Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী

Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী and select needs one.

Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী

Join Telegram channel

Also, you can read SCERT book online in these sections Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী Solutions by Expert Teachers as per SCERT (CBSE) Book guidelines. Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী These solutions are part of SCERT All Subject Solutions. Here we have given Class 10 Bengali Chapter 9 আদরণী for All Subject, You can practice these here…

আদরণী

               Chapter – 9

অনুশীলনীর প্ৰশ্নোত্তরঃ

( ক ) অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন ১। নগেন বাবুর পেশা কী?

উত্তরঃ নগেন বাবুর পেশা ছিল ডাক্তারী করা।

প্রশ্ন ২। জয়রামের পেশা কী?

উত্তরঃ জয়রাম পেশায় মোক্তার ছিলেন।

প্রশ্ন ৩। কুঞ্জবিহারীবাবু পেশায় ছিলেন ……………। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)

উত্তরঃ কুঞ্জবিহারীবাবু পেশায় ছিলেন জুনিয়ার উকিল।

প্রশ্ন ৪। মেজবাৰু কে?

উত্তরঃ মেজবাবু হলেন পীরগঞ্জের বাবু।

প্রশ্ন ৫। জয়রামের বয়স কত?

উত্তরঃ জয়রামের বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে।

প্রশ্ন ৬। জয়রাম কার কাছে হাতি চেয়ে পাঠালেন?

উত্তরঃ মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছে জয়রাম হাতি চেয়ে পাঠালেন।

প্রশ্ন ৭। জয়রামের আদি নিবাস কোথায় ছিল?

উত্তরঃ জয়রামের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলায়।

প্রশ্ন ৮। জয়রামের গাভীটির নাম কী ছিল?

উত্তরঃ জয়রামের গাভীটির নাম ছিল মঙ্গলা গাই।

প্রশ্ন ৯। কার নামে জয়রাম তাঁর গরুর বাছুরের নাম রেখেছিলেন?

উত্তরঃ ডেপুটিবাবুর নামে জয়রাম তাঁর গরুর বাছুরের নাম রেখেছিলেন।

প্রশ্ন ১০। উমাচরণ লাহিড়ীর বাসস্থান কোথায়?

উত্তরঃ উমাচরণ লাহিড়ীর বাসস্থান বারপুরে।

প্রশ্ন ১১। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা কোথায় হয়?

উত্তরঃ চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হয় বামুনহাটে।

প্রশ্ন ১২। আদরিণী কে?

উত্তরঃ বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে কিনে আনা হাতিটির নাম আদরিণী।

প্রশ্ন ১৩। ‘হাতি তোর ………….পায়ে………….’। (শূন্যস্থান পূর্ণ করো)।

উত্তরঃ ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’।

প্রশ্ন ১৪। ‘হাতি তোর গোদা পায়ে নাতি’…………….এখানে ‘নাতি’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তরঃ এখানে “নাতি” শব্দের অর্থ লাথি।

প্রশ্ন ১৫। জয়রামের কয় ছেলে?

উত্তরঃ জয়রামের তিন ছেলে।

প্রশ্ন ১৬। আদরিণী গল্পে উল্লিখিত মেলা দুটির নাম লেখো।

উত্তরঃ মেলা দুটি হলো— চৈত্রসংক্রান্তিতে বামুনহাটের মেলা, রসুলগঞ্জের সপ্তাহব্যাপী মেলা।

সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও

প্রশ্ন ১। জয়রাম মুখোপাধ্যায় কে? তাঁর স্বভাবের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায় হলেন একজন মোক্তার। তাঁর আদিনিবাস হল যশোর জেলায়। জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেলামেশা করলেই বোঝা যায় যে, তাঁর হৃদয়টি স্নেহে, বন্ধুবাৎসল্যে কুসুমের মতো কোমল। তবে তাঁর মেজাজ ছিল কিছুটা রুক্ষ। যৌবনকালে তিনি রীতিমত বদরাগী ছিলেন। এখন রক্ত অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। সেই সময় হাকিমেরা একটু অবিচার অত্যাচার করলেই মুখার্জি মহাশয় রেগে অনর্থপাত করে তুলতেন।

প্রশ্ন ২। জয়রাম হাতি চেয়ে পাঠালেন কেন?

উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায় পীরগঞ্জের মেজবাবুর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু পীরগঞ্জে যাওয়ার রাস্তা খুব খারাপ ও ঘোড়ার গাড়ির পথ না থাকায় গোরুর গাড়ি করে যেতে হলে যেতে আসতে চারদিন লাগবে। পাল্কি করে যেতে চাইলেও তা যোগাড় করা মুশকিল। সেজন্য নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে জয়রাম রাজবাড়ীতে হাতি চেয়ে পাঠালেন।

প্রশ্ন ৩। জয়রামের প্রথমদিকের জীবনযাপন কেমন ছিল?

উত্তরঃ জয়রামের আদিনিবাস যশোর জেলায়। এখানে যখন প্রথম মোক্তারী করতে আসেন, তখন এদিকে রেল ছিল না। পদ্মা পার হয়ে কিছুটা নৌকাপথে, কিছুটা গোরুর গাড়িতে, কিছুটা পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল। তার সঙ্গে কেবলমাত্র একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটি। সহায় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। মাসিক তেরো সিকিতে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে নিজের হাতে রেঁধে খেয়ে মোক্তারী ব্যবসা শুরু করে দেন।

প্রশ্ন ৪। কার নামে এবং কেন জয়রাম তাঁর বাছুরের নাম রেখেছেন?

