Class 9 Bengali Chapter 5 মনসামঙ্গল

Class 9 Bengali Chapter 5 মনসামঙ্গল Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 9 Bengali Chapter 5 মনসামঙ্গল and select needs one.

Class 9 Bengali Chapter 5 মনসামঙ্গল

Join Telegram channel

Also, you can read SCERT book online in these sections Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 9 Bengali Chapter 5 মনসামঙ্গল for All Subject, You can practice these here…

মনসামঙ্গল

               Chapter – 5

ক-বিভাগ পদ্যাংশ

ক্রিয়াকলাপ-

১।শূন্যস্থান পূরণ করাে-

(ক) সপ্তডিঙা ……………………….. চারিদিকে জল।

উত্তরঃ সপ্তডিঙা মধুকব চারদিকে জল।

(খ) শ্রাবণের অবিশ্রাম ………………………..।

উত্তরঃ শ্রাবণের অবিশ্রাম মনসামঙ্গল।

(গ) এখনাে বুকের ……………………….কহে।

উত্তরঃ এখনাে বুকের দ্বিজ বংশীদাস কহে।

(ঘ) কুপিম্পে রাতকানা নিরক্ষরা…………………………।

উত্তরঃ কুপিলম্পে রাতকানা নিরক্ষরা বুড়ি।

২। মনসামঙ্গল’ কবিতার বিশেষ্য পদগুলাে বাছাই করে সাজিয়ে লেখাে। যেমন—মধুকর।

উত্তরঃ মনসামঙ্গল’ কবিতার বিশেষণ পদগুলাে হলাে : সপ্তডিঙা, জল, কথা, বেহুলা, ঝিয়ারী, মনসামঙ্গল, পাটে, ডােবা, চম্পক নগর, ঘরের সাতনরী শিকা, বুড়ি, লখা, ছেলে, দ্বিজ বংশীদাস, মা মনসা, কালীদহে, সায়ের।

৩। মনসামঙ্গল’ কবিতার বিশেষণ পদগুলাে বাছাই করে লেখাে। যেমন—নিরক্ষরা।

উত্তরঃ মনসামঙ্গল’ কবিতার বিশেষণ পদগুলাে হলাে- অবিশ্রাম, পচা, ছেড়া, এঁদো, বিষধর, যন্ত্রণা, দখিনা।

৪। পদ পরিবর্তন করে। যেমন—শ্রাবণ-শ্রাবণী। অবিশ্রাম- অবিশ্রান্ত। জল, বিল, যন্ত্রণা, গীত, ঘর, জাল, রাত, গাঙ, দখিনা।

উত্তরঃ পদ পরিবর্তন :- জল-জলীয়, বিল—বিলে, যন্ত্রণা-যাতনা, গান—গীত, ঘর—ঘরােয়া, জাল-জেলে; রাত—রাতি, গাঙ—গাঙ্গেয়, দখিনা—দখিন।

৫। আট-দশটি বাক্যে উত্তর দাও-

(ক) “মনসামঙ্গল’ কবিতা অবলম্বনে শ্রাবণের রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা দাও।

উত্তরঃ গ্রীষ্মের অগ্নিক্ষরা দহনে নিসর্গ প্রকৃতি যখন দগ্ধ, নিরুদ্ধ নিঃশ্বাস তার তৃষ্ণাদীর্ণ বুকে যখন সুতীব্র, অস্থির হাহাকার, তখনই একদিন মেঘমেদুর অম্বরে আবির্ভাব ঘটে ভৈরব হরষে ‘ঘন গৌরবে নবযৌবনা বর্ষার। বর্ষাই সকলের অন্দরের ঋতু। সজল মেঘমেদুর অপরূপ, বর্ষার সঙ্গে আছে সকলের আজন্মকালের হৃদয় বন্ধন। বর্ষার আবির্ভাবেই অহল্যা মাটির অভিশাপ মােচন, বর্ষা মানুষের মনে সঞ্চার করে অনন্ত বিরহ বেদনা, মনকে দেয় চির সৌন্দর্যলােকের আভাস। বর্ষা আমাদের সামনে তুলে ধরে নদী কলধ্বনিতে সানুমত পর্বত বন্ধুর, জম্মুকুঞ্জ ছায়ান্ধকার নববারি সিঞ্চিত যুথী সুগন্ধি একটি বিশাল পৃথিবী। বর্ষার স্নিগ্ধ সজল মায়াঞ্জনে যুগে যুগে কবি হৃদয় উদ্বেল হয়েছে। বর্ষায় গ্রাম বাংলার অপরূপ শ্যামশ্রী সত্যই অনির্বচনীয়। তার ধূলি মলিন বিবর্ণতার অবসান হয়েছে। কবির নিপুণ লেখনী স্পর্শে মনসামঙ্গল কবিতায় শ্রাবণের রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।

(খ) বেহুলা-যন্ত্রণার পরিচয় দাও।

উত্তরঃ চাঁদ সদাগর এবং তার স্ত্রী সনকার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র লখীন্দরের সঙ্গে সায়বেনের সর্বসুলক্ষণা কন্যা বেহুলার বিবাহ হয়। লখীন্দরের ভাগ্যে যে বিয়ের রাত্রেই সর্পাঘাতে মৃত্যুযােগ আছে, চাঁদ সদাগর আগেই সেকথা জেনেছিলেন। সেজন্য ছেলের বিয়ের রাতটুকু যাতে নির্বিঘ্নে পার হয়ে যায়, তার জন্য লােহার বাসর ঘর তৈরি করিয়ে দিয়ে সেখানে নবদম্পতির থাকবার বন্দোবস্ত করে দেন। কিন্তু লােহার সেই বাসর ঘর তৈরি করার সময় মনসার আদেশে ও তার কোপের ভয়ে ভীত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকার এক জায়গায় অতি সঙ্গোপনে যে ছিদ্র রেখে দেয়, সেটাই হয় লখীন্দরের কাল। গভীর রাতে সেই ছিদ্রপথে মনসা প্রেরিত কালনাগ বাসর ঘরে প্রবেশ করে, এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন বেহুলার অসর্তকতার সুযােগে ঘুমন্ত লখীন্দরকে দংশন করে পালিয়ে যায়। সর্পদংশনে লখীন্দরের মৃত্যু হলে বেহুলার যন্ত্রণাময় জীবন শুরু হয়।

(গ) “সায়ের ঝিয়ারী’— কে ? তাঁর অনন্ত ভাসানে যাত্রার বর্ণনা দাও।

উত্তরঃ মায়ের ঝিয়ারী হলাে উজানী নগরের সায়বেনের কন্যা বেহুলা এবং চাদ সদাগরের সপ্তম পুত্র লখীন্দরের স্ত্রী। মনসার ইচ্ছায় বিয়ের রাত্রেই সর্পদংশনে লখীন্দরের মৃত্যু হয়। বেহুলা তখন তার স্বামীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্য কৃতসংকল্প হয়ে স্বামীর শব ভেলার উপরে চাপিয়ে স্বর্গলােক অভিমুখে যাত্রা করে, পথে নানারকম বিপদ-আপদ দেখা দেয় এবং বহু প্রলােভনও উপস্থিত হয়। কিন্তু সতী বেহুলা সব কিছু অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলে, এইরূপে যেতে যেতে একদিন সে উপস্থিত হয়,স্বর্গরাজ্যের রজকিনী ও দেবী মনসার সহচরী ‘নেতা’র ঘাটে। তারপর বেহুলা সেই নেতার সাহায্যে স্বর্গলােকে উপস্থিত হয় এবং তার পরামর্শেই নিজের অপরূপ নৃত্য পরিবেশন করে দেবতাদের মনােরঞ্জন করে। দেবতারা খুশি হলে তাকে বর প্রার্থনা করতে বলেন; বেহুলা তখন ‘চিরকাল সধবা হয়ে থাকা’র বর প্রার্থনা করে। দেবতারা তার সেই মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। শিবের আদেশে মনসা লখীন্দরকে পুনর্জীবিত করেন।

৬। রচনাধর্মী উত্তর লেখাে ।

(ক) মনসামঙ্গল’ কবিতাটির ভাবার্থ লেখাে।

উত্তরঃ মনসামঙ্গলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিজয়গুপ্ত। বিজয়গুপ্তের সৃষ্ট চাদ সদাগর চরিত্র অত্যন্ত বলিষ্ঠ, দৃপ্ত গৌরবে উজ্জ্বল। কিন্তু কাব্যের শেষে ষােড়শ উপচারে মনসার পূজার প্রস্তুতি এবং শ্রদ্ধাবনত চাদের মূর্তি চরিত্রসঙ্গতি ক্ষুন্ন করেছে। চরিত্রের এই পরিণামে যুগ প্রভাব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল এমন অনুমান অযথার্থ নয়। চরিত্রের আনুপূর্বিক সঙ্গতির চেয়ে বৈচিত্র্য সৃষ্টির দিকে কবির আন্তরিকতা বেশি ছিল বলে মনে হয়। মনসার চরিত্র সৃষ্টিতে কৰি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এই দেবী চরিত্রের মধ্যে মানবিক দিকটি সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। জীবনের সমস্ত মাধুর্য উপভােগে, মনসা বঞ্চিত। মায়ের মেহ, পিতার সান্নিধ্য, স্বামীর প্রেম ভালবাসা কিছুই পরিপূর্ণভাবে তার ভাগ্যে জোটেনি। সুন্দর জীবন স্বপ্নে ব্যর্থ মনসা সমস্ত সৌন্দর্য, ভালবাসা পূর্ণতার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণা, যন্ত্রণা লাঞ্ছিত। গ্লানিক্লান্ত মনসা বলেছে—

