Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী

Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী and select needs one.

Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী

Join Telegram channel

Also, you can read SCERT book online in these sections Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী for All Subject, You can practice these here…

প্রশ্ন ৪। —“এ বিবাহে আমার যাওয়াই হবে না।”—উক্তিটি কার? এখানে কার বিবাহের কথা বলা হয়েছে? বক্তা সেই বিবাহে যেতে চান না কেন?

উত্তরঃ উক্তিটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের। এখানে পীরগঞ্জের জমিদার মেজবাবুর মেয়ের বিয়ে।

জয়রাম মুখোপাধ্যায় একজন নামকরা মোক্তার। তিনি মহারাজ নরেশচন্দ্রের বাপের আমলের মোক্তার। জয়রামবাবু বন্ধু নগেন এবং জুনিয়র উকিল কুঞ্জবিহারীকে সাথে নিয়ে পীরগঞ্জে যাওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যদিকে। পীরগঞ্জে যাওয়ার রাস্তা ভালো নয়। ঘোড়ার গাড়ির পথ নেই। গোরুর গাড়ি করে যেতে হলে যেতে আসতে চারদিন লাগে। পালকি যোগাড় করে যাওয়াও মুশকিল। সেজন্য জয়রাম মোক্তার ভাবেন রাজবাড়ি থেকে হাতি এনে তাঁর পিঠে চেপে বন্ধুসহ নিমন্ত্রর রক্ষা করতে যাবে। এরকম কাজ তিনি পূর্বেও করেছেন। তাই তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস ছিল।

কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না, জয়রামবাবুর ভৃত্য চিঠি নিয়ে রাজবাড়িতে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার আগে সে দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরে আসে। ভৃত্য জানায়—মহারাজ হাতি পাঠাতে রাজি নন। উপরন্তু বলেছেন বিয়ের নিমন্ত্রণের জন্য হাতি পাঠাবার দরকার নেই। জয়রামবাবুরা গোরুর গাড়িতে আসুক। আত্মাভিমানী জয়রামবাবু মহারাজের এই আচরণে প্রচণ্ডভাবে আহত হলেন। তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সারা শরীর রাগে উত্তেজনায় জ্বলে উঠে। বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বন্ধুরা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে গোরুর গাড়িতে যাওয়াই শ্রেয় বলে মন্তব্য করেন।

কিন্তু জয়রামবাবু এই অপমান মেনে নিতে পারলেন না। মনস্থির করেন যদি বিয়েতে যেতেই হয় তবে হাতির পিঠে চেপেই যাবেন, নতুবা অপর কোনো যানবাহনে যাবেন না। আর যদি হাতির বন্দোবস্ত না হয় তবে তিনি বিয়ে বাড়িতে যাবেনই না। তাই হাতির সন্ধানে নানাদিকে লোক পাঠালেন। শেষ পর্যন্ত বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে দুহাজার টাকায় একটি মেয়ে হাতি কেনেন। মেয়ে হাতিটির নাম রাখেন আদরিণী। আদরিণীর পিঠে চেপেই বন্ধুসহ জয়রামবাবু পীরগঞ্জে বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান।

প্রশ্ন ৫। মেজবাবুর মেয়ের বিয়েতে যাওয়ার জন্য জয়রাম কী উপায় করলেন এবং কেন?

উত্তরঃ পীরগঞ্জের জমিদার মেজবাবুর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ জয়রামবাবু, নগেন ডাক্তার এবং উকিল কুঞ্জবিহারী তিনজনেই পান। কিন্তু পীরগঞ্জের যাতায়াতের রাস্তাটি খুব খারাপ, ঘোড়ার গাড়ি বা গোরুর গাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়, পালকিও পাওয়া যাবে না। সেজন্য নগেনবাবু পরামর্শ দেন রাজবাড়ি থেকে যদি হাতি আনিয়ে নেওয়া যায় তবে অনায়াসেই তিনজনে হাতির পিঠে চড়ে বিয়েবাড়ি যাওয়া যায়। নগেনবাবুর পরামর্শ জয়রামবাবুর মনঃপূত হয়। তিনি রাজবাড়ি থেকে হাতি পাঠাবার জন্য ভৃত্যের হাতে চিঠি পাঠিয়ে দেন। জয়রামবাবু ভেবেছিলেন তাঁর চিঠি গেলেই রাজবাড়ি থেকে হাতি চলে আসবে। 

কিন্তু জয়রামবাবুর আশা পূর্ণ হল না। মহারাজ নরেশচন্দ্র জানিয়ে দেন বিয়েবাড়িতে যেতে হাতি পাঠাবার দরকার নেই। বরং তাঁরা গোরুর গাড়িতে আসুন। মহারাজের এই আচরণে জয়রামবাবু প্রচণ্ড অপমানিত হন। তাঁর জেদ চেপে গেল যদি বিয়েবাড়িতে যেতে হয় তবে হাতির পিঠে চড়েই যাবেন, নাহলে যাবেন না। গোরুর গাড়িতে চড়ে জয়রামবাবু যাবেন না। 

শহর থেকে দু’তিন ক্রোশের মধ্যে দু’তিন জমিদারের হাতি ছিল। সেই রাত্রেই প্রত্যেকের কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন, যদি কেউ হাতি বিক্রি করে তবে তিনি কিনে নেবেন। রাত্রি দুপ্রহরের সময় খবর আসে বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর একটি মেয়ে হাতি আছে ; বিক্রি করতে চায়। বাচ্চা হলেও সওয়ারী নিতে পারবে কিন্তু দাম দুহাজার টাকা দিতে হবে। জয়রামবাবু তাতেই রাজি হয়ে যান। জয়রামবাবু খবর পাঠালেন পরের দিন সকালেই যেন লাহিড়ীবাবু বিশ্বাসী কর্মচারী দিয়ে হাতিটিকে পাঠিয়ে দেন এবং টাকা নিয়ে যান। পরের দিন বেলা সাতটার সময় মেয়ে হাতিটি আসে। তার নাম রাখেন আদরিণী। আদরিণীর পিঠে চড়েই বন্ধুসহ জয়রামবাবু পীরগঞ্জে বিয়েবাড়ি যান।

প্রশ্ন ৬। আদরিণী কে? তার আগমনে গ্রামের কী অবস্থা হয়েছিল বর্ণনা করো।

উত্তরঃ জয়রাম মোক্তারের পোষা মেয়ে হাতি হল আদরিণী। তিনি আদরিণীকে লাহিড়ী মহাশয়ের কাছ থেকে দুহাজার টাকায় কিনেছিলেন।