উত্তরঃ জয়রাম মুখোপাধ্যায় যৌবনকালে ছিলেন কিছুটা বদরাগী। হাকিমেরা একটু অবিচার অত্যাচার করলেই মুখার্জি মহাশয় রেগে চেঁচিয়ে অনর্থপাত করতেন। একদিন এজলাসে এক ডেপুটির সঙ্গে জয়রামের বচসা বেঁধে যায়। বিকালে বাড়ি এসে দেখেন তাঁর মঙ্গলা গাই একটি এঁড়ে বাছুর প্রসব করেছে, তখন আদর করে সেই ডেপুটিবাবুর নামে বাছুরটির নামকরণ করেন।

প্রশ্ন ৫। কী কারণে আদালতে জয়রাম মোক্তারের জরিমানা হয়েছিল?

উত্তরঃ একবার এক ডেপুটির সামনে জয়রাম মুখোপাধ্যায় আইনের তর্ক করলেও হাকিম কিছুতেই তার কথায় সায় দিচ্ছিলেন না। অবশেষে রাগের মাথায় জয়রাম বলে বসেন— “আমার স্ত্রীর যতটুকু আইন-জ্ঞান আছে হুজুরের তাও নাই দেখছি।” সেদিন আদালত অবমাননার কারণে মোক্তার মহাশয়ের পাঁচ টাকা জরিমানা হয়। তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়েছিলেন।

প্রশ্ন ৬। পত্রবাহক ভৃত্য হাতি সম্পর্কে কী খবর এনেছিল?

উত্তরঃ পত্রবাহক ভৃত্য এসে খবর দেয় যে হাতি পাওয়া গেল না। ভৃত্য জানায় সে চিঠি দেওয়ানকে দিয়েছিল। দেওয়ান চিঠি নিয়ে মহারাজের কাছে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে এসে খবর জানায় যে বিয়ের নিমন্ত্রণের জন্য হাতির দরকার নেই। গোরুর গাড়িতে আসুক।

প্রশ্ন ৭। তাই ত! সব মাটি— কে কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন?

উত্তরঃ নগেন্দ্রবাবুর এই উক্তিটি করেছেন।

পীরগঞ্জে মেজবাবুর মেয়ের বিয়েতে যাবার জন্য জয়রামবাবু, মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছে হাতি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রতি রবিবার দুপুরবেলায় পাড়ার যুবক-বৃদ্ধেরা জয়রাম মোক্তারের বৈঠকখানায় তাস পাশা খেলতেন। সেখানে মোক্তার মহাশয়ও থাকতেন। এমন সময় পত্রবাহক ভৃত্য এসে জানায়— মহারাজ হাতি দিতে রাজি হননি। সেইসময় নগেন্দ্রবাবু উক্তিটি করেছিল।

প্রশ্ন ৮। “পরের জিনিস, জোর তো নেই।”—উক্তিটি কার? কোন প্রসঙ্গে তিনি এই উক্তি করেছেন?

উত্তরঃ জয়রাম মোক্তারের বৈঠকখানায় মিলিত হওয়া জনৈক ভদ্রলোকের উক্তি।

জয়রামবাবু বিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছে হাতি চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। ভৃত্য এসে জানায় তাঁকে গোরুর গাড়িতে করে যেতে বলা হয়েছে। খবর শোনামাত্র জয়রাম ক্ষোভে, লজ্জায়, রোষে একেবারে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে উঠেন। তাঁর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরে পড়তে থাকে। মুখের শিরা উপশিরা ফুলে উঠতে থাকে। সেইসময় তাঁর বৈঠকখানায় সমবেত ভদ্রলোকদের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি উক্তিটি করেছিলেন।

প্রশ্ন ৯। জয়রাম কোথা থেকে হাতি ক্রয় করলেন এবং কেন?

উত্তরঃ মহারাজ নরেশচন্দ্রের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়রামের হাতি কেনার জন্য জেদ চেপে যায়। শহর থেকে দুই তিন ক্রোশের মধ্যে যে যে জমিদারের হাতি ছিল তাঁদের কাছে লোক পাঠান। রাত্রি দুই প্রহরের সময় খবর আসে যে—বীরপুরের উমাচরণ লাহিড়ীর একটি বাচ্চা হাতি আছে। বিক্রি করবে— তবে প্রচুর দাম। জয়রামবাবু জেদবশত দুহাজার টাকা দিয়েই সেই হাতিটি ক্রয় করলেন।

প্রশ্ন ১০। জয়রামের বর্তমান নিবাস কোথায়?

উত্তরঃ জয়রামের বর্তমান নিবাস কলকাতায়।

প্রশ্ন ১১। “আপনি জ্ঞানী লোক, মায়া পরিত্যাগ করুন।”—উক্তিটি কার? কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে?

উত্তরঃ উক্তিটি জয়রামবাবুর বন্ধুদের।

জয়রামবাবুর অবস্থা আগের মতো স্বচ্ছল ছিল না। বিষয় সম্পত্তির পরিমাণ ক্রমশ কমে যাচ্ছিল, বড় নাতনি কল্যাণীর বিয়ে স্থির হয়েছিল, বিয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল আড়াই হাজার টাকা। কিন্তু আড়াই হাজার টাকা জোগাড় করা খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছিল, দুশ্চিন্তায় জয়রামের শরীর ভেঙে পড়েছিল। এর মধ্যে খবর আসে ছোট ছেলে বি. এ. পরীক্ষায় ফেল করেছে। সেই সময় জয়রামবাবুর বন্ধুরা হাতিটিকে বিক্রি করে দেবার পরামর্শ দিয়েছিল।

প্রশ্ন ১২। আদরিণী কে? আদরিণীকে নিয়ে জয়রাম কীরূপ সমস্যায় পড়েছিলেন?