জনম দুঃখিনী আমি দুঃখে গেল কাল।

যেই ডাল ধরি আমি ভাঙে সেই ডাল।।

মনসামঙ্গলের মূল সুর করুণ। এই করুণ রস সৃষ্টিতে কবি সার্থক নন। মনসামঙ্গল কাব্যের করুণ বেদনাময় কাহিনী বাঙালী মনকে স্বাভাবিক ভাবেই আকৃষ্ট করে।

মনসা শিবের কন্যা। এক পদ্মবনে তার জন্ম হওয়ায় তার অপর একটি নাম পদ্মা। নাগলােকে তিনি লালিত পালিত হন এবং কালক্রমে সর্পকুলের রাণী হয়ে বসেন। শিব তাঁকে এক সময়ে কৈলাসে নিয়ে গেলে চণ্ডীদেবী ক্রুদ্ধ হয়ে মনসার চোখ কানা করে দেন। ফলে কৈলাসে থাকা মনসার পক্ষে আর সম্ভব হয়।

জরৎকারু নামে এক মুনির সঙ্গে মনসার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু পুত্র আস্তিক জন্মাবার পর জরৎকারু পত্নী মনসাকে ত্যাগ করে তপশ্চর্যার জন্য দূরে চলে যান। একদিকে পিতৃগৃহে স্থান হল না, অন্যদিকে স্বামী সুখ থেকেও বঞ্চিত হতে হল। ফলে মনে মনে মনসার তখন আর ক্ষোভের অন্ত রইল না। চণ্ডী ও শিবের অবহেলাই তাকে যেন বেশি করে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। মনসা তখন প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যেমন করেই হােক, মর্তে পূজা প্রচলনের মাধ্যমে তার মাহাত্ম্য প্রচার করতে হবে।

মনসা নিজের মাহাত্ম্য প্রচার ও পূজা প্রচলনের জন্য মর্ত্যে নেমে এলেন। এসে দেখলেন, চম্পক নগরে চন্দ্রধর বা চাদবেনে নামে এক সদাগরের খুব প্রতিপত্তি। কাজেই মনসা বুঝলেন যে, এমন তার দরকার কেননা প্রভাব প্রতিপত্তিশালী চাঁদ সদাগর যদি তার পূজা করেন, তাহলে তার দেখাদেখি সমাজের অন্যান্য লােকেরাও মনসাপূজা করবে। এভাবে লােকসমাজে মনসাপূজা অতি সহজেই প্রচলিত হতে পারে।

চাঁদ সদাগরের পূর্ব-জন্মকথা ও দেবী মনসা তখন চাঁদ সদাগরের কাছে গিয়ে নিজের বাসনা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু, ফুল হলাে উল্টো। সে-সময়ে মহাজ্ঞানের দ্বারা চাঁদ সদাগর নিজের পূর্বজন্মের কথা সব জানতে পেরে মনসার প্রতি রেগে গিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেন; সেই সঙ্গে সারা রাজ্যে ঘােষণা করে দেন যে, চাদ সদাগরের রাজত্বে বাস করে কেউ যেন মনসার পূজা না করে।

পুরাণে কথিত আছে, পূর্বজন্মে শিবভক্ত চন্দ্রধর একদিন শিবপূজার জন্য স্বর্গোদ্যানে ফুল তুলতে গেলে তার সঙ্গে চণ্ডী কর্তক বিতাড়িত একচক্ষু মনসার দেখা হয়। চন্দ্রধরের ভয়ে সর্পকুল তখন মনসাকে পরিত্যাগ করে দ্রুত পালিয়ে যায়। সেই অবস্থায় মনসা স্বভাবতই চন্দ্ৰধরের প্রতি বিরূপ হন এবং তাঁকে অভিশাপ দেন। সেই অভিশাপের ফলেই চন্দ্রধরকে স্বর্গ থেকে বিদায় নিয়ে পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হয়। অভিশপ্ত হওয়ার সময় চন্দ্রধর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পৃথিবীতে তিনি সাপের শত্রু হয়েই জন্মগ্রহণ করবেন।

দেবী মনসার সঙ্গে চাদসদাগরের বিরােধ- চাঁদ সদাগরের ভাগ্য-বিপর্যয় নররূপী চন্দ্রধর শিব ছাড়া অপর কোনাে দেবতার পূজা করতেন না। মনসা যখন তার কাছ থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে যান, তখন স্বামীর অমঙ্গলের আশঙ্কা করে সদাগর-পত্নী সনকা গােপনে গােপনে মনসার পূজা শুরু করেন। কিন্তু, স্বামীর কাছে একদিন তিনি ধরা পড়ে যান। চাঁদ সদাগর তখন রেগে গিয়ে পূজার যাবতীয় জিনিসপত্র পদদলিত করে স্ত্রীকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, চন্দ্রবংশে কেউ যেন ভুলেও কখনাে একচক্ষু মনসার পূজা না করে। তখন থেকে দেবী মনসা চাদ সদাগরের সঙ্গে সরাসরি শত্রুতায় লিপ্ত হন। তার কোপে চাদের বাগানবাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, ছয় ছেলে জলমগ্ন হয় বাণিজ্য করতে গিয়ে। চাদ তবু অচল অটল। 

এতটুকু বিচলিত হন না তিনি কারণ, তিনি ছিলেন মহাজ্ঞানমণির অধিকারী; অর্থাৎ, দৈবশক্তিতে তিনি ছিলেন বলীয়ান। সেই শক্তির জোরেই জলমগ্ন ছয় পুত্রকে পুনরায় তিনি বাঁচিয়ে তােলেন, এরং বাগানবাড়িও পুনরুদ্ধার করেন। উপায়ান্তর দেখে, মনসা তখন এক হীন ছলনার আশ্রয় নিয়ে চাদকে বশীভূত করে তার দৈবশক্তিরূপী মহাজ্ঞানমণি হরণ করেন। তখন থেকে শুরু হয় চাদের চরম ভাগ্যবিপর্যয়। তাঁর ছয় ছেলে আবার মারা যায়, এবং সমস্ত বিষয়-সম্পত্তিও একে একে নষ্ট হতে থাকে। তবু তিনি মাথা নােয়াতে সম্মত হন না মনসার কাছে। যে-হাতে তিনি দেবাদিদেব শিবের পূজা করেন, সে হাতে কখনাে ‘চেংমুড়ী কানী’ মনসার পূজা করতে পারবেন না বলে সুস্পষ্ট ঘােষণা করেন।

ভাগ্য বিপর্যয়েও অবিচল উঁদ সদাগর ও বিষয় সম্পত্তি পুনরায় যাতে করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে চাঁদ সদাগর একদিন নরােদ্যমে বাণিজ্যযাত্রা করলেন। স্ত্রী সনকা তখন ছিলেন সন্তানসম্ভবা। বাণিজ্যের নৌবহর নিয়ে চাদ যখন মাঝ সমুদ্রে, মনসা দেবী তখন আবার এসে আবির্ভূত হলেন তার সম্মুখে; উপদেশ দিলেন তার পূজা করতে, নতুবা পরিণাম যে আদৌ শুভ হবে না সে ভয়ও দেখালেন। কিন্তু সংকল্পে অটল চাঁদ সদাগর সে-কথায় কর্ণপাত করলেন না, মনসাকে গালাগালি দিয়ে বিতাড়িত করলেন। মনসার কোপে তখন প্রচণ্ড এক ঝড় উঠল, চাদের চৌদ্দ-ডিঙা ডুবে গেল সেই মাঝ-সমুদ্রে, সর্বস্বান্ত হয়ে তিনি তখন কোনােমতে প্রাণ বাঁচিয়ে তীরে এসে উঠলেন।

