি এই অভিমতের সঙ্গে একমত? তোমার যুক্তির সমর্থনে একটি উদাহরণ দাও।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ হল মূলত বিশ্বের মহাশক্তিধর দুটি রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত সংঘের বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। শীতল যুদ্ধ শুধুমাত্র শক্তি প্রদর্শনের, সামরিক সংঘবদ্ধতার ও শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার মধ্যে সীমিত ছিল না। সমগ্র বিশ্বের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ব্যাপারে দুটি শক্তির মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী শক্তিসমূহ উদার গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছিল, অপরদিকে সোভিয়েত সংঘের নেতৃত্বে প্রাচ্যের মিত্রশক্তিসমূহ সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। শীতল যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব দুটি পৃথক গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায় এবং প্রত্যেক গোষ্ঠীই নিরপেক্ষ দেশগুলিকে তাদের গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তাই বলা হয়ে থাকে যে শীতল যুদ্ধ ক্ষমতা দখলের একটি সহজ লড়াই এবং এর সঙ্গে আদর্শের খুব একটা যোগ নেই।

অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১৫। শীতল যুদ্ধের সূচনা ও সমাপ্তি সংক্ষেপে আলোচনা কর। শীতল যুদ্ধ প্রশমনে রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকা কি ছিল?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শীতল যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১২ই মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানের ঐতিহাসিক ঘোষণা (Truman Doctrine) আনুষ্ঠানিকভাবে শীতল যুদ্ধের সূচনা করে। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পূর্ব ইউরোপে দ্রুত সাম্যবাদ প্রসার লাভ করে। পশ্চিম ইউরোপে ফ্রান্স ও ইতালিতে কমিউনিস্টদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। 

এইরূপ উদ্যোগজনক পরিস্থিতিতে গ্রীস ও তুরস্কে কমিউনিস্টদের তৎপরতায় গৃহ – যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মার্কিন উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে এক প্রস্তাব উত্থাপন করে গ্রীস ও তুরস্কে মার্কিন সাহায্য দানের পরামর্শ দেন, যা ট্রুম্যান নীতি’ নামে খ্যাত। ট্রম্যান নীতির সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র সাম্যবাদ বিরোধী ‘বেষ্টনী নীতি’ রূপায়ণে সচেষ্ট হয়।

১৯৪৭ সালের ৫ই জুন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জর্জ মার্শাল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সাহায্য দানের এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা ‘মার্শাল পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত। প্রকৃতপক্ষে মার্শাল পরিকল্পনা ছিল টুম্যান নীতির অর্থনৈতিক দিক। বিপুল অর্থ সাহায্য দানের মাধ্যমে দুর্বল দেশগুলিতে সাম্যবাদের সম্প্রসারণ রোধ করাই ছিল এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। অর্থ সাহায্যের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক জোট গঠন করে সোভিয়েত রাশিয়াকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। এর ফলে ১৯৪৮ সালে ‘ব্রাসেলস চুক্তি’ ১৯৪৯ সালে উত্তর আটলান্টিক চুক্তি বা NATO ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি বা SEATO ইত্যাদি স্বাক্ষরিত হয়।

মার্কিন বেষ্টনী নীতির প্রতিবাদে সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘মলো পরিকল্পনা’ ঘোষণা করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ রোধ করতে সচেষ্ট হয়। সাম্যবাদী দেশগুলির সমন্বয়ে ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় ‘কমিনফর্ম’। ন্যাটো জোটের প্রত্যুত্তরে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক জোটের মধ্যে প্রতিপত্তি বৃদ্ধির শীতল যুদ্ধ শুরু হয়। শীতল যুদ্ধের প্রভাবে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সুয়েজ খাল, আফগানিস্তান সহ বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

শীতল যুদ্ধ মূলত মার্কিন শিবির ও সোভিয়েত শিবিরের মধ্যেই সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। ফলে সোভিয়েত সমর্থক রাষ্ট্রগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রশ্ন ১৬। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

অথবা,

গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি বলতে কি বোঝ? এর উৎপত্তি ও বিকাশ আলোচনা কর।

উত্তরঃ গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি: কোন শক্তিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ না দিয়ে স্বাধীনভাবে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করার নীতিকে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি বা জোট নিরপেক্ষ নীতি বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী ও সমাজবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি শক্তিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। এই গোষ্ঠীদ্বয়ের কোনটিতে যোগদান না করে উভয় শক্তিগোষ্ঠীর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে নিজের জাতীয় স্বার্থ পূরণের জন্য যে বিদেশ নীতি গ্রহণ করা হয় তাকেই গোষ্ঠী নিরপেক্ষ বা জোট নিরপেক্ষ নীতি বলা হয়।