উত্তরঃ আদরিণী হল জয়রাম মোক্তারের পালিত মেয়ে হাতি।

জয়রাম আদরিণীকে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্রি করার পরামর্শ অনেকে দেন। কিন্তু কন্যাসমা আদরিণীকে বিক্রি করার ইচ্ছা জয়রামের ছিল না। বিক্রির কথায় তিনি মাটির দিকে তাকিয়ে ম্লান মুখে বসে শুধুমাত্র চিন্তা করেন, মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন।

প্রশ্ন ১৩। কল্যাণী কে? কত তারিখে বিয়ে ঠিক হয়েছিল?

উত্তরঃ জয়রাম মোক্তারের বড়ছেলের বড়মেয়ে হল কল্যাণী। ১০ই জ্যৈষ্ঠ কল্যাণীর বিয়ের দিন স্থির হয়েছে।

দীর্ঘ উত্তর দাও

প্রশ্ন ১। জয়রামের চরিত্র বর্ণনা করো।

উত্তরঃ ‘আদরিণী’ গল্পে মোক্তার জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রের যে চিত্রায়ণ করা হয়েছে, তা থেকে তাঁর চরিত্রের বৈচিত্র্যময়তার দিকটি প্রস্ফুটিত হয়। তাঁর চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলে একদিকে পৌরুষ, অপরদিকে স্নেহময়তা, বাৎসল্যরসের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের একটি উচ্চাঙ্গ চরিত্র নির্মাণ করে লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যে প্রতিভার নিদর্শন রেখেছেন, সেকথা বলা বাতুলতা মাত্র। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ বিষয়ে সহমত।

‘আদরিণী’ গল্পে আদরিণীর নামে গল্পের নামকরণ হলেও এই গল্পের প্রধান চরিত্রটি হলেন জয়রাম মুখোপাধ্যায়। কেননা তাঁর জেদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোবাসা, অভিমান ইত্যাদি দ্বারাই সমগ্র গল্পটি পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। সেজন্য এই গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে চরিত্র নির্ভরতা। ছোটোগল্প সাধারণত যে দুটি রীতি অনুযায়ী লেখা হয়ে থাকে, তার মধ্যে এই গল্পটি চরিত্র-প্রধান রীতি অনুযায়ীই লেখা হয়েছে। কেননা জয়রামবাবুর হৃদয়লোকের নানা ধরনের ঘাতপ্রতিঘাতই গল্পের ওঠা-পড়া পরিণতি— সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। তাই, রীতি অনুযায়ী বিচার করলে গল্পটিকে চরিত্র-প্রধান গল্পই বলা যেতে পারে।

‘আদরিণী’ গল্পটি লিখিত হয়েছে মোট সাতটি পরিচ্ছেদে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের ঘটনাই জয়রামবাবুর চরিত্রের নানা বর্ণময় দিক ফুটিয়ে তুলেছে। পরিচ্ছেদগুলির ঘটনা ও তার পারম্পর্য জয়রামবাবুর চরিত্রের হৃদয়বৃত্তির নানা পরিচয় পাঠককুলের কাছে তুলে ধরেছে। শুরুতেই লেখক জয়রামবাবুর শরীরের একটি নিপুণ বর্ণনা দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে জীবনের শুরুতে যে কষ্ট তিনি করেছিলেন, তার বর্ণনাও দিয়েছেন— “পদ্মা পার হয়ে গরুর গাড়িতে পায়ে হেঁটে তিনি এসেছিলেন। সেদিন খুব সামান্যই সম্পত্তি ছিল—একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ এবং একটি পিতলের ঘটি।” আমরা শুরুতেই জানতে পেরেছি যে জয়রামবাবু বাইরে কঠোর ও কঠিন প্রকৃতির একজন মানুষ। তাঁর এই কঠোরতা ও কাঠিন্যের কারণ বোঝাতেই লেখক এই বর্ণনার অবতারণা করেছেন। তিনি যে পরিমাণ কষ্ট, সহিষ্ণুতা, পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে জীবনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাতে পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে লড়তে লড়তে চরিত্রগত ভাবে যে-কোনো মানুষের পক্ষেই কঠোর ও কঠিন হওয়াটা স্বাভাবিক। যে লোকটি সামান্য একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ ও একটি পিতলের ঘটিকে পাথেয় করে জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল, বাড়ি, পুকুর, কোম্পানির কাগজ এবং মোক্তার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি সেই জীবনসংগ্রামে সফল হয়েছিলেন। বিনিময়ে তাঁর বাইরের কোমলতাটুকু হারিয়ে গিয়েছিল। কাঠিন্যই তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রবল আত্মসম্মান বোধ এবং সেই আত্মসম্মানকে জীবনের সর্বস্ব দিয়ে রক্ষার পণ ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর জীবনের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল যে আত্মসম্মানকে তিনি বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিলেন, দুনিয়ার সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে গিয়েও তাকে রক্ষা করা। অকুতোভয় ও বদরাগ ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম। কাউকে ভয় না পাওয়ার জন্য এবং নিজের বদরাগ ও জেদ বজায় রাখতে তিনি নিজের লোকসান করতেও পেছপা হতেন না। যেমন— কোনো একজন ডেপুটিবাবুর সাথে আদালতে বচসা হওয়ার জন্যে তিনি নিজের এঁড়ে বাছুরটির নাম রেখেছিলেন ডেপুটিবাবুর নামে। এর জন্য শাস্তির কোনো ভয় তিনি পাননি। আরো একবার আদালতে হাকিম আইনের তর্কে তাঁর পক্ষে সায় না দেওয়ায় বলেছিলেন— “আমার স্ত্রীর যতটুকু আইন-জ্ঞান আছে, হুজুরের তাও নেই দেখছি।” অর্থাৎ সত্য কথা বলতে তিনি পিছপা হতেন না— তাতে যদি তিনি আদালত অবমাননার দায়ে পড়েন, তাতেও তাঁর ছিল না কোনো আপশোষ। এই কাজের জন্য তিনি সত্য সত্যই আদালত অবমাননার দায়ে পড়েছিলেন এবং তাঁর পাঁচ টাকা জরিমানা হয়েছিল। কিন্তু নিজের বিচারে যেহেতু তিনি সঠিক ছিলেন, সেজন্য এই জরিমানা রদ করতে তিনি হাইকোর্ট অবধি গিয়েছিলেন এবং মোট সতেরোশো টাকা খরচের বিনিময়ে এই জরিমানা রদ করেছিলেন। 