চাঁদ সদাগর-পুত্র লখীন্দরের সঙ্গে বেহুলার বিয়ে ও সর্পাঘাতে লখীন্দরের মৃত্যু-  বারাে বছর পরে দেশে ফিরে চাদ দেখলেন, তার স্ত্রী, সনকার স্নেহে লালিতপালিত হয়ে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র লখীন্দ্র (বা লখীন্দর) সুন্দর এক কিশােরে পরিণত হয়েছে। সেই পুত্র যৌবনে উপনীত হলে, তিনি সায়বেনের সর্বসুলক্ষণা কন্যা বেহুলার সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। লখীন্দরের ভাগ্যে যে বিয়ের রাতেই সর্পাঘাতে মৃত্যুযােগ আছে, চাঁদ সদাগর সে-কথা আগেই জেনেছিলেন। সেজন্য ছেলের বিয়ের রাতটুকু যাতে নির্বিঘ্নে পার হয়ে যায়, তার জন্য লােহার বাসরঘর তৈরি করিয়ে দিয়ে সেখানে নবদম্পতির থাকবার বন্দোবস্ত করে দেন। কিন্তু লােহার সেই বাসরঘর তৈরি করার সময়, মনসার আদেশে ও তার কোপের ভয়ে ভীত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকার এ জায়গায় অতি সঙ্গোপনে যে ছিদ্র রেখে দেয়, তাই হয় লখীন্দরের কাল। গভীর রাত্রে। সেই ছিদ্রপথে মনসা-প্রেরিত কালনাগ বাসর ঘরে প্রবেশ করে, এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন বেহুলার অসতর্কতার সুযােগে ঘুমন্ত লখীন্দরকে দংশন করে পালিয়ে যায়। লখীন্দরের মৃত্যু হয় সর্পদংশনে।

মৃত লখীন্দরের পুনর্জীবন লাভ- মনসার কৃপায়- বেহুলা তখন তার স্বামীর প্রাণ ফিরে পেতে কৃতসংকল্প হয়ে স্বামীর শব ভেলার উপরে চাপিয়ে স্বর্গলােক অভিমুখে যাত্রা করে। পথে নানারকম বিপদ-আপদ দেখা দেয় এবং বহু প্রলােভনও উপস্থিত হয়। কিন্তু, সতী বেহুলা সবকিছু অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলে। এইভাবে যেতে যেতে, একদিন সে গিয়ে উপস্থিত হয় স্বর্গরাজ্যের রজকিনী ও দেবী মনসার সহচরী ‘নেতা’র ঘাটে। তারপর, সেই ‘নেতা’র সাহায্যে বেহুলা স্বর্গলােকে উপস্থিত হয়ে ‘চিরদিন সাধবা হয়ে থাকা’র বর প্রার্থনা করে। দেবতারা তার সেই সেই মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। শিবের আদেশে লখীন্দরকে পুনর্জীবিত করেন দেবী মনসা।

চাঁদ সদাগরের মনসাপূজা এবং মর্ত্যে সেই পূজার প্রচলন- সেই সঙ্গে চাদ সদাগরের অন্যান্য মৃত পুত্রেরাও প্রাণ ফিরে পায়। বেহুলার প্রার্থনামতে মনসাদেবী চাদ সদাগরকে তার বাণিজ্যের নৌকা ও জিনিসপত্র এবং ধনসম্ভার সব ফিরিয়ে দেন। অবশেষে পুত্রবধূ সতীসাধ্বী বেহুলার একান্ত অনুরােধেই চাঁদসদাগর মনসাপূজায় সম্মত হন, কিন্তু পূজা করেন বাঁ হাতে। সেই থেকে মর্ত্যলােকে মনসাপূজা প্রচলিত হয় ; পূর্ণ হয় দেবী মনসার এতকালের আকাঙক্ষা।

(খ) সায়ের ঝিয়ারী কথার অর্থ কী ? তিনি কেন ভাসানে গেলেন? তার এই ভাসান যাত্রার করুণ বিবরণ দাও।

উত্তরঃ সায়ের ঝিয়ারী’ কথার অর্থ উজানীনগরের সায়বেনের কন্যা বেহুলা। 

সদাগরের সপ্তম পুত্র লখীন্দরের সঙ্গে বেহুলার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের রাত্রেই সর্পাঘাতে লখীন্দরের মৃত্যু হবে একথা চাদ সদাগর জানতেন। সেইজন্য ছেলের বিয়ের রাতটুকু যাতে নির্বিঘ্নে পার হয়ে যায় তার জন্য লােহার বাসর ঘর তৈরি করিয়ে দিয়ে সেখানে নবদম্পতির থাকার বন্দোবস্ত করে দেন। কিন্তু লােহার বাসর ঘর তৈরি করার সময় মনসার আদেশে ও তার কোপের ভয়ে ভীত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকার এক জায়গায় অতি সঙ্গোপনে যে ছিদ্র রেখে দেয়, সেটাই হয় লখীন্দরের কাল, গভীর রাত্রে সেই ছিদ্রপথে মনসা প্রেরিত কালনাগ বাসরঘরে প্রবেশ করে এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন বেহুলার অসতর্কতার সুযােগে ঘুমন্ত লখীন্দরকে দংশন করে পালিয়ে যায়। সর্পদংশনে লখীন্দরের মৃত্যু হয়। বেহুলা তখন স্বামীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্য কৃতসংকল্প হয়ে স্বামীর শব ভেলার উপরে চাপিয়ে স্বর্গলােক অভিমুখে যাত্রা করে।

বেহুলা একাকী ভেলাতে স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য যাত্রা করে। বেহুলা ভগবান নারায়ণের প্রতি কাতর প্রার্থনা জানিয়ে বলে যে অভাগিনীর তাকে ছাড়া আর কোনও গতি নেই। নদীতে বেহুলা কলার ভেলা নিয়ে ভেসে চলেছে, সেইপথে বেহুলার পিতা মাতার প্রেরিত হরি সাধু গিয়ে বেহুলা বেহুলা বলে উচ্চস্বরে ডাকে। হরি সাধু বেহুলাকে বলে মায়ের আজ্ঞা পেয়ে সে তাকে নিতে এসেছে। বাবা, ভাইকে ত্যাগ করে না গিয়ে উপরন্তু পিতার গৃহে থেকে যেতে অনুরােধ জানায়। কেননা বেহুলা অত্যন্ত সুন্দরী, যৌবনবতী, পথে-ঘাটে একাকী বেহুলার প্রচুর বিপদের সম্ভাবনা। বেহুলা পিতৃগৃহে ফিরে যেতে অসম্মতি জানিয়ে বলে যে স্বামীর জীবন না থাকলে নারীর জীবন কুৎসিত। এহেন কথা বলা উচিত নয়। ছয়মাসের জন্য বেহুলার যাত্রা আরম্ভ হয়। 

পথে যেতে যেতে বেহুলা দিবারাত্র মনসার চরণে ভক্তি জানায়। এক দুদিন করে যেতে যেতে ভেলা গােদার ঘাটে পৌছয় । গােদা জাতিতে কৈবর্ত, মাথায় ঝটার মতন চুল, সর্বদাই নদীর তীরে একমণ লােহার বঁড়শি বাঁশের ছিপে লাগিয়ে মাছ ধরে, সুন্দরী, বেহুলাকে দেখে গােদার হৃদয় আনন্দে ভেসে যায়। সে ভাবে স্বর্গ থেকে কোনাে সুন্দরী কন্যা বােধহয় তাকে বিবাহ করতে এসেছে। গােদা বেহুলাকে ভেলা নিয়ে নদীর পাড়ে আসতে বলে। গােদা বেহুলাকে নানাপ্রকার প্রলােভন দেখিয়ে বশে আনতে চায়। প্রচুর ধন সম্পত্তির অধিকারী, সেই ধনের দ্বারা বেহুলাকে শিলামণির কাচ কিনে দেবে, শিলামণির কাচ সুন্দরীদের ভালাে মানায়। এছাড়া গােদা মাছ ধরায় পারদর্শী। সতীন থাকলে তাকে কাটাটুকু দিয়ে বেহুলা মাছটুকু খাবে, অনেকগুলি গুণের মধ্যে গােদার দোষ কেবলমাত্র একটি। মাঝে-মধ্যে প্রচণ্ড জ্বর হলে অন্ন জল ত্যাগ করে রােদে চট মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকে। গােদার কথায় বেহুলা কর্ণপাত না করে অবিচল চিত্তে ভেলা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলে গােদা জলে ঝাপ দিয়ে ভেলা ধরবার চেষ্টা করে, বেহুলা ধর্মপুরুষকে সাক্ষী করে গােদাকে অভিশাপ দেয় গােদার বঁড়শি গােদারই পায়ে বিধবে। যতদিন না বেহুলা ফিরে আসে ততদিন বড়শী গােদার পায়ে বিধে থাকবে।