গোষ্ঠী নিরপেক্ষতাকে নিষ্ক্রিয়তা বা নিরপেক্ষতা বোঝায় না। এই নীতি উপনিবেশবাদ ও শীতল যুদ্ধের বিরোধিতা করে। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এই নীতির প্রধান  উদ্দেশ্য। যুদ্ধের সাহায্যে বিবাদ মীমাংসা না করে আলোচনা ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে পরস্পরের বিরোধিতা ও মতভেদ দূর করার উপর গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির গুরুত্ব আরোপ করে।

উৎপত্তি ও বিকাশ: ১৯৬১ সালে যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড শহরে মোট ২৫টি দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রথম গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বেলগ্রেড সম্মেলনকে প্রথম গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলন বলা হলেও অনেক আগে এই ধরনের নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ‘এশিয়া সম্পৰ্কীয় সভায়’ (Asian Relations Conference) পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এই নীতির সূচনা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের স্বাক্ষরিত পঞ্চশীল নীতিও গোষ্ঠী নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। 

নিম্নলিখিত পাঁচটি নীতি ছিল:

(ক) প্রত্যেক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।

(খ) কোন রাষ্ট্র আক্রমণ না করা।

(গ) অন্য রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।

(ঘ) পারস্পরিক সহযোগিতা সৃষ্টি করা। এবং

(ঙ) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি পালন করা।

১৯৫৫ সালের বান্দুং শহরে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির সম্মেলনেও এই নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে ভারতের জওহরলাল নেহেরু, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, মিশরের নাসের ও যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর চেষ্টায় ১৯৬১ সালে বেলগ্রেড শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলন শুরু হয়। এর পর ১৯৬৪ সালে কাইরো, ১৯৭০ সালে লুসাকা, ১৯৭৩ সালে আলজিরিয়া, ১৯৭৬ সালে কলম্বো, ১৯৭৯ সালে হাভানা, ১৯৮৩ সালে নয়াদিল্লী, ১৯৪৪ সালে হারারে, ১৯৮৯ সালে বেলগ্রেড এবং সবশেষে ১৯৯৫ সালে কলম্বিয়ায় গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন বর্তমান একটি বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ১৯৬১ সালের বেলগ্রেডে প্রথম সম্মেলনে ২৫টি দেশ যোগ দেয়। বর্তমানে সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা ১১৩টি। বর্তমান বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা এবং প্রায় ৪৫ শতাংশ ভূখণ্ড গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত।

প্রশ্ন ১৭। গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির উদ্দেশ্যসমূহ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ১৯৬১ সালে বেলগ্রেড শহরে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম সম্মেলনে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির অনুসরণকারী দেশগুলির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছিল:

(ক) গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতির অনুসরণকারী দেশ শান্তির জন্য সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে।

(খ) বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির অনুসরণকারী দেশগুলির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করবে।

(গ) শীতল যুদ্ধের বিরোধিতা করবে।

(ঘ) উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করবে এবং বৈদেশিক শাসন হতে মুক্তি লাভের জন্য সব ধরনের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করবে।

(ঙ) নিজ নিজ দেশে বিদেশি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় বাধা দান করবে।

(চ) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে।

১৯৬৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলনে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশগুলির বিদেশ নীতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়:

(ক) উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নির্মূল করা।

(খ) দেশের জনসাধারণের ইচ্ছা অনুসারে সরকার গঠন করার নীতির প্রতি সম্মান দেখানো।

(গ) বর্ণবৈষম্য নীতির বিরোধিতা করা।

(ঘ) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর গুরুত্ব দেওয়া।

(ঙ) দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।

(চ) রাষ্ট্রসংঘের সনদে উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পরস্পরের মতভেদ শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা।

(ছ) নিরস্ত্রীকরণের উপর গুরুত্ব দেওয়া।

(জ) বৈদেশিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠায় বাধা দেওয়া।

উপরের নীতিগুলি হতে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ নীতি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যায়। এইসব দেশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে। কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত থাকতে চায় না এবং রাষ্ট্রসংঘের নীতি ও উদ্দেশ্যের প্রতি সমর্থন জানায়। গোষ্ঠী নিরপেক্ষতার সঙ্গে অর্থনৈতিক মতবাদের কোন সম্বন্ধ নেই। সমাজবাদী, পুঁজিবাদী সব দেশই এই নীতি গ্রহণ করতে পারে।

পাঠ্যপুস্তকের প্রশ্নাবলীর উত্তরঃ

প্রশ্ন ১। শীতল যুদ্ধ সম্পর্কিত নিম্নোক্ত বিবৃতিগুলির মধ্যে কোনটি অশুদ্ধ?