‘পাটিগণিতে ঠাসা মগজ’ আছে এধরনের যে-কোনো লোকই বলবে— পাঁচ টাকা জরিমানা রদ করতে গিয়ে সতেরোশো টাকা খরচ করা নিতান্তই মূর্খামির কাজ। কিন্তু আত্মসম্মান রক্ষার যে কোনো দাম হয় না— একথা জয়রামবাবুর মতো ব্যক্তিরাই একমাত্র মানতে পারবেন। সেজন্য সতেরোশো টাকার বিনিময়ে তিনি যে নিজের জেদ, অভিমান, অহংকার ও আত্মসম্মান রক্ষা করেছিলেন, সেকথা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু এই ধরনের ঘটনা তাঁর চরিত্রের একদিকের চিত্রের ওপরই আলোকপাত করেছিল বলা গেলেও জেদ, বদরাগই তাঁর চরিত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্য ছিল না। কোমল হৃদয়বৃত্তি, পরোপকার মনোভাবও তাঁর চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল। যেমন তিনি দু’হাতে অর্থ-উপার্জন করেছেন, তেমনি অকাতরে দরিদ্র, আর্ত মানুষের সাহাযার্থে তা ব্যয় করেছেন। তিনি অকাতরে অন্নদান করতেন। বিনা পয়সায় বহু উৎপীড়িত মানুষের মোকদ্দমা তিনি চালিয়েছেন। এমনকি প্রয়োজনে নিজের উপার্জন করা টাকা খরচ করেও বহু অসহায় লোকের মামলা চালিয়েছিলেন। এর থেকেই তাঁর চরিত্রের পরোপকারী দিকটি পাঠকদের সামনে ফুটে ওঠে। কোমল ও কঠিনের এই সংমিশ্রণ বড়ো একটি চোখে পড়ে না। কারণ যে অর্থ উপার্জন করার জন্য, যে প্রতিষ্ঠা পেতে তিনি জীবনে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করেছিলেন— যে কারণে তাঁর চরিত্রে এই কাঠিন্য, সেই উপার্জিত অর্থকে পরোপকারের উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে তিনি কখনও দ্বিধাবোধ করেননি। তাঁর কষ্ট, তাঁর কাঠিন্য তাঁকে ক্ষুদ্রমনস্ক করে তুলতে পারেনি। বরং তাঁর চরিত্রকে মহান করে তুলেছে ; একটি অনন্যমাত্রা দান করেছে। সাধারণের মধ্যে থেকেও তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছে।

তবে তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান বোধের প্রখরতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যায় পীরগঞ্জের জমিদার বাড়িতে নিয়ন্ত্রণে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। জয়রামবাবু ছিলেন পীরগঞ্জের জমিদারদের চারপুরুষের মোক্তার। সেই সূত্রে এই জমিদার পরিবারের সঙ্গে তাঁর বহুদিনের হৃদ্যতা। তাই যখন ওই জমিদার পরিবারের পক্ষ থেকে বাড়ির মেজছেলের বিবাহে যাওয়ার নিমন্ত্রণ এল, তখন বন্ধুদের অনুরোধে অবলীলায় তিনি জমিদারবাবুকে একটি হাতি পাঠানোর আর্জি জানিয়ে পত্র পাঠান। এর আগেও নিঃসঙ্কোচে তিনি এই ধরনের আর্জি জানিয়ে হাতি পেয়েছিলেন। সেজন্য এবারও তাঁর চিন্তা করার কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু এবার ঘটে অঘটন। বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়—যা তিনি কখনও আশা করেননি। পত্রের উত্তরে জমিদারবাবু হাতি না পাঠিয়ে খালি হাতেই পত্রবাহককে ফেরৎ পাঠান। এর উপর বলে বসলেন, নিমন্ত্রণ বাড়িতে আসতে হাতির প্রয়োজন নেই। তিনি পত্রবাহককে আরো বলেন যে, জয়রামবাবু যেন গোরুর গাড়িতেই আসেন। এই ঘটনাটি জয়রামবাবুর আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত হানে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে যদি তিনি নিমন্ত্রণ বাড়িতেই যান, তবে হাতিতে চড়েই যাবেন, নতুবা যাবেন না। ফলে নিজের প্রতিজ্ঞা বজায় রাখতে হাতি কেনায় উঠে পড়ে লাগেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে দুহাজার টাকার বিনিময়ে তিনি একটি মাদি হাতি কেনেন এবং সেই হাতির পিঠে চড়েই তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। জমিদারবাবু হাতির মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করলে শ্লেষাত্মক উত্তর দিয়ে বলেন যে, যেহেতু তিনি রায়বাহাদুরের দ্বারা পালিত, সেহেতু হাতিটি জয়রামবাবু কিনলেও তার মালিকানা স্বত্ব আসলে জমিদারের। এইরূপে নিজের আত্মসম্মান ও আত্ম-অহংকার রক্ষা করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এই ঘটনাটি তাঁর আপোষহীন— ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি জয়রামবাবুর চরিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলেও তার অপর বৈশিষ্ট্যগুলির ভিতর আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর অপত্যস্নেহ, বাৎসল্যরস, বেদনাময়তা এবং মমত্ববোধের। জয়রামবাবুর চরিত্রে দুটি বৈশিষ্ট্যের সমান্তরাল প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। বন্ধু-বাৎসল্যের যে কাহিনি দিয়ে গল্পের সূত্রপাত, তার সমাপ্তি কন্যা-বাৎসল্যে। গরীব সাধারণ মানুষের প্রতি যে মমত্ববোধ তিনি অনুভব করতেন, তা ছড়িয়ে পড়েছিল মূক প্রাণীটির প্রতিও। মনুষ্যেতর প্রাণী হলেও তিনি হাতিটিকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে তার নাম রেখেছিলেন আদরিণী।