এরপর বেহুলার ভেলা ভাসতে ভাসতে নন্দীপুরে আপু ডডামের ঘাটে ঠেকল। বেহুলাকে দেখে আপু ডামেরও মন সজাগ হয়। সে পরিহাস করে বেহুলার জাত, বংশ এবং বসতি জানতে চায়। কার পুত্রবধূ, কার কন্যা, কেন মড়ার সাথে ভেসে চলেছে জানতে চায়। বেহুলা লখীন্দরের মৃত্যুর কাহিনী শুনিয়ে শিবের কাছে যাওয়ার কথা জানায়। আপু ডােম বেহুলাকে লখীন্দরের মৃতদেহ নদীর কূলে ফেলে দিয়ে তার ঘরণী হতে বলে। পাটের শাড়ি, নাকের বেসর কিনে দিতে চায়, দুপা ধুইয়ে দিয়ে ভাত বেঁধে খাইয়ে দিতে চায়। বেহুলা আপু ডােমকে নিরস্ত করতে চাইলে সে হাত বাড়িয়ে ভেলা ধরতে যায়। সতী বেহুল অভিশাপে আপু ডােম অচেতন হয়ে নদীতীরে পড়ে থাকে।

দু-তিন মাস পর বেহুলার ভেলা মালিয়ার মালঞ্চতে ভাসে। মালঞ্চ বারাে বছর যাবৎ শুষ্ক, মালিনী পায়ে পড়লে বেহুলা তাকে তিনটি বর প্রদান করে। তিনটি বর হল—স্বামী, অন্ন এবং জাত। এরপর ভেলা বােনা মােনার ঘাটে পৌছােয়। ধােনা মােনা দুভায়ের ঘরে কোনও নারী নেই। বেহুলার রূপ দেখে তারা ধড়ফড় করে, বেহুলা সর্বগায়ে বহু মূল্য অলঙ্কার দেখে দুভাই কৌতুক করে। শীঘ্র নৌকা ভাসিয়ে ভেলা অনুসরণ করে, দুভাইয়েরই স্ত্রী নেই তাই সতীনেরও ভয় নেই। দুভায়ের মধ্যে একজনকে স্বামী হিসেবে নির্বাচন করতে বলে। ধােনা মােনার ব্যবহারে বেহুলার মন দুঃখে ভরে ওঠে। বেহুলার দুঃখে কাতর পদ্মা বা মনসা দুভায়ের মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে দেয়। বিবাদ করতে করতে নদীতে পড়ে জলে হাবুডুবু খেতে শুরু করলে বেহুলাকে মাতা সম্বােধন করে ক্ষমা প্রার্থনা করে। বেহুলা দেবী মনসার কাছে দুভায়ের প্রাণভিক্ষা করে। মনসা বােনা মােনাকে পাড়ে নিয়ে গিয়ে তােলেন।

এরপর খেয়ানীর ঘাট থেকে বেহুলার ভেলা টেটনের ঘাটে পৌছােয়। সেখানে জাতিতে মালাকার টেটনকে গলায় কলসি বেঁধে নদীতে আত্মহত্যা। করতে দেখে। বেহুলা টেটনের আত্মহত্যার কারণ জানতে চায়। টেটন জানায় শিশু বয়স থেকে জুয়া খেলার নেশায় পিতার ধন, নিজ স্ত্রী সবকিছু হারিয়েছে। লােকে তাকে জুয়ারী টেটন বলে ডাকে। বেহুলা টেটনের গলার দড়ি ছিড়ে তাকে ধন দান করে। টেটন জানায় ঘরে যখন নারী নেই তখন সে ধন দিয়ে কি করবে, বেহুলা বলে টেটন এখন কিছুদিন মণি মাণিক্য বিক্রি করে দিন কাটাক ফিরবার সময় আরাে বেশি ধন দান করে যাবে।

এদিকে মনসা নেতাকে বাঘের রূপ ধারণ করে লখীন্দরের অস্থি মাংস খাওয়ার নির্দেশ দেন। বেহুলা সাতদিনের পথে কোনাে মানুষের দেখা পায় না। শুধু নদীর দুপাড়ে শালবনের মধ্যে বাঘের দর্শন পায়। বাঘ বারবার গর্জন করে লখীন্দরকে খেতে চায়। বুদ্ধিমতী বেহুলা বাঘের কাছে করজোড়ে মিনতি জানায়। নিজের দুরবস্থার কাহিনী শুনিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে। বেহুলার দুঃখে বিগলিত নেতা নিজের পরিচয় দেয়। জানায় মনসার নির্দেশেই সে বাঘরূপ ধারণ করে লখীন্দরের মৃতদেহ খেতে এসেছে। নেতা অভয় দিয়ে বলে বেহুলার কোনও ভয় নেই। আর চারদিনের মধ্যেই মনসার পুরীর দেখা মিলবে। এখান থেকে ভেলার উপর দাঁড়ালেই পদ্মার প্রাসাদ চূড়া দেখা যায়। নেতা উপদেশ দেয় বেহুলা যেন অষ্টনাগকে বন্দী করে না রেখে ছেড়ে দেয়।

মনসা পুনরায় নেতাকে চিল রূপধারণ করে লখাইয়ের মাংস খাওয়ার জন্য প্রেরণ করে। সমুদ্রের ভিতর চিলরূপী নেতা লখীন্দরের পাজর ছোঁ মেরে নিতে চায়। বেহুলা স্বামীর পাজর আঁচল দিয়ে চেপে রেখে চিলের কাছে হাতজোড় করে মিনতি জানায়। বেহুলা কাকুতি করে বলে লখীন্দর তার জামাই। কী করে তার অঙ্গে ছোঁ মারতে চায়। বেহুলার বচনে নেতা লজ্জা পেয়ে প্রস্থান করে। নেতার কথা স্মরণে আসায় অষ্টনাগ একে একে ছেড়ে দিল। নাগ ছেড়ে দিয়ে মনের দুঃখে বেহুলা-নাগকে অভিশাপ দিল, নাগজাতি হয়ে যার দাঁতে বিষ থাকে মানুষ দংশন করলে তার লেজ খসে যাবে।

ভাসতে ভাসতে বেহুলা টোপানীর ঘাটে পৌছােয়। লখীন্দরের শরীরের মাংস পচে পুঁজ জলের স্রোতে ভাসে, তবু বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ আগলে বসে থাকে। ঘাটে বেহুলা টোপানীর চরণ জড়িয়ে ধরে। নেতা বেহুলাকে অভয় প্রদান করে বলে মনসা যদি না করেন তাহলে তিনিই লখীন্দরকে বাঁচিয়ে তুলবেন। তিনি দেবতাদের সভায় যেতে বলেন। সেখানে মহাদেবের সঙ্গে দেখা হলে বেহুলার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। শােকে উপবাসে শীর্ণ শরীর বেহুলার, ঘাটে লখীন্দরের পাজর পুঁতে রেখে টোপানীর ঘাট থেকে রাজঘাটে যায়। সেখানে মনসার প্রধান দাসীর মাধ্যমে দেবলােকে পৌছে নৃত্যগীতে দেবতাদের তুষ্ট করে শিবের বর লাভ করেন এবং মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরে পান।

৯। তাৎপর্য ব্যাখ্যা করাে।

(ক) সায়ের ঝিয়ারী যায় অনন্ত ভাসানে।

উত্তরঃ মর্ত্যলােকে মনসা নিজ পূজার প্রচলন করার জন্য চাঁদ সদাগরের শরণাপন্ন হন। শিবভক্ত চাদ মনসা পূজা করতে অসম্মত হন, তাতে ক্রুদ্ধ মনসা চাদের সপ্তডিঙা মধুকরসহ সাত পুত্রকে গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত করে হত্যা করেন। তাতেও চাদকে বশে আনতে না পেরে তার নিজস্ব বাণিজ্যতরীও ডুবিয়ে তাকে অমানুষিক কষ্ট দেন।

এদিকে মহাদেবের ইচ্ছায় স্বর্গের অনিরুদ্ধ ও ঊষা লখীন্দর ও বেহুলা রূপে মর্তে জন্মগ্রহণ করে। তারা চম্পক নগরের বণিক চাদের পুত্র পুত্রবধূ। লখীন্দরের ভাগ্যলিপি ছিল। বিবাহের রাতে বাসর ঘরে সর্পদংশনে মৃত্যুযােগ। চঁদ সদাগর তা জানতে পেরে সান্তালি পর্বতে একটি লােহার বাসর ঘর তৈরি করে সেখানে সব পরিণীত পুত্র ও পুত্রবধূকে রাখেন। নিজে হেন্তালের যষ্টি হাতে সারারাত্রি সে গৃহ পাহারা দেন। কিন্তু কোনাে এক অসতর্ক মুহূর্তে সকলের অলক্ষ্যে কালনাগিনী লখীন্দরকে দংশন করে, ফলে লখীন্দরের মৃত্যু হয়। চাদ বেনে কলার ভেলায় মৃতপুত্র ও পুত্রবধূকে কালীদহের জলে ভাসিয়ে দেন। শুরু হয় মৃত স্বামীকে কলার ভেলায় নিয়ে অনির্দিষ্ট কালের যাত্রা।