জয়রামবাবুর বাড়িতে আদরিণী আসামাত্রই পাড়ার সব বালকরা এসে বৈঠকখানার উঠোনে ভিড় করে দাঁড়াল। কয়েকজন দুষ্টু বালক সুর করে বলতে থাকে— ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’। বাড়ির বালকরা অত্যন্ত রেগে গেল এবং তাঁদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আদরিণী গিয়ে অন্তঃপুরের দরজার কাছে দাঁড়ায়। জয়রামবাবু বিপত্নিক ছিলেন। তাঁর বড়ো পুত্রবধূ একটি ঘটিতে জল নিয়ে ভীত পায়ে হেঁটে বের হয়ে আসেন। কাঁপা হাতে হাতিটির চারটি পায়ে একটু একটু করে জল ঢেলে দেন। মাহুতের ইঙ্গিত অনুসারে আদরিণী জানু পেতে বসল। বড়ো পুত্রবধূ তেল ও সিঁদুরে তাঁর কপাল রাঙিয়ে দেন। ঘন ঘন শঙ্খ বাজতে থাকে। তারপর আদরিণী উঠে দাঁড়ালে একটা ধামায় ভরে আলো চাল, কলা ও অন্যান্য মঙ্গল দ্রব্য তাঁর সামনে রাখা হয়। আদরিণী শুড় দিয়ে তুলে কিছুটা খেল, কিছুটা চারদিকে ছড়াল, এরূপে বরণ শেষ হলে রাজহাতির জন্য আনা কলাগাছ এবং গাছের ডালপালা খেতে থাকল।

প্রশ্ন ৭। জয়রামের বাড়িতে আদরিণীকে কীরূপে আপ্যায়ন করা হয়েছিল?

উত্তরঃ জয়রামবাবুর বাড়িতে আদরিণী আসামাত্রই পাড়ার সব বালকরা এসে বৈঠকখানার উঠোনে ভিড় করে দাঁড়াল। কয়েকজন দুষ্টু বালক সুর করে বলতে থাকে— ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’। বাড়ির বালকরা অত্যন্ত রেগে গেল এবং তাঁদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আদরিণী গিয়ে অন্তঃপুরের দরজার কাছে দাঁড়ায়। জয়রামবাবু বিপত্নিক ছিলেন। তাঁর বড়ো পুত্রবধূ একটি ঘটিতে জল নিয়ে ভীত পায়ে হেঁটে বের হয়ে আসেন। কাঁপা হাতে হাতিটির চারটি পায়ে একটু একটু করে জল ঢেলে দেন। মাহুতের ইঙ্গিত অনুসারে আদরিণী জানু পেতে বসল। বড়ো পুত্রবধূ তেল ও সিঁদুরে তাঁর কপাল রাঙিয়ে দেন। ঘন ঘন শঙ্খ বাজতে থাকে। তারপর আদরিণী উঠে দাঁড়ালে একটা ধামায় ভরে আলো চাল, কলা ও অন্যান্য মঙ্গল দ্রব্য তাঁর সামনে রাখা হয়। আদরিণী শুড় দিয়ে তুলে কিছুটা খেল, কিছুটা চারদিকে ছড়াল, এরূপে বরণ শেষ হলে রাজহাতির জন্য আনা কলাগাছ এবং গাছের ডালপালা খেতে থাকল।

প্রশ্ন ৮। “ ওদের একে একে বিক্রী করে ফেল।’—উক্তিটি কার? কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উত্তরঃ জয়রামবাবু মহারাজ নরেশচন্দ্রের কথায় অপমানিত হয়ে জেদ বশত উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে ২০০০ টাকায় আদরিণীকে কিনেছিলেন। এই ঘটনার পর সুদীর্ঘ পাঁচ বছর কেটে গেছে। এই পাঁচ বছরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন নিয়মে পাশ করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরে গিয়েছে। শিথিল নিয়মের আইন ব্যবসায়ীর কদর নেই। ক্রমশ জয়রামবাবুর আয় কমতে থাকল। আগের মতো উপার্জন হয় না। অথচ প্রতিবছর ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাঁর তিনজন পুত্রের দুটিরই কোনো উপার্জন নেই। শুধু ছোটো ছেলেটি কলকাতায় পড়ছে।

কথাতেই বলা হয়— হাতির খরচ— আদরিণীর পেছনে খরচও হয়ে দাঁড়াল জয়রামবাবুর কাছে ‘বোঝার ওপর শাকের আটি’। এরপর ঘটনাক্রমে জয়রামবাবু কাছারি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ায় মুখোপাধ্যায়ের সংসার অত্যন্ত কায়ক্লেশে চলতে থাকল। ব্যয় যে পরিমাণ কমিয়ে ফেলবেন ভেবেছিলেন তা শত চেষ্টাতেও সম্ভব হল না। সুদে সঙ্কুলান হয় না— মূলধন খরচ হতে শুরু হয়। কোম্পানীর কাগজেও হাত পড়ে।

একদিন সকালে মোক্তার মহাশয় বৈঠকখানায় বসে নিজের অবস্থার বিষয় চিন্তা করছেন এমন সময় মাহুত আদরিণীকে নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যায়। অনেকদিন থেকেই অনেকে পরামর্শ দিচ্ছিল— আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য। তাঁতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে। কিন্তু মুখার্জি মহাশয় উত্তর দেন— তার চেয়ে ছেলে বৌ নাতি নাতনিদের খাওয়াতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে, ওদের একে একে বিক্রি করে ফেলা যায়।

বুদ্ধিমান ব্যক্তি আয় বুঝে ব্যয় করেন। কেননা তাঁরা জানেন, ওজন বুঝে না চললে পরিণামে দুঃখ পেতে হবে। দিনেরবেলায় সূর্যের আলো সবাই দেখতে পায়, অপর কোনো আলোর তখন প্রয়োজন পড়ে না। রাত্রির অন্ধকারে আলোর প্রয়োজন কিন্তু নিজের অপদার্থ খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য কেউ যদি দিনেরবেলায় আলো জ্বালায় তবে তার বুদ্ধি বিবেচনার অভাব আছে, এ কথাই বুঝতে হবে। হয়তো এমন সময় আসবে, যখন আলোর বড়ই প্রয়োজন, তখন তাঁর আলো জ্বালাবার সামর্থ্যই থাকবে না।