কিন্তু জীবনের দায় বড়ো দায়। মানুষের জীবনে যখন দুঃসময় আসে, তখন ভালোবাসাকেই আগে বলি দিতে হয়। জয়রামবাবুর জীবনের ক্ষেত্রে এই নিয়মের পরিবর্তন ঘটেনি। পারিবারিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক চাপ ও অর্থনৈতিক সঙ্কট বৃদ্ধকে শেষ পর্যন্ত আদরিণীকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। আগে অবশ্য তিনি আদরিণীকে ভাড়া দিয়ে সংসার ও আদরিণী দুজনকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু যেখানে ভাগ্য বিপরীত, সেখানে অসহায় মানুষ কী করবে? অগত্যা ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় তাঁকে। গল্পের শুরুতে জয়রামবাবুর যে দৃঢ় ও দাম্ভিক চরিত্রের পরিচয় মিলেছিল—সময়ের আঘাতে তা পরিণত হয়েছিল অসহায়তায়। এই মূক প্রাণীকে তিনি অপত্যস্নেহে আপন করে নিয়েছিলেন। বন্ধুরা বিক্রির কথা বলতেই তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন— “তার চেয়ে বল না তোমার এই ছেলে-পিলে নাতিপুতিদের খাওয়াতে অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে—ওদের একে একে বিক্রি করে ফেল।” তাঁর এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, বাইরের কঠিন আবরণের ভিতরেই ছিল নরম, স্নেহপ্রবণ একটি মন— যা মনুষ্যেতর প্রাণীকেও সন্তানস্নেহে আপন করে নেয়। অথচ বুকের পাঁজর ভেঙে পরিবার ও পরিস্থিতির চাপে পড়ে সেই ভালোবাসার আদরিণীকেই বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ যে কত কঠিন কাজ তা তাঁর পরবর্তী আচরণগুলি থেকেই উপলব্ধি করা যায়। কঠিন পরিবেশ, সামাজিক চাপ কোনো কিছুতেই দমে না যাওয়া, হেরে না-যাওয়া জয়রামবাবু শেষপর্যন্ত সময়ের কাছে নতিস্বীকার করেন।

আদরিণীর নীরব প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। সেজন্য ঘটনায় যদিও লক্ষ্য করা যায়, আদরিণীকে রসগোল্লা খাইয়ে, বামুনহাটের মেলা দেখে আসতে বলে এই মূক প্রাণীটির সাথে ছলনা করছেন তিনি—প্রকৃতপক্ষে সে ছলনা তিনি করেছেন নিজেকে। তিনি হৃৎপিণ্ডের শিরা ছেঁড়া কষ্টকে চেপে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। বামুনহাটের মেলায় আদরিণী বিক্রি না হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে যেন তিনি বেঁচেছেন। এখানে কোথায় গেল তাঁর ব্যক্তিত্ব! কোথায় গেল তাঁর বদরাগ, জেদ! এখানে শুধু দেখা যায় অপত্যস্নেহ, সন্তান-প্রতি ভালোবাসা এবং তার থেকে বিচ্ছেদের বেদনা ; যা পাঠক হৃদয়কে বেদনাতুর করে তোলে।

একজন সৎ, ব্যক্তিত্ববান পুরুষের পক্ষে এই ধরনের ছলনা করা বেশিদিন সম্ভব নয়। সেজন্য দ্বিতীয়বার যখন রসুলগঞ্জের মেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদরিণীকে, তখন তিনি থেকেছেন সম্পূর্ণ নিশ্চপ। আদরিণীকে ‘আর ছলনা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। আদরিণী যাওয়ার সময় চোখের জল ফেলেছে জানতে পেরে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কেননা তিনি বুঝেছিলেন আদরিণী তাঁর ছলনা ধরতে পেরেছে। নীরবে, চোখের জলের মধ্য দিয়ে তার অভিমান জানিয়ে প্রাণীটি যে চলে গেছে তা তিনি বুঝেছিলেন। সেজন্য তার মন হাহাকার করে উঠেছিল। তারপর যখন শুনেছিলেন, আদরিণী অসুস্থ— তখনই বুঝতে পেরেছিলেন আদরিণী বিক্রির কথা বুঝতে পেরেছিল। প্রকৃতপক্ষে যখন ভাষা কাজ করে না, তখন মন কথা বলে। সেই অন্তরঙ্গ কথা আদানপ্রদানের জন্যেই জয়রামবাবু আর আদরিণী পরস্পর পরস্পরের মনের কথা বুঝতে পারত। এবারেও পেরেছিল। সেজন্য বাবার কাজের কোনো প্রতিবাদ না করে সে চলে যায়। আর সেই অভিমানের ধাক্কা এসে লাগে জয়রামবাবুর বুকে। আপাতকঠিন আবরণের ভিতরে থাকা নরম মন সে ধাক্কা সামলাতে পারেনি। প্রিয়জনকে হারাবার বেদনায় তাঁর জীবনীশক্তি কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছিল। এবং আদরিণীর অভিমানের বোঝা বুকে নিয়ে তিনি আর মাত্র দু’মাস জীবিত ছিলেন।