(খ) ছেড়া কাঁথা কানি আর বেহুলা যন্ত্রণা।

উত্তর- দেবলােকে ও নরলােকে নারী স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিতা, আপন গৌরবে গৌরবান্বিতা। এই দেবলােক ও নরলােকের মিলন ঘটেছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ত্রিবেণী ধারায় মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্যে। এই প্রধান মঙ্গলকাব্যগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পাওয়া যায়—“দেবখণ্ড ও নরখণ্ড’ দেখণ্ডে হরপার্বতীর কথা ও কাহিনী এবং নরখও কোথাও চাদ সদাগর— সুনকা লক্ষ্মীন্দর-বেহুলা।

মনসামঙ্গল কাব্যে নারী-জীবনের প্রধান দুটি রূপ-জায়া ও জননীর প্রতিমূর্তি রূপে বেহুলা ও সনকাকে পাওয়া যায়। বেহুলা হল বাংলার পরিবার ও সমাজ জীবনে পাতিব্রত্যের পরাণপদ্মস্বরূপা সতী সাধ্বী নারী। কুলবধূ সুলভ কোমলতার সঙ্গে সতীত্বের সুদৃঢ় মনােবলের সংমিশ্রণে সে আজও চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। -যৌবনদীপ্তা বেহুলার রূপবর্ণনায় পাওয়া যায়-

চাচর মাথার কেশ চন্দন ললাটে।

পূর্ণিমার চাঁদ যেন রাহুর নিকটে।

বণিক শ্রেষ্ঠ চাদ সদাগরের পুত্র লখীন্দরের সঙ্গে এই বেহুলা সুন্দরীর বিয়ে হয়। বিয়ের রাতেই লখীন্দর সর্পদংশনে প্রাণত্যাগ করে। সদ্যবিবাহিত জীবনেই বৈধব্যের আঘাতে কাতর বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ কলার ভেলায় সাজিয়ে গাঙ্গরের জলে ভেসে চলে। এই চিত্রে বেহুলার বুকফাটা আর্তনাদ শােনা যায়—

তুমি তাে আমার প্রভু আমি যে তােমার।

মরা কভু নহরে তুমি গলার হার,

প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, শ্বশুর-শাশুড়ি সকলের অনুরােধ, অনুনয়-বিনয় উপেক্ষা করে স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়সঙ্কল্প বেহুলা মহাযােগিনীর মতােই ভেসে চলে।

স্বর্গের ধারে ‘নেতা ধােপানী’ দেবতাদের কাপড় কাচে। তার কাজ করে, মন জুগিয়ে তারই সঙ্গে বেহুলা দেবলােকে যায়। সেখানে নৃত্যগীতে মহাদেবকে বেহুলা পরিতুষ্ট করে। মহাদেবের আদেশে মনসা লখীন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। বেহুলার সাধনায়, স্বামীনিষ্ঠায় মর্তমানবের অন্তর শ্রদ্ধায় ও মমত্বে ভরে ওঠে। তারই সম্মানে ও স্বীকৃতিতে চাঁদ সদাগর মনসা পূজা করে।

(গ) গাঙের গর্ভিনী সেই গন্ধ ভেসে আসে।

উত্তরঃ মনসামঙ্গল কাহিনির তিনটি অংশ। প্রথম অংশ পৌরাণিক কাহিনি। এতে শিবের সঙ্গে মনসার সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে চাঁদ সদাগর ও দেবী মনসার সংঘর্যের কাহিনিই প্রাধান্য লাভ করেছে। তৃতীয় অংশের প্রধান কাহিনিটি বেহুলা লখীন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। মনসাকে শিব-কন্যারূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু সৎ মা চণ্ডীর সঙ্গে তার কলহ মর্ত্যলােকে তার পূজা প্রচারের আকাঙক্ষা এমন উগ্রতা লাভ করে যে তার পক্ষে কিছুই অকরণীয় ছিল না। তার ক্রুরতা ও নিষ্ঠুরতা সীমাতীত। চাঁদ সদাগরের পূজা লাভের জন্য মনসা যথেষ্ট চেষ্টা করেও যখন কৃতকার্য হলেন না তখন প্রতিহিংসা বশে তিনি চাদের বাগানবাড়ি ধ্বংস করলেন, তার মহাজ্ঞান মন্ত্র হরণ করলেন, সপ্তডিঙা মধুকরকে ডুবিয়ে দিলেন এবং চাদের সাত পুত্রকে সর্পদংশনে হত্যা করলেন। চাদ তবু ছিল অচল-প্রতিষ্ঠ, শেষ পর্যন্ত কনিষ্ঠ পুত্র লখীন্দরও বিবাহরাত্রে লৌহবাসর ঘরে সর্পদংশনে মারা যায়, লখীন্দরের মৃতদেহ নিয়ে পুত্রবধূ বেহুলা ইন্দ্রসভায় উপস্থিত হয়ে নৃত্যগীতে দেবতাদের তুষ্ট করে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনে।

সমগ্র মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্যে চাদের মতাে দৃপ্ত পৌরুষময় চরিত্র আর একটিও নেই। কাহিনির প্রয়ােজনেই তাকে শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতে হয়েছিল। যে যুগে এই কাহিনি কল্পিত হয়েছিল সম্ভবত তখন বঙ্গদেশের বাণিজ্যতরী বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাত, ফলত সমাজে বণিক সম্প্রদায়েরই ছিল প্রবল প্রাধান্য। তাই মনসা বণিকদের মধ্যেই আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হােক কিছুটা স্থান করে নিতে পেরেছিলেন।

(ঘ) শ্রাবণীর দিগম্বরী দখিনা বাতাসে।

উত্তরঃ খরতপ্ত দিবাবসানে দূর দিগন্তে ধূসর আকাশে জমে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘক্তৃপ। ঘন গৌরবে আসে উন্মাদ বরফ’, ‘অকৃপণ বর্ষণ’ শাখায় শাখায় জাগল নবজীবনের শিহরণ, বাংলার দগ্ধ প্রান্তরে, বনে-বনান্তরে, খাল-বিল নদী-নালায় জাগে প্রবল প্রাণােচ্ছাস, গ্রীষ্মের ধূলি ধূসর প্রকৃতি ফিরে পেল সজল বর্ষার স্নিগ্ধ শ্যামশ্রী। শিখীর পাখায় লাগল নৃত্যের মাতন। মত্ত হলাে দাদুরী, ডাহুকীর ডাকে, পাখির কলগীতিতে প্রকৃতি হলাে মদির বিহূল। দিকে দিকে বেজে উঠল মেঘের মৃদঙ্গ মুরজ-মুরলী ধ্বনি। তিমির মেদুর বনাঞ্চলে ছড়াল কেতকী কদম্বের সৌরভ। মৃত্তিকার তপ্ত তৃষিত বুকে জেগে উঠল বহু প্রতিষ্ঠিত অভিশাপ মােচনের মহােল্লাস।

শােনা গেল উদ্যতবাহু অরণ্যের উচ্ছ্বলিত প্রাণস্পন্দন। দিকে দিকে দেখা গেল শস্যশিশুর বরণ উৎসব, প্রকৃতির হৃদয় বেদনা হলাে উৎসারিত। মৃদঙ্গ ধ্বনিতে বিশ্বের চিরবিরহ বেদনার অশ্রুজল গেল খুলে। শতবরণের কলাপ বিস্তার করেই শুরু হয় তার বিজয় যাত্রা। তাহার নকিব আগে আগে গুরু গুরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে মেঘের পাগড়ি পরিয়া। পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। দিগ্বিজয় করাই তাহার কাজ।

নির্দেশক প্রত্যয়-

(ক) বিশেষ্যের পরে কেবল একবচনে নির্দেশক প্রযুক্ত হয়, এবং তখন বিশেষ করিয়া উক্ত বিশেষ্যের গুণ বা রূপ ব্যতীত তাহার অবস্থানকে নির্দেশ করে যথা-“লােকটা, লােকাটি ; বই-খানা ; বই-খানি ; লাঠি-গাছ, লাঠি-গাছা”- এখানে “লোক, বই, লাঠি”—এই তিনিটা বিশেষ্যের পরে “টা, টি, খানা, খানি, গাছ, গাছা” বসিয়া, ইহাদের আমর বা প্রকৃতি-সম্বন্ধে বক্তার ধারণার নির্দেশ করিয়া দিতেছে।

(খ) সংখ্যাবাচক বিশেষণ প্রযুক্ত হইলে, বিশেষ্যের পরে এই সংখ্যাবাচক শব্দ বসিলেই এইরূপ সুনির্দিষ্ট-ভাব প্রকটিত হয় ; যথা- “তিন-খানা বই ঞ্চ যে কোনও অনির্দিষ্ট তিন খানা বই,” কিন্তু “বই তিন-খানা সুনির্দিষ্ট।

(গ) সংখ্যাবাচক বিশেষণের পূর্বে কতকগুলি নির্দেশক-শব্দ বা শব্দাংশ ব্যবহার করা—“জন-দুই মানুষ, খান-চার কাপড়, গাছ কতক লাঠি”। 