মানুষকে সাংসারিক নানা প্রয়োজনে অর্থ ব্যয় করতে হয়, কিন্তু তা পরিমিত এবং যথোচিত হওয়া প্রয়োজন। নিজের ঐশ্বর্য গরিমা প্রদর্শনের জন্য যাঁরা অকারণ অর্থ বা শক্তি ব্যয় করেন তাঁরা অপরিণামদর্শী। মানুষের যতটুকু শক্তি সামর্থ্য, তার বাইরে গেলেই অনর্থ ঘটে। যাঁরা পূর্বপুরুষের সঞ্চিত ধনরত্নের অধিকারী তাঁরাও যদি ভোগবিলাসের মাত্রা ছাড়িয়ে যান তবে তাঁদের শেষ জীবন দুঃখ-দারিদ্র্যে অতিবাহিত করতে হবে। কৃপণের মতো কেবল অর্থসঞ্চয় যেমন বাঞ্ছিত নয়, তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনক্ষয়ও কাম্য নয়। অর্থের সদ্ব্যয় করলে তবেই জীবনে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারী হওয়া যায়, নতুবা অমিতব্যয়িতার ফলস্বরূপ জীবনে কেবল দুঃখ্যাতনাই ভোগ করতে হয়।

প্রশ্ন ৯। ‘যেনো হারাধন ফিরিয়া পাওয়া গিয়াছে’—উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, অভিমান ও অপমান হিসেবে মুখোপাধ্যায় পরিবারে আদরিণী এসেছিল। তাঁকে হাতি দিতে মহারাজা নরেশচন্দ্র চাননি, সেজন্য তার বদল হিসেবেই তিনি নেহাতই ঝোঁকের বশে আদরিণীকে কিনে ফেলেছিলেন এবং অম্লমধুর প্রতিশোধও নিয়েছিলেন এই ঘটনায়। তিনি হাতিতে চেপে মহারাজ নরেশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন পীরগঞ্জ থেকে ফেরার পরের দিনই।

জয়রাম মুখোপাধ্যায় প্রাচীন ধ্যান-ধারণার মানুষ, তাঁর কোনো পুত্রই উপযুক্ত নয়। জয়রামবাবুর কোনো কন্যাসন্তান ছিল না, সেজন্য পঞ্চাশ পেরনো বৃদ্ধের হৃদয়ে কন্যার স্থান দখল করে নেয় আদরিণী। জয়রামের অবসর জীবন সুখের নয়। ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ায় অস্বচ্ছলতা দেখা দেয়। ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছিল না। সুদে সংসার চলছে না বলে মূলধনও খরচ হতে লাগল। কোম্পানীর কাগজের সংখ্যা কমতে লাগল। তখন অনেকে আদরিণীকে বিক্রি করে দেবার পরামর্শ দেয়। এতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বাঁচবে। কিন্তু আদরিণী ছিল জয়রামবাবুর আত্মার আত্মীয়, জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেজন্য তাঁকে বিক্রি করার কথা তিনি কখনো ভাবতে পারেন নি। সেজন্য ঠিক হল আদরিণীকে ভাড়া দেওয়া হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দূরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে আদরিণীকে ভাড়া দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞাপনে দেওয়া হলেও সেভাবে সাড়া পাওয়া গেল না।

এরমধ্যে নতুন সমস্যা উপস্থিত হয়। জয়রামবাবুর বড় নাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর ডাক্তার ওষুধ খরচে ৫।৭ টাকা ব্যয় হতে লাগল। মাসখানেক পরে নাতি কিছুটা সুস্থ হলে বড়বৌ ও মেজবৌ একসাথে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে।

এদিকে বড় নাতনি কল্যাণীর বারো বছর বয়স হতে চলল, শীঘ্রই তাঁর বিয়ে দেওয়া দরকার। নানা জায়গা থেকে সম্বন্ধ এলেও পছন্দসই হচ্ছিল না। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে মেয়ের বাবার কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। সে সর্বক্ষণ নেশাভাঙ করে, তাসপাশা খেলে বেড়াত, যত দায় জয়রামবাবুর ওপরেই ছিল। অবশেষে কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়। পাত্রটি রাজশাহী কলেজে এল-এ পড়ে। কিন্তু বিয়ে সম্পন্ন করতে হলে আড়াই হাজার টাকার দরকার।

এমতাবস্থায় সকলে আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দিতে থাকে। জয়রামবাবুকে আদরিণীর প্রতি মায়া ত্যাগ করতে বলেন। শুনে জয়রাম বারংবার কোঁচার খুঁটে চোখ মুছতে থাকেন। অবশেষে চৈত্র সংক্রান্তির ১৫ দিন আগে শুরু হওয়া বামুনহাটের মেলায় আদরিণীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সঙ্গে জয়রামবাবুর মেজোছেলে যাবে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ সন্ধ্যাবেলা আদরিণী মেলা থেকে ফিরে এল, বিক্রি হয়নি। নায্য মূল্য দেবার খরিদ্দার জোটেনি। আদরিণীকে ফিরে আসতে দেখে বাড়িতে আনন্দের কোলাহল পড়ে যায়। বিক্রি হয়নি বলে কারো মনে খেদের চিহ্ন ছিল না। বাড়ির সকলে এমন আচরণ শুরু করল যেন হারানো ধন ফিরে পাওয়া গেছে। মানুষ বিশ্ববিধাতার মহান সৃষ্টি, বিধাতা তাকে যে মহাসম্মান দান করেছেন তাকে রক্ষা করাই তার কর্তব্য।

এই পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের মূলে আছে অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ। জগতের বিশাল ক্ষেত্রে যারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে মানবজাতির কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, হৃদয়ধর্মের প্রেরণায় যারা দুঃখীজনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের জীবনই সার্থক, পরার্থপরতাই জীবনের চরিতার্থতার মূল। নিঃস্বার্থ এবং উদার মন নিয়ে যারা বেঁচে থাকেন তাঁদের জীবনই সফল। বস্তুত স্বার্থমগ্ন মানুষের সঙ্গে বিশ্বজনের হৃদয়ের কোনো যোগ নেই। পৃথিবীতে যে সকল মহাপুরুষ আবির্ভূত হয়েছেন তাঁরা সকলেই পরহিতব্রতে দীক্ষিত। যদি স্বার্থমগ্ন মানুষ স্বার্থত্যাগের মাধ্যমে নিজেদের সত্তাকে মানবগোষ্ঠীর সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিত, তবে তাদের জীবন ব্যর্থ হত না।

প্রশ্ন ১০। “ওঁর মুখ দিয়ে ব্রহ্মাক্য বেরিয়েছে….” —রহ্মবাক্য বলতে কী বোঝায়? কার মুখ দিয়ে এই বাক্য নির্গত হয়েছে? এবং বাক্যটি কী?