কাহিনির এই অংশ থেকে আমরা জয়রামবাবুর স্নেহবৎসল পিতার রূপটি খুঁজে পাই— যা তাঁর চরিত্রে একটি অন্যন্যমাত্রা দান করেছে। তাঁর বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব, বদরাগী মেজাজ, জেদ ইত্যাদিই যদি একতরফা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হত, তবে একজন সাধারণ ব্যক্তি হিসাবেই তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকতেন। কিন্তু শুষ্ক খড়ের ওপরে মৃত্তিকার প্রলেপ লাগিয়ে, সুনিপুণ হাতে যেমন মূর্তি তৈরি করা হয়— তেমনই লেখক তাঁর সুনিপুণ হাতে মৃত্তিকার মতো তাঁর শুষ্ক শরীরে নরম, স্নেহপ্রবণ, বাৎসল্যরস পরিপূর্ণ পরোপকারী মনটি স্থাপন করে চরিত্রটিকে মহৎ করে তুলেছেন। আর এখানেই জয়রামবাবুর চরিত্রটি অনন্যতা লাভ করেছে।

প্রশ্ন ২। জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের জীবন সম্পর্কে যা জান লেখো।

উত্তরঃ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা ‘আদরিণী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আদরিণীর পালনকর্তা জয়রাম মুখোপাধ্যায়। তাঁকে আমরা সহজেই আদরিণীর ‘পালক পিতা’ও আখ্যা দিতে পারি।

মামলার এক সহায়সম্বলহীন যুবক যশোহর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নৌকাযোগে পদ্মা পার হয়ে জেলা শহরে এসে পৌঁছেছিলেন। তার সম্বল ছিল একটি পিতলের ঘটি আর একটি ক্যাম্বিশের ব্যাগ। ওই যুবকের কৃচ্ছসাধনা ও কর্মসাধনা শুরু হয়েছিল নিজের হাতে রান্না করে, আধপেটা খেয়ে, মাসিক তেরো সিকের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। ওই যুবক জেলা আদালতে মোক্তারি শুরু করে। সেই সংগ্রামী কপর্দকহীন যুবক নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে। জেলা আদালতে খ্যাতিমান জবরদস্ত মোক্তার, পাকা দালানবাড়ি, পুকুর, বাগান এবং বেশ কয়েকটি কোম্পানির কাগজের মালিক জয়রাম মুখোপাধ্যায় এখন যথেষ্ট সম্পন্ন। মহারাজের সঙ্গেও তার খাতির। এর কারণ মহারাজ তাঁরও মক্কেল। এ সমস্তই জয়রামের জীবনব্যাপী ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের ফসল।

এই পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটি দীর্ঘদেহী, ঈষৎ চাপা গৌরবর্ণ, তার কাঁচা-পাকা মেশানো মোটা গোঁফ, মাথার সামনে বিস্তৃত টাক, ভাসা ভাসা চোখ এবং অম্লমধুর অন্তর নিয়ে সর্বজনপ্রিয় এবং অজাতশত্রু। তিনি কারণ ছাড়া কাউকে আঘাত করেন না, নিজেও আঘাত পেতে চান না। কোনো নীচ বা ছোটো কাজে তিনি নিজেকে কোনোদিন জড়াননি। আত্মসম্মানী, জেদি এবং পৌরুষগুণসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়। জয়রাম যেমন কুসুমের মতো কোমল তেমনি বজ্রের মতো কঠিন।

এই মানুষটি জীবনযুদ্ধে কৃতী হলেও পারিবারিক বা সাংসারিক জীবনে ভাগ্যতাড়িত। তিনি বিপত্নীক, প্রথম দুটি পুত্র মূর্খ ও নিষ্কর্মা, তাসুড়ে এবং নেশাখোর। বড়ো পুত্রটি ‘ফুলুট’ বাজায়। সব কাজেই অপটু, বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া। কনিষ্ঠ পুত্রটি বিএ পড়লেও পড়াশোনায় তেমনি মেধাবী নয়। এখানেই জয়রামের পরাজয়। তিনি বেশি নজর দিয়েছেন অর্থোপার্জনের দিকে, তার ফলে সংসারের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নজর দেবার সময় পাননি, আর সেজন্য তাঁর পুত্রেরা সব অযোগ্য। জয়রামের দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণা এখানেই। এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে বলে জয়রাম কিছুটা সংবেদনশীল।

এই অভিমানী সংবেদনশীলতা জয়রামের চরিত্রটিকে চিনিয়ে দেয় গল্পের শুরুতেই। পাড়ার নগেন ডাক্তার ও জুনিয়র উকিল কুঞ্জবিহারীবাবু জয়রামের বৈঠকখানায় এসেছিলেন পীরগঞ্জের বাবুদের বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে কীভাবে যাওয়া যায় তার পরামর্শ করতে। কিন্তু জয়রাম নিমন্ত্রণ পেয়েছেন কি না এই প্রশ্নে তিনি ক্ষুব্ধ ও অভিমানী হয়ে ওঠেন। তার কারণ আজ বিশ বছর ধরে পীরগঞ্জের বাবুরা তাঁর মক্কেল। জয়রাম তাঁদের আইনি উপদেষ্টা, আর তিনি নিমন্ত্রণ পাবেন না এটা তাঁরা ভাবল কী করে? তাই তিনি বলেই ফেলেন—“আমাকে বাদ দিয়ে তারা তোমাদেব নিমন্ত্রণ করবে, এইটে কী সম্ভব মনে কর?” এই কথা শুনে তারা ভুল স্বীকার করলে জয়রামের রাগ শান্ত হয়ে গেল।