(ক) এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এদের মিত্রদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা ছিল।

(খ) এটা মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আদর্শগত সংঘাত ছিল।

(গ) এটা একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা।

(ঘ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ।

উত্তরঃ (খ) এটা মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আদর্শগত সংঘাত ছিল।

প্রশ্ন ২। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা গঠিত সামরিক আঁতাত-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে নিম্নোক্ত বিবৃতিগুলিতে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ চিহ্ন দাও:

(ক) আঁতাতের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিজ নিজ ভূমিতে মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের ঘাঁটি করতে অনুমতি দান।

উত্তরঃ শুদ্ধ।

(খ) সদস্যরাষ্ট্রসমূহ মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলিকে আদর্শগত ও সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে সমর্থন করবে।

উত্তরঃ শুদ্ধ।

(গ) কোন রাষ্ট্র যখন কোন সদস্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ করবে তখন তাকে সকল সদস্য রাষ্ট্র আক্রমণ করা হিসেবে গণ্য করা হবে।

উত্তরঃ শুদ্ধ।

(ঘ) মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলি তাদের নিজস্ব পরমাণু অস্ত্র উন্নত করতে সকল সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে সাহায্য করবে।

উত্তরঃ অশুদ্ধ।

প্রশ্ন ৩। নিম্নোক্ত বিবৃতিগুলির মধ্যে কোনটি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য প্রতিফলিত করে না?

(ক) নূতন অনুপোনিবেশিকে রাষ্ট্রসমূহকে স্বাধীন নীতি অনুসরণে সহায়তা না করা।

(খ) কোন্ সামরিক আঁতাতে যোগদান না করা।

(গ) আন্তর্জাতিক বিষয়ে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা।

(ঘ) বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধের উপর আলোকপাত করা।

উত্তরঃ (গ) আন্তর্জাতিক বিষয়ে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা।

প্রশ্ন ৪। নীচে কতকগুলি রাষ্ট্রের একটি তালিকা দেওয়া আছে। শীতল যুদ্ধের যুগে তাদের সাথে জড়িত থাকা রাষ্ট্রগোষ্ঠীর নাম তাদের পাশে বসাও:

(ক) পোল্যান্ড।

(খ) ফ্রান্স।

(গ) জাপান।

(ঘ) নাইজেরিয়া।

(ঙ) উত্তর কোরিয়া।

(চ) শ্রীলঙ্কা।

উত্তরঃ (ক) পোল্যান্ড — সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন আঁতাত।

(খ) ফ্রান্স — মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী আঁতাঁত।

(গ) জাপান — পশ্চিমী আঁতাঁত।

(ঘ) নাইজেরিয়া — জোট নিরপেক্ষ।

(ঙ) উত্তর কোরিয়া — প্রাচ্যের আঁতাঁত।

(চ) শ্রীলঙ্কা — জোট নিরপেক্ষ।

প্রশ্ন ৫। শীতল যুদ্ধ অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করেছে। উভয় বিষয়ের কারণসমূহ কি কি ছিল?

উত্তরঃ সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে শীতল যুদ্ধ অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। শীতল যুদ্ধ যেহেতু দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উত্তেজনা প্রশমন করেনি সেহেতু তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ প্রভৃতি তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে বাধ্য করেছে। যুদ্ধ প্রতিহত করতে বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার মজুত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করা হয়। সকল প্রকার প্রতিহত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও উভয় শক্তিগোষ্ঠী যুদ্ধ আরম্ভ হতে পারে বলে মনে করে। অস্ত্রের মজুত ভাণ্ডার নিয়ে উভয় শক্তির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিও দেখা দেয়। এছাড়াও পরমাণু দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকতে পারে। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্দিষ্ট পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র ও অপরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলস্বরূপ উভয়পক্ষই নানা সময়ে নানা চুক্তিতে সই করে।