উত্তরঃ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণদের মুখ থেকে যে বাক্য বের হয় সেই বাক্যই ফলপ্রসূ হয়, তাকেই বলে ব্রহ্মবাক্য।

জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের মুখ দিয়ে এই বাক্য বের হয়েছে। সংসারে আর্থিক অনটনের কারণে সকলে জয়রামবাবুকে পরামর্শ দিয়েছিল আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়া হোক। তাতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বাঁচবে। কিন্তু জয়রামবাবু গররাজি ছিলেন। আদরিণী জয়রামবাবুর কাছে ছিল কন্যাসমা। আদরিণীকে বিক্রি করার কথায় তার চোখে জল আসে। কিন্তু নাতনি কল্যাণীর বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার খুব দরকার হয়ে পড়ে। তখন বাধ্য হয়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে বামুনহাটের মেলায় আদরিণীকে বিক্রির জন্য পাঠান। কিন্তু মেলায় পাঠিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। আদরিণী যদি ভালো মালিকের হাতে না পড়ে এই ভয়ে লোকজনদের বলেছেন— একজন ভালো খদ্দের ঠিক কর তাতে দাম যদি দু-পাঁচশো টাকা কমও হয়, সেও স্বীকার। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় পিতা যেভাবে কন্যাকে আশীর্বাদ করে সেভাবেই জয়রাম আদরিণীকে নিজে হাতে রসগোল্লা খাইয়ে দিয়েছেন। শেষে তাঁর গলার নীচে হাত বুলাতে বুলাতে ভগ্ন কণ্ঠে বলেছেন— “আদর, যাও মা, বামুনহাটের মেলা দেখে এস।” প্রাণ ধরে বিদায়বাণী উচ্চারণ করতে পারলেন না। উদ্বেল দুঃখে এই ছলনার আশ্রয় নিলেন।

প্রশ্ন ১১। “আজ আর বৃদ্ধ তাহার কাছে গিয়া বিদায় সম্ভাষণ করিতে পারিলেন না।”—বৃদ্ধটি কে? তিনি কাকে বিদায় সম্ভাষণ করতে পারলেন না এবং কেন?

উত্তরঃ বৃদ্ধটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়। তিনি আদরিণীকে বিদায় সম্ভাষণ করতে পারলেন না।

মহারাজা নরেশচন্দ্রের কাছে অপমানিত হয়ে জয়রামবাবু দুহাজার টাকায় উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে আদরিণীকে কিনেছিলেন। আদরিণী যখন জয়রামবাবুর বাড়ি আসে তখন সে বাচ্চা। সেই থেকে জয়রামবাবু তাঁকে কন্যাস্নেহে বড় করে তুলেছেন। জয়রাম মুখোপাধ্যায় প্রাচীনপন্থী, মূল্যবোধ সম্পন্ন, সংবেদনশীল মানুষ। তাঁর নিজের পুত্রেরা উপযুক্ত নয়। নিজের কোনো কন্যাসন্তানও ছিল না। তাই বৃদ্ধ জয়রামের অন্তরে কন্যার স্থানটি আদরিণী দখল করে নেয়। তিনি আদরিণীকে সন্তান-নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একাসনে বসিয়েছেন। বড় নাতনি কল্যাণীর বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। বৈশাখ মাস পড়লেই উভয়পক্ষের আশীর্বাদ হবে। তখন বাধ্য হয়ে আদরিণীকে বিক্রির জন্য বামুনহাটের মেলায় পাঠিয়ে দেন। কন্যাসমা আদরিণীকে মেলায় পাঠিয়েও তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। আদরিণী যদি ভালো মালিকের হাতে না পড়ে তাই লোকজনদের বলেছেন—“একজন ভালো খদ্দের ঠিক কর, তাতে দাম যদি দু-পাঁচশো টাকা কমও হয় সেও স্বীকার।” কথাটির মধ্য দিয়ে জয়রামবাবুর স্নেহার্দ্র মনের পরিচয় পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় যেভাবে পিতা কন্যাকে আশীর্বাদ করে। সেভাবেই তিনি আদরিণীকেও বামুনহাটের মেলায় যাবার সময় মিষ্টিমুখ করিয়েছেন, গায়ে হাত বুলিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু কন্যাকে বিদায় দানের সময় স্নেহশীল পিতা যেভাবে বিদায়বাণী উচ্চারণ করতে পারেন না, জয়রামও তেমনি আদরিণীকে বিদায় জানাতে পারেননি। আদরিণী মেলায় বিক্রির জন্য চলে যাওয়ার পর তাঁর শোকে বিহ্বল হয়ে ভেঙে পড়ার দৃশ্যটিও কন্যাকে বিদায়ের সময় পিতার শোকের সাথে তুলনা করা চলে।

প্রশ্ন ১২। জয়রাম কীভাবে সাংসারিক অচলাবস্থায় পড়লেন এবং কীভাবে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় করলেন বর্ণনা করো?

উত্তরঃ আত্মসম্মানী, জেদি এবং পৌরুষগুণসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়। একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটিকে সম্বল করে যশোর জেলা থেকে শহরে এসে পৌঁছেছিলেন। জয়রামের কৃচ্ছসাধনা ও কর্মসাধনা শুরু হয়েছিল নিজের হাতে রান্না করে, আধপেটা খেয়ে, মাসিক তেরো সিকের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। সেই সংগ্রামী কপর্দকহীন যুবক নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে। জেলা আদালতে খ্যাতিমান জবরদস্ত মোক্তার, পাকা দালানবাড়ি, পুকুর, বাগান এবং বেশ কয়েকটি কোম্পানির কাগজের মালিক জয়রাম মুখোপাধ্যায় এখন যথেষ্ট সম্পন্ন। বলা যায় তিনি নিজের কর্মদক্ষতায় ও পরিশ্রমে একজন সফল মানুষ।

বৃদ্ধ মানুষটি জীবনযুদ্ধে জয়ী হলেও সাংসারিক জীবনে অসফল। পাঁচ বছরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নিয়মে পাশ করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরে গিয়েছে। শিথিল নিয়মে আইন ব্যবসায়ীর দাম নেই। ক্রমশ জয়রামের আয় কমতে থাকল। পূর্বে যা আয় হত এখন তার অর্ধেক হয় কি না সন্দেহ, অথচ খরচ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জয়রামের তিনটি ছেলে। প্রথম দুটি নিরক্ষর, নিষ্কর্মা, নেশাখোর এবং তাসুড়ে। বড় পুত্রটি আবার ‘ফুলুট’ বাজায়। বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো কাজ করার যোগ্যতা নেই। একমাত্র ভরসা ছোট ছেলে–যে কলকাতায় পড়াশুনা করছে। জয়রামের পরাজয় এখানেই। উপার্জনের প্রতি মন দিতে গিয়ে সাংসারিক দিকে দৃষ্টিপাত করেননি।