জয়রাম মোক্তার আইনব্যবসাকে গুলে খেয়েছেন বলে তিনি অসৎ হননি। সেজন্য হাকিমেরা তাদের পদমর্যাদার সুযোগ নিয়ে অন্যায় অবিচার করলেই তিনি চেঁচিয়ে অনর্থ ঘটাতেন, তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতেও দ্বিধা করতেন না। তিনি একবার এইরকম বচসায় এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর বাড়ির মঙ্গলা গাইয়ের এঁড়ে বাছুরের নামে নাম রেখেছিলেন হাকিমের। আর একবার অন্য এক হাকিমের স্বল্প আইনজ্ঞান দেখে তাঁকে কটাক্ষ করেন। ফলে তাঁর জরিমানা হয় পাঁচটাকা। কিন্তু অভিমানী জয়রাম এই পাঁচটাকা জরিমানার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত লড়েন। হাকিমের হুকুম রদ করে ছাড়েন। এর থেকেই অনুমান করা যায় তিনি কেবলমাত্র ন্যায়পরায়ণই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কেবলমাত্র অসম্ভব জেদীও। অত্যাচারিত উৎপীড়িত গরীব মানুষদের মোকদ্দমা তিনি অনেক সময়েই ফিস না নিয়ে নিজের অর্থব্যয়ে চালিয়েছেন, এমনকি তিনি অকাতরে অন্নদানও করতেন।

জয়রামের ক্ষোভ, অভিমান ও অপমানের জবাব হিসাবে মুখোপাধ্যায় পরিবারে আদরিণীর আবির্ভাব। তাঁকে মহারাজা নরেশচন্দ্র হাতি দিতে চাননি তার বদল হিসেবেই তিনি নেহাতই ঝোঁকের বশে আদরিণীকে কিনে ফেলেছিলেন এবং অম্লমধুর প্রতিশোধও নিয়েছিলেন এই ঘটনার। তিনি হাতিতে চেপে মহারাজ নরেশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন পীরগঞ্জ থেকে ফেরার পরের দিনই। হাতি দেখে মহারাজ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন কার হাতি। উত্তরে জয়রাম জানিয়েছেন— “আজ্ঞে হুজুর বাহাদুরেরই হাতি।” মহারাজ আবার বিস্ময়সূচক প্রশ্ন করাতে উত্তরে জয়রাম বলেছেন— “যখন হুজুর বাহাদুরের দ্বারাই প্রতিপালিত হচ্ছি— আমি যখন আপনার তখন হাতি আপনার বৈ আর কার।” মহারাজ এ কথার প্রকৃত অর্থ কী তা বুঝেছেন। মিষ্টি কথায় কী করে অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া যায় তা খুব ভালোভাবে জানতেন জয়রাম মোক্তার।

জয়রাম মুখোপাধ্যায় প্রাচীনপন্থী, মূল্যবোধসম্পন্ন, সংবেদনশীল মানুষ। তাঁর নিজের পুত্রেরা উপযুক্ত নয় এবং তাঁর ছিল না কোনো কন্যাসন্তান। সেজন্য প্রৌঢ় জয়রামের হৃদয়ে কন্যার জায়গাটি দখল করে নেয় আদরিণী। জয়রাম সত্যবাদী। তিনি জজের কাছে অকপটে স্বীকার করেছেন যে তিনি ইংরাজী জানেন না। তিনি দায়রা খুনের মামলায় জিতে জজসাহেবের কাছ থেকে প্রশংসা পাবার পরই কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেন। তাঁর মনে হয়েছিল কর্মক্ষেত্র থেকে মাথা উঁচু করে সরে যাওয়াই উচিৎ। কেননা তিনি মনে মনে বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজী জানা মোক্তারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তিনি পারবেন না। সেক্ষেত্রে আত্মমর্যাদা বজায় রেখে সরে যাওয়াই ভাল। তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন। সেজন্য জজসাহেবের মুখে প্রশংসা শুনে সার্থকতার আনন্দে বিহ্বল হয়ে তাঁর চোখ জলে ভরে যায়।

কিন্তু জয়রামের অবসর জীবন সুখের হয়নি। আয় নেই, সংসার চালানোর জন্য জমানো অর্থও ক্রমশ কমছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আদরিণীর খোরাক মেটাবার জন্য যে খরচ তা তাঁর বন্ধুদের কাছে বাহুল্য মনে হলেও জয়রামের তা মনে হয়নি। তিনি আদরিণীকে ছেলেপুলে নাতিনাতনিদের সঙ্গে একাসনে বসিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত তিনি হাতি ভাড়ার বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। কিন্তু এইসমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর দ্বিধা ফুটে উঠেছে প্রতি পদে। তাঁর আড়াই হাজার টাকা অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বড়ো নাতনি কল্যাণীর বিবাহের জন্য। তখন বাধ্য হয়ে জয়রাম আদরিণীকে বিক্রির জন্য পাঠিয়েছিলেন মেলায়। কিন্তু মেলায় পাঠিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে— আদরিণী যদি ভালো মালিকের হাতে না পড়ে এই ভয়ে লোকজনদের বলেছেন— “একজন ভালো খদ্দের ঠিক কর তাতে দাম যদি দুপাঁচশো টাকা কমও হয়, সেও স্বীকার।” এই ঘটনায় এক স্নেহার্দ্র পিতার অন্তরের প্রকাশ পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় যেভাবে পিতা কন্যাকে আশীর্বাদ করে, সেইভাবেই তিনি আদরিণীকেও বামুনহাটের মেলায় যাবার সময় মিষ্টিমুখ করিয়েছেন, গায়ে হাত বুলিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু কন্যাকে বিদায়দানের সময় স্নেহশীল পিতা যেভাবে বিদায়বাণী উচ্চারণ করতে পারেন না, জয়রামও পারেননি তাকে বিদায় জানাতে। আদরিণী চলে যাবার পর তাঁর শোকে বিহ্বল হয়ে ভেঙে পড়ার দৃশ্যটিও কন্যাকে বিদায়ের সময় পিতার শোকের সঙ্গে তুলনা করা চলে।