এরূপ ক্ষেত্রে, অনিদের্শ-ভাবকে আরও ভাল করিয়া প্রকাশ করিবার জন্য সংখ্যাবাচক শব্দে অনিশ্চয়- বােধক প্রত্যয় “ক” যুক্ত করা যাইতে পারে ; যথা- জন-দুইয়েক মানুষ, খান-চারেক কাপড়, গাছ-পাঁচেক লাঠি, খান-আষ্টেক রুটি” ইত্যাদি।

(ঘ) পরিমাণবাচক বিশেষণের সঙ্গেও ঐরূপ নির্দেশক প্রযুক্ত হয় ; যথা“- এতটা জল, এতখানি বেলা, এইটুকু দুধু, দুধুটুকু” ইত্যাদি। 

“টা, টি, টুকু, খানা” প্রভৃতির দ্বারা বক্ষ্যমান বস্তুর আকার বা প্রকৃতি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত থাকে। “টি, খানি, গাছি”- -এই প্রকার ই-কারান্ত রূপের দ্বারা বস্তুর হ্রস্ব-ভাব বা ইহার প্রতি বক্তার আদর জ্ঞাপন করা হয়।

“-টা”-র উৎপত্তি সংস্কৃত “বৃত্ত হইতে (বৃত্ত ঞ্ছ বট্ট ঞ্ছ তাটু ডু টা, টি ; যথা- একবৃত্ত ঞ্ছ একট্ট ঞ্ছ একবট্ট একটা ; অস্বৃত্ত ঞ্ছ আউট ; স্নেহবৃত্ত ছু নেহটা, ন্যাওটা); “খানা” আসিয়াছে “খণ্ড-” শব্দ হইতে।

“টা, টি”—যেখানে বস্তুটি পূর্ণ বা অখণ্ড রূপে ও তাহার সমগ্র গুণাবলি প্রকৃতিতে যুক্ত বলিয়া ধরা হয়, সেখানেই “টা” (হ্রস্বার্থে ও আদরে “টি”) প্রযুক্ত হয়।

অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তর সাধারণতঃ “টা, টি” এই নির্দেশক প্রযুক্ত হয়।

মানব ও উচ্চশ্রেণির প্রাণীবাচক শব্দে “টা” যােগ করিলে অনার প্রদর্শন করা হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে “টি” যােগ করিলে কিঞ্চিৎ স্নেহভাব বা অনুকম্পা অথবা আদরের দ্যোতনা আসিবে ; যথা- “লােকটা অতি পাজি ; মানুষটি বেশ ভাল। দুটা (চলিত বাংলার দুটো’) ভাতের জন্য ছুটাছুটি ; দুটা ভাত দাও ; ‘ওদের বাড়ির ছেলেটা খায় এতটা, নাচে যেন বুড়াে বাঁদরটা—আর আমাদের বাড়ির ছেলেটি খায় এতটা, আর নাচে যেন ঠাকুরটি’ ;ইত্যাদি।

“খানা” (হ্রস্বার্থে, আদরে বা অনুকম্পায় “খানি”) “খণ্ড”-শব্দ হইতে জাত—সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না। যে বস্তু দ্বিখণ্ডিত-রূপে হইতে পারে, এবং যাহার খণ্ড-বিশেষের কার্যকারিতা নষ্ট হয় না, এরূপ স্থলে, “খান, খানা, খানি” শব্দের প্রয়ােগ হয়।

বৃত্তাকার বস্তুর নামের সঙ্গে “খান, খানা, খানি” সাধারণত বসে না ; যথা; গােলা-খানা, বল-খানা, রসগােল্লা-খানা সমতল ও চতুরঙ্গ বস্তুর নামের সঙ্গেই এই শব্দ যুক্ত হয় ; “কাপড়-খানা” 

“আমটা”, কিন্তু আমের চাকলা-খানা” ; মুণ্ডটা’, কিন্তু “মুখখানি, মুখখানা”

গুণবাচক বস্তুর নামের সঙ্গে কচিৎ “খানা, খানি”-র প্রয়ােগ হইতে পারে ? “ভাব-খানা ভাল নয় ; ছুটি’ গেল গরম-খানি” |

পরিমাণ-বাচক বিশেষণের সহযােগেও “টা, টি, খানা, খানি” প্রযুক্ত হয় ও “এতখানি বা এতটা বেলা, এতখানা কাণ্ড হইয়া গেল, এতখানি জমি ছাড়া হইবে  অনেকখানি বা অনেকটা সােনা” ইত্যাদি।

পরিমাণে, অল্পার্থে ও আদরে, “টুক, টুকু” কচিৎ “টু” প্রযুক্ত হয়- “এতটুকু জল, এতটুকু ছেলে”। ইস্বতার আধিক্য বুঝাইতে গেলে, “টুকুন, টুকুনি” প্রযুক্ত হয়- “এত্তটুকুন ছেলে”।

“গাছ, গাছা, গাছি”—ইহা বৃক্ষার্থক বাংলা “গাছ” শব্দের সঙ্গে অভিন্ন। এই নির্দেশটি অখণ্ড, সরু বা দীর্ঘ বস্তুর নামের সঙ্গে প্রযুক্ত হয় ; যথা—“লাঠি-গাছি, খড়-গাছা, আখ-গাছা”। “গাছটি” মিলিতভাবেও কচিৎ ব্যবহৃত হয়; যথা “লাঠি-গাছটি”।

অতিরিক্ত জ্ঞাতব্য বিষয়- 

মঙ্গলকাব্য :-  মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ স্থান অধিকার করে আছে মঙ্গলকাব্য। পল্লিবাংলার লৌকিক এবং অপৌরাণিক কিছু দেবদেবী গ্রামীণ আদর্শে পূজিত হন। বিশেষ করে সমাজের নিম্নস্তরে এবং স্ত্রী-সমাজে এই দেবদেবীর পূজা এবং ব্রত উপলক্ষ্যে গান করা হয়। এগুলিই মঙ্গলগীত বা মঙ্গলকাব্য। বিপদে পড়লে মানুষ তার থেকে পরিত্রাণের জন্য দেবদেবীর শরণ নেয়। এইভাবেই সাপের দেবী মনসা, হিংস্র শ্বাপদের থেকে রক্ষাকত্রী চণ্ডী, কলেরা বসন্তের থেকে রক্ষাকর্ত্তী শীতলা, এমনকি বাঘের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মানুষ দক্ষিণরায়ের পুজোর আয়ােজন করেছে। তুর্কি বিজয়ের পর মুসলমান অভিযানের প্রভাবে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি কোণঠাসা হয়ে পড়লে এই সমস্ত লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে সমন্বয় গড়ে ওঠে। 

মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও প্রায় সকল প্রকার মঙ্গলকাব্যেই বিশেষ তিনটি অধ্যায় বা খণ্ড দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলি হলো—বন্দনাখণ্ড, দেবখণ্ড ও নরখণ্ড।

বন্দনাখণ্ড :- দেবদেবীর মঙ্গলাচরণের মধ্য দিয়ে মঙ্গলকাব্যের সূচনা। এই অংশ বন্দনাখণ্ড নামে পরিচিত। শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর তার প্রভাবে চেতন্যবন্দনা’ এই অংশে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। এরপর কবি কাব্য রচনার কারণ ও প্রেরণার উল্লেখ করেন। সাধারণত স্বপ্নাদেশ পেয়ে কবি কাব্য রচনায় আত্মনিয়ােগ করেছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এই অংশে পরিবেশিত হয় কবির আত্মপরিচয়, ভৌগােলিক অবস্থান, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীর পুজো প্রচারিত হয় প্রধানত তার কোনাে এক ভক্তের দ্বারা, যিনি পূর্বজন্মে ছিলেন স্বর্গের অধিবাসী। দেবীদেবীর পুজো প্রচারের জন্য তাকে বিনা অপরাধে বা সামান্য অপরাধে মর্তে জন্মগ্রহণ করতে হয়। পুজো প্রচারিত হওয়ার পর আবার তিনি স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করেন।

দেবখণ্ড :- বেশিরভাগ মঙ্গলকাব্যের কাহিনিভাগ শুরু হয় শিবের ঘরগৃহস্থালির জীবন্ত বর্ণনা দিয়ে। এই অংশের নাম দেবখণ্ড। তারপর কবি তার নিজের পরিচয় প্রদান করেন। স্বর্গভ্রষ্ট দেবতার মর্তে জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়। অনেক সময় মৰ্ত্যে তার পুজো প্রচারের জন্য শিবের কাছে দরবার করার কথাও উল্লিখিত রয়েছে।