অবসরের পর জয়রামের সংসার কষ্টে চলতে থাকল। শত চেষ্টাতেও ব্যয় কমাতে পারলেন না। সুদে কুলোয় না বলে মূলধনে হাত পড়তে লাগল। কোম্পানীর কাগজের সংখ্যা কমে গেল। এই পরিস্থিতিতে সকলে আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দিল—তাতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে না। কিন্তু তাতে জয়রাম কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বাড়ির সকলের মতো আদরিণীও একজন সদস্যা। সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে আদরিণীকে বিয়ের শোভাযাত্রা, দূরদূরান্তে যাতায়াত প্রভৃতি কাজে ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের ফলে মাঝে মাঝে ভাড়া হলেও ১৫/২০ টাকার বেশি আয় হল না। এদিকে জয়রামের বড় নাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর জন্য প্রতি দিন ৫/৭ টাকা খরচ হতে লাগল। মাসখানেক পরে বালকটি কিছু সুস্থ হল। আবার বড়ো বৌ, মেজ বৌ অন্তঃসত্ত্বা। কয়েকমাস পরে আরও দুটি মানুষের অন্নসংস্থান করতে হবে। বড় নাতনী কল্যাণীর বারো বৎসর বয়স। তারও বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তাঁর পিতা নির্বিকার। যত দায় এই বৃদ্ধ লোকটির ঘাড়ে। কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়। বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার প্রয়োজন। কোম্পানীর কাগজ কমে আসছে, তা থেকে আড়াই হাজার টাকা পাওয়া কঠিন। এছাড়া আরও নাতনীরা রয়েছে। তাদের কী হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে জয়রামবাবুর শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। একদিন সংবাদ এল ছোট ছেলেটি বি.এ. পরীক্ষায় ফেল করেছে।

অবশেষে আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বন্ধুদের পরামর্শে বামুনহাটের মেলায় বিক্রির জন্য আদরিণীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আদরিণীর উপযুক্ত খরিদ্দার না পাওয়ায় মেলা থেকে ফিরে আসে। কিন্তু অবস্থার পাকচক্রে রসুলগঞ্জের মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাবার সময় আদরিণীর কান্নার খবর পেয়ে জয়রামবাবুও কাঁদতে লাগলেন। পরদিন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। জয়রামবাবু খবর পেলেন সাতক্রোশ দূরের একটি জায়গায় আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জয়রামবাবু এই খবরে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়লেন যে, তিনি কালবিলম্ব না করে আদরিণীর কাছে ছুটে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আদরিণী মারা গেছে। এর ছয়মাসের মধ্যে জয়রামবাবুও মারা যান।

প্রশ্ন ১৩। “যত দায় এই ষাট বৎসরের বুড়ারই ঘাড়ে।”—ষাট বছরের বুড়োটি কে? তিনি কীরূপ দায়ে পড়েছিলেন?

উত্তরঃ ষাট বছরের বুড়োটি হলেন জয়রাম মুখোপাধ্যায়।

আত্মসম্মানী, জেদি এবং পৌরুষগুণসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়। একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটিকে সম্বল করে যশোর জেলা থেকে শহরে এসে পৌঁছেছিলেন। জয়রামের কৃচ্ছসাধনা ও কর্মসাধনা শুরু হয়েছিল নিজের হাতে রান্না করে, আধপেটা খেয়ে, মাসিক তেরো সিকের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। সেই সংগ্রামী কপর্দকহীন যুবক নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে। জেলা আদালতে খ্যাতিমান জবরদস্ত মোক্তার, পাকা দালানবাড়ি, পুকুর, বাগান এবং বেশ কয়েকটি কোম্পানির কাগজের মালিক জয়রাম মুখোপাধ্যায় এখন যথেষ্ট সম্পন্ন। বলা যায় তিনি নিজের কর্মদক্ষতায় ও পরিশ্রমে একজন সফল মানুষ।

বৃদ্ধ মানুষটি জীবনযুদ্ধে জয়ী হলেও সাংসারিক জীবনে অসফল। পাঁচ বছরে মোক্তার মহাশয়ের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নিয়মে পাশ করা শিক্ষিত মোক্তারে জেলাকোর্ট ভরে গিয়েছে। শিথিল নিয়মে আইন ব্যবসায়ীর দাম নেই। ক্রমশ জয়রামের আয় কমতে থাকল। পূর্বে যা আয় হত এখন তার অর্ধেক হয় কি না সন্দেহ, অথচ খরচ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জয়রামের তিনটি ছেলে। প্রথম দুটি নিরক্ষর, নিষ্কর্মা, নেশাখোর এবং তাসুড়ে। বড় পুত্রটি আবার ‘ফুলুট’ বাজায়। বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো কাজ করার যোগ্যতা নেই। একমাত্র ভরসা ছোট ছেলে–যে কলকাতায় পড়াশুনা করছে। জয়রামের পরাজয় এখানেই। উপার্জনের প্রতি মন দিতে গিয়ে সাংসারিক দিকে দৃষ্টিপাত করেননি।

অবসরের পর জয়রামের সংসার কষ্টে চলতে থাকল। শত চেষ্টাতেও ব্যয় কমাতে পারলেন না। সুদে কুলোয় না বলে মূলধনে হাত পড়তে লাগল। কোম্পানীর কাগজের সংখ্যা কমে গেল। এই পরিস্থিতিতে সকলে আদরিণীকে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দিল—তাতে মাসে ত্রিশ চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে না। কিন্তু তাতে জয়রাম কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বাড়ির সকলের মতো আদরিণীও একজন সদস্যা। সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে আদরিণীকে বিয়ের শোভাযাত্রা, দূরদূরান্তে যাতায়াত প্রভৃতি কাজে ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের ফলে মাঝে মাঝে ভাড়া হলেও ১৫/২০ টাকার বেশি আয় হল না। এদিকে জয়রামের বড় নাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর জন্য প্রতি দিন ৫/৭ টাকা খরচ হতে লাগল। মাসখানেক পরে বালকটি কিছু সুস্থ হল। আবার বড়ো বৌ, মেজ বৌ অন্তঃসত্ত্বা। কয়েকমাস পরে আরও দুটি মানুষের অন্নসংস্থান করতে হবে। বড় নাতনী কল্যাণীর বারো বৎসর বয়স। তারও বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তাঁর পিতা নির্বিকার। যত দায় এই বৃদ্ধ লোকটির ঘাড়ে। কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়। বিয়ের জন্য আড়াই হাজার টাকার প্রয়োজন। কোম্পানীর কাগজ কমে আসছে, তা থেকে আড়াই হাজার টাকা পাওয়া কঠিন। এছাড়া আরও নাতনীরা রয়েছে। তাদের কী হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে জয়রামবাবুর শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। একদিন সংবাদ এল ছোট ছেলেটি বি.এ. পরীক্ষায় ফেল করেছে।