দ্বিতীয়বার মেলায় নিয়ে যাবার পথে আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়াতে তিনি উদ্বেগে অস্থির হয়ে পড়েন। পায়চারি করতে থাকেন পাগলের মতো। আদরিণী অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাঁর মনে হয়েছে তাঁর প্রতি অভিমানেই আদরিণীর এই অসুস্থতা। পিতৃহৃদয়ের শোকবিজড়িত মূর্তি হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এই আক্ষেপ। সেজন্য আদরিণীর মৃত্যুতে তিনি যেভাবে ভেঙে পড়েছেন তা কোনো সন্তানের মৃত্যুতে শোকাহত পিতার ভেঙে পড়ারই শামিল। জয়রাম এই আঘাত সামলাতে পারেননি, তিনিও দুমাস পরেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

মুক পশুর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনে জয়রাম এক উজ্জ্বল চরিত্র। মূল্যবোধসম্পন্ন নিষ্ঠাবান সৎ, সংবেদনশীল চরিত্রসম্পন্ন মানুষ জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্যে এখন দুর্লভ।

প্রশ্ন ৩। “হাতি দিলে না। হাতি দিলে না!” —উক্তিটি কার? প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করো।

উত্তরঃ উক্তিটি মোক্তার জয়রাম মুখোপাধ্যায়ের।

জয়রাম মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেকালের একজন নামকরা মোক্তার। আদালতে ছিল তাঁর যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি। জয়রামবাবুর বৈঠকখানায় একদিন বিকালে তাঁর দুই বন্ধু পাড়ার নগেন ডাক্তার এবং জুনিয়ার উকিল কুঞ্জবিহারীবাবু পান খেতে খেতে হাতের ছড়ি দোলাতে দোলাতে এসে উপস্থিত হন। তাঁদের কাছ থেকেই জয়রামবাবু জানতে পারেন যে পীরগঞ্জের জমিদার মেজবাবুর মেয়ের নিমন্ত্রণ তাঁরা পেয়েছেন। নগেন ডাক্তার ও কুঞ্জবিহারী জয়রামবাবুকে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি রেগে যান। কেননা তিনি পীরগঞ্জের বাবুদের এষ্টেটের কুড়ি বছরের বাঁধা মোক্তার। নিমন্ত্রিতের তালিকা থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া নিয়ে সমস্যা উপস্থিত হয়, পীরগঞ্জের যাওয়ার রাস্তাটি ছিল মেঠো, সেখানে ঘোড়ার গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই, গোরুর গাড়িতে যাওয়া যায়। কিন্তু তাতে যেতে দুদিন আসতে দুদিন লাগবে। সেজন্য খুব সহজে যাওয়ার জন্য বন্ধুরা জয়রামবাবুকে একটি হাতির বন্দোবস্ত করতে বলেন। জয়রাম খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বন্ধুদের চিন্তামুক্ত থাকতে বলেন। কেননা তিনি হলেন বর্তমান জমিদারের বাপের আমলের মোক্তার। সেজন্য তিনি হাতি চেয়ে রাজবাড়িতে চিঠি পাঠালেন। সন্ধ্যা নাগাদ হাতি এসে পৌঁছে যাবে। এখানেই সমস্যার উৎপত্তি হয়। পরের দিন রবিবারের সকালে পূজা আহ্নিক সেরে জয়রামবাবু বেলা নটার সময় জলযোগ করে বৈঠকখানায় এসে বসেন। মক্কেলদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাতির কথা মনে পড়ে যায়। তখন কাগজ কলম নিয়ে চশমা পরে “প্রবল প্রতাপান্বিত শ্রীল শ্রীমন্মহারাজ শ্রীনরেশচন্দ্র রায় চৌধুরী বাহাদুর আশ্রিতজনপ্রতিপালকেষু” পাঠ লিখে দুতিন দিনের জন্য একটি সুশীল ও সুবোধ হাতি প্রার্থনা করে চিঠি লেখেন। আগেও তিনি অনেকবার জমিদারের কাছ থেকে হাতি আনিয়েছেন বলে এবারও দৃঢ়বিশ্বাস ছিল চিঠি পাওয়া মাত্রই মহারাজ নরেশচন্দ্র হাতি পাঠিয়ে দেবেন। সেজন্য হাতিকে বাঁধবার জন্য বাগানে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করা হল হাতির খাওয়ার জন্য বড় বড় পাতাশুদ্ধ কয়েকটা কলাগাছ ও অন্যান্য গাছের ডাল কেটে আনা হল এবং মোক্তার মহাশয় নিজে সমস্ত কাজে তদারক করেন।

সন্ধ্যার কিছু আগে জয়রাম বৈঠকখানায় বসে পাশা খেলা দেখছেন। এমন সময় ভৃত্য দুঃসংবাদ নিয়ে আসে। ভৃত্য জানাল —মহারাজ নরেশচন্দ্র হাতি পাঠাবেন না, বরং বলেছেন— বিয়ের নিমন্ত্রণের জন্য হাতি পাঠাবার প্রয়োজন নেই। জয়রামবাবুদের মহারাজ গোরুর গাড়িতে আসতে বলেছেন। ভৃত্যের আনা এই সংবাদ জয়রামবাবুর আত্মসম্মানে আঘাত করে। তিনি ক্ষোভে, লজ্জায়, রোষে একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তাঁর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। দুই চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরতে লাগল। মুখের শিরা উপশিরাগুলি ফুলে উঠল, কম্পিত স্বরে ঘাড় বাঁকিয়ে বারবার বলতে লাকেন “হাতি দিলে না! হাতি দিলে না!”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top