নরখণ্ড :- অবশেষে শিবের ভক্তের দ্বারা দেবতা বা দেবীর মাহাত্ম প্রচার পায়। এই অংশের নাম নরখণ্ড। এছাড়া কোনাে কোনাে কাব্যে নায়ক নায়িকার বারােমাসের সুখদুঃখের কাহিনি বারমাস্যা’, বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে চৌত্রিশ অক্ষরের ইষ্টমন্ত্র ‘চৌতিশা ইত্যাদির উল্লেখ থাকে। মঙ্গলকাব্যের প্রধান উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর মানবধর্ম। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কথা এই কাব্যের মধ্যে মর্যাদার সঙ্গে স্থান পেয়েছে।

অতিরিক্ত প্রশ্নোত্তর

১। ‘মঙ্গলকাব্য’ নামকরণের কারণ।

উত্তরঃ মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল—প্রধানত কোনাে বিশেষ ব্যক্তির বা পরিবারের কিংবা সমাজের, দেশের মঙ্গলের জন্য এই কাব্যটি পাঠ করে দেবীকে সন্তুষ্ট করা। নিতান্ত পার্থিব প্রয়ােজন সিদ্ধিই এই পুজোপাঠের উদ্দেশ্য। প্রতি মঙ্গলবারে কিংবা কোনাে একটি মঙ্গলবারে এই কাব্যটি পাঠ করা হয়। আবার কখনাে-কখনাে এক মঙ্গলবার থেকে শুরু করে পরের মঙ্গলবারে পাঠ শেষ করা হয় বলেও এর নাম মঙ্গলকাব্য হয়ে থাকতে পারে। এখানে মঙ্গল অর্থে ভক্তের উদ্দেশ্যে দেবতা বা দেবীর মঙ্গলদৃষ্টি সহযােগে বরাভয় মূর্তিতে আবির্ভূত হওয়ার কাহিনীকেও সূচিত করে। তাছাড়া অনেকের বিশ্বাস, এই কাব্যের পুঁথি নকল করে ঘরে রাখলে, বা নিত্য পাঠ করলে কিংবা শুনলে গৃহস্থের মঙ্গল হবে। এই সমস্ত কারণে কাব্যের নাম মঙ্গলকাব্য হয়েছে।

মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক কারণ ও মানুষ চিরকাল হিংস্র জীবজন্তুbআধিব্যাধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ভয় করে এসেছে। শারীরিক ক্ষমতার ছায়া যখন তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সে জয়লাভ করতে পারল না, তখন আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে কতকগুলি কাল্পনিক দেবদেবীর শরণাপন্ন হল। নিজের পছন্দমতাে তার রূপ কল্পনা করে পুজোপাঠ, ব্রতকথা বা কথকতা করে সেই সমস্ত কাল্পনিক দেবতাকে সন্তুষ্ট করবার চেষ্টা করেছে। এই সমস্ত দেবদেবী বিপদের সময় স্মরণমাত্র সশরীরে আবির্ভূত হয়ে ভক্তকে রক্ষা করেছেন, এই রকম গল্পকাহিনিই হল মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্তু। এই ধারণা থেকে মঙ্গলকাব্যের উৎপত্তি। কাব্য রচনার প্রেক্ষাপটে কবিগণের বর্ণনার মধ্যে সমকালীন সমাজচিত্র, রাজনৈতিক বাতাবরণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিস্ফুট হয়েছে। এইজন্য মধ্যযুগের তথ্যনিষ্ঠ ইতিবৃত্তের প্রতিফলন ঘটাতে ইতিহাসের দিক দিয়ে এই মঙ্গলকাব্যগুলির বিশেষ গুরুত্ব আছে।

মঙ্গলকাব্যের প্রধান শাখাপ্রশাখা- মঙ্গলকাব্যগুলি মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল এবং ধর্মমঙ্গল। এছাড়া আরও কতকগুলি অপ্রধান মঙ্গলকাব্য আছে। তাদের মধ্যে শিবমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালীকা-মঙ্গল, রাধিকামঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মঙ্গলকাব্যের প্রভাব সমাজের বুকে এত ব্যাপক আকারে প্রতিফলিত হয়েছিল যে উনিশ, শতকের ‘ভােরের পাখি’ গীতিকবি বিহারীলাল চক্রবর্তীও তাঁর কাব্যের নাম রেখেছিলেন ‘সারদামঙ্গল’।

টীকা :-

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ :- মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হলেও তাঁর কাব্যের প্রচার ঘটেছিল বাংলাদেশ জুড়ে। পশ্চিমবঙ্গের কবিকুলের মধ্যে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। ক্ষেমানন্দের বংশপরিচয় সম্পূর্ণ জানা যায় না। তবে সম্ভবত তিনি ছিলেন কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত। তার আত্মবিবরণী থেকে বহু তথ্য জানা যায়। তবে কাব্যরচনাকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনাে তথ্য পাওয়া যায় না। তার কাব্য ‘ক্ষেমানন্দী’ নামে পরিচিত ছিল। কেতকাদাসের মনসামঙ্গল এত জনপ্রিয় ছিল যে, নারায়ণ দেব ও বিজয়গুপ্তের নাম পর্যন্ত ঢাকা পড়েছিল। ক্ষেমানন্দ সম্ভবত কবির উপাধি। বর্ধমান জেলার কাদড়া গ্রামে কবির জন্য | অশান্তির ফলে কবি দেশত্যাগ করেন। পরে রাজা বিষ্ণুদাসের ভাই ভারামল্লের কাছে তিনি তিনটি গ্রাম দানস্বরূপ লাভ করেন। কেতকাদাস মুচিনীবেশধারিণী মনসা-কতক আদিষ্ট হয়ে কাব্যরচনায় বৃত হন। কেতকাদাসের কাব্য সম্ভবত খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত হয়েছিল। কাব্যে চৈতন্যদেবের উল্লেখ ও মুকুন্দরামের চণ্ডীমণ্ডলের অনুসরণে রচনার নিদর্শন আছে। কেতকাদাস নিজেকে মনসার দাস বলে পরিচয় দিয়েছেন।

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের পুঁথিগুলি নানা পালায় বিভক্ত। এক-একটি পুঁথি এক-একটি পালা নিয়ে লেখা। তবে এইসব পালার মধ্যে মনসামঙ্গলের পালা সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়েছিল। বহু পুঁথি একসঙ্গে নিয়ে কেতকাদাসের ‘ মনসামঙ্গল সম্পাদনা করেছিলেন শ্রী যতীন্দ্রমােহন ভট্টাচার্য। কাব্যে দু’তিন রকম ভণিতা পাওয়া যায়। কেতকাদাস, ক্ষেমানন্দ, কেতকাদাস-ক্ষেমানন্দ এই রকমের ভণিতা আছে। কোনটি তার আসল নাম কেতকাদাস, না ক্ষেমানন্দ সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি। ডঃ সুকুমার সেন প্রথমে ক্ষেমানন্দ নামে কবির নাম উল্লেখ করলেও পরে কেতকাদাস বলেছেন। তবে বেশিরভাগ পণ্ডিতের মতাে কবির প্রকৃত নাম ক্ষেমানন্দ। কেতকাদাস তাঁর ডপাধি।

কেতকাদাসের কাব্য দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। প্রতিভার অনুপাতে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। ক্ষেমানন্দকে কেউ কেউ উচ্চশ্রেণির কবি বলেছেন। কেউবা বলেছেন, তিনি ছিলেন মনসামঙ্গলের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। মনসামঙ্গলের অন্যান্য কবিরা মনসাকে ‘পদ্মা’ নামে অভিহিত করেছেন। কেননা তাদের মতে মনসার জন্ম হয়েছিল পদ্মপাতায়।

অন্যান্য মঙ্গলকাব্য থেকে কেতকাদাসের কাব্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কোনাে পৌরাণিক আখ্যায়িকা নেই। বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনীই কাব্য-বিষয়। কেতকাদাসের কাব্যে চৈতন্য-প্রভাব উল্লেখযােগ্য। মুকুন্দ সম্ভবত ছিলেন তার আদর্শ। তাঁকে সামনে রেখে তিনি কাব্য লিখেছেন। চিত্রবিন্যাসে ও ভাষা-ব্যবহারে মুকুন্দ ছিলেন তার লক্ষ্য।

কাব্য-পরিচয় :- ক্ষেমানন্দের কবি-প্রতিভা যাই হােক না কেন, তার কাব্য প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কেতকাদাসের কাব্যে পাণ্ডিত্য-প্রকাশের উদাহরণ রয়েছে। সামাজিক, রীতিনীতি ও ভৌগােলিক সংস্থানের বর্ণনা তার কাব্যে পাওয়া যায়। কেতকাদাসের মতে মনসাদেবীর অপর নাম কেতকা। কেতকাদাস বেহুলার চরিত্র-চিত্রণে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। বেহুলার দুঃখ-বর্ণনায় করুণরসের পরিচয় রয়েছে। তার ভাষা মার্জিত এবং গ্রাম্যতা-দোষমুক্ত। চাঁদসদাগরের চরিত্র উল্লেখযােগ্য নয়। তবে মনসার ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ চরিত্রটি সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।