অবশেষে আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বন্ধুদের পরামর্শে বামুনহাটের মেলায় বিক্রির জন্য আদরিণীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আদরিণীর উপযুক্ত খরিদ্দার না পাওয়ায় মেলা থেকে ফিরে আসে। কিন্তু অবস্থার পাকচক্রে রসুলগঞ্জের মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাবার সময় আদরিণীর কান্নার খবর পেয়ে জয়রামবাবুও কাঁদতে লাগলেন। পরদিন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। জয়রামবাবু খবর পেলেন সাতক্রোশ দূরের একটি জায়গায় আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জয়রামবাবু এই খবরে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়লেন যে, তিনি কালবিলম্ব না করে আদরিণীর কাছে ছুটে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আদরিণী মারা গেছে। এর ছয়মাসের মধ্যে জয়রামবাবুও মারা যান।

প্রশ্ন ১৪। “দাদামশায় আদর যাবার সময় কাঁদছিল।”—উক্তিটি কার? “আদর” কে? সে কোথায় যাচ্ছিল? আদর যাবার সময় কাঁদছিল কেন?

উত্তরঃ উক্তিটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের বড় নাতনী কল্যাণীর।

‘আদর’ হল আদরিণীর ডাক নাম। সে রসুলগঞ্জের মেলার যাচ্ছিল।

মূক প্রাণী মানুষের চোখ ও দেহের ভাষা বোঝে। যারা মনুষ্যেতর প্রাণীদের অপত্যস্নেহে ভালোবাসেন, তারাও জানেন একথা। সেজন্য যখন আদরিণীকে চৈত্র সংক্রান্তিতে বামুনহাটের মেলায় বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন জয়রামবাবু আদরিণীকে মিথ্যে কথা বললেন। তাকে হাট থেকে ঘুরে আসতে বলেন। কিন্তু নিয়তির খেলার কারণে সেখানে সঠিক দাম না মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করা যায়নি। ফলে আবার দ্বিতীয়বার আদরিণীকে পাঠানো হয় রসুলগঞ্জের মেলায়। অসহনীয় বেদনায় এবার জয়রামবাবু আদরিণীকে বিনাবাক্যব্যয়ে বিদায় দিলেন।

যে মর্মান্তিক অনুশোচনায় জয়রামবাবু জ্বলছিলেন, তার আঁচ থেকে কিন্তু তিনি আদরিণীকে দূরে রাখতে পারেননি। কোনো একটি অদৃশ্য চাপের কারণে যে তিনি আদরিণীকে দূরে করে দিচ্ছিলেন, সে কথাটি ওই মূক প্রাণীটি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিল। সেজন্য কথা না বলতে পারা ওই প্রাণীটি রসুলগঞ্জে যাওয়ার সময় নীরবে চোখের জল ফেলার মধ্য দিয়ে সেকথা জানান দিয়ে গিয়েছিল। জয়রামবাবুর কাছ থেকে বিচ্ছেদের কারণে যে আঘাত আদরিণী পেয়েছিল, সে আঘাত মৃত্যুবাণ হয়ে ফিরে এসেছিল আদরিণীর কাছে। বিচ্ছেদের অভিমান আদরিণী সইতে পারেনি। সেজন্য রসুলগঞ্জের পথেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে সে এবং জয়রামবাবু খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছোনোর আগেই মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

রসুলগঞ্জে যাওয়ার সময় নীরবে চোখের জল ফেলে আদরিণী যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল জয়রামবাবুর দিকে। যেন জিজ্ঞাসা করেছিল—“যদি মনুষ্যেতর প্রাণী না হয়ে মানুষ হতাম, রক্তের সম্পর্কের কেউ হতাম, তাহলে এভাবে পিতা হয়ে কি আমাকে বিক্রি করতে পারতে?” কিন্তু বাস্তবে এই ধরনের কোনো প্রশ্ন কিন্তু আদরিণী করেনি। সে নিঃশব্দে সরে গিয়েছিল জয়রামবাবুর সমস্যাবহুল জীবন থেকে। কিন্তু সে মরে গিয়ে নিজে মুক্তি লাভ করলেও জয়রামবাবুকে অদ্ভুত এক বন্ধনের মধ্যে রেখে দিয়ে গিয়েছিল। চর্মচক্ষু দিয়ে বাইরে থেকে তাকে দেখা যায় না, কিন্তু হৃদয় দিয়ে তাকে অনুভব করা যায়। তিনি হৃদয় দিয়ে সেটাই অনুভব করেছিলেন।

‘আদরিণী’ গল্পে লেখক তার সুনিপুণ লেখনীর দ্বারা মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর মধ্যেকার নিবিড় সম্পর্কের চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের মতো প্রত্যক্ষভাবে হয়তো নয়, কিন্তু তাঁর লেখনী পরোক্ষভাবে, অত্যন্ত সুনিপুণ হস্তে হৃদয়বৃত্তির সূক্ষ্ম তারগুলিকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেজন্য তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা বেদনাময়তার সুরগুলি পাঠক হৃদয়ে বেদনার ঢেউ তুলেছিল।

প্রশ্ন ১৫। “জানতে পেরেছে। ওরা অন্তর্যামী কিনা।”—উক্তিটি কার? ওরা বলতে এখানে কাদের কথা বলা হল? এখানে জানার ব্যাপারটা কী ব্যাখ্যা করো।

উত্তরঃ উক্তিটি জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের। ওরা বলতে এখানে মূক পশুদের কথা বলা হয়েছে।