প্রশ্ন ৬। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ ক্ষুদে রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সামরিক আঁতাতভুক্ত হয় কেন? তিনটি কারণ দাও।

অথবা,

বৃহৎ শক্তিদুটি কেন ক্ষুদ্র দেশগুলির সঙ্গে সামরিক মিত্রতায় আবদ্ধ হয়েছিল? তিনটি কারণ আলোচনা কর।

উত্তরঃ বৃহৎ শক্তিদুটি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষুদ্র দেশগুলির সঙ্গে সামরিক মিত্রতায় আবদ্ধ হওয়ার অনেকগুলি কারণ বর্তমান। তার মধ্যে তিনটি কারণ নিচে আলোচনা করা হল:

(ক) কোন একটি দেশের সঙ্গে সামরিক মিত্রতায় আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে সেদেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ ঘটে। এর ফলে সেই দেশের প্রতিবেশী দেশগুলির কার্যকলাপের উপর নজরদারি করা সম্ভব হয়। নানানভাবে সেই দেশগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের জোটে সামিল করার প্রয়াস চালানো যায়।

(খ) যুদ্ধের জুজু দেখিয়ে সেই দেশকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য করা হয়; ফলে নিজেদের তৈরি অস্ত্র বিক্রি করার বাজার পাওয়া সম্ভব হয়। এতে সেইসব ক্ষুদ্রদেশগুলির অর্থনৈতিক অবনতি ঘটলেও নিজেদের আর্থিক লাভ ঘটে এবং প্রয়োজনের অধিক অস্ত্র নিতে তাদের ধার দিয়ে তাদের ঋণপাশে আবদ্ধ করা হয়।

(গ) সামরিক মিত্রতার সুযোগে সেইসব ক্ষুদ্র দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন— খনিজ তেল, কয়লা ইত্যাদি উত্তোলনের জন্য কারিগরি সাহায্য দিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া যায় এবং ক্রমশ তার উপর আধিপত্য কায়েম করা যায়।

এইভাবে ক্রমশ সেই ক্ষুদ্র দেশ এবং তার প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করে সেইসব দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন ৭। কখনো কখনো এটা বলা হয় যে শীতল যুদ্ধ ক্ষমতা দখলের একটি সহজ লড়াই এবং এই আদর্শ এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। তুমি কি এই অভিমতের সঙ্গে একমত? তোমার যুক্তির সমর্থনে একটি উদাহরণ দাও।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ হল মূলত বিশ্বের মহাশক্তিধর দুটি রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত সংঘের বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। শীতল যুদ্ধ শুধুমাত্র শক্তি প্রদর্শনের, সামরিক সংঘবদ্ধতার ও শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার মধ্যে সীমিত ছিল না। সমগ্র বিশ্বের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ব্যাপারে দুটি শক্তির মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী শক্তিসমূহ উদার গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছিল, অপরদিকে সোভিয়েত সংঘের নেতৃত্বে প্রাচ্যের মিত্রশক্তিসমূহ সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। শীতল যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব দুটি পৃথক গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায় এবং প্রত্যেক গোষ্ঠীই নিরপেক্ষ দেশগুলিকে তাদের গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তাই বলা হয়ে থাকে যে শীতল যুদ্ধ ক্ষমতা দখলের একটি সহজ লড়াই এবং এর সঙ্গে আদর্শের খুব একটা যোগ নেই।

প্রশ্ন ৮। শীতল লড়াইকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্ক কিরূপ ছিল? তুমি কি মনে কর এই নীতি ভারতের স্বার্থরক্ষায় সহায়ক ছিল?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের বৈদেশিক নীতি জোট নিরপেক্ষ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার অনেক পূর্বে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি ঘোষণা করলেন যে, ভারতবর্ষ দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগোষ্ঠী থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখবে। ১৯৪৬ সালে তিনি ঘোষণা করলেন যে ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করবে। স্বাধীনতা অর্জনের পর জোট নিরপেক্ষতা ভারতবর্ষে এর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, ভৌগোলিক অবস্থান, জাতীয় স্বার্থ ও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রভৃতি উপাদানের দরুন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।

নিম্নলিখিত কারণে জোট নিরপেক্ষ নীতি ভারতের স্বার্থ সুরক্ষিত করেছে:

(ক) জোট নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ভারতবর্ষ একটি রাষ্ট্র হিসাবে নিজের পৃথক অস্তিত্ব ও পরিচয় বজায় রেখেছে। এই নীতি ভারতবর্ষকে বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করেছে।