ক্ষেমানন্দের কাব্য বাণীবন্দনায় ব্যাস-বাল্মীকির সঙ্গে নারায়ণ দেবের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। মুকুন্দরামের অনুসরণে তাঁর কাব্যে তিনি আত্মবিবরণী অংশ যুক্ত করেছেন। তবে সেখানে কাব্যরচনার কালের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ক্ষেমানন্দ ছিলেন পণ্ডিত-কবি। করুণ রসসৃষ্টিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধ। পরিচ্ছন্ন ভাষা ও রুচির পরিচয় তার কাব্যে আছে। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকাব্য ও রামায়ণ ছিল তার কাব্য রচনার আদর্শ। ক্ষেমানন্দ তাঁর কাব্যে রচনা সংহতির পরিচয় দিয়েছেন।

দ্বিতীয় ক্ষেমানন্দ :- ক্ষেমানদের ভণিতায় দেবনাগরী অক্ষরে লেখা একটি ছােট পুথি পাওয়া যায়। গ্রন্থের লিপিকার পুরুলিয়ার অধিবাসী। এই গ্রন্থের সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায়ের মতে কাব্যটি প্রকৃতপক্ষে ক্ষেমানন্দের। কিন্তু সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। এই ক্ষেমানন্দের পুঁথির প্রচার তেমন বেশি নয়। কিন্তু পূর্ব কথিত কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের পুঁথির বহুল প্রচলন ছিল।

পরবর্তী পুঁথিটি সম্ভবত ক্ষেমানন্দ নামধারী অপর কোনাে কবির। এই কাব্যটির ভাষায় আধুনিকতার পরিচয় রয়েছে। সম্ভবত কাব্যটি উনবিংশ শতকে লেখা। ক্ষেমানন্দের জনপ্রিয়তার সুযােগে এই পুঁথির রচয়িতা সম্ভবত উক্ত নাম গ্রহণ করে পুঁথিটি লিখেছিলেন। মধ্যযুগের সাহিত্যে বিশেষ করে বৈষ্ণব কাব্যে এই ধরনের ঘটনা অনেক ঘটেছে।

নারায়ণ দেব :- নারায়ণ দেব রচিত ‘মনসামঙ্গল’-  মঙ্গলকাব্যের ঐতিহাসিক ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্যের মতে, ১৫শ শতাব্দীর শেষভাগে নারায়ণ দেব ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। প্রাচীন বাংলাসাহিত্য-গবেষকদের অনেকের মতে তার মনসামঙ্গল’ সবচাইতে কাব্য-গুণসমন্বিত।”

নারায়ণ দেবের জন্ম ও বংশপরিচয়-  নারায়ণ দেবের বেশ কিছু পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বেশিরভাগ পুঁথিতে তিনি সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। যদিও সব পুঁথির পাঠ হুবহু একরকমের নয়, তবুও আত্মপরিচয় বর্ণনায় তথ্যগত মিল আছে। তা থেকেই জানা যায় যে, নারায়ণ দেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। তারা কায়স্থ, মৌদগল্য গােত্র ও ‘দেব’ পদবীযুক্ত। নারায়ণ দেবের পিতামহের নাম উদ্ধারণ দেব (বা উদ্ধবরাম)। তাঁর নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে। কোনাে একসময় সপরিবারে রাঢ়দেশ পরিত্যাগ করে তিনি পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ জেলার কিশােরগঞ্জ মহকুমার বােরগ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু কৰে। বােরগ্রাম বর্তমান কালে মৈমনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও একসময় তা শ্রীহট্টের অন্তর্গত ছিল। এই বােরগ্রামেই নারায়ণ দেবের জন্ম হয়। তার পিতার নাম নরসিংহ দেব এবং মাতার নাম রুক্মিণী।

নারায়ণ দেবের কবিত্বশক্তি ও পরিচয়- নারায়ণ দেবের পুঁথিতে তার নিজস্ব। ভণিতায় ‘সুকবি’, ‘সুকবিবল্লভ’ বা ‘কবিবল্লভ এই জাতীয় বিশেষণাত্মক পরিচয় রয়েছে। অনেকের মতে এই ‘সুকবিবল্লভ’ বা ‘কবিবল্লভ’ তার উপাধিবিশেষ। ভাষার প্রাচীনত্ব ও অন্যান্য বহু কারণে, সাহিত্য-গবেষকদের অনেকেই নারায়ণ দেবকে ১৫শ শতাব্দীর শেষভাগের একজন প্রধান মনসামঙ্গল কাব্য-রচয়িতা বলে গ্রহণ করেছেন। সংস্কৃতভাষায় কবির বিশেষ পাণ্ডিত্য ছিল। সম্ভবত তাই তার রচনায় গাঢ়বদ্ধতা এবং ছন্দ ও অলংকারের নিপুণ প্রয়ােগ কৌশল লক্ষ করা যায়। সে যুগের ধারা অনুযায়ী তার কাব্যে ক্ষেত্রবিশেষে আদিরসের বাড়াবাড়ি থাকলেও, করুণরস ও হাস্যরস-সৃষ্টির দিক থেকে নারায়ণ দেব যথেষ্ট নিপুণতা দেখিয়েছেন। কবিত্বশক্তি ও পাণ্ডিত্যের গুণেই, ‘মনসামঙ্গল কাব্য (বা পদ্মপুরাণ) -এর রচয়িতা হিসাবে তিনি শুধু পূর্ববঙ্গেই নয়, আসাম-অঞ্চলেও বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। নারায়ণ দেবের কাব্যে দেবখণ্ডের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। এই অংশ বর্ণনায় তিনি পৌরাণিক জ্ঞানের যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। করুণরসের বর্ণনায় নারায়ণ দেব অতুলনীয কবি। সপর্দষ্ট লক্ষ্মীন্দর যেখানে মায়াঘুমে আচ্ছন্ন বেহুলাকে জাগিয়ে তুলছেন, নারায়ণ দেবের বর্ণনায় করুণরস সেখানে যেন চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে।

নারায়ণ দেবের ‘মনসামঙ্গল কাব্যে মহাকাব্যোচিত প্রসারতা ও গভীরতা লক্ষ করা যায়। যুগধর্মের জন্য তিনি তাঁর কাব্যকে পুরােপুরি মহাকাব্যের রূপ দিতে পারলেও তিনি যে মনসামঙ্গলের একজন উৎকৃষ্ট কবি তা অনস্বীকার্য। হাস্যরস ও করুণরস সৃষ্টিতে নারায়ণ দেবের বিশেষ দক্ষতা ছিল। ছায়া-ছন্দ ও আলঙ্কারিকতার দিক থেকেও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কাব্যে সংস্কৃত পুরাণের প্রভাবে ভাষা কোথাও গুরুগম্ভীর হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর রচনা গাঢ়বদ্ধ, সরল ও সাবলীল। নারায়ণ দেবের কাব্যে জীবন-রসের ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে। নারায়ণ দেবের কাব্যে বৈষ্ণব প্রভাবও স্পষ্ট। অনেক জায়গায় রাধাকৃষ্ণ প্রসঙ্গ আছে। চরিত্রচিত্রণেও নারায়ণ দেবের কৃতিত্ব উল্লেখযােগ্য। তার রচিত চন্দ্ৰধরের ব্যক্তিত্ব, গুণে ও সম্মানবােধে অসাধারণ। বেহুলা চাদের সাত পুত্রকে বাঁচিয়ে তুলে, চাদের চোদ্দ ডিঙা উঠিয়ে এনেছিল একটি শর্তে চাঁদকে মনসাপূজা করতে হবে। কিন্তু চাদও অনড়।

চাদ অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাঁ-হাতে মনসাপূজা করেছে পুত্রবধূর অনুরােধে। নারায়ণ দেবের হাতে চন্দ্রধর-চরিত্র অপূর্ব লাভ করেছে।

নারায়ণ দেবের কাব্যের কাহিনী সুপরিকল্পিত। তাঁর ‘পদ্মাপুরাণ’-এর কাব্যাংশ অনেক স্বাভাবিক।

নারায়ণ দেবের কাব্যকে কেউ-কেউ অশ্লীলতা- দোষে দুষ্ট মনে করেন। আসলে, সংস্কৃত পুরাণ অবলম্বনে নারায়ণ দেব কাব্য রচনা করেন। সেকালে সংস্কৃত শৈব পুরাণগুলির দূষিত আবহাওয়া এর কারণ বলে মনে হয়। নারায়ণ দেবের কাব্য সর্বাধিক প্রচার লাভ করেছিল। এ থেকে কাব্যটির জনপ্রিয়তাসম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। কবিত্বের সঙ্গে পাণ্ডিত্যের যােগে নারায়ণ দেবের কাব্য বিশিষ্ট রূপ লাভ করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top