জয়রাম মুখুয্যে এবং তার বন্ধুদের সুখ বিলাস ভোগ করার জন্যই হাতিটির সমাদার। এই মনোভাব পশুপ্রীতির নমুনা প্রমাণ করে না। দীর্ঘ পাঁচবছর মোক্তারের বাড়িতেই থেকে যায় ‘আদরিণী’ নামক হাতিটি। দীর্ঘ পাঁচবছর ধরে গল্পকার মোক্তারের সঙ্গে হাতির ব্যবহারের বাৎসল্যের যে সম্পর্ক সেই চিত্র এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার চিত্র আঁকেননি। মোক্তারের প্রতি হাতির আকৃষ্ট হবার স্বরূপ বোঝা যায় না এই চিত্রের অভাবে। তাছাড়া কোনো প্রমাণচিত্রও মেলে না। কোনো কোনো মানবিক বৃত্তিতে হাতির প্রতি মোক্তারের স্নেহের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়েছে। বিয়ের নিয়ন্ত্রণ সেরে আসার পর পাঁচবছর যাবৎ হাতির স্বভাব, বাসনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্রই এখানে পরিস্ফুট হয়নি। এগুলি যদি থাকত তাহলে হাতির এবং মোক্তারের সম্পর্কের এই যুক্তিটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠত। মোক্তার চিরকালের মতো কাছারি বাড়ি ত্যাগ করে আসে, তারপর তার পারিবারিক অর্থনৈতিক সমস্যা ও বিপর্যয় এবং আবার হাতির প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। আর তখনই এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্যই উদ্যোগী হন হাতি বিক্রি করার। তখন গল্পে দ্বিতীয় গুরুত্ব পায় ‘আদরিণী’। আদরিণীর প্রতি মোক্তারের স্নেহার্দ্র হৃদয়ের স্বভাবচিত্র হতে থাকে তখন থেকেই। এইখানেই গল্পকার দুপক্ষের সম্পর্কে বাৎসল্যরস পরিস্ফুট করেছেন। বাজারে হাতি বিক্রির ব্যবস্থা করার সময় তার মনের খবর দু’বার পাওয়া যায়। এই অংশটিতে বারো বছরের জ্যেষ্ঠ পৌত্রী কল্যাণীর কথায়—“দাদামশায় আদর যাবার সময় কাঁদছিল। মুখোপাধ্যায় শুইয়া ছিলেন, উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, ‘কি বললি? কাঁদছিল ??

“হ্যাঁ দাদামশায়। যাবার সময় তার চোখ দিয়ে টপ্‌টপ্ করে জল পড়তে লাগল।”

এই চিত্রে কিছুটা ধরা পড়ে হাতির প্রতিক্রিয়া। মোক্তারের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কথাও জানা যায় এই চিত্রে। “ওরা অন্তর্যামী কিনা। এ বাড়িতে যে আর ফিরে আসবে না, তা জানতে পেরেছে।”

হাতির কান্নার প্রতীকী স্বভাব মধ্যমপুত্রের দ্বারা প্রেরিত চাষীর হাতের একটি চিঠির ভাষায়—

“…আদরিণী অত্যন্ত পীড়িত হইয়া পড়ে। সে আর পথ চলিতে পারে না। রাস্তার পার্শ্বে একটা আমবাগানে শুইয়া পড়িয়াছে। তাহার পেটে বোধহয় কোনও বেদনা হইয়াছে।—শুঁড়টা উঠাইয়া মাঝে মাঝে কাতর স্বরে আর্তনাদ করিয়া উঠিতেছে।”

মোক্তারের প্রতিক্রিয়ায় তার হাতির প্রতি স্নেহার্ড মানবিকতার অসহায়তার দিক দেখতে পাওয়া যায় এই চিত্রে—

“আমার গাড়ির ব্যবস্থা করে দাও। আমি এখন বেরোব। আদরের অসুখ-যাতনায় সে ছটফট করছে। আমাকে না দেখতে পেলে সে সুস্থ হবে না। আর আমি দেরী করতে পারব না।”

…….“বৃদ্ধ ছুটিয়া গিয়া হস্তিনীর শবদেহের নিকট লুটাইয়া পড়িয়া, তাহার মুখের নিকট মুখ রাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বার বার বলিতে লাগিলেন—“অভিমান করে চলে গেলি মা? তোকে বিক্রি করতে পাঠিয়েছিলাম বলে?—তুই অভিমান করে চলে গেলি?”

কেন্দ্রীয় ভাববস্তু আদরিণী গল্পের অঙ্গীরস যে মমত্ববোধ এবং অসীম পশুপ্রীতি তার একতরফা প্রকাশ পায় গল্পটির মধ্যে। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের মহেশ নামক ষাঁড়টি হল গল্পের কাহিনি। রক্তমাংসের স্বভাবে ওতপ্রোত প্লটে এবং আবহে। তর্করত্ন পুরোহিতের হাতে ফলের পুঁটলি দেখে মহেশ আহারের বাসনা জানায় মাথা নাড়িয়ে, সে অন্যের সাজানো বাগানের গাছপালা নষ্ট করে দেয়, দারুণ গ্রীষ্মে তৃষ্ণার্ত মহেশ জলের কলসি ভেঙে দেয় আমিনার— এগুলি সব প্রতীকী হওয়া সত্ত্বেও নায়ক গফুরের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তা অনেক বড়ো তাৎপর্য আনে গল্পের কেন্দ্রীয় রসে। কিন্তু আদরিণী তা করে না।

প্রশ্ন ১৬। আদরিণীর বিদায় পর্বে জয়রাম কী বলে মনকে প্রবোধ দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ রসুলগঞ্জের মেলায় আদরিণীকে বিক্রি করতে পাঠিয়ে দেওয়ার পর জয়রামবাবু খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কল্যাণী এসে বৃদ্ধকে জানালো “আদর” যাবার আগে কাঁদছিল। শুনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জয়রামবাবু মাটিতে বসে পড়লেন। কল্যাণী চলে গেলে অশ্রুপূর্ণ নয়নে আপন মনে বলতে লাগলেন যে “যাবার সময় আমি তোর সঙ্গে দেখাও করলাম না, সে কি তোকে অনাদর করে? না মা, তা নয়, তুই ত অন্তর্যামী। তুই কি আমার মনের কথা বুঝতে পারিস নি?—খুকীর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর তুই যার ঘরে যাবি, তাদের বাড়ি গিয়ে আমি তোকে দেখে আসব। তোর জন্য সন্দেশ নিয়ে যাব—রসগোল্লা নিয়ে যাব। যতদিন বেঁচে থাকব, তোকে কি ভুলতে পারব? মাঝে মাঝে গিয়ে তোকে দেখে আসব। তুই মনে কোন অভিমান করিসনে মা।”

পরের দিন বিকালে একজন চাষী লোক আদরিণীর অসুস্থতার সংবাদ লেখা চিঠি এনে দিল। চিঠি পড়ে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মাথায় বজ্রাঘাত হয়। চিঠিতে লেখা আছে বাড়ি থেকে সাত ক্রোশ দূরে আদরিণী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পথ চলতে পারছে না। রাস্তার পাশে আম বাগানে শুয়ে পড়েছে। মাহুত সারারাত চিকিৎসা করেছে, হয়তো আর বাঁচবে না। খবর পাওয়া মাত্রই বৃদ্ধ পাগলের মতো ছুটে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। জয়রামবাবু পৌঁছানোর পূর্বেই অভিমানী আদরিণী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। তারপর জয়রাম মুখোপাধ্যায় মাত্র ছমাস জীবিত ছিলেন।

প্রশ্ন ১৭। “ব্রাহ্মণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল।”—এখানে ব্রাহ্মণ কে? প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উত্তরঃ এখানে ব্রাহ্মণ বলতে জয়রাম মুখোপাধ্যায়কে বোঝানো হয়েছে।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আদরিণী’ গল্পটি ছোটো-বড়ো সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। এর মধ্যে কোনো পরিচ্ছেদেই জয়রাম মোক্তারের সঙ্গে আদরিণীর আন্তরিক সম্পর্কজনিত কোনো চিত্র আমরা দেখতে পাই না। অথচ জয়রাম মোক্তার আদরিণীর অসুস্থ হওয়ার সংবাদে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। আদরিণীর মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। এই চিত্র দেখে অস্বাভাবিক লাগতেই পারে, কারণ আদরিণী গল্পের কাঠামো এবং বিন্যাসে জয়রাম মোক্তারের সঙ্গে আদরিণীর স্নেহমায়াজনিত সম্পর্কের কোনোরকম চিত্র আসা স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য এখানে আসেনি, এই না-আসা ব্যাপারটা কি লেখকের ইচ্ছাধীন না গল্পের কাঠামোর মূল দুর্বলতা?