(খ) জোট নিরপেক্ষ নীতি ভারতের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার একটি উৎস। এই নীতির মাধ্যমে ভারত মহাশক্তিধর রাষ্ট্রদ্বয় থেকে আর্থিক সহায়তা অর্জন করেছে। জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার ভিত্তি হল জোট নিরপেক্ষ নীতি।

প্রশ্ন ৯। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির দ্বারা তৃতীয় পছন্দ’ বলে বিবেচিত হত। এই পছন্দ শীতল যুদ্ধের চরম পর্যায়ে কিভাবে তাদের শ্রীবৃদ্ধি করেছিল?

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকে দুইটি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী বা জোট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে অপর জোট ও গোষ্ঠী। এইরূপ পরিস্থিতিতে জোট নিরপেক্ষতা এশিয়া ও আফ্রিকার নবস্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রসমূহকে অন্য কোন জোটে যোগদান না করে তাদের ‘তৃতীয় পছন্দ’ প্রদান করে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উৎস নিহিত ছিল ভারতের জওহরলাল নেহরু, যুগোশ্লাভিয়ার জোসেফ টিটো এবং মিশরের আবু নাসের—এই তিন নেতার বন্ধুত্বের মধ্যে। তাঁরা ১৯৫৫ সালে এক বৈঠকে মিলিত হন। তাঁদেরকে সমর্থন জানান ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ এবং ঘানার খোমে নাকুমা। এই পাঁচ নেতাই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতারূপে খ্যাত। জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর প্রথম অধিবেশন ১৯৬১ সালে যুগোশ্লাভিয়ার বেলগ্রেড শহরে অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে মোট ২৫টি সদস্য রাষ্ট্র যোগদান করে। বর্তমানে বিশ্বের মোট ১১৬টি দেশ জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সদস্য।

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রধানত স্বল্প উন্নত দেশ বা উন্নয়নশীল দেশসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এই দেশসমূহের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ। সুষম উন্নয়ন ব্যতীত কোন রাষ্ট্রই স্বাধীন হতে পারে না। এই রাষ্ট্রগুলি যদি যে-কোন একটি শক্তিগোষ্ঠীতে যোগদান করত তাহলে তারা অন্য শক্তিগোষ্ঠী রাষ্ট্র থেকে সাহায্য সহায়তা পেত না। জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রমণ্ডলীতে থেকে তারা অন্যান্য সকল রাষ্ট্র থেকে তাদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য নানাপ্রকার সাহায্য সহায়তা অর্জন করছে। সুতরাং জোট নিরপেক্ষ নীতি রাষ্ট্রসমূহের বিকাশে যথেষ্ট উপকার সাধন করেছে।

প্রশ্ন ১০। তুমি কি মনে কর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও।

উত্তরঃ শীতল যুদ্ধের অবসানে বর্তমান বিশ্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে শীতল যুদ্ধের ফলস্বরূপ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত। এই আন্দোলন বিশ্বরাজনীতিতে দুই মেরুগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষুদে রাষ্ট্রকে তাদের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় যথেষ্ট সাহায্য করেছে এবং রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় যথেষ্ট সহায়তা করেছে। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর মার্কিন আধিপত্য বৃদ্ধির ফলে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নানা বিতর্কের সূত্রপাত হয়। 

এমতাবস্থায় নিম্নলিখিত কারণে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক:

(ক) বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্র। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনই বর্তমান বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য, জাপান ও অন্যান্য ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহকে প্রভাবমুক্ত করতে সক্ষম হবে।

(খ) জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অধিকাংশই উন্নয়নশীল অথবা অনুন্নত। সুতরাং এই রাষ্ট্রগুলির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

(গ) বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ প্রভূত পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী যা অন্যান্য রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদের কারণ। জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান সারা বিশ্বে সাড়া দেয় যা বিশ্বের শান্তি রক্ষার এক বৃহৎ প্রচেষ্টা।

(ঘ) বিশ্বের অধিকাংশ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ সন্ত্রাসবাদ, মানবাধিকার, নিরস্ত্রীকরণ, পরিবেশ প্রদূষণ প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত। এই সমস্যাসমূহ জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর সহায়তায় সমাধান করা সম্ভব।

সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বর্তমানে একমেরু বিশ্বে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক, অর্থপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top