জয়রাম নিজের অহংকার চরিতার্থ করতে কিনেছিলেন আদরিণীকে। পীরগঞ্জের বাবুদের বাড়ির বিবাহের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে মহারাজা শ্রীনরেশচন্দ্র রায়চৌধুরীর কাছে একটি হাতি প্রার্থনা করেছিলেন জয়রাম। কিন্তু যখন মহারাজ প্রত্যাখ্যান করলেন তাঁর অনুরোধ এবং দেওয়ানজী দিয়ে বলে পাঠালেন “বিয়ের নেমন্তন্ন হয়েছে তার জন্য হাতি কেন? গরুর গাড়িতে আসতে ‘রোলো’।” সেই কথা শুনে লজ্জায়, রাগে, ক্ষোভে জয়রাম একেবারে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্যই জয়রাম হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে আদরিণীকে কিনে ফেলেছিলেন দু-হাজার টাকা দিয়ে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সদ্য কেনা হাতি আদরিণীকে দেখানো এবং অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া।

লেখক গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদেই আদরিণীকে কেনার প্রেক্ষাপট এবং জয়রাম মোক্তারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। জয়রামের আর্থিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়েছে। আর্থিক অনটনের জন্য তাঁর হিতাকাঙ্খীরা তার আদরিণীকে বিক্রি করে দেবার জন্য জয়রামকে বলেছিলেন। এ প্রস্তাবে জয়রাম রাজি হননি।

দীর্ঘ পাঁচবছরের আদরিণীর সঙ্গে জয়রামের সম্পর্ক শুধু পশু এবং প্রতিপালকের সম্পর্ক নয়, একটি আন্তরিক সম্পর্কও প্রবাহিত হয়েছে ফল্গুধারার মতো। শেষ পর্যন্ত এই প্রবাহ এক গভীর পারিবারিক বন্ধনে গিয়ে পৌঁছেছে।

আদরিণীকে বামুনহাটের মেলায় এবং রসুলগঞ্জের মেলায় পাঠাবার ঘটনার ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন লেখক। যখন আর্থিক অভাবে পড়ে বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধে আদরিণীকে বামুনহাটের মেলায় পাঠাতে মনস্থ করেন। আদরিণীকে মেলাতে পাঠাবার আগে জয়রাম নিজের হাতে রসগোল্লা খাইয়েছিলেন। সবশেষে তিনি ভাঙা গলায় আদর করতে করতে বলেছিলেন— “আদর, যাও মা, বামুনহাটের মেলা দেখে এস।” এরপর মাত্র দুটি লাইনেই জয়রামের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়—“প্রাণে ধরিয়া বিদায় বাণী উচ্চারণ করিতে পারিলেন না। উদ্বেল দুঃখে এই ছলনাটুকুর আশ্রয় লইলেন।”

আদরিণীকে রসুলগঞ্জের মেলায় পাঠাবার সময় জয়রাম এই ছলনাটুকুরও পুর্নবার আশ্রয় নেননি। তিনি আদরিণীর সামনেও যাননি। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেনম—“জানতে পেরেছে এ বাড়ীতে যে আর ফিরে আসবে না, জানতে পেরেছে।”

আদরিণীর মৃত্যুতে বোঝা যায় যে জয়রাম ও আদরিণীর মানসিক সম্পর্ক কতখানি ছিল। আদরিণীর মৃত্যুতে জয়রামের শোকে কাতর হয়ে পড়া আর অস্বাভাবিক লাগে না। গল্পটি সার্থক হয়ে ওঠে এখানে। আদরিণীর মৃত্যুর ঠিক দুমাস পরেই জয়রামের মৃত্যু হয়।

ব্যাকরণ

সমাস :-

জরামৃত্যু — জরা ও মৃত্যু (দ্বন্দ্ব সমাস)।

পাপপুণ্য — পাপ ও পুণ্য (দ্বন্দ্ব সমাস)।

সদস্য — দলের সভ্য যে (উপপদ তৎপুরুষ)।

জ্ঞানতরু — জ্ঞানের যে তরু (কর্মধারয়)।

বিষতরু — বিষের যে তরু (কর্মধারয়)।

জ্ঞানালোক — জ্ঞানের যে আলোক (কর্মধারয়)।

জন্মান্ধ — জন্ম থেকে অন্ধ যে (উপপদ তৎপুরুষ)।

শতাব্দী — একশত বর্ষব্যাপী যে কাল (কর্মধারয়)।

বিপরীত শব্দ :-

জরা — যৌবন।

মৃত্যু — জন্ম।

তুষ্ট — অসন্তুষ্ট।

জ্ঞান — অজ্ঞান।

পুরোহিত — যজমান।

অলীক — বাস্তব।

নিৰ্ভীকতা — ভয়যুক্ত।

অন্ধ — দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন।

সুন্দর — কুৎসিত।

অতীত — বর্তমান।

অশুদ্ধি সংশোধন :-

উজ্জল — উজ্জ্বল।

সৌন্দৰ্য্য — সৌন্দর্য।

তোষন — তোষণ।

অপরাহ্ন — অপরাহ্ণ।

সদ্যজাত — সদ্যোজাত।

নিচের শব্দগুলো প্রসারিত করে লেখো।

অননুভূতপূর্ব — অনুভূত হওয়ার পূর্বে।

সদ্যোজাত — সবে জন্মগ্রহণ করেছে যে।

অধীত — অধ্যয়ন করা হয়েছে এমন।

জন্মান্ধ — জন্ম থেকে অন্ধ।

অদূরদর্শিতা — দূর বা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে কাজ করা।

কুলীন — কুলে (বংশে) জন্মায় যে।

হীনম্মন্যতা — হীন চিন্তাভাবনা যার মনে কাজ